হৈমন্তীকা পর্ব-২০

0
479

হৈমন্তীকা

২০.
পরিস্থিতি ভীষণ গুমোট। ঘনকালো পাঁপড়ির নিকষকৃষ্ণ আখিঁজোড়ায় ভয়, আতঙ্ক আর বিস্ময়ের ভীড়। নাওয়াজকে প্রচন্ড অদ্ভুদ লাগছে তার। ভীতি কাজ করছে। পলক ফেলে তার দিকে আরেকটু মনোযোগী হলো হৈমন্তী। নাওয়াজ গম্ভীর স্বরে বললো,
— “তোমার আমাকেই বিয়ে করতে হবে হৈমন্তী। তুষারকে হয়তো তুমি পছন্দ করো, হয়তো না। হয়তো বিয়ে করতে চাও। কিন্তু বিশ্বাস করো, সেটা আমি হতে দেব না। যাই-ই হোক না কেন।”

হৈমন্তীর চোখ বড় বড় হয়ে গেল। বিমূঢ়তায় স্তব্ধ হয়ে গেল সে। ভীতি কাজ করতে লাগলো আরও প্রবল ভাবে। হৈমন্তীর এহেন অভিব্যক্তি দেখে শরীর দুলিয়ে হাসলো নাওয়াজ। ক্ষীণ উচ্চশব্দে। তারপর হাসি একটু কমিয়ে বললো,
— “আমাকে ভয় পাচ্ছো হৈমন্তী?”
হৈমন্তী জবাব দিলো না। সে আগের ন্যায়ই চেয়ে আছে। এমতাবস্থায় নাওয়াজকে কোনো স্বাভাবিক মানুষ বলে মনে হচ্ছে না তার। অদ্ভুদ, বদ্ধ পাগল লাগছে। নাওয়াজ নিজের মুচকি হাসি বহাল রেখে আবার বললো,
— “ভয় নেই হৈমন্তী। আমি মজা করছিলাম শুধু। তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে এমন কিছুই করবো না আমি যাতে তুমি কষ্ট পাও। তুমি যাকে চাও বিয়ে করবে, ভালোবাসবে। সেটা একান্তই তোমার ব্যক্তি স্বাধীনতা। যা হস্তক্ষেপ করার অধিকার আমার নেই।”

এতটুকু শুনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো হৈমন্তী। নিমিষেই ভেতর থেকে যেন এক বিশাল বড় পাথর নেমে গেল। এতক্ষণ নাওয়াজকে নিয়ে কতকিছুই না ভাবছিল সে! কৃতজ্ঞা কিংবা এমনিই হৈমন্তী কিছু বলতে চাইলেই তাকে থামিয়ে দিলো নাওয়াজ। ন্যায়নীতি নম্র স্বরে বললো,
— “তবে আমি এটাও জানি আঙ্কেল কখনোই ওই ছেলের সঙ্গে তোমার বিয়ে দেবেন না। তাই আশা তো ছাড়তে পারছি না। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো হৈমন্তী।”

বলে আর এক মুহুর্ত দাঁড়ালো না সে। গতিপথ বাড়িয়ে বড় বড় পা ফেলে চলে গেল রুম থেকে। হৈমন্তী স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। জীবনটা ভীষণ জটিল মনে হচ্ছে তার। ঠিক যেমন ধাঁধাগুলো হয়।

_____

বর্ষা স্নাত সকাল। নতুন ফ্ল্যাটে আসার পর থেকেই এযাবত আর ভার্সিটি যাওয়া হয় নি হৈমন্তীর। বৃষ্টি হওয়ায় আজকেও যাবে না বলে মনস্থির করে রেখেছে সে। আসরাফ সাহেবও অফিসে যান নি আজকে। মেয়ের হাতের গরম গরম পরোটা চিবুচ্ছিলেন, হঠাৎ-ই কলিংবেল বেজে উঠলো সশব্দে। টুংটাং টুংটাং। হেমন্ত নাস্তার টেবিল থেকে উঠতে নিলে আসরাফ সাহেব মানা করে বলে উঠলেন,
— “তুই নাস্তা খা। আমি দেখছি কে এসেছে।”

সদর দরজার কাছে এগিয়ে গেলেন আসরাফ সাহেব। দরজা খুলতেই ক্ষীণ পরিচিত এক ছেলেকে দেখতে পেলেন। ছেলেটার চেহারায় চেনা চেনা ভাব থাকলেও ঠিক কে, তা ঠাওর করতে পারলেন না। ভ্রু কুঞ্চিত করে প্রশ্ন ছুড়লেন,
— “কে তুমি?”

বাম হাতের শাহাদাত আঙুলের সাহায্যে ছেলেটা তার নাকের ডগায় হেলে পরা চশমাটা ঠিক করলো। নম্র গলায় আওড়ালো,
— “আমি হৈমন্তীকার ফ্রেন্ড আঙ্কেল। ওর সাথে দেখা করতে এসেছি।”
আসরাফ সাহেবের ভ্রু যুগল যেন আরেকটু কুঁচকালো। আবারো প্রশ্ন করে উঠলেন,
— “এই হৈমন্তীকাটা কে?”
— “আসলে আমি হৈমন্তীর কথা বলছিলাম আঙ্কেল। ওকে আমি হৈমন্তীকা বলেই ডাকি। আপনি যদি ওকে একটু ডাকতেন?”
ছেলেটার কণ্ঠস্বর ভীষণ স্বাভাবিক। চাহনি ভীষণ শান্ত। এই ভীষণ জিনিসটাই পছন্দ হলো না আসরাফ সাহেবের। উনার মুখের ভাবভঙ্গি পরিবর্তন হলো না এক বিন্দুও। তবুও অতি সন্তপর্ণে ভেতরকার সন্দেহটা চেপে গেলেন তিনি। গম্ভীর স্বরে বললেন,
— “ভেতরে আসো।”

অতঃপর হৈমন্তীকে ডাকলেন।
ওপাশ থেকে ‘জি’ শব্দ উচ্চারণ করেই দ্রুত ওড়না গায়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো সে। বাবার পাশে সুঠাম দেহের ছেলেটিকে দেখে ক্ষণিকের জন্য থমকে গেল। চিনতে কয়েক সেকেন্ড লেগে গেল তার। নিজ বাবার পাশে তুষারের দাঁড়িয়ে থাকাটা ঠিক বিশ্বাস হলো না হৈমন্তীর। দৃষ্টি আরো মনোযোগী হলো। তবুও ফলাফল একই। তুষার হৈমন্তীর চমকে যাওয়া মুখশ্রী দেখে ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো,
— “হাই, হৈমন্তীকা।”

হৈমন্তী জবাবহীন। বড় বড় চোখে চেয়ে আছে সে। আসরাফ সাহেব এবার একটু কেঁশে উঠলেন। বললেন,
— “তোরা কথা বল, আমি আমার রুমে যাচ্ছি। আর তুমি। তোমার নাম জানা হয়নি আমার। কি নাম তোমার?”
— “তৈমুর।”
— “তৈমুর?”

আসরাফ সাহেব যেন একটু অবাকই হলেন। সঙ্গে সন্দেহটাও বেড়ে গেল তীব্র মাত্রায়। প্রতিউত্তরে তুষার মাথা নাড়ালো শুধু। কি ভেবে আর কিছু প্রশ্ন না আসরাফ সাহেব। প্রশ্ন করাটা অহেতুক মনে হলো তার। ধীর পায়ে চলে গেলেন রুমে।

হেমন্ত নাস্তার টেবিল থেকে উঠে এলো। হাসি-মুখে একটু জোড়েই বললো,
— “তুষার ভাইয়া তুমি এখানে?”
— “আস্তে কথা বলো। নয়তো তোমার বাবা যদি জানে আমিই তুষার, তাহলে ঘাড় থাক্কা দিয়ে বের করে দেবেন।”
হেমন্তের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো সে। শুনে খিলখিল করে হাসলো হেমন্ত। তুষার আবার বললো,
— “তুমি নাস্তা করো যাও। আমি তোমার বোনের সঙ্গে কথা বলবো।”
হেমন্ত জ্ঞানী ভাব দেখিয়ে বললো,
— “আচ্ছা, আচ্ছা। এমনিতেও তোমরা তোমাদের প্রাইভেট টাইমে কি করো তা কে দেখতে চায়?”

হৈমন্তী কড়া চোখে তাকাতেই হেমন্ত চুপ হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চলে গেল সেখান থেকে। তুষারের কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো হৈমন্তী। ক্ষীপ্ত স্বরে প্রশ্ন করলো,
— “আপনি এখানে কি করছেন? ভয় করলো না এখানে আসতে? ভাগ্যিস মা বাসায় নেই। নয়তো বাবাকে কিছু বলে দিলে কি হতো ভেবেছেন?”

তুষার হাসলো। বিস্তর, প্রাণ খোলা হাসি, “আমি তো জানি হবু শ্বাশুড়ি মা বাসায় নেই। তাই তো এসেছি।”
হৈমন্তী ছোট ছোট চোখে তাকালো। আশ্চর্য গলায় জিজ্ঞেস করলো, “আপনি আমার ওপর নজর রাখছেন?”
— “সেটা তো সবসময়ই রাখি হৈমন্তীকা।”

হৈমন্তী ধাতস্ত হলো। কেন যেন রাগ করতে পারলো না। তুষার তার চশমা ঠিক করতে নিলে বিরক্ত গলায় বললো,
— “হুট করে চশমা পরেছেন কেন? এত ঢং কোথা থেকে আসে আপনার?”
— “কিন্তু আমি তো পারু থেকে শুনেছি, এই চশমা পড়া ঢংগি ছেলেদেরই আপনার পছন্দ।”
হৈমন্তী ধমক দিলো, “আমাকে নাম ধরে ডাকেন বুঝলাম। কিন্তু পারুকে নাম ধরে ডাকছেন কেন? ও যে আপনার বড় ভুলে গেছেন?”
— “উনি আমার হবু শালী হন হৈমন্তীকা। হবু শালীকে কেউ আপু ডাকে?”
নিষ্পাপ স্বরে আওড়ালো সে। হৈমন্তীর কটমট গলা, “পাগল কোথাকার।”
ওপাশ থেকে শান্ত উত্তর, “ধন্যবাদ, হৈমন্তীকা।”

_________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here