হৃদয়ের কোণে পর্ব ৩৯

0
604

#হৃদয়ের_কোণে (পর্ব ৩৯)
#নাহার
·
·
·
এক সপ্তাহ হয়ে গেছে। নিরা এখন স্বাভাবিক ভাবেই চলাফেরা করে। নিরাকে দেখে মনে হয়না সে খুব কষ্টে আছে। ঝুমুর ওকে দুইটা টিউশন দিয়েছে। প্রতিদিন কলেজের ক্লাস শেষে বাসায় আসবে। ফ্রেস হয়ে, নামাজ পড়ে, খেয়ে একবার ঘুমিয়ে তারপর বিকেলের দিকে পড়াতে যায়। একটা স্টুডেন্ট ক্লাস ওয়ানে পড়ে এবং অন্যটা ক্লাস থ্রিতে। নিরার বেশ ভালোই লাগে বাচ্চা দুটাকে পড়াতে। বাচ্চা দুইটা যখন তাদের নিজেদের মতো করে গল্প করে নিরা নিশ্চুপ হয়ে সব শুনবে এবং মুচকি হাসবে। টিউশন থেকে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। আজও টিউশন শেষ করে বাসায় ফিরেছে নিরা। দরজা খোলাই ছিলো। নিরা ঘরে ঢুকে বেশ অবাক হয়। দরজা খোলা রেখে সবাই উপরে গিয়ে বসে আছে। নিরা ডাইনিং টেবিলের দিকে যায়। এক গ্লাস পানি খেয়ে নেয়। এই কদিন খুব গরম পড়ছে। একটা টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে উপরে উঠে।

দ্বিতীয় তলায় আসার পর কিছুটা ধমকের আওয়াজ এলো। নিরা উৎসুক হয়ে যেদিক থেকে আওয়াজ আসছে সেদিকে রওনা হয়। ফাতেমার রুমের সামনে এসে দাঁড়ায়। সবাই এখানে ভিড় করে রেখেছে। কিছু একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছে, ঝগড়া হচ্ছে। নিরা ভেতরে যায়নি। ছোট চাচি ফাতেমাকে ধমক দিয়ে বলছে,
— মাত্র এস এস সি পাস করে কলেজে ভর্তি হয়েছিস এখনই কেনো এসব নিয়ে ভাবছিস?

ফাতেমা বললো,
— আমি কই ভাবলাম? তুমি দেখলে না ওরাই তো প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। এখানে আমার কি দোষ?

ছোট চাচি কিছু বলতে যাবে তখন মিসেস তানজুম বললেন,
— মা শুন তোর বড় নিরা আছে বাসায়। ওর এখনো বিয়ে হয়নি। ওকে রেখে তোকে আগে বিয়ে দিয়ে দিবো কিভাবে বল? মানুষজন শুনলে তো খারাপ বলবে তাইনা?

ছোট চাচি চেঁচিয়ে বললেন,
— বড় ভাবি এখন কিসের বিয়ে দিবো এই পুচকি মেয়েকে? ওকে বলো এসব যেনো আর না শুনি।

মিসেস শায়েলা ফাতেমার পাশে বসলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
— শুন আমি বুঝতে পারছি তুই ওই ছেলেকে পছন্দ করিস। হারাতে চাস না বলেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিস। কিন্তু মা বাসায় তোর বড় নিরা আছে। ওর বিয়ে না দিয়ে আগে তোকে বিয়ে দিলে বিষয়টা খারাপ দেখায় না বল? ওই ছেলেকে বল দুই তিন বছর অপেক্ষা করতে। নিরার বিয়ে হয়ে গেলে তারপর আমরা তোর বিয়ে দেবো।

— তোমার মেয়ের বিয়ে হবে বলে তো মনে হয়না মেঝো চাচি। দুই দুইবার বিয়ে ভেঙে গেছে। এসব শুনলে কেউ রাজিই হবে না।

ফাতেমার কথায় মিসেস শায়েলা চমকে যান। ফাতেমার মা তেড়ে আসেন ফাতেমাকে মারতে। নিরা এসে তার ছোট চাচিকে ধরে ফেলে। সবাই নিরাকে দেখে ঢোক গিলছে। আফিয়া অপ্রস্তুত হয়ে বললো,
— নিরা তুমি কখন এলে?

নিরা হেসে বললো,
— এসেছি অনেকক্ষণ হয়েছে।

সবাই একজন আরেকজনের দিকে তাকাচ্ছে। বুঝতে পারছে না নিরার মতিগতি। এখন নিরাকে একদমই বোঝা যায় না। কোন বিষয়ে কষ্ট পেলো আর কোন বিষয়ে পেলো না। কোনো কিছুতেই রিয়েক্ট করে না। নিরা ফাতেমার পাশে বসে বললো,
— বিয়ে করতে চাস তো করে নে। আমার জন্য তো ভালোই হয়। তোর বিয়েতে অনেক মজা মাস্তি করতে পারবো।

ছোট চাচির দিকে তাকিয়ে বললো,
— চাচি তুমি রাজি হচ্ছো না কেনো? প্রস্তাব এসেছে রাজি হয়ে যাও। তোমার মেয়ের বিয়েতে তুমি মজা করতে চাও না? বলো?

— বড়মা, মা তোমরা আয়োজন করো। কেনো অপেক্ষা করছো? আর কার জন্য ফাতেমার বিয়ে আটকে রেখেছো বলো। ছেলে রাজি, মেয়ে রাজি তোমরা কেনো বাঁধা দিচ্ছো। রাজি হয়ে যাও।

নিরা উঠে বেরিয়ে যাবে তখন নিরার মা বললো,
— মা তোর আগে ফাতেমাকে বিয়ে দিলে কেমন দেখায় না বল?

— কেমন দেখাবে? ভালোই হবে। অন্তত আমার মতো হবে না মা।

নিরা আর দাঁড়ালো না। রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিলো। কাবার্ড থেকে রাফিনের সেই সাদা শার্টটা বের করে জড়িয়ে ধরে নাক ডুবিয়ে দেয়। চোখ বন্ধ করে কাপাকাপা গলায় বললো,
— কেনো এভাবে ছেড়ে চলে গেলেন? আপনি বোঝেন না কেনো আমার আপনাকে ছাড়া চলতে ভিষণ কষ্ট হয়। এভাবে ভালো থাকার অভিনয় করতে খুব কষ্ট হয় ডাক্তার।

শার্টের মাঝে মুখ গুজে দেয়। চোখ থেকে কয়েক ফোটা পানি বেরিয়ে আসে।

——————————
ফাতেমার এঙ্গেজমেন্ট এর জন্য আয়োজন চলছে খুব। নিরা এখন এতোটা রুম থেকে বের হয়না। প্রয়োজন ছাড়া কারো সাথে তেমন কথাই বলে না। আর একদিন বাকি এঙ্গেজমেন্ট এর। বাড়িতে তেমন মানুষ নেই। শুধু ফাতেমার খালা, মামারা এসেছে। আর নিরার দাদি আছে। রাতে খেয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। আজও মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে। নিরা চুপিচুপি ছাদে এসে দাঁড়ায়। মুহুর্তেই কাক ভেজা হয়ে গেছে। মাথা উঠিয়ে চোখ বন্ধ করে দুই হাত মেলে দাঁড়িয়ে আছে। এভাবে কিছুক্ষণ থাকার পর কেউ নিরাকে পেছন থেকে “আপু” বলে ডাকলো। নিরা হাত নামিয়ে ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখলো তার ভাই নাঈম দাঁড়িয়ে আছে। সেও কাক ভেজা হয়ে ভিঝেছে। নিরা হালকা হেসে বললো,
— এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? রুমে যা ঠান্ডা লাগবে তোর।

নাঈম কোনো কথা না বলেই নিরাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। নিরা পিঠে চাপড় মেরে বললো,
— কাঁদছিস কেনো পাগল?

নাঈম কান্না ভেজা কণ্ঠে বললো,
— আপু প্লিজ তুই আমার আগের আপু হয়ে যা। যে অনেক দুষ্টামি করতো। দুষ্টামি করে সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখতো। কখনো কারণ ছাড়াই সবার মাঝে ঝগড়া বাঁধিয়ে দিতো। আপু তোকে এভাবে দেখতে আমার মোটেও ভালো লাগে না।

নাঈম নিরাকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। কান্না করায় নাঈমের চোখ লাল হয়ে গেছে। নিরা নাঈমের গালে হাত বুলিয়ে বললো,
— আমার ভাইটা বড় হয়ে গেছে অনেক। দেখ গালে খোচা দাড়ি। এই তুই দেখছি আমার থেকে লম্বা হয়ে গেছিস। কিরে নাঈমমা তুই আমার ছোট হয়ে আমার থেকে লম্বা হয়ে গেলি কেমনে? হ্যাঁ?

— আমার বড় ভাই হওয়ার ইচ্ছা ছিলো।

নিরার কপালে আঙুল দিয়ে ঢু মেরে বললো,
— তোর বড়ভাই হওয়ার ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু আল্লাহ আমাকে তোর ছোট ভাই বানিয়ে পাঠালো। তবে এখন আর আমার কোনো আপসোস নেই। দেখ আমাকে লম্বা বানিয়ে দিয়েছে। এখন যে কেউ দেখলে বলবে আমি তোর বড় ভাই। হাহা। এরপর উলটা পালটা চললে কানে নিচে দিবো।

কথাটা বলে নাঈম জিভ কামড়ালো। নিরা কোমড়ে দুই হাত চেপে ভ্রু কুচকে নাঈমের দিকে তাকিয়ে আছে। নাঈম এক কান ধরে আমতা আমতা করে বললো,
— উপস! স্লিপ অফ টাং।

নিরা ছুটলো নাঈমকে মারার জন্য। পুরো ছাদে দুই ভাই বোন দৌড়াদৌড়ি করছে। তাদের দুজনের ভালাবাসা দেখে মেঘ বৃষ্টিকে বললো চলো আমরাও এভাবে দুজন দুজকে ভালোবাসি। বৃষ্টি যেনো আরো জোরে নামলো। দৌড়াদৌড়ি করতে করতে নাঈম আর নিরা ছাদের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেলো। ফায়াজ এবং ফাহিম দুই ভাই কোমড়ে হাত চেপে ভ্রু কুচকে চেহারা রাগি রাগি করে বললো,
— বাহ আমরা পর হয়ে গেলাম।

দুইজন ছাদে ঢুকে নিরার সামনে দাঁড়িয়ে অভিমানি সুরে বললো,
— আমরা এখন কারো ভাই হইনা মনে হয়। তাই আমাদেরকে রেখে খেলা হচ্ছে।

নিরা হাসলো। দুজনের গালে হাত রেখে বললো,
— কে বলেছে তোরা পর হয়ে গেছিস। তোরাও তো আমার ভাই। ওমা আমার এই ভাই দুইটাও দেখছি বড় হয়ে গেছে। দেখ গালে দাড়ি উঠেছে। তোরা দেখছি নাঈমমার মতো লম্বা হয়ে গেছিস।

ফায়াজ এবং ফাহিম ভ্রু নাঁচিয়ে বললো,
— বড় ভাই হয়ে গেছি এখন।

চারজনই শব্দ করে হেসে দেয়। ফাহিম গাল ফুলিয়ে বললো,
— আপু এবার আমাদের সাথে দৌড়াদৌড়ি খেলতে হবে। নাইলে কিন্তু রাগ করবো।

তারপর চারজন মিলে এই বৃষ্টির মধ্যে দৌড়ে খেলা খেলছে। আবারো চারজন ছাদের গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে যায়। গেটের সামনে ফাতেমা দাঁড়িয়ে আছে। নিরাকে দেখে ফাতেমা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। নিরা অবাক হয়। সাথে বাকি তিন ভাই। ফাতেমা বললো,
— আপু আমাকে মাফ করে দাও প্লিজ। আমি তোমাকে খুব কষ্ট দিয়েছি। আমি সবাইকে কষ্ট দিয়েছি। এখন তুমি মাফ করে দিলে সবাই আমাকে মাফ করে দিবে।

— আরে পাগলি মাফ চাইছিস কেনো?

— তোমার আগে আমি বিয়ে করবো না। আমি এতো তাড়াতাড়ি এই বাড়ি ছেড়ে যাবো না।

নিরাকে আবারো জড়িয়ে ধরে বললো,
— আমি আমার আপুকে ছেড়ে যাবো না। বিয়েটা ভেঙে দিয়েছি আমি।

নিরা অবাক হয়। ফাতেমাকে সোজা করে দাড় করিয়ে বললো,
— এসব কি বলছিস?

— হ্যাঁ ঠিক বলছি। মাথা খারাপ হয়ে গেছিলো আমার। এখন ঠিক হয়ে গেছে। আমি তোমাদের কাউকে ছড়ে এতো তাড়াতাড়ি যাচ্ছি না।

নিরার দুই হাত শক্ত করে ধরে ভাঙা গলায় বললো,
— আপু প্লিজ মাফ করে দাও না। এতদিন কেমন যেনো অস্থির লেগেছে। প্লিজ মাফ করে দাও।

নিরা হেসে বললো,
— তুই তো আমার ছোট বোন। ভুল করেছিস এখন বুঝতে পেরেছিস। তাতেই আমি খুশি।

নাঈম এসে বললো,
— ওই আমার পা ধরে মাফ চা। আমিও কষ্ট পেয়েছি।

ফাহিম চুল টেনে বললো,
— শাকচুন্নি বহুত কষ্ট দিছোস এবার মাফ চা।

পা এগিয়ে দিয়ে বললো,
— ঠ্যাং ধইরা মাফ চাবি।

ফাতেমা দুইটাকে পেটে ঘুষি মেরে দৌড় দিলো। তাদের দৌড় খেলা আবার শুরু হয়। এরমধ্যে কৌশিক এসে বললো,
— তোগো দাপাদাপির জন্য আমরা ঘুমাইতে পারতেছি না। এতো রাইতে এসব কি শুরু করছিস?

নিরা কৌশিকের হাত ধরে একটানে ছাদের ভেতরে নিয়ে আসে। কৌশিক লাফিয়ে উঠে বলে,
— ওম্মা আমি ভিজে গেলাম।

সবাই একসাথে হেসে দেয়। এর মাঝে আফিয়া এসেও যোগ হয়েছে। সবাই মিলে দৌড় খেলা খেলছে। একবার এ ছাদ থেকে তুহিনদের ছাদে যাচ্ছে। যেহেতু দুই ছাদ লাগানো। দুই ছাদের জায়গা পুরোটা মিলে একটা বড় মাঠের মতো হয়ে গেছে। কাশফি ছাদে এসে বললো,
— আমারে বাদ দিয়ে দিলি তোরা?

কৌশিক বললো,
— জামাইয়ের সেবা কর যা। আমাদের খেলায় বিরক্ত করবি না।

কাশফি তেড়ে এসে কৌশিকের পিঠে ধুম করে কিল বসিয়ে দেয়। আফিয়ে বললো,
— ঠিক হয়েছে।

কৌশিক দৌড়ে আফিয়াকে ধরতে গেলে আফিয়ে দৌড় দেয়। তূর্য এসে কাশফিকে বললো,
— তুমি আমাকে রেখে একা খেলছো? দাঁড়াও জানু দেখো তোমার কি করি।

এরমাঝে তুহিন চলে আসে। পুরো একটা দল হয়ে গেছে ছাদে। ফায়াজ বললো চলো এবার বরফ পানি খেলি। সবাই যেভাবে ইচ্ছা দৌড়াচ্ছে। অনেকদিন পর সবাই আবার বরফ পানি খেলছে। সবাই কাক ভেজা হয়ে গেছে। ভোর হতে অল্প সময় বাকি। এখনো তাদের খেলা বন্ধ হওয়ার নাম নেই। আজান পড়ার সাথে সাথে দুই বাড়ির বউ ছেলে মেয়ে দৌড়ে ছাদ থেকে নেমে যায়। যে যার যার রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দেয়।

দুই বাড়িতে ছেলে, মেয়ে, বউ সবাই ঘুম থেকে উঠে দুপুর বারোটায়। বাড়ির বড়রা সবাই অবাক হচ্ছে। সবাই কিভাবে একসাথে প্ল্যান করে ঘুম থেকে উঠলো। নিরা হাই তুলতে তুলতে সোফায় বসা মাত্রই নাঈম, ফায়াজ এবং ফাহিম ঘিরে ধরে বললো,
— আপু তোমার কি খেতে মন চাইছে বলো। আমরা এখনি বানিয়ে এনে দিবো।

ফাতেমাও এসে যোগ হয়েছে। নিরা এবং ফাতেমা একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,
— আমাদের জন্য ফুসকা আর চটপটি বানা।

যেই বলা সেই কাজ। তিন ভাই দৌড়ে রান্না ঘরে চলে গেলো। মা এবং চাচিকে রান্না ঘর থেকে বের করে দিয়ে তারা দখল করে নেয়। আফিয়া গাল ফুলিয়ে বসে আছে। কৌশিক পড়লো আরেক ঝামেলায়। মেয়েটার রাগ কিছুতেই কমছে না। আফিয়া কৌশিককে বললো,
— যাও আমার জন্যও ফুসকা চটপটি বানাও।

— তখন রাগ কমবে তো?

— হ্যাঁ।

তিন ভাইয়ের সাথে এবার কৌশিকও যোগ হলো। আফিয়া, নিরা, ফাতেমা পায়ের উপর পা তুলে গল্প জুড়ে দিয়েছে। বাড়ির বড়রা এটা দেখে অনেক খুশি। নিরাকে অনেকদিন পর এভাবে হাসতে দেখছে। ওইদিকে কাশফি রাগ করে, ধমকিয়ে একপ্রকার ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে তূর্যকে দিয়ে রান্না করাচ্ছে। কাশফি এবং তুহিন সফায় বসে খোশ গল্পে মেতেছে। আর এদিকে তূর্যের কাহিল অবস্থা।

——————————
এভাবে আরো একমাস কেটে গেলো। নিরা কলেজ থেকে এসে তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে। আজকের রোদ খুব কড়া ছিলো। গলা একেবারে শুকিয়ে গেছে। নিরা ডাইনিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে পানি খেতে খেতে ড্রয়িং রুমের সিঙেল সোফার দিকে নজর যায়। একজন মানুষ সাদা শার্ট গায়ে নিরার দিকে পিঠ দিয়ে বসে আছে। বাকি সবাই হেসে হেসে কথা বলছে। নিরার ভেতরে ধক করে উঠে। কাপাকাপা হাতে পানির গ্লাস টেবিলের উপর রাখে। বুকের ভেতরে ঢিপঢিপ করছে। কপাল বেয়ে ঘাম পড়ছে। নিরা কাধের ব্যাগ চেয়ারে রেখে সেদিকে এগিয়ে যায়। হাত পা কেমন অসার হয়ে আসছে। পা চলতেই চাইছে না। সাদা শার্ট গায়ে দেয়া সেই মানুষের চুল দেখে খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। খুব খুব পরিচিত। নিরাকে দেখে আফিয়া এসে টেনে সেই মানুষটার সামনে নিয়ে যায়।

নিরা মানুষটাকে দেখে নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম। দাঁড়িয়ে থাকতে ভিষণ কষ্ট হচ্ছে তার। এতোদিন পর এতোগুলো সময় পর সেই মুখটা দেখছে। নিরার দুই হাটু কাঁপছে। নাঈম টেনে নিরাকে সোফায় বসিয়ে দেয়। সবার এমন একটা ভাব যেনো কিছুই হয়নি। সেই মানুষটা আর কেউ নয় রাফিন। মিসেস শায়েলা তাড়াতাড়ি এলেন মিষ্টির প্লেট হাতে নিয়ে। নিরার চোখ সেই মানুষটার উপর থেকে সরছেই না। মিসেস তানজুম রাফিনের পাশের চেয়ারে বসা ছিলেন। নিরাকে বললেন,
— নিরা মিষ্টি মুখ কর। রাফিনের বিয়ে করছে। এখানে এসেছে শুধু আমাদের সবার থেকে সাক্ষি হিসেবে সাইন নিতে। আমরা সাইন করে দিয়েছি এবার তুই করবি।

একথা শুনার পর নিরার কলিজায় কেউ যেনো পেরেক ঢুকিয়ে দিলো খুব যত্ন করে। নিরা এখনো রাফিনের দিকে তাকিয়ে আছে। আগের থেকে আরো বেশি সুদর্শন লাগছে রাফিনকে। সাদা শার্টে বেশ দারুণ মানিয়েছে। আগের থেকে ফর্সা হয়েছে। কনুইয়ের উপর শার্টের হাতা ফোল্ড করা এতে আরো বেশি আকর্ষণীয় লাগছে। মিসেশ শায়েলা জোর করে মেয়ের গালে মিষ্টি ঢুকিয়ে দেন। কৌশিক হাতে একটা পেপার দিয়ে কলম ধরিয়ে দিয়ে বললো,
— তাড়াতাড়ি সাইন করে দে বনু। রাফিন আজকেই আবার চলে যাবে।

নিরা একবার কৌশিকের দিকে তাকালো। নিরার মস্তিষ্ক শূন্য লাগছে। এটা ভেবে পাচ্ছে না, “যার সাথে তার বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো সে অন্য কাউকে বিয়ে করায় বাড়ির সবাই এতো খুশি কিভাবে?” কৌশিক বললো,
— ওহ তোকে তো বলাই হয়নি। রাফিনের বিয়ে মালিহার সাথে হবে আজকে। তাই সাক্ষি হিসেবে আমাদের সাইন নিয়েছে। তাড়াতাড়ি সাইন কর।

নিরা আবার রাফিনের দিকে তাকায়। রাফিন একবারো নিরার দিকে তাকায়নি। কেমন যেনো নিশ্চিন্তে বসে আছে। মনে হচ্ছে মালিহাকে বিয়ে করতে পারায় খুব খুশি। নিরার রাগ হলো। একবার কাগজটার দিকে তাকিয়ে আবার রাফিনের দিকে তাকালো। রাগে কলম শক্ত করে ধরে গটগট করে সাইন করে দিলো। কাগজ কলম রাফিনের সামনে বরাবর ছুড়ে মেরে দাঁড়িয়ে বললো,
— দয়া করে সাইন করে দিয়েছি।

কথাটা বলেই হনহন করে রুমে চলে গেলো। দরজা লাগিয়ে ওয়াশরুমের আয়নার সামনে দাঁড়ালো। প্রিয় মানুষটাকে হারানোর শোকে চেহারার কি হাল করেছে। রোদে হেটে আসায় গাল দুটো লাল হয়ে গেছে। কপালে আর থুতনিতে ব্রন উঠেছে। নিরার খুব রাগ লাগছে। নিজের উপর আজ সব রাগ উপচে পড়ছে। কি দরকার ছিলো তার জন্য এতো পাগল হওয়ার। রাগে বোরকা পড়েই শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে যায়।

——————————
বিকেলে নিরা রেডি হয়ে নেয় টিউশনে যাবার উদ্দেশ্যে। বের হওয়ার সময় নিরার ছোট চাচি বললো,
— নিরা এখন কোথায় যাচ্ছিস? একটু পর মালিহা আসবে বউ সাজে। আমাদের সবার থেকে দোয়া নিতে। তুই দেখবি না রাফিনের বউকে?

নিরার রাগ আরেক দফা বাড়লো। দুপুরে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে রাগটাকে কন্ট্রোল করেছে। এখন আবার দপদপ করে রাগ যেনো চড়া দিয়ে উঠছে। নিরা রাগ দেখালো না। শান্ত স্বরে বললো,
— আমার মতো চরিত্রহীন মেয়ের কাছ থেকে দোয়া নেয়াটা মানায় না। তোমরা দোয়া করে দিও।

নিরা দাঁড়ালো না। বেরিয়ে যায়। রাগ তো নিজের উপর উঠছে সাথে বাড়ির সবার উপর।

টিউশন শেষ করে বাড়ি ফিরে আসে। ফ্রেস হয়ে নাস্তা খেয়ে ছাদে গিয়ে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর মনে হলো কেউ তার পেছনে দাঁড়ানো। নিরা আতকে উঠে পেছন ফিরে। সাথে সাথে বুকের ভেতরে আবার আগেই সেই হাতুড়ি পেটা শুরু হয়। রাফিন নিরার থেকে কিছুটা দূরত্ব নিয়ে পাশাপাশি দাঁড়ায়। নিরা রাফিনের দিকে না তাকিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। দাতে দাত চেপে রেখেছে। কান্না নিয়ন্ত্রণ করছে নাকি রাগ নিয়ন্ত্রণ করছে নিজেই বুঝতে পারছে না। রাফিন হালকা কেশে বললো,
— সরি নিরা। আসলে সেদিন তোমায় গায়ে হাত তোলাটা ঠিক হয়নি। মালিহা আমাকে আগে থেকেই ভালোবাসত আমি জানতাম না। আর মায়েরও পছন্দ ছিলো তাই না করিনি। সরি।

— ঠিকাছে। আমি কিছু মনে করিনি।

— আচ্ছা তাহলে আসি। একটু পরেই আমার অস্ট্রেলিয়া ফিরার ফ্লাইট।

নিরা অন্যদিকে ফিরেই কথাগুলো বলে। রাফিন চলে গেলে নিরা ঢুকরে কেঁদে উঠে। আবার স্বাভাবিক করে নেয় নিজেকে। রাফিন তার কমিটমেন্ট রেখেছে। হ্যাঁ রেখেছে তো। সে বলেছে ফিরে আসবে। ফিরে এসেছে তবে সাথে বউ নিয়ে। কৌশিক এসে বললো,
— মালিহা এসেছে। একটু পর চলে যাবে। দেখতে যাবি না?

— না। এখান থেকে যা।

প্রচুর রাগ ছিলো সেই কথায়। কৌশিকও দাঁড়ালো না। চলে গেলে। নিরার খুব অভিমান জমেছে সবার উপর। আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিরা। মনের মধ্যে শত ঝড় তুফান চলছে কিন্তু বাহিরে তা প্রকাশ করছে না। শান্ত হয়েই দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে। নিরা কিছুটা ঘাবড়ে পেছনে ঘুরে আরো ঘাবড়ে যায়। একটা কালো ড্রেস পরা মানুষ। মেখেও মাস্ক। নিরার মুখে কিছু একটা স্প্রে করলেই নিরা জ্ঞান হারায়। সেই লোকটি মাস্ক খুলে শয়তানি হাসি দেয়। লোকটি যেনো এই অপেক্ষাতেই ছিলো।
·
·
·
চলবে………………………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here