হৃদমোহিনী পর্ব-২

0
4428

হৃদমোহিনী
২য় পর্ব
মিশু মনি
.
৩.
পূর্ণিমার চাঁদ আকাশে। অপার্থিব এবং অদ্ভুত সুন্দর। চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে সবকিছু। গাছের পাতায় আলো লেগে ঝিকমিক করে উঠছে। ট্রেন ছুটে চলেছে দ্রুত গতিতে। ট্রেনের ঝাঁকুনি অনুভব করছে মিশু। থেকে থেকে দুলে দুলে উঠছে আর ঝিকঝিক শব্দ কানে আসছে। মাঝেমাঝে কিছু তরুণ তরুণীর হাসির শব্দ ট্রেনের ঝিকঝিক শব্দকেও হার মানাচ্ছে। মিশু কারো শরীরের উষ্ণতা মাপতে পারছে। মনেহচ্ছে কেউ বুকের বা পাশে ঠিক বাহুর কাছাকাছি পরম যত্নে জড়িয়ে রেখেছে ওকে,তার পেশিবহুল বাহুর উপস্থিত টের পাচ্ছে নিজের বাহুর উপর। সে আলগোছে মেয়েটির বাহু ধরে রেখেছে, মাঝেমাঝে ট্রেনের ঝাঁকুনিতে শক্ত করে চেপে ধরছে। ভ্রম লেগে যাচ্ছে মিশুর। সেই শয়তানটা নয়তো? শুয়োরটা ট্রেনে করে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?

চিৎকার করে হাত ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করলো মিশু। চোখ মেলে দেখলো পরিস্থিতি অন্যরকম। একটা দারুণ হ্যান্ডসাম মতন ছেলের বুকের বা পাশে গুটিসুটি মেরে ঘুমাচ্ছিলো সে। সেই ছেলেটিই ওকে আলগোছে ধরে ছিলো বুকের সাথে। সামনের সিটে, পাশের সিটে কয়েকটা যুবক যুবতীর কৌতুহলী চোখ দেখে বিস্মিত হয়ে গেলো। এরা আবার কারা? ওদের সাথে আমি কোথায় চলেছি? আর এই ছেলেটিই বা কেন এভাবে আমায় বুকে জড়িয়ে রেখেছিলো? সবকিছু কেমন যেন স্বপ্নের মত লাগছে। ঘোর ঘোর লেগে যাচ্ছে রীতিমত। মিশু মনে করার চেষ্টা করলো।

আস্তে আস্তে মনে পড়ে যাচ্ছে সবকিছু। পালানোর জন্য প্রাণপণে ছুটছিলো সে। হঠাৎ রাস্তার মাঝখানে দাঁড়ানো মাত্রই আর কিছু বলতে পারেনা। খুব সম্ভবত সেন্সলেস হয়ে পড়েছিলো। তারপর কি যেন হয়ে গেলো বুঝতে পারেনি সে। কয়েকটা কৌতুহলী মুখ উপুড় হয়ে তাকে দেখছিলো। হ্যা,এইতো সেই কৌতুহলী মুখগুলো। এখন যারা পাশে বসে আছে তাদেরকেই তো দেখেছিলো। এবার বেশ মনে পড়েছে, মিশু ভেবেছিলো আল্লাহ কোনো ফেরেশতা পাঠিয়ে দিয়েছেন ওর জন্য। এই পাশে বসে থাকা হ্যান্ডসাম ছেলেটা ওকে কোলে নিয়ে হাঁটলো, তারপর সিএনজিতে বসে রুটি আর ওষুধ খাইয়ে দিলো। হুম,এরপর ছেলেটি বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলেছিলো ঘুমিয়ে পড়তে, ঘুমালে নাকি আর বিপদ থাকবে না। সত্যিই তো,তারপর মিশু ঘুমিয়ে পড়েছিলো আর এখন অদ্ভুত ভাবে বিপদ কেটে গেছে। কিন্তু ওরা কারা? আর ট্রেনে উঠলো কিভাবে?

মিশুকে এমন উৎসুক চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেঘালয় বললো, “শরীর কেমন লাগছে এখন?”

মিশু চমকে উঠলো। এত সুন্দর, স্পষ্ট, নিঁখুত কারো গলার স্বর হতে পারে! প্রত্যেকটা শব্দ যেন আয়নার মত পরিষ্কার, বারবার প্রতিধ্বনিত হয়ে মাথার ভিতর বাজতেই লাগলো। মিশু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “আমি এখানে কিভাবে এলাম?”

মেঘালয় উত্তর দিলো, “তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে। ঘুমের ঘোরেই ধরে এনে ট্রেনে তুললাম মনে পড়ছে না?”

ও হ্যা মনে পড়েছে। ট্রেনে ছেড়ে দেয়ার সময় হয়েছিলো। সিএনজি থেকে নেমে সবাই ছোটাছুটি করে গিয়ে ট্রেনে উঠলো। আর এই ছেলেটি রীতিমত কোলে করে নিয়ে ওকে ধরে এনে ট্রেনে তুলে দিলো। অবাক হলো মিশু। কিন্তু ওর পায়ে তো রক্ত… মিশু নিজের পায়ের দিকে তাকালো। জামাকাপড় বদলে দিলো কে? মনে পড়েছে, সিএনজিতে বসে একটা মেয়ে জামাকাপড় আর প্যাড বদলে দিয়েছে। কিন্তু অদ্ভুত লাগছে এটাই যে ওর অসুস্থতার কথা এরা কিভাবে জানলো? যতদূর মনে পড়ে ওর বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলো। তাহলে ওরা কিভাবে.. ভেবেই পাচ্ছেনা মিশু।

সবচেয়ে চঞ্চল মেয়েটি বললো, “মিশু, তোমার এখন কেমন লাগছে?”

এবার আরো অবাক হতে হলো। ওরা নামও জানে! কি অদ্ভুত! এবার হয়ত এমন কিছু বলবে যাতে মিশু আরো অবাক হবে। কিন্তু কিভাবে সম্ভব হলো এটা? কারো কি টেলিপ্যাথিক ক্ষমতা আছে নাকি?

মেঘালয় এক বোতল পানি এগিয়ে দিয়ে বললো, “নাও মুখ ধুয়ে ফেলো।”

মিশু উঠে দাঁড়ালো। সত্যিই এখন বেশ ভালো লাগছে। গায়ে শক্তিও পাচ্ছে। জানালার কাছে এসে বাইরে তাকালো। অদ্ভুত সুন্দর জোৎস্না ছড়িয়েছে চারিদিকে। যদিও আজকে সবই অদ্ভুত লাগছে। কেমন যেন অলৌকিক ব্যাপার মনেহচ্ছে। তবে যাই হোক,একটা বড় ধরণের বিপদের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। আর এই ছেলেমেয়ে গুলো না থাকলে এখন শক্তি নিয়ে দাঁড়াতে পারতো না বোধহয়। সবচেয়ে বেশি ধন্যবাদ দিতে হয় ওই হ্যান্ডসাম মতন ছেলেটাকে। মিশু ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো মেঘালয়ের দিকে। চোখাচোখি হয়ে গেলো। মেঘালয়ের দৃষ্টি কত ঠাণ্ডা অথচ তীক্ষ্ণ। একদম ভেতরে পৌছে যায়। কত মায়াবী লাগে চোখ দুটোকে কিন্তু বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে ওঠে। সত্যিই ছেলেটার চোখ দুটো ভয়ংকর রকমের সুন্দর! কোনো ছেলের চোখও এত সুন্দর হয় নাকি?

মিশু অপলক ভাবে তাকিয়ে আছে মেঘালয়ের দিকে। ঘোর লেগে যাচ্ছে। ছেলেটা মৃদু হাসিহাসি মুখে তাকিয়ে আছে, চোখে কত অপার্থিব মায়া! বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায়না। মিশু মুখ ঘুরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। মৌনি জানালার পাশের সিট থেকে সরে গিয়ে বললো, “এখানে বসো।”

মিশু সিটটায় বসতে বসতে তাকালো মেয়েটির দিকে। এই মেয়েটির চেহারার সাথে ওই হ্যান্ডসাম ছেলেটির চেহারায় অনেক মিল। আচ্ছা,বারবার হ্যান্ডসাম ছেলেটি ভাবছি কেন? ওই লোকটার নামটা কি জানা যায়না? প্রশ্নটা মনে আসতেই মিশু মেঘালয়ের দিকে ছুড়ে দিলো, “আপনার নাম কি?”

সবাই যতটা অবাক হলো মেঘালয়ের ঠিক ততটাই মজা লাগলো। কখনো কেউ এভাবে ওর নাম জিজ্ঞেস করেনি,সেখানে এই পিচ্চিটার মত অসংখ্য স্টুডেন্টস ওর আছে। ও হেসে বললো, “মেঘালয়।”

মিশু চোখ কপালে তুলে বললো, “মেঘালয় আবার কারো নাম হয়? হিমালয় থেকে হিমু,আপনার নাম কি মেঘালয় থেকে মেঘু?”
মেঘালয় ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বললো, “নাহ, আমাকে শর্ট করে সবাই মেঘ বলে ডাকে।”

মিশু চোখ পিটপিট করে বললো, “সার্টিফিকেট দেখি।”
-“কিসের সার্টিফিকেট?”

মিশু বললো, “হিমুকে যখন কেউ জিজ্ঞেস করে নাম কি? বলে হিমু। ভালো নাম? হিমালয়। ইয়ার্কি মারেন? তখন হিমু পকেট থেকে সার্টিফিকেট বের করে দেখায়। তারপর সে বলে, আপনি কি সবসময় সার্টিফিকেট পকেটে নিয়ে ঘোরেন? তখন হিমু জবাব দেয়, আপনার মত অনেকেই বিশ্বাস করতে চায়না আমার নাম হিমালয়। তখন সার্টিফিকেট বের করে দেখাই।”

সবাই হেসে উঠলো মিশুর কথা শুনে। সিটের উপরের ঝোলানো সিট থেকে সায়ান মাথা ঝুলিয়ে তাকালো। অদ্ভুত একটা ক্যারেক্টার তো! এতক্ষণ বোবা বনে ছিলো আর এখন মুখে খই ফুটছে। দারুণ করে কথা বলে তো মেয়েটা।

পূর্ব জিজ্ঞেস করলো, “তোমার কি হিমুসমগ্র মুখস্থ নাকি?”
-“নাহ, তবে এতবার পড়েছি যে কিছু কিছু লাইন মুখস্থ হয়ে গেছে।”
-“বাহ! তাই নাকি?”
মৌনি মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “ভাইয়া তুইও এখন থেকে সার্টিফিকেট পকেটে নিয়ে ঘুরবি।”

মিশু তাকালো মৌনির দিকে। এই মেয়েটা কি ওই ছেলেটার বোন? হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কারণ চেহারায় মিল আছে আর মেয়েটা ওকে ভাইয়া বলে ডাকছে। প্রশ্নটা করতে যাবে এমন সময় মেঘালয় বললো, “কিছু খেয়ে নাও।”
-“কি খাবো?”
-“কি খেতে চাও? বিরিয়ানি?”

মিশু কিছু বললো না। খিদে পেয়েছে এটা সত্যি। বিরিয়ানি ওর খুবই পছন্দ। কিন্তু কিভাবে বলবে বিরিয়ানি খেতে ইচ্ছে করছে। ও মাথাটা দুদিকে নাড়লো। মেঘালয় বললো, “একটু হেঁটে আসো তাহলে ভালো লাগবে।”
-“কোথায় হাঁটবো?”
-“আমার সাথে আসো। খাবার বগিতে নিয়ে যাই, যা খেতে ইচ্ছে হবে খেয়ে তারপর আবার আসবো।”

মিশুর এতক্ষণে খেয়াল হলো এটা একটা কেবিন। পুরো কেবিনটাই ওরা বুক করে নিয়েছে। এরা নিশ্চয়ই বন্ধু বান্ধবী হবে। সেটা পরে জিজ্ঞেস করা যাবে,আগে পেট ভরাতে হবে। সত্যিই বড্ড খিদে পেয়েছে।
মিশু উঠে দাঁড়ালো। মেঘালয় ওকে সাথে নিয়ে কেবিন থেকে বের হলো। সবাই আড্ডায় মেতে উঠলো একসাথে। মিশুকে নিয়েই কথা চলতে লাগলো ওদের মধ্যে। মেয়েটা বেশ সরল সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তবে ইন্টারেস্টিং একটা মেয়ে।

মেঘালয় মিশুর দিকে তাকিয়ে বললো, “রংপুরে কোথায় তোমার বাসা?”
-“শহরেই। আপনি কিভাবে জেনেছেন এই তথ্য?”
-“হিপনোটাইজ করে।”
-“সিরিয়াসলি!”

মিশুর মুখ হা হয়ে গেলো। এইটুকু সময়ের মধ্যে হিপনোটাইজ করা কিভাবে সম্ভব! অবশ্য এই ছেলেটাকে দেখেই বোঝা যায় একটু সবার থেকে আলাদা। চেহারায় একট আইনস্টাইন আইনস্টাইন ভাব আছে। বোধহয় সাইকোলজি ফিলসফি ইত্যাদি ইত্যাদি চর্চাও করে। যাকগে সেসব,অতকিছু ভেবে লাভ নেই। এখন কিছু ভাবতে ভালো লাগছে না। মাথাটা কেমন যেন ভারী হয়ে আছে। মস্তিষ্কের একটা নিউরন বোধহয় এখনো তন্ময়ের কথা ভেবে চলেছে। ভাবতে না চাইলেও মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে ছেলেটা।

এইতো মাস ছয়েক হবে। একদিন রাতে লগ আউট করে ঘুমাতে যাচ্ছিলো তন্ময়। সেই সময়ে হুট করেই একটা আইডি থেকে মেসেজ আসে ওর ফোনে, “এই তন্ময়”

এমন ভাবে ডাকলো যেন কত বছরের চেনা। তন্ময় বেশ অবাক হয়ে গেলেও ভাবলো ফেক আইডি হবে। সিন করে রেখে দিলো। কিছুক্ষণ পর আবারো সেই আইডি থেকে মেসেজ, “একবার ফোন দিবা?” নিঃসংকোচ আবেদন। চমকানোর মতই। মেসেজ দেখেই মনেহচ্ছিলো যেন নিজের বয়ফ্রেন্ডকে সে ফোন দিতে বলছে। তন্ময় রিপ্লাই দিলো, “কে আপনি খালা?”

তন্ময়কে অবাক হয়ে দিয়ে মেয়েটি একটা উচ্ছল কিশোরীর ছবি সেন্ড করে দিয়ে বললো, “আমাকে তোমার খালা মনেহয়? বিলাই,চামচিকা, বান্দর,ব্যাংজাদা,ছাগলজাদা, ভোটকা বাছুর, বাল”

তন্ময়ের হাসি পেলো গালি দেখে। প্রথমত ছবিটা দেখে দারুণ লেগেছে আর দ্বিতীয়ত মজা লাগলো গালি গুলো দেখে। মেয়েটি এখনো কতটা বাচ্চা বোঝাই যাচ্ছে। তন্ময় একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে মেসেঞ্জারে কল দিলো মিশুকে। আর তারপর.. বাচ্চা মেয়েটিকে নিজ হাতে প্রেম শেখালো ছেলেটা, রোজ রাতে কথা বলা,সারাদিন টুকটাক মেসেজিং করা, ইস! কত কেয়ার নিতো ছেলেটা। কিন্তু হুট করেই এমন হবে কে জানতো তখন?

-“কি ভাবছো এমন তন্ময় হয়ে?”

চমকে উঠলো মিশু। তন্ময় হয়ে তো সে তন্ময়ের কথাই ভাবছিলো। ভাবলেও যতটা কষ্ট হয়নি,মেঘালয়ের মুখে নামটা শুনে তারচেয়ে দ্বিগুণ কষ্ট হলো। ইচ্ছে করছিলো লাফ দিয়ে ট্রেনের চাকার নিচে চলে যায়। এতটা যন্ত্রণা হচ্ছে মাথার ভেতর। ও একটা প্রতারক, সেইসাথে বেঈমান ও। স্বার্থপর ছেলেটা এভাবে অপমান করে চরম বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছিলো ওকে। নাহ,একদম ই আর ওকে নিয়ে ভাববে না মিশু। কিছুতেই ভাব্বে না। ও মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “আমার খুব বিষ খেতে ইচ্ছে করছে। গাড়িতে বিষ পাওয়া যায় না?”

মেঘালয় বিস্ময় লুকালো। এতটুকু একটা মেয়ে, বয়স আর কতই হবে? আঠারো ছুঁই ছুঁই কিংবা সতের বছর। তার এতকিসের কষ্ট যে বিষ খেতে হবে? একটা বিচ্ছেদ নিশ্চয়ই জীবনের অর্থ বদলে দিতে পারেনা। মেয়েটার সাথে কথা বলতে হবে এটা নিয়ে।
প্রসঙ্গ পালটে জিজ্ঞেস করলো, “মুরগির মাংস দিয়ে গরম গরম ভাত খাও।”
মিশু বললো, “আমি ভাতের চেয়ে বিরিয়ানি বেশি খেতে পারি।”
-“আচ্ছা বেশ। মাটন বিরিয়ানি হবে, খাবা?”
-“লেবু দেবে সাথে?”

মেঘালয় হেসে বললো, “হুম দেবে অবশ্যই। সাথে কাচা মরিচ আর পেয়াজ ও দেবে।”

মিশু কিছু বললো না। একটা সিটে বসে পড়লো। মেঘালয় একটু দূরে গিয়ে কাকে যেন কি বলে আসলো। এসে পাশেই বসে পড়লো। খাবার দিতেই মিশু হাত ধুয়ে খেতে আরম্ভ করলো। মেঘালয় পাশে বসে চেয়ে আছে ওর দিকে। মেয়েটার চেহারায় একটা সরল আর নিষ্পাপ ছাপ মিশে আছে এরকম একটা মেয়েকে ছেড়ে কোন ছেলেটা চলে গেলো সেটাই ভাবছে মেঘ।
মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছিলো বলবে? তুমি এখানে কিভাবে এলে আর ওভাবে ছুটছিলে কেন?”
মিশু খাবার মুখে দিতে দিতে বললো, “এখন কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না।”
-“বেশ। তবে খাও পেট ভরে। একবার মরিচে কামড় দাও,তাহলে খেতে পারবা।”

মিশু ওর কথামত মরিচে কামড় দিয়ে চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিলো। মেঘালয় পানি তুলে দিলো ওর মুখে। একদম ই ঝাল সহ্য করতে পারেনা মেয়েটা। খাওয়াদাওয়া শেষ করে আবারো মেঘালয়ের সাথে কেবিনের দিকে রওনা দিলো। একটা দরজায় এসে দাঁড়িয়ে প্রাণভরে শ্বাস নিতে নিতে বললো, “ইস! কি সুন্দর লাগছে সবকিছু!”
মেঘালয় পিছনে দাঁড়িয়ে বললো, “তোমার শরীর দূর্বল। আবার মাথা ঘুরে নিচে পড়ে যাবা।”
-“পড়ে গেলেই ভালো হয়। সোজা চাকার তলে চলে যেতাম।”

মেঘালয় মিশুর হাত ধরে একটা হেচকা টান দিয়ে পিছনে টেনে নিলো। মিশু ওর বুকে এসে ঠেকলো একেবারে। আচমকা এরকম করার মানে বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো, “এটা কি হলো?”
-“উল্টা পালটা কথা বলছিলে। আবার ঝুপ করে লাফিয়ে পড়ো কিনা ভাবছি।”
-“পড়বো না,হাত ছাড়ুন।”

মেঘালয় মিশুর হাত ছেড়ে দিলো। হাত ছাড়ুন কথাটা শুনতে কেমন যেন লাগলো। এতক্ষণ মেয়েটার সেরকম হুশ ছিলো না তাই বুকে জড়িয়ে থাকলেও কিছু হয়নি। কিন্তু এখন সে দাঁড়াতে পারছে বলে ‘হাত ছাড়ুন’ কথাটা এমন ভাবে বললো যেন হাত ধরায় বড় অন্যায় হয়ে গেছে। কিন্তু কিছু মনে করলো না মেঘালয়। দরজায় দাঁড়িয়ে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে দরজা আটকে ধরে মিশুকে বললো, “আমার হাতের উপর দিয়ে তাকিয়ে থাকো তাহলে ভালো লাগবে।”

মিশুর ভালো লাগলো ব্যাপার টা। হাত দিয়ে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরী করে তাকে বাইরে দেখতে বলছে। এমন কেন ছেলেটা? এত ভালো মানুষ হতে হয়? অবাক বিস্ময়ে বাইরে তাকালো মিশু। খুব সুন্দর বাতাস এসে গায়ে লাগছে, বাইরে চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে সবকিছু। ট্রেন শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে যাচ্ছে।

মিশু উৎফুল্ল হয়ে উঠলো ক্রমশই। এখন বেশ ভালো লাগছে ওর। বললো, “আচ্ছা আমরা কোথায় যাচ্ছি এখন?”
-“পঞ্চগড় একটা ফ্রেন্ডের বিয়েতে এটেন্ড করতে যাচ্ছি আমরা। ওরা সবাই আমার বন্ধু। তুমি চিন্তা করোনা,তোমাকে বাসায় পৌছে দেয়া হবে। তবে সবকিছু খুলে বললে ভালো হতো।”
-“বারবার কেন মনে করিয়ে দিচ্ছেন সবকিছু? বললাম তো আমার বলতে ইচ্ছে করছে না। ধেৎ ভালোই লাগেনা।”
-“আচ্ছা বাবা সরি। আর বলবো না।”
-“আমি আপনার বাপ নই,নানীও নই। আমি মিশু।”
-“হা হা, আচ্ছা বেশ। এখন চলো কেবিনে যাই। ওরা সবাই খুব ফ্রেন্ডলি। ওদের সাথে একটু মেশার চেষ্টা করলে দেখবে খুব ভালো লাগবে।”

মিশু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, “ঠিকাছে। আমরা কি যমুনা ব্রীজ পেরিয়েছি?”
-“না, এখনো অনেক বাকি।”
-“আমাকে যমুনাসেতুর উপরে উঠলে দরজায় এনে দেখাবেন?”
-“আচ্ছা দেখাবো। এখন যাই চলো।”

মিশু হাঁটতে ধরে উলটে পড়ে যাচ্ছিলো। মেঘালয় ওকে ধরে ফেলতেই মিশু বাঁকা চোখে তাকালো মেঘালয়ের দিকে। মেঘ ছেড়ে দিয়ে বলল, “সরি বাবা। সরি, সরি মিশু।”
মিশু হেসে ফেললো ওর কথা শুনে। বললো, “সমস্যা নেই। আসুন। আমি এখন হাঁটতে পারবো।”

মিশু আগে আগে হাঁটছে। মেঘালয় ওর পিছুপিছু। মেয়েটির সরলতা মুগ্ধ হওয়ার মত। কেবিনে গিয়ে গল্প শুরু করে দিতে হবে। হাসি ঠাট্টার মাঝে থাকলে স্বাভাবিক হতে পারবে মেয়েটা।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here