হৃদয়ের ওপারে তুমি ❤ পর্ব-৫

0
2155

#হৃদয়ের_ওপারে_তুমি
#গল্প_ভাবনায়_ফারজানা_ইয়াসমিন_রিমি (আপু)
#লেখিকা_রিয়া_খান
#পর্ব_৫
পা টিপে টিপে খুব সতর্ক হয়ে বাড়িতে ঢুকলেও শেষ রক্ষা হলো না।ভেজা শরীর থেকে পানি আর পায়ে লেগে থাকা কাদার জন্য পা পিছলে পড়ে যায়। পিচ্ছিল খেয়ে পড়ে গিয়ে মাথা থেকে ঘোমটা টা সরে যায় ফুলের, নিয়ম সামনে ছিলো বলে দেখতে পায় নি পেছনে বোনের পড়ে যাওয়ার দৃশ্য।

ফুল মাথা উঠে দাঁড়াতে যাবে তখন কেউ হাত বাড়িয়ে দিলো,মাথা উঁচু করে উপরের দিকে তাকাতেই ফুল ভয়ে ছিটকে গেলো।

মেঘকালো গম্ভীর হয়ে মা ফুলের দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।ফুল আস্তে আস্তে মায়ের দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। মা কোনো কথা না বলে ফুলের হাত ধরে নিয়ে হুড়মুড় করে উপরের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো ।

চোখের সামনে দিয়ে একটা মেয়েকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে,কালো কুচকুচে মণির বড় বড় চোখ, ঠোঁট টা লালচে রঙের, ধবধবে স্নো হোয়াইটের ন্যায় গায়ের রঙ, মাথায় ভর্তি চুল আলগা দেয়া, ভেজা অবস্থায় আছে টপটপ করে চুল বেয়ে পানি পড়ছে । অভ্র বাকরুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে আর মুখ ফুটে আস্তে করে বেরিয়ে যায়,
-“আমার হুর!”

পাশে থেকে কাব্য অভ্রর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-কিছু বললি?
কাব্যর কথায় হুঁশ ফিরলো অভ্রর, কাব্যকে উত্তরে বললো,
-কই না তো!

ফুলকে নিয়ে ওর মা নিয়ে যাচ্ছিলো।মায়ের এভাবে টেনে নেয়াটা ফুলের অপছন্দ হওয়াই ফুল এদিক ওদিক না তাকিয়ে সোজা মায়ের দিকে তাকিয়ে যাচ্ছিলো।এমন সময় কাব্য ফুলকে ডেকে উঠলো,
-পুতুল বোন!
ফুল নজর ফিরিয়ে কাব্যর দিকে তাকাতে যাবে তখনই চোখ পড়লো, কাব্যর পাশে অভ্রর দিকে।কোনো উত্তর না দিয়ে ফুলও বোবা দৃষ্টিতে অভ্রর দিকে তাকিয়ে রইলো।ছোটো বেলা থেকে ফুপির কাছে রূপকথার গল্পে রাজপুত্রদের বর্ণনা শুনেছে কিন্তু এভাবে বাস্তবে কখনো দেখবে ভাবতে পারে নি।
অভ্রর দিকে তাকিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলে উঠলো,
-রাজপুত্র!

কাব্য ফুলের দিকে হাত ইশারা করতেই ফুলের হুঁশ পজিশনে এলো।
-কাব্য নানা ওয়েট করো আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।
-ঠিক আছে।তাড়াতাড়ি করো।

ফুল মায়ের সাথে চলে গেলো। এদিকে অভ্র এখনো ফুলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।
কাব্য ব্যাপারটা নোটিস করলো,আর অভ্রর চোখের সামনে হাত নিয়ে চুটকি বাজালো,অভ্র কিঞ্চিৎ ছিটকে গিয়ে কাব্যর চোখে চোখ রাখলো!কাব্য কোনো প্রশ্ন না করে ভ্রু নাচালো।অভ্র খানিকটা স্বাভাবিক হয়ে প্রশ্ন করলো,
-এটাই কি তোর সেই রূপকথার গল্পের নায়িকা?
-হুম,রোজ প্যাটেলের রোজ!
কাব্যর সন্দেহ এড়াতে অভ্র একদম স্বাভাবিক হয়ে বলতে লাগলো,
-কিন্তু ফুলে অমন কাদা লেগে আছে কেনো?কোথাও পড়ে গিয়েছিলো হয়তো!যেরকম কাদা লেগেছে তাতে মনে হচ্ছে ব্যাথাও সেই রকম পেয়েছে।আমার প্রশ্ন হলো এতো ব্যাথা পেয়েও স্বাভাবিক ভাবে হেঁটে যাচ্ছিলো মেয়েটা, সেটাই আমি গভীর পর্যবেক্ষণ করে দেখছিলাম কোন এংগেলে দাঁড়ালে এভাবে নিখুঁত ভাবে হাঁটা যায় ।
কাব্য হেসে দিয়ে বললো,
-পড়ে গিয়ে ব্যাথা পায় নি।আমি শিউর ও বাইরে কাদা দিয়ে খেলছিলো বৃষ্টিতে! এটা ফুলের রেগুলার রুটিন! অবাক হওয়ার ও কিচ্ছু নেই।

নিয়ম কাব্য, অভ্র, সমুদ্র, আবির,অয়নের সাথে হ্যান্ডশেক করলো।সবাইকে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে ওদের সামনেই আকাশের পাশে বসে গল্প করতে লাগলো।সবার সাথে গল্পের ভীড়ে থাকলেও অভ্রর মন চলে গেছে ফুলের পিছু পিছু।বসে বসে অপেক্ষা করছে মেয়েটা কখন আসবে! সময় যেনো যাচ্ছেই না।
অনেক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে ফুলের জন্য।ভেতরটা ছটফট করছে প্রচন্ড রকম।নার্ভাস ফিলও হচ্ছে খুব।

-ওপস্ দম বন্ধ হয়ে আসছে কেনো! মেয়েটা সেই কখন বলে গেলো “ফ্রেশ হয়ে আসছি”।এখনো আসছে না কেনো!ওটা কি কোনো মেয়ে ছিলো নাকি হুর ছিলো?এতো সুন্দর! কাব্য যেভাবে বর্ণনা দিয়েছিলো এ তো তার থেকেও শত কোটি গুণ সুন্দর।
ওপস এই মুহুর্তে মনে পড়ে যাচ্ছে
কবি জীবনানন্দ দাশ নাটোরের বনলতা সেনের প্রেমে পড়ে লিখেছিলেন সেই কবিতাটা। সেও হয়তো আমারি মতো অপ্রত্যাশিত ভাবে প্রথম দেখায় ঘোরে পড়ে যায়।

হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে।
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে।
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।

আচ্ছা আমি যদি এই নারীকে নিয়ে কবিতা করতে যাই? এতো কষ্ট করার কি প্রয়োজন! নাটোরের বনলতা সেনের জায়গায়” টাংগাইলের হুর পরী “লাগিয়ে দিলেই তো হয়!
আমিও যদি এ নারীর রূপের বর্ণনাতে বনলতা সেন ম্যাডামের নাম আনি তবে তো জীবনানন্দ দাশ স্যার খুওওওব রাগ করবেন।একেতে শর্টকাটে তাঁর কবিতা লাগিয়ে দিয়েছি এখন যদি নামটাও নিয়ে নেই!স্যার প্রচ্চুর রাগ করবেন!

চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ‘পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে টাংগাইলের হুর!

-কিরে অভ্র কি ভাবছিস?
সমুদ্রের উচ্চস্বরে ডাক পড়াতেই অভ্রর মন কল্পনার রাষ্ট্র থেকে বাস্তব ও বর্তমানে ফিরে এলো।

-না নাহ ক্কি কিছু না তো। কিছু ভাবছি না।জার্নি করে এসেছি না,তাই টায়ার্ড লাগছে।

এমন সময় আকাশের মা এসে বললো,
-বাবা তোমরা সবাই ফ্রেশ হয়ে নাও।সেই কখন বেরিয়েছো তোমরা,এতোদূরের পথ।যাও সবাই ফ্রেশ হয়ে নাও তারপর দুপুরের খাবার খাবে। যদিও বেলা পেরিয়ে গেছে।
অভ্র সাথে সাথে উত্তর দিলো,
-ইট’স ওকে আন্টি সমস্যা নেই।রাস্তা ফ্রিই ছিলো অতোটা টায়ার্ড হই নি আমরা।
-আরে বাবা জানি তোমরা খারাপ লাগলেও বলবে না।এই যে কাব্য এতোদিন ধরে আমাদের সাথে থাকে কিন্তু এই ছেলেটার এতো বাজে স্বভাব নিজের কোনো সমস্যা হলে আমাদের বলবে না।সে নিজের সমস্যা নিজে নিয়েই পড়ে থাকবে।
কাব্য উত্তর দিলো,
-ঠিক আছে যাচ্ছি আমরা আন্টি।সত্যি বলতে আসলেই টায়ার্ড লাগছে।সকাল সকাল উঠে রেডি হয়ে বের হয়েছি।

– অনু,মীরা, অয়নী,বৃষ্টি মা তোমরা ফুপির সাথে যাও,তোমাদের রুম দেখিয়ে দেবে।আর বাবা তোমরা আকাশের সাথে যাও।আকাশ ওদের যা যা লাগে দিয়ে দিস।

-আরেহ তাহলে কি হুরের সাথে এখন দেখা হচ্ছে না? এতোক্ষণ ওয়েট করলাম তাও এলো না!আর কিছুক্ষণ ওয়েট করলেই তো দেখা পেতাম।কিন্তু এদের কিভাবে বুঝাই!

অভ্র মনে মনে বললো কথা গুলো।
না চাইতেও উঠে যেতে হলো আকাশের সাথে। সব রুম আগে থেকেই ওদের জন্য বুকিং ছিলো মানে গুছিয়ে রাখা হয়েছিলো আর কোনো আত্মীয়দের উঠতে দেয়া হয়নি। ওরা আনকম্ফোর্টেবল ফিল করবে বলে আর কোনো গেস্টদের রাখা হবে না।শুধু পারভেজের শ্বশুর শাশুড়িদের থাকতে দেয়া হয়েছে।বাকি সব গেস্টদের জন্য ফুলদের ফ্ল্যাট,নিজামদের ফ্ল্যাট আর,ফুলের ফুপিদের ফ্ল্যাট বরাদ্দ করা হয়েছে।

আসমা বেগম আকাশদের বাড়ির নিচ তলায় দুটো রুম দেখিয়ে দিলো একটা রুমে অয়নী আর অনু ঢুকলো,আরেক রুমে মীরা আর বৃষ্টি।

আর ছেলেরা উপরতলায় গেলো।ফুপি সবার থাকার রুমে আগে থেকেই মিষ্টি, সন্দেশ, ফ্রুটস, কেক, ড্রাইফ্রুট দিয়ে রেখেছে। ওদের সবার দেখাশোনার দায়িত্ব ফুপিমার উপরেই দেয়া হয়েছে যেনো কোনো অসুবিধায় না পড়তে হয়।

অভ্রর কোনো ভাবেই ঘোর কাটছে না।আবার মুখ ফুটে কাউকে বলতেও পারছে না।কারণ যে পরিমাণে ফুলের নামকে ইগনোর করেছে তাতে যদি অভ্র এখন বন্ধুমহলের কাউকে জানায় তবে সবাই মজা নেবে ওর।

এদিকে ফুল সেই একই ঘোরের মধ্যে আছে।মা প্রচুর বকাঝকা করছে আর পরিষ্কার করে গোসল করিয়ে দিচ্ছে। গায়ে এমন বাজে ভাবে কাদা লাগিয়েছে।বিশেষ করে চুলের মধ্যে কয়েক জায়গায় কাদা লেগেছে যেগুলো শ্যাম্পু করার পরও যাচ্ছে না।
-ইশ কি বাজে অবস্থা করেছিস নিজের দেখেছিস?ছবি তোলে সবাইকে দেখানো উচিৎ ছিলো তোর এই রূপ!বিয়ে বাড়ি নানান দেশ থেকে নানান আত্মীয় এসেছে।সবাই এসে জিজ্ঞেস করছে মেয়ে কোথায়! মেয়ে কোথায় সেটা বাড়ির একটা সদস্যও জানি না।এতো বড় মেয়ে সেজেগুজে টিপটপ হয়ে ঘুরবে তা না। মেয়ে আমার কোথায় হাওয়া হয়ে গিয়ে গা ভরে কাদা নিয়ে ঘুরছে।লোকে তো তোকে পাগল বলবে কিছুদিন পর থেকে।আচ্ছা তোর কি বোধ শক্তিতে আসে না? তুই যে বড় হতে বাদ নেই?কলেজ পড়ুয়া মেয়ে এমন ছেলেমানুষি করলে পোষায়?আর কতোদিন তোর এই অত্যাচার সহ্য করবো বলতো?কবে তোর মস্তিষ্ক বোধ শক্তি বড় হবে?

মায়ের বকুনি খেয়ে ফুল আজ মাইন্ড করছে না। কারণ একটা বকুনিও কান দিয়ে যাচ্ছে না। ফুল আছে এক বেঘোরের মধ্যে, চোখের সামনে তাঁর রাজপুত্রের স্পষ্ট কায়া ভেসে উঠছে!আর সেটাই সে উপলদ্ধি করছে।

গোসল শেষে ফুলকে জামা কাপড় পড়িয়ে দিলো মা।

ভেজা চুল গুলো টাওয়াল দিয়ে ভালো করে মুছে দিয়ে কোনো প্রকার দুষ্টুমি না করে নিচে যেতে বললো।ফুল শুধু মাথা নাড়ালো,মা ফুলের রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।

এদিকে অভ্ররা সবাই ফ্রেশ হয়ে আকাশের সাথে ফুলদের বাড়িতে এলো।লাঞ্চের জন্য আবার আসা।আকাশদের ফ্ল্যাটেই খাবার দিতে চেয়েছিলো কিন্তু ওরা সবাই বললো এবাড়িতেই খাবে সবার সাথে।

এরমধ্যে আশিক, পলাশ,আয়মান ও এসে পড়েছে।নিজাম তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে ডক্টরের কাছে গেছে।আশিক সবার সাথে কোলাকুলি করতে লাগলো।আয়মান পলাশের সাথেও সবাই হ্যান্ডশেক করে কুশল বিনিময় করলো।আর অভ্র ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক শুধু ফুলকে খুঁজছে।
নিশ্বাস টা আটকে আসছে কেমন যেনো।এতো মানুষের ভীড়ে কোন আড়ালে আছে মেয়েটা জানা নেই!প্রচন্ড নার্ভাস লাগছে কেনো জানি।

সবাই ডাইনিংয়ের দিকে যাবে এমন সময় পেছন বরাবর উপর থেকে আওয়াজ এলো,
-কাব্য নানা!
সবাই এক সাথে পেছন ঘুরে তাকায়।ফুলকে দেখে শুধু অভ্র না,সমুদ্র, অয়ন,আবির, প্রত্যেকেই ফিট খায়।সবাই এক সাথে নির্বাক দৃষ্টিতে চেয়ে রয় ওর দিকে!
কাব্য ফুলের দিকে তাকাতেই ফুল কয়েক সেকেন্ডে চিলের ন্যায় যেনো উড়াল মেরে নিচের দিকে আসছে।

একটা ব্ল্যাক কালার ড্রেস পড়েছে ফুল।তখন কর্দমাক্ত অবস্থায়তেই এতো সুন্দর লাগছিলো।আর এখন তো পুরো ফিটফাট আছে।কালো রঙের জামাতে যেনো আরো জ্বলজ্বল করছে।চুল গুলো ভেজা আছে,আগা বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে,অভ্র আবার সেই চুল বেয়ে পানি পড়ার দৃশ্য গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছে!ফুল ওদের দিকে যতোই আসছে অভ্রর নিশ্বাসের গতি ততোই কমে আসছে।
ফুলের ঠোঁটে একটা মিষ্টি হাসি লেগে আছে যেটা আরো বেশি মন কেড়ে নিচ্ছে।

নিজের ভেতর গিলটি ফিল হতে লাগলো এটা ভেবে আজকে দুপুর অব্ধিও এই মেয়ের নাম শুনে অভ্রর গা জ্বলে উঠতো।ভাবতেও পারে নি এরকমটা হবে পরিস্থিতি।

ফুল একদম কাছে আসতেই কাব্য ফুলকে জড়িয়ে ধরলো,
-এইতো পুতুল বোন আমার।কেমন আছে বোনটা?
-অনেক ভালো নানা।তুমি কেমন আছে?
-আলহামদুলিল্লাহ আমিও অনেক ভালো আছি।আসো তোমাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।

ফুল হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো, কাব্য সবাইলে দেখিয়ে একে একে পরিচয় করিয়ে দিতে লাগলো।ফুল অভ্রর দিকে তাকিয়ে লজ্জা পেয়ে,সাথে সাথে নজর ফিরিয়ে নেয়।সবার মধ্যে ফুলের কেনো জানি অনুকে খুব বেশি পছন্দ হলো,কারণ অনুর কথা কাব্যর কাছে খুব শুনেছে আর ফুল অনু দুজনেই সমবয়সী বলেই হয়তো বেশি মনে ধরেছে।এখনো অনুর সাথে ফুলের কথা হয় নি।তবে এই এক নজরেই ফুল বুঝতে পেরে গেছে অনু আর অভ্র ভাই বোন হবে কারণ ওদের গায়ের রঙ একদম এক আর চেহারার কাটিং ও প্রায় সেম তাতেই বোঝা যাচ্ছে।অভ্রর বড় ভাইয়ের চেহারাও প্রায় অভ্রর মতো কিন্তু জিয়াদ অনেকটা ফর্সা আর অভ্র অনু উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের।

ফুলের বড় চাচী সবার সামনে এসে বললো,
-তোমরা ডাইনিংয়ে চলো এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি?চলো চলো।আর পরীমা তুই ও চল খেয়ে নিবি।
-বড় মা আমি খাবো না এখন!পরে খাবো?
-বেলা কটা বেজেছে দেখেছিস?
-না এখন খাবো না আমি।
-আমি কিছু জানি না ভাইদের গিয়ে বলো খাবো না।

কাব্য ফুলের দিকে তাকিয়ে বললো,
-আরে পুতুল বোন খাবে না কেনো?চলো আমাদের সাথে খেয়ে নেবে।না হলে তোমার জন্য একটা জিনিস এনেছি সেটা দেবো না।
-কি এনেছো তুমি?
-আগে খাবে তারপর দেবো।
-ঠিক আছে চলো।

ফুলকে সাথে নিয়ে সবাই ডাইনিংয়ে বসলো।খাবার টেবিলে এক পাশে কাব্য,সমুদ্র, অভ্র, অয়ন,আবির, আকাশ বসেছে।আর একপাশে ফুল, অয়নী,অনু,মীরা বৃষ্টি।ফুল কাব্যর সাথে টুকিটাকি কথা বলছে হাসাহাসি করছে আর অভ্র ফুলের মনমাতানো হাসির শব্দ মন দিয়ে শুনে মস্তিষ্কে রেকর্ড করছে।
বড় মা ফুলকে খাইয়ে দিচ্ছে আর ফুপি, মামী খাবার সার্ভ করে দিচ্ছে সবাইকে।ফুলের মা আশিকের রুমে কি একটা কাজে যেনো আছে। বাড়িতে এতো এতো আত্মীয় স্বজন আসায় কাজের লোকরা সব কাজ নিয়ে ব্যস্ত আর বাড়ির লোকেরা অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত।ফুলের সব ভাবীরা বাকি অতিথিদের আপ্যায়ন করছে।

কিছু মানুষ বিয়ে বাড়ি এসে নানান দোষ
খোঁজার চেষ্টা করে।এরকম কোনো কিছু যেনো না ঘটে সে দিকে সতর্ক এবাড়ির সবাই।প্রত্যেক মেহমানকে আন্তরিকতার সাথে আপ্যায়ন ও আদর যত্ন করা হচ্ছে।সকাল থেকে দূর দুরান্তের আত্মীয়রা আসছেই।

ফুল খাচ্ছে খাচ্ছে আর আড়চোখে একটু পর পর অভ্রর দিকে তাকাচ্ছে,অভ্র যখন ফুলের থেকে চোখ সরিয়ে খাবারের দিকে তাকিয়ে খাবার মুখে নেয় ফুল ঠিক তখনি অভ্রর দিকে তাকায়,আবার ফুল যখন বড় মার দিকে তাকিয়ে খাবার মুখে নেয় ঠিক তখন অভ্র ফুলের দিকে তাকায়।এমন ভাবে চোখাচোখি চলছে দুজনের, কারোর সাথে কারো চোখে চোখ পড়ছে না।

খাবার শেষ হতেই সবাই আকাশদের বাড়িতে গেলো।বিকেল অব্ধি সবার রেস্ট করার প্ল্যান চলছে।যেহেতু ফুলদের বাড়িতে মানুষ বেশি, সবাই রিল্যাক্সে গল্প গুজব করার জন্য আকাশদের বাড়িতেই গেলো।
সাথে ফুলকে নিয়েও গেলাও কাব্য।কারণ ফুলের জন্য অনেক কিছু এনেছে।
কাব্য ব্যাগ খোলে ফুলের জন্য এতো এতো ডল এনেছে আর অনেক রকম চকলেট। এগুলো ঈদ উপলক্ষে দেয়া হচ্ছে ফুলকে। এমনিতেও কাব্য প্রতিবার ঢাকা থেকে ফেরার সময় ফুল,নিয়াজ,আমানের জন্য কিছু না কিছু আনে।আজও ফুলের জন্য ডল আর আমার আমান, নিয়াজের জন্য খেলনা গাড়ি এনেছে। ফুল কাব্যর থেকে গিফট পেয়ে প্রচন্ড খুশি।ফুল যখন হাসে ওর চোখে মুখে ওর হাসি গুলো ফুটে উঠে স্পষ্ট,দেখতে প্রচন্ড মায়াবী লাগে।সবার সাথে ফুল কত্ত তাড়াতাড়ি মিশে গেছে। ফুলের ব্যাবহারে সবাই খুব বেশি মুগ্ধ।প্রত্যেকেই টুকিটাকি কথা বলছে মজা করছে কিন্তু অভ্র একটা কথাও বলছে না চুপচাপ শুধু ফুলকে দেখে যাচ্ছে।আর অবাক হচ্ছে এতো বড় একটা মেয়ে বিহেভিয়ার একদম আট দশ বছরের বাচ্চার মতো,একটুতেই অনেক বেশি খুশি হয়ে যায়।কথায় কথায় সবাইকে খুব হাসাচ্ছে। আবার মাঝে মাঝে দুষ্টুমিও করছে।ফুলের দুষ্টুমি গুলো খুব এনজয় করার মতো।ফুলের সাথে এখানে সব থেকে বেশি ভাব হয়েছে অনুর।দুজনের কথায় কথায় খুব মিল হচ্ছে।

বিকেল ৪ টা বাজে
আকাশের রুমে গোল মিটিং বসেছে, যেখানে উপস্থিত আকাশের পুরো ফ্রেন্ড সার্কেল,পলাশ, আশিক,ফুল, আয়মানের স্ত্রী কবিতা, নিজাম ও নিয়মের স্ত্রী সুমাইয়া ও ঐশী আর পারভেজের স্ত্রী সুলতানা।

বিয়েতে কি কি মজা করবে তার প্ল্যানিং আর গায়ে হলুদে হবে নাচ গান হবে।
কে কোনটা করবে তার প্ল্যানিং।

রাতে সবাই রিহার্সাল করবে, প্রস্তুতি নিবে কালকের অনুষ্ঠানের জন্য।

সবাই কিছুক্ষণ গল্প গুজব করার সময় আসরের আজান দিয়ে দিলো।আর গল্পের আসর ভেঙে নামাজের জন্য যেতে লাগলো সবাই।

নামাজ শেষে সবাই বাইরে ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করলো।কিন্তু সবার সাথে বাড়ির ভাবীরা শামিল হতে পারলো না।কারণ বাড়িতে অতিথি আপ্যায়নের দায়ীত্ব পড়েছে তাদের ঘাড়ে।তাঁর মাঝে নিজামের স্ত্রী তো প্রেগন্যান্ট ওর চলাফেরা খুব কেয়ারফুললি করতে হয়।সবে আজ ডক্টর দেখিয়ে এসেছে কাল ঈদ ছিলো বলে যেতে পারে নি ডক্টর দেখাতে।

ভাবীরা বাদে সবাই ঘুরতে গেলো,আশিক,আকাশ,পলাশ, ফুল, নিয়াজ,আর বন্ধু মহলের সবাই।

খুব দূরে কোথাও না গিয়ে সবাই বেড়াতে গেলো মনতলা রোডে। এটা অনেক বেশি সুন্দর জায়গা।রোডের একপাশে বর্ষার পানি টলমল করছে।তারমধ্যে ভাসমান শাপলা ফুল কিন্তু ফুটন্ত না।যেনো ফুল গুলো দলবেঁধে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিয়ে জড়সড় হচ্ছে। দুপুরের পর বৃষ্টি পুরোপুরি থেমে গিয়ে আকাশ একদম পরিষ্কার দেখাচ্ছে।নীল আকাশে সাদা রঙের মেঘ গুচ্ছ উড়ে বেড়াচ্ছে।প্রকৃতিটা খুব বেশি মনোমুগ্ধকর লাগছে।রোডের মাঝখান দিয়ে সবাই গ্রুপ বেঁধে গল্প করতে করতে হাঁটছে হাসি ঠাট্টা করছে।

আর অভ্র দল ছেড়ে পেছনে পড়ে আছে দুই হাত পকেটে ঢুকিয়ে মেঘ সমান ঘোর নিয়ে, পিঁপড়ার গতিতে হাঁটছে,আর মনে মনে নানান কবিতা বুনছে।আবার ভাবছে!
-আচ্ছা কি আছে এই হুরপরীর মাঝে এতো নজর কাড়ছে আমার?মন টিকছে না আমার মস্তিষ্কের মাঝে।প্রেমে পড়ে গেছি আমি ওর?নাকি কেবলি একটা ঘোরে আটকে গেছি?কতো নারীই তো দেখলাম জীবনে কই তাদের পিছনে তো কখনো আমার আমার মন ছুটে পালিয়ে পিছু নেয় নি!যা আজকে এক দেখায় ই এই নারীকে দেখে হচ্ছে।আচ্ছা ও কাছে এলে আমার হৃদস্পনদন থেমে যায় কেনো?আমি কি ওর প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে যাচ্ছি? আবার দূরত্ব বাড়লেই হৃদস্পনদন বেড়ে যাচ্ছে সেটা কি তবে?হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে আঁকড়ে রাখার প্রবণতা? এমনটাও সম্ভব? ওকে তো আমি আজই দেখলাম তাহলে কেনো সব কিছু এতো ফাস্ট হচ্ছে?কাছে এলেই গুলিয়ে যাচ্ছি।ভালোবাসা নামের অনুভুতিটাকি এভাবেই হুট করে আসে জীবনে?

মস্তিষ্ক কাউকে ভালোবাসতেই পারে কিন্তু তাই বলে এভাবে আকষ্মিম ভাবে?যার নাম অব্ধি শুনতে পারতাম না, যার প্রসঙ্গ উঠলে কান চেপে থাকতাম মনে মনে তার এক বিশ্রি প্রতিচ্ছবি এঁকে নিয়েছিলাম আর বাস্তব সবটা উল্টে দিলো!
হায় নিয়তি কি ঘটতে চলেছে আমার সাথে?

এমন সময় সামনে থেকে ফুল পেছনে ঘুরে অভ্রর দিকে তাকিয়ে বললো,
-অভ্র ভাইয়া!
অভ্র হাল্কা মস্তিষ্কে ঝাঁকুনি খেয়ে ফুলের দিকে স্পষ্ট নজরে তাকালো।
-এতো পেছনে কেনো?এদিকে আসেন।
অভ্র মাথা নাড়িয়ে হাঁটার বেগ বাড়িয়ে ওদের কাছাকাছি চলে গেলো। ফুল কাব্যর দিকে তাকিয়ে বললো,
-অভ্র ভাইয়া কি একটু অন্যরকম নাকি?
কাব্য চোখ কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
-কি রকম?
-এই যে কেমন যেনো সবার থেকে একটু বিচ্ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে।কথা কম বলে।সমুদ্রে ভাইয়া,অয়ন ভাইয়া, আবির ভাইয়া কতো কথা বলছে আর উনি চুপচাপ। আমি তো অভ্র ভাইয়ার ভয়েসটাই ঠিক মতো শুনি নি।।
-আরে না তেমন কিছু না।অভ্র খুবই মিশুক শুধু একটু টাইম লাগে।

মুখে এই উত্তর দিয়ে কাব্য মনে মনে বললো,
-কি করে বলি রে বোন।অভ্র তোর নামটাই যেখানে সহ্য করতে পারে না আর জলজ্যান্ত তোকে কি করে সহ্য করবে!ও যে আমাদের সাথে এখনো আছে এটাই তো বেশি। কখন যেনো বলে উঠে বিয়ের আগেই ঢাকা চলে যাবো!নাহ কোনো ভাবেই অভ্রকে প্রেশার করা যাবে না কোনো কিছুতে। ফুলকে কৌশলে বলতে হবে অভ্রর থেকে দূরে থাকতে।নাহলে কখন আবার অভ্র ফুলের সাথে মিসবিহেভ করে বসে কে জানে!

কাব্যর ধারণা অভ্র যেহেতু ফুলের প্রসঙ্গ উঠলেই রেগে যেতো সেহেতু এখন ফুলকে দেখে আরো রাগ হচ্ছে যার কারণে কথা কম বলছে ফুলের সামনে, আর দূরে দূরে থাকছে।

ফুলের প্রশ্নটা অভ্র পেছন থেকে শুনে ফেলে। কোনো উত্তর না দিয়ে মনে মনে বললো,
-কি করে কথা বলবো হুর! তোমাকে দেখলেই তো আমার ভেতর থেকে বাকশক্তি সাপ্লাই অসাড় হয়ে কণ্ঠস্বর চেপে আসে যার জন্য মুখ থেকে কোনো কথা বের হয় না ।

অভ্র এসে ফুলের পাশে এসে দাঁড়ালো ফুলের মুখে চুইংগাম ছিলো মুখের মধ্যে চুইংগাম দিয়ে বাবল ফুলাতে লাগলো এমন সময় আশিক বাঁ হাত লাগিয়ে ফুলের বাবল টা ফাটিয়ে দেয় আর ফুলের নাকে মুখে চুইংগাম টা লেগে যায়।
ফুল উচ্চস্বরে বলে উঠলো,
-দাদা কি করলে এটা তুমি?আমার বাবল টা ফাটিয়ে দিলে!
আশিক বদ হাসি দিয়ে বললো,
-কি করবো বল,তোকে বাবল ফুলানো দেখে আমার হাত শুঁড়শুঁড় করছিলো তাই করলাম আর কি।
– বাঁ হাত দিয়ে কেনো? নষ্ট করে দিলে চুইংগাম টা, এখনো মিষ্টি শেষ হয় নি এটার।
-হি হি হি!
-সরি না বলে হি হি করছো দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা।
এই বলেই ফুল মুখের মধ্যে লেগে থাকা চুইংগাম আশিকের গায়ে লাগিয়ে দেয়ার উদ্দ্যেশে হাতে নিতে নিতেই আশিক বুঝে গেলো আর ফুলের কাছে থেকে সরে গিয়ে সামনের দিকে দৌড়াতে লাগলো ফুলও পিছু নিলো,এক দৌড়ে আশিকের কাছে পৌঁছালেও কোনোমতেই আশিকের গায়ে লাগিয়ে দিতে পারছে না। আশিক ফুলকে সহ ফুলের হাত চেপে ধরেছে আর খিলখিল করে হাসছে। ওদের কান্ড দেখে সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ার অবস্থা অবশেষে কোনো মতে আশিকের শার্টে লাগিয়েই দিলো।এবার ফুলের ঠোঁটে বিজয়ের হাসি ফুটেছে।
আশিক শার্ট থেকে চুইংগাম উঠিয়ে ফুলের চুলে লাগিয়ে দেবে এই হুমকি দিয়ে ধাওয়া করতেই ফুল হাসতে হাসতে উল্টো ঘুরে দৌড় লাগায়। চিলের মতো দৌড় দিতে গিয়ে নিচের দিকে নজর নেই,রাস্তার মাঝ বরাবর কিছু কংক্রিট ভাঙা ছিলো যার মধ্যে ফুল উষ্টা খেয়ে পড়ে যায় যায় তাঁর আগেই…..

চলবে…………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here