হৃদমাঝারে_আছো_তুমি চতুর্থ_পর্ব

হৃদমাঝারে_আছো_তুমি
চতুর্থ_পর্ব
#তাসনূমা_ফারেহীন

বাড়ি ফিরে অধরাকে অস্বাভাবিক ভাবে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে তারিনের হৃদস্পন্দন যেন একমুহূর্তের জন্য থেমে গেলো! অপ্সরাকে নিয়েই বাড়িতে ফিরে আসছিলো তারিন। বাড়ি ফিরার পর এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে তারিন বুঝতে পারছেনা তার কী করা উচিত। অপ্সরা তারিনের কিছুটা পেছনেই ছিলো। বাড়িতে ঢুকে মাকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে অনুমান করে নেয় কিছু একটা ঠিক নেই। হাতে থাকা চিপসের প্যাকেট এবং চকলেট গুলো ফেলে দৌড়ে ছুটে গেলো অধরার কাছে।

– ‘মা, তুমি অসময়ে ঘুমিয়ে আছো কেন? তুমি না বলেছিলে এটা পঁচা কাজ। দেখো, আন্টি আমাকে পঁচা লোকগুলোর কাজ থেকে নিয়ে এসেছে। মা, উঠো। আর কত ঘুমাবে।’

অধরার যে মারাত্মক কিছু হয়েছে তারিন খুব ভালো করেই তা বুঝতে পারছে। কিন্তু ছোট্ট অপ্সরাকে তা বুঝানোর মতো ক্ষমতা নেই তার। তারিন নিজেই তো বুঝতে পারছে না! কী থেকে কী হয়ে গেলো। কাল তো সবকিছুই ঠিক ছিলো তবে আজ কেন সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে!

বোধ ফিরে পাবার পর তারিন সাথে সাথেই অধরার কাছে ছুটে গেলো।

– ‘অধরা, এই অধরা?’

অপ্সরার মতোই তারিনের ডাকেও অধরা সাড়া দিলো না। এক ফোঁটা অশ্রুজল অচিরেই গাল বেয়ে নিচে গড়িয়ে পড়লো। সে দ্রুত হাতের পিঠে তা মুছে নেয়।

তারিন উঠে দাঁড়ায়। এভাবে বসে বসে অশ্রুজল ফেললে সে অধরাকে বাঁচাতে পারবেনা। অধরাকে দ্রুত হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। অধরার চিকিৎসার প্রয়োজন। কিন্তু একা হাতে তারিন সবকিছু কী করে সামলাবে?

তারিন যখন সবকিছু নিয়ে চিন্তামগ্ন তখনি রায়হানকে তারিনের পেছন থেকেই ঘরে প্রবেশ করতে দেখে তারিন বেশ অবাক হলো। তার তো এখন হোটেলেই থাকার কথা! আর তারিন যে ডক্টরকে কল করেছিলো তাঁরও এতক্ষণে চলে আসার কথা। তাহলে তিনি এখনো আসেননি কেন? আর রায়হানই বা কোথায় গিয়েছিলো।

তারিনের মনে যখন নানা প্রশ্নের উদয় হতে থাকে তখনি রায়হান যা বললো তাতে তার মনের ভাবনা সমূহের অবসান ঘটলো।

– ‘তারিন, তুমি এসেছো? তোমায় বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। আসলে, তুমি যে ডাক্তারকে আসতে বলেছিলে তিনি রাস্তায় একটি এক্সিডেন্টে গুরুতর ভাবে আহত হন। আমি তার সাথেই দেখা করতে গিয়েছিলাম। সরি, সেসময় তোমাকে জানিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিলাম।’

তারিনের পেছনে অধরার দিকে দৃষ্টি গেলে রায়হান বিস্ময় প্রকাশ করে বললো,

– ‘আরেহ্! অধরার কী হয়েছে? তিনি এখানে এভাবে পড়ে রয়েছেন কেন? আর তার মাথায় এই চোট কিসের? তারিন কী হয়েছে? সবকিছু আমায় খুলে বলো, সোহান কিছু করেছে?’

রায়হানের কথায় তারিন অধরার কপালে তাকিয়ে দেখলো, আসলেই অধরা সেখানে চোট পেয়েছে। এক মুহূর্তেও দেরি না করে বললো,

– ‘এখন এত কথা বলার সময় নেই। আমাদের দ্রুত অধরাকে হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। ড্রাইভারকে বলো দ্রুত গাড়ি বের করতে।’

রায়হান ড্রাইভারকে কল করে গাড়ি বের করার নির্দেশ দিলো। অধরাকে দ্রুত নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যায় তারা। নার্স এসে দ্রুত অধরাকে হসপিটালে নিয়ে গেলো।

– ‘মাথায় জোরে আঘাত পাবার কারণে পেশেন্টের মাথার একটি নার্ভে আঘাত লেগেছে। যার ফলে পেশেন্ট এর জ্ঞান ফিরছে না।’

– ‘ডক্টর প্লিজ কিছু করুন। দ্রুত অধরার জ্ঞান ফিরিয়ে আনুন। তার পাঁচ বছরের একটি বাচ্চা মেয়ে আছে! যে এখন তার মাকে পাগলের মতো খুঁজছে।’

– ‘আমাদের হাতে আর কোন কিছুই নেই। আঘাতটা মাথায় খুব গভীরে প্রভাব ফেলেছে। অধরার যেকোনো সময় জ্ঞান ফিরতে পারে, আবার এমনো হতে পারে কখনোই ফিরবে না। এখন বাকি উপরে যিনি রয়েছেন তাঁর ইচ্ছা।’

তারিন প্রচন্ড ভেঙ্গে পড়ে। ডাক্তার পুনরায় বললেন,

– ‘সরি মিস্ তারিন। বাট উই আর হেল্পলেস। ডাক্তারি ভাষায় একে কোমা স্টেজ বলে।’

অধরা কোমা স্টেজে রয়েছে, ডাক্তারের কথা শুনে এক মুহূর্তের জন্য তারিনের চারপাশে যেন অন্ধকার নেমে আসে।

তারিনের চোখে কেবল অধরার মুখটিই ভাসছে। দেখে মনে হচ্ছিল যেন অধরা ঘুমিয়ে আছে। কেন যেন সবকিছুর জন্য তারিনের মন সোহানকেই দায়ী করছে। হঠাৎ রায়হান তারিনের কাঁধে হাত রেখে বললো,

– ‘চিন্তা করো না, সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি বাড়ি গিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নাও। তোমাকে প্রচুর ক্লান্ত দেখাচ্ছে। এদিকটা আমি সামলে নেবো।’

তারিন প্রথমে যেতে চাইলো না। রায়হান তবুও তাকে জোর করে পাঠিয়ে দিলো। তারিন বাড়ি এসে দেখে অপ্সরা ঘুমিয়ে রয়েছে। কী নিষ্পাপ লাগছে দেখতে। অপ্সরা খানিকটা তার মায়ের চেহারা পেয়েছে। তাই তাকে দেখে তারিনের পুনরায় অধরার কথা মনে পড়লো। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে তারিন। অপ্সরার কপালে চুমু দিতে গেলে এক ফোঁটা চোখের জল এসে অপ্সরার গালে পড়লো। তারিন উঠে চলে যেতে নিলেই অপ্সরা তারিনের হাত ধরে বললো,

– ‘আন্টি, মা কোথায়? তুমি মাকে সাথে করে আননি কেন?’

অপ্সরার মাথায় হাত বুলিয়ে তারিন চেষ্টাপূর্বক মুচকি হেসে বললো,

– ‘তোমার মা তো পরীদের রাজ্যে গিয়েছে। তোমার না চকলেট অনেক প্রিয়? খুব তাড়াতাড়ি অনেকগুলো চকলেট নিয়ে ফিরে আসবে তোমার মাম্মাম্।’

– ‘আমার চকলেট চাইনা। মাকে বলো এখনি ফিরে আসতে।’

তারিনের বুক হাহাকার করে উঠে। এই নিষ্পাপ শিশুটিকে সে কী করে বুঝাবে তার মা কোথায় আছে। অনেক কষ্টে নিজের কষ্ট চেপে রেখে বললো,

– ‘আচ্ছা বাবা। তোমার চকলেট লাগবে না। এবার তুমি গুড গার্লদের মতো খাবারটুকু খেয়ে নাও তো!’

– ‘আগে মাকে নিয়ে আসো, আমি মায়ের হাতেই খাবো। নয়তো আমি খাবোনা।’

তারিন কিছুতেই অপ্সরাকে রাজি করাতে পারছেনা। একমাত্র তারিন জানে তার মনের ভেতর দিয়ে কী বয়ে চলেছে।

– ‘বন্ধু ঠিক বলেছিলো, আন্টি খুব পঁচা। তুমি তুমি তুমি খুব পঁচা আন্টি। প্রথমে আমার বন্ধুকে আমার থেকে কেড়ে নিলে আর এখন মাকে নিয়ে আসছো না।’

তারিন অবাক হয়ে বললো,

– ‘বন্ধু? কোন বন্ধু?’

– ‘আরে ঐ ভালো আংকেলটা। যাকে তুমি পঁচা লোকদের মতো পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিলে।’

– ‘ও মোটেও ভালো নয়, ঐ লোকটা খুব পঁচা। তাইতো তোমাকে কিডন্যাপ করেছিলো। আর তুমি ওকে আর বন্ধু বলবে না। সে কারো বন্ধু হবার যোগ্য নয়।’

অপ্সরা পুনরায় বলতে নিলো,

– ‘বন্ধু মোটেও পঁচা লোক নয়। বন্ধু-ই তো আমাকে…’

অপ্সরা কথাটি শেষ করার আগেই সেখানে রায়হানের আগমন ঘটলো। অপ্সরাকে কোলে নিয়ে বললো,

– ‘মায়ের সাথে দেখা করতে চাও?’

অপ্সরা উচ্ছাসিত কন্ঠে বললো,

– ‘হ্যাঁ…!’

– ‘বেশ। আমি তোমাকে তোমার মায়ের কাছে নিয়ে যাবো। তবে একটি শর্তে! আগে তোমাকে এই পুরো খাবারটুকু শেষ করতে হবে।’

রায়হানের কথা অনুযায়ী অপ্সরা সত্যিই পুরো খাবারটুকু শেষ করে নিলো। তারিন নিরব দর্শকের মতো রায়হানের পরম যত্নে অপ্সরাকে খাইয়ে দেবার দৃশ্য দেখতে লাগলো। রায়হান কত স্নেহ করে অপ্সরাকে! দেখে বুঝাই যায় না যে ওরা বাবা-মেয়ে না! কিন্তু সম্পর্কটা ঠিক এরকমই।

অপ্সরার খাওয়া শেষে মাকে দেখার বায়না ধরলো। তারিন বললো,

– ‘অপ্সরাকে এভাবে মিথ্যে বলাটা কী ঠিক হলো? আমরা তো অধরার সাথে অপ্সরার দেখা করাতে পারবো না! মিথ্যে আশ্বাস দেয়ার ফলে অপ্সরার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না তো?’

রায়হান তারিনকে চোখে ইশারা করে নিশ্চিন্ত থাকতে বললো। তারপর অপ্সরাকে নিয়ে একটি ঘরের সামনে গেলো। রায়হানের পেছন পেছন তারিনও আসতে লাগলো। রায়হান বললো,

– ‘অপ্সরা মামনি, তোমার মাম্মাম্ তো এখন গভীর ঘুমে আছে। তাই তুমি ডাকলে তার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটবে। যা তোমার মাম্মামের জন্য ক্ষতিকর। তুমি কী তা চাও।’

অপ্সরা না-বোধক মাথা নাড়ে। যার অর্থ সে চায়না তার মায়ের কোন ক্ষতি হোক। রায়হান বললো,

– ‘বেশ। তোমাকে আমি তোমার মায়ের কাছে নিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু মাকে ডাকা চলবে না। কেমন?’

– ‘আচ্ছা।’

অপ্সরা মুখে অঙ্গুল দিয়ে রাখলো। রায়হান অপ্সরাকে তার মায়ের কাছে নিয়ে গেলো। তারিন কেবল সবকিছু দেখেই চলেছে। রায়হান এই জটিল বিষয়টিকে কত সহজভাবে অপ্সরাকে উপস্থাপন করলো। মা-কে এক ঝলক দেখতে পেয়ে অপ্সরার চোখে আনন্দের ঝিলিক দেখা যাচ্ছে! তারিনের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। উড়নার সাহায্যে মুখ চেপে ধরে নিজের চিৎকারকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করে।

রায়হান অপ্সরাকে ঘুম পাড়িয়ে দিলো। তারপর তারিনকে বললো,

– ‘ডাক্তার বললো, অধরাকে হসপিটালে রাখার প্রয়োজন নেই। পেশেন্টের জ্ঞান ফিরলে এভাবেই ফিরে আসবে। আমি ঘরেই অধরার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি। সাথে একজন নার্স আছেন। তিনিই অধরার দেখাশুনো করবেন। চিন্তা করো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।’

তারিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘আমাদের হোটেল থেকে বাড়ি ফিরে যাওয়া উচিত। তুমি সবকিছুর ব্যবস্থা করো।’

রায়হান বললো,

– ‘অবশ্যই! তবে তার আগে আমায় আরো একটি কাজ করতে হবে।’

– ‘কী কাজ?’

– ‘সোহানের এমন শাস্তির ব্যবস্থা করবো, যাতে সে কখনো কারাগার থেকে বেরোতে না পারে!’

তারিন বললো,

– ‘না, রায়হান। তুমি এমনটি করবেনা। আইন সোহানকে তার যথাযোগ্য শাস্তি দিবে। আর…’

রায়হান তারিনকে থামিয়ে বললো,

– ‘তারিন…! তুমি আমার হবু স্ত্রী! অন্য কারো হবু স্ত্রী হওয়া সত্বেও তোমার সোহানের প্রতি আকুলতা মানায় না!’

তারিন দৃঢ় কন্ঠে বললো,

– ‘আমার কথা এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি রায়হান! সোহানকে তুমি নও এবার আমি শাস্তি দেবো!’

চলবে…

[ কোমা স্টেজ সম্পর্কে আমার তেমন বিশেষ কোন ধারণা নেই। তবুও গল্পের স্বার্থে নিজের জানামতে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি। রিচেইক দিতে পারিনি। ভুল-ত্রুটি মার্জনার দৃষ্টিতে দেখবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here