হৃদমোহিনী পর্ব-৯

0
2779

হৃদমোহিনী
পর্ব ৯
মিশু মনি
.
১০.
রাত নেমেছে।
কুয়াশার আবরণে ধোয়াটে দেখাচ্ছে সবকিছু। নদীর জলে ভেসে চলেছে ছোট্ট ডিঙি নৌকা। যেদিকে চোখ যাচ্ছে শুধু ধূ ধূ করছে জল। জল থেকে ধোয়া উঠছে৷ শীতের রাতের মোহময় পরিবেশের সারহে যুক্ত হয়েছে চাঁদের অপূর্ব আলো। মেঘালয় ও মিশু ভেসে চলেছে নদীর বুকে।

নৌকার উপর দুজন দুদিকে শুয়ে আছে৷ মাথার উপর পূর্ণিমার চাঁদ। চাঁদের আলো কুয়াশার চাদর ভেদ করে সরাসরি গায়ের উপর এসে পড়েছে৷ সুখে মরে যেতে ইচ্ছে করছে মিশুর৷

ও আনন্দের চোটে কথাই বলতে পারছে না। হাঁফাতে হাঁফাতে বললো,’ইস! এত্ত সুন্দর কেন সবকিছু? এত ভালো লাগলে তো আমি আনন্দে কান্না করে ফেলবো।’

মিশুর কণ্ঠে এরকম বাচ্চাদের মত কথা শুনে হাসি পেলো মেঘালয়ের। হেসে বললো, ‘নদীর জলে লাফাতে ইচ্ছে করছে না?’
– ‘হ্যা একদম। কিন্তু জল তো একদম পানির মত ঠান্ডা হয়ে আছে।’
– ‘পানির মত ঠান্ডা? হা হা হা। বরফের মত হিম শীতল।’
– ‘বাহ! দারুণ উপমা দিয়েছেন তো।’
– ‘আরেকটা দারুণ উপমা দেই?’
– ‘অবশ্যই, দিন। শুনি?’

মেঘালয় বললো,’তোমাকে এখন চাঁদের আলোর মত স্নিগ্ধ লাগছে।’

লজ্জা পেয়ে লাজরাঙা হয়ে উঠলো মিশু৷ মুখটা ঘুরিয়ে তাকালো জলের দিকে৷ নৌকাটা স্রোতের টানেই ভেসে চলেছে৷ স্রোতে ধাক্কা খেয়ে অন্যরকম যে শব্দটা উৎপন্ন হচ্ছে, সে শব্দটাই কানে বাজতে থাকে অনেক্ষণ। নৌকা দুলছে, চাঁদ ও দুলছে৷ সেইসাথে পুরো প্রকৃতিই যেন আজ উল্লাসে মেতেছে৷ লাজুক লতার মত মিটিমিটি করতে লাগলো মিশুর চোখের পাপড়ি।

মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি ক্ষ্যাতমার্কা মেয়ে কথাটা যে বলেছে সে কেমন কোয়ালিটির মানুষ?’

মিশু চমকে উঠলো প্রশ্ন শুনে। নৌকার উপর উঠে বসতে বসতে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর বললো,’ও অনেক স্মার্ট।’

মেঘালয় অবজ্ঞার সুরে হেসে বললো, ‘বয় ফ্রেন্ডের নামে ভালো বলেছো। কিন্তু তোমাকে ওভাবে অপমান করাটা নিশ্চয়ই স্মার্টনেসের অংশের মধ্যে পড়েনা?’

মিশু চুপ করে রইলো৷ এর উত্তর ওর জানা নেই। মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, ‘তা তোমার কি নিজেকে স্মার্ট মনে হয়না?’
– ‘আমি মোটেও বলার মত স্মার্ট নই।’
– ‘বেশ। এবার আসল কথায় আসি। স্মার্টনেস বলতে তুমি ঠিক কি বুঝাচ্ছ? তোমার কাছে স্মার্টনেসের অর্থ কি?’

মিশু ড্যাবড্যাবিয়ে তাকালো মেঘালয়ের দিকে৷ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে লাগলো। কিন্তু বলার মত কিছু খুঁজে পাচ্ছেনা। আসলে হয়ত স্মার্টনেস কাকে বলে সেটা ও ভালোভাবে জানেই না। তাই বলতে পারছে না। উৎসুক চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘স্মার্টনেসের সংজ্ঞা আমার জানা নেই।’

মেঘালয় হেসে বললো, ‘তাহলে অন্তত বৈশিষ্ট্য গুলো জানা আছে? সেটাই বলো। তোমায় বয় ফ্রেন্ডের স্মার্টনেসের উদাহরণ শুনি?’

মিশু চুপ করে রইলো। মেঘালয় নিজে থেকেই বললো, ‘প্রত্যেকেই এই শব্দটা ইউজ ব্যবহার করে৷ কিন্তু স্মার্টনেস কি সেটা আদৌ কয়জন জানে বলোতো?’
– ‘জানিনা। আমি নিজেই তো জানিনা। তবে আমি ভাবতাম যে সবকিছুতে আপডেট, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলে, আউটলুক সুন্দর। এটাই।’

মেঘালয় মিশুর দিকে একটু ঝুঁকে এসে বসলো। তারপর বললো,’এটা মানছি। কিন্তু স্মার্টনেস শুধুমাত্র আউটলুকিং এর উপর নির্ভর করেনা। এনিওয়ে, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলা বলতে কি বুঝাচ্ছো? ফিটিং ওয়েস্টার্ন ড্রেস আপ, ঠোঁটে লিপস্টিক, হাই হিল,মাথায় বাঁধাকপি স্টাইলের হিজাব, এসব আউটলুকিং দিয়ে স্মার্টনেস মাপছো?’

মিশু চুপ করে রইলো। মেঘালয় আবারও বললো,’আপডেট হতে হবে ঠিক আছে কিন্তু সবকিছুর প্রয়োগ করা যাবেনা৷ আমার ভার্সিটির সিক্সটি পারসেন্ট গার্লস স্মোকিং করতো। শরীরে নিকোটিন নিয়ে আয়ু কমিয়ে ফেলাটাকে নিশ্চয়ই স্মার্টনেস বলেনা।’

মিশু উত্তেজনা বোধ করছে কথাগুলো শুনতে শুনতে৷ বললো,’একদম ঠিক বলেছেন।’
– ‘তোমার তন্ময় নিশ্চয় স্মার্টনেস বলতে এসবই বুঝিয়েছে?’

মিশু মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, ‘হুম।’

মেঘালয় হাসলো। হাসতে হাসতে চুপ হয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে রইলো। পানি থেকে ধোয়া উঠছে। তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগছে। পাশে একজন উচ্ছল কিশোরী, আরো ভালো লাগছে। মেয়েটির পাগলামি ভরা কথাগুলোও ভালো লাগছে। ও মুখ টিপে হাসতেই লাগলো।

মিশু বললো, ‘স্মার্টনেসের সংজ্ঞা তো বললেন না?’

মেঘালয় হেসে বললো,’সংজ্ঞা? আসলে স্মার্টনেস হচ্ছে অনেক কিছুর সমষ্টি। এতকিছু ঠিক বুঝিয়ে বলা সম্ভব না। তবে মূলকথা হচ্ছে, জ্ঞান,অনন্য ব্যক্তিত্ব, অন্যকে আকৃষ্ট করতে পারার ক্ষমতা, কথা বলার স্টাইল,চলার স্টাইল, আউটলুকিং, বিনয়ীভাব, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারার মত অদ্ভুত পাওয়ার এরকম আরো অনেক বৈশিষ্ট্যের সমষ্টি। এসবকিছু দিয়ে যে দ্রুত অন্যকে আকর্ষণ করতে পারে সেই প্রকৃত হচ্ছে স্মার্ট। যাকে দেখলে বা যার কথা বলার ধরণ শুনলে সবার থেকে দ্রুত তাকে আলাদা করা যায়। অন্যের মাঝে প্রভাব ফেলার ক্ষমতা রাখে এরা।’

মিশু মুগ্ধ হয়ে শুনছিলো কথাগুলি। এত সুন্দর করে,এত ভালোভাবে গুছিয়ে কেউ কখনও বলেনি ওকে। মেঘালয়কে ওর একজন আদর্শ মানুষ মনে হচ্ছে। চোখেমুখে মুগ্ধতা ছড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি এত সুন্দর করে কথা বলেন কিভাবে!’

মেঘালয় হেসে ফেললো মিশুর প্রশংসায়। হাসতে হাসতে বললো, ‘ইমপ্রেসড নাকি?’
– ‘সত্যিই অনেক সুন্দর করে কথা বলেন আপনি। আমি শুধু অবাক হয়ে শুনি। আপনার কত জ্ঞান বুদ্ধি, কত সুন্দর গুছিয়ে উপস্থাপন করেন। আর সত্যিই সবদিক থেকেই আপনি অনন্য। অন্যকারো থেকে দ্রুত আলাদা করা যায়।’

মেঘালয় মুচকি হেসে বললো,’এটাই স্মার্টনেস।’

আবারও চমকালো মিশু৷ জলজ্যান্ত স্মার্ট একজন পুরুষ ওর সামনে বসে আছে। আর সে কিনা ভাবছে তন্ময়ের কথা! তন্ময় তো মানুষ নামক অমানুষ। যে কিনা এভাবে নিয়ে গিয়ে চরম বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছিলো। ভয়াবহ বিপদের কথা স্মরণ করে শিউরে উঠলো মিশু।

মেঘালয় বললো,’তোমাকে একটা কারণে আমি গাইয়া বলবো না, সেটা হচ্ছে তোমার স্বকীয়তা। নিজের স্বকীয়তা বজায় রাখতে পারাটাও একটা বড় স্মার্টনেস। যেটা সবাই পারেনা।’
– ‘হুম। গুরুজি তাহলে সত্যি সত্যি আমাকে মানুষ বানাবেন মনেহচ্ছে?’
– ‘হ্যা। আমি বান্দরকেও মানুষ হতে মোটিফ করতে পারি। এনিওয়ে, তোমার উপর কড়া বিক্রিয়া চালাতে হবে। সহ্য করতে পারব তো?’
– ‘পারবো। তা গুরুজি,মানুষ হওয়ার জন্য আমাকে কি কি করতে হবে?’

মেঘালয় একটু ভেবে বললো,’প্রথমত স্মার্ট হতে হবে। এরজন্য সর্বপ্রথম যে কাজটা করবা সেটা হচ্ছে জ্ঞানার্জন। বেশি বেশি বই পড়তে হবে, ট্রাভেলিং করতে হবে, সব ধরণের মানুষের সাথে মিশতে হবে। এসবের মাধ্যমে দ্রুত অনেক কিছু শিখতে পারবা। আর স্মার্টনেসের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে জ্ঞানী হতে হবে। তোমার মাঝে জ্ঞানের আলো না থাকলে অন্যের মাঝে কিছুই ছড়িয়ে দিতে পারবা না।’

মিশু অবাক হয়ে বললো, ‘জ্ঞান! আমার তো পড়তে একদমই ভালো লাগেনা।’
– ‘শুধু পড়লেই হয়না রে পাগলী। বললাম তো,সব শ্রেণির মানুষ দের সাথে অনায়াসে মিশতে হবে। অভিজ্ঞতা হচ্ছে জ্ঞানার্জনের সবচেয়ে অন্যতম উপায়। বই পড়ে যা জানতে পারবা না, অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সেটাই জানবে। যা তোমাকে অভিজ্ঞ মানুষ বানাবে।’

মিশু মুগ্ধতার শেষ পর্যায়ে পৌছে গেছে। অবাক হয়ে বললো, ‘আমার মগজে বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে। জানেন আমার প্রচুর ট্রাভেলিং করার ইচ্ছে।’
– ‘সেটা বুঝতে পেরেছি। যত ট্রাভেলিং করবা,তত জ্ঞান বাড়বে। এটাও জ্ঞানার্জনের উপায়। আর বেশি বেশি সাধনা করতে হবে।’
– “আচ্ছা গুরুজি। আপনি কি কোনো ভার্সিটির লেকচারার?’

মেঘালয় হেসে বললো,’কিভাবে বুঝলে?’
– ‘সত্যিই? অনুমান করলাম।’
– ‘ওহ আচ্ছা। হ্যা, অনুমান লেগে গেছে। আমি একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির লেকচারার ছিলাম। পার্ট টাইম, আমার আম্মু অসুস্থ হওয়ার পর সেটা ছেড়ে দিয়েছি। বাসায় তিনবেলা রান্না করতে হয়েছে তো।’

মিশু অবাক হয়ে বললো, ‘আপনি রান্না করেছেন!’
– ‘হ্যা, মৌনি তখন দেশের বাইরে ছিলো।’
– ‘অদ্ভুত! আপনি মানুষ না ভিনগ্রহের কোনো প্রাণী?’
– ‘হা হা হা। আমাকে দেখতে কি এলিয়েনের মত লাগে?’
– ‘একদম ই না। আপনিও দেখতে চাঁদের মতই স্নিগ্ধ, আকাশের মত বিশাল আর নদীর স্রোতের মতই ধারালো।’

মেঘালয় মুচকি হাসলো মিশুর উপমা শুনে।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here