১৩+১৪
#একগুচ্ছ_ভালোবাসা
লেখনীতে : আনিশা সাবিহা (ছদ্মবেশী)
পর্ব : ১৩
সকাল সকাল একটি সুখবর আমাদের বাড়িতে আনন্দের বন্যা বয়ে নিয়ে গেল। সুখবরটি হল নৌশিন মা হতে যাচ্ছে। এই বাড়িতে অদ্রিজার থেকে আরো ছোট সদস্য আসবে। এবার হারে হারে বুঝছি নৌশিনের বলা কালকের কথাগুলো। আসলে ও মা হতে যাচ্ছে বলেই ওর ভেতরটাই এমন ফিলিংস হচ্ছিল।
সবাই আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে গিয়েছে। সবাই নৌশিনকে নিয়ে এক প্রকার ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। অনুরাগ আনন্দের চোটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে মিষ্টি কিনতে চলে গিয়েছেন। নৌশিন কে নিজের বোনের থেকে কম ভালোবাসেন না সেটা আমি এই বাড়িতে আসার পরে বুঝতে পেরেছি। নিজের ছোট বোন মনে করেন অনুরাগ নৌশিনকে। আর অর্ণব বাচ্চাদের মত সারাবাড়ি লাফিয়ে বেড়াচ্ছে বারবার একই কথা বলে চলেছে,,,,
–“আমি বাবা হবো! আমি বাবা হবো!”
তার সাথে আরেকটি আজগুবি কথাও ও বলে চলেছে,,,
–“ভাইয়া আর আমাকে বলদ বলবেনা। আহা কত শান্তি জীবনে….!”
অর্নবের একথা আমরা নানান ভাবে খুঁটিয়ে গবেষণা করেও বিস্তারিত জানতে পারলাম না। অবশেষে বুঝতে পারলাম এতে দুই ভাইয়ের সংগঠিত কোন ঘটনা যেখানে অনুরাগ অর্ণবকে বলদ বলে সম্বোধন করেছেন। ব্যাপারটা আমরা সেইভাবে হাসাহাসি করছি। তবে আমাদের হাসাহাসিতে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই অর্ণবের। বর্ণদাও বেশ আনন্দেই আছে। একপাশে বসে থেকে সবার সাথে কম বেশি কথাবার্তা বলছেন। আমার জ্বরটাও কমে এসেছে অনেকাংশেই। তাই সবাই ঠিক করেছে নৌশিন যেহেতু আমাদের এতো বড় একটা খুশির খবর দিয়েছে সেহেতু ওকে কিছু না কিছু একটা গিফট দেওয়াই উচিত। সেই কারণে আজকে সবাই ঘুরতে যাবে। যেখানে যাওয়ার কথা অনুরাগ বলছিলেন সেখানে যাবে সবাই মিলে। কারো খুশি যেন ধরছে না। আমিও সবার খুশিতে বেশ খুশি!
এতো খুশির মাঝেও আমার মনে একটা চাপা কষ্ট রয়ে গিয়েছে। কষ্টটা এই পরিবারকে ছেড়ে যাবার কষ্ট। অদ্রিজাকে ছেড়ে যাবার কষ্ট। আর অনুরাগকে ছেড়ে যাবার কষ্ট! হ্যাঁ অনুরাগকে ছেড়ে যাবার কষ্টটাও কাজ করছে। কেন জানি না উনার প্রতি আমার মনে একটা ভিন্ন অনুভূতি কাজ করে। সেটা বিয়ের পর থেকেই। হয়তবা এটাই বিয়ে নামক সম্পর্কের কোনো মায়াজাল। বিয়েটা একটা ছেলে আর মেয়ের মাঝে অদৃশ্য একটা বন্ধন তৈরি করে ফেলে। যার জন্য আমি বিয়ের দিন থেকে আজ পর্যন্ত উনার একটা কথাও ফেলতে পারিনি। লোকটাকে অসম্মানও করতে পারিনি। আমার হাতে বেশি সময় নেই। এই বাড়িতে চিরকাল থাকার ভাগ্য নিয়ে হয়ত এই পৃথিবীতেই আসিনি।
নৌশিনের কন্ঠে ধ্যান ভাঙল আমার। চমকে ওর দিকে তাকালাম। ও আমাকে বলে উঠল ,,,,
–“অনু ভাবি চা খাবে?”
আমি ছোট ছোট চোখ করে তাকালাম ওর দিকে। বেশ কড়া মেজাজে বললাম,,,,
–“সেটা জেনে তুমি কি করবে?”
নৌশিন হালকা ভয় পেল। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বোঝার চেষ্টা করল ও কি কিছু ভুল বলল? মাথা হেলিয়ে ও মিনমিনে গলায় বলল,,,,
–“ওইতো সবাই চা খাবে। সকালে তো সবাই কমবেশি চা কফি খায় তাই বলছিলাম।”
–“সেটা নিয়ে তোমার চিন্তা কেন শুনি? এই অবস্থায় চা কফি বানাবে তুমি?” (তীক্ষ্ণ গলায়)
নৌশিন নিজেকে ভালোভাবে দেখে নিল। কিছুটা ভ্যাবলাকান্ত হয়ে বলল,,,
–“কেন ভাবি? কি হয়েছে আমার?”
এই মূহুর্তে সবার দৃষ্টি আমার আর নৌশিনের দিকে। সবাই নৌশিনের কথায় মিটিমিটি হাসছে। আমিও নিজের হাসিটা চেপে রেখে কেশে বললাম,,,,
–“নৌশিন! তুমি কিন্তু এবার বাড়াবাড়ি করছো। তোমারই তো সব হয়েছে। তুমি কি পুরোপুরি ভাবে ভুলে গিয়েছো তোমার ভেতরে আরেকটা প্রাণ বেড়ে উঠছে? তোমার এখন সারাদিন রাত বিশ্রাম করা উচিত। আনন্দে থাকা উচিত। আর তুমি কি না আগুনের তাপে কাজ করবে?”
–“তাহলে কি করবে?” (গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে)
আমি নৌশিনের কথা শুনে হাসলাম। প্রায় সবাই হেসে দিল। ও বেক্কল হয়ে সবার হাসি দেখছে। আসলে হয়ত মেয়েটার নিজেকেই অদ্ভুত লাগছে এখন। আমি উঠে নৌশিনকে ধরে বসে দিয়ে ওর নাক টেনে বললাম,,,,
–“পাকা গিন্নি হবে ভালো কথা। কিন্তু এতো চিন্তা তোমায় করতে হবে না বুঝতে পেরেছো? এখন তুমি শুধু নিজের আর বাচ্চার কথাটা ভাবো। আর বাড়ির বাকি কাজ করার জন্য আমি আছি। আর তোমার ভাইয়া এতো কাজের জন্য লোক রেখেছে। আর কি চাই?”
নৌশিন এবার বুঝল আমাদের হাসির কারণ। নিজেও ফিক করে হেসে দিল। আমি রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতেই নেত্রা আপুনি পেছন থেকে ডাকতেই পেছন ফিরে তাকালাম।
–“আরে অনুশ্রী! তোমার না জ্বর গায়ে। এদিকে এসে চুপটি করে বসো দেখি। আমি সবার জন্য চা কফি বানিয়ে নিয়ে আসছি।”
–“না আপুনি। আমি পারব। আমি তো এখন একেবারে ফিট আছি। জ্বর যা আছে তাতে কিছু হবে না আমার। এভাবে অসুস্থ মানুষের মতো বসে থাকলে তোমার ভাই বাইরে থেকে এসে আমাকে দেখে জীবনটা স্যুপময় করে ফেলবে।” (ঠোঁট উল্টে)
আমার কথায় আরেক দফা হাসল সবাই। হাসল না সবাই হাসিতে ফেটে পড়ল। আমি মুখ গোমড়া করে আপুনির উদ্দেশ্যে বললাম,,,
–“তুমি শুধু অদ্রিজার খেয়াল রেখো। ওকে নিয়ে যেন টানাটানি না হয়। (সুনয়নার দিকে তাকিয়ে)
দ্রুত পায়ে হেঁটে রান্নাঘরে চলে এলাম।
কফি বানানোর জন্য কফিমেকার আছে। তাই সেদিকে মন না দিয়ে চা বানানোর জন্য চুলো ধরিয়ে পানি বসালাম। অতঃপর মনে পড়ল অদ্রিজার জন্যও খাবার বানাতে হবে। রান্নাঘরে এসে ব্যস্তই হয়ে পড়লাম আমি। অদ্রিজার খাবার বানানোর মাঝপথে মনে হলো কেউ আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। শুধু পেছনে না অনেক কাছে। পেছন ফিরলাম আমি। সাথে সাথে কারো মাথার সাথে ঢিপ খেলাম। মাথায় হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে রইলাম। কয়েকসেকেন্ড পর চোখ খুলতেই দেখলাম বর্ণদা। সেও আমারই ভঙিতে মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখেমুখে রাগ ফুটিয়ে বললাম,,,
–“তুমি?”
বর্ণদা মাথা থেকে হাত সরালো। পকেটে হাত রেখে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল,,,
–“আই থিংক তোর মাথায় শিং উঠবে।”
–হোয়াট? শিং উঠবে কেন? আমাকে দেখে কি ষাঁড়, হরিণ, গরু মনে হয়?” (ভ্রু কুঁচকে)
সে হাসল। তার হাসিতে বরাবরের মতোই রসকষ নেই। অন্যদিকে তাকিয়ে বলে উঠল,,,
–“আগে তুই নিজেই বলতিস। মনে আছে? একদিন তোর মাথার সাথে আমার মাথার এতো জোরে ঢিপ লেগেছিল যে তুই কেঁদেই ফেলেছিলি। তারপর আমি তোকে কোনোভাবে শান্ত করাতে কি না করাতেই আমার মাথায় আবারও ঢিপ দিয়ে বসলি। এই ঢিপ খেয়ে আমার মাথায় আলু বেরিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল। তোর ওপর চরম রাগ করেছিলাম। তারপর তুই কি বলেছিলি জানিস? একবার অন্যের সাথে ঢিপ খেলে নাকি শিং গজায়। তাই দ্বিতীয়বার আবারও একইভাবে জোর দিয়ে ঢিপ দিতে হয়। তাহলে আর শিং গজায় না। আর তোর শিং উঠবে জেনেই তুই কাঁদতে বসেছিলি। সেটা শুনে আমি ঠিক কি রিয়েকশন দেব বুঝতে পারছিলাম না। আই মিন তোর মাথায় লেগেছে তার জন্য কাঁদিসনি। তোর মাথায় শিং উঠবে সেই কারণে কেঁদেছিস। হাহাহা।”
কথাগুলো বলে উচ্চহাসিতে ফেটে পড়ল সে। আমি চুলোয় থাকা পাতিলের দিকে তাকিয়ে অদ্রিজার খাবার বানানোতে মন দিলাম। খাবার নাড়তে নাড়তে বললাম,,,
–“সবই মনে আছে আমার। কিছুই ভুলিনি। শুধু কি জানো? বদলে গেছে সময়। বদলেছে বয়স। বড় হয়েছি আমি। বুঝতে শিখেছি। বুঝেছি বাস্তবতা!”
–“আসলেই খুব বড় হয়েছিস তুই।”
আমি শুধু দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। এই দীর্ঘশ্বাসে যে কতটা কষ্ট মিশে আছে তা নিজেও আঁচ করতে পারছি না ঠিক। আর কষ্টগুলো যে শুধু বর্ণদার সাথে আমার বিয়ে হয়নি এই কারণে সেটাও নয়। অন্য কোনো কিছুর জন্য কষ্ট আর একাকিত্বে ভুগছি। অথচ চারপাশে সবাই আছে। কিন্তু মনে হচ্ছে আমার পাশে কেউ নেই। আমি একা বড়ই একা।
বর্ণদা নানানরকম বাটি বাসন অন্যদিকে ঠেলে ওপরে উঠে বসল। আমার দিকে তাকিয়ে আচমকা বলে উঠল,,,
–“মন খারাপ তোর?”
আমি বর্ণদার দিকে এক পলক তাকালাম। তারপর চুলো ওফ করে পাতিল নামিয়ে নেড়েচেড়ে ঠান্ডা করতে লাগলাম। ভার গলায় বললাম,,,
–“না তো।”
–“এই বাড়ি থেকে চলে যাবি। অদ্রিজাকে ফেলে চলে যাবি। সব থেকে বড় কথা অনুরাগকে ফেলে চলে যাবি সেই কারণে তোর মনটা অস্থির হয়ে উঠেছে তাই না রে?”
আমি ঘাড় ঘুড়িয়ে তার দিকে তাকালাম। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকলাম। মনে একটাই প্রশ্ন ও কিভাবে জানল? সেও তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমার থেকে চোখ সরিয়ে চোখ বন্ধ করে ওপর দিকে মাথা করে থমথমে গলায় বলে উঠল,,,,
–“ভালোবাসিস অনুরাগকে?”
চোখজোড়া বিস্ময়ে ছেয়ে গেল। ভালোবাসা? না ভালোবাসতে পারি না আমি। কারণ অনুরাগ অনামিকাকে ভালোবাসেন। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,,,
–“না। এটা কি করে ভাবছো ভালোবাসি উনাকে? এক জীবনে দুজনকে ভালোবাসা যায়? আমি দুই নৌকোয় পা দিয়ে চলতে পারব না বর্ণদা। একজনকে বাছতে হবে আমায়। আর কারো বোঝা হয়ে থাকতে চাই না আমি। একদমই চাই না।”
কথাটা বলতে বলতে দ্রুত সবার চা কফি আর অদ্রিজার খাবার সাজিয়ে ফেললাম। বেরিয়ে আসতে নিলেই রান্নাঘরের দরজা পেরিয়ে এলো সুনয়না। এসেই আমাকে দেখে অবাক হলো না ও। কারণ ও জানে আমি এখানেই আছি। তবে বর্ণদার দিকে চোখ যেতেই তাকে খুঁটিয়ে দেখলে সে। ঠোঁটজোড়া প্রসারিত করে বলল,,,,
–“ওয়াও! এখানে দেখছি লায়লা মজনুর কাহিনী রচনা হয়ে যাচ্ছে।”
কথাটা বলে ফ্রিজের দিকে এগিয়ে গিয়ে ফ্রিজের দরজা খুলতেই বর্ণদা বেশ শক্ত গলায় বলল,,,
–“এক্সকিউজ মি! হোয়াট ডু ইউ মিন?”
সুনয়না স্বাভাবিকভাবে ফ্রিজ থেকে অ্যাপেল বের করে বলল,,,
–“ভাইয়া আপনি ভাব করছেন যে আমি ভুলভাল কিছু বলে ফেলেছি! দেখুন আমি খুব স্ট্রেটকাট কথার মানুষ। তাই যা দেখেছি তাই বললাম। আর অনুশ্রী! এমন হাবভাব করো যে তুমি অদ্রিজাকে খুব ভালোবাসো? ওকে ছেড়ে কোথাও যেতেই পারবে। এখন তো নির্ঘাত তোমার এই মামাতো ভাই আই মিন প্রেমিকের সাথে ঢ্যাং ঢ্যাং করে সংসার করতে চলে যাবে। অযথাই অনুরাগদার কাছে আমাকে খারাপ বানিয়ে দিলে। দ্যাটস নট ফেয়ার!”
–“নিজের কথাবার্তার ধরন ঠিক করো সুনয়না। এসব চিপ কথাবার্তা বলে নিজের চিপ মাইন্ডের পরিচয় দিও না।”
কথাটা একটু রাগের সাথে বললাম আমি। আমার কথা যেন সুনয়নার কাছে হাসির কথা বলে মনে হলো। তাই সে এক চমক হাসল। ভ্রু কুঁচকে ফেললাম আমি। ও অ্যাপেলে এক কামড় মেরে বলল,,,
–“হোয়াট? তোমরা প্রেম করবে আর আমি বললেই দোষ? হাউ ফানি! যাই হোক একটা সিক্রেট কথা তোমাদেরকেও বলি। (ফিসফিস করে) অনুশ্রী চলে গেলে মেবি আমারই ভালো হবে। আই মিন অনুরাগদাকে আমি অনেক অনেক আগে থেকে পছন্দ করতাম জানো তো। কিন্তু কি দুর্ভাগ্যবশত সে অনামিকাদি কে বিয়ে করে নিল। যাই হোক অনুরাগদার মতো গুড লুকিং, ওয়েল সেটেলড মানুষ আর কয়টা পাওয়া যাবে বলো তো? এখন তোমরা হয়ত ভাবছো তোমার আর এই বর্ণ ভাইয়া সেটেলের কথা কিভাবে জানলাম আমি? আসলে কি বলো তো? অনুরাগদা তো সব সময় তোমাদের বিয়ে নিয়ে তোরজোর করছে লুকিয়ে কিন্তু একটু অসাবধানতাবশত আমি শুনে ফেলেছি।”
কথাটা বলে নিজের অ্যাপেলে আবারও এক কামড় বসাল সুনয়না।
বর্ণদা আর আমি নিজেদের দিকে তাকালাম। এই মেয়ে এতোটা নিচু মনের জানতেও পারতাম না ও নিজ থেকে এসব কথা বললে। ওর প্রতি আমার মনটা বিষিয়ে গেল একেবারেই। নিজের জড়ানো চোখমুখ নিয়ে আমি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। আমার পেছন পেছন বেরিয়ে এলো বর্ণদা। ওর মতো মেয়ের সাথে কথা বলার বিন্দুুমাত্র ইচ্ছে নেই। পেছনদিকে শুনতে পেলাম সুনয়নার বিদঘুটে হাসির শব্দ!
বাস ছুটে চলেছে গন্তব্যের দিকে। আমরা সবাই দুপুরের পর পর সবাই বেরিয়ে পড়েছি ঘুরতে যাওয়ার জন্য। সবাই হুট করেই প্লানটা করে ফেলল। তার ওপর সবাই বলছে আমি আর অনুরাগ বিয়ের পর পর কোথাও যাইনি। তাই আমাদেরও ঘুরে বেড়ানো উচিত। কিন্তু কেউ তো জানে না। আমরা সারাজীবন একসাথে থাকার প্রতিজ্ঞাবোধ্য হলেও সারাজীবন একসাথে থাকতে পারব না। কেননা উনি অনামিকাকে ভালোবাসেন। আর আমি কাকে ভালোবাসি? কাকে? অনুরাগও নিজের গম্ভীর মুখখানাকে রাজি করিয়েছেন। মনমরা লোকটাকে কিছুতেই বুঝতে পারছি না আমি। উফফ….!
সবাই যে যার সিটে। সবার আবদার পূরণ করার জন্য অনুরাগ বাসের টিকিটও কেটেছেন। অবশ্য এই আবদারটা নৌশিনের। মেয়েটা আবদার করেছে বাসে করে যাবে। বাসে নাকি মজাটা হয় আলাদা। কিন্তু আমি এই আলাদা মজাটা একেবারেই উপভোগ করতে পারছিনা। গা ভীষণভাবে গুলোচ্ছে আমার। আমার পাশে থাকা নেত্রা আপুনি গল্পের আসর বসিয়ে দিয়েছে। আমি শুধু হু হা করে চলেছি। আর মাঝে মাঝে তার দিকে অসহায় ভাবে তাকাচ্ছি। যে কোন সময় আমার অবস্থা কাহিল হয়ে যেতে পারে। আমাদের অন্য পাশের সিটে বসে আছেন অনুরাগ ও বর্ণদা। উনারাও হালকা-পাতলা কথা বলতে ব্যস্ত। অদ্রিজাও তাদের কাছেই আছে। মেয়েটা জানালা দিয়ে গাড়ি, দৃশ্য দেখতে বেজায় ব্যস্ত। মাঝে মাঝে নিজের মায়াবী চোখ দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়াচ্ছে সে।
এই নৌশিনের চক্করে আমি যে কথায় ফেঁসে গেলাম আল্লাহ মালুম। এবার সহ্য সীমা অতিক্রম হয়ে গেল। মুখটা চেপে ধরলাম আমি। আমাকে দেখে আপুনি অস্থির গলায় বলে উঠলো…..
“তুমি ঠিক আছো, অনুশ্রী??”
আমি মাথা নাড়িয়ে জবাব দিলাম না আমি ঠিক নেই। বিষয়টা খেয়াল করলো বর্ণদা। সে আমার দিকে উঠে আসতে নিলেও বসে গেল। অনুরাগকে ডাকল সে। উনিও আমার দিকে তাকালেন। বর্ণদা কিছু কথা বলল অনুরাগকে। আমি তার কিছুই শুনতে পেলাম না। আমি শোনার মতো অবস্থাতেই নেই একেবারে। অনুরাগ উঠে এসে নেত্রা আপুনির উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,,,
–“নেত্রাদি। তুমি বরণ উঠে পড়। আমি নীলকে বলে দিচ্ছি ও যেন এখানে এসে বসে পড়ে। বর্ণের সিটে। বর্ণ দুলাভাইয়ের সাথে বসবে।”
উনার কথায় তাকালেন আপুনি। সরু গলায় বললেন,,,
–“কেন বলতো?”
–“মনে হচ্ছে অনুশ্রী বমি করবে। আর এসব দেখলে তোরও গা গুলাবে। তুই উঠে পর। কেন যে এই মেয়েটাকে নিয়ে আসলাম আল্লাহ জানে!! অনুশ্রী মানে প্যারা!”
উনার শেষের কথাটাই আমার দৃষ্টি নিস্তেজ থেকে অগ্নিদৃষ্টি হয়ে গেল। মুখ ফুলিয়ে জানালার দিকে তাকালাম আমি। নেত্রা আপুনি অনুরাগের মাথায় টোকা মেরে বলল,,,
–“অসভ্য। তোর বউ ও। প্যারা বলতে লজ্জা লাগে না?”
অনুরাগের কন্ঠস্বর আর শুনতে পেলাম না। অনুভব করলাম আপুনি উঠে গেল। অনুরাগ পাশে বসল সেটাও দৃঢ়ভাবে অনুভব করতে পারলাম। তার গভীর আবেশ খুঁজে পেলাম। সে আমার গাল টিপে এদিকে ঘুরিয়ে বললেন,,,
–“তোমাকে দেখার পর না টমেটো দেখার ইচ্ছেটা মরে গেছে। লাল লাল গাল। যেন তোমার গালে কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে হাহাহ!”
আমি রাগি দৃষ্টিতে চেয়ে অন্যদিকে ফিরে তাকানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। লোকটা আমার গাল টিপে ধরে রেখেছে। হঠাৎ অন্যহাতে থাকা একটা পানির বোতল চোখের সামনে তুলে ধরলেন অনুরাগ। তারপর আমার গাল ছেড়ে গম্ভীর গলায় বললেন,,,
–“পানিটা খেয়ে নাও ভালো লাগবে। এটা লেবু পানি।”
আমি বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালাম। উনি কি করে জানলেন আমি বাসে উঠলে লেবু পানি লাগে? এতে গা গুলানো ঠিক হয়ে যায়? কি করে জানলেন? হাউ?
আমার চোখে ভেসে থাকা প্রশ্ন যেন অনুরাগ পড়ে নিলেন। আমি কিছু বলার আগেই উনি মলিন কন্ঠে বললেন,,,
–“আমি নয়। বর্ণ এনেছে তোমার জন্য লেবু পানি। ও জানত তোমার এই অবস্থা হবে। খেয়ে নাও।”
আমি বর্ণদার দিকে তাকালাম। এখনো সে আমার আচার-আচরণ ও অভ্যেস সুনিপুণ ভাবে মনে রেখেছে। বর্ণদা ইশারাই পানি খেতে বলল। আমি আর কথা বাড়ালাম না। অনুরাগের হাত থেকে পানি নিয়ে দুই ঢক পানি পান করতেই উনি সিটে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলেন। বেশ আবেগ মাখানো গলায় বলে উঠলেন,,,
–“তোমাকে কত ভালো করে চেনে বর্ণ তাই না?”
–“হুমম!”
উনি চোখ বুজেই হাসলেন। এক অদ্ভুত ভঙিতে বললেন,,,
–“সে কারণেই হয়ত তোমায় আমার সাথে মানায় না অনুশ্রী! যে তোমাকে চেনে জানে তার সাথেই তোমায় মানায়। খুব মানায়। তার সাথেই তোমায় মিলাতে চাইছি। আনন্দিত নও তুমি?” (চোখ খুলে)
আমার চোখে অজান্তেই পানি ভাসতে থাকল। বলতে ইচ্ছে করছে। উনাকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে আমি খুশি হয়েও কেন হতে পারছি না? কিন্তু প্রশ্নটা গলার মাঝেই বাঁধিয়ে গেল। আটকা আটকা গলায় বললাম,,,
–“হ..হ্যাঁ খুব আ…আনন্দিত।”
–“ব্যাস! তোমার আনন্দ হলেই আমি খুশি।”
কথাটা বলে আমার ঠোঁটের নিচ দিয়ে গড়িয়ে পড়া পানি নিজের বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে মুছিয়ে দিলেন। উনার এই স্পর্শে কেমন জানি আদরের ছোঁয়া বলে মনে হলো। এইটাও কি উনার দায়িত্ববোধ? এটা দায়িত্ববোধের মধ্যে তো পড়ে না অবশ্যই। বেশ উৎসুক চাহনি নিয়ে বললাম,,,
–“আমি আনন্দে আপনি খুশি কেন? আমার খুশিতে কেন খুশি আপনি?”
–“জানি নাহ।”
এই ‘জানি নাহ’ কথাটাই কি সত্যি? কেন যেন মনে হলো কথাটা উনি বেশ কষ্ট নিয়ে বললেন।
জায়গাটা নারায়ণগঞ্জ। নানান জ্যামজটের কারণে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল গড়িয়ে গেল। বাস স্টপে নামিয়ে দিতেই গাড়ির অনেক ড্রাইভার এসে একপ্রকার জেরায় করতে শুরু করল। প্রশ্নটা হলো আমরা কোথায় যাব? শেষমেশ দুটো ভ্যান ঠিক করা হলো। অনুরাগ এই ভ্যান ঠিক করাতে বেশ নারাজ ছিলেন। উনার একটাই কথা আমরা ভ্যানে যাব? ব্যাপারটা যেন উনার কাছে অসম্ভব ছিল!
সুনয়না, মা, বর্ণদা, অর্ণব আর নৌশিন একই ভ্যানে উঠলেন। ভ্যানটা বেশ বড় ছিল তাই অসুবিধা হয়নি। তবে অনুরাগ বেশ চেষ্টা করেছিলেন আমাকে আর বর্ণদাকে একসাথে বসাতে। সক্ষম হন নি আপুনির জন্য। আপুনি ধমক দিয়ে বলেছিল আমরা দুটো পাখি যেন একত্রে বসি। আমরা সত্যিই পাখির ন্যায়। তবে দুজনই ভিন্ন ভিন্ন জাতের পাখি।
তাই অন্য ভ্যানে আমি, অনুরাগ, অদ্রিজা, নেত্রা আপুনি আর তার বর বসলেন। আমি আর অনুরাগ ভ্যানের পেছন দিকটাই বসলাম। অদ্রিজা আমার কোলে। মেয়েটার চোখে যেন ছিটেফোঁটা ঘুমও নেই। ওর দুই একটা দাঁত উঠার কারণে বারে বারে আমার হাতের আঙ্গুল মুখে দিয়ে বসে রইয়েছে।
অনুরাগ খানিকটা ইতস্ততবোধ করে ভ্যানে বসলেন। আমি উনার কান্ড দেখে মিটিমিটি হাসছি। কোনোমতে বসে আমায় বললেন,,,
–“অদ্রিজাকে নিয়ে তুমি বসতে পারবে? আমার কোলে দাও।”
কথাটা বলে টলতে টলতে নিজের হাত ভ্যানের সাথে চেপে ধরলেন। আমি হেসে দিয়ে ব্যঙ্গ করে বললাম,,,
–“আপনি তো নিজেই নিজেকে সামলাতে পারছেন না। ওকে কি করে সামলাবেন? আমি ঠিক অদ্রিজাকে সামলে নেব। আপনি শুধু ধরে থাকুন।”
উনি কিছু না বলে আমার দিকে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকালেন। আমি আকাশের দিকে চেয়ে আছি। ভ্যান গাড়ি ছুটে চলেছে শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ের দিকে। সেখান থেকে নদী পেরিয়ে গেলেই কিছুদূর পরেই অনুরাগদের একটা বড়সড় ফার্মহাউজ।
মিনিট পাঁচেক পর আমি অনুরাগের দিকে তাকালাম। এবার উনি বেশ ভালোভাবেই বসেছেন। উনার দিকে বললাম,,,
–“এবার ভালো লাগছে ভ্যানে?”
–“হুমম ভালোই লাগছে। যতটা খারাপ ভেবেছিলাম ততটাও নয়। খোলামেলা গাড়ি। পা ঝুলিয়ে যাচ্ছি। আর বাতাস গা ছুঁইয়ে দিচ্ছে বেশ।”
আমি আর কিছু না বলে আগের ন্যায় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
অবশেষে পৌঁছালাম সবাই নিজেদের গন্তব্যে। ফার্মহাউজটা আসলেই অনেকটা বড়। সামনে বাগান নেই তবে কৃষ্ণচূড়া ফুলের গাছ আছে অনেক বড় বড়। যা দেখে খুশিতে মনটা যেন নেচে উঠেছিল। ফার্মহাউজটা ভেতরটাও বেশ দেখতে। সব আগের ফার্নিচার। যা সৌন্দর্যকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। এখানকার কেয়ারটেকার আগের থেকেই সবার রুম পরিষ্কার করে রেখেছিল। তাই সবাই ক্লান্ত শরীর নিয়ে যে যার রুমে চলে গেল। আমি অদ্রিজাকে নিয়ে অনুরাগের পেছন পেছন উনার ঘরে এলাম। রুমটার ডিজাইন অন্যরকম। দেওয়ালে পেইন্টিং গাছ আর ফুল দিয়ে করা। অদ্রিজা এখন ঘুমিয়েই পরেছে। ওকে শুইয়ে দিলাম।
অনুরাগ গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠলেন,,,,
–“পাশের ঘরটা বর্ণর। যখন ইচ্ছে করবে ওর সাথে কথা বলতে পারো।”
–“যখন ইচ্ছে করবে?”
উনি আমার চাহনি দেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। তারপর রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। ভালো লাগছে না আমার। কিছু ভালো লাগছে না!
গভীর রাত! ঘুমটা হঠাৎই ভেঙে গেল। আমার আর অনুরাগের মাঝখানে ঘুমিয়ে থাকা অদ্রিজা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু তার ওপর পাশে অনুরাগ নেই! কোথায় গেলেন? আশেপাশে তাকালাম। উনার কূল কিনারা পেলাম না। ওয়াশরুমেও নেই। থাকলে পানি পড়ার শব্দ শুনতে পেতাম। এখানে আলাদা করে বেলকনিও নেই। বেড থেকে উঠে দাঁড়ালাম। রুম থেকে বেরিয়ে লম্বা করিডোরের এপাশ ওপাশ দেখলাম। নজরে পড়ল হুট করে করিডোরের শেষ প্রান্তে থাকা একটা অবয়ব। চাঁদের আলো পড়ছে সেখানে। এগিয়ে গেলাম সেদিকে। এগোতে এগোতে স্পষ্ট হলো ওটা আর কেউ নয় অনুরাগ! উনি কিছু একটা বলছেন একা একা। আড়ালে থেকে তা শোনার চেষ্টা করলাম। বুঝতে সক্ষমও হলাম। উনি একরাশ কষ্ট নিয়ে বলছেন,,,
–“সে আমার অস্তিত্ব।”
চলবে….🍀🍀
বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
___________________________________________
#একগুচ্ছ_ভালোবাসা
লেখনীতে : আনিশা সাবিহা (ছদ্মবেশী)
পর্ব : ১৪
(আসসালামু আলাইকুম। সবাইকে আগেই বলে দিই। আজকে আমি একটু বিজি আছি। বছরের শেষ। বুঝতেই পারছেন এই দিনে ব্যস্ততা থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাই পার্ট টা ছোটই হয়ে গেল। আশা করি সবাই বুঝবেন।)
কে উনার অস্তিত্ব? মনে বার বার এই প্রশ্নটা আঘাত হানতে থাকল। আবারও উনার দিকে তাকালাম আড়াল থেকে। উনি এদিকে ফিরে তাকালেন। উনার হাতে দেখতে পেলাম অনামিকার ছবি। ছবিটা চাঁদের আলোতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। এবার উত্তরটা পেয়ে গেলাম আমি। অন্যকেউ নয় অনামিকা উনার অস্তিত্ব! এই মূহুর্তেও আমি প্রমাণ পেয়ে গেলাম যে অনামিকা ছাড়া উনার জীবনে কারোর স্থান নেই। আমারও না। শুধু আমিই হয়ত লোকটার জন্য মায়া বাড়াচ্ছি। আমার প্রতি তো উনার কোনো অনুভূতিই তৈরি হয়নি। সেখানে উনার কাছে থেকে উনার বিরক্তির কারণ হতে আমি চাই না মটেও চাই না। আমি চলে যাব বর্ণদার সাথে। নিজের সব অনুভূতিকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে চলে যাব।
অনুরাগ আমাকে দেখার আগেই দৌড়ে রুমের ভেতরে এসে শুয়ে পড়লাম অদ্রিজার পাশে। চোখজোড়া বন্ধ করে ফেললাম। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে গেল। তবে এই ড্রিমলাইটের আলোতে এই কষ্টের পানি দেখার সাধ্য কারো নেই। অনুভব করলাম অনুরাগও রুমে এসেছেন। এক চোখ হালকা খুলতেই দেখলাম উনি অনামিকার ছবি নিজের ব্যাগে ভরে আমার দিকেই এগিয়ে আসছেন। আমি চোখটা পুরোপুরিভাবে বন্ধ করে নিলাম। উনার গরম নিশ্বাস পড়ল আমার মুখের ওপর। কিছুক্ষণ পর সেটা মিলিয়ে গেল। আমার মাথায় একটাই কথা ঘুরপাক খাচ্ছে সেটা হলো আমাকে এই সম্পর্ক থেকে মুক্তি পেতে হবে। পিছুটান রাখতে চাই না আমি। কিছুতেই চাই না।
সকাল সকাল অদ্রিজার কান্নার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল আমার। চোখ কচলে ওর দিকে তাকালাম আমি চোখ কুঁচকে। ও হাত পা নাড়িয়ে কান্না করছে। ওর কান্নার আওয়াজে অনুরাগও নড়েচড়ে উঠলেন। তবে উনার ঘুম ভাঙল না। আমি অদ্রিজাকে কোলে তুলে নিলাম। ওর তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙাটাই স্বাভাবিক কারণ ও কাল রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিল। ওকে নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরতেও ও শান্ত হলো না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে। এতোক্ষণে হয়ত অনেকেই উঠে পড়েছে। আমি অনুরাগের দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি ঘুমিয়ে আছেন এখনো। চোখমুখটা বিরক্তিতে কুঁচকানো। হয়ত অদ্রিজার কান্নার শব্দে ঘুমোতে সমস্যা হচ্ছে উনার। আমি অদ্রিজার দিকে তাকিয়ে গাল টেনে দিয়ে বললাম,,,,
–“ওলে ওলে! মেয়েটা কাঁদে কেন? চলো দেখি আমরা নিচে যাব। নিচে হয়ত এতোক্ষণে তোমার দাদীজান উঠে পড়েছেন। কাঁদে না সোনা।”
অদ্রিজাকে কথাগুলো বলতে বলতে বাইরে বেরিয়ে এলাম আমি। বাইরে বের হতেই মা সামনে এসে পড়লেন। একটুর জন্য ধাক্কাটা লাগেনি। মা তড়িঘড়ি করে বলে উঠলেন,,,
–“আরে অনুশ্রী অদ্রিজা কাঁদছে কেন? দেখি ওকে আমার কোলে দাও।”
–“আপনি অযথা সিঁড়ি বয়ে ওপরে আসতে গেলেন কেন মা?”
মা অদ্রিজাকে কোলে নিয়ে ব্যস্ত ভঙিতে বলে উঠলেন,,,
–“আহা অনুশ্রী! নিজের শরীর নিয়ে এতো ভাবলে চলে না বুঝলে? নিচে এখনো কেউ ওঠেনি। অনুরাগের তো তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে পড়ার অভ্যেস তাই দেখতে এসেছিলাম ও উঠল কি না। আর তাছাড়া মাঝে মাঝে তো আমার নাতনীকেও দেখতে আসতে ইচ্ছে করে। তাই না অদ্রিজা মনি?”
কথাটা শুনে অদ্রিজা কান্না থামিয়ে টলটল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল মায়ের দিকে। মা হেসে অদ্রিজা গাল আলতো ছুয়ে বলে উঠলেন,,,
–“এই দেখো আমার অদ্রিজা মনি আমাকে কিভাবে দেখছে! কি দেখছো ওমন করে?”
অদ্রিজা চোখ সরিয়ে আমার দিকে তাকাল। আধো আধো গলায় বলে উঠল,,,
–“মা….মাম্মা!”
আমিও হাসলাম। মা আমাকে হাসোজ্জল গলায় বলে উঠলেন,,,
–“ফ্রেশ হয়ত হওনি তুমি তাই না?তুমি ধীরেসুস্থে ফ্রেশ হয়ে নিচে এসো। আমি অদ্রিজাকে নিয়ে যাচ্ছি।”
কথাটা বলে দেরি না করেই মা অদ্রিজাকে নিয়ে হাঁটতে লাগলেন উল্টো দিকে। আমি ফ্রেশ হওয়ার জন্য রুমে ঢুকে পড়লাম। উনি এখনো ঘুমোচ্ছেন। অবশ্য ঘুমানোরই কথা! কালকে গভীররাতে অনামিকার স্মৃতিচারণ করে অনেক বেশ রাত করে ঘুমিয়ে ছিলেন। উনার ঘুমন্ত চেহারা দেখে একটা ইচ্ছে এসে আমার মাথায় চড়ে বসলো। উনাকে ঘুমন্ত অবস্থায় ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে। নিজের ইচ্ছেটা কে পূরণ করতে এগিয়ে গেলাম। বাদ সাধল অধিকার। কিসের অধিকারে আমি উনাকে ছুঁয়ে দেখতে যাচ্ছি? আই হ্যাভ নো রাইট টু টাচ হিম। পিছিয়ে গেলাম। অনুরাগের থেকে ঠিক চার হাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছি। হ্যাঁ এটাই আমার আসল জায়গা। অনুরাগ থেকে চার হাত দূরে। এই দূরত্ব আমার আসল জায়গা। এই দূরত্ব হয়তো কখনো ঘুচবে না বরং বাড়বে। বাড়তেই থাকবে।
ফ্রেশ হয়ে নিজের চুল খোপা করে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। হাঁটতে হাঁটতে বর্ণদার রুম পেরোতেই একটি সুন্দর গানের কন্ঠ সুর আমার কানে এসে পৌঁছালো। পা দুটো থেমে গেল বর্ণদার ঘরের সামনে। বেশ কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকালাম ঘরের ভেতরটায়। অনেকদিন পর শুনছি সেই চেনা গানের সুর। বর্ণদা খালি গলায় গান গাইছে জানালার পাশে বসে। বেশ ছোট থেকেই গান খুব ভালো করতো বর্ণদা। সবাই ছিল তার গানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বর্ণদারও স্বপ্ন ছিল গান নিয়ে ক্যারিয়ার গড়তে। তবে মামিমা সেটা সম্পূর্ণ হতে দেয়নি। আজ অনেকদিন পর তার গান শুনে মন শীতল হয়ে গেল। অজান্তে ঢুকে গেলাম তার ঘরে। আমার উপস্থিতি যেনো আমাকে না দেখেই পেয়ে গেল সে। গান থামিয়ে বর্ণদা জানালার দিকে একধ্যানে চেয়েই বলে উঠলো…..
–“কিরে নুড়ি তুই এলি?”
আমি গিয়ে তার পাশের চেয়ারে বসতে বসতে বললাম,,,
–“হ্যাঁ কিন্তু তুমি গানটা বন্ধ করলে কেন বেশ ভালোই তো গিয়েছিলে।”
–“আর আমার গান!! আগের মত কি ভালো সুরটা আছে রে? গলার সুর বেশ মোটা হয়ে গিয়েছে।
আমি ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলাম,,,
–“মোটেও না তোমার গলার সুর আগের মতোই সুন্দর আছে।”
বর্ণদা হাসলো। মজার ব্যাপারটা হলো তার হাসিটা আগের হাসিগুলোর মতো নয়। বেশ প্রাণোচ্ছল হাসি। হেসে আবারও থেমে গেল। আমার গাল ধরে বলল,,,
–“তোর মুখটা এমন ভার করে রেখেছিস কেন নুড়ি?”
–“এমনি বর্ণদা। ভালো লাগছে না।”
কথাটা বলে গাল বর্ণদার হাত ছাড়িয়ে নিলাম আমি। বর্ণদা আবারও আকাশ আর সকালের পাখির উড়াউড়ি দেখতে মনোযোগ দিলেন। হুট করে থমথমে গলায় বললেন,,,,
–“আমি জানি তোর মন খারাপের কারণ। তুই অনুরাগ কে নিয়ে ভাবছিস তাই না?”
আমি চমকে উঠলাম। প্রত্যেকদিনই এমন হুটহাট কথাগুলোতে এই ছেলেটার চমকে দেওয়ার চাইই চাই। কি করে যে বোঝে ও মনে কথাগুলো! তবুও দমে গেলাম না আমি। মাথা নাড়িয়ে বললাম,,,
–” উনার কথা কেন ভাবতে যাব? কিসের দায়ে পড়েছে আমার?”
বর্ণদা জানালায় হাত রেখে সেখানে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে নিল। শান্ত গলায় বলল,,,
–“পড়েছে পড়েছে। বেজায় দায়ে পড়েছে তোর। আবারও বলছি আরো একশবার বা হাজারবার ভাব। তুই এই সংসার ছাড়তে পারবি না নুড়ি।”
–“আমি কি করতে পারব কি করতে পারব না সেটা না হয় আমার ওপরেই ছেড়ে দাও। অনুরাগ তো এখনো আমাকে নিজের মনে জায়গায় দেয়নি। তার সংসারে থেকে কি লাভ বর্ণদা? মেয়েরা কেন সংসার করে জানো? ভালোবাসা, বিশ্বাস, মর্যাদা পাওয়ার জন্য। আমি তো এই সংসারে একটা জিনিসও পাইনি। আমি তোমার সাথে চলে যেতে চাই বর্ণদা।”
প্রথম প্রথম কথাগুলো শক্তভাবে বললেও শেষ কথাগুলোতে আমি দুর্বল হয়ে পড়লাম। বর্ণদা মাথা উঠিয়ে আমার মাথায় হাত দিয়ে বুলিয়ে দিতে দিতো আমার মাথা থেকে ক্লিপ সরিয়ে নিলেন। সাথে সাথে আমার চুলগুলো পিঠে এলোমেলো হয়ে পড়ল। আমি বিরক্তির সুরে বললাম,,,
–“কি করছো? তোমার কাছে গান শুনতে এসেছিলাম আর তুমি আমার চুলগুলো ছেড়ে দিলে? ভারি বিরক্তিকর মানুষ তুমি!”
–“জানি সেটা আমি। অনুরাগের খোলা চুল বেশ পছন্দ জানিস? তোর খোলা চুল ভালো লাগে তার।” (দাঁত কেলিয়ে)
অনুরাগের কথা শুনে আমি চোখ জোড়া গোল গোল করে কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই মুখ ফুলিয়ে ফেললাম। অভিমানি কন্ঠে বললাম,,,
–“তাতে কি হয়েছে? আমার খোলা চুল ভালো লাগে না ছাই! দাও আমার ক্লিপ। উনার কোনো পছন্দের জিনিস করব না আমি।”
কথাটা বলে নিজের ক্লিপটা হাতিয়ে নিয়ে উঠতে নিলাম আমি। যে আমাকে পছন্দই করে না সে নাকি আমার খোলাচুল পছন্দ করবে হুহ। তার জন্য চুল খুলে রাখতে চাই না আমি। বর্ণদা আমার হাত ধরে বললো,,,,
–“আরে কোথায় যাচ্ছিস? গান শুনবি না?”
–“না শুনব না। তুমি গান শুনালে এতোক্ষণ শুনিয়ে দিতে। এসব আজগুবি কথা বলতে না। ” (রাগে গজগজ করে)
সে আমাকে টেনে বসালো। আমার মাথায় টোকা মেরে জানালার দিকে ঠেস দিয়ে বসে চোখ বন্ধ করে মিষ্টি সুরে গাইতে লাগলেন,,,,
“পৃথিবী অনেক বড়,
ইচ্ছে হলে যাবো উড়ে
বাতাসে মাখবো রোদ,
ইচ্ছে হলে যাবো পুড়ে
আকাশ গাইবে গান,
নীলে নীলে সুরে সুরে।
চলো যাই বহুদূরে,
ডানা মেলে ঐ নীলে
সীমা ছেড়ে !”
বর্ণদার প্রত্যেকটা লাইন আমাকেই ডেডিকেট করছে সেটা বেশ বুঝতে পারছি। তবে আজ আমারও সত্যিই ডানা মেলে উড়ে যেতে ইচ্ছে করছে। সীমা ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে। তবে বর্ণদার সাথে নয়। অন্যকারো সাথে। উঠে পড়লাম আমি। চলে এলাম। বর্ণদা অনেকবার পিছু ডাকল আমায়। পিছু ফিরে তাকানো ইচ্ছেটা আর জাগল না।
চলবে….🍀🍀
বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।