#হুংকার
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_৪
উর্মি আর মোস্তফা হতাশ হয়ে হসপিটাল আসলো। এত কষ্ট করেও কোনো লাভ হলো না। রাবেয়া এখন কোমায়। তার সুস্থ হতে কতদিন লাগবে আন্দাজ করতে পারছে না। ইলিয়াস ও সুলতান সাহেব মিলে রমজান সাহেবকে জোর করে খাইয়ে দিচ্ছে। উর্মি এসে বাবার পাশে বসলে। সুলতান সাহেব মেয়েকে এক নজর দেখে বলল,
“কি হয়েছে মামনি?”
“বার বার হেরে যাচ্ছি আব্বু।”
“এতে মন খারাপ করার কি আছে? এখন হয়তো ভাগ্য খারাপ। কিন্তু এক না একদিন জয় তোমারই হবে।”
উর্মি বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার ভাগ্য কখনো ভালো হবে না আব্বু। জয় লাভ করার দিনটাই হবে আমার জীবনের সবচেয়ে কষ্টের দিন।”
সুলতান সাহেব আলতো করে মেয়েকে বুকের মাঝে ভরে নিলো। উনার স্ত্রী চলে যাওয়ার পর ছেলে মেয়েদের অনেক কষ্টে মানুষ করেছেন। তাদের কষ্ট দেখলে যে কলিজা ফেটে যায়।
রাবেয়াকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে। সকলে রাবেয়ার কেবিনে জমাট বেঁধেছে। উর্মি তাকিয়ে রইল রাবেয়ার দিকে। নিষ্পাপ বাচ্চাদের মতো চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। উর্মির ইচ্ছে করলো একবার তাকে ডাকতে। কিন্তু ডেকে লাভ নেই। রাবেয়া উঠবে না। ইলিয়াস এসে উর্মিকে বলল,
“খাবার নিয়ে আসিস নি? আংকেল ও আন্টিকে বাহির থেকে খাবার এনে খাওয়াতে হয়েছে।”
উর্মি ইলিয়াসের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আব্বুকে নিয়ে বাসায় চলে যাও। তুমি একটুও বিশ্রাম করো নি। তুমি আর আব্বু খেয়ে শুয়ে পরো। আমি আর মোস্তফা আছি হসপিটালে।”
ইলিয়াস জবাব দিলো না। দৃষ্টি ঘুরিয়ে রাবেয়ার দিকে তাকাল। রাবেয়ার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
“উর্মি ওকে ভালো মতো বুঝিয়ে বল, আমরা সবসময় ওর পাশে আছি। সকল বিপদ থেকে রক্ষা করবো আমরা ওর।”
“হয়তো রাবেয়া আমাদের সব কথা শুনছে ভাই।”
“তাই?”
ইলিয়াস মুচকি হেসে রাবেয়ার মাথায় আলতো করে হাত রেখে বলল,
“দিন দিন দুষ্টুমি বাড়ছে তোমার। একবার সুস্থ হয়ে নাও সব প্রতিশোধ একবারে তুলবো।”
“ভাই, সমাজের কাছ থেকে আমরা ওকে রক্ষা করতে পারবো তো?”
“পারবো, রাবেয়া জীবনযাপন করে দেখিয়ে দেবে সবাইকে। পথে ও একা থাকলেও ছায়া হয়ে তার সাথে থাকবো আমি। বিপদ তাকে ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখতে পারবে না। সমাজের বাজে লোকেরা আঙুল তোলার আগে তাদের হাত কেটে দেবো আমি।”
উর্মি অবাক হয়ে ইলিয়াসের দিকে তাকিয়ে রইল। ইলিয়াস উর্মির দিকে তাকিয়ে আবার বলল,
“আমার কথার মানে বুঝতে পারিস নি তো? কিছুক্ষণ ভাব বুঝে যাবি।”
উর্মির মুখে হাসি ফুটে উঠল। জড়িয়ে ধরলো ভাইকে।
“সব বুঝেছি ভাই সব বুঝেছি। তোমার মতো মানুষ যাতে প্রত্যেকের ঘরে জন্মায়।”
“হয়েছে হয়েছে, রাবেয়ার খেয়াল রাখিস আমরা আসছি।”
উর্মি ইলিয়াসকে ছেড়ে চোখের পানি মুছে মাথা নাড়াল।
.
.
ইজি চেয়ারে বসে একটার পর একটা সিগারেট শেষ করছে ইয়ামিন। গাড়ির হর্ণের শব্দ শুনে উঠে দাঁড়াল। ঘর থেকে বেরিয়ে দেখে দরজা দিয়ে বাবা প্রবেশ করছে। ইয়ামিন ঘরে এসে সিগারেট ফেলে পুরো ঘরে রুম স্প্রে ফিটিয়ে দিলো। যদিও বাবা তার ঘরে আসবে না সে জানে। ইলিয়াস এসে দরজায় টোকা দিলো। ইয়ামিন দরজার দিকে তাকিয়ে আবার ইজি চেয়ারে বসে পরলো।
“কিছু বলবে?”
“আপনি খাবার খান নি এখনো?”
“ক্ষুধা নেই। তুমি বাবাকে নিয়ে খেয়ে নাও। আর হ্যাঁ উনার ঔষধ এনেছি। ড্রয়ারে রাখা আছে। খাইয়ে দিও।”
ইলিয়াস হেটে এসে ইয়ামিনের পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“ভাইয়া আমাকে ক্ষমা করে দিন।”
“ক্ষমা চাচ্ছো কেন?”
“অনেক বাজে ব্যবহার করেছি আপনার সাথে।”
“সমস্যা নেই। যাও এখন গোসল করে খেয়ে নাও। তোমার শরীর থেকে মেডিসিনের গন্ধ আসছে।”
ইলিয়াস মাথা নাড়িয়ে চলে গেল। ইয়ামিন হেলান দিয়ে বসে লম্বা নিশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করলো।
রাবেয়ার পাশে বসে আছে উর্মি। পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাবেয়ার দিকে। ছোটোবেলা থেকে তারা বেস্টফ্রেন্ড। রাবেয়া তার ও মোস্তফার অনেক সাহায্য করেছে। যেমন তাদের ছাদে দেখা করানো। আবার গিফট আদান-প্রদান করে দেয়া। ইয়ামিন সবসময় উর্মিকে চোখে চোখে রাখতো। তাই রাবেয়া ও ইলিয়াস মিলে তাদের সাহায্য করতো। মোস্তফা উর্মির উদ্দেশ্যে বলল,
“খাবার নিয়ে এসেছি খেয়ে নাও।”
উর্মি মোস্তফার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ক্ষুধা পাচ্ছে না আমার।”
“তোমার কি অসুস্থ হওয়ার ইচ্ছে আছে?”
উর্মি না সূচক মাথা নাড়াল। মোস্তফা মুচকি হেসে বলল,
“তাহলে খেয়ে নাও। যাতে বিপদের সাথে সাহসী এবং শক্তিশালী হয়ে লড়তে পারো।”
“খাইয়ে দাও তাহলে।”
“ইশশ আহ্লাদী।”
উর্মি নিঃশব্দে হাসলো।
ইয়ামিন ঘর থেকে বের হলো। বাবার ঘরের সামনে গিয়ে আস্তে করে লক ঘুরিয়ে দেখে খোলা। উঁকি দিয়ে দেখে বাবা ঘুম। ইয়ামিন ধীরপায়ে হেটে গিয়ে বাবাকে এক নজর দেখলো। এসি অন কিন্তু বাবা চাদর উড়ে নি। এসি কিছুটা কমিয়ে বাবার গায়ে চাদর টেনে দিলো ইয়ামিন। জানালার পর্দা টেনে দিয়ে ডিম লাইন অন করে দিলো। ঘর থেকে বেরিয়ে আস্তে করে দরজা বন্ধ করে ইলিয়াসের ঘরে গেল। ইলিয়াসও বেখবর হয়ে ঘুমাচ্ছে। ইয়ামিন কিছুক্ষণ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। আলতো করে ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।
রাতেরবেলা……
ইয়ামিন ড্রইংরুমে বসে চা পান করছে। বাবা আর ইলিয়াস আসলো এগিয়ে। ইয়ামিন বাবাকে এক নজর দেখে সালাম দিলো। বাবা সালামের উত্তর নিয়ে বলল,
“হসপিটাল যাবে তুমি?”
“অফিসের কিছু কাজ আছে। সেটা কমপ্লিট করে যাবো।”
“ঠিক আছে, কিছু ফল কিনে নিয়ে যেও।”
“জি”
বাবা আর ইলিয়াস বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। ইয়ামিন চা শেষ করে তার অফিসের কাজে ব্যস্ত হয়ে পরলো।
বেশ কিছুক্ষণ পর মেসেজ টন বাজার শব্দ আসলো। ইয়ামিন তার পাঞ্জাবির পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখে ভয়েস মেসেজ এসেছে। মেসেজ অন করলো,
“কোথায় তুই? তোকে কল দিয়ে পাই না কেন?”
ইয়ামিন মেসেজটা শুনে টাইপ মেসেজ পাঠালো,
“বেশিরভাগ সময় হসপিটালে কেটে যায় আমার। সবাই সেখানে থাকে বলে তোর সাথে কথা বলতে পারি না?”
মেসেজ পাঠানোর সাথে সাথে একটা টাইপ রিপ্লাই আসলো,
“আচ্ছা রাবেয়ার কী খবর? তুই তো বলেছিলি ওর বাঁচার চান্স নেই।”
ইয়ামিন বিরক্ত হয়ে রিপ্লাই দিলো,
“তার মৃ*ত্যু কি আমার হাতে? এখন আমি ব্যস্ত আছি ডিস্টার্ব করিস না। আর যখন তখন কল মেসেজ দিবি না। সবাই বুঝে যাবে নয়তো।”
ইয়ামিনের মেসেজের রিপ্লাই আসলো,
“রাগ করিস না। আমার আসলে টেনশন হচ্ছে। যদি রাবেয়া বেঁচে যায় আমরা সবাই ফেঁসে যাবো।”
ইয়ামিন রিপ্লাই দিলো,
“আমি সব সামলে নেবো। তুই নিশ্চিন্তে থাক। যদিও ওর বেঁচে থাকার চান্স বেশি।”
রিপ্লাই আসলো,
“শা*লা তোকে বলেছিলাম মে*রে ফেল রাবেয়াকে। কিন্তু শুনিস নি আমার কথা। এখন লটকে থাক ভয়ের মাঝে।”
ইয়ামিন মেসেজটা দেখে লম্বা নিশ্বাস ফেলল। তার এখন রিপ্লাই দিতে ইচ্ছে করছে না। মোবাইল রেখে আবার কাজে মনোযোগ দিলো।
.
.
মোস্তফার হাতে হাত রেখে করিডরে হাঁটছে উর্মি। সময়টা এখন রাত সাড়ে ১২ টা। মোস্তফা কিছুক্ষণ পর চলে যাবে বাসায়। ততক্ষণ মন ভরে তার সাথে সময় কাটানো যাক। যদিও উর্মির মন এই কম সময়ে ভরবে না। মোস্তফা বলল,
“মনে আছে আমার বার্থডের দিন? তুমি দেয়াল টপকে বাসায় গিয়ে আমাকে সারপ্রাইজ দিয়েছিলে?”
উর্মি হেসে বলল,
“হ্যাঁ, ইলিয়াসের কাঁধে উঠে আমি দেয়াল টপকে ছিলাম। আর রাবেয়া দারোয়ান মামার উপর নজর রাখছিল যেন ঘুম থেকে উঠে না যায়।”
পুরানো স্মৃতি মনে শব্দ করে হাসলো দুজন। উর্মি হাসি থামিয়ে বলল,
“সেই দিন গুলো যত মধুর ছিল তাই না? ইদানীং দিনগুলো বিষাক্ত মনে হয়।”
মোস্তফা দাঁড়িয়ে উর্মির গালে হাত রেখে বলল,
“সব আগের মতো হয়ে যাবে। আমাদের শুধু ধৈর্য ধরতে হবে।”
“জানি না আর কতদিন ধৈর্য ধরতে হবে। মোস্তফা আমি যে কিছু করতে পারি রাবেয়ার ধ*র্ষককে শা*স্তি দেয়ার জন্য।”
“আমি জানি তুমি খুব সাহসী। আর আমি তোমার পাশে আছি সবসময়।”
তখনই পাশ থেকে ইলিয়াসের কন্ঠ ভেসে আসলো,
“আমিও আছি।”
উর্মি আর মোস্তফা ইলিয়াসের দিকে তাকাল। ইলিয়াস হাসিমুখে এগিয়ে এসে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“রাবেয়ার ধ*র্ষককে নিজের হাতে মা*রার ইচ্ছে আমার।”
উর্মি চোখ বড়ো বড়ো করে বলল,
“মে*রে তোমার জেল যাওয়ার ইচ্ছে না-কি? রাবেয়া সুস্থ হলে তার খেয়াল কে রাখবে শুনি?”
“তুই”
“পারবো না। তোমার আমানত তুমি তার খেয়াল রাখবে।”
মোস্তফা বোকাদের মতো তাকিয়ে তাদের কথা শুনছে। সব যেন তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। ইলিয়াস মোস্তফার চাহনি দেখে বলল,
“ভাইয়ার ফিউজ উড়ে গিয়েছে আমাদের কথা শুনে। তুই ভাইয়াকে বুঝিয়ে বল। আমি গিয়ে আব্বুর জন্য চা নিয়ে আসি। রাত করে উনার চায়ের নেশা উঠেছে।”
বলেই ইলিয়াস হাসতে হাসতে চলে গেল। মোস্তফা মাথা চুল্কাচ্ছে। উর্মি হেসে মোস্তফার কপালে টোকা দিয়ে বলল,
“বেশি ভেবো না। আমি যেমন তোমার আমানত রাবেয়া ইলিয়াসের আমানত।”
ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই মোস্তফা বলল,
“ইলিয়াসের আপত্তি নেই?”
“আপত্তি কেন থাকবে?”
“সে রাবেয়াকে সত্যি আপন করে নিতে চায়?”
“হুম, বলল তো আমায়। আশা করছি আমার ইলিয়াস ভাই যাতে ইয়ামিন ভাইয়ার মতো না হয়ে যায়।”
“হবে না। ইলিয়াস পুরো তোমার মতো হয়েছে।”
“হ্যাঁ আমরা জমজ বলে কথা। আমাদের ভাবনা চিন্তা খুব মিলে। জানো একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছিল একবার? ছোটোবেলায় একবার আমি সাইকেল চালাতে গিয়ে পড়ে ব্যথা পেয়েছিলাম হাঁটুতে। যতদিন আমার হাঁটুতে ক্ষত ছিল ঠিক ততদিন ইলিয়াসের পায়ের হাঁটুতে ব্যথা ছিল।”
“ভীষণ আশ্চর্যজনক বিষয়।”
“হ্যাঁ, আর জানো আব্বু বলে আমরা দুজন না-কি পুরো আম্মুর মতো হয়েছি। আজ আম্মু থাকলে হয়তো ইয়ামিন ভাইয়াও আমাদের মতো হতো।”
উর্মির গলা ধরে আসলো। ঢোক গিলে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। মোস্তফা উর্মিকে জড়িয়ে ধরলো। উর্মি নিঃশব্দে চোখের জল ফেলতে লাগলো মোস্তফার শার্ট আঁকড়ে ধরে।
.
.
ইয়ামিন ভেবেছিল হসপিটাল যাবে। কিন্তু কাজ করতে করতে সে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে খুব। ক্ষুধাও পেয়েছ। রান্না ঘরে গিয়ে দেখে কিছু নেই। ফ্রিজ খুলে দেখে প্লেটে তার জন্য খাবার রাখা। ইয়ামিন প্লেটটা বের করে ওভেনে খাবার গরম করে ডাইনিং টেবিলে এসে বসলো। খাওয়ার সময় তার মোবাইলে কল আসলো। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে রশিদ কল দিয়েছে। রিসিভ করে কানে ধরলো,
“বল”
“তুই বলায় রাবেয়াকে আমার ঘুমের ঔষধের উপর রাখতে হচ্ছে। তুই চাচ্ছিস কী বল তো?”
“একবারে যদি ম*রে যায় সবাই বলবে তুই ওর ভুল চিকিৎসা করায় ও ম*রে গিয়েছে। যা বলছি করতে থাক।”
“ইয়ার আমি আর মিথ্যে বলতে পারবো না কাওকে। রাবেয়া কোমায় যায় নি এটা যদি কেও জেনে যায় তখন?”
“আমি আবারো বলছি, যা বলছি তাই কর। আমি আগামীকালই এসে রাবেয়ার ব্যবস্থা করছি।”
“তোর কারণে সত্যিই মেয়েটা ম*রে যাবে। আমার অনেক খারাপ লাগছে তার জন্য।”
ইয়ামিন বিরক্ত হয়ে উঁচু স্বরে বলল,
“ক্ষুধার কারণে মাথা খারাপ হয়ে আছে আমার আর তুই আমাকে কল দিয়ে বেদনার গান শুনাচ্ছিস।”
“তো শোনাবো না? কেও যদি জানে আমি এসবে তোর সাথে সামিল। আমার এত বছরের কষ্ট সব ভেস্তে যাবে রে।”
“কিছু হবে না। আমি আছি। তুই শুধু খেয়াল রাখ রাবেয়া যাতে ঘুম থেকে না ওঠে।”
“আচ্ছা”
রশিদ কল কেটে লম্বা নিশ্বাস ফেলল। ড্রয়ার থেকে ঘুমের ইনজেকশন বের করে রাবেয়ার কেবিনের দিকে হাঁটা ধরলো।
.
.
খুব দেরিতে ইয়ামিনের ঘুম ভাঙলো। উঠে দেখে ১২ টা বাজে। কখনো এত দেরি করে ওঠে না সে। আজ অফিস যাওয়া হলো না। বসকে কল দিয়ে বলে দিলো আজ আসতে পারবে না। রাতে হসপিটাল যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু যায় নি। মোবাইল চেক করে দেখে বাবার ৪ টা মিসড কল। মোবাইল সাইলেন্ট করে রেখেছিল বলে বুঝতে পারেনি। আচ্ছা বাবা তো তাকে কখনো এতবার কল দেয় না।হঠাৎ এতবার কল দিলো কেন? রাবেয়ার কিছু হয়নি তো? ইয়ামিন বেশ কিছুক্ষণ বসে রইলো। হঠাৎ ভাবলো রাবেয়ার কিছু হলে রশিদ তাকে নিশ্চয়ই কল দিতো। লম্বা নিশ্বাস ফেলে বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো। ঘরে এসে জানালার পর্দা সরিয়ে দিলো। আজ আকাশে সূর্য দেখা যাচ্ছে না। ঘন কালো মেঘ। এবং কনকনে ঠান্ডা বাতাস চারপাশে। ইয়ামিনের শীত তাড়াতাড়ি লাগে। শীতে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে তার। দ্রুত হেটে এসে আলমারি থেকে পাঞ্জাবি বের করে পড়ে নিলো। তখনই তার মোবাইল বাজার শব্দ আসলো। দ্রুত গিয়ে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে বাবা কল করছে। কল রিসিভ করলো,
“আসসালামু আলাইকুম বাবা”
“কোথায় তুমি? সকাল থেকে তোমাকে কল দিয়ে পাচ্ছি না যে?”
“আজ ঘুম ভাঙতে দেরি হয়েছে।”
“অফিস যাও নি?”
“না, যেতে পারি নি।”
“যাক ভালো হয়েছে। রাতে তো আসো নি। নামাজ পড়তে যাবে যখন মনে করে কিছু টাকা মসজিদ এবং মাদরাসায় দিয়ে দিও। আর ইমাম সাহেবকে বলো রাবেয়ার জন্য দোয়া পড়াতে।”
“জি বাবা আমি এখনই গিয়ে বলছি।”
“ঠিক আছে”
বাবা কল কেটে দিলো। ইয়ামিন মোবাইল খাটের উপর রেখে ড্রয়ার থেকে কিছু টাকা বের করে নিলো। তখনই চারপাশে জোহরের আজান ভেসে উঠল। ইয়ামিন টুপি পকেটে রেখে আলমারির ড্রয়ার খুলল। কয়েকটার জামার নিচে একটা শাল পেল। শালটা হাতে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। হারিয়ে গেল অতীতের এক পৃষ্ঠায়…..
———
শীতকাল চলছে, ইয়ামিন ছাদে এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে। দুটো সিগারেট শেষ করলো। কিন্তু ভালো লাগছে না। তার দৃষ্টি বরাবর ছাদে। সেই ছাদে একটা দোলনা লাগানো। ইয়ামিন যখনই ছাদে আসে রাবেয়া সেই দোলনায় বসে থাকে। কখনো বসে মোবাইল দেখতে থাকে, কখনো বই পড়তে থাকে। বা কখনো বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু আজ দোলনাটা ফাঁকা। কারণ রাবেয়া নেই। তার বাবা মায়ের সাথে কক্সবাজার ঘুরতে গিয়েছে ১০ দিন আগে। আজ এসে পরার কথা। ইয়ামিন আর একটা সিগারেট বের করলো। দু ঠোঁটের মাঝে রাখতেই পেছন থেকে উর্মির কন্ঠ ভেসে আসলো,
“ভাইয়া নিচে চলুন আব্বু ডাকছে। আংকেল, আন্টি, রাবেয়া এসে পরেছে।”
ইয়ামিন সিগারেট আবার প্যাকেটের ভেতর রেখে দিলো উর্মির কথা শুনে। পকেটে রেখে ঘুরে উর্মির দিকে তাকিয়ে বলল,
“উনারা এসেছে তো আমি কি করবো?”
“আপনার কিছু করতে হবে না। আব্বু ডাকছে, চলুন।”
“বিরক্তিকর পাবলিক গুলো ফিরে এসেছে যত্তসব।”
ইয়ামিন বিড়বিড় করতে করতে ছাদ থেকে নেমে গেল। উর্মির দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছু করার নেই। তার ভাই এমনই।
ইয়ামিন হলরুমে আসলো। সবাই সেখানে বসে হাসিঠাট্টা করছে। বাবা ইয়ামিনকে দেখে ইশারায় বলল উনাদের সালাম জানাতে। ইয়ামিন উনাদের সালাম দিয়ে সোফায় বসে পায়ের উপর পা তুলল। রাবেয়া ভ্রু কুঁচকে ইয়ামিনের পায়ের দিকে তাকাল। ইয়ামিন বিষয়টা খেয়াল করলেও পাত্তা দিলো না। উর্মিও নেমে এসে রাবেয়ার পাশে বসলো। রাবেয়া হাসিমুখে বলল,
“ঠিক আছে, সবাই যেহেতু এসে পড়েছে তো এখন গিফট দেয়ার পালা।”
রাবেয়া উঠে লাগেজ টেবিলের উপর রেখে খুলল। এক এক করে সব শপিং ব্যাগ বের করে নাম দেখে দেখে সবাইকে দিলো। উর্মির জন্য থ্রি পিস, ম্যাচিং কানের দুল ও চুড়ি। ইলিয়াসের জন্য টি-শার্ট, প্যান্ট আর একটা ঘড়ি। সুলতান সাহেবের জন্য ঘড়ি ও পাঞ্জাবি সেট। ইয়ামিনের গিফট বের করে রাবেয়া চিন্তায় পরলো। ইয়ামিন নিবে তো? যদি ফিরিয়ে দেয়? ইয়ামিন মোবাইল গুতাচ্ছে বসে। রমজান সাহেব রাবেয়াকে ইশারায় বললেন ইয়ামিনকে তার গিফট দিতে। রাবেয়া মাথা নাড়িয়ে হেটে এসে ইয়ামিনের দিকে গিফট এগিয়ে দিয়ে বলল,
“এটা আপনার জন্য?”
ইয়ামিন চোখ তুলে রাবেয়ার দিকে তাকাল। রাবেয়া তার চাহনি দেখে ঢোক গিলে বলল,
“আপনার পছন্দের সম্পর্কে আমার ধারণা নেই। কি নেবো ভেবে পাই নি। মার্কেটে ঘুরাঘুরি করার সময় এই শালটা দেখতে পেলাম। মনে পড়লো আপনার ছোটোবেলা থেকে ঠান্ডার সমস্যা। শীতকাল চলছে তাই এটা আপনার জন্য নিয়েছি।”
ইয়ামিন রাবেয়ার পুরো কথা শুনে আবার মোবাইলের দিকে তাকিয়ে বলল,
“টেবিলের উপর রাখো। পরে দেখে নেবো।”
রাবেয়া ভেংচি কাটলো। ইয়ামিন আবার বলল,
“জোকারদের মতো মুখ বানিয়ে লাভ নেই। যা বলছি তা করো।”
রাবেয়া ইয়ামিনের পাশেই শপিং ব্যাগ ধপ করে রাখলো। ইয়ামিন তার ব্যবহার দেখে রাগী দৃষ্টিতে তাকাল। রাবেয়া বিরক্ত হয়ে গিয়ে উর্মির পাশে বসে পরলো। বড়োরা সামনে আছে বলে ইয়ামিন তাকে কিছু বলল না। দৃষ্টি ঘুরিয়ে আবার মোবাইলের দিকে তাকাল।
———
বর্তমান…..
ইয়ামিন শালটা ড্রয়ারে ছুঁড়ে রেখে ঘুরে মোবাইল আর গাড়ির চাবি নিয়ে হাঁটা ধরলো। দরজার সামনে গিয়ে থামলো। জানালা দিয়ে বাতাস ঢুকে পুরো ঘর ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। নিশ্চয়ই বাহিরেও খুব শীত। আবার হেটে এসে শালটা নিয়ে শরীরে পেঁচালো। তার অনুভব হচ্ছে রাবেয়া তার পাশে। হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছে। লম্বা নিশ্বাস নিয়ে ছাড়লো। ড্রয়ার বন্ধ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
চলবে……..