হৃদয়ে_রেখেছি_তোমায় অষ্টম_পর্ব

#ধারাবাহিক_গল্প
#হৃদয়ে_রেখেছি_তোমায়
অষ্টম_পর্ব
#আসেফা_ফেরদৌস

-আচ্ছা মৃদুল, মা বাবার সঙ্গে তোমার সম্পর্কটা কখন যে এমন অন্তরঙ্গ হয়ে গেলো, আমি তো কিছু জানলামও না। তুমি তো আমাকে কিছুই বলোনি।
-পরিবারের সাথে সম্পর্ক তো এমনই হয়। এতে বলার কি আছে আবীর?
আবীর হাসলো শুধু। প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গিয়ে বললো, চলোনা ঘুরে আসি?
-কোথায়, অজানাতে?
-পার্কে, পার্কে। আবীর হাসতে হাসতে বললো।
-বেশিক্ষন থাকবো না কিন্তু।
-ঠিক আছে। চলো তো আগে!
কিছুক্ষণ পর আবীর আর মৃদুলা পার্কে বসে আছে। চারদিকে অসম্ভব বাতাস! রোদ তেমন নেই। মূহুর্তেই মন ভালো হয়ে যায় এমন পরিবেশে। অবনী কাছাকাছির মধ্যেই বল নিয়ে খেলছে। কিছুক্ষণ আগেই দোলনা থেকে নেমেছে ও।
মৃদুলার কড়া নিষেধ আবীর যেন অবনীর সাথে দৌড়াদৌড়ি না করে। কিছুক্ষণ আগে আবীরও খেলেছিলো অবনীর সাথে। মৃদুলা একপ্রকার ধমক দিয়েই ওকে বসিয়ে রেখেছে। অবনী দোলনায় চড়ার সময় আবীর আর মৃদুলা দোল দিয়ে দিচ্ছিলো, অবনীর সেকি আনন্দ! হাসি যেন থামতেই চায় না।
মৃদুলা আর আবীর পাশাপাশি বসে আছে চুপচাপ। হঠাৎ আবীর বললো, তুমি যে আমাকে এভাবে বসিয়ে রাখবে তাতো বুঝতে পারিনি মৃদুল, তাহলে তো আসতাম না।
-না, তুমিও অবনীর সাথে শিশু বনে যাও। দৌড় ঝাঁপ শুরু করো, এরপর বাসায় গিয়ে অসুস্থ হলে কি হবে ভেবে দেখেছো?
আবীর উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো, মনে আছে মৃদুল, বিয়ের আগে এমন কতগুলো বিকেল একসঙ্গে কেটেছে আমাদের? অনর্গল আড্ডার পরও ক্লান্ত না হওয়া সে বিকেল গুলোর কথা তোমার কি মনে পড়ে? মনে পড়ে, কেমন মুগ্ধ দৃষ্টিতে নিস্পলক তাকিয়ে থাকতাম আমরা পরস্পরের দিকে?
মৃদুলা হালকা হেসে বললো, না মনে পড়ার তো কিছু নেই। বাদাম, ডালভাজা আর আইসক্রিম খেতে খেতে দাঁত ব্যথা হয়ে গিয়েছিলো আমার।
আবীর হেসে ফেললো।
মৃদুলা বললো, কখনোই ভালো কোন রেস্টুরেন্টে খাওয়াওনি তুমি আবীর, সস্তা ক্যাফের চা, সিঙাড়া, বার্গার, বাদাম, আইসক্রিম, ডালভাজা এই ছিলো তোমার মেনু।
-তোমাকে নামিদামি রেস্টুরেন্টে ট্রিট দিতে গেলে টিউশনির সব টাকা ওখানেই শেষ হয়ে যেতো, বাবা মায়ের হাতে কিছু আর তুলে দিতে পারতাম না। তাছাড়া, এসব স্বস্তা খাবার খেয়েই তুমি যে পরিমাণ সন্তুষ্ট ছিলে! একবার চিন্তা করো, দামি কোন রেস্টুরেন্টে স্যান্ডুইচচ, বার্গার, চাইনিজ খাওয়ালে উপায়টা কি হতো?
আবীরের কথা শুনে মৃদুলা শব্দ করে হেসে ফেললো। বললো, মাঝে মাঝে আমিও অবাক হয়ে ভাবি আমার মতো এমন স্মার্ট, সুন্দরী, বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়েকে তূমি পটিয়ে ফেললে কি করে?
আবীর হাসলো। হাসিটা একটু তাচ্ছিল্যের মতো শোনালো। বললো, ভালো করে মনে করে দেখো তো মৃদুল, কে কার পেছনে ঘুরঘুর করতো? তুমি তো আমার সঙ্গে কথা বলার, আড্ডা দেয়ার অজুহাত খুঁজতে শুধু, আমি কিন্তু তোমার পেছন পেছন কিন্তু যাইনি। তবে হ্যাঁ, তোমার ঐকান্তিক প্রচেষ্টার সামনে একপর্যায়ে আমি মন হারিয়ে ফেলেছিলাম তোমার কাছে। আমার তো মনে হয়, সে সময় আমার দারিদ্র্যও তোমাকে আকর্ষন করতো।
মৃদুলা হেসে বললো, কথা সত্য। পুরো ডিপার্টমেন্ট পাগল ছিলো তোমার পেছনে। মেয়েদের মধ্যে একটা অঘোষিত প্রতিযোগিতা চলতো কে তোমার মন জয় করবে। শেষ পর্যন্ত আমি সফল হয়েছিলাম।
-আমাকে ঘিরে তোমাদের মধ্যে এত উৎসাহ কেন ছিলো বলোতো?
-ওমা হবেনা! তুমি ছিলে ডিপার্টমেন্টের সেরা ছাত্রদের একজন, তার উপর গান, বিতর্ক, নাটক, অনুষ্ঠান উপস্থাপনা সব ক্ষেত্রেই তোমার ছিলো সরব পদচারণা। বলতে গেলে পুরো ইউনিভার্সিটি চিনতো তোমাকে।
-তখন চোখে ছিলো রঙিন চশমা। ভাবতাম, জীবনটা হয়তো অন্যরকম হবে। আবীর বললো।
মৃদুলা বললো, মনে আছে, একবার তুমি ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের রুনার সাথে একটা নাটকে অভিনয় করেছিলে। তোমরা ছিলে নায়ক, নায়িকা। রুনা অসম্ভব সুন্দরী মেয়ে। শুনে আমার তো মনই খারাপ হয়ে গেলো। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমি নাটক দেখতে যাবো না। পরে বন্ধুদের জোরাজুরিতে গিয়েছিলাম। পুরো নাটকটা আমি রাগে কিড়মিড় করতে করতে দেখেছি।
-তাই নাকি? জানতাম না তো! বলতে গিয়ে আবীর হেসে ফেললো।
মৃদুলা বললো, আগে তুমি যখন কথা বলতে, বক্তৃতা করতে বা অনূষ্ঠান উপস্থাপনা করতে, আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। মনে হতো‌, ইশ! কি সুন্দর কন্ঠ! কি দারুন বাচনভঙ্গি!
আর এখন?
এখন তো রোজ শুনতে শুনতে ব্যপারটা ডাল ভাত হয়ে গেছে।
সরি? আবীরকে দেখে মনে হলো চরম শকড!
মৃদুলা চুপ করে গেলো। বুঝতেই পারছে ভূল হয়ে গেছে। ফস্ করে কথাটা বলে ফেলা ঠিক হয়নি। আঘাত পেয়েছে আবীর।
আবীর আবার বললো, কি বললে তুমি?
না মানে বলছিলাম কি, ব্যপারটা নরমাল হয়ে গেছে। মৃদুলা সামলাবার জন্য বললো।
না তুমি এটা বলোনি। আবার বলোতো, কি বলেছো? আবীর রাগ করে তাকিয়ে আছে।
মৃদুলা চুপ। চোখ নামিয়ে মুচকি হাসছে।
-একা একা হাসবেনা। বলো! আবীর একটু ধমকের সুরে বললো।
মৃদুলা চোখ তুলে আবীরের দিকে চাইলো। ও রাগ করে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখের ইশারায় মৃদুলাকে বলার জন্য ইঙ্গিত করলো আবার।
ডালভাত বলতে গিয়ে উচ্ছল হাসিতে ফেটে পড়লো মৃদুলা।

রাত আটটা‌। মৃদুলা ড্রইং রুমে বসে টিভি দেখছে। আবীর এবং অবনী, অবনীর ঘরে খেলাধুলায় ব্যাস্ত। সেখান থেকে অবনীর হাসির শব্দ ভেসে আসছে। বাবাকে কাছে পেয়ে ভীষণ খুশি সে। আসলে আজ বিকেলটা দারুন কেটেছে ওদের। অনেক দিন পর রিক্সায় করে ঘুরেছে। রিক্সায় একসঙ্গে ঘোরা আবীর এবং মৃদুলার ভীষণ শখের। এরপর তিনজনে মিলে হালকা শপিং করেছে। জিনিসপত্র বেশিরভাগই কেনা হয়েছে অবনীর জন্য। এছাড়াও বিভিন্ন খাবার জিনিস কিনেছে। কিছুক্ষণ আগেই বাসায় ফিরেছে ওরা।
যাইহোক, মৃদুলাা টিভি দেখছিলো, এমন সময় আবীর রুম থেকে বের হলো। মৃদুলা ওর পায়ের শব্দে ফিরে তাকালো। বললো, কি শখ মিটেছে? তোমার এবং তোমার মেয়ের?
আবীর ওর পাশে এসে বসলো। বললো, অবনী আজকাল অনর্গল কথা বলে তাইনা? ওর সব বন্ধুদের সম্পর্কে আমাকে একের পর এক বলেই চলেছে।
মৃদুলা হেসে বললো, ওর বয়সের বেশিরভাগ শিশুরাই এভাবে কথা বলে।
সেকি, কাঁদছিলে নাকি? আবীর অবাক! ও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মৃদুলার চোখ বেয়ে নামা অশ্রুর ধারা শুকাতে বসেছে। ও প্রশ্ন করলো, কি হয়েছে মৃদুল?
আরে কিচ্ছু না! মৃদুলার কন্ঠ স্বাভাবিক। বললো, সিরিয়াল দেখছিলাম, আমার প্রিয় চরিত্রদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেছে। তাই মনটা খারাপ হয়ে গেলো। সংলাপ শুনতে শুনতে চোখ ভিজে গেছে।
আবীর না হেসে পারলো না। বললো, তুমি কি আর কিছু না পেয়ে এখন মেকী কষ্ট খুঁজে বেড়াচ্ছো?
-নিঃসঙ্গতার মাঝে সঙ্গ খুঁজি, একাকিত্বের মাঝে আনন্দ! এরকম একটা বাড়িতে, এতটা সময় একা একা কাটাতে হলে কিছু না কিছু তো খুঁজে নিতেই হয়। আর সেই খুঁজে নেয়া জিনিসটাকে আঁকড়ে ধরতে গেলে মন তো জুড়েই যায়। এর প্রয়োজনীয়তা তুমি বুঝবেনা, তোমার বাইরের একটা জগত আছে, নিজেস্ব ব্যস্ততা আছে, তোমার হাতে নিঃসঙ্গ হবার মত সময় কোথায়?
-ঠিকই বলেছো, আমার ব্যস্ততা হয়তো আমাকে বাইরে নিঃসঙ্গ হতে দেয় না। কিন্তু প্রতিদিন আমার আপন ভূবনটা যে একটু একটু করে আমার অচেনা হয়ে উঠছে, সে যন্ত্রণা ঘুচাতে আমি কি আঁকড়ে ধরবো বলতে পারো? যন্ত্রণাটা আমাকে বড্ড পীড়া দেয় মৃদুল, কিন্তু আমি তোমার মতো ব্যক্ত করতে পারিনা। তুমি আমার ব্যস্ততাটাই দেখতে পাও অথচ, আমার ভেতরের যন্ত্রনাটা অনুভব করতে পারোনা। হয়তো তোমার মন, তোমার দৃষ্টি, আগের মতো আর আমার আঁখির কোণে বা হৃদয় গভীরে পৌঁছাতে পারেনা। কিংবা আমার কন্ঠ, আমার বাচনভঙ্গির মতো, আমার আরো অনেক কিছুই তোমার কাছে ডালভাত মনে হয়!
কথা শেষ করেই আবীর উঠে গেলো।
মৃদুলা তো অবাক! আবীরের কথাগুলো ওকে কষ্ট দিচ্ছিলো সত্য, কিন্তু কথার মোড় যে এইদিকে ঘুরে যাবে ভাবতেও পারেনি। আবীর সোজা ওদের রুমে চলে যাচ্ছে।
মৃদুলা বলতে গেলে চিৎকার করে উঠলো, আবীর! কি বললে এটা? আশ্চর্য তো!
পরদিন সকালে নাশতার পর। আবীর ল্যাপটপে কাজ করছে। কাল রাতে মৃদুলা আর আবীরের মধ্যে প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া তেমন কোন কথা হয়নি। আবীর বুঝতে পারছে মৃদুলা রেগে গেছে। কিন্তু কিছু করার নেই। কষ্ট তো সেও পেয়েছে।
অন্যদিকে মৃদুলাও আবীরের রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করেনি। কেন করবে? সারা দিনের সকল পরিশ্রম, প্রচেষ্টার কোন কিছুই যার চোখে পড়লোনা, একটা তুচ্ছ ঠাট্টাকে কেন্দ্র করে যে ভুল বোঝে, দোষী করে, তার এই অভিমান ভাঙানো বড় কঠিন! কিন্তু ওরা ঝগড়া করেনি। দুজনে এমন ভাব দেখিয়েছে যেন সব স্বাভাবিকই আছে। পরিনত বয়সের অভিমান হয়তো এমনই হয়, অভিমান চাপা পড়ে থাকে মনের কোণে,জীবন চলে জীবনের গতিতে।
যাইহোক, মৃদুলা রুমে এসে ঢুকলো। দেখলো আবীর কাজ করছে। ও বললো, কি করছো আবীর?
এইতো অফিসের কিছু কাজ, ভালো লাগছিলো না ভাবলাম, একটু কাজ নিয়ে বসি, সময়টা কাটবে।
কিন্তু এভাবে বেশিক্ষণ ল্যাপটপের সামনে বসে থাকলে তো তোমার মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যাবে আবার।
উত্তরে আবীর হাসলো শুধু। কিছু বলার নেই।
মৃদুলা বললো, আচ্ছা আবীর, শোন না, মায়া বারবার ফোন করছে। ওরা নতুন বাড়িতে উঠেছে, সবকিছু নতুন করে সাজিয়েছে, ভীষণ ভাবে অনুরোধ করছে আমাকে যাবার জন্য। আমি বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেছি, বলেছি, তুমি বাসায় আজকে সম্ভব হবে না। কিন্তু কিছুতেই উপেক্ষা করা যাচ্ছেনা। আমি ওদের বাসা থেকে একটু ঘুরে আসি?
আবীর আবার হাসলো। বললো, কত স্বাধ ছিলো, তোমার সাথে আজকের দিনটা একান্তে কাটাবো, অথচ তুমি কি আমাকে শাস্তি দিতে চাইছো?

চলবে

আগের পর্বের লিংক

https://www.facebook.com/groups/canvasbd/permalink/4378089838902842/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here