#৫ম_তলার_মেয়েটা
#পর্ব_১৮
নওমিকে ডাইনিং টেবিলে দেখে তোফাজ্জল হোসেন চমকে গেলেন। ব্যপারটা এতটাই অপ্রত্যাশিত যে তোফাজ্জল দাঁড়িয়েই রইলেন যতক্ষণ না তাঁর মা তাঁকে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আসতে তাড়া দিলেন।নওমি, তোফাজ্জলকে দেখে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।দাদু ওকে বসতে এবং খেতে শুরু করতে বললেন।
এত খাবারের আইটেম করা হয়েছে যে, নওমি বুঝতে পারছে না কোনটা দিয়ে শুরু করবে। মনে মনে তার কান্নাও পাচ্ছে। এতটা আদর করে খাওয়ায় শুধু রজনী। পম্পিদের বাসায় গেলে টেবিল ভর্তি করে খাবার দেয় রজনী। সব গুলো আইটেম থেকেই খেতে হয়। রজনী বসে থেকে খুব আদর করে খাওয়ায়।যেটা জীবনে কারো কাছ থেকে নওমি পায়নি। পম্পি তার বান্ধবী আর রজনী, পম্পির সৎ মা হলেও এখন তাদের বান্ধবী।সেই ব্যপারটা আলাদা।
কিন্তু আজ এখানে এমন অবস্থা দেখে তার কান্না পাচ্ছে। তাকে উদ্দেশ্য করেও কেউ এত আয়োজন করতে পারে এটা বিশ্বাস হচ্ছে না। খাওয়াটাই বড় কথা না, এখানে যে ভালবাসা মিশে আছে সেটারও গন্ধ পাচ্ছে নওমি।
তোফাজ্জল বাসায় কখন আসবেন তার ঠিক থাকে না।আজ তাঁর মা জালেরা বেগম কল করে,রাত নয়টার মধ্যে চলে আসতে বলেছিলেন তোফাজ্জলকে।
তোফাজ্জল হোসেন এসে বসলেন টেবিলে। তিনি হেসে জিজ্ঞেস করলেন-
—বাহ্ বিরাট আয়োজন! আজকে বিশেষ কিছু আম্মা?
—বিশেষ তো অবশ্যই। তোর ঘরেতো মাইয়া হইল না, দুই ছেলে তাও আবার বিদেশ পইড়া আছে। এখন এইখানে আমি এই নাতনিরে পাইছি। এই উপলক্ষেই এই সামান্য আয়োজন।
তোফাজ্জল হোসেন কিছু ভাবতে লাগলেন। তার মা আসলে কি করতে চাইছে সেটার ধারণাও করতে পারছেন না তিনি। অন্য কেউ হলে লোক লাগিয়ে যে কোনো খবর হোক বের করে ফেলতে পারতেন খুব অনায়াসে। কিন্তু তার মায়ের মনে কি চলছে সেটার ধারণাও এই পৃথিবীর কেউ করতে পারবে না। সবচেয়ে বড় কথা এত এত মানুষের চোখ দেখে মনের কথা বুঝতে পারলেও তার মায়ের মনের কথা কোনদিন বুঝতে পারেননি। গভীর চিন্তায় তার কপালে ভাঁজ পড়ে গেল।
তোফাজ্জল খাবার সামনে নিয়ে বসে আছেন দেখে মা তাড়া দিলেন খেতে। এটাও বললেন, খাবার সামনে নিয়ে বসে থাকতে হয় না।
তোফাজ্জল তার আম্মাকে কিভাবে বোঝাবে তার ভেতরে কি ঝড় বইছে।যদিও তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন নরমাল থাকতে।এখন তার কাছে ছোট্ট বেলার মত মনে হচ্ছে। ছোট্ট বেলায় কোন অন্যায় করে ফেললে,আম্মার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখার পর আম্মা জবাবদিহিতার জন্য যখন সামনে দাঁড় করিয়ে রাখতেন, ঠিক তেমন অনুভূতি হচ্ছে। আবার তার ছোট্ট হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। তখন আম্মা শাসনের পরে আবার বুকে জড়িয়ে বলতেন, দ্বিতীয়বার যেন এমন না হয়। এখন এই বয়সে কোন অন্যায় তো আর ক্ষমা করে দিতে পারবে না। আর বুকে জড়িয়ে বলতেও পারবেন না, এমনটা যেন না হয়।তিনি এখন যে পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আছেন এটা কোন অন্যায় নয় বরং জীবনের অনেক বড় একটা ভুল।
এর মধ্যে দুইটা আইটেম জালেরা বেগম নিজে তৈরি করেছেন- একটা হলো পটলের দোড়মা আর একটা হলো ফলি মাছের কোপ্তা।
প্রতি সপ্তাহে মাছের আরত থেকে বিভিন্ন রকমের মাছ আসে এই বাড়িতে।এখন তোফাজ্জলের মা আছেন তাই তিনি যেই সব মাছ খেতে পছন্দ করেন সব আনিয়ে রাখেন।তিনি মাংস খেতে বেশি পছন্দ করেন না।
তোফাজ্জলের স্ত্রী হাজেরা বললেন-
—নওমি এই দোড়মা আর কোপ্তা অবশ্যই খাবে।আজ অনেক বছর পরে আম্মা আমার রান্না ঘরে ঢুকে এই দুই আইটেম রান্না করেছেন,শুধু তোমার জন্য।
এই কথা শুনে তোফাজ্জল খুশি হয়ে বলে উঠলেন-
—তাই নাকি !এই গুলোই আগে খাবো। আমার খুব পছন্দের।আগে আম্মা আমার জন্য প্রায়ই করতেন মাছের কোপ্তা।আম্মা মনে আছে আপনার?
—মনে আবার থাকবো না?খাওন নিয়া সবচাইতে বেশি জ্বালাইছস তুই। খাওয়া পছন্দ না হইলেই খাইবি না কইতি।তাই তোর পছন্দ মতো রানতে চেষ্টা করতাম।
তোফাজ্জল আবার ভাবনার রাজ্যে ডুব দিলেন। নওমির মা নিরার ও রান্নার হাত খুব ভালো ছিল।সব সময় আরো ভালো রান্না করতে চেষ্টা করতো। তোফাজ্জল যখন রান্নার প্রশংসা করতেন তখন নিরার চোখ জ্বলে জ্বল করে উঠতো খুশিতে।
জালেরা বেগম এখানে বসে আছেন ঠিকই কিন্তু তার মন চলে গিয়েছে সেই সময়ে, যখন তার শাশুড়ি এই সব রান্না তাঁকে ধরে ধরে শিখিয়েছিলেন।আর প্রত্যেকটা রান্না প্রথমবার করার পরে, খেয়ে বলতেন,’খুব সোয়াদ অইছে বৌ।’
আহ কিভাবে সময় চলে যায়!মনে হয় এই তো সেই দিনের কথা। তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথেই সব কিছুই শেষ,এই পৃথিবীর সব কিছুর সাথেই সম্পর্ক শেষ!আজ তিনি মরে গেলেও তাই হবে।আজ তিনি তাঁর শাশুড়িকে মনে করে কষ্ট পাচ্ছেন কিন্তু তাঁর ছেলের বৌয়েরা তাঁকে এভাবে মনেই করবে না হয়তো। বেঁচে থাকতেই দেখছেন বৌরা তাঁকে কতটা পছন্দ করে!এর জন্য কি তিনি দায়ী?সব সময় চেয়েছেন বৌরা সব কিছু ভালো করে করুক নিয়মমতো চলুক এই সব চাওয়া কি খুব অন্যায় ছিল?বিয়ের পরে বৌ নিয়ে সব ছেলেরা দূরে দূরে চলে গেল।এতে অবশ্য ছেলেদের দোষ নেই।যার যার কর্মস্থলে তো বৌকে নিয়ে থাকবেই।যখন ওরা বাড়ি যায় কিংবা তিনি ছেলেদের বাড়িতে আসেন তার মন টেকে না।দম বন্ধ লাগে , আশপাশের ওদেরকে দূরের মানুষ মনে হয়।
নওমির গলায় খাবার যেন আটকে যাচ্ছে। সবার সামনে খেতে তার খুব লজ্জাও লাগছে। সারাজীবন নিজেকে গুটিয়ে রাখতে রাখতে একটা জড়তা সব সময় কাজ করে। পম্পির সাথে মিশে তবুও অনেকটা সহজ হতে শিখেছে।তবে সেটাও নির্দিষ্ট একটা গন্ডির ভেতরে। বাড়িওয়ালা এবং তার পরিবার অবশ্যই এই গন্ডির বাইরে।
তোফাজ্জল আড়চোখে বার বার নওমিকে দেখছেন আর দীর্ঘশ্বাস গোপন করছেন।কি মায়াবী চেহারা হয়েছে মেয়েটার। কাছে বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিবেন,কত গল্প করবেন সেই সবের কোন সুযোগ নেই।যেই মেয়েটার এই পৃথিবীতে আসার কথাই না সে দিব্যি বসে আছে তার সামনে। নওমির জন্মের খবর তিনি পেয়েছেন নওমির জন্মের উনিশ বছর পরে। তার পর থেকে মেয়েটা তার চোখের সামনেই আছে।কি দুর্ভাগা একটা মেয়ে। কিন্তু এখন তিনি আছেন। কিভাবে নওমির জীবন সুন্দর করা যায় সেটার সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাবেন। বাকিটা ওপরওয়ালার ইচ্ছা। এর মাঝে তার মা জালেরা বেগম কোন ঝামেলা না বাজালেই হয়।তা না হলে সবকিছু ভন্ডুল হয়ে যাবে । তাহলে নওমির জীবনটা আরো দুর্বিষহ হয়ে যেতে পারে। তোফাজ্জল ঠিক করলেন আম্মার সাথে তিনি কথা বলবেন।
বাসায় এসে নওমি তার মামাকে কল দিলো।সব কিছু বলল, কিভাবে যত্ন করে ওকে খাইয়েছে, কিভাবে আদর করে কথা বলেন দাদু,সব কিছু বলল।মামা একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলেন আবার ভয়ও পেলেন, এটা কোন ঝড়ের পূর্বাভাস নয়তো?নওমিকে কিছুই বুঝতে দিলেন না।মুখে মুখে বললেন, খুব ভালো, খুব ভালো।’
এতদিন পর আজ হঠাৎ নওমির খুব আফসোস হতে লাগল তার নিজের একটা পরিবার নেই বলে। কেন সবার সব কিছু থাকতেও তার কিছুই নেই?তার মন ডুকরে উঠলো।এমন সময় মোবাইলে কল এলো। স্ক্রিনে তাশফির নাম ভেসে উঠলো।যেই পর্যন্ত রিসিভ না করবে কল করতেই থাকবে।তাই কল ধরবে না ধরবে না করেও শেষ পর্যন্ত ধরলো।
নওমির ভারি গলা শুনেই তাশফি অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলো-
—কি হয়েছে?কি হয়েছে তোমার কাঁদছ কেন?
—এমনি।
—এমনি মানে কি?বল আমাকে?
—বাড়িওয়ালার বাসায় রাতের খাবারের দাওয়াত ছিল।ওখান থেকে আসার পর থেকে মনটা খারাপ লাগছে।
—কেন?
—সবার পরিবার আছে, আমার কেন একটা পরিবার নেই।এক মামা ছাড়া কারো আদর পাইনি।
—আমাদের পরিবার হবে।তুমি, আমি মিলে পরিবার হবে। আমার আব্বু-আম্মু তোমাকে খুব আদর করবে দেখো।
নওমি চুপ করে আছে দেখে -তাশফি বলল-
—কি হলো বল।
—কিছু না।
—আমি আম্মুর কাছে তোমার কথা বলেছি। তোমার ছবি দেখিয়েছি।আম্মু খুব পছন্দ করেছেন তোমাকে।
—আপনি কি বলে পরিচয় দিয়েছেন আমার?
—আমার পছন্দের মানুষ-এটাই বলেছি আম্মুকে।
তুমি কি ভেবেছ বলবো তুমি আমার গার্লফ্রেন্ড?
—সেটাই ভেবেছিলাম।
—আমার কি মাথা খারাপ। তুমি এখনো বলইনি আমাকে পছন্দ কর কিনা,তাহলে কিভাবে বলি তুমি আমার গার্লফ্রেন্ড?
এবার ও চুপ।এবার দুজনেই চুপ। কিছুক্ষণ পর তাশফি বলল-
—আমি কি তোমাকে ডিস্টার্ব করি? আমার সাথে কথা বলে বিরক্ত হও?
—না তো।
—তাহলে?
—তাহলে কি?
—আমাকে পছন্দ কর?
—আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।
—কথা এড়িয়ে যাচ্ছ কেন?
—যে মনের কথা বোঝে না তার সাথে কথা নেই।
বলেই নওমি কল কেটে দিলো।
কল কেটে গেলে ,তাশফি মোবাইলটা এক হাত দিয়ে বুকে চেপে বসে রইলো। তার মনে হচ্ছিল এই মোবাইলটাই নওমি।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছে নওমি, স্বর্ণা এখন আগের মতো মিশতে চায় না একটু এড়িয়ে চলছে চায়। এই কথাটা স্বর্ণাকে বলার পর ও বলল,’ নওমি তুই ইদানিং আমার কাছে অনেক কথা বলিস না।আর এখন তো তোর প্রাণের বন্ধু হয়েছে পম্পি।যেই পম্পিকে আগে তুই দেখতেই পারতি না।এখন আমার সাথে না মিশলেও হবে তোর।
নওমি একদম অবাক হয়ে গিয়েছিল।আসলেই কি স্বর্ণার কথা ঠিক?স্বর্ণার সঙ্গে প্রথম পরিচয় থাকলেও, ক্যাম্পাসে তার প্রথম ফ্রেন্ড হলেও একটা সূক্ষ্ম দূরত্ব ছিল সবসময়। যেটা পম্পির মাঝে নেই। পম্পি কিভাবে যেন মনের গভীরে ঢুকে যেতে পারে।আর এখন তো রজনী,যার কোন তুলনাই নেই,যে একাধারে মা ,বোন আর বান্ধবীর মতো।
নওমির মামা হোসেনের চোখে ঘুম আসছিল না। তাঁর খুব আদরের বোন ছিল নওমির মা নিরা। বোনটার জন্য কিছুই করতে পারেনি।করতে পারলে হয়তো এভাবে মরতে হতো না নিরাকে।সব কিছুর মূলে ছিল অভাব।নিরা ক্লাস নাইনে উঠতেই বাবা বিয়ে দিয়ে দিলেন।তখন হোসেন কলেজে পড়ে।তার বড় অন্য দুই বোনেরও বিয়ে হয়ে গিয়েছে।তিন মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে যৌতুকের টাকা যোগাড় করতে জমিজমা বিক্রি করতে হয় হোসেনের বাবাকে।নিরাকে টাকা পয়সা, জিনিস বরের চাহিদা অনুযায়ী সব কিছু দেয়া হয়েছিল। বিয়ের কিছুদিন পরেই নিরা বুঝতে পারে তার স্বামী একটা জুয়াখোর। একসময় সব কিছু এভাবেই শেষ হয়ে গেল।আরো যৌতুকের জন্য নিরাকে তার স্বামী বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিল। নিঃশ্ব বাপ কোত্থেকে দিবে?বিয়ের জন্য পড়াশোনা হলো না, কি করবে ভেবে পেলো না ।এত সব সমস্যায় নিরার বাবা হঠাৎ মরে গেলেন।বলা যায় মরে গিয়ে তিনি বেঁচে গেলেন।মা আগেই মারা গিয়েছিলেন।
সংসারে রইলো হোসেন আর নিরা দুই ভাই বোন।
এইচএসসি পাস করা হোসেন চাকরি খুঁজতে লাগলো।একসময় একটা খামারে কাজ জোগাড় হলো হোসেনের।এই বহুমুখী খামারে চাষ হয় মাছ, মুরগী আর গরু পালন করা হয়। অনেক বড় জায়গা জুড়ে এই খামার।আর এখানে মালিকের সময় কাটানোর জন্য খুব সুন্দর করে তৈরি করা হয়েছে খামার বাড়ি।মালিক মাঝে মাঝে আসেন সব কিছু তদারকি করতে।রান্নার জন্য একজন মহিলা আছেন।হঠাৎ সেই মহিলা অসুস্থ হয়ে পড়লে, হোসেনের উপর দায়িত্ব পড়লো রান্নার জন্য একজন মহিলা খুঁজে আনার।সেই মুহূর্তেই প্রয়োজন, কারণ মালিক উপস্থিত।
হোসেনের বাড়ি বেশ খানিকটা দূরে। আশপাশে খোঁজ করেও কাউকে জোগাড় করতে পারলো না হোসেন। হঠাৎই মনে পড়লো বোন নিরার কথা।
বাড়ি পৌঁছে দেখে নিরার স্বামী বেরিয়ে যাচ্ছে। দেখেই মাথায় রক্ত উঠে গেলো হোসেনের।নিরার স্বামী , হোসেনের গালিগালাজ কিছুই গায়ে মাখলো না দাঁত কেলিয়ে হেসে হেসে বেরিয়ে গেলো।
ঘরের ভেতরে নিরা বসে বসে কাঁদছে।হোসেন জানতে পারলো,নিরার স্বামী দুই দিন আগে এসেছে। তার আসল উদ্দেশ্য নিরা আগে বুঝতে না পারলেও পরে বুঝলো।সে এসেছিলো নিরার গায়ের শেষ গয়না কানের রিং জোড়া খুলে নিতে।
চলবে…
#ফাহমিদা_লাইজু