হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে পর্ব:১৬

0
872

উপন্যাস :হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে।

কলমে: চন্দ্রা।

পর্ব:১৬

ক্ষণটা একদম ভর দুপুর যাকে বলে। সূর্যের পৃথিবী ঝলসানো তেজ।শহরের একটি পুরাতন ধরনের আবাসিক হোটেল এর সামনে এসে দাঁড়ালো অটোটা। ভেতর থেকে নেমে এলো অখিলেশ এবং নিরুপমা।অটোর ভাড়া মিটিয়ে সঙ্গিনীর হাত ধরে ব্যস্ত গতিতে গেটের ভেতরে প্রবেশ করলো সে। পরনের ঢিলে ঢলা হাফ হাতা চেক শার্ট আর মাথার এলোমেলো চুল দেখলেই যে কেউ বুঝে যাবে ছেলেটার মধ্যে আধুনিকতার ছোঁয়া অতি মাত্রায় কম। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে এমনভাবে যেনো ভারত বাংলাদেশের বর্ডার ক্রস করছে বিনা পাসপোর্টেই।এখনি হয়তো বিজিবি বা বি এস এফ এর গুলিতে প্রাণ যাবে তার।অপরদিকে সঙ্গিনীটি হেঁটে চলেছে একদমই শান্ত শিষ্ট নিরুত্তাপ ভঙ্গিমায়।পরনে জাম রঙা আটো-সাটো দামী থ্রিপিস।হালকা সোনালী চুল গুলোতে পরিপাটি ভাব।এক কথায় প্রাকৃতিক সুন্দরী সে কিন্তু খানিকটা উদাসীন হলেও শৌখিনতা আর আভিজাত্যের ছাপ বহন করছে প্রতিটি পদক্ষেপে।এভাবে কোনো পাবলিক হোটেলে মিট করা আজই প্রথম ওদের।এতে ঝামেলাও আছে অনেক।চেনা শোনা কেউ দেখলে কেলেঙ্কারির আর শেষ থাকবে না। অখিলেশ এদিক ওদিক ভীত চোখে তাকিয়ে হাঁটতে লাগলো। কিন্তু নিরুপমা নিরুত্তাপ।এমন ভাব যেনো, হাঁটতে হবে তাই হাঁটছে না হলে এক কদমও বাড়াতো না। কিন্তু আজ এই পরিবেশে দেখা করা এবং সময় কাটাতে সেই বাধ্য করেছে অখিলেশকে।না হলে অন্য সময়ের মতো অখিলেশের ম্যাচেই দেখা করতে পারতো। বন্ধুদের সাহায্যের হাত সবসময় বাড়ানোই থাকে ওদের দিকে।আজো হতো কিন্তু একজন রুমমেটের বাবা এসে উঠেছেন ডাক্তার দেখানোর উদ্দেশ্যে ।তিনি থাকবেন দু চার দিন। কিন্তু নিরু কোনো কথাই শুনতে চাইলো না সময় দিতে চাইলো না একটুও। ওর আজকেই দেখা করতে হবে বলে জেদ ধরলো।অখিলেশও হার মানলো কারন তারও নতুন কিছুর চাহিদা বেড়ে চলেছে দিনের পর দিন।নিরু কাছে থাকলে এখন শুধু হাতে হাত রেখে কাঁধে মাথা এলিয়ে ক্ষান্ত হয় না অখিলেশ তার আরো কিছু চাই,অনেক নিষিদ্ধ কিছু চাই যার লোভ নিরুপমা ই প্রথম পাইয়ে দিয়েছে তাকে।আসলে নিষিদ্ধ সবকিছুতেই মানুষের আগ্রহ বেশী থাকে কিন্তু অখিলেশ বা নিরু কখনোই সেটা নিষিদ্ধ হিসেবে মনে করে না।তারা বিশ্বাস করে, ভালো লাগা, ভালোবাসা তখনই প্রেমে পরিণত হয় যখন দুটি মানব মানবীর সেচ্ছায় মন,আত্মা এবং দেহ এই তিনটি জিনিসের মিলন ঘটে।এর যে কোন একটা জিনিসের মিলন না হলে তাকে পরিপূর্ণ প্রেম বলা হয় না।সেটা ভালো লাগা বা ভালোবাসা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে।
রিসিপশনের কার্য সম্পাদন করে চাবি নিয়ে উপরে উঠে এলো দুজনে। চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে দেখলো অখিলেশ,,যা ভেবেছিলো তা নয়,হাইফাই লেভেলের বিলাস বহুল হোটেল না হলেও এখানকার পরিবেশ অনেক ভালো।গ্যাঞ্জাম,হাউকাউ একদমই নেই।মনে মনে বন্ধুকে একবার ধন্যবাদ দিলো।সেই একবেলার জন্য ব্যাবস্থা করে দিয়েছে। নিজেদের জন্য বরাদ্দকৃত রুমে ঢুকে দরজা এটে দিলো অখিলেশ।ফ্যান চলছে কিন্তু হেঁটে আসায় ঘেমে নেয়ে একাকার সে। এসি নেই রুমে।বুকের উপরের দু’টো বোতাম খুলে মুখ দিয়ে ফু দিলো অখিলেশ।নিরু ততক্ষনে জানালার রেলিংয়ে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে।অখিলেশের স্মরণ হলো অন্য দিনের নিরুপমা আর আজকের নিরুপমার মধ্যে বিস্তর ফারাক। ভীষণ উচ্ছলতার জায়গা দখল করে আছে নিদারুণ নিরবতা।

কি হলো নিরু হয়েছে কি তোমার?নিজে দেখা করার জন্য পাগল হয়ে নিজেই আনমনা হয়ে আছো?
নিরু নিরুত্তর। অখিলেশ এগিয়ে গিয়ে কাঁধে হাত রাখতেই নিরু সর্ব শক্তি দিয়ে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিলো ।হঠাত এমন ধাক্কা সামলাতে দুই পা পিছিয়ে গেলো অখিলেশ। স্নেহের পরশ দিলো পিঠে।নিরুর ব্রহ্মতালুতে একটি চুমু খেয়ে তুথনী ঠেকিয়ে শুধোলো কোমল স্বরে,,কি হয়েছে আমার নিরু সোনার?
মনটা কি খুবই খারাপ?বাবা বলেছে কিছু আবারো?
বুকের পরেই দুদিকে মাথা নাড়ে নিরু। মুচকি হেসে পুনরায় বলে অখিলেশ,,

তাহলে এমন চুপচাপ ক্যানো হ্যা?

অখিল আমি তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি মানোতো?

মানে কি নিরু?আমি কি তোমাকে ভালোবাসি না?
নিরু মাথা উঠিয়ে অখিলেশের খোলা বুকে ঠোঁট ছোঁয়ায় পরম আবেশে।
আর কোন বাক্য ব্যয় করে না দু’জনে।নিরুর মুখটা দুহাতের আজঁলাতে তুলে নিয়ে তাকায় ওর পদ্মদিঘীর সচ্ছ জলের মতো চোখের গহীনে।কিছু একটার অভাব অনুভব করে অখিলেশ সেখানে। কিন্তু কি সেটা বুঝতে পারে না। নিরুকে জিজ্ঞেস করেও উত্তর মেলে না।ধীরে ধীরে ঘোলাটে হয় অখিলেশের চোখের কুচকুচে কালো মনি দুটি।নিরুর লিপিষ্টিক হীন হালকা গোলাপী আভা যুক্ত ঠোঁটে নিজের অধর ডুবিয়ে দেয়। তারপর দীর্ঘ চুম্বন।তার পর আরো গভীরে,আরো গহীনে। অবশেষে কষ্টসাধ্য পথ অতিক্রম প্রবেশ করে করে নাম না জানা এক সুখের দেশে।

এই অখিল তুই এখানে?আমি তোকে খুঁজে খুঁজে হয়রান।চল চল নিচে ষষ্টী চলছে।

নির্দয় ভাবে পনেরো মিনিটে ছয়টি সিগারেটের দেহ জ্বালিয়েছে অখিলেশ। কিন্তু কই তার অন্তরের দহন তো একটুও শিথিল হয়নি।মন থেকে একবারও মুছে যায়নি ঐ বড়লোকের বাপের বাধ্য গত মেয়েটির কথা। চোখের কার্নিশে জমে থাকা তরল পদার্থ টুকু বৃদ্ধাঙ্গুলি দ্বারা মুছে নেয় সন্তর্পনে।
বিরূপাক্ষের ডাকেই স্মৃতির ঝাঁপি বন্ধ হয় অখিলেশের।মাইকের মিডিয়াম ভলিউমে পুরোহিত ঠাকুরের স্পষ্ট মন্ত্রাচ্চোরণ ভেসে আসছে।
কি হলো ভাই চল না।দেখ তো ক্যামন ভিজে গিয়েছিস ?এখনো কার্তিক মাসের শুরু হয়নি তাতেই শিশিরের এই ঝরো ঝরো দশা, অগ্রহায়ণ,পৌষে কি হবে কে জানে?একা একাই কথাগুলো বলে গেলো বিরূপাক্ষ।অখিলেশের অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো মন্দিরে তারপর হ্যাচকা টানে বসিয়ে দিলো নিজের পাশে।ষষ্ঠীতে তেমন কেউ উপোস রাখে না তাই উপোবাসীর সংখ্যা নিতান্তই কম। অবশেষে পূজার সমাপ্তি ঘটে সেদিনের মতো।

রাত দশটা নাগাদ পূজা শেষে অনেকেই যে যার বাড়ির দিকে চলে গিয়েছে।রয়েও গেছে অনেকে। মন্দিরে এখন গান চলছে উচ্চ স্বরে।ঢাকের স্বর চাপা পরছে মাইক এবং সাউন্ড বক্সের বিকট শব্দে।ব্যান্ড পার্টির যে দুটো দল এসেছে তারা এখন নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাচ্ছে মন্দিরের পেছনে বৃহৎ হলঘড়ের ছোট্ট রুমটাতে। চারিদিকে ইট সিমেন্টের দেওয়াল আবৃত এ্যাডভেস্টার টিন সেডের বিশাল লম্বা হলঘড়।যেখানে পূজায় দর্শনার্থীদের প্রসাদ সেবনের ব্যবস্থা করা হয়।থরে থরে সাজানো কাঠের তৈরি চেয়ার টেবিল।সেই ঘড়ের এক পাশে দেয়াল উঠিয়ে রুমের মতো করা হয়েছে । পূজায় ঢাক বাজানো ঢাকী এবং অন্যান্য বাজনদারের শোয়ার ব্যবস্থা করা হয় এখানেই।অন্দরমহলে সবাইকে নেওয়া হয় না।

পূজা শেষে বাড়ির পুরুষেরা খেতে বসেছে ডাইনিংয়ে‌।রিতি সারাদিনে জল ছাড়া কিছুই খায়নি মাথাটা ঘুড়ছে, দুর্বলতা আছে কিছুটা।মুখটা শুকিয়ে গেছে একদিনের অনাহারে। অন্নপূর্ণা দেবী বুঝলেন সবটা সরলা,কাজলকে তাড়া লাগালেন সবাইকে খাবার দিতে আর নিজে ডাইনিংয়ের অদূরে মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে খেতে দিলেন রিতি সহ বাড়ির সকল মেয়েদের।রিতি এমন জায়গায় বসেছে বিরূপাক্ষ স্পষ্ট দেখছে তার পাতের দিকে।অল্পদুটো ভাত একটু আলু ভাজি আর সামান্য ডাল নিয়ে খেয়ে উঠলো রিতি। অন্নপূর্ণা দেবী বা জয়া হাজার অনুরোধ কিংবা শাসিয়ে ও আর একটা দানা মুখে দেওয়াতে পারলো না।

এতটুকু খেয়ে বাঁচে কিভাবে মেয়েটা?সাধে কি আর অমন তাল পাতার সিপাহি হয়েছে?মনে মনে ভাবলো বিরূপাক্ষ।অখিলেশ হালকা করে কনুই মারলো বিরূপাক্ষের গায়ে। হকচকিয়ে খাওয়ায় মনযোগ দিলো বিরূপাক্ষ। একসাথে সব পদ মেখে খেয়ে সেও উঠে গেলো সবার আগে।এমন জগাখিচুড়ি খাওয়া দেখে ভিমরী খাওয়ার অবস্থা অখিলেশ ও রঘুনাথের। বিরূপাক্ষ সবটা মিলিয়ে একসাথে খেলো বিশ্বাসই হলো না তাদের। নিশ্চয়ই ওর ঘাড়ে কোনো ভূত ভর করেছে, নির্ঘাত মেয়ে ভূত!মনে মনে কথাগুলো ভেবে একচোট হাসলো রঘুনাথ ।

অনেক রাত,দরজা খুলে নিজের শয়নগৃহে প্রবেশ করলো বিরূপাক্ষ। ডিনার সেরে অখিলেশ এর সাথে যখন একটু হাঁটতে গিয়েছিলো বাইরে তখন দেখেছিলো মন্দির প্রাঙ্গণে কয়েকটা চেয়ার বৃত্তাকারে সাজিয়ে গল্পে,হাসি ঠাট্টায় মেতেছিলো তিতলি,অহনা, রাহুল এবং রিতি পরে অবশ্য যোগ দিয়েছিলো জয়া।আড়চোখে দেখেছিলো বিরূপাক্ষ রিতির ক্লান্তিতে ঢুলু ঢুলু চোখ দুটো।মনে মনে বিরক্ত হয়ে বলেছিলো,গল্প খোরের শিরোমণি হয়েছে একটা। সারাদিনের অভুক্ত এখন গিয়ে ঘুমাবে তা না গল্প করছে। গল্প করার উপযুক্ত লোক পেলে কি আর শরীরের চিন্তা থাকে?
এখনো গল্প চলছে সেখানে কিন্তু রিতিকে অনুপস্থিত দেখে দ্রত পদে ঘড়ে ফিরেছে সে।মা ভেবেছিলো তাই হয়েছে।মেঝেতে গুটিসুটি মেরে ঘুমাচ্ছে রিতি। পরনের সেই সাজ সজ্জা আর নেই। সাধারণ একটা সুতির শাড়ি পরেছে তাতেই যেনো অপরুপ লাগছে।
শাড়িটা সামান্য উপরে উঠে ফর্সা সুগঠিত পায়ের গোড়ালির খানিকটা দেখা যাচ্ছে। বিরূপাক্ষ ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে হাঁটু ভেঙ্গে বসে পরে রিতির হালকা ঘুচিয়ে রাখা পায়ের কাছে।রিতির পায়ের কাছে নিজের একটা হাত নামিয়ে এনে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে একদৃষ্টে।অনেকটা ব্যাবধান দুজনের গায়ের রঙে।মৃদু হাসি ফুটিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে বিরূপাক্ষ,,আমি ভূল বলেছিলাম বুড়ি।তুই আমার থেকে অনেক ফর্সা।তুই নোস আমিই কালো রে।অপলক চেয়ে থাকে রিতির ঘুমন্ত মুখের দিকে।তিরতির করে কাঁপছে চোখের পাতা দুটো।গভীর ঘুমের ভারী নিঃশ্বাসের সাথে নাকের পাটা দুটো উঠছে নামছে।এক অপরিসীম মুগ্ধতায় ভরে যায় বিরূপাক্ষের সমগ্র হৃদয়।সেই অমোঘ মুগ্ধতার রেশ কাটে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখা ফোনে ম্যাসেজ আসার টুং টুং শব্দে।ঘোর কাটে বিরূপাক্ষের।দোনা মোনা করে ফোনে হাত রাখে।তখনো ডিস্পেলেতে আলোটা জলছে।বিরূপাক্ষের চোখ জ্বালা করে ওঠে ফোনের উপর ইংরেজি অক্ষরে রাহুল নামটা দেখে।অন্যের ফোন তার অনুমতি ব্যতিত ঘাটা অপরাধ জেনেও নিজের আঙুল ছোঁয়ায়।না বিশেষ কোন লক দেওয়া নেই।ওকে করতেই রাহুলের পাঠানো মেসেজটা ভেসে আসে।
সে লিখেছে,,”আমার পছন্দের তারিফ করতে ভুলোনা যেনো,শাড়িটাতে দারুন মানিয়েছে কিন্তু।আমি ধন্য যে তুমি ঐ শাড়িটাই পূজার প্রথম দিনে পরলে”
লেখার শেষে একটা লাভ ইমুজি দেওয়া।
বিরূপাক্ষের ভেতর প্রলয় বয়ে যায়।স্ক্রল করতে থাকে নিচ থেকে উপর।কত এস এম এস তার হিসাব নেই।রিতির প্রত্যেকটা লেখাতে রাহুলকে বাংলাদেশে আসার জন্য অনুরোধ।আর পড়তে পারে না বিরূপাক্ষ। হাতের মুঠোয় ফোনটা যেনো মিশিয়ে দিতে চাইছে ভেঙেচুরে। কিন্তু তাতে শুধু জড়বস্তুটার উপর অন্যায় অবিচার করা হবে আর কিছুই নয়।হাত থেকে ফোনটা রেখে ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে যায় ঘড় থেকে।এমন রাগের মানে সে বের করতে পারে না।রিতি কাউকে চাইলে তাতে ওর কি?
দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় চিলেকোঠার ছাদের দিকে। সেখানে শুয়ে তাঁরা গুনবে এলোমেলো ভাবে কিন্তু শেষ হবে না সেই গননা।আজ গা ভেজাবে শিশিরের জলে।দেহটা একসময় শীতলতায় ভরে উঠবে কিন্তু মনের মধ্যে যে অচেনা অজানা দহন জ্বালা তার কিঞ্চিত পরিমাণ কি খর্ব হবে?

চলবে,,,,
ভুল ত্রুটি মার্জনীয় ।
ভালো থাকবেন সবাই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here