হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে পর্ব:১৫

0
847

উপন্যাস: হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে।

কলমে :চন্দ্রা ‌।

পর্ব:১৫

এই ডাকাবুকা বিজ্ঞানের যুগে মন্ত্র তন্ত্র বিদ্যা যতই হ্রাস পেয়েছে,জ্যোতির্বিদ্যার কৃপায় নতুন পুরোনো জ্যোতির্বিদদের চেম্বারে ততটাই ভাগ্যলক্ষীর আনা গোনা বেড়েছে।দেখা যায়, অবস্থাপন্ন কোনো শিক্ষিত পরিবার কবিরাজের ঝাড়ফুঁক কে কুসংস্কার বলে হেয় করলেও সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সাথে সাথে তাঁরাই আবার ছুটে যায় জ্যোতিষীর চেম্বারে।”নামে নাকি জমে টানে “এই কথাটা সর্বান্তকরণে মেনে নবজাতকের কোষ্ঠী গননার মাধ্যমে সেই নামের কারনে জমে টানাটা ঘুচিয়ে দেয় সচেতন পরিবারের লোকেরা। ভবিষ্যতে সেই নবজাতকের যদি নামের কারনে জমে মানুষে টানাটানি হয়েও যায় একদফা, তারও ব্যাখ্যা আছে ঐসব সচেতন লোকেদের কাছে। নেহায়েৎ ভাগ্য সহায় হলো না তাই এমন হলো।
আবার এমন অনেক শিক্ষিত, জ্ঞানী গুণী ব্যাক্তি আছেন যারা ঠাকুর দেবতার মন্দিরের মাটি এমনকি মা,বাবা গুরুজনদের পায়ের ধুলোর মাঝেও জীবাণু খুঁজে পায়।তারাই আবার বিপদ তারিনীর নামে লাল সুতোয় হাতের কব্জির শোভা বাড়ায়।
যাক সে কথা,
জ্যোতিষশাস্ত্র সত্য নাকি মিথ্যা সে তর্কে যাবো না।যার সম্মন্ধে আমার সয়ংসম্পূর্ণ জ্ঞান নেই সে আলোচনা করতে চাইনা।প্রভাকর রায় চৌধুরী ওঝার ঝাড়ফুঁক এমনকি তাঁর পিতার এই যে গুরুবাক্যে অন্ধ বিশ্বাস সেটাও একসময় নিজের কোক্ষগত আধুনিক শিক্ষার অবদানে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেন সর্বান্তকরণে।সে অনেক বছর আগের কথা, বিরূপাক্ষ সবে ছয় বছরের শিশু। গুরুদেবের পদধুলি পরলো রায় চৌধুরী বাড়িতে।প্রভাকর রায় চৌধুরী পিতার গুরুকে তখনো মন থেকে শ্রদ্ধা করতে না পারলেও পিতার ভয়ে হোক আর যে কারনেই হোক গুরুদেবের অসন্মান হবে এমন কোনো আচরণ করতেন না। সেদিন ছিলো আষাঢ়ের মাঝামাঝি সময়। গুরুদেব আসলেন ।যথারিতি তার আপ্যায়নের কোনো ত্রুটি হলো না।প্রিয় শিষ্যের একমাত্র বংশপ্রদীপ হওয়াতে বিরূপাক্ষকে যথেষ্ট স্নেহ করতেন তিনি।
সেদিন আপন মনে ক্রীড়ারত বিরূপাক্ষের দিকে একপলক তাকিয়ে বললেন তিনি অন্নপূর্ণা দেবীর উদ্দেশ্যে,,মাগো, ছেলের হাত পা গজিয়েছে একটু খেয়াল রাখিস।ওর যে জলে জঙ্গলে ভীষণ অনুরাগ।
সদাহাস্য গুরুদেবের শান্ত বাক্যে অন্নপূর্ণা দেবীর মন চমকে ওঠে।

প্রবোধ রায় চৌধুরীর মনে খটকা লাগলো ভীষণ ভাবে। তিনি জোড় হস্তে চেপে ধরলেন গুরুদেবকে। কিন্তু তাঁর সাথে জোড়াজুড়ি খাটে না।যদি কুপিত হন?

প্রভাকর রায় চৌধুরী সেসব দেখে বিরক্ত হয়ে উঠে গেলেন ধুতির কাঁচা ঝেড়ে।গুরুদেব দেখলেন সবই,, অবশেষে তিনি একান্তে কথা বলতে চাইলেন প্রভাকর রায় চৌধুরীর সাথে।সে ব্যাবস্থা হলো অতি শিগগিরই।
দেখো বাবা আমাকে তুমি পছন্দ করো না সেটা জানি। কিন্তু নিজের সন্তানকে তো ভালোবাসো?প্রথম কথা বললেন গুরুদেব এবং তা অত্যন্ত নম্র স্বরে।

আশ্চর্য কথা বললেন গুরুদেব। আমার সন্তানকে আমি ভালো বাসবো না?সেটা কি হয়? অবাক হলেন প্রভাকর।

নির্মল,হাসিতে মুখ উজ্জ্বল করলেন গুরুদেব,,

ভাগ্যের উপর আমাদের হাত নেই পুত্র। কিন্তু ভাগ্য নির্মিত হয় মনুষ্য জাতির কর্মের উপর ভিত্তি করে। যে যেমন কর্ম করবে,সে তেমন ফল পাবে, অবশেষে নিজের মন্দ কৃতকর্মের দায় চাপিয়ে দেবে ভাগ্যের উপর।

আপনি কি বলতে চান গুরুদেব স্পষ্ট করে বলুন? অধৈর্য স্বরে বলে প্রভাকর রায় চৌধুরী।

এত ধৈর্য হারা হলে চলে পুত্র? এই যে,মাতা সিংহ বাহিনীর প্রার্থনা করো।সে কি শুধু অর্থ বিত্ত আর ক্ষমতাকে অমর করার প্রয়াসে।তেমন ভেবোনা বাবা। তিনি যেমন তোমার চাকচিক্য মাখা পাথরের দালানে থাকেন আবার পাতার কুটিরেও সাচ্ছন্দে থাকতে পারেন তার ভক্তদের হৃদয়ে।ধর্মে বিশ্বাস আনো,কর্মে আনো সততা। অর্থই সব নয়।অর্থ অনর্থের মূল হয় জানো তো?এমন কিছু করোনা যাতে জীবনে বেঁচে একমাত্র থাকার অবলম্বন টুকু হারিয়ে যায়।
প্রভাকর রায় চৌধুরী খানিক শংকিত হন গুরুদেবের অমন উপদেশ মূলক বাক্যে।তবে কি তিনি কিছুর ইঙ্গিত করছেন,,

গুরুদেব যেনো পড়ে ফেললেন প্রভাকরের ভেতর বাহির। তিনি তেমনই নির্মল স্বরে বললেন,তোমার পিতা স্নেহ পরায়ণতার দিক দিয়ে অতিশয় দূর্বল তাই তোমাকেই বলছি,, দাদুভাইয়ের ঘোর বিপদ আসবে সামনে।এবং তা অতিশীঘ্রই। সেদিকে লক্ষ্য রেখো।

প্রভাকর রায় চৌধুরীর পিতৃহৃদয় সন্তানের বিপদাশঙ্কায় কিছুটা বিচলিত হলেও তা কুসংস্কার ভেবে আমলে নিলো না।স্ত্রী বা পিতা কেউই অবগত হলোনা সেদিন বদ্ধ কক্ষে গুরুদেবের সহিত প্রভাকরের কি কথা হলো?
কিন্তু ঘটনা টা ঘটলো তার দশদিনের মাথায়।
প্রভাকর চৌধুরী জেলা শহরে নতুন ব্যাবসাটা শুরু করে সবে ফিরেছেন বাড়িতে।বিরূপাক্ষের খোঁজ করতেই থাকে পাওয়া গেলো না কোথাও।ঐটুকু ছেলে একা একা কোথায় যাবে। বাড়িতে যারা কাজের মানুষ ছিলো তারা এবং নিজেরা চারজনে হন্যে হয়ে খুঁজলো সবখানে না কোথাও নেই। রঘুনাথ দৌড়ে গেলো রাস্তার ঐ পাশে শান বাঁধানো পুকুর ঘাটের দিকে।চোখ গেলো পুকুরের থৈ থৈ জলে ভাসছে একটা ছোট গোলাপী রংয়ের স্যান্ডেল। রঘুনাথ হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলো ভীষণ চিৎকার করে।
। তিনদিন আগে ভাইকে সে ঐ স্যান্ডেল জোড়া এনে দিয়েছিলো অল্প টাকা দিয়ে।যেটা ভাই অতি প্রিয় বস্তুর মতো পায়ে পরে ঘুমিয়েছে কদিন। ঝাঁপিয়ে পরলো পুকুরের জলে।রঘুনাথের চিৎকার শুনে ততক্ষনে পুকুর পাড়ে দৌড়ে আসে সবাই। অন্নপূর্ণা দেবী জ্ঞান হারিয়েছিলেন ততক্ষণে।
অবশেষে পাওয়া গেলো বিরূপাক্ষের জ্ঞানহীন নিথর দেহখানি। প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হলো। আশ্চর্য জনক ভাবে সকলে দেখলো ছোট্ট বিরূপাক্ষের পেটে জল ঢোকার কোন ভাব নেই। মুখের মধ্যে কেকের টুকরো ভরা। হয়তো খাচ্ছিল কিছুক্ষণ আগে।সেগুলো বের করে মুখে মুখ লাগিয়ে শ্বাস দিতেই দম ছাড়লো বিরূপাক্ষ।

সে যাত্রায় বিপদ কাটালো আর প্রভাকর রায় চৌধুরীর কাটলো ভ্রম। নিজের যথেষ্ট বিত্ত বৈভব থাকা সত্ত্বেও যে ব্যবসা শুরু করেছিলেন তা অতি দ্রুত ত্যাগ করে সৎ ভাবে ব্যবসা শুরু করলেন।সেই থেকে পিতার গুরুকে নিজের গুরু হিসেবে মেনেছেন প্রভাকর রায় চৌধুরী।তা না হলে রিতির সাথে হয়তো ছেলের বিয়েটা দিতেন না জোরজবরদস্তি করে।কারন রিতি দাদুকেও কালে কালে অপছন্দ করতে শুরু করেন রাজনৈতিক কারণে।
আজ আবার যখন গুরুদেবের মুখে শুনলে একমাত্র ছেলের আসন্ন বিপদের কথা তখন এক অসহনীয় ভয়ে,যন্ত্রনায় অস্থির হয়ে পরলো প্রভাকর রায় চৌধুরীর বৃদ্ধ হৃদয়খানি।

ডাইনিং টেবিলে থাকা একটা চেয়ার একটু দূরে টেনে বসেছে রিতি।ব্যস্ত হাতে আতপ চালের কাঁকঁড় বাছছে। কিন্তু দশ মিনিটে সুচাগ্র সমান একটা কাঁকঁড়ের দেখা মেলেনি তার।দাদু(গুরুদেব) ব্রহ্মচারী মানুষ তায় আবার স্ব-পাকে রেঁধে খান। কিন্তু আনাজ-তরকারী অন্যকেউ কেটে কুটে গুছিয়ে দিলে সমস্যা নেই।চাল দুটো ধুয়ে দিলেও তিনি খুশি মনে নেন কিন্তু নিজে রান্না করে খেতে তিনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, নিরামিষাশী তিনি।জয়া কিচেনের বাড়তি গ্যাসের চুলাতেই রান্নার ব্যবস্থা করেছে। স্নানের আগে ভালো করে মুছে দিয়েছে চুলা সহ পুরো রন্ধনশালার মেঝে।
কিচেন থেকে হাঁক ছাড়ল জয়া,কইরে রিতি বেলা যে যায়।দাদু রাঁধবে কখন আর খাবে কখন?নাকি নিজের সাথে উপোস রাখতে চাস?
রিতি দ্রুত উঠে দাঁড়ায়,,এইতো হলো বৌদিদি।খাবেন তো সেদ্ধ ভাত নয়তো ডাল,চাল,আলু পটলের জগাখিচুড়ি। কতক্ষনইবা লাগবে?
দে দেখি ধুয়ে দেই তারাতাড়ি।তোর দাদাভাইকে বল দাদুর রান্নার ব্যবস্থা হয়েছে।ওনাকে নিয়ে আসতে এখানে।

গুরুদেব আসতেই কিচেন থেকে বিদায় নিলো সবাই।

গুরুদেব এলে তাঁকে প্রণাম করে সেই যে বিরূপাক্ষ বাড়ি থেকে বেরিয়েছে বিকেল হতে চললো তার খবর নেই।প্রদীপ খুঁজেছে কয়েকবার।কল দিলে ধরছে না।
এই রিতি রূপ কোথায় জানো তুমি?তিতলি বললো কোথা হতে এসে।
মন্দিরের বড় বারান্দার এক কোনে বসে কাজ করছিলো রিতি।
না গো তিতলি দি। তোমার যদি অসুবিধা না থাকে তাহলে একটু ধরবে এগুলো? বোঁটাটা ছিঁড়ে দাও শুধু।এক সাঁজি ছোট টগর এগিয়ে দিলো তিতলির দিকে।
তিতলি খুশিই হলো তাকে কাজ দেওয়ার জন্য।
বৌমনি তুমি আমাকে বলতে,আমি তোমাকে হেল্প করতাম।
এতক্ষণ কোথায় ছিলে পাকনা বুড়ো?যেই দেখলে তিতলি দি এলো অমনি তুমিও হাজির?হাসছে রিতি কিন্তু মন তার অন্য কোথাও।

তবে যাই বলো তিতলি আমাদের অভিরাজ বাবু কিন্তু একদিন রাজ করবে দেখো?অভির মাথায় টোকা দিয়ে বললো তিতলি বিনিময়ে শুধু হসলো রিতি।অভি বললো ভাব নিয়ে,, সেদিন কিন্তু তোমাকে পাত্তা দেবোনা তিতলি দি,এখন যেমন আমাকে দিচ্ছো না।চোখ বড়ো করে তাকায় তিতলি,রিতি হাসে শব্দ করে।

এই ইচঁরে পাকা ছেলে তোকে আমি পাত্তা দেই না কে বললো?তখন যে বললাম স্কুলের মাঠে মেলা বসেছে আমাকে একটু চুড়ি,ফিতে,স্নো, পাউডার কিনে দিবি চল,তুই কি বললি?

কি বললাম বলো?সত্যিইতো বললাম ওখানে ভালো কিছু পাওয়া যায় বলো বৌমনি?রিতিকে সাক্ষী মানে।

সত্যিইতো পাওয়া যায় না।তো তুই কি বললি বল?

বলেছি যে,ছোটদাভাই যখন শহরে যাবে তখন তাকে যেন লিষ্ট দিয়ে দেয়।

তুই দিবি গিফ্ট আর ছোটদাভাই এনে দেবে?ক্যানো?
তাতে কি হয়েছে আমি নিজের হাতে দেবো।

এতটুকু ছেলের কি অসাধারণ লজিক হাসতে হাসতে পেটে খিল লেগে যায় দুজনের।

এত হাসছিস ক্যানো তোরা?এই রিতি, ভাইকে দেখেছিস?তিতলি তুমি জানো কোথায় গিয়েছে?দাদু ডাকছে তাকে।

দুজনেই ডানে বামে মাথা নাড়ে।

যে বেগে এসেছিলো সেই বেগেই চলে যায় জয়া।অহনা বসে পরে ওদের সাথে।পাড়ার কয়েকজন অল্প বয়সী মেয়েও এসে হাত লাগায় মালা গাঁথায়।
সবাই কথোপকথনে ব্যস্ত শুধু আনমনা হয়ে গেছে রিতি।
রিতি মনে মনে খুব খুঁজছে তাকে। কোথায় যে গেলো মানুষ টা?সারা গ্রামের লোকজন তার বাড়িতে গিজগিজ করছে আর সে আছে কোন মহাকাজে?

******
সারা শরীর কাঁপছে বিরূপাক্ষের।ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে ধরফর করে উঠে বসলো তেল চিটচিটে হালকা ময়লা কাঁথার বিছানায়।চ্যাপ্টানো বালিশের পাশে নজর পরতেই শরীর কাঁপার কারনটা বুঝলো।ফোনটা ভাইব্রেশন করে রেখেছিলো ঘুমানোর আগে। সেটাই কেঁপে কেঁপে ঘুমের বারোটা বাজালো। কিন্তু ঘুমের মধ্যে কি যেনো একটা স্বপ্ন দেখছিলো বিরূপাক্ষ, অনেক ভেবেও সেটা মনের কোনেও আনতে পারলো না। হ্যান্ডসেটটা আবারো নিজের সারা শরীর কাঁপিয়ে অথর্ব বোবার মত জানান দিলো কেউ ডাকছে বিরূপাক্ষকে।হাতে নিয়ে দেখলো দাদাভাই শব্দটা জলছে নিভছে। ডিসকানেক্ট হলো ভাবনা চিন্তার মাঝেই। সতেরোটি মিসড কল।হাতে থাকা বিরক্তকর যন্ত্রটা বালিশের উপর উপুড় করে রেখে দুহাতের আজঁলাতে একবার চোখ মুখ আবদ্ধ করলো। বাঁশের চটা দেওয়া নাম মাত্র বেড়ার বড়ো বড়ো ফাঁক গলে এগিয়ে এসেছে দুইটি লাউ ডগা ‌এমন ভাবে পেঁচিয়ে রেখেছে দুজন দুজনকে দেখে ভাবলো বিরূপাক্ষ ,একেই বুঝি বলে গলায় গলায় ভাব? ভাঙাচোরা জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি দিলো , যতদুর চোখ গেলো শুধু লাউ আর কুমড়ো গাছ আপন গতিতে বেড়ে চলেছে বাঁশ এবং শক্ত সুতায় তৈরী টাঙানো মাচা বেয়ে।পিছু ফিরে তাকানোর সময় নেই এদের।শুধু একটাই নিয়ম যতদিন বাঁচো, প্রতিযোগিতা ধরে রেখে ফুল ফল দিয়ে তার পর একদিন শুকিয়ে শুকিয়ে জীবনটাকে শেষ করো।কত ভালো হতো যদি এমন জীবন হতো মানুষের, যতদূর পারো বেড়ে যাও তারপর একসময় সব শেষ কোনো পিছুটান নেই, দায়িত্ব পালনের বাধ্য বাধকতা নেই। এইসব হাবিজাবি ভাবনা শেষে শুষ্ক হাসি হাসে বিরূপাক্ষ। নিজের ভাবনায় নিজেই বিরক্ত হয়ে উঠে পরে বিছানা ছেড়ে।শার্টটা গায়ে দিয়ে ফোনটা পকেটে রাখে। দরজা বিহীন নিচু ঘড়ে মাথা নুইয়ে বেড়িয়ে এসে চোখ রাখে পশ্চিম দিগন্তে।সূর্যটা তার গতিপথ বদলাতে চলেছে।লার আভা যুক্ত আলোক রশ্মি হামলে পরেছে সবুজ গাছগুলোতে।
দুহাত মেলে চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস নিয়ে মনে মনে আওড়ায়,আহা শান্তি, এমন দেশটি সত্যি ই কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। চারিদিকে সবুজ লাউ লতা,কুমড়ো ডগা আর মাঝেমধ্যে উন্নত শিরে দাঁড়িয়ে আছে ধূসর রঙের লাউ ফুলগুলো।

উচ্চ স্বরে ডাকলো বিরূপাক্ষ,,ও,,বিনু দাদা,,

দুইবার ডাকতেই মাঝ বয়েসী এক ব্যক্তি দৌড়ে আসে দক্ষিণ দিক থেকে,,

আজ্ঞে দাদাবাবু,, আপনি চলি যাচ্ছো?সসম্ভ্রমে দাঁড়ায় বিনু নামক ব্যক্তিটি।

মৃদু হাসে বিরূপাক্ষ,, তোমার কুমড়ো গাছে তো ফুল আসেনি লাউ কি পরেছে একটাও?

হ দাদাবাবু,ঐ দিকে পরছে কয়ডা।কাল কাইড্ডা (কেটে)দিয়া আমুনে।

কাল দিয়ে আসবে মানে কি?আগে নিজের খরচ-খরচা চালান উঠাবে তারপর ফাও খাওয়াবে বুঝলে?রসিকতা করে বিরূপাক্ষ।

ছিঃ ছিঃ দাদাবাবু,এইডা কি কও?পাও তো আমি খাই আপনাগো ডা।জিভ কাটে বিনু।

খামারে গরুগুলো আছে ক্যামন তোমার?

হ ভালো।

ঠিক আছে আজ তাহলে আসি।আবার আসবো কিন্তু তোমার ঘড়ে ঘুমাতে।

আজ্ঞে দাদাবাবু ঘড় তো আপনাগো ই।আইবেন। খুশিতে ডগমগ বিনু।

বিরূপাক্ষ পা বাড়িয়ে আবারও পিছিয়ে আসে,,বিনু দাদা তোমার কাঁথা বালিশ গুলো একটু ধুয়ে রেখো বুঝলে?ওই সুগন্ধে ঘুমের চেয়ে দুঃস্বপ্ন দেখি বেশী।হাসতে হাসতে বলল সে।
মাঝবয়েসী বিনুদাদার খুশিতে ডগমগ হওয়া মুখখানি নিমেষেই লজ্জায় কাঁচুমাচু হয়ে যায়। কিন্তু বিরূপাক্ষ আর ফিরে তাকায়নি।এগিয়ে চলেছে আপন গতিতে। বাড়ির মন্দিরে উচ্চ শব্দে বাজছে এখনকার ছেলেমেয়েদের পছন্দের ডি জে গান।কান কপালে কপাট লেগে যাওয়ার অবস্থা।
বিরূপাক্ষ এতক্ষণ যেখানে ছিলো সেটা ওদেরই খামার বাড়ি। সেখানে এমন কোন শাক সবজি নেই যা হয় না।আর সবকিছুই নিজের হাতে যত্ন করে ফলায় বিনোদ বিহারী অর্থাৎ বিরূপাক্ষের বিনুদা। পঞ্চাশোর্ধ্ব বিনুদা অন্য তিনজনের সাথে খামারের গরু গুলোর যত্ন নেয়।পয়ত্রিশটা দুধেল গাই আর পনেরোটা ষাড় ।সব মিলিয়ে পঁচাশি টি গরু। যেগুলোর দেখাশোনার প্রধান দায়িত্ব ই বিনুদার।

*****
কি গো এই ভর সন্ধ্যায় এভাবে পরে আছো যে,,শরীর খারাপ করেছে কি?

চোখ মেলে তাকান প্রভাকর রায় চৌধুরী।সোজা হয়ে বসেন,,

না গো,শরীর আমার ঠিকই আছে। এমনিতেই মনটা বড়োই চঞ্চল। ছেলেকে বুঝাও এখনো সময় আছে।নইলে যে সকল চেষ্টা বৃথা যাবে। অন্নপূর্ণা দেবী স্বামীর পাশে বসেন চেয়ার টেনে। বলেন আশ্বাস দিতে,,এত ভাবছো ক্যানো ?মনটাকে স্থির করো।

তুমি কি পেরেছো মনটাকে স্থির করতে? শান্ত করতে পেরেছো মনটাকে? গুরুদেব যেটা বললেন সেটা যে সত্যিই হবে তা তুমি যেমন জানো, আমিও বিশ্বাস করি। কিন্তু খোকা তো রিতিকে মেনেই নিতে পারছে না। কিসের এত বাঁধা তার।এই মেয়েটা ছাড়া আর কেউ নেই যে তোমার ছেলের মৃত্যুযোগ খন্ডন করতে পারবে।ক্যানো বুঝছে না তোমার ছেলে?কিছুটা উত্তেজিত হয়ে পরেন প্রভাকর রায় চৌধুরী। অন্নপূর্ণা দেবীর চোখ অশ্রু সজল হয়,,
অযথা অশ্রু বিসর্জন দিও না অনু।মাতা সিংহ বাহিনীর পায়ে পরে কাঁদো তিনি নিশ্চয়ই নিরাশ করবেন না। তোমার ছেলেকে সুবুদ্ধি,সৎমতি দান করবেন।

বিরূপাক্ষ ঘড়ে ঢুকতেই মৌমাছির মত ছেঁকে ধরেছে সবাই,

কোথায় ছিলি এতক্ষণ? এতবার কল দিলাম ধরিসনি ক্যানো?বললো তিতলি। বিরূপাক্ষ তাকালো তিতলির দিকে।ঘিয়ে এবং খয়েরী রঙের মিশেলে গর্জিয়াস কারুকার্যের একটা লেহেঙ্গা পরেছে সে।কপালে সাদা পাথরের ছোট্ট টিপ,গলায় সামান্য গহনা।হাতে তেমন কিছুই নয়।সোনার তৈরি চিকন চেইনের ঘড়িটা বাঁ হাতে আর ডান হাতে সবসময়ের পরা ব্রেসলেট।তাতেই সুন্দর লাগছে তিতলিকে।এমন সাজে কখনো দেখেনি তাই হয়তো ভালো লাগছে ভাবলো বিরূপাক্ষ। অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নেয় সে যা তিতলির দৃষ্টি এড়ায়নি।একটা দীর্ঘশ্বাস বুকের ভেতর চাপা দিয়ে বলে নকল উচ্ছলতায়,,কিরে ক্যামন লাগছে বললি না তো?
বিরূপাক্ষ হো হো করে হেসে ওঠে,,
তুই এই পোশাকে?আগে তো বিশ্বাস করতে দে তারপর নাহয় প্রশংসা শুনবি।

কি করবো বল?তোর বউ এসব না পরিয়ে ছাড়লো না।পেত্নির মতো লাগছে বল?মন খারাপের ভঙ্গিতে বললো তিতলি।
মাথা খারাপ তোর?এই সাজে বাইরে গেলে দেখিস কতজনের মাথা খারাপ হয়ে যায়? একবার দেখলে ভুলতেই পারবেনা সারারাতে।

কই তোর তো মাথা খারাপ হয় না?দিব্যি সুস্থ আছিস।অন্যের কি হলো না হলো তাতে আমার কি বল? হঠাৎ ক্যমন যেনো আবেগী হয়ে উঠলো তিতলি।

বিরূপাক্ষের মুখের হাসিটা দপ করে নিভে যায়।আমতা আমতা করে বলে কোন মতে,,
একটু দাঁড়া আমি আসছি পোশাক পাল্টে একসাথে যাবো মন্দিরে।তর তর করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যায় বিরূপাক্ষ সেদিকে আশাহত নয়নে তাকিয়ে চাপা দেওয়া দীর্ঘশ্বাস টা আরো একটু দীর্ঘ করে হাওয়ায় মিলিয়ে দেয় রিতি।
***
ড্রেসিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ির কুচির গোছায় সেফটিপিন আটকাতে ব্যাস্ত রিতি।এমন ধাঁচের শাড়ি সে আগে কখনো গায়ে তোলেনি আজই প্রথম তাই কিছুটা লজ্জা,অসস্থি টের পাচ্ছে নিজের মধ্যে। দাদাভাই বলেছে কড়া সুরে,বুড়ি আজ যদি তুই তোর দিদি মনি ক্লাসের শাড়িগুলো পরিস তাহলে তোর হাত পা বেঁধে নদীতে ফেলে দিয়ে আমি ও গলায় কলসি বেঁধে ঝাপ দেব বলে দিলাম।রিতি মনে মনে হাসে,,দাদাভাই ব্লাকমেইল করার আর জিনিস পেলোনা? পুরুষ ছেলেরা কখনো কলসি বেঁধে জলে ঝাঁপ দেয়?তবুও গায়ে জরিয়েছে বাহারী শাড়ি।ক্যানো জানে না।তারউপর আজ এমন কিছু সাজ সেজেছে বড়মার অনুরোধে যা এতদিন সবার চোখের আড়ালে ছিটে ফোটা চলতো।এখন গ্রামের লোকে দেখলে কি বলবে কে জানে?

গাড়ো নীল রঙের শাড়ি পরিহিত রিতিকে দেখে দরজাতেই পা আটকে গেছে বিরূপাক্ষের। শাড়ির মধ্যে নীল জমিনের উপর হালকা করে সুতোর কাজ করা। আর নীলের উপর সোনালী সুতায় চওড়া পারের কাজে যেনো চমক দিচ্ছে শাড়িটা। বিরূপাক্ষ অপূর্ব মুগ্ধ চোখে দেখছে বড়ো হাত খোঁপার চারিধারে কৃত্তিম বেলী ফুলের বেষ্টনী।বিরূপাক্ষের চোখ আটকে আছে রিতির ফর্সা পিঠে আটো সাটো হয়ে মিশে থাকা ব্লাউজের পেছনটায়।
মনে মনে প্রলাপ বকে বিরূপাক্ষ,,এই মেয়ে নির্ঘাত আমাকে চরিত্র হীন করে ছাড়বে।এভাবে সাজতে কে বলে ওকে।রিতি সেফটিপিন লাগানো সম্পন্ন করে ঘুরতেই ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়।তুতলিয়ে বললো,,তুমি এখানে,,,, এই সময়,,না মানে এতক্ষণ কোথায় ছিলে তুমি রূপদা?রিতির রূপদা কথাটা শুনে ভাবনার আকাশ থেকে ধপাস করে পরলো বিরূপাক্ষ,,

কুল কুল,,,এত তোতলানোর কিছু হয়নি আর আমি এখানে আসবো না বলছিস?

হ্যা,,না,,মানে ক্যানো আসবে না? তোমার ঘড়।আমিই বরং কম আসবো।ঠিকাছে আসছি এখন হ্যা,,,
রিতি আর একমুহুর্ত দেরী করেনি বেরিয়ে গিয়েছে রিরূপাক্ষের পাশ ঘেঁষে। বিরূপাক্ষ রিতির এমন ব্যাবহারের কারন তো খুঁজে পেলো না তবে ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলো মন্ত্র মুগ্ধের মতো।চোখের পর্দায় ভেসে উঠলো রিতি আজ চওড়া সিঁথি সিঁদুর দিয়ে রাঙিয়েছে ইচ্ছে মতো। কপাল জুড়ে বড়ো সিঁদুরের টিপ। মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত মায়ের মূর্তির সাথে রিতির মুখের আদলটা গুলিয়ে ফেললো।এযে একই ছাঁচে গড়া দুটি মুখাবয়ব।একজন মনুষ্য তৈরী মাটির প্রতিমা অন্যজন সৃষ্টিকর্তার তৈরী রক্ত মাংসের মানবী।

কি যে করতে চায় মেয়েটা বুঝতে পারে না বিরূপাক্ষ।

চলবে,,,,

ভুল ত্রুটি মার্জনীয়।
ভালো থাকবেন সবাই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here