হৃদয়ের কোণে পর্ব ১৭

0
796

#হৃদয়ের_কোণে (পর্ব ১৭)
#নাহার
·
·
·
বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে নিরা। আজকের আকাশ মেঘলা। শীতকালে সূর্যের তাপ তেমন একটা প্রখর হয় না তাই আকাশ মেঘলাই দেখায়। আকাশের সাথে সাথে নিরার মনটাও মেঘলা হয়ে আছে। চুপ করে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে। বিষন্নতা ভর করেছে নিরার মনে। বারবার মনে হচ্ছে তার মতো খারাপ মেয়ে আর একটাও নেই দুনিয়াতে। তুহিনের প্রেমে অন্ধ হয়ে কত পাগলামো করেছে ভাবতেই কান্না আসছে। পেছন থেকে কারো আওয়াজ পেয়ে চোখ মুছে পেছন ফিরে তাকায় নিরা। নিরার ছোট চাচি দাঁড়িয়ে আছে। মিসেস রেহানা বিছানায় বসতে বসতে বললো,
— এভাবে একা একা ওখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস নিরা?

নিরা রুমে ঢুকে বেডে আধশোয়া হয়ে বসে বললো,
— কিছু না চাচি। তোমার খবর বলো।

— কিছুতো একটা হয়েছে চেহারা দেখেই বুঝতে পারছি। বল কি হয়েছে?

নিরার চোখ পানিতে ভিজে গেলো। ছলছল চোখে মিসেস রেহানার দিকে তাকিয়ে বললো,
— আমি খুব খারাপ তাই না চাচি? উলটা পালটা কত কিছু করে ফেলেছি। আমি সত্যি খুব খারাপ।

— আচ্ছা এই কথা। ওকে তাহলে তোকে একটা গল্প শোনাই শুনবি?

— কিসের গল্প?

— একটা মেয়ের গল্প।

— আচ্ছা বলো।

— একটা মেয়ে। খুব বোকা মেয়ে। কলেজে ফাস্ট ইয়ারে পড়তো কিন্তু ভালো মন্দ বুঝতো কম। একবার একটা ছেলের সাথে বন্ধুত্ব করে। ভেবেছিলো ছেলেটা ভালো হবে কিন্তু তার ধারণা ভুল করে দিয়ে ছেলেটা একা পেয়ে মেয়েটার সাথে খারাপ আচরণ করে। মেয়েটা এবার খুব একা হয়ে যায়। সারাদিন কাঁদতে থাকে। কাউকে বলতে পারতো না। আবার একজন আসে এইরকম বন্ধুত্ব করে। বলেছিলো মেয়েটার বিশ্বাস ভাঙবে না। প্রথমবারের মতো মেয়েটা সেই ছেলের প্রেমে পড়ে। ভালই যাচ্ছিলো প্রেম। সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। কিছুদিন পরই ছেলেটাও আগেরজনের মতো খারাপ আচরণ করে। নিরা খারাপ আচরণ মানে বুঝতে পারছিস?

— তুমি বলো।

— আপত্তিকর এমন ব্যবহার।

— তারপর?

— এবার মেয়েটা আর কাউকে বিশ্বাস করতো না। আর কোনো মেয়েকেও বান্ধুবি বানাতো না। একা একা থাকতো। এভাবে তিন বছর একাই ছিলো। ভার্সিটিতে প্রথম বর্ষের মাঝামাঝি একজনের সাথে তার পরিচয় হয়। বেশ এরিয়ে চলতো সেই মানুষটিকে। ছেলেটা মেয়েটার তিন বছরের সিনিয়র ছিলো। মেয়েটা ভয় পেতো যদি আগের মতো কিছু হয়। দিন যত যাচ্ছে ছেলেটা আরো মিশতে থাকে। একদিন মেয়েটাকে প্রপোজ করে দেয়। মেয়েটা না করে দিয়ে চলে আসে। এভাবে ছেলেটা মেয়েটাকে চার পাঁচ বার প্রপোজ করে এবং মেয়েটা না করে দেয়। দুই বছর আর কোনো খোজ পায়নি ছেলেটার। দুই বছর পর ছেলেটা একেবারে মেয়েটার বাসায় উপস্থিত হয় এবং বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে আসে। বিয়েও হয়। তাদের সম্পর্কটা এখন এতোই ভালো যে সেখানে ভালোবাসায় ভরপুর। কি বুঝলি এখান থেকে?

— আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না।

— গাধি। কে আছে কে চলে গেছে এসব ভেবে কষ্ট পাস না। যে থাকার সে তোর অতীত মেনে নিয়েই তোকে ভালোবাসবে। ভালোবাসায় দোষ গুণের জায়গা নেই নিরা। খারাপ কিছুর পরেই জীবনে ভালো কিছু ঘটে। জীবনটা সবসময় আমাদের নিজের চাওয়ার মতো করে ঘটে না। আমরা যেটা বেশি প্রত্যাশা করি সেটা ঘটে না। যেটা আমরা একদমই প্রত্যাশা করি না সেটাই বেশি ঘটে। তাই জীবন থেকে খুব বেশি চাওয়া, খুব বেশি আশা রাখতে নেই। “জীবন সহজ না। জীবনকে সহজ বানিয়ে নিতে হয়। কখনো দু’আ করে, কখনো সবর করে, কখনো মাফ করে আবার কখনো বা এরিয়ে চলে” (- মাওলানা তারিক জামিল)। যা হয়েছে সব এরিয়ে যা। আর যে করেছে তাকে মাফ করে দে। আর শুন। বোকা মেয়েরা সব সময় বোকা থাকে না। জীবনের এমন অনেক পরিস্থিতি তাদের কঠিন বানিয়ে দেয়। শিখে যায় কিভাবে মানুষ চিনতে হয়। তুইও পারবি।

নিরার চাচি কথা গুলো বলে উঠে দাঁড়ায়। দরজার দিকে পা বাড়ায়। নিরার মনে এক রকম ভালো লাগা কাজ করছে। নিরার মনে হঠাৎ প্রশ্ন আসে তাই সে তার চাচিকে ডেকে বলে,
— চাচি তোমার গল্পের মেয়েটা কে?

নিরার চাচি পেছন ফিরে মুচকি হেসে বলে,
— তোর চোট চাচি।

নিরা অবাক হয়ে বলে,
— মানে মেয়েটা তুমি?

— হুম।

— আর শেষের মানুষটা চাচা?

নিরার চাচি আরেক দফা মুচকি হেসে চলে যায়। নিরা উঠে দাঁড়ায়। চোখে মুখে প্রফুল্লতা। এমন ভালো লাগা আর কখনো কাজ করেনি নিরার। তার চাচিকে দেখে অনেক কিছু শিখার আছে। নিরা এসব ভেবে কৌশিকের রুমে যায়। কৌশিক বই পড়ছিলো। নিরা গিয়ে কৌশিকের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
— ভাইয়া তুই খুব ব্যস্ত?

কৌশিক বইটা নামিয়ে বললো,
— কিছু বলবি?

— হুম।

কৌশিক পা ভাজ করে বসে বলে,
— বয় এখানে। বল কি বলবি?

নিরা কৌশিকের ভাজ করা পায়ের উপর মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। কৌশিক আবার বইটা চোখের সামনে ধরে। নিরা ডান হাতের আঙুল দিয়ে সামনের চুল পেছাতে পেছাতে বলে,
— ভাইয়া তোর আর আফিয়া আপুর ব্যাপারে কিছু বল না প্লিজ। শুনতে ইচ্ছে করছে।

কৌশিক বইয়ের নিচ দিয়ে ফাক করে নিরাকে দেখে। হালকা হেসে বইয়ের পাতায় মনোযোগ এনে বলে,
— আমাদের কথা বাদ দে। একটা গল্প শুন।

— কি গল্প?

— খুব সুন্দর একটা সম্পর্কে ভাঙন ধরেছিলো। তাই মেয়েটা চলে গেছিলো ছেলেটাকে ছেড়ে। অবশ্য ছেলেটার দোষ ছিলো সেখানে। মেয়েটা আর কোনো ভাবেই ছেলেটাকে চাইতো না। তবে অন্য কোনো সম্পর্কেও যায়নি। ছেলেটা অনেকবার চেয়েছে ফিরে আসতে মেয়েটা পাত্তা দেয়নি। তাই আর না পারতে ছেলেটা মেয়েটার মুখে এসিড মারে। তারপর মেয়েটাকে বিয়ে করে।
( ২০১৬/১৭ এর দিকে abc রেডিও-তে RJ কিবরিয়ার একটা অনুষ্ঠান Hello 8920 -তে এসিড দগ্ধ মেয়েটা এসে তার জীবন গল্প বর্ণনা করে গেছিলো। সম্পূর্ণ মনে নেই। শুধু থিমটাই মনে আছে। মেয়েটার নামও মনে নেই।)

— সিরিয়াসলি? পুরাই সিনেমার গল্প।

— সিনামা নয় সত্যি। মেয়েটাকে এসিড মারার একটাই কারণ ছিলো যাতে অন্য কোনো ছেলে তাকে বিয়ে না করে এবং সে যেনো বাধ্য হয়ে ছেলেটার কাছেই ফিরে আসে।

— অদ্ভুত!

— পৃথিবীতে সবচেয়ে আজব প্রাণী হচ্ছে মানুষ। মানুষ কতটা অদ্ভুত চরিত্রের হতে পারে সেটা কল্পনার বাহিরে। ভালোবাসায় মানুষ কতটা অদ্ভুত অদ্ভুত আচরণ করে সেটা তোর আমার কল্পনার বাহিরে। রেডিও-তে যেই জীবন গল্প দেয় সেগুলি শুনিস। মানুষের জীবন কতটা কঠিন সেটা বুঝতে পারবি। ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে মানুষ কি কি করেছে তাও জানতে পারবি।

নিরা কিছু না বলে উঠে চলে আসে। এইসব ভাবছে আর সিড়ি দিয়ে নামছে। মায়ের রুমের সামনে চলে এসেছে। নিরা তার মায়ের রুমে এসে মার সামনে বসে জিজ্ঞেস করলো,
— আচ্ছা মা তোমার কাছে ভালোবাসা মানে কি?

— হঠাৎ এই প্রশ্ন?

— জানতে চাইছি। প্লিজ বলো। বাবার প্রতি ভালোবাসাটা বলবে।

— তুই হয়তো জানিস না তোর বাবা আমার অংকের স্যার ছিলো।

— মা সিরিয়াসলি? তারপর কিভাবে কেমনে হলো?

— সবসময় পড়ার জন্য কত যে শাসন করতো। যেদিন আমার এস এস সি পরীক্ষা শেষ হয়েছে সেদিন যাওয়ার সময় আমার খাতায় লিখে গেছিলো ” শায়েলা আমি তোমাকে ভালোবাসি “। কয়েকদিন পরই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে।

— ওয়াও মা। হাও রোমান্টিক!

— তোর বাবার শাসন, শাসনের পরে সুন্দর করে কথা বলা, আমার জন্য ফুল নিয়ে আসা এগুলোই আমার কাছে ভালোবাসা। তুই এবার যা বুঝার বুঝে নিস।

নিরা এবার ড্রয়িং রুমে বসা তার বাবার কাছে যায়৷ পাশে বসে জিজ্ঞেস করে,
— বাবা একটা কথা ছিলো।

— হ্যাঁ মা বল।

— আচ্ছা বাবা তোমার কাছে ভালোবাসা মানে কি?

— হঠাৎ?

নিরা করুণ সুরে বললো,
— প্লিজ বলো।

— তোর মায়ের অনেক রাগ জানিস তো?

— হ্যাঁ।

— আমার রাগও অনেক। দুইজনই রেগে গেলে বাড়ি উঠিয়ে ফেলতাম। তবে আমি রাগলে সে চুপ থাকতো এবং সে রাগলে আমি চুপ থাকতাম। সবাই বলতো এই দুইজন বেশিদিন একসাথে থাকতে পারবে না। একদিন আমি এবং তোর মা দুইজনেই খুব রেগে গেছিলাম। আমি ঘর থেকে বের হয়ে চলে গেছিলাম আর শায়েলা বললো বাপের বাড়ি চলে যাবে। খুব রাত করে বাড়ি ফিরেছি। ফিরার সময় শুনলাম অনেকে বলছে তারা যা বলেছে সেটাই ঠিক। আমরা কোনোদিন একসাথে থাকতে পারবো না। রাগ হলো। মনে মনে ঠিক করে নিয়েছি ওদেরকে ভুল প্রমাণিত করে শায়েলাকে বাপের বাড়ি থেকে ফিরিয়ে আনবো। ঘরে গিয়ে দেখি তোর মা সেকি কান্না। আমি সামনে যেতেই আমাকে ঝাপটে ধরে বললো আর কখনো রাগারাগি করবে না। তখন আমি মিটিমিটি হাসছিলাম। তোর মা আমার পায়ে ধরেও মাফ চেয়েছে। সেদিনের পর থেকে আজ পর্যন্ত ছেড়ে যাওয়ার কথা একবারো আসেনি। আমরা দুইজন খুবই রাগি মানুষ তাও একসাথে আছি, একজন আরেকজনকে সম্মান করি, একজন আরেকজনের খেয়াল রাখি,পছন্দ অপছন্দ সব খেয়াল রাখি। এটাই ভালোবাসা।

নিরা উঠে হাটতে থাকে। সে বুঝতে পারছে এক একজনের কাছে ভালোবাসা একেকরকম। নিরা উঠে তার বড় চাচির কাছে গেলো। মিসেস তানজুম রুমে বসে আছেন। নিরা আজকে পুরো বাড়ির মানুষের কাছ থেকে জিজ্ঞেস করবে তাদের কাছে ভালোবাসা মানে কি? তারপর নিজ থেকে একটা ডেফিনেশন বের করবে। নিরা মিসেস তানজুম এর পাশে বসতে বসতে বললো,
— তোমাকে কিছু কথা জিজ্ঞেস করবো। প্লিজ রাগ করবা না।

— আরে রাগ করবো কেন? বল কি কথা?

— তোমার কাছে ভালোবাসা মানে কি?

— ওউ এই ব্যাপার। আমার কাছে ভালোবাসা মানে তোর চাচার কেয়ার করা, আর তার দেখভাল করা। তোদের দেখভাল করা এইসব।

নিরার চাচা মোহাম্মদ আনোয়ার সাহেব রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,
— তোর চাচি একদম আনরোমান্টিক। সবকিছুতেই পানসা জবাব দেয়।

মিসেস তানজুম ঝাজালো কণ্ঠে বললেন,
— তুমি তো অনেক রোমান্টিক। তাহলে তুমিই উত্তর দাও।

নিরা ওদের কান্ড দেখে হাসছে। মিসেস তানজুম রুম থেকে চলে গেলেন।নিরার চাচা নিরার পাশে বসে নিরাকে বললো,
— শুন আমাদের বিয়ে হিয়েছিলো কিভাবে জানিস?

— কিভাবে? আর তোমরা কি ঝগড়া করো।

— আরে শুন। বিয়ের আগে আমরা কেউই দেখিনি একজন আরেকজনকে। বাবা মা বললো মেয়ে পছন্দ হয়েছে বিয়ে করতে হবে। তাই বিয়ে করে নিলাম। বিয়ের পর দেখলাম এক রূপবতী আমার ঘরে। তোর চাচি একদম ঠান্ডা মেজাজের মানুষ। সব রকম পরিস্থিতিতে ঠান্ডা থাকতে পারে। তাই তানজুমকে আমার অল্পদিনেই ভালো লেগে যায়। জানিস রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে যেতো আমরা দুইজন চুপিচুপি বের হতাম হাটতে যাওয়ার জন্য। মাঝেমধ্যে তো তোর চাচির জন্য চুরি করে আম ছিড়ে আনতাম মানুষের বাড়ি থেকে। তারপর দুইজনে একসাথে বসে হাতে লবণ নিয়ে পুকুরে পা ডুবিয়ে আম খেতাম। আমাদের সম্পর্কটা ছিলো বন্ধুর মতো। প্রথম প্রথম যখন এসেছিলো তোর চাচি আমাকে খুব ভয় পেতো। তানজুমকে স্বাভাবিক করার জন্যই এতো কিছু করেছি। আমার কাছে এগুলোই ভালোবাসা।

— তোমরা যে হাটতে যেতে সেটা তোমার বেশি ভালোলাগতো নাকি চাচির?

— তোর চাচির। আমার তো বিরক্ত লাগতো খুব।

— তাহলে কেনো যেতে?

— তানজুমের ঠোঁটের হাসিটা দেখার জন্য।

নিরা বের হয়ে আসে। এখান থেকে বুঝলো ভালোবাসার জন্য গায়ের রঙ কোনো ব্যাপার না। চাচি যদি কালো হতো তাহলেও চাচা এভাবেই ভালোবাসত। শুধু মুখের হাসিটা দেখার জন্য রাতের অন্ধকারে দুজন হাটতে বের হতো। নিরা এটা ভেবেই এক তৃপ্তির হাসি দেয়। ছোট চাচা বাকি আছে। তাই তার ছোট চাচার কাছে যায়। গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
— চাচা তোমার কাছে ভালোবাসা মানে কি বলো?

নিরার চাচা একবার নিরার দিকে তাকিয়ে আবার সোজা হয়ে বসে বলে,
— তোর চাচিকে ভালোবাসা।

— না মানে সেটা নয়। চাচির কাছে শুনেছি চাচির অতীত। তুমি সব জানতে? সব মেনে নিয়োছো?

— হ্যাঁ। দেখ নিরা আমি সেই মানুষটাকে ভালোবাসি তার অতীত দিয়ে কি করবো? তার মনটা যদি পরিষ্কার হয় তাহলে অতীতে কিছু যায় আসে না। আমি ওর মনটাকে ভালোবাসি তাই ঘর বাধার স্বপ্ন দেখেছি। ওর অতীতে আমার কিছু যায় আসে না। হ্যাঁ খুব বাজে অতীত ছিলো। আমি এটা দেখি আমি ওকে কতটুকু খুশি রাখতে পেরেছি। ওকে কতটুকু ভুলিয়ে দিতে পেরেছি আগের সব। এটাই।

নিরা চলে আসে। ফায়াজের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
— তোর কাছে ভালোবাসা মানে কি?

— আপু তোমার জন্য তোমার পছন্দের নাস্তা বানানো।

দুইজনে হেসে দেয়। ফাহিম আর ফাতেমাকে জিজ্ঞেস করলে ফাহিম বলে,
— আমার কাছে ভালোবাসা মানে ফাতেমার চুল টানা।

ফাতেমা তখন এক কিল দেয় ফাহিমের পিঠে। ফাতেমা বলে,
— আমার ভালোবাসা হচ্ছে ফাহিমকে কিল দেয়া। আর যদি কাউকে ভালোলাগে তোমাকে জানাবো।

তিনজনই হাসতে থাকে। নিরা নাঈমকে জিজ্ঞেস করে ভালোবাসার মানে। নাঈম বললো,
— আব্বু আম্মুকে একসাথে হাসতে দেখা। জানো আপু এটা পৃথিবীর সব বেস্ট ফিলিংস এর উপরে। আর সবার সাথে দুষ্টামি করা এবং তোমাকে বড় ভাইয়ের মতো শাসন করা। ইশ্ আপু আমি যদি তোমার বড় ভাই হতাম কি যে ভালো হতো।

নিরা হেসে চলে আসে। সবাইকে জিজ্ঞেস করেছে। দাদি বাকি আছে। তবে নিরার দাদি তার ফুফির বাসায়। এখন কাশফি আপু বাকি আছে। নিরা কাশফির রুমে যায়। কাশফি আয়নার সামনে আনমনে দাঁড়িয়ে কি যেনো ভাবছে। নিরা ভেতরে এসে জিজ্ঞেস করলো,
— আপু কি ভাবছো?

নিরার ডাকে কাশফির হুশ ফিরে আসে। নিরার দিকে তাকিয়ে বলে,
— কিছু বলবি?

— হ্যাঁ।

— বল।

— আচ্ছা আপু তোমার কাছে ভালোবাসা মানে কি?

কাশফি একটু হচকচিয়ে উঠে। চুল বেধে নিরার সামনে এসে বলে,
— সেটা পরে বলছি। একটা গল্প শুন। ওইটা দিয়েই যাচাই করিস৷ আমার ভালোবাসার কোনো গল্প নেই। তাই এটাই শুনাচ্ছি।

— হ্যাঁ বলো।

— একটা ছেলে ছিনতাই করতো, ড়্রাগ নিতো, মারামারি করতো। এটাই ওর পেশা ছিলো। এরপর নিজের গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় চলে আসে জব করবে তাই। সে সারাদিন ড্রাগ নিতো। এতোটা ড্রাগ এডিক্টেড ছিলো যে এক মিনিট ড্রাগ থেকে দূরে থাকলে তার অবস্থা খারাপ হয়ে যেতো।সেখানে বাড়িওয়ালার মেয়েকে দেখে তার ভালো লাগে। এরপর আস্তে আস্তে চিঠি আদান প্রদান করে। মেয়েটাও চিঠি দিত। এরপর সারাদিন ভাবতো কিভাবে চিঠি লিখবে এইসব নিয়ে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে ছেলেটা সারাদিন চিঠি নিয়ে ভাবতো আর একটা দুইটা চিঠি লিখতো। তখনই ওর ড্রাগের নেশাটা কেটে যায়। সারাদিনে একবারও নেশা করতো না। পরে ওরা পালিয়ে বিয়ে করে এবং বাসায় মেনে নেয়। এরপর ছেলেটা সবকিছু ছেড়ে দিয়ে একটা ছোট জব করতো, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো।
( এটাও ২০১৭/১৮ এর দিকে Abc রেডিও-তে Rj কিবরিয়ার অনুষ্ঠান JBSB- যাহা বলিবো সত্য বলিবো- এই অনুষ্ঠানে ছেলেটা এসে বলেছিলো।)

— ওয়াও। এটাও সিনেমার কাহিনির মতো।

— হ্যাঁ। আমাদের জীবনটা সিনেমা থেকেও সিনেমাটিক। যেই ছেলে ড্রাগ নেয়া ছাড়া থাকতে পারতো না সে ছেলে চিঠি আদান প্রদান করতে গিয়েই ড্রাগের দুনিয়া থেকে বেরিয়ে আসে। কেন ইউ ইমেজিন? ভালোবাসায় কতটা শক্তি বুঝতে পারছিস?

— আসলেই অবাক করার বিষয়।

— পবিত্র ভালোবাসা একজন অমানুষকেও মানুষ বানাতে পারে। যদি বিপরীত মানুষটার মন পরিষ্কার হয়। তুই তুহিনকে ঠিক করতে পারতি যদি ওর মন পরিষ্কার হতো। তুহিনের মনে কাদা। ছেড়ে দিয়েছিস ভালোই করেছিস।

— সত্তিই কি তুহিন ঠিক হবে না?

— একজনের মনের পবিত্রতা যথেষ্ট নয় নিরা। অপরজনের মনেও পবিত্রতা থাকতে হবে। আমি যেই কাহিনি বলেছি সেখানে ছেলেটা ছিনতাইকারী ড্রাগ এডিক্টেড হলেও তার মন পরিষ্কার ছিলো যার কারণে সে ভালো হয়ে গেছে।

— হুম।

নিরা রুমে আসে। সবকিছু শুনে বুঝতে পারলো,
— ভালোবাসা যে কারো সাথে হয়ে যেতে পারে। সেই মানুষটা যেমনই হোক না কেনো। একজন মানুষকে না দেখেও ভালোবাসা যায়। তার অস্তিত্ব অনুভব করেও ভালোবাসা যায়। ভালোবাসায় দোষ গুণের বিচার করা হয় না। না অতীত নিয়েও চর্চা করা হয় না। সবকিছু ভুলে সবকিছু মেনে নিয়ে একজন আরেকজনকে ভালোবাসে। একসাথে থাকার স্বপ্ন দেখে, একসাথে বেঁচে থাকার জন্য প্রস্তুতি নেয়। ভালোবাসাটা আসলেই অদ্ভুদ। চেহারা, ফিগার, সৌন্দর্য এসব যাচাই করা হয় না। মনের মিলনটাই আসল ভালোবাসা৷ আমার হাজার অপূর্ণতা আছে কিন্তু প্রিয় মানুষটার কাছেই গেলেই নিজেকে পূর্ণ মনে হয়। সবকিছু পেয়ে গেছি মনে হয় এটাই ভালোবাসা।

নিরা একটা বই খুজছে। যেখানে রগট ধর্ম সম্পর্কে পড়েছিলো সেখানে শেষের দিকে ভালোবাসা নিয়ে কিছু লাইন ছিলো। নিরা সেগুলা পড়ার জন্য সেই বইটা খুজছে। অবশেষে খুজে পেলো। বইয়ের ৭৬ পৃষ্ঠায় পদ্মের সংলাপে সুন্দর করে বলা আছে প্রেম নিয়ে।
” প্রেম হলো একধরনের আবেগ যা লুকানো থাকে। প্রেমিককে দেখে প্রেমিকার সেই আবেগ লুকানো অবস্থা থেকে বের হয়ে আসে। তখন হার্টবিট বেড়ে যায়। ঘাম হয়। পানির পিপাসা হয়। একসঙে প্রবল আনন্দ এবং প্রবল বেদনা হয়। আনন্দ, কারণ প্রেমিক সামনে আছে। বেদনা, কারণ কতক্ষণ সে থাকবে কে জানে”।(- বই- আমরা কেউ বাসায় নাই-হুমায়ুন স্যার।)

নিরা ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেলো। তার এখন রাফিনের কথা মনে হতেই হার্টবিট বেড়ে গেছে। ঘাম হচ্ছে। এই শীতেও সে ঘামছে। নিরা বুঝতে পারছে। খুব করেই বুঝতে পারছে সে রাফিনের প্রেমে পড়েছে। খুব খুশি হয় নিরা। পরক্ষণেই আবার মন খারাপ হয়ে যায় নিরার। এই ভেবে যে রাফিন হয়তো এখন আর তাকে মানবে না।
·
·
·
চলবে……………………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here