#৫ম_তলার_মেয়েটা
#পর্ব_১৬
আরো ভয়ঙ্কর সাংঘাতিক তথ্য বেরিয়ে এলো ঐ স্যার সম্পর্কে।
প্রথমে আমেনা ম্যাডামকে নিয়ে প্রধান শিক্ষিকার সাথে কথা বলতে বসলো তারা।তিনি অভিযোগ শুনে বললেন,’এটা অবশ্যই জঘন্য অপরাধ।এটা সত্যি হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।সেই স্যারকে খবর পাঠানো হলো অফিস রুমে আসতে।সে তার বিরুদ্ধে কমপ্লেইন শুনে রাগে ফেটে পড়লো। পম্পি মোবাইল বের করে ভিডিও করতে নিলে রাগে মোবাইল কেড়ে নিতে চাইলো।তাকে বলা হলো শান্ত হয়ে কথা বলেন,তা না হলে মিডিয়াতে চলে যাবে আপনার কুকর্ম। ইনভেস্টিগেশন হবে আপনার অতীত এবং বর্তমান চাকরি ক্ষেত্র গুলোতে।’
এই সব শুনে একটু দমে গেল সে।নিজেকে একটু সামলে আবার উঁচু গলায় বলতে লাগল,’আমার বিরুদ্ধে কিছুই পাবেন না,কিছুই প্রমাণ করতে পারবেন না,কোন প্রমাণ নেই।’
পম্পি বলল-,’অন্য সব বাদ দিন,ঝিমির সামনে বলতে পারবেন ওর সাথে অসভ্য আচরণ করেন নি?ক্লাসের মেয়েদের ডেকে জিজ্ঞেস করবো, ওদের গায়ে অকারণে হাত দেন না।’
এবার সে তোতলাতে আরম্ভ করলো। অগোছালো কথা বলতে শুরু করলো।
শফিক প্রধান শিক্ষিকাকে দুই দিন সময় বেঁধে দিলেন এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য।একটা লিখিত অভিযোগ দিয়ে এলেন স্কুলে।
দুইদিন পর আবার সবাই স্কুলে প্রধান শিক্ষিকার অফিস রুমে বসলো কথা বলতে।আজ স্কুল কমিটির লোক জন ও আছে।
প্রধান শিক্ষিকা অনুরোধ করলেন ব্যপারটা বাইরে যেন না যায়। তিনি স্কুলের সম্মানের কথাটাই আগে চিন্তা করলেন।তিনি বললেন ঐ স্যারকে চাকরিচ্যুত করা হবে।মিডিয়াতে যেন এই ঘটনা না আসে।শফিক,পম্পি,নওমি কিছুতেই এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারলো না।এমন ঘটনার জন্য শুধু চাকরিচ্যুতি!পরে আবার অন্য কোথাও চাকরিতে ঢুকে আবার একই অপকর্ম করবে।এরা সব জায়গাতেই বিপদজনক। এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি অবশ্যই দিতে হবে।
পম্পি বলল-
—আপনার স্কুলের রেপুটেশানটাই বড় হলো এত এত মেয়েদের হ্যারেজমেন্টের কথা একবার ও চিন্তা করবেন না।সরি ম্যাডাম আপনার রিকোয়েস্ট রাখতে পারছি না।
শফিক বললেন-
—আমার মেয়ের সাথে করা অন্যায়ের শাস্তি অবশ্যই পেতে হবে ওকে।এমনি এমনি ছেড়ে দিবো না কিছুতেই।
স্কুল কমিটির একজন লোক বলল-
—এটা নিয়ে এত বাড়াবাড়ি কেন করছেন কেন আপনার মেয়ের তো রেপ হয় নি।
শফিক আর নিজেকে সংযত রাখতে পারলেন না, ঐ লোকের করার চেপে ধরলেন দুই হাতে আর বলতে লাগলেন-
—কত বড় কথা বলিশ?তোকে খুনই করে ফেলবো।কত বড় সাহস এমন ওয়ার্ড ইউয়ুজ করিস?
সবাই শফিককে ছাড়ালেন।শফিক রাগে কাঁপতে লাগলেন।
পম্পি বলল-
—আঙ্কেল ওঁরা এমনি মানবে না।এখনি পুলিশকে আসতে বলি।ওরাই ব্যপারটা হেন্ডেল করবে।
—তাই বল।পুলিশই আসুক।
এর পর আর স্কুলের কারো কথাই শোনা হলো না।
আগে থেকেই কথা বলে রাখা পুলিশ এসে ঐ স্যারকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেল।স্কুলের সব স্টুডেন্ট, টিচার সবার সামনে দিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় মুখ লুকানোর আর জায়গা পেলো না।
পুলিশের ইনভেস্টিগেশনে বেরিয়ে এলো ঐ স্যারের সব অপকর্ম।এর আগে গ্রাম শহর মিলিয়ে আরো চারটা স্কুলে চাকরি করে এসেছে।এই ধরনের অপকর্মের জন্য চাকরিচ্যুত হয়েছে।তবে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ঘটনাটায় ও ঐ শয়তানের বিরুদ্ধে কোন আইনি ব্যবস্থা নেয়নি ভিকটিমের পরিবার এতে সবাই অবাক হলো।দুই বছর আগে কোচিং করানোর পরে,সব ছাত্রীকে ছুটি দিয়ে একটা ক্লাস এইট এর ছাত্রীকে রেপ করেছিল এই জঘন্য শয়তান।ঐ ভিকটিমের পরিবার আইনের আশ্রয় নেয়নি স্কুল কর্তৃপক্ষ আর এই শয়তানের দাপটে।
অনেক আগেই যদি কোন ভিকটিমের পরিবার সাহস করে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিত তাহলে এর এত বার বারতো না।
একে একে সব ভিকটিমের পরিবার এক হতে লাগল।এই ঘটনা মিডিয়াতে ছড়িয়ে গেলো।
লাখ লাখ কমেন্ট আসতে লাগল ঐ টিচারের বিচারের দাবিতে।
পম্পিকে কাজের মেয়ে এসে খবর দিল একটা মহিলা তার সাথে দেখা করতে এসেছে। কে হতে পারে এই মহিলা পম্পি কোনো ধারনাই করতে পারল না।
পম্পি লিভিং রুমে এসে দেখে একটা মহিলা পাঁচ কিংবা ছয় বছরের বাচ্চাকে নিয়ে বসে আছে। মহিলার গড়ন মাঝারি ধরনের বয়স বোঝা যাচ্ছে না তবে অসম্ভব সুন্দরী মহিলা।
পম্পি বলল-
—আমি আপনাকে চিনতে পারছিনা। বিশেষ কোনো কাজে এসেছেন আমার কাছে?
—আমি ওই টিচার এর হতভাগ্য স্ত্রী জান্নাত।
পম্পি এই কথা শুনে দাঁড়িয়ে গেল। সে বলল-
—আমার কাছে সুপারিশ করে কোন লাভ হবে না, কিছুই করতে পারবো না আমি।
জান্নাত খুব নির্লিপ্তভাবে বলল-
—আমি কোন সুপারিশ করতে আসিনি। বরং আপনাকে ধন্যবাদ দিতে এসেছি। বিবাহিত জীবনের ছয় বছরে আমি অতিষ্ট হয়ে গেছি। কিছুই করতে পারিনি তার সব অপকর্ম জেনেও। মুখ বুজে আমাকে সবকিছু সহ্য করতে হয়েছে। এতদিনে আমি মুক্তির একটা পথ পেয়েছি।
পম্পি জান্নাতের দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছেনা। অদ্ভুত সুন্দর সে।এখন মনে হচ্ছে জান্নাতের বয়স পম্পির বয়সের কাছাকাছিই হবে।ছেলেটা দেখতে অনেকটা মায়ের মত হয়েছে।
জান্নাত বলল-
—আপনার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারি?
—অবশ্যই পারেন। তাহলে আমরা চা খেতে খেতে কথা বলি । চা খেতে সমস্যা নেই তো?
—না সমস্যা নেই।
পম্পি চায়ের কথা বলে আবার এসে বসলো।
—আপনি আসলে কি বলতে চান বুঝতে পারছি না।
—আপনাকে আমার জীবনের গল্প বলবো।
—আমাকে কেন বলবেন?
—আপনার জন্যই সবকিছু ভালো হচ্ছে। আমার জীবনের গল্পটা শুনতে আপনার খারাপ লাগবে না। কম বয়সে কিভাবে মেয়েরা ফাঁদে পড়ে সেটাও জানতে পারবেন ।
—আচ্ছা ঠিক আছে বলুন, আমি শুনছি।
—সে আমার প্রাইভেট টিচার ছিল। একসময় আমাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।বয়স কম ছিল আমার। তার লোলুপ দৃষ্টিটাকেই আমি প্রেম ভেবেছিলাম।সম্পর্ক এক সময় মন থেকে শরীরের দিকে এগোতে লাগলো। তখন এমন অবস্থা যে তাকে ছাড়া আমি কিছুতেই বাঁচবো না।
সে যা বলে আমি তাই পালন করি। আমাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক ও গড়ে উঠলো।একদিন আমার মায়ের চোখে ধরা পড়ে গেলাম। সমাজ সংসারের ভয়ে ভীত হয়ে পড়লেন তারা।তারা কিছুতেই এই ছেলের সাথে আমাকে বিয়ে দিবে না।আমি মিথ্যে করে বললাম আমি প্রেগনেন্ট। যে কোন উপায়ে তাকে আমি চাইছিলাম তার জন্য অন্ধ হয়ে গেলাম।তাকে বলা হলো বিয়ের কথা কিন্তু সে এড়িয়ে যেতে চাইলো সব কিছু।বাবা বললেন, অবশ্যই বিয়ে করতে হবে।সে জানিয়েছিল তার বাবা মা নেই।তাই তার সাথেই আলাপ করে বিয়ের দিন ঠিক করা হলো। কিন্তু সে আর আসেনা। অনেক অপেক্ষার পর বাবা তার মেসে লোক পাঠিয়ে তাকে একপ্রকার উঠিয়ে নিয়ে এলেন এবং আমার সাথে বিয়ে পড়িয়ে দিলেন।বিয়ের পর আমাদের বাড়িতেই থাকতে লাগলাম।আমি যেন হাতে চাঁদ পেলাম।
কিন্তু বিয়ে হওয়ার পর তার মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ্য করতে লাগলাম।আমাকে আগের মতো সময় দেয় না।একটা কেমন ছাড়া ছাড়া ভাব। এক সময় জানতে পারলাম তার বাবা-মা বেঁচে আছে। তাদের সাথে আমার বাবা যোগাযোগ করলেন। আনুষ্ঠানিকভাবে আমাকে উঠিয়ে দিলেন শ্বশুরবাড়িতে। প্রথম দিনে শাশুড়ি আমাকে বললেন,’খুব বড় ভুল করে ফেলছ মা।’ওই সময় তাঁর এই কথার মানে বুঝতে পারিনি। কিছুদিন পর থেকে সব কিছু বুঝতে পারলাম। নিজের পায়ে নিজে কুড়াল দেয়া আমার আর কিছুই করার ছিলনা। সম্পর্ক ছিন্ন করে বাবা-মার কাছে যাওয়ার ও আমার মুখ ছিল না।
একটা সময় আমাদের এই ছেলে হলো। ভাবলাম সন্তানকে দেখে সে ঠিক হয়ে যাবে। কিছুতেই কিছু হলো না। আমি প্রতিদিন আগুনে জ্বলতে লাগলাম।
বিভিন্ন জায়গায় আমার ছেলেটাকে মানুষ আঙ্গুল তুলে দেখায় ওই যে দেখা যাচ্ছে ওই টিচারের ছেলে।ঐ যে দেখ ঐ লুচ্চার বৌ যায়।এত দিন আড়ালে আড়ালে বলেছে এখন সরাসরি বলবে।
এই বলতে বলতে জান্নাত কেঁদে ফেলল।
পম্পি মনোযোগ দিয়ে কথা শুনছিলো। হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে বলল-
—বাচ্চাটার সামনে এত কিছু বলা ঠিক হচ্ছে না। আমরা মনে করি বাচ্চারা কিছু বুঝতে পারে না আসলে ওরা সব কিছুই বুঝতে পারে। এসব কথায় ওর মনে অনেক বড় এফেক্ট পড়তে পারে।
—ও কিছু শুনতে পারবে না।
—শুনতে পারবে না মানে?
— আল্লাহ সব কিছুই যেন ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ওর বাবার লুচ্চামির কথা ওর কানে যেন না পৌঁছায় এইজন্য আল্লাহ ওর শ্রবণশক্তি দেন নাই। ও কিছুই শুনতে পারে না কথাও বলতে পারেনা। ইদানিং কিছু সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ শিখছে।
পম্পি হতবাগ হয়ে গেলো।এত সুন্দর মায়াবী বাচ্চাটা কানে শোনে না কথা বলতে পারেনা কি আশ্চর্য বিষয়! পম্পির মনটা কষ্টে ভারী হয়ে গেল।
অনেক আগেই চা চলে এসেছে।সেদিকে কারো খেয়াল নেই। চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
জান্নাত আবার বলতে শুরু করলো-
—এমন অসম্মানের জীবন পাওয়ার জন্য কি আমি দায়ী? কেন আমার জীবনটা এমন হলো? চিন্তা করছি অনেক দূরে কোথাও চলে যাব ছেলেকে নিয়ে, যেখানে কেউ আমাদেরকে চিনবে না । আমাদের নিজেদের মতো আমরা থাকতে পারবো শুধুমাত্র আমাদের পরিচয়ে।
গতকাল আমার বাবা আমাদেরকে নিয়ে এসেছেন বাবার বাসায়। ওখানে চারপাশের মানুষের কথাবার্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। তবুও বাবাকে বলিনি আমাকে নিয়ে যাও । মা-বাবা মনে হয় সন্তানের কথা আগেই বুঝে ফেলে।
আগামীকাল গিয়ে জেলে দেখা করে আসবো তার সাথে আর বলে আসবো খুব তাড়াতাড়ি তার কাছে ডিভোর্স লেটার পৌঁছে যাবে।
রজনী এসে দাঁড়ালো।পম্পিকে উদ্দেশ্য করে বলল-
—তোমাদের চা তো ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
পম্পি বলল-
—বসো খালামণি। জান্নাত আপনি চা নিন।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও জান্নাত হাত বাড়িয়ে চা নিল।
রজনী জিজ্ঞেস করলো-
—কি নাম বাবুর?
—জারিফ।
—খুব সুন্দর নাম।মায়ের নামের সাথে মিলানো নাম।এত শান্ত জারিফ। খুব লক্ষ্মী বাচ্চা আপনার।
দুইটা বড় চকলেটবার জারিফের হাতে দিল রজনী।পম্পি চকলেট খেতে খুব পছন্দ করে তাই ওর বাবা অনেক চকলেট এনে রাখে বাসায়।
—আসলেই খুব লক্ষ্মী আমার বাবাটা।আমরা তাহলে আসি।আপনাদের অনেক সময় নষ্ট করলাম সেজন্য দুঃখিত।
জান্নাত , জারিফের হাত ধরে যেতে লাগলো।
পম্পি পেছন থেকে জিজ্ঞেস করলো-
—আচ্ছা আপনি আমার ঠিকানা পেলেন কোথায়?
জান্নাত ঘাড় ঘুরিয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল-
—আপনার বাসার ঠিকানা পাওয়া এখন কোন ব্যপার হলো?
চলবে…
#ফাহমিদা_লাইজু