হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে পর্ব:১৩

0
855

উপন্যাস: হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে।

কলমে: চন্দ্রা।

পর্ব: ১৩

সারা ঘড়ময় পায়চারী করছে বিরূপাক্ষ। বারবার চোখ চলে যাচ্ছে বিছানাটার দিকে।কোনো কাজেই মন বসছে না তার।শুতেও ক্যমন অসহ্য লাগছে।এমন মনে হচ্ছে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই হয়তো শত শত কাঁটা বিধবে নয়ত শতসহস্র বিষাক্ত বিছা কিলবিল করে ঢুকে যাবে টিশার্ট,প্যান্ট,এমন কি আরো নিচে।আর ঢুকার শেষে নিশ্চই সভ্য শান্ত বালক এর মতো চুপ করে থাকবে না।ভাবনা শেষে আতংকিত হয় বিরূপাক্ষ।ল্যাপটপ, ফোনের উজ্জ্বল কিংবা চোখ সওয়া আলোও বিরক্তিকর লাগলে।বৌদিদি একটু আগে বিছানাটা পেতে দিয়ে গিয়েছে নিজের হাতে অতি যত্নে। তখন ও ঘড়ে ছিলো না।
রাতের খাওয়া দাওয়া পর্ব শেষে এসে ঘড়ের এই নব্য সাজ দেখে অন্যের ঘড় ভেবে ভ্যাবাচেকা খেলো বিরূপাক্ষ।পরক্ষণে ভালো ভাবে অবলোকন করতেই বুঝলো না এটা তার নিজের ই অতি পরিচিত এবং অতিশয় প্রিয় শয়নকক্ষ। কিন্তু পালঙ্কে নতুন বেডসীটের সাথে নতুন বালিশ কভার।যেখানে একটা বালিশ শোভা পেত সেখানে বিরূপাক্ষের দিকে তাকিয়ে ক্রুর হাসছে বারতি বালিশখানা। সবচেয়ে দুঃখ পেলো যখন দেখলো তার অতি আদরের, এবং একান্ত শয়নসঙ্গী পাশবালিশ অর্থাৎ কোলবালিশটা কোথাও উধাও করে রাখা হয়েছে।মনে মনে সমবেদনায় বিগলিত চিত্তে সেই হারিয়ে যাওয়া পাশবালিশ খানির উদ্দেশ্যে উচ্চারণ করলো,,প্রিয় আজ থেকে তোমার আর আমার শান্তিময় নিদ্রাযাপনের কাল সমাপ্ত হলো।
বিরূপাক্ষ এটা নাড়ছে ওটা নাড়ছে কিন্তু মনস্থির নয়।এমনটা তার কোনদিনও হয়নি। তবুও মনের মধ্যে একটা ক্ষীণ আশার আলো দেখতে পাচ্ছে এইভেবে যে,রাত বারোটা বাজলো এখনো যখন আসেনি,আর বোধহয় আসবে না রিতি।তাহলেই বেঁচে যাবে বিরূপাক্ষ।ধরি মাছ না ছুঁই পানি,ব্যাপারটা ঘটবে ভেবে খানিক আত্মপ্রসাদ লাভ করলো সে।রিতি যদি নিজেই তাকে এড়িয়ে যায় তাহলে সে দায় তো বিরূপাক্ষের উপর বর্তাবে না আর বাবা,মায়ের কথারও অমান্য হবে না।
সকালে বাবার বন্ধু স্বপরিবারে এসেছেন। দুপুর হতেই ছোট মামা, ছোট মামী মানে অভিরাজের মা বাবা। সন্ধ্যায় তিতলি ফিরেছে।ওর প্রত্যাগমনই কাল হলো বিরূপাক্ষের।বাড়িতে বলতে গেলে লোকে লোকারণ্য।গ্রামের বৌ-ঝি দের আনাগোনা বেড়েছে অন্দরমহলে।সন্ধ্যায় যখন তিতলিকে নিয়ে বাড়িতে পৌঁছোলো বীরূপাক্ষ, তখন বসার ঘরে সবাই সন্ধ্যার জলযোগে ব্যস্ত।তিতলিকে দেখে রিতি এসে জড়িয়ে ধরে কুশল বিনিময় করলো,বৌদিদিও তাই ।প্রভাকর চৌধুরীর থমথমে দৃষ্টি এড়ালো না বিরূপাক্ষের। নিজের ঘড়ে ঢুকেছে মাত্র, অমনি ডাক পরে বাবা মায়ের শয়নগৃহে। গিয়ে দেখলো বিরূপাক্ষ,বাবা সেই থমথমে মুখে বসে আছেন নিজের আরাম চেয়ারে।মা পাশ ঘেঁষে দাঁড়ানো। বিরূপাক্ষ বুঝলো ব্যাপারটা কঠিন কিন্তু কতটা কঠিন সেটা বুঝলো যখন নিজের অস্বস্তি ঝেড়ে প্রভাকর রায় চৌধুরী বললেন গম্ভীরভাবে,,,

দ্যাখো খোকা,বাড়িতে আমার বন্ধুর পরিবারের সবাই আছে। তোমার মামা মামী আছে,আরো আত্মীয় স্বজন আসবে যাবে। এতদিন যা করেছো মেনে নিয়েছি। কিন্তু আমি চাইনা যে আবার ও তোমার কার্যকলাপের জন্য আমার মান সম্মান নষ্ট হোক।তার ফল ভালো হবে না বলে দিলাম।
রাগে গলা কাঁপছে প্রভাকর চৌধুরীর।
বিরূপাক্ষ আগা মাথা না বুঝে মায়ের দিকে তাকায় জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে।
মুখ খোলেন অন্নপূর্ণা দেবী,,, তাঁর স্বরেও কোমলতার চেয়ে কাঠিন্যের প্রলেপ বেশী পরিলক্ষিত হলো,,
শোন খোকা,তোরা দুইজনে এতদিন আলাদা ঘড়ে থেকেছিস মেনে নিয়েছি।কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছিস না সেটাও ঠিক আছে। কিচ্ছুটি বলিনি।কিন্তু আজ থেকে তা হবে না,,দুজনে একঘড়ে থাকবি এটাই শেষ কথা।তোকে মানতে হবে এ সিদ্ধান্ত আর রিতিকেও মানিয়ে নেবো।না হলে এবার দেখবে তোমার মা, বাবার জেদ। নিজের জেদটা তো এমনি এমনি পাওনি।
বিরূপাক্ষ বুঝলো তার মায়ের কন্ঠে বাবার শেখানো বুলি।আরো একটা জিনিস খুব ভালো করে বুঝতে পারলো যে,দেশে এসে ভালোমতোই বিপাকে পড়েছে সে এই পাক থেকে মুক্তি পেতে হলে মাথা ঠান্ডা রেখে করতে হবে যা করার। তবুও একবার বোঝানোর চেষ্টা করলো বাবা মাকে,,,

মা আমি তো,,,,
চুপ করো বেয়াদব।আর একটা কথাও বলবে না তুমি। সারাদিন লোকজন আত্মীয় স্বজন দেখবে প্রভাকর চৌধুরীর ছেলে আর ছেলের বৌকে।আর রাত হলে দেখবে তারা আলাদা ঘড়ে ঘুমায়?এতে কি পরিমান কানাঘুষো হবে তুমি জানো!গ্রামের মানুষের সম্পর্কে কোন ধারণা আছে তোমার? তোমার জন্য মান, সম্মান অনেক খুইয়েছি আর নয়। উত্তেজনা প্রকাশ পায় বাবার কথায়।

বিরূপাক্ষ উপলব্ধি করলো তার বাবার সেই একরোখা জেদ। প্রচন্ড ক্রোধে, যা খুশি করো বলে বেড়িয়ে আসে ঘড় থেকে ।দরজার পাশে থাকা ফুলদানিটা একধাক্কায় নিচে পরে শত খন্ড হয়েছে ততক্ষনে।
অসহায়ের মতো পেছন পেছন ছুটে আসেন অন্নপূর্ণা দেবী। তিনি এই মুহূর্তে দিশেহারা। কিন্তু মেয়েটাকেও যে ভীষণ ভালোবাসেন।তাই স্বামীর সিদ্ধান্তে মত দিয়েছে। পেছন থেকে বিরূপাক্ষ কে টেনে ধরে,,
যাসনে খোকা।শোন আমার কথা।
বিরূপাক্ষ থমকে দাঁড়ায় । মায়ের চোখের জল দেখে ঠিক থাকা সম্ভব নয় তারপক্ষে।
মা,, তুমি এখন যাও।একটু একা থাকতে দাও আমাকে। হাতজোড় করে কোমল কন্ঠে বলে মাকে।
বাবা, মেয়েটা কোন দিক দিয়ে তোর অযোগ্য বল?ক্যানো এমন অবুঝের মতো করছিস?অমন মেয়ে হাজার ক্যানো লাখেও একটা মিলবে না বাবা,,

মা,,প্লিজ লাগবেনা তোমার অমন মেয়ে। নিরুপায় আমি।আমি পারবো না ওকে মানতে,,
আরো কিছু বলতো বিরূপাক্ষ কিন্তু তার কন্ঠরোধ হয়ে যায় আপনা আপনি। অনতিদূরে ওদের দিকে তাকিয়েই দাঁড়িয়ে আছে রিতি।তার চোখের দৃষ্টিতে কি গভীর বেদনার ছাপ দেখলো বিরূপাক্ষ?নাকি অন্যকিছু?
অন্নপূর্ণা দেবী নির্বাক দাঁড়িয়ে দেখেতে থাকেন ছেলের চলে যাওয়া। ছেলেটা তার এতটা অবাধ্য হবে ভাবতেও পারেননি কখনো।

বিরূপাক্ষ নিজের ঘড় থেকে বেরিয়ে একবার উঁকি দিয়ে এসেছে রিতির ঘড়ে সেখানে আড্ডা চলছে পুরোদমে, অখিলেশ,তিতলি এবং আঙ্কেলের ছেলে রাহুল আর সবার মধ্যমনি হয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে গা জ্বালানো মেয়েটা। রাহুল ছেলেটা খারাপ না।সারা বিকেল ঘুরলো একসাথে। কিন্তু রিতির সাথে তার অন্তরঙ্গতা একটুও ভালো লাগছেনা বিরূপাক্ষের।চোখে বাঁধছে খুব।হয়তো আগেই পরিচয় আছে দুজনের।নইলে এত আদিখ্যেতা ক্যানো।নাকি আরো অন্যকিছু?চমকে ওঠে বিরূপাক্ষ ।আর ভাবতে পারছেনা সে।এমন ফালতু অনাসৃষ্টি ভাবনা সে কবে থেকে ভাবতে শুরু করলো?
সব ভাবনাকে তাড়িয়ে দিয়ে শূন্য মস্তিষ্কে
বিরূপাক্ষ যখন নিশ্চিত হয়ে বিছানায় উঠে শুয়ে পড়লো তখনি টোকা পরলো দরজায়।হুরমূর করে উঠে বসে।নিজেকে স্বাভাবিক করে দরজা খুলে পাশে সরে দাঁড়ায়।রিতি তার স্বভাবসুলভ মৃদু ছন্দে প্রবেশ করে একহাতে কফির মগ।অন্য হাতে দরজা বন্ধ করে কফির মগটা বিরূপাক্ষের দিকে এগিয়ে দিয়ে মিষ্টি হেসে বলে,, এই নিন আপনার কফি। নিচের ঘড়ে পাড়ার মহিলারা নাড়ু বানাচ্ছে।বার বার সেখানে গেলে খারাপ দেখায় তাই নিয়েই আসলাম।কি হলো ধরুন।আরেকটা কথা,অযথা টেনশন করে আমার বানানো কফির নিন্দে করবেন না দয়া করে।
বিরূপাক্ষ কফির মগটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে দেখতে থাকে রিতির মধ্যে কোন বিচলতা নেই স্বাভাবিক ভাবেই হেঁটে গিয়ে বিছানায় বসলো পা উঠিয়ে।
বিরূপাক্ষ চেয়ারটা টেনে বসে কফির মগে ঠোঁট ছোঁয়ায় হালকা করে আর বুঝতে চেষ্টা করে রিতির মুচকি হাসির অন্তরালে চলছে টা কি?
বেশি ভাববেন না একটু রাত হোক আমি চলে যাবো তিতলির ঘড়ে।ওর সাথে সব কিছু ঠিক করে এসেছি।কেউ টেরই পাবে না রাতের অন্ধকারে কোথাকার জিনিস কোথায় গেলো।হেসেই চলেছে রিতি।
তোকে কে বললো আমি এতক্ষন তোকে ভেবে মরছি। তুই কোথায় ঘুমাবি না ঘুমাবি ঐ চিন্তা ছাড়াও আমার আরো অনেক কাজ আছে!ঢেড় গুরুত্বপূর্ণ কাজ।যাক সে কথা,তোর ব্যাথা কমেছে?

উ হু ।কমেনি, দেবেন নাকি মলম লাগিয়ে? রসিকতা করে রিতি।

সেদিন লাগিয়ে দিতে চাইলাম দিলিনা তোর সোনার অঙ্গে হাত দিতে। আমিও হাত পা ধুয়ে বসে নেই তোর ক্ষতে মলম দিতে।

সেই তো।আমিও বা কি হচ্ছি দিনে দিনে কে জানে?মুখে বিরক্তি টানে নিজের উপর।

সেইরাতে রিতির ঘড় থেকে বিধ্বস্ত মনে বেরিয়ে আসে বিরূপাক্ষ।প্রবল ঘৃনা বর্ষিত করে নিজের উপর।সে কি করে পারলো একটা মেয়েকে এভাবে অপমান করতে তাও শুধু মাত্র জেদের বশে। তবে কি সে সত্যিই নিম্নগামী পুরুষদের দলে ভীড়ছে দিনে দিনে।নাকি মনের কোথাও অধিকার বোধ রেখেছে রিতির উপর?
ছটফট করতে করতে কাঁটা ছেঁড়ায় লাগানো মলটা নিয়ে ছুটে যায় পাশের ঘড়ে।রিতি ততক্ষনে ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে ছোট মোটা কাগজটাকে পাখা বানিয়ে হাওয়া করছে পেটের কাছে।বিরূপাক্ষের চার আঙুলের চারটা নখই বসে গেছে সেখানে। ঘামের বিন্দুর মতো রক্ত ঝরছে সেখানে।জলছে ভীষণ।চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরছে তার। মানসিক আঘাত জীবনে কম পায়নি সে তবে শারীরিক আঘাত কি, সে সম্পর্কে সম্পূর্নই অনভিজ্ঞ।বিরূপাক্ষকে দেখেই হালকা কেঁপে উঠলো রিতি। কিন্তু সেটা বুঝতে দিলো না তাকে।ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে অপরাধীর মতো বললো বিরূপাক্ষ,,,আই এম সরি বুড়ি,,আই এম সরি ফর মাই বিহেবিয়ার।

রিতির অশ্রু দ্বিগুণ গতিতে ধাবিত হলো চিবুক ছুঁয়ে বিরূপাক্ষের মুখে বহু বহু বছর পরে বুড়ি ডাকটা শুনে। ভালো লাগলো এটা ভেবে যে তাকে বুড়ি ডাকাটা ভোলেনি সে। কিন্তু কিছুই বললো না।

তোর নিজেরই দোষ কম নয়।এমন এমন সব কথা বলিস মেজাজ খারাপ হয়।আর তোর ঐ গুলো সব তিতলি কিনে দিয়েছে ম্যাচিং করে।হ্যা টাকাটা আমার।দেখি এই ওষুধ লাগিয়ে দেই যন্ত্রণা কমে যাবে।
বিরূপাক্ষ এগিয়ে আসতেই রিতি এক ঝটকায় দু কদম পিছিয়ে যায়। উষ্মার সাথে বলে, খবরদার আপনার ঐ হাতে একদমই ছোঁবেন না আমাকে।এত ছুঁই ছুঁই ক্যানো সারাক্ষণ হ্যা?চোখ তো আগেই লাল ছিল তা যেনো আরো গাঢ়ো হলো রিতির।

আচ্ছা আচ্ছা ছোঁবোনা।নিজে লাগিয়ে নে ধর। ননীর শরীর কি না?গলে যাবে।সামনের টেবিলে রাখে মলমটা।

ফুঁসছে রিতি।দেখে বললো বিরূপাক্ষ,,,
কোলে কাঁধে তো কম উঠিসনি।যখন একেবারে ছোট ছিলি কোলে নেওয়ার লোভে চলে যেতাম বাড়িতে না বলে।মনিমা আমাকে বসিয়ে তোকে কোলে দিতো।আর এমন কোনো দিন ছিলোনা যেদিন তোকে কোলে নিয়েছি আর তুই আমার প্যান্টটা শুকনো রেখেছিস? তখন কোথায় ছিলো এত দেমাগ তোর?

হ্যা হ্যা বুঝেছি আপনি অনেক মহান ছিলেন দোলনার মতো ।আমাকে কখনোই মাটিতে রাখতেন না।এখন যান এখান থেকে।

ক্যানো আমি আসতে পারি না এখানে?থাকতে পারিনা এঘড়ে?

সে তো অবশ্যই পারেন।বাড়িটা যেহেতু আপনাদের ঘড়টাও তাই।তাহলে আমিই যাই আপনি থাকেন।পা বাড়ায় রিতি।

তুইও তো এখনো আমার তাহলে?সে স্বনামে হোক আর বেনামে।শান্ত স্বরে বলল বিরূপাক্ষ।
রিতির চলা থামলো।মনের ভেতর জলতে থাকা ক্রোধের আগুন নিভু নিভু হলো এক বেদনাদায়ক উত্তাল পবনে।তার তিরতির করে কম্পণরত হৃদযন্ত্রটা বুঝতে সক্ষম হলো না আসলে কি চায় মানুষটা?
শোন,,, আমার কথাগুলো এক কানে শুনবি অন্য কান দিয়ে বের করবি তাহলে তোরই মঙ্গল। বিরূপাক্ষ রিতির কানের কাছে ফিসফিস করে কথা গুলো বলে বেরিয়ে যায়।দরজা আটকে টেবিলে থাকা মলমটা সটান ছুঁড়ে ফেলে বলে ,, শয়তান ছেলে একটা কে বলেছে তোকে আমার মঙ্গল চিন্তা করতে?
সেই রাতের পর বিরূপাক্ষ আর রিতির সাথে দূর্ব্যবহার করেনি এখনো পর্যন্ত।

আমার ঘুম পাচ্ছে ভীষণ।সকালে ডেকোরেটর এর ছেলেরা আসবে কাজ আছে আমার।হাই তুলে বললো বিরূপাক্ষ।
রিতি নেমে হেঁটে গিয়ে দরজাটা টেনে চেক করলো।যা ভেবেছিলো সেটাই হয়েছে।বৌদিদি দরজাটা লক করে রেখেছে বাইরে থেকে।
বিরূপাক্ষকে চিন্তিত দেখায় ।সেও বুঝেছে ব্যপারটা।

আপনি শুয়ে পরুন।অনেক রাত হলো।

তুই কোথায় ঘুমোবি?

যেখানেই শুই আপনার সাথে ঘুমাবো না সেই ব্যপারে নিশ্চিত থাকতে পারেন।এই না বললেন আমার চিন্তায় আপনার শরীর খোয়াতে চান না?
বিরক্তি সূচক” চ”উচ্চারণ করে বিরূপাক্ষ,,
তুই এত ঘাড় ত্যাড়া ক্যানোর?।

আপনার চেয়েও?

আলোটা নিভিয়ে দে।

বিরূপাক্ষ উঠে বিছানায় শুয়ে পরে। কিন্তু চোখ বন্ধ করে না, রিতির চলন বলন দেখছে সে,
রিতি হেঁটে গিয়ে ওয়্যারড্রবের পেছন থেকে একটা মাদুর বের করে, নিজের বুদ্ধিকে বাহবা দেয়,ভাগ্যিস এই পথটা খোলা রেখেছিলো।
মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে বিছানা থেকে বালিশ নিয়ে শুয়ে পরে কাঁথা কম্বল ছাড়াই। শাড়ির আঁচল টেনে ঢেকে নেয় শরীরটাকে।ঘড়ের বাতিটা নেভালে ও ব্যালকনিতে জ্বলা আলোর ছটা এসে পরছে কাঁচের দরজা ভেদ করে সেই মৃদু মৃদু আবছা আলোয় রিতির গুটিয়ে থাকা শরীরটাকে বিরূপাক্ষের কাছে ভীষণ মোহনীয় ঠেকলো।অপলক তাকিয়ে দেখতে লাগলো সে রূপ। আশ্চর্য রকমভাবে উপলব্ধি করলো তার একটুও সংকোচ বোধ হলো না রিতিকে মুগ্ধ হয়ে দেখতে।

বিরূপাক্ষের ঘড়ের ব্যালকনি,জানালা এমনকি বাথরুম থেকেও দেখা যায় বাড়ির সামনের সবকিছু।এক কথায় বলা যায় ঘড়টা থেকে ঘুরে ঘুরে বাড়ির শুধু একটা পাশ বাদে আর সব দিকেই দেখা যায় অনেক দূর পর্যন্ত।তিতলি দাঁড়িয়ে আছে বিরূপাক্ষের ব্যালকনিতে। সামনের বাগানময় চলছে ডেকোরেশনের কাজ।আজ সন্ধ্যায় মহাসপ্তমী।তিতলি মুগ্ধ নয়নে দেখছিলো নিচে দাঁড়ানো কথোপোকথনরত বিরূপাক্ষকে।বিরূপাক্ষের সব কিছুই ভালো লাগে তার।কালো শর্টস্ আর ছাইরঙা স্লিভলেস টিশার্ট।পায়ে স্নিকার্স।নিশ্চয়ই মর্নিং ওয়াক করে ফিরেছে।ঐ যে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলার তালে হাতের মাংসপেশী উঠা নামা করছে সেটাও ভীষণ ভাবে টানে তিতলিকে।কথার তালে মাথার ঘনকালো চুল গুলোতে আঙুল দিয়ে নাড়িয়ে দিচ্ছে সেটাও মন্দ লাগেনা।ওটা না করলেই বুঝি তার বিশেষ ব্যক্তিত্ব লোপ পাবে।রূপকে সে ছাড়বে না।রূপকে ছাড়তে হলে যে নিজেকে আগে ছাড়তে হবে।রূপ দর্শনে এতটাই মগ্ন ছিলো যে রিতি ট্রেতে করে ব্রেকফাস্ট আর কফি এনেছে সেটাও খেয়াল হলো না তার।

মানুষটাকে খুব ভালোবাসো তাইনা তিতলি দি?
হুম,,, অন্নেক।
ভ্যবাচেকা খেয়ে ফিরে তাকায় তিতলি।রিতি তার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দেখছে বিরূপাক্ষকে। ঠোঁটে বিরাজ করছে সবসময়ের হাসিটুকু।

এত অপ্রস্তুত হওয়ার কিছু নেই তিতলি দি।ভালোবেসে ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যাচ্ছো অথচ প্রকাশ করতে অনীহা ক্যানো?এসো আগে খেয়ে নাওতো!বিষয় পাল্টাতে চায় রিতি।

তোমাকে বোঝা আমার সাধ্যেরও সাধ্য নেই রিতি!

কি সব বলো তুমি?আমি কি খুবই প্যাঁচালো?হাসছে রিতি।

আরে না না তা নয়। তুমি গভীর সমুদ্রে অতল গহবর।যার অজানা রহস্য আমি ক্যানো স্বয়ং বিরূপাক্ষ রায় চৌধুরীও উদঘাটন করতে পারবে না।তিতলিও হাসে।

তোমার কফি কিন্তু ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।

একটা কথা বললে বিশ্বাস করবে রিতি?
রিতি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সমর্থন করে।
আমি যখন তোমার কথা জানতাম না।তোমাকে দেখিনি তখন মনে প্রাণে চাইতাম রূপের সমস্ত প্রতিজ্ঞা,দায়বদ্ধতা মিথ্যে হয়ে যাক শুধু আমি থাকি ওর সর্বত্র জুড়ে।ওর সবকিছু মিথ্যে হয়ে যাক, প্রতিক্ষায় থেকে থেকে ক্লান্ত হয়ে শেষ হয়ে যাক কেউ।তাহলে তো রূপ আমার হবে।ও আমাকে বলেছে ওর জন্য যদি কেউ পথ চেয়ে না থাকে তাহলে আমাকে সুযোগ দেবে। কিন্তু এখন আমার মনে হচ্ছে ও যার জন্য আমাকে তোমাকে এভাবে ইগনোর করছে তার বিকল্প অপশনটি আমি না হয়ে তুমি হলে আমার ভালো লাগবে।
রিতি এতক্ষণ দম বন্ধ করে শুনছিলো তিতলির বলা কথাগুলো।যতই হোক নিজের স্বামীর কথা এই ভাবে অন্য নারীর মুখে শুনতে হয়তো কারোই ভালো লাগবে না।
কিন্তু রিতি তো অন্য ছাঁচে গড়া, নিজেকে যতটা সম্ভব সংযত করে বললো,,তিতলি দি আমি কারো বিকল্প অপশন হতে চাইনা বিশ্বাস করো।যা আমার তা আমারি হবে।আমিই হবো এক এবং অদ্বিতীয়। আমার বিকল্প অপশন কেউ হবে না আর না আমি হবো।তিনি কার হবেন,কাকে নেবেন তা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় সত্যিই আমার নেই। তুমি খেয়ে নাও।আমি আসছি।
কথাটা বলে পা বাড়াতেই বললো তিতলি,

কাল রাতে এলে না যে?
রিতি তাচ্ছিল্য ভরে হেসে তাকায় তিতলির দিকে।এমন একটা প্রশ্ন যে তাকে করতে পারে সেটা ভাবনাতেই ছিলো না তার।তিতলির এমন প্রশ্নের মানেটা ঠিকঠাক উদ্ভাবন করতে সময় না নিয়েই বলে,, ভাবনার কোন কারন নেই দিদি।তার সাথে একঘড়ে থাকলেও হঠাৎ করে কিছু হওয়ার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই। একটা কথা কি জানো?সে আমাকে ঘৃনা করে না।অথচ তার অবহেলা পাহাড় সমান। ভালোবাসার উল্টোপিঠে ঘৃনা থাকে আর অবহেলার অপরপিঠে যত্ন।আর যত্ন যে কাউকেই করা যায়। ভালো না বাসলেও করা যায়।তো তার যদি কখনো দয়া হয় দিক বদল হয় তাহলে আমার ভাগ্যে যত্নই জুটবে। আমাকে হয়তো যত্ন করবে কিন্তু ভালো বাসবে না।
তিতলি নিজের হুট করে করা প্রশ্নটায় নিজেই খানিক ইতস্তত বোধ করছিলো।রিতির এমন ব্যাখ্যায় সেটা দিগুন হলো,,

রিতি আসলে আমি ঐভাবে কিছু মিন করিনি প্লিজ ভূল বুঝোনা। এমনিতেই মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলো প্লিজ রিতি প্লিজ। অনুতপ্ত হয়ে রিতির হাত দুটো আঁকড়ে ধরে তিতলি।

তিতলি দি এত অনুতাপ সন্তাপ করার কিছু নেই তো।তবে হ্যা তোমার মতো জীবনসঙ্গী পাওয়া কিন্তু ভাগ্যের ব্যাপার।তা যদি হয় তাহলে আমার চেয়ে খুশি কেউ হবে না গো।

আবারো ভুল করছো রিতি,ওই ভাগ্যবান এর ভাগ্যবতী আমি নই রে।সে যে এক অচেনা অজানা বনলতা।ভাবা যায়,দি গ্রেট বিরূপাক্ষ রায় চৌধুরীর মন মজেছে এক বুনো বনলতায়।ভাগ্যবতী সে আর ভাগ্যবতী তুমি।ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছাকৃত হোক তার নামের সিঁদুরে সিঁথি রাঙিয়েছো।আর আমি,,,,
তিতলির শেষের কথাটা শুনে রিতির পায়ের তলাটা টলে ওঠে যেনো।সে মরিয়া হয়ে প্রশ্ন করে কি বললে তুমি? আরেকবার বলো তো,,দুজনে সিঁদুর পরছি মানে কি হ্যা?বলো বলো?
তিতলির আপাদমস্তক কেঁপে ওঠে আবেগের বশে অসাবধানতাবশত বলা কথাটায়।কি করে ফেললো সে? বিরূপাক্ষ পই পই করে বলে দিয়েছিলো কথা গুলো যেনো বাড়ির কেউ জানতে না পারে আর ও এক নিমিষেই কথাটা বলে ফেললো তাও আবার রিতিকে!কি হবে এবার?

একান্ত চাপের মুখে পরলে যা হয় তিতলির হলো সেই দশা। বনলতার সাথে রূপের যত কথা সে শুনেছিলো রূপেই মুখে তার আদ্যোপান্ত বলে গেলো রিতিকে।রিতি শুনলো একাগ্র চিত্তে।
তিতলি বার বার অনুরোধ করলো বিরূপাক্ষকে যেনো কিছু না বলে।রিতি আশ্বাস দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় মনের পর্দায় দৃশ্যমান হলো রবি ঠাকুরের চোখের বালি উপন্যাসের কয়েকটি চিত্র।
ভাবলো মনে মনে,দেখি আর কয়েকবার আন্ডারলাইন করে করে পড়তে হবে বইটা।তিতলিদিকে কি অবশেষে চোখের বালি করতে হয়?

চলবে,,,,

ভুল ত্রুটি মার্জনীয়।
ভালো থাকবেন সবাই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here