হুংকার পর্ব-৫

0
1246

#হুংকার
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_৫

মসজিদে প্রবেশ করলো ইয়ামিন। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি হচ্ছে। সবাই নামাজ পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইয়ামিন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে মাথা নিচু করে। কিছুক্ষণের মধ্যে নামাজ শুরু হলো। নামাজ আদায় করে ইয়ামিন ইমাম সাহেবের ঘরে গেল। ইমাম সাহেব বসে জিকির করছিলেন। ইয়ামিন দাঁড়িয়ে উনার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। বেশ কিছুক্ষণ পর উনি ইয়ামিনের দিকে তাকিয়ে ইশারায় কাছে ডাকলেন। ইয়ামিন কাছে গিয়ে মাথা নিচু করলো। ইমাম সাহেব ইয়ামিনের মাথায় হাত রেখে দোয়া করে দিলেন। ইয়ামিন সোজা হয়ে উনাকে সালাম জানালো। সালামের উত্তর নিয়ে ইমাম সাহেব ইয়ামিনকে বসতে বললেন। ইয়ামিন শালটা ভালো মতো পেঁচিয়ে বসলো। ইমাম সাহেব ইয়ামিনকে ভালো মতো দেখে বললেন,
“চিন্তিত দেখাচ্ছে তোমায়।”
ইয়ামিন উনার দিকে তাকিয়ে বলল,
“রমজান সাহেবের মেয়ে খুব অসুস্থ। আব্বু বলেছে তার জন্য দোয়া পড়াতে।”
ইয়ামিন পকেট থেকে টাকা বের করে উনার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
“কিছু টাকা পাঠিয়েছে মাদরাসার বাচ্চাদের ও মসজিদের জন্য।”
ইমাম সাহেব মুচকি হেসে টাকা নিয়ে পাশে রাখলেন।
“তোমার আব্বু কিছুদিন যাবত আসছেন না। ঠিক আছেন উনি?”
“রাবেয়াকে উনি খুব ভালোবাসেন। হসপিটালেই থাকে সারাদিন। পাশেই আর একটা মসজিদ আছে। সেখানেই নামাজ আদায় করে নেন।”
“যাক আলহামদুলিল্লাহ, আমি এখনই দোয়া পড়িয়ে দিচ্ছি।”
“জি, আজ আসি তাহলে।”
ইয়ামিন উঠে দাঁড়াল। কিন্তু মনে কয়েকটা প্রশ্ন ঘুরছে বলে যেতে পারছে না। ইমান সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
“কিছু বলবে?”
ইয়ামিন উনার দিকে তাকিয়ে বলল,
“কিছু জানার ছিল।”
“কি?”
“ভাবুন কেও একজন একটা ভুল করে ফেলল। না মানে, পাপ করে ফেলল তাও জেনে শুনে। তাহলে তার শা*স্তি কি হওয়া উচিত?”
“কেমন পাপ?”
“ধরুন সেই পাপের কারণে অন্য এক মানুষের জীবন নষ্ট হয়ে গেল।”
“প্রত্যেক পাপের শা*স্তি আছে। আর জেনেশুনে পাপ করলে শা*স্তি বেশ ভয়ংকর হয়। আল্লাহ তায়ালা খুব নারাজ হোন এতে।”
ইয়ামিন বেশ কিছুক্ষণ ইমাম সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইল। ইমাম সাহেবকে সালাম জানিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো। মসজিদ থেকে বেরিয়ে গাড়ির সামনে গেল। ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে। বৃষ্টি পরছে চারপাশে শীত কিন্তু ইয়ামিনের ভেতরে অস্থিরতা কাজ করছে। দ্রুত গাড়িতে উঠে বসলো। শাল খুলে মাথা ভালো মতো মুছে নিলো। পুরো শরীর তার কাঁপছে ঠান্ডায়। আবার দ্রুত শাল শরীরে জড়িয়ে সিটের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলো।
.
.
ধীরে ধীরে চোখ খুলল রাবেয়া। শুধু চোখ নাড়িয়ে চারপাশে তাকাল। কেও নেই আশে পাশে৷ হঠাৎ একজনকে দেখতে পেল। একজন পুরুষ মানুষ। সে ভয় পেয়ে গেল। মানুষটা বলল,
“শান্ত হও রাবেয়া। ভালো মতো দেখো আমি রশিদ। ভয় পেও না।”
রাবেয়া আবার চোখ চারপাশে বুলিয়ে বলল,
“আমার আম্মু কোথায়?”
“সারারাত উনি তোমার পাশে ছিলেন। এখন বিশ্রাম করতে গিয়েছেন।”
“আমার আব্বু এসেছিল আমাকে দেখতে?”
“হ্যাঁ, উনিও তোমার সাথে থাকে সবসময়। নামাজ পড়তে গিয়েছে।”
রাবেয়া রশিদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতে থাকতে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল। ঘুমের ইনজেকশনের পাওয়ারের কারণে রাবেয়া বেশিক্ষণ জেগে থাকতে পারবে না। রশিদ নিশ্চিন্তের নিশ্বাস ফেলল। মেয়েটাকে ইনজেকশন দিতে দিতে তার ভেতরে গিল্ট কাজ করছে।

রশিদ নার্সকে ডেকে রাবেয়ার খেয়াল রাখতে বলে কেবিন থেকে বের হলো। বের হতেই দেখে ইয়ামিন ধীরপায়ে হেটে আসছে। কিছুটা ভিজেছে ইয়ামিন। রশিদ হেটে গেল তার সামনে।
“তোকে কতবার বলবো বৃষ্টিতে ভিজতে না? নিউমোনিয়া হয়ে যাবে তো।”
“হবে না, রাবেয়ার কী অবস্থা?”
“ঘুম, সবাই জানে কোমায়। আচ্ছা এই কাজ কতদিন করতে হবে বল তো।”
“আজই হয়তো শেষ।”
“মানে? কী করবি তুই?”
“তোকে কেন বলবো?”
রশিদ চোখ ছোটো ছোটো করে ফেলল। ডাক্তার হয়েও তার সম্মান নেই। ইয়ামিন হেটে গেল নামাজ পড়ার জায়গায়। যেমনটা ভেবেছিল। উর্মি নামাজ পড়ছে। ইয়ামিন দাঁড়িয়ে রইল। উর্মি মোনাজাত শেষ করে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে ইয়ামিন দাঁড়িয়ে আছে। তার মন বলছিল তার ভাই এসেছে। উর্মি উঠে জায়নামাজ ভাজ করতে করতে এগিয়ে আসলো। ইয়ামিনের বরাবর দাঁড়িয়ে নিচু স্বরে বলল,
“কোথায় লুকিয়েছিলেন ব্যাগটা?”
“গাড়িতে”
“হুম, বাসা থেকে আসার পর মনে হয়েছিলে আমার একটা কিছু তো মিস করেছি। এখন বুঝলাম গাড়ি।”
“বুদ্ধি হাঁটুর নিচে থাকলে এমনই হয়। মোস্তফাকে বলে দিস তার পুলিশ বন্ধু কোনো কাজের না। সে পারবে না রে*পিস্টকে ধরতে।”
“সমস্যা নেই, আলী ভাইয়া না ধরতে পারলেও আমি ধরবো। একবার শিকার জালে ফাঁসুক, তাকে শা*স্তি দেয়ার দায়িত্ব তখন আমার।”
“ভেরি ভেরি অল দ্যা বেস্ট।”
“সময় আছে নিজের অপরাধ কবুল করে নিন।”
ইয়ামিন জবাব দিলো না। একরাশ বিরক্ত নিয়ে সেখান থেকে চলে গেল। উর্মি তাকিয়ে আছে ইয়ামিনের যাওয়ার দিকে।
.
.
ইলিয়াস হসপিটাল আসলো। রাবেয়ার কেবিনে উঁকি দিয়ে দেখে আসফিয়া বেগম রাবেয়ার পাশে বসে আছেন। ইলিয়াস ভেতরে গিয়ে আসফিয়া বেগমকে সালাম দিলো। আসফিয়া বেগম সালামের জবাব নিলেন। ইলিয়াস বলল,
“আন্টি, ওখানে একটা আরামদায়ক সোফা রাখা৷ আর আপনি এখানে বসে আছেন।”
“রাবেয়ার কাছ থেকে সরতে ইচ্ছে করে না বাবা। মনে হয় আমি সরে গেলেই আমার মেয়েটা হারিয়ে যাবে।”
“আপনি চিন্তা করবেন না। আমরা তাকে কোথাও হারাতে দেবো না। এখন আপনি গিয়ে সেখানে আরাম করে বসুন। আমি আছি রাবেয়ার পাশে।”
আসফিয়া বেগম দাঁড়িয়ে ইলিয়াসের গালে হাত রেখে বললেন,
“আফসোস হয় খুব। আমি কেন তোমার মতো একটা ছেলে পেলাম না।”
“আপনি কি আমাকে নিজের ছেলে ভাবেন না?”
আসফিয়া বেগম হাসিমুখে বললেন,
“হ্যাঁ ভাবি”
“তো এখন এই ছেলেটার উপর ভরসা রাখুন। আর গিয়ে আরাম করুন। আমি আছি।”
আসফিয়া বেগম গিয়ে সোফায় হেলান দিয়ে বসে পরলেন। ইলিয়াস বসলো রাবেয়ার কাছে। বেশ কিছুক্ষণ রাবেয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। ছোটোবেলায় স্লিপিং কুইনের সম্পর্কে পড়েছিল আজ রাবেয়াকে দেখে মনে হচ্ছে ঘুমন্ত রাজকন্যা। ইলিয়াস আলতো করে রাবেয়ার কপালে হাত রাখলো। হঠাৎ রাবেয়ার চোখের পাতা হালকা নড়ে উঠল। ইলিয়াস সাথে সাথে দাঁড়িয়ে গেল। ভালো মতো খেয়াল করলো। রাবেয়ার চোখ বন্ধ কিন্তু ভেতরে চোখ নড়ছে। ইলিয়াস দ্রুত গেল রশিদের পার্সোনাল কেবিনে।

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে রশিদ ইয়ামিনের দিকে তাকাল। ইয়ামিন আয়েস করে বসে আছে চেয়ারে। রশিদ কাপ রেখে বলল,
“কি করবি বললি না যে?”
ইয়ামিন রশিদের দিকে এক ভ্রু উঁচু করে তাকিয়ে বলল,
“বললাম না যখন করবো দেখে নিস।”
“দেখ ভাই আমার ভয় করছে। রাবেয়ার অবস্থা খুব খারাপ। কিভাবে ওর চিকিৎসা করছি একমাত্র আমি আর আল্লাহ তায়ালা জানেন।”
“তো করছিস কেন? ছেড়ে দে তার চিকিৎসা করা।”
“বলছিস কি? ম*রে যাবে চিকিৎসা না হলে।”
“তোর কি মনে হয় ওর অবস্থা কি বেঁচে থাকার মতো? সুস্থ হলেও মানুষের মুখে কথা শুনতে শুনতে ম*রেই যাবে।”
“তোর কি মনে হয় না তুই তোর মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলছিস।”
ইয়ামিন জবাব দিলো না। রশিদ আবার কিছু বলতে যাবে তার আগেই ধপ করে দরজা খুলে ইলিয়াস আসলো। দৌড়ে এসে রশিদের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“রাবেয়া নড়ছে।”
রশিদ চমকে ইয়ামিনের দিকে তাকাল। ইয়ামিন ভ্রু কুঁচকে ফেলল ইলিয়াসের কথা শুনে। রশিদ দাঁড়িয়ে ইলিয়াসকে বলল,
“ভুল হচ্ছে তোমার। রাবেয়া এখন কোমায়।”
“না, ও নড়ছে। আমি নিজে দেখেছি, আসুন আপনি আমার সাথে।”
রশিদকে নিয়ে ইলিয়াস দ্রুত গেল। ইয়ামিনের রাগ হচ্ছে। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলতে লাগলো। নিজেকে কোনো মতো স্বাভাবিক করে রশিদের চেম্বার থেকে বের হয়ে রাবেয়ার কেবিনে গেল। গিয়ে দেখে সবাই রাবেয়াকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। ইয়ামিন হাত মুঠো শক্ত করে ফেলল। রশিদকে সে বলেছিল রাবেয়া যাতে না ওঠে। এখন পরিস্থিতি কিভাবে সামলাবে সে?

রশিদ রাবেয়াকে ভালো মতো চেক করে দেখে রাবেয়া বেখবর হয়ে ঘুমাচ্ছে। নিশ্চিন্তের নিশ্বাস ফেলে বলল,
“কোমায় থাকা রোগীরা মাঝে মধ্যে চোখ নাড়ায়। শুধু তাই না মাঝেমধ্যে হাত পা পর্যন্ত নাড়ায়। আপনারা চিন্তা করবেন না। এটা ভালো লক্ষণ। রাবেয়া খুব তারাতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে।”
ইলিয়াস বলল,
“তার মানে ও কোমা থেকে বের হয়নি?”
“না”
উর্মি ইলিয়াসের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“মন খারাপ করিস না ভাইয়া। দেখবি রাবেয়া হঠাৎ আমাদের সারপ্রাইজ দেবে।”
ইলিয়াস উর্মির দিকে আহত দৃষ্টিতে তাকাল। উর্মি চোখের ইশারায় তাকে বলল শান্ত থাকতে। রশিদ হেটে আসলো ইয়ামিনের দিকে। ফিসফিস করে বলল,
“চিন্তা করিস না। কেও বুঝেনি। আমি সবাইকে বলছি কেবিনে ভীর না করতে। আর নার্সকে বলছি রাবেয়ার খেয়াল রাখতে।”
ইয়ামিন রশিদের কথা শুনে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। রশিদ সবাইকে বলল কেবিন খালি করতে। আসফিয়া বেগম অনুরোধ করায় শুধু উনাকে কেবিনে থাকার অনুমতি দিলো রশিদ। নার্সকে বলল রাবেয়ার উপর নজর রাখতে সে ঘুম থেকে উঠলে কেও যাতে টের না পায়। রশিদ আর ইয়ামিন আবার চেম্বারে ফিরে আসলো। রশিদ ধপ করে চেয়ারে বসে বলল,
“ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি। যাক ভালো হলো কেও বুঝতে পারেনি।”
ইয়ামিন রশিদের বরাবর বসে বলল,
“অনেক কষ্ট করেছিস আমার জন্য তোকে ধন্যবাদ।”
“ধন্যবাদ না দিয়ে তুই কি করতে চাচ্ছিস সেটা বল।”
“বুঝবি বুঝবি, সময় আসুক সব বুঝবি।”
.
.
উর্মির মানসিক যন্ত্রণা হচ্ছে খুব। কিছুই ভালো লাগে না তার। মনে হচ্ছে এখনই প্রাণ বেরিয়ে যাবে। মাঝেমধ্যে নিশ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হয় তার। সুলতান সাহেব খেয়াল করলেন উর্মির অবস্থা। দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মুখ দিয়ে ঘনঘন নিশ্বাস নিচ্ছে উর্মি। উনি দ্রুত রশিদকে ডাকলেন। রশিদ এসে উর্মিকে চেয়ারে বসিয়ে চেক করলো। প্রেশার একদম লো। আর দুশ্চিন্তা তাকে কাবু করে ফেলেছে।
সুলতান সাহেব কি করবে ভেবে পাচ্ছেন না। মোস্তফা কোথায় জানি গিয়েছে এখনো ফিরছে না। সে থাকলে উর্মিকে সামলাতে পারে। উর্মি সবাইকে টেনশন নিতে না বলে চুপচাপ বসে রইল। মাথা প্রচন্ড ব্যাথা তার। বেশ কিছুক্ষণ পর মোস্তফা আসলো। খুব গম্ভীর দেখাচ্ছে তাকে। সে এসে উর্মির সম্পর্কে জানলো। কিন্তু তেমন কিছু বলল না। উর্মি তার ভাবসাব দেখে অবাক হলো। মোস্তফা তার অসুস্থতার সম্পর্কে জানলে পাগল হয়ে যায়। আর এখন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সুলতান সাহেব মোস্তফাকে বললেন উর্মির পাশে থাকতে উনি রমজান সাহেবের কাছে যাচ্ছেন। মোস্তফা চুপচাপ এসে উর্মির পাশে বসলো। কিছুক্ষণ নিরব থাকার পর উর্মি বলল,
“কিছু হয়েছে মোস্তফা?”
মোস্তফা জবাব দিলো না। উর্মি আবার জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে বলো আমায়।”
মোস্তফা উর্মির দিকে তাকিয়ে বলল,
“সব বিষয় তোমার জানতে হবে?”
উর্মি অবাক হলো। মোস্তফা কথাটা শান্ত গলায় বললেও তার কন্ঠে ক্ষোভ অনুভব করলো উর্মি।
“না, ভাবলাম কিছু হয়েছে।”
“কিছু হলেই বা কি? ঠিক করতে পারবে তুমি?”
“এভাবে কথা বলছো কেন?”
“তো কি করবো? অযথা এত প্রশ্ন করো কেন?”
মোস্তফার চেহারা লাল হয়ে গিয়েছে। সে রাগ খুব কম করে। কিন্তু আজ হঠাৎ কী হলো উর্মি বুঝতে পারছে না। উর্মি মাথা নিচু করে বলল,
“আংকেল আন্টি কিছু বলেছে নিশ্চয়ই। একটা কথা বলি, তুমি আর হসপিটাল এসো না।”
মোস্তফা মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। উর্মি মোস্তফার হাত ধরে আবার বলল,
“সবসময় আমার পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ তোমাকে। আমি জানি তুমি অনেক কথার সম্মুখীন হচ্ছো কিছুদিন যাবত। যত পর্যন্ত এই সমস্যা সমাধান না হবে তুমি আর এসো না। আর যদি আংকেল আন্টি বলে আমার সাথে আর সম্পর্ক না রাখতে। তাহলে তুমি উনাদের কথার মতো চলবে। উনারা বললে আমি আংটি ফিরিয়ে দেবো।”
মোস্তফা নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। হাত আড়াআড়িভাবে ভাজ করে হেলান দিয়ে বসে চোখ বন্ধ করলো। উর্মি তাকাল মোস্তফার দিকে। সে বুঝতে পারলো তাদের সম্পর্কে ফাটল তৈরি হচ্ছে ধীরে ধীরে। কিন্তু তার করার কিছু নেই। ভাগ্যে যা আছে চুপচাপ মেনে নেবে৷ তার জন্য তার পরিবার আগে। রমজান সাহেব আর আসফিয়া বেগমের ঋণ সে কখনো শোধ করতে পারবে না। তার মায়ের মৃ*ত্যুর পর থেকে উনারা তাদের খেয়াল রেখেছে৷ উনাদের বিপদে তাদের পাশে থাকাটা জরুরি। উর্মি সোজা হয়ে বসে মাথা নিচু করে রাখলো।

ইয়ামিন করিডরে হাঁটছে। ঠান্ডা বাতাস গা ছুঁয়ে যাচ্ছে তার৷ রাত ১ টা বাজে। সুলতান সাহেব রমজান সাহেব আর উর্মিকে নিয়ে বাসায় গিয়েছেন। উর্মির শরীর অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তার বিশ্রাম প্রয়োজন৷ ইলিয়াস আর ইয়ামিন হসপিটালে রয়েছে। আসফিয়া বেগম রাবেয়ার কাছেই আছে। ইলিয়াস করিডরের চেয়ারে বসে ঝিমাচ্ছে। মোবাইল ভাইব্রেশন মোডে দেয়া। কল আসতেই ইয়ামিনের জামার পকেট কেঁপে উঠল। ইলিয়াসকে এক নজর দেখে তার দিকে পিঠ করে দাঁড়াল। পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখে স্ক্রিনে “জাহিদুর” নাম ভাসছে। ইয়ামিন কল কেটে মেসেজ পাঠাল,
“হসপিটাল আছি কথা বলতে পারবো না। যা বলবি মেসেজ করে বল আমি রিপ্লাই দিচ্ছি।”
জবাব আসলো,
“ঠিক আছে। তুই আমাদের রাবেয়ার আপডেট দিচ্ছিস না কেন?”
“যা বলেছিলাম তাই, আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলে রাজি করিয়েছি। সবাই জানে রাবেয়া কোমায়।”
“তুই কি প্ল্যান করেছিস তা তো বলছিস না।”
“বলবো না। প্ল্যান অনুযায়ী কাজ করে দেখাবো। তার মা সবসময় তার পাশে থাকে। তাই আমি কিছু করতে পারছি না।”
“ভাই আমার, তোকে বেস্ট আইডিয়া দেই। ডাক্তারকে টাকা দিয়ে বল রাবেয়াকে মে*রে ফেলতে। রাবেয়ার অবস্থা তো এমনিতেও ভালো না।”
“ইন্সপেক্টর আলীকে চিনিস না? সে-ই এই কেস নেবে। রাবেয়া হঠাৎ ম*রে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। কারণ পোস্ট ম*র্টেম তো নিশ্চয়ই করাবে।”
“শিট ইয়ার আমরা তো ভালো মতো ফাঁসবো।”
“তোরা আমার উপর বিশ্বাস করিস না?”
“করি, কিন্তু রিস্ক নিতে চাচ্ছি না।”
“এটা তো তাকে ধ*র্ষণ করার আগে ভাবিস নি।”
“ইয়ার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল রাবেয়াকে দেখে। আর এখন সব দোষ আমার উপর দিস না। তুইও সাথে ছিলি।”
ইয়ামিন এই মেসেজটার জবাব টাইপ করছিল তখনই পেছন থেকে ইলিয়াসের কন্ঠ ভেসে আসলো,
“ভাইয়া, কি করছেন এভাবে ঘুরে?”
ইয়ামিন কিছুটা চমকে উঠল। দ্রুত মোবাইল পকেটে রেখে ঘুরে দাঁড়াল। ইলিয়াস ইয়ামিনের ভাবসাব দেখে ভ্রু কুঁচকালো। ইয়ামিন চোখ মুখ শক্ত করে বলল,
“অফিস থেকে একটা মেইল এসেছে সেটাই চেক করছিলাম।”
“কিছু লুকাচ্ছেন।”
“কি লুকাবো শুনি?”
“আপনি আমার ভাই। আপনাকে ভালো মতো চিনি। সহজে ভয় পাওয়ার পাবলিক আপনি না। কিন্তু এখন ভয়ে কপাল থেকে ঘাম ঝরছে। অথচ এখনকার পরিবেশ বেশ ঠান্ডা।”
ইয়ামিন দ্রুত কপালের ঘাম মুছলো। শরীর থেকে শালটা খুলে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“তুমি আর তোমার আজগুবি কথা। শালটা খুব মোটা। আমার খুব গরম লাগছিল তাই ঘামছি। আর তোমার কি হয়েছে হঠাৎ? এত প্রশ্ন করছো কেন?”
“এইভাবেই, আমার ক্ষুধা পেয়েছে। কেন্টিনে যাচ্ছি। আপনি যাবেন?”
“না, তুমিই যাও।”
ইলিয়াস কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ইয়ামিনের দিকে। তার ইয়ামিনের ব্যবহার মোটেও স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। ভাবলো আর কথা বাড়াবে না। তাই পাশ কাটিয়ে চলে গেল। ইলিয়াস যেতেই ইয়ামিন লম্বা নিশ্বাস ফেলল। সত্যি ভয় পেয়ে গিয়েছিল সে। মোবাইলে মেসেজ আসলো আবার। ইয়ামিন চেয়ারে বসে আশে পাশে দেখে মোবাইল বের করলো। জাহিদুর আবার মেসেজ দিয়েছে।
“একটা কথা ভেবেছি জানিস। তোর বাবার বেশ নামডাক এলাকায়। যদি রাবেয়া আমাদের বিরুদ্ধে স্টেটমেন্ট দিয়ে দেয় তাহলে আমাদের সবাইকে এরেস্ট করে ফেলবে পুলিশ। তোর বাবা আর ভাই বোনের কি হবে? তারা সবাইকে মুখ দেখাবে কি করে ভেবেছিস? তোর হাতে ভালো সুযোগ আছে। সময় বুঝে রাবেয়াকে শেষ করে দে। একবার ভেবে দেখিস আমার কথাটা।”
ইয়ামিন মেসেজটা পড়ে বেশ কিছুক্ষণ মোবাইলের দিকে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ রাবেয়ার কেবিন খুলে আসফিয়া বেগম বের হলেন। ইয়ামিন উনাকে দেখে মোবাইল পকেটে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়াল। আসফিয়া বেগম ইয়ামিনকে বললেন,
“ইলিয়াস কোথায়?”
“কেন্টিন গিয়েছে।”
“রশিদ কি তার কেবিনে আছে?”
“হয়তো আছে। কিছু বলবেন আপনি?”
“হ্যাঁ তার সাথে কিছু কথা আছে। তুমি এখানেই আছো?”
“জি”
“কিছুক্ষণ থাকো আমি এখনই এসে পরবো।”
ইয়ামিন মাথা নাড়াল। আসফিয়া বেগম একবার ভাবলেন যাবে না। ইয়ামিনের উপর বিশ্বাস করা কি ঠিক হবে? কিন্তু উনার রশিদের সাথে কথা বলা জরুরি৷ ইয়ামিন আবার চেয়ারে বসে বলল,
“চিন্তা করবেন না। আমি যাব না কেবিনের ভেতরে। ইলিয়াস এসে পরবে তাকে পাঠাবো নি রাবেয়ার কাছে। আর ওইদিকে দেখুন সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো। আপনি পরে চেক করে নিয়েন আমি গিয়েছিলাম কি-না ভেতরে।”
আসফিয়া বেগম বিরক্ত হলেন। এই ছেলেটা সবসময় বেশি বেশি কথা বলে। তাই উনি পছন্দ করেন না তাকে। কিন্তু ইয়ামিন যা বলেছে ঠিক বলেছে। আর সাথে ভালো বুদ্ধিও দিয়েছে। উনি পরে নাহয় ফুটেজ চেক করে নেবেন। আসফিয়া বেগম রশিদের চেম্বারের দিকে হাঁটা ধরলেন। উনি যেতেই ইয়ামিন পকেট থেকে মোবাইল বের করে আবার মেসেজটা পরলো। মাথা ঝিমঝিম করছে তার। লম্বা নিশ্বাস নিয়ে ছাড়লো। উঠে দাঁড়িয়ে মোবাইল পকেটে রাখলো। শালটা শরীরে জড়িয়ে হাঁটা ধরলো রাবেয়ার কেবিনের দিকে।

চলবে…….

[রাবেয়াকে কি ইয়ামিন মে*রে ফেলবে? 🤔]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here