হৃদমাঝারে_আছো_তুমি
পঞ্চম_পর্ব
#তাসনূমা_ফারেহীন
– ‘ইডিয়ট! তোদের প্রত্যেকে এক একটা স্টুপিড। একটি বাচ্চা মেয়েকে শেষ করার কাজ দিয়েছিলাম সেটাও পারিস নি! আবার এসেছিস বড় মুখ করে নিজেদের অপারগতার খবর দিতে!’
কালো পোশাক পরিহিত উল্টো দিকে ঘুরে কথা বলছে কেউ একজন। পুরো ঘর জুড়ে কেবল অন্ধকার! ঘরের জানালার ফাঁক দিয়ে আলোকরশ্নি এসে প্রবেশ করেছে ঘরে। সেই আলোতেই আবছা বুঝা যাচ্ছে লোকটি কালো হ্যাট পড়ে আছে!
অন্ধকারে তেমন কিছুই আর দেখা যাচ্ছে না। কালোর আবরণে যেন সে অদৃশ্য হয়ে আছে। তবে কন্ঠস্বরের দৃঢ়তা দেখে বুঝা গেল কোন কারণে সে বেশ রেগে আছে। লোকটির ধমকের স্বরে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দে ফোনের অপরপাশের ব্যাক্তি কেঁপে উঠলো যেন।
– ‘আমি আমার পথে কোন কাঁটা রাখি না। কাঁটা পায়ে বিঁধার অনেক পূর্বেই তা পথ থেকে সরিয়ে ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেই। আর এই কাজের জন্যই তোদের খাইয়ে দাইয়ে পালন করছি। আর তোরা কিনা একটা সামান্য কাজ করতে পারলি না!’
লোকটির কন্ঠ ধীরে ধীরে আরো ভয়ংকর হয়ে উঠছে যেন! ফোনের অপর পাশ থেকে ভীতু স্বরে একটি কন্ঠ ভেসে আসছে,
– ‘সরি বস, আর কখনো এমন হবে না। এবার একটুর জন্য বাচ্চাটা আমাদের হাত ফসকে পালিয়ে গিয়েছিলো। তন্য তন্য করে খুঁজেও মেয়েটিকে আর খুঁজে পাইনি। যখন মেয়েটিকে পাহাড়ে খুঁজোখুঁজি করছিলাম, হঠাৎ এক যুবক এসে আমাদের প্রচুর মারে। আমাদের ধারণা, সেই মেয়েটিকে আজ বাঁচিয়ে দিয়েছে।’
লোকটি পুনরায় গর্জে উঠে বললো,
– ‘সাট আপ! স্টুপিড কোথাকার। এই দিনের জন্য তোদের খাইয়ে-পোষে পালছিলাম আমি! এতগুলো লোক মিলে একটা লোককে শায়েস্তা করতে পারলি না! উল্টো গরুর মতো চুপচাপ মার খেয়ে এখন আবার আমাকে বলছিস! ফোন রাখ।’
অপরপাশ থেকে কলটি সাথে সাথেই কেটে গেলো। নয়ত তার কপালে আজ অনেক দুঃখ ছিলো।
ফোনটিকে সর্বশক্তি দিয়ে দূরে ছুড়ে মেরে লোকটি বলে উঠলো,
– ‘সোহান!! আমি খুব ভালো করেই জানি ওটা তুমিই ছিলে। আমার পরিকল্পনায় বাঁধা দিয়ে তুমি মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছো! এর পরিণতি তোমাকে ভোগতেই হবে! ভোগতেই হবে।’
দাঁতে দাঁত চেপে কথাগুলো বলে লোকটা বেশ জোরে জোরে পাগলের মতো হাসতে শুরু করলো!
তারিন জানালার পাশে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ঝিরিঝিরি ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। বাতাসের দরুণ বৃষ্টির কিছু ফোঁটা এসে তারিনকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। মুখে বিন্দু বিন্দু পানি জমে বেশ লাবণ্যময়ী লাগছে তাকে। তারিনের সেদিকে কোন খেয়াল নেই। সে গভীর ভাবনায় মগ্ন। অনেক রকম চিন্তা, নানান ভাবনা ক্রমাগত ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়। যেন মনের সাথে বেশ বড়সড় কোন যুদ্ধ চলমান। রায়হানের ডাকে তারিনের ভাবনার অবসান ঘটলো।
– ‘বাড়ি ফেরার সকল ব্যবস্থা সম্পন্ন হয়েছে। এখন কেবল আমাদের রওনা হওয়া বাকি।’
– ‘বেশ। তবে তোমরা রওনা হও…!’
– ‘না, আকাশের অবস্থা তেমন ভালো না, বৃষ্টি ক্রমশ বাড়ছে। এমন অবস্থায় পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফেরা বিপজ্জনক। আমাদের বৃষ্টি থামা অবদি অপেক্ষা করতে হবে।’
– ‘আচ্ছা। তাহলে বৃষ্টি কমে গেলেই রওনা দিও।’
– ‘তুমি কি কোথাও যাচ্ছো, তারিন?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘কিন্তু এরকম আবহাওয়ায় বাহিরে বেরনো কি ঠিক হবে? আর তুমি যাচ্ছো-ই কোথায়?’
– ‘তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য আমি বাধ্য নই রায়হান। তুমি ভালো করেই জানো, আমি কখনোই কাউকে বলে কিছু করিনা।’
তারিন তার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো।
– ‘এতদিন ভাবতাম তুই একজন পারফেক্ট বেস্টফ্রেন্ড। এখন দেখছি কেবল বন্ধুত্ব পালনে নয়, ভালোবাসার অপেক্ষায় ধৈর্য ধারণের ক্ষেত্রেও তুই কোন কমতি রাখছিস না। একটা মানুষ এত ধৈর্যশীল কী করে হয়! আমি ভেবে পাই না।’
মিয়াজের কথায় সোহান খানিক হাসলো। মুচকি হেসে বললো,
– ‘ইয়ার! ভালোবাসায় সবই সম্ভব। তুই কাউকে ভালোবাসলে বুঝবি।’
মিয়াজ বিরক্তি-মাখা কন্ঠে বললো,
– ‘হ্যাঁ, এখন আমি তা খুব ভালোভাবেই টের পাচ্ছি। তোকে ভালোবাসি বলেই তো আজ তোর ব্যথাগুলো আমিও অনুভব করি। বজ্জাত গুলো কী বাজে ভাবে পিটিয়েছে তোকে। তোর এসব আবেগপ্রবণ কথা ছাড়। ভেবে পাচ্ছিনা তুই এতগুলো মার কী করে সহ্য করছিস? তোর কী আঘাত অনুভূতও হয়না? এখন বলিস না, ভালোবাসা সকল ব্যথা ভুলিয়ে দেয়। তোর সব ইমোশন তোর কাছেই রাখ।’
সোহান পুনরায় বললো,
– ‘মিয়াজ! আমিও মোটেও তা বলিনি। আঘাত তো প্রচুর পেয়েছি। কিন্তু সবচেয়ে বেশি কষ্ট লেগেছে এটা দেখে যে তারিন আমাকে বিশ্বাস করেনি!’
মিয়াজ পুনরায় রাগী স্বরে বললো,
– ‘তবুও তো তার অপেক্ষায় এখানেই পড়ে রয়েছিস।’
সোহান কেবল মুচকি হাসলো। আর কিছু বললো না। সোহানকে কিছু বলতে না দেখে মিয়াজ-ই পুনরায় বলে উঠলো,
– ‘ইয়ার! সেসময় কী হয়েছিলো আমায় একটু খুলে বলতো। পুলিশ তোকে এরেস্ট করলো কেন আর তারিনই-বা কেন তোকে অবিশ্বাস করলো?’
সোহান মিয়াজকে সকাল থেকে তার সাথে যা কিছু ঘটেছে সবকিছু খুলে বলতে শুরু করলো। সবকিছু শুনে মিয়াজের বিস্ময়ের মাত্রা আরো বেড়ে গেলো।
নার্স ভালোভাবেই অধরার দেখাশুনো করছে। রায়হান নার্সের সাথে কথা বলে নিয়েছে, তাদের সাথে অধরার দেখাশুনো করার জন্য নার্সকেও তাদের বাড়ি যেতে হবে।
অধরার সাথে আবার দেখা করিয়ে এনে নিজ হাতে অপ্সরাকে খাবার খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে রায়হান। বর্তমানে সে তার রুমে অবস্থান করছে। কেন যেন আজ তারিনের উপর রায়হানের প্রচুর রাগ উঠছে। রাগের বসে পাশে টেবিলে রাখা ফুলদানিটা ধাক্কা দিয়ে জোরে ফ্লোরে ফেলে দিলো। শব্দ শুনে একজন স্টাফ দ্রুত সেখানে ছুটে এলো। রায়হান হুংকার দিয়ে বললো,
– ‘কেন এসেছ এখানে? এক্ষুণি এখান চলে যাও।’
স্টাফটি আর কিছু না বলেই সেখান থেকে দ্রুত প্রস্থান করলো। রায়হান ভাঙ্গা ফুলদানির টুকরো গুলো হাতের মুঠোয় নিয়ে মুষ্টিবদ্ধ করলো। হাত কেটে রক্ত গ ড়িয়ে পড়ছে। রায়হান বললো,
– ‘তারিন শুধু আমার।’
রায়হান তৎক্ষণাৎ কাউকে ফোন দিলো। কিছুক্ষণ কথা বলার পর ফোন রেখে দিয়েই রায়হান হেসে উঠলো। তারপর রায়হান বেরিয়ে পড়লো।
– ‘এতকিছু ঘটে গেলো, আর তুই আমায় সবকিছু এখন বলছিস!’
– ‘তোকে জানানোর সময় পেলাম কই? মেয়েটিকে লোকগুলোর থেকে সুরক্ষিত করার সাথে সাথেই তো পুলিশ এসে আমাকে মিথ্যে অভিযোগে থানায় নিয়ে এলো।’
– ‘তুই কেন শুধু শুধু ঐ গুন্ডাদের সাথে পাঙ্গা নিতে গেলি? ওরা তোর ক্ষতি করতে পারতো। তাছাড়া তাদের সাথে মার-ধোর করার ফলে ওরা পরবর্তীতে তোর উপর প্রতিশোধ নিতে পারে। তুই কেন শুধু শুধু রিস্ক নিতে গেলি? তাও আবার এমন একজনের জন্য যাকে বাঁচানোর কারণে তোকে জেলে পঁচে মরতে হচ্ছে।’
– ‘কাউকে বাঁচানোর জন্য আমাকে গ্রেফতার করা হয়নি। একটি ভুল বুঝা-বুঝির কারণে আমাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’
– ‘এটা মোটেও ঠিক হয়নি। তুই এখনো বসে থাকবি? কেন তুই বিনা-দোষে চৌদ্দ শিকের পেছনে দিন কাটাচ্ছিস?’
সোহান পুনরায় মুচকি হাসলো। তাতে যেন মিয়াজের বিরক্তির মাত্রা আরো বেড়ে গেলো। বেশ বিরক্তি নিয়েই বললো,
– ‘তুই চাইলে নিমেষেই এই জেল থেকে বেরিয়ে আসতে পারতি। তবুও তুই তা করছিস না আর আমাকেও তা করতে দিচ্ছিস না। তোর চেয়ে বড় বোকা আর একটাও নেই। এক মিথ্যে আশা নিয়ে বিনা-দোষে শাস্তি ভোগ করে যাচ্ছিস।’
সোহান পুনরায় মুচকি হেসে বললো,
– ‘জানিস, বাচ্চাটার মুখে না একটা আলাদা মায়া লেগে ছিলো। মনে হচ্ছিল বুকে জড়িয়ে রাখি। আর কখনো তাকে যেতে না দিই। প্রথম বার আমি কারো প্রতি এতটা টান অনুভব করলাম। ঠিক যেমনটা…’
সোহানকে থামিয়ে দিয়ে মিয়াজ বললো,
– ‘তুই এখনো জেদ ধরে থাকবি?’
– ‘আমার বিশ্বাস তারিন আসবে, মিয়াজ।’
– ‘তুই তোর মিথ্যে আশা নিয়েই বসে থাক!’
প্রতিবারের মতোন আবারো মুচকি হাসলো সোহান। মিয়াজ বিরক্তি প্রকাশ করে কিছু বলতে যাবে তার আগেই সেখানে আগমন ঘটলো তারিনের। দূর থেকেই তারিনকে দেখতে পেয়ে মিয়াজের উদ্দেশ্যে সোহান বলে উঠলো,
– ‘তোকে বলেছিলাম না মিয়াজ! দেখ তারিন এসেছে। আমার অপেক্ষা বৃথা যায়নি। আমার ভালোবাসার জোর এতটাও ঠুনকো নয়! আমার বিশ্বাস জিতে গিয়েছে। এতে আমার বিশ্বাসের ভিত্তি আরো মজবুত হলো।’
কিন্তু পরবর্তীতে তারিন এসে সোহানকে যা বললো তাতে সোহানের তার ভালোবাসার প্রতি বিশ্বাসের ভিত্তিটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবার জন্য যথেষ্ট ছিলো।
চলবে…