একগুচ্ছ_ভালোবাসা লেখনীতে : আনিশা সাবিহা (ছদ্মবেশী) পর্ব : ১৫

#একগুচ্ছ_ভালোবাসা
লেখনীতে : আনিশা সাবিহা (ছদ্মবেশী)
পর্ব : ১৫
ফার্মহাউসের সামনের বড় বড় কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে কেউ কেউ গল্পগুজব আবার কেউ কেউ নাচগানে মেতেছে। নৌশিন আর অর্ণব জোড়া পাখির মতো এদিক আর ওদিকে ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে উড়ে বেরাচ্ছে। তাদের ঠোঁটের কোনে হাসিটা সবসময়ের জন্য লেগে আছে। নতুন সদস্য আসার হাসি। এই অদ্রিজাও যেন আমাকে ভুলতে বসেছে। নিজের দাদীমা আর নীল ভাইয়াকে পেয়ে খেলাতে মেতে উঠেছে। আমাকে সবাই ভুলেই গেছে হুহ। আমি মুখটা ভার করে একা একা হাঁটছি আর সবাইকে পর্যবেক্ষণ করছি।
অবশ্য একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। সবাই ভুলে গেলে আমি চলে গেলে কারোর কষ্ট হবে না। বিশেষ করে অদ্রিজার! আমিও মনপ্রাণ থেকে চাই ও আমায় ভুলে যাক। ছোট বাচ্চা তো। কয়েকদিনের মাঝেই আমাকে মা ভেবে নিজের আধো আধো কথা দিয়ে মাম্মা ডাকতে চায় মেয়েটা। সবার কাছ থেকে দূরে চলে গেলে সব থেকে বেশি পিছুটান টা অদ্রিজা আর ওই অনুভূতিহীন লোকটার জন্যই হবে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করে বাড়ির দেওয়ালের সাথে ধাক্কা খেলাম। মাথায় লাগল বেশভাবে। চোখ বুজে মাথা ঢলতে ঢলতে খেয়াল হলো আমি বাড়ির পেছন দিকটাই চলে এসেছি। আশেপাশে তাকিয়ে কয়েকটা জঙ্গলি গাছ দেখতে পেলাম। দূরদৃষ্টি দিতেই কিছুদূরে আরেকটা বড়সড় কৃষ্ণচূড়ার গাছ দেখতে লাফাতে শুরু করলাম। অন্যান্য গাছগুলোতে ফুল ঠিকভাবে না ধরলেও এই গাছে ঝাঁকে ঝাঁকে ফুল ঝুলছে। দৌড়ে গিয়ে গাছের কাছে দাঁড়ালাম। হাত বাড়িয়ে সব থেকে কাছের ডালের ফুলগুলো ধরার চেষ্টা করলাম। সফল হলাম না। এবার লাফিয়ে ধরার চেষ্টা করলাম। তবুও অসফল। মুখটা গোমড়া করে বললাম,,,
–“পঁচা গাছ। একটাও ভালো ফুল নেই।”
কথাটা বলে মুখ ফুলিয়ে সেখান থেকে আসতে নিলেই অনুরাগের কন্ঠে হকচকিয়ে উঠলাম।
–“ফল পাওনি। তাই আঙ্গুরফল টক?”
প্রথমে উনার কথায় রাগটা বাড়লেও খানিকটা খুশিও হলাম। তারপর ভ্রু কুঁচকে বললাম,,,
–“এখানে ফল কোথায়? এটা তো ফুল। কৃষ্ণচূড়া ফুল।”
অনুরাগ আমার দিকে এগিয়ে এলেন। মধুর হেসে পকেটে হাত দিয়ে আমার চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে বলে উঠলেন,,,
–“আরে ছোটবেলায় একটা গল্প পড় নি? ওইযে একটা শেয়াল যখন আঙ্গুরফল গাছ থেকে নামানোর চেষ্টা করেও পারে না তখন কি বলে? আঙ্গুরফল টক বলে। আমিও তাই বললাম।”
বাঁকা চোখে তাকালাম উনার দিকে। আমার গোমড়া মুখে রাজ্যের হাসি ফুটে উঠল। হাসোজ্জল মুখ নিয়ে অনুরাগের হাত চেপে ধরে বললাম,,,
–“আপনি তো বেশ লম্বা। আপনার হাত ওই ডাল পর্যন্ত যাবে। ফুল নামিয়ে দিন না!”
উনি ভ্রু উঁচিয়ে আমার দিকে তাকালেন। উনাকে চুপ দেখে আমি উনার হাত আরো জোরে চেপে ধরে বায়নার সুরে বললাম,,,
–“দিন না প্লিজ।”
অনুরাগ তবুও কিছু বললেন না। আমি যেই চেপে ধরেছি সেই হাতের দিকে তাকালেন। সাথে সাথে আমারও খেয়াল হলো। আমি উনার হাত তৎক্ষনাৎ ছেড়ে দিলাম। উনি কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে তাকিয়ে ভাব নিয়ে বললেন,,,
–“আমি পারব না। এতো ইনার্জি লস করতে।”
–“ইনার্জি লস মানে?” (সরু গলায়)
–” প্রথমত গাছের ফুল গাছেই মানায়।দেখো কৃষ্ণচূড়ার গাছ ওইদিকে। সো আমি আগে ওখানে হেঁটে যেতে হবে। তারপর হাত বাড়িয়ে ডালটাকে শক্ত হাতে ধরতে হবে। ডালটাতে তীক্ষ্ণ কিছু থাকলে সেটাতে হাত দিলে হাত কেটে ছিঁড়ে যাওয়ার সম্ভবনাও আছে। মাই গড! কতটা রিস্ক এতে ভাবতে পারছো?”
উনার কথা শুনে প্রচন্ড রাগ হলো আমার। রাগে মাথাটা ফেটে যাচ্ছে। সামান্য একটা ফুলের জন্য এতো কথা? আই এম সিউর এটা আমি জন্য উনার ফুলটা দিতে এতো আপত্তি। অনামিকা হলে মুখ থেকে কথাটা বেরোনোর আগে ফুলটা হাজির হয়ে যেত। আমি জোরে চেঁচিয়ে বললাম,,,
–“ঢের হয়েছে আমার। দরকার নেই আপনার গাছের ফুল। আপনি আপনার ইনার্জি নিয়ে শুয়ে থাকুন। আর ফুল দিয়ে গোসল করুন।”
কথাটা বলে হনহন করে হেঁটে চলে এলাম আমি। চাইনা আমার ফুল।

গোসল করে সবে ওয়াশরুম থেকে বের হলো বর্ণ। মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে। ফুরফুরে মনটার ক্রেডিট যাচ্ছে অনুরাগের কাছে। ওর জন্যই নিজের ভালোবাসাকে ফিরে পেতে যাচ্ছে সে। যাকে পাওয়ার আশা পুরোপুরি ভাবে হারিয়ে বসেছিল তাকে এভাবে পেয়ে যাবে ভাবতেই পারেনি। সব যেন স্বপ্নের ন্যায়! তবে মনের মাঝে রয়ে গেছে সংকোচ। সংকোচটা নুড়ির জন্য। মেয়েটা মায়ায় আটকে পড়েছে। অনুরাগের মায়ায়। এটাকে মায়া বলবে নাকি ভালোবাসা সেটা জানে না বর্ণ। সেই কারণেই তার নুড়িকে বারবার ভাবতে বলেছে সে। কিন্তু মেয়েটা যেন কোনো একটা জেদের বশে অনুরাগের প্রতি তার অনুভূতিটাকে চাপা দিয়ে ফেলছে। সে যাই হোক। নুড়ির বোঝার বয়সটুকু হয়েছে। আবেগের বয়স পেরিয়ে এসেছে সে। তাই ওকেই ওর ভালোবাসাকে বাছতে হবে।
দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে মাথার চুল মুছতে মুছতে বিছানায় বসে পড়ল সে। হাতটা বিছানায় রাখতেই হাতটা ফোনের ওপর গিয়ে পড়ল। ফোনটা লাগাতার ভাইব্রেশনের সাথে বেজে চলেছে। ফোনের ওপর থেকে হাত সরাতেই বর্ণের চোখমুখে বিরক্তির হাতছানি এসে ধরা দিল। ফোনটা হাতে নিতে নিতে কল কেটে গেল। আবারও কল বেজে উঠতেই কল রিসিভ করে কানে ধরল সে। ওপর পাশ থেকে মায়ের গলা পেতেই তার বিরক্ত আরো প্রসারিত হলো।
–“হ্যালো বর্ণ বাবা। কেমন আছিস?”
বর্ণ ছন্নাছাড়া কন্ঠে বলে উঠল,,,,
–“হুমম ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?”
–“কেমন থাকার কথা বল তো তুই? সবে সবে বিদেশ থেকে ফিরলি। অথচ আমার কাছে দুই দন্ডও না থেকে চলে গেলি অনুর শ্বশুড়বাড়িতে? নিজের মায়ের একটুও পরয়া করবি না তুই বাবা?” (হতাশ ভঙিতে)
বর্ণ তাচ্ছিল্যর হাসি হাসল। কানের ফোন চেপে রেখে গায়ে শার্ট পড়তে পড়তে বলল,,,
–“তোমার মুখে পরয়া শব্দটা মানায় না মা। তুমি কি পরয়া করেছিলে তোমার ছেলের?”
ওপাশে বর্ণের মা চুপ হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,,,
–“কি বলতে চাইছিস তুই?”
–“আমি কি বলতে চাইছি সেটা তুমি ছাড়া ভালো করে কেউ বুঝবে না। নুড়িকে আমি ভালোবাসি জানা সত্ত্বেও কি করে অন্য একটা ছেলের সাথে তুমি বিয়ে দিতে পারলে তুমি? শুধু তাই নয়। তুমি ওর সাথে এমন এক ছেলের বিয়ে দিলে যার আগের পক্ষের বউ ছিল। আর আগের পক্ষের বাচ্চা আছে। জানো তো? তুমি যদি ওকে এমন ঘরে বিয়ে দিতে যেখানে ও খুশি থাকবে তাহলে আমার বুকটা জুড়াতো। তবে তুমি সেটা করোনি। কেন মা?”
কথাগুলো বেশ শক্ত গলায় বলল বর্ণ। বর্ণের মা বেশ তাড়াহুড়ো করে ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,,,
–“এসব তুই কি বলছিস বর্ণ? নিশ্চয় ওই বেয়াদব মেয়েটা তোর মাথা খেয়েছে তাই না রে? তুই চলে আয় বর্ণ।”
–“প্লিজ মা। অনেক বলেছো নুড়ির বিরুদ্ধে কথা। আর নয়। একটা কথা কান খুলে শুনে রাখো। নুড়িকে আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে করছি।”

বর্ণের কথায় তার মা চরমভাবে বিস্মিত হলো। তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। যেই মেয়েটার পিছু ছাড়াতে সে তার ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছে। এমনকি তড়িঘড়ি করে মেয়েটার বিয়ে অবধি দিয়েছে এখন ঘুরেফিরে সেই মেয়েটাই তার বাড়ির বউ হবে? এটা কিছুতেই হতে দেবেন না বর্ণের মা। রাগ আর বিস্ময় মিশ্রিত গলায় সে বলল,,
–“এসব কি বলছিস তুই বর্ণ? তুই ভুলে যাস না। অনুর বিয়ে হয়েছে অন্য একজনের সাথে। তুই ওকে বিয়ে করতে পারিস না। ও তোর যোগ্য নয়।”
বর্ণ রেগেমেগে বলল,,,
–“নুড়ি সুখি নয়। আর যার সাথে তুমি তাকে বিয়ে দিয়েছো সেও সুখি নয়। তাই অনুরাগ ওকে আমার করে দিতে চেয়েছে। যেই কাজটা তুমি করতে পারোনি। সেই কাজটা অনুরাগ করবে। যেভাবে ওদের বিয়ে হয়েছে সেভাবেই ওদের ডিভোর্স হবে। নারায়ণগঞ্জ থেকে ফেরার পর নুড়িকে বিয়ে করব আমি। আশা করছি তুমি ওকে মেনে নেবে।”
বর্ণের মা রেগে গেলো। তার ছেলের বউ হিসেবে অনুকে সে কিছুতেই মেনে নেবে না। বর্ণের মা জোরে চেঁচিয়ে বলে উঠল,,,
–“এ জীবন থাকতে আমি ওই মেয়েকে আমার ছেলের বউ হিসেবে মেনে নেব না বর্ণ। ওকে বিয়ে করলে ওর এই বাড়িতে ঠাঁই হবে না।”
–“এটা তোমার ব্যাপার তুমি মেনে নেবে কি না। আমার জানানোর কথা ছিল তাই জানিয়ে দিলাম।”
কানে ফোন ধরে মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল বর্ণ।

সবে অদ্রিজার সাথে ওর ভঙিতে কথা বলে উঠলাম আমি। মুখটা এখনো বেজায় ভার। তার সাথে বিরক্তির ছাপ এখনো রয়ে গেছে। এখনো মনে হচ্ছে কৃষ্ণচূড়ার ফুলগুলো নামিয়ে দিলে কি বেশ ক্ষতি হত তার? অদ্রিজার দিকে তাকালাম। নীল নিজের মুখের অঙ্গিভঙ্গি বেশ হাস্যকর করছে সেটা দেখে অদ্রিজা হাসতে হাসতে মাটিতে বিছিয়ে রাখা বসার ম্যাটে গড়িয়ে পড়ছে। আহা কি সুন্দর হাসি! ছোটবাচ্চাদের হাসিগুলো বেশ মনোমুগ্ধকর হয়। যেন ইচ্ছে করে দেখতেই থাকি। উফফ এই হাসির ভিডিও করার জন্য মনটা আনচান করতে শুরু করল আমার। যেই ভাবা সেই কাজ। ফোন বের করে ভিডিও করতে শুরু করলাম। মিনিট দুয়েক ভিডিও করে ভিডিও অপশন ওফ করতেই মনে হলো আমার কানে কেউ কিছু একটা গুঁজে দিলো। হাতিয়ে কান থেকে বস্তুটা আনতেই দেখি কৃষ্ণচূড়ার ফুল। চোখজোড়া চকচক করতে লাগল আমার। ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠল মুচকি হাসি। পিছন ঘুরতেই অনুরাগকে দেখে হাসিটা বিস্ময়ের হাসিতে পরিণত হলো। উনার হাত ভর্তি কৃষ্ণচূড়ার ফুল দেখে হাসি আরো প্রসারিত হলো। আমার হাতে উনি ধরিয়ে দিলেন ফুলগুলো। আমি চমকে গেলাম। উনার দিকে উৎসুর দৃষ্টিতে তাকাতেই উনি নিজের চুলগুলো এক সাইডে করতে করতে বললেন,,,,
–“কি করব আর? ফুলগুলো নেওয়ার জন্য এতো কান্নাকাটি করলে তাই ভাবলাম ফুলগুলো দিতেই হয়। তাই দিলাম। বেশি কিছু নয় কিন্তু!”
কথাটা বলে আশেপাশে তাকালেন উনি সামনে তাকিয়ে দেখলাম বর্ণদা আসছে। কানে ফোন ধরে কারো সাথে কথা বলছে সে। তার চোখমুখের ভঙি দেখে মনে হলো সে বেশ রাগান্বিত। সে যাই হোক ফুলগুলো পেয়ে আমি খুশি। ভীষণ ভীষণ খুশি। এই খুশিটা হয়ত শুধু ফুলগুলোর জন্য নয়। ফুল দেওয়া ব্যক্তিটার জন্যও। আমি নাক ফুলিয়ে অনুরাগকে বললাম,,,
–“জানি জানি। আর বলতে হবে না।”
উনি আমার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন,,,,,
–“নিজের বাঁধা চুলগুলো ছেড়ে দিলে কিন্তু কৃষ্ণচূড়া ফুলের সাথে বেশ মানাবে।”
কথাটা বলে দূরে সরে গেলেন উনি হাঁটতে হাঁটতে। আমি কি যেন একটা ভেবে হেসে চুল ছেড়ে দিলাম। উনি অনেকটা দূরে সরে গিয়ে খানিকটা সুর করে বললেন,,,,
–“তুমি সৌন্দর্যে ভরপুর হও
তোমার কন্ঠে হাজার মধু থাকুক
তুমি হাজার বিত্তের অধিকারী হও
আমি তুচ্ছ আমি বিকৃত আমি হিন
তবুও ভালোবাসি।”
উনার ব্যবহার আর এই ছন্দ কবিতাতে আমার বুকে এসে লাগল যেন। মাথায় একটাই প্রশ্ন ভনভন করছে মাছির মত। উনি ছন্দ কবিতাটি কার উদ্দেশ্যে বললেন??

চলবে…..🍀🍀
বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটা শেষ দিকে খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here