হৃদয়ের কোণে পর্ব ৪১

0
620

#হৃদয়ের_কোণে (পর্ব ৪১)
#নাহার
·
·
·
হারিকেন হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকলো রাফিন। গরমে ঘেমে নেয়ে একাকার। গায়ের শার্টটা চুপসে গেছে। শার্টটা খুলে বাহিরে দড়িতে ঝুলিয়ে এসে বিছানায় বসতেই ফুপিয়ে কান্নার আওয়াজ পেলো। আজ এদিকটায় লোডশেডিং হয়েছে। সেই বিকেল থেকেই কারেন্ট নেই। সন্ধ্যার পরেও যখন কারেন্ট আসছিলো না তাই বাধ্য হয়েই নিরাকে ঘরে রেখে দোকানে গিয়ে কেরোসিন আনতে হয়েছে। দোকান থেকেই হারিকেন জ্বালিয়ে নিয়েছে। কান্নার আওয়াজে রাফিনের বুকের ভেতরে মোচড় দিলো। তাড়াতাড়ি করে নিরার দিকে ফিরে বসলো এবং সাথে সাথেই কারেন্ট এলো।

নিরা খাটের এক কোণে ঘাপটি মেরে বসে আছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে বেশ ভয় পেয়েছে। ভয়ে হাটুর দিকের কাপড় দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে রেখেছে। নিরার পাশ ঘেষে বসতে যাবে তখনই খাবার নিয়ে দুপুরের সেই মহিলাটা এলো। রাফিন খাবার নিয়ে টেবিলের উপর রেখে দরজা লাগিয়ে দিলো। খাটের উপর এসে নিরার পাশ ঘেষে বসে। নিরা এবার আরো জোরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। রাফিন নিরার সামনে বসে দুইহাত ধরতেই নিরা ঝাপটা মেরে হাত সরিয়ে দেয়। কেঁদে কেঁদে বললো,
— আমি এখানে থাকবো না। বাসায় দিয়ে আসুন আমাকে।

— কি হয়েছে বলো? ভয় পেয়েছিলে?

নিরা রাগে ফোসফাস করে বললো,
— না অনেক ভালো লাগছিলো এই অন্ধকার ভূতুড়ে ঘরটাতে।

আবার কেঁদে দেয়। রাফিন বললো,
— কারেন্ট ছিলো না এদিকে। সন্ধ্যার পরেও কারেন্ট না আসায় কেরোসিন আনতে গেছিলাম। সরি বাবু আর হবে না।

নিরা ফুপিয়ে কেঁদে অস্পষ্ট সূরে বললো,
— আমি আম্মুকে বলে দিবো আপনি আমাকে একা রেখে চলে গেছিলেন। আমাকে বাসায় দিয়ে আসুন। থাকবো না আমি এখানে।

— আচ্ছা আগে খেয়ে নাও।

নিরা চেচিয়ে বললো,
— খাবো না আমি। আপনার খাওয়ার ইচ্ছে হলে আপনি খান।

রাফিন হতাশ হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নিরা ভয় না পাওয়ার জন্যই কেরোসিন আনতে গেছিলো। এর মধ্যেই ঘুম থেকে উঠে ভয় পাবে কে জানতো? রাফিন উঠে হাত ধুয়ে খাবারের প্লেট নিয়ে নিরার সামনে বসে। নিরা তখনো খুব কাঁদছিলো। রাফিন ভাত মাখিয়ে নিরার সামনে ধরে। নিরা ধাক্কা দিয়েই দুই তিনবার হাত সরিয়ে দেয় আর ভাত নিচে পরে যায়। এবার ভাতের লোকমা নিরার গালে জোর করিয়ে ঢুকিয়ে দিয়ে হাত দিয়ে চেপে ধরে মুখ। বললো,
— মুখের ভাত ফেলতে নেই। খেয়ে নাও।

নিরা খেয়ে নিলো। রাফিন নিজেও খাচ্ছে নিরাকেও জোর করে খাইয়ে দিচ্ছে। খাওয়া শেষে পানির গ্লাসে করে রাফিন নিজের হাতে নিরাকে পানি খাইয়ে দিলো। খাওয়া শেষে রাফিন খাট থেকে নেমে মাটিতে পরে থাকা ভাতগুলো প্লেটে নিয়ে হাত ধুয়ে নেয়। নিরা তখনো ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকে। বাহিরে গিয়ে পুকুর থেকে হাত মুখ ধুয়ে আসে রাফিন। ঘরে এসে নিরাকে বললো,
— আকাশে গোল থালার মতো চাঁদ উঠেছে। বাহিরে যাবে চাঁদ দেখতে?

— আপনার চাঁদ আপনি দেখেন। আমার ইচ্ছে নেই। আমি বাসায় যাবো।

— ঠিকাছে তাহলে শুয়ে পরো।

— না। আমি শুয়েও পরবো না। আপনি আমাকে যেভাবে এনেছেন সেভাবে বাসায় দিয়ে আসুন।

রাগে চেচিয়ে কথাটা বললো। রাফিন দরজা লাগিয়ে দেয়। লাইট অফ করে দেয়। হারিকেনের আলো কমিয়ে টেবিলের নিচে রেখে খাটের উপরে এসে শুয়ে পরে। নিরাকে বললো,
— আসো ঘুমাও।

নিরা কিছু বললো না। এখনো কেঁদেই যাচ্ছে। নিরার হাত ধরে হেচকা টানে নিজের বুকের উপর নিয়ে আসে নিরাকে। নিরা দাপাদাপি করে সরে যায়। কান্নার আওয়াজ বারিয়ে দেয়। বেরিয়ে যাওয়ার জন্য বারবার উঠে যাচ্ছে। একরকম পাগলি শুরু করেছে নিরা। রাফিন নিরাকে জোর করে শুইয়ে দিয়ে নিরার বুকের উপর মাথা রেখে শুয়ে পরে। শরীরের সম্পূর্ণ ভার নিরার উপর ছেড়ে দেয় যাতে নড়তে না পারে। বাম হাত চেপে ধরে রেখেছে। নিরা রাগে ডান হাত দিয়ে রাফিনের পিঠে কিল ঘুসি মারছে। জোরে জোরে চুল টানছে। পিঠে ঘাড়ে চিমটি দিচ্ছে। কিন্তু রাফিন একটুও নড়লো না। এভাবে অনেকক্ষণ যাওয়ার পর নিরা হাপিয়ে যায়। রাফিন কিছুক্ষণ আগেই নিরার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছে। নিরারও এবার চোখে ঘুম নেমে আসে। সেও ঘুমিয়ে যায়।

——————————
সকালে রাফিনের ঘুম ভাঙার পর নিজেকে ওভাবে দেখে হালকা হাসলো। নিরা ঘুমের মধ্যে রাফিনের গলা জড়িয়ে ধরেছে। রাফিন নড়লো না। আবারো চুপ করে শুয়ে পরলো নিরার বুকে। এতোদিনে দূরত্বে আজ এভাবে নিরার এতো কাছাকাছি থাকতে পেরে ভালোই লাগছে। মনে প্রশান্তি। নিরা একটু নড়েচড়ে উঠলো। বুকে ভারি কিছু অনুভব করায় আবারো নড়ে উঠে। রাফিনের চুল শক্ত করে ধরে বিড়বিড় করে বললো,
— সরুন আমার উপর থেকে। নিঃশ্বায়া বন্ধ হয়ে আসছে।

রাফিন সরে যায়। উঠে বসে। নিরার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। খুব মায়াবী চেহারা। নিরার মুখের উপর একটু ঝুকে মুখের উপর থেকে চুল সরিয়ে কপালে চুমু দেয়। সোজা হয়ে বসে আবার। নিরার আঁচল ঠিক করে দিয়ে ব্রাশ নিয়ে পুকুর ঘাটের দিকে যায়।

বেলা সাড়ে দশটার দিকে নিরা আবার কাল রাতের মতো পাগলামি শুরু করে। সে বাসায় চলে যাবে। রাফিনের সাথে থাকবে না। নিরা হনহন করে ঘর থেকে বের হয়ে উঠানে চলে আসে। রাফিনও বেরিয়ে যায় নিরার পেছন পেছন। পেছন থেকে নিরার শাড়ির আঁচল ধরে শক্ত করে। এমন সময় একটা আটাশ উনত্রিশ বছরের জোয়ান কালো যুবক এসে উঠানে দাঁড়ায়। রাফিন তাকে দেখা মাত্রই নিরাকে আড়াল করে ফেলে। আজকে কোথায় কোথায় যাবে, গ্রাম সম্পর্কে ধারণা নিচ্ছে ওই লোকটার থেকে। নিরা রাফিনের পেছন থেকে বেরিয়ে লোকটার সামনে চলে আসলে রাফিন আবার নিরাকে আড়াল করতে ওর সামনে এসে দাঁড়ায়। নিরা রেগে আবারো রাফিনের পেছন থেকে সরে লোকটার সামনে চলে আসে। রাফিন এবার কড়া চোখে নিরার দিকে তাকায়। রাফিনের চাহনি দেখে নিরা ঘরে চলে আসে। লোকটা রাফিনকে বললো,
— ভাই উনি ভাবি মনে হয়?

— জ্বী।

— ভাবি তো অনেক সুন্দর ভাই। একদম হুর পরি।

কথাটা বলেই ঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে ডান হাতের বৃদ্ধাঙুলি দিয়ে ঠোঁটে স্লাইড করে। এটা দেখে রাফিনের মাথায় রাগ বেশ চড়া দিয়ে উঠে। লোকটাকে কিছু বললো না। আজকে তারা কোথাও যাবে না এসব বলে লোকটাকে বিদায় দিয়ে দিলো। ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে দেয়। নিরা কিছু বলার জন্য প্রস্তুত হয় তার আগেই রাফিন রাগে দরজায় লাথি মারে। নিরা ভয়ে কেঁপে উঠে। কিছু বলার সাহস পায়না। কাচুমাচু হয়ে খাটের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। রাফিন খাটে বসে ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেলো। রাগ এখনো কমেনি। টেবিলে খুব জোরে বারি মারলো। টেবিলের উপর থেকে স্টিলের গ্লাস দুটো ঝনঝন শব্দে নিচে গড়িয়ে পরলো। নিরা ভয়ে এবারো কেঁপে উঠে। শাড়ির আচল শক্ত করে খামছে ধরেছে। রাফিন উঠে দাঁড়ায়। নিরার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াতেই ভয়ে নিরার ভেতরের আত্মা শুকিয়া যায়। নিরা জানে রাফিনের রাগ খুব বেশি। এমনিতে রাগে না। কিন্তু রাগলে খুব ভয়ংকর হয়ে উঠে । এখন কি করবে এটা ভেবেই ভয়ে দুই তিনটা ঢোক গিলে। জড়োসড়ো হয়ে বেড়ার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রাফিন কিছুতেই মেজাজ নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। রাগের বসে নিরার দুই বাহু চেপে ধরে খুব জোরে। নিরা ভয়ে এবং ব্যাথায় চোখ খিঁচে নেয়। এখন কিছু বললেই থাপ্পড় খেতে হবে নিরা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে। রাফিন বাহু ধরে টেনে নিরাকে নিজের কাছে এনে বললো,
— সমস্যাটা কি তোর? তোকে যে আমি বারবার আড়াল করছিলাম তুই বুঝিস নি? হ্যাঁ? উত্তর দে? ওই লোকটা যে তোকে চোখ দিয়েই গিলে খাচ্ছিলো খেয়াল করেছিলি? কিরে কথা বল ইডিয়ট।

রাগে চিল্লিয়ে বলতেই নিরা আরো চুপ হয়ে যায়। ভেতরে ভেতরে কাঁদছে কিন্তু রাফিনের ভয়ে চোখ থেকে পানি বের করতেও কলিজা কাপছে। রাফিন চেচিয়ে আবারো বললো,
— এই একটা ব্যাপার তুই বুঝিস না কেনো? তোকে নিরাপদ রাখার জন্যেই তোর থেকে সাড়ে তিনমাস দূরত্ব বজায় রেখেছি। আর তুই যার তার সামনে এভাবে ঢ্যাং ঢ্যাং করে চলে যাস কেনো?

একহাতে চুলের মুঠি টেনে ধরে। অন্যহাতে নিরার মুখ উপরে তুলে চেপে ধরে। নিরা ভয়ে চোখ বন্ধ করে রাখে। এভাবে ধরায় ব্যাথায় চোখ থেকে পানি বের হয়ে আসে। নিরার চোখের পানি দেখে নিরাকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। রাফিন শান্ত স্বরে বললো,
— নিরুপাখি তুমি কেনো বুঝো না তুমি এভাবে থাকলে ছেলেরা আকৃষ্ট হবে। তোমার রুপ, শারিরীক গঠন ছেলেদের মনে আগুন ধরানোর মতো। তাইতো তোমাকে সবার কাছ থেকে আড়াল করে রাখি। তোমাকে বোরকা নামক আবরণে আবৃত করেছি। নিকাব দিয়ে তোমার চেহারার মায়া, সৌন্দর্য ঢেকে দিয়েছি। তুমি কেনো বুঝো না এসব?

রাফিন নিরাকে ছেড়ে দুইহাতে নিরার মুখ তুলে ধরে। নিরার চোখ ছলছল করছে। ঠোঁট ফুলিয়ে রেখেছে। একদম বাচ্চা বাচ্চা লাগছে। নিরার কপালে ঠোঁট ছুয়ে দিয়ে রাফিন আবার বললো,
— শুধু তোমাকে নিরাপদে রাখার জন্য সেদিন তোমাকে ছেড়ে অস্ট্রেলিয়া চলে গেছিলাম। মালিহা তোমার আর মেহরাবের কিছু ছবি তুলে মাকে দেখিয়ে তোমাকে চরিত্রহীন প্রমাণ করেছিলো। আমিতো দেখেই বুঝেছি মালিহা মিথ্যে বলছে। আমিতো জানি আমার নিরুপাখি কতটা পবিত্র। তোমাকে নির্দোষ প্রমাণ করতে মালিহার সাথে প্রেমের অভিনয় করে ওর মুখ থেকে সব সত্যি মায়ের সামনে তুলে ধরেছি। নিরা তোমাকে অন্য কারো কাছে প্রমাণ করার দরকার আমার নেই। কিন্তু আমার নিরুপাখিকে কেউ চরিত্রহীন বললে সেটাতো আমার বুকে লাগে তাই না। মালিহা এখানে থাকলে তোমাকে কষ্ট দিতো। আমি চাইনি সেটা। তাই দূরত্ব রেখেছিলাম।

রাফিন খাটে বসে নিরার বুকে মাথা রেখে কোমড় জড়িয়ে ধরে। চোখ বন্ধ করে নেয়। আবার বললো,
— আমি প্রতিদিন তোমার খোজ নিয়েছি কৌশিক থেকে। তোমার এতো বাজে অবস্থা শুনে লুকিয়ে কেঁদেছি। তোমাকে স্ট্রং করতেই সেদিন কৌশিককে বলেছিলাম লাউডস্পিকারে দিতে। তোমাকে কিছু কড়া কথা শুনাই যাতে কিছুটা হলেও স্বাভাবিক হতে পারো।

রাফিন চুপ হয়ে যায়। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আরেকটু শক্ত করে ধরে নিরাকে। আজ নিজেকে হালকা লাগছে খুব। নিরা নিরবে কাঁদে। রাফিনের গলা জড়িয়ে ধরে। চুলের মাঝে চুমু দেয়।

——————————
দুপুরে গোসল করে, খেয়ে হালকা বিশ্রাম নেয় দুজনেই। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হবে হবে এমন সময়ে নিরা উঠে চুল আঁচড়ে পরিপাটি হয়ে নেয়। রাফিনকে ডেকে বললো,
— চলুন পুকুর ঘাটে গিয়ে বসি।

রাফিন মৃদু হেসে নিরার সাথে বেরিয়ে যায়। দুজনে পুকুরের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে আছে। রোদের উত্তাপ তেমন একটা নেই। মিহি বাতাস বইছে। গাছের পাতা নড়ার শব্দ আর বিলের নৌকা বইয়ে নিয়ে যাওয়ার শব্দ দুটো মিলিয়ে দারুণ একটা মূহুর্ত তৈরি হয়েছে। নিরা পা দুটো পানির মধ্যে দোলাতে শুরু করে। কিছু একটা ভাবে। পা নাড়ানো বন্ধ করে রাফিনের দিকে তাকিয়ে বলে,
— আচ্ছা শুধু এইজন্য আপনি আমাকে বোরকা পড়তে বলেন?

রাফিন নিরার দিকে তাকায়। নিরার নাক টেনে বলে,
— শুধু সেটা নয়। অন্য একটা কারণও আছে।

— কি কারণ?

রাফিনের দৃষ্টি পুকুরের মাঝের দেয়ালের দিকে। নিরা উৎসুকভাবে রাফিনের দিকে তাকিয়ে আছে। রাফিন বললো,
— আগে বলো কখনো কাউকে দেখেছো হিরা, মুক্তা এসব মানুষের সামনে হাতে নিয়ে ঘুরতে?

— এটা তো অনেক দামি জিনিস। হাতে নিয়ে ঘুরলে তো কেউ নিয়ে নিবে।

— তোমাদের ঘরের অলংকার কি এমনিতেই এখানে সেখানে ফেলে রাখে?

— না।

— তাহলে এই দামি জিনিস গুলো কোথায় রাখে বলো?

নিরা বিরক্ত হলো। বিরক্ত হয়েই বললো,
— দামি জিনিস সিন্দুকেই রাখবে। এমনিতে তো আর ফেলে রাখবে না।

রাফিন এবার নিরার দিকে তাকিয়ে বললো,
— প্রতিটা নারী হচ্ছে এই হিরা, মুক্তার মতো। আর তাদের সিন্দুক হচ্ছে বোরকা, নিকাব। তুমি আমার পৃথিবীর সবচেয়ে দামী হিরাটার থেকেও দামী। তোমাকে কিভাবে খোলামেলা ঘুরতে দেই বলো?

নিরার কপালের চুল কানের পেছনে গুজতে গুজতে বললো,
— খোলা রাখলে তো যে কেউ এসেই নিয়ে যেতে চাইবে। নতুবা এতো দামী হিরা আমার কাছে দেখে হিংসায় সেটা নষ্ট করে দিতে চাইবে তাইনা? তাই তোমাকে বোরকা নামক দামি প্যাকেটে রেখেছি।

রাফিন পেছনের দিকে দুইহাতে ভর দিয়ে বসে। পানির মধ্যে পা দুলাতে শুরু করে। আবার বললো,
— বিয়ের আগে তোমাকে আমি ততটুকু শাসন করেছি যতটুকু দরকার ছিলো। আর এখন তুমি সম্পূর্ণ শাসনে থাকবে। আমার অনুমতি ছাড়া বাহিরের কোনো ব্যাক্তির সাথে কথা বলতে পারবে না।

নিরার মুখের কাছে মুখ এনে বললো,
— তুমি আমার সবচেয়ে দামী কিউট পিচ্চি বউ। তাই তোমাকে আমার মতো করে রাখবো যাতে কেউ তোমাকে না দেখে। আচ্ছা তুমি কি থাকবে আমার কাছে আমি যেভাবে রাখতে চাই সেভাবে?

নিরা মাথা দোলায়। মানে সে থাকবে। রাফিন হেসে দেয়। হঠাৎই “আহ” করে ঘাড়ে হাত নিয়ে যায়। নিরা বিচলিত হয়। বিচলিত কণ্ঠে বলে,
— কি হয়েছে আপনার?

— দেখো তো ঘাড়ে কিছু একটা কামড় দিচ্ছে।

নিরা রাফিনের একেবারে কাছে এসে ঘেষে বসে ঘাড়ে ভালো করে দেখলো। লাল পিঁপড়া কামড় দিয়েছে।
নিরা হেসে বললো,
— লাল পিপড়া আপনাকে আদর করেছে। আচ্ছা আপনার ঘাড়ে লাল লাল এগুলো কিসের দাগ?

রাফিন ভ্রু কুচকে বললো,
— কাল রাতে একটা জংলি বিল্লী খামছি দিয়ে আদর করেছে।

নিরা ভেঙছি কেটে সামান্য একটু সরে বসে। রাফিন নিরাকে ডাকলো,
— এ্যাই মেয়ে।

নিরা মাথা তুলে তাকায় রাফিনের দিকে। রাফিন ঠোঁট কামড়ে বললো,
— তুমি কি আমাকে অসুস্থ বানানোর প্ল্যান করে রেখেছো?

— মা.. মানে? আ.. আমি ক.. কি করেছি?

রাফিন ভ্রু নাচিয়ে বললো,
— আঁচল ঠিক করো।

নিরা হাতড়ে দেখলো আঁচলটা ডান পাশ থেকে সরে ঝুলে গেছে। তাড়াতাড়ি ঠিক করে নেয়। আবার রাফিনের দিকে তাকায়। রাফিন এখনো নিরার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে নেশা। নিরা আরেকটু দূরে সরে যায়। অন্যপাশ ফিরে বসে। লজ্জায় গাল লাল হচ্ছে। কান দুটো গরম হয়ে আসছে। নিরা চোখ বন্ধ করে ঠোঁট কামড়ে ধরে। মনে মনে বললো,
— এই লোকটা এভাবে করে না বললে কি হতো? সবসময় আমাকে লজ্জায় ফেলে মজা নেয়। অসভ্য ডাক্তার।

রাফিন বললো,
— ঘরে চলুন রাণী সাহেবা। আপনি হচ্ছে আমার ঘরের রাণী। আর আমি হচ্ছি এই রাণীর রাজা।

দুজন ঘরে চলে আসে। নিরা খাটের উপর পা তুলে বসে। রাফিন বললো,
— তুমি একটু বসো। আমি আসছি।

— কই যাচ্ছেন?

রাফিন দুষ্টু হেসে বললো,
— টয়লেট। যাবে আমার সাথে?

নিরা মুখ ভেঙায়। রাফিন হেসে বেরিয়ে যায়। নিরা সেদিকে তাকিয়ে থাকে। আনমনে হাসে। এই একটা মানুষ যার মধ্যে নিরা কখনো লালসা দেখেনি। যার মধ্যে দেহ ভোগের কোনো আকাঙ্খা দেখেনি। যার সামনে গেলে নিরার অস্বস্তি হয়নি। লোকটা মাঝে মাঝে ইচ্ছে করেই লজ্জায় ফেলে দিতো। এসব ভেবে নিরা আবারো লজ্জা পেয়ে মুচকি হাসে। খুব ভালো করে ভেবে দেখলো, বিয়ের আগে রাফিন কখনো নিরাকে চুমু দেয়নি। নিরা অবাক হয়। কত সুযোগ ছিলো তাও সেটার অপব্যবহার করেনি। কত ছেলে তার দিকে লালসার জন্য তাকিয়েছে শুধু এই মানুষটা সেভাবে তাকায়নি। এটা তার মানুষ। একান্তই তার। তার স্বামী। স্বামী শব্দটা মনে পড়তেই নিরা আরেকদফা লজ্জা পায়। দুইদিন পার হয়েছে অথচ একবারের জন্যেও অধিকার দেখায়নি। রাফিনের প্রতি নিরার সম্মান বেড়ে যাচ্ছে দিগুণ। সেই প্রথমদিন থেকে আজ পর্যন্ত কত খেয়াল রেখেছে এই মানুষটা তার।

এতশত ভাবনার মাঝেই রাফিন উপস্থিত হয়। নিরার সামনে বসে বললো,
— কাল আমরা ঘুড়তে বের হবো। তোমার জন্য বোরকাও রেডি করে ফেলেছি।

নিরা ঝাপটে পরে রাফিনের বুকে। রাফিন হতভম্ব হয়ে যায়। গলা জড়িয়ে ধরে রাফিনের দাড়িতে চুমু দেয়। রাফিন শখ খেয়েছে মতো গালে হাত দিয়ে হা করে বসে আছে। নিরা কিছু না বলেই সরে আসে। মনে মনে বললো,
— ইশ্ কি করে ফেলেছি আবেগের বসে। এই অসভ্য ডাক্তার এখন প্রতিটা সময় আমাকে খোটা দিবে।

————————————
মধ্যরাতে মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে। গ্রামের দিকে একটা বাজলেই মধ্যরাত হয়ে যায়। রাফিনকে হালকা ধাক্কা দিতেই ঘুম ভেঙে যায় রাফিনের। রাফিন কিছু না বলে প্রশ্নবোধক চাহনি নিয়ে নিরার দিকে তাকিয়ে আছে। নিরা খুব আদুরে ভাবে বললো,
— বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে চলুন আমরা একসাথে ভিজি। প্লিজ।

রাফিন কিছু না বলেই উঠে বসে। থ্রি কোয়াটার প্যান্ট পরে নেয়। গায়ে সেন্টু গেঞ্জি। নিরার পরনে সবুজ রঙের সূতির শাড়ি। দুইজনে এসে উঠানে দাঁড়ায়। মূহুর্তেই কাকভেজা হয়ে যায়। রাফিন নিরার থেকে বেশ দূরত্ব নিয়ে দাঁড়িয়েছে। নিরা দুই হাত মেলে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। কিছুক্ষণ দুজন এদিক সেদিক হেটেছে এই বৃষ্টিতে। এখানে আসার আগেরদিন তারা সবাই বৃষ্টিতে ভিজে বরফ পানি খেলেছে সেসব গল্প বলে নিরা হেসে কুটিকুটি। রাফিন এক ধ্যানে নিরার দিকে তাকিয়ে আছে।

হারিকেনের আলো বাড়িয়ে দরজার পাশে রেখেছে। হারিকেনের আলোয় উঠান মৃদু আলোকিত হয়েছে। আবারো আগের জায়গায় দূরত্ব নিয়ে দাঁড়ায় দুজন। রাফিন ভিজে যাওয়া নিরার দিকে তাকায়। গায়ে শাড়িটা একদম লেপ্টে আছে। যা দেখে রাফিনের মধ্যে একটা নেশা কাজ করে। চুল সব পিঠে লেপ্টে আছে। অনেকক্ষণ ঘোর লাগা নয়নে নিরার দিকে তাকিয়ে থাকে রাফিন। হারিকেনের আলো নিরার মুখে পড়ায় আরো মায়াবী লাগছে। চোখের পাপড়িতে বিন্দু বিন্দু পানি ফোটায় ফোটায় গড়িয়ে পড়ছে। রাফিন মৃদু আওয়াজে ডাকলো,
— নিরা।

নিরা উত্তর স্বরূপ রাফিনের দিকে তাকায়। রাফিন নেশাক্ত কণ্ঠে বললো,
— আজ একটু অসভ্য হই?

নিরা কিছু বললো না। নিরার চুপ থাকাকে হ্যাঁ সম্মতি ধরে নেয় রাফিন। হাত ধরে হেচকা টানে একদম কাছে নিয়ে আসে রাফিন। কাধের চুল সরিয়ে সেখানে ঠোঁট ছুয়ে দেয়। নিরা কেঁপে উঠে। তারপর নিরার ওষ্ঠ যোগল দখল করে নেয়।

নিরার কপালে কপাল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাফিন। দুইজনেই বড়বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছে। দুঘন্টা যাবত ভিজলো বৃষ্টিতে। রাফিন বললো,
— চলো ঘরে চলো। আরো ভিজলে ঠান্ডা লাগবে।

— আরেকটু ভিজি?

— তাহলে আমি আরো অসভ্য হয়ে যাবো। তখন আমাকে সামলাতে তোমার কষ্ট হবে।

নিরা মুখ ভেঙিয়ে ঘরে চলে আসে। কাপড় পালটে নেয়। নিরার কাপড় পালটানো শেষ হলেই রাফিন ঘরে এসে কাপড় পালটে নেয়। তাদের ভেজা কাপড় ঘরের বাহিরে বেড়ার সাথে লাগানো দড়িতে ঝুলিয়ে রাখে।

নিরা উল্টোদিক করে বসে আছে। রাফিন নিরার চুল মুছে দিচ্ছে। তারপর শুয়ে পরে। নিরা একদম গুটিসুটি মেরে রাফিনের বুকের কাছে এসে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পরে। বাহিরে এখনো বৃষ্টি হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর রাফিন ডাকলো,
— নিরা।

— হু।

— ঠান্ডা লাগছে?

— হু।

— কাঁথা দেই?

— হু।

রাফিন উঠে বড় ভারী একটা কাঁথা নিয়ে নিরার গায়ে জড়িয়ে দেয়। নিজেও কাথার ভেতরে ঢুকে নিরাকে জড়িয়ে ধরে।
·
·
·
চলবে………………………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here