#৫ম_তলার_মেয়েটা
#পর্ব_১৪
সিমি তার পেটের উপর হাতটা রাখে।একটা প্রাণ তার নিজের মধ্যেই আছে চিন্তা করতেই কেমন অদ্ভুত লাগে।মনটা বিষণ্ন হয়ে যায়, তার কোন বান্ধবীর এখনো বাচ্চা হয়নি আর সে বাচ্চা নিয়ে ঘুরবে? কিন্তু আবার যখন ওর মনে হয় ,’আমার নিজের সন্তান,আমার অংশ।’ তখন সেই বিষণ্নতাকে ছাপিয়ে ভালোলাগার একটা অনুভুতি তাকে ঘিরে ধরে। কয়েকদিন আগেও অনেক রাগ লাগতো,শরীরটা যখন খারাপ লাগতো,বমি হতো সব কিছু ভেঙে চুরমার করে দিতে ইচ্ছে করতো। এখন এমনটা হয় না।বমি কমে গেছে, শরীরের অস্থিরতা ও অনেকটা কমেছে,তবে ঘুম কমে গেছে।
কিছুক্ষণ আগেই ভোরের আলো ফুটেছে।সিমির ঘুম ভেঙ্গে গেছে আরো আগে। পরশের দিকে তাকাতেই সিমির মনে হলো কি সুন্দর একটা মুখ।বিয়ের পর থেকে পরশের দিকে ভালো করে তাকানোই হয় না।পরশ হয়েছে ওর মায়ের মত দেখতে।সিমির মনে হয়,’আমার বাচ্চাটা কার মতো দেখতে হবে,ছেলে নাকি মেয়ে হবে?’
পরশের একেবারে কাছে গিয়ে ভালোবাসার গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলো পরশকে।পরশ ভয় পেয়ে জেগে উঠলো-
—তোমার খারাপ লাগছে?
—না,খারাপ লাগছে না।
—তাহলে কি হলো?
—কি আশ্চর্য আমি তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরতে পারি না?
পরশ হেসে বলল-
—সেটা তো পারই। কিন্তু তোমার এমন আচরণ দেখে আমি ভয় পেয়ে গেছি, কখনো তো এমন কর না।
সিমি তাকিয়ে রইলো পরশের দিকে।হাসলে পরশকে খুব সুন্দর লাগে।
—কি হলো রাগ করলে আমার কথায়?
—না রাগ করিনি।এবার কথা না বলে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধর তো একটু।
পরশ বুকের মাঝে জড়িয়ে নিল সিমিকে।
কয়েকদিন থেকেই সিমির আচরণে অনেক পরিবর্তন এসেছে।পরশের খুব ভালো লাগছে। নিজেকে খুব সুখি সুখি লাগছে।সিমির অনেক লম্বা চুল।এখন যত্ন নিতে পারে না।চুলে আঙুল চালাতে লাগলো পরশ।
—তোমার চুল আজকে শ্যাম্পু করিয়ে দিবো।মনে হয় ময়লা হয়েছে।
—গন্ধ লাগছে?তাহলে ছাড় দুরে গিয়ে শুই।
—আরে না।চুলটা চিটচিটে হয়ে গেছে।
—তুমি পারবে শ্যাম্পু করিয়ে দিতে?
—কেন পারবো না?
—হয়েছে আর কাজ দেখাতে হবে না।মা-ই আমাকে বিছানায় শুইয়ে শ্যাম্পু করিয়ে দেন।গোসল করার সময় এখানে বসে থাকেন, দরজা খোলা রাখতে বলেন।
—মা অনেক খেয়াল রাখছেন তোমার। তবুও তোমার যদি ইচ্ছে করে আমার শ্বশুর বাড়ি গিয়ে কিছু দিন থাকতে,থাকতে পার।
—তোমার শ্বশুর বাড়ি গিয়ে থাকতে হবে না। আমার শ্বশুর বাড়িতেই ভালো আছি আর আমার মা তো আসছেই এক দুই দিন পর পর।দুই মা মিলে আমার জীবন অস্থির করে ফেলল।
—তাঁরা তোমার এত খেয়াল রাখছেন দেখে খুব বিরক্ত হচ্ছো?
—মোটেও না। আমার খুব ভালো লাগে।মনে হয় আবার আমি ছোট হয়ে গেছি।আমাকে জোর করে,ধমক দিয়ে আদর করে খাওয়ায়।
—তাহলে বল তো,তুমি আলাদা বাসায় থাকতে চেয়েছিলে ,তখন এমন টেককেয়ার পেতে?
—আমি ঐ সব কথা একদম মনে করতে চাই না।
আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে কিছু খাবো।
—কি খাবে,এখানে ফ্রুটস, বিস্কিট আরো অনেক কিছু আছে কি খাবে?নাকি ফ্রোজেন ফুড কিছু খাবে,ভেজে দেই?
—এই সব কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না।আমাকে কাঁচা মরিচ আর পিঁয়াজ দিয়ে মুড়ি মাখিয়ে দাও।
—কি!মুড়ি মাখানো খাবে? আচ্ছা দেখি মুড়ি আছে কিনা?
কিছুক্ষণ পর পরশ মুড়ি মাখিয়ে নিয়ে এলো।সিমি খেতে খেতে বলল-
—এই মুড়ি পৃথিবীর সবচেয়ে মজার মুড়ি মাখানো হয়েছে।এত মজার মুড়ি মাখানো কখনো খাইনি।
—সত্যি বলছ?
—ভালো না লাগলে খেতাম?তুমিও একটু খাও।
—না,তুমি খাও আমি তোমাকে দেখি।
কাঁচা মরিচের ঝালে হু হা করতে লাগল সিমি তবুও সে খুব তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে। আর পরশ দেখছে ঝালে লাল আভা ছড়ানো সিমির মুখটা।
বাড়িওয়ালা তোফাজ্জল হোসেন অনেকক্ষণ থেকেই বসে আছেন তাঁর মা শুভ্রতায় জরানো জালেরা বেগমের সামনে।জালেরা বেগম পান বানাচ্ছেন। অনেক সময় নিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে পান বানাচ্ছেন তিনি।মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে এই কাজটা নিখুঁতভাবে না করলে এই পৃথিবীর অনেক অনিষ্ট হয়ে যাবে।জালেরা বেগমের এই স্বভাব, মানে নিজের সামনে কাউকে বসিয়ে রেখে নিজের কাজ করে যাওয়া ,কাউকে এভাবে ইগনোর করা, খুব ভালো ভাবে পেয়েছেন তোফাজ্জল।যখন নিজে এটা করেন তখন বুঝতে না পারলেও তার মা যখন তাকে বসিয়ে রেখে এমনটা করেন তখন কতটা অসহ্য লাগে বুঝতে পারেন।এটাও স্পস্ট বুঝতে পারছেন তার মা অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলার জন্য তাকে বসিয়ে রেখেছেন। বিষয়টা অবশ্যই জালেরা বেগমের খুব অপছন্দের কোন বিষয় হবে। তোফাজ্জল ভাবছেন তার মা হয়তো তার স্ত্রী হাজেরার বিষয়ে কিছু বলবেন। ছেলের বৌয়ের দোষ সেটা সারা জীবনের সমস্যা। অনেকক্ষণ বসে থেকে তোফাজ্জল বললেন-
—আম্মা আমার তো দেরি হইয়া গেলো।
জালেরা বেগম চোখ তুলে তাকালেন।একটু মুচকি হেসে বললেন-
—মায়ের কাছে বসার ও সময় নাই তোমার?
তোফাজ্জল ভাবছেন বিষয়টা মনে হয় খুবই জটিল।কারণ আম্মা তাকে তুমি করে বলছেন।
—আচ্ছা ঠিক আছে আম্মা।আমি বসতেছি। আপনের কাজ শেষ হোক।
—আমার কোন কাজ নাই।পান বানানো কোন কাজ হইলো?
—রশিদের খবর কি কওতো।কেন তারে এই বাড়ি ছাড়া করলা?
—আপনেরে বলা যাবে না।সে জঘন্য একজন মানুষ। আমার বোন জামাই না হইলে কল্লাটা কাইটা রাখতাম।
—পাঁচ তলার মেয়েটার জন্য এত দরদ কেন তোমার?
হঠাৎ তোফাজ্জল যেন কারেন্টে শক খেলেন।এত কথা তার মা জানলো কি করে?
—আম্মা এইটা কেমন কথা বলেন? রশিদ যা করছে তাতে ওরে এমনি এমনি ছাইড়া দেয়া যায় না। শুধু মাত্র আমার বোন জামাই বলেই না রক্ষা পাইলো।ঐ মেয়ের মামা পুলিশে কমপ্লেইন করতে চাইছিলো। আমি বললাম আমার বাড়ির ভিতরের ব্যপার আমি সমাধা করতেছি, পুলিশের ঝামেলায় গেলে শুধু শুধু বদনাম হবে।
—তুমি উইঠা গিয়া দরজাটা লাগাইয়া আস।আর তোমার বৌ যে দরজার বাইরে দাঁড়াইয়া কথা শুনতেছে তারে বল আর যদি কখনো এমন করে আমি সোজা ওর গালে থাপ্পড় বসাইয়া দিমু।
তোফাজ্জল উঠে গিয়ে কাউকে পেলেন না তবে বুঝতে পারলেন এই মাত্র হাজেরা সরে গেলো। দরজা লাগিয়ে আবার এসে বসলেন তোফাজ্জল।
—এই বার বল ঐ মেয়েটার বাড়ি কই? এইখানে কার মাধ্যমে আইছে?
—বাড়ি ময়মনসিংহ।ওর মামা আমার পরিচিত। মেয়েটা এতিম।
এতিম কথাটা বলতে গিয়ে তোফাজ্জলের গলাটা কেঁপে উঠলো।তিনি জানেন তার মা জালেরা অসম্ভব বিদূষী একজন মহিলা। তিনি যেন সবসময় মনের ভেতরটা পড়ে ফেলতে পারেন। তোফাজ্জলের এই মুহূর্তে খুব ভয় হচ্ছে। এই রকম ভয় তিনি অনেক বছর আগে পেয়েছিলেন। তার যেন কেমন দিশেহারা লাগছে। তার মা কেন তাকে এত জেরা করছেন?
—ময়মনসিংহের কই যেন তোমার একটা খামার বাড়ি আছে?
—নাগলা।
—আচ্ছা ঠিক আছে তুমি যাও তাইলে। তোমার না জরুরি কাজ আছে?তুমি এমুন ঘামতাছ কেন?
—আজ মনে হয় গরম খুব বেশি।
—এই রুমে তো এ সি ছাড়ি না। আমার সহ্য হয় না। হাজেরারে বল এক গ্লাস লেবুর শরবত কইরা দিতে।চিনি কম দিয়া।সেই শরবত খাইয়া বাইর হও।
—আচ্ছা ঠিক আছে আম্মা।
তোফাজ্জল যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। কিন্তু তিনি জানেন তার মায়ের মনে নিশ্চই কিছু চলছে।
একটা অজানা ভয় তোফাজ্জল হোসেনকে ঘিরে ধরলো।
হাজেরা মনে হয় এতক্ষণ একটুও বসে নি।কি কথা মা আর ছেলে মিলে এতক্ষণ হলো জানার জন্য অস্থির হয়ে আছেন। তোফাজ্জল বেরিয়ে আসতেই জিজ্ঞেস করলেন-
—আম্মা এতক্ষণ কি নিয়ে আলোচনা করলেন? আমার তো দোষের সীমা নাই।এক মিনিট বসতে পারি না, সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকি কি থেকে আবার কি মাইন্ড করে বসেন।
—তোমার ব্যপারে কিছু বলেননি।তবে তুমি যে লুকিয়ে কথা শুনছিলেন আর একবার এমন করলে আম্মা তোমার গালে কষিয়ে নাকি থাপ্পর দিবেন।
তোফাজ্জল আর দাঁড়ালেন না গট গট করে বেরিয়ে গেলেন। হাজেরা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন জায়গাতেই। তোফাজ্জল থাপ্পরের কথাটা এমনভাবে বললেন যেন হাজেরার গালে সত্যিই একটা থাপ্পর দিয়ে গেলেন।
ঝিমিকে পড়াতে গিয়ে নওমির পাগল হওয়ার অবস্থা। কয়েকদিন আছে পরীক্ষার আর এই মেয়ে তেমন কিছুই পড়েনি।নওমির কাছে এসেই পড়ে ঝিমি। দায়িত্ব নিয়েছে নওমি এখন মানাও করতে পারছে না।আর একটা সমস্যা হলো ঝিমি অনেক বেশি কথা বলে।ওর বয়সের সাথে কথার মিল নেই অনেক পাকা পাকা কথা বলে।এই যেমন পরশুদিন বলল,’আপু তোমার বয়ফ্রেন্ড আছে?কেন নেই? আমাদের ক্লাসের অনেকের বয়ফ্রেন্ড আছে।ওরা কত জায়গায় ঘুরতে যায়।’
নওমি প্রথমে খুব হাসলো ওর কথা শুনে।এক সময় তো সে নিজেও এই বয়সটা পার হয় এসেছে। তার মনেও এমন অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খেতো।কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারতো না।আর বান্ধবীদের সাথে ও এত খোলামেলা ছিল না।সবার মাঝেই একটা লজ্জা কাজ করতো।আর এখন ঝিমি কি সহজভাবে এই সব প্রশ্ন করছে? নওমির হাসি বন্ধ হলে বলেছে,’পড়তে বসলে কথা বলবে না। পড়ার পর আমরা অন্য বিষয় নিয়ে কথা বলবো। আমার কাছে যেই জন্য তোমার আসা সেটা যদি মনোযোগ দিয়ে না কর তাহলে লাভ কি এসে? শুধু শুধু আমার এবং তোমার দু’জনেরই সময় নষ্ট।পড়ায় মনোযোগ না দিলে তোমার মায়ের সাথে কথা বলবো।
‘ঠিক আছে মনোযোগ দিবো প্লিজ মাকে বলবে না। এমনিতেই বাবা মাকে কত কথা শোনায় আমার জন্য মাকে কথা শুনতে হোক সেটা একদম চাই না।’
আজ ঝিমি অনেকটা চুপচাপ।ঠিক করেই পড়া শেষ করলো।তবে একটু বেশিই বিষন্ন মনে হচ্ছে ঝিমিকে আজ।পড়া শেষ করে নওমি বলল-
—কফি খাবে?
—হু খাবো।
কফির মগ হাতে নিয়ে নওমি জিজ্ঞেস করলো-
—কিছু হয়েছে ঝিমি?এত মন খারাপ কেন?মন খারাপ থাকলে এত সুন্দর মুখটা কেমন প্যাঁচার মত দেখা যায়।
ঝিমি এতেও একটুও হাসলো না। হঠাৎ নওমিকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।
চলবে…
#ফাহমিদা_লাইজু
‘