#৫ম_তলার_মেয়েটা
#পর্ব_২০
ভাবীর প্রতিটা কথাই নিরার গায়ে কাঁটা ফুটানোর মত অনুভূতি দেয়।ভালো মুখে সে নিরার সাথে কথাই বলতে পারে না।নিরার কাঁথা সেলাইয়ের কাজ করে যা আয় হতো তা সামান্য হলেও সেটা ছিল তার একটা শক্তি।তাই ভাবী যখন ঐ কাজ ছেড়ে সংসারের কাজ করতে বলে,নিরা রাজি হয় না কাজ ছাড়তে।সে যথেষ্ট কাজ করে সংসারের। সে যদি এই কাঁথা সেলাইয়ের কাজটা ছেড়ে দেয়, তখন দেখা যাবে সংসারের সমস্ত দায়িত্ব তার কাঁধেই চাপবে ।এই নিয়েই চলে ভাবীর কথা,নিরা চুপ করে থাকতে চেষ্টা করে।যখন আর সহ্য হয় না তখন বেরিয়ে যায় বাড়ী থেকে।তখন পেছন থেকে ভাবী বলতে থাকে,’কাউরে খুঁজে নিলেই তো পারস,তাইলে আর আমার গলার কাঁটা হইতে হয় না।’
এই কথা বেশির ভাগ সময় বলে হোসেন বাড়ী না থাকলে।তার পর ও হোসেন অনেক কিছুই জানতে পারে প্রতিবেশীর কাছ থেকে-
‘কি রে হোসেন তোর বৌ কি তোর বইনরে একটু শান্তি দিবো না?কি এমন করছে নিরা যে এমন কইরা কথা শুনায় আর হইছে মাশাআল্লাহ নিরা একটা মানুষ!একটা কথার ও উত্তর দেয় না।কি দিয়া বানাইছে ওরে আল্লায়?
হোসেনের মাথা গরম হয়ে যায়।বৌকে জিজ্ঞেস করলে সব কিছু অস্বীকার করে।বৌ ভাবে নিরা গিয়ে সব কিছু ভাইকে বলেছে। তাই এমনি এমনি কিছুক্ষণ হুমকি ধামকি করে হোসেন শান্ত হয়। নিরা আসলে জিজ্ঞেস করে , নিরা তো উত্তরই দেয় না। প্রতিবার এই ঘটনাই ঘটে।
নওমির খুব অশান্তি লাগে এই সব দেখে। তার খুব খারাপ লাগে তার মাকে আজেবাজে কথা বলে মামি।সে কিছুই করতে পারে না। আবার সহ্য ও করতে পারে না।তার ভেতরটা চুরমার হয়ে যায়।পারা-প্রতিবেশী, শিক্ষকদের সবাই নওমিকে ভালোবাসে তার আচার আচরণ আর ভালো রেজাল্টের কারণে।ক্লাসে তার রোল নং এক অথবা দুই হয়।এই ভালোবাসাই নওমিকে বাড়ীর অশান্তি অনেকটা ভুলিয়ে দেয়।
একদিন নিরার ধৈর্য্যর সমস্ত বাঁধ যেন ভেঙে যায় , সে তার ভাবীর গলা চেপে ধরতে চায় কিন্তু তার রোগা শরীরটাকে এক ধাক্কায় ফেলে দেয় ভাবী। নিরা ছিটকে পরে গিয়ে হাঁপাতে থাকে।ভাবী যেন অগ্নিমূর্তি ধারণ করে।
এবার প্রতিবেশী চাচী এসে দেখে নিরা মাটিতে পরে আছে। তাড়াতাড়ি ওকে উঠিয়ে বসায়।নিরা বসে থাকতেও পারছে না ঠিকমত।ঘরে নিয়ে নিরাকে শুইয়ে দেয় চাচী,পানি খাওয়ায়। ভাবী মনে মনে ভয় পেয়ে যায়।হোসেন এই অবস্থা দেখলে উপায় নেই।চাচী হোসেনের বৌকে কথা শোনাতে থাকে।
নিরার শরীর দিন দিন দূর্বল হয়ে যাচ্ছে। খাওয়ার সময় খোঁটা শুনতে শুনতে গলা দিয়ে খাবার নামতে চায় না।আস্তে আস্তে শরীর শুকিয়ে, ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে নিরার।
হোসেন বাড়ীতে ঢোকার আগেই প্রতিবেশী চাচীর কাছে সব কিছু শুনলো। নিরার কাছে গিয়ে দেখে নিরা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।ওর চোখের কোনে পানি।
হোসেন চলে যেতে পা বাড়ালেই নিরা ডাকলো,
‘ভাইজান।’
‘কেমন লাগতাছে এহন?’
‘ভাল।’
হোসেন ,নিরার পাশে গিয়ে বসলো।
‘তোমারে কিছু কথা কইতে চাইছিলাম।’
‘তোর ভাবীর কথা কইবি?’
‘কখনো ভাবীর নামে তোমার কাছে নালিশ করছি?’
‘সেইটাই তো সমস্যা।সব কিছু তোর মনের মধ্যে চাপা দিয়া রাখস?’
‘নওমির ব্যপারে কথা ছিল।’
‘এত আমতা আমতা করতাছস কেন?যা কইতে চাস কইয়া ফ্যালা।’
‘নওমির বাবা সম্পর্কে।’
‘ঐ অসভ্যের কথা কি আর কইবি?’
‘হায়াত মৌতের তো ঠিক নাই। মরনের আগে তোমারে একটা কথা জানাইয়া যাইতে চাই। কিন্তু কথা দেও এই কথা তুমি ছাড়া আর কেউ যেন জানতে না পারে।আমারে আগে কথা দেও।’
‘কি এমন কথা? আচ্ছা ঠিক আছে কথা দিলাম।’
‘যেই সত্য এত দিন শুধু একমাত্র আমি জানতাম এখন তোমারে কইতেছি,সব কিছু শোনার পর আমারে যেই শাস্তি দিতে চাও তুমি দিও কিন্তু আমার নওমিরে পর কইরা দিও না। আমার জন্য নওমি ক্যান শাস্তি পাইবো?’
‘কি ব্যপার, কি এমন কথা আমারে বল?’
নিরা , হোসেনের হাত ধরে কেঁদে ফেলল,
‘তোফাজ্জল স্যারের কথা মনে আছে?’
‘থাকবোনা আবার? তার টাকা দিয়াই তো আমার দোকান।’
‘নওমি উনার সন্তান।’
‘কি?’
হোসেন উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।
‘মানে কি?আমি তো কিছুই বুঝতে পারতাসি না।’
এর পরে নিরা সব কিছুই বলল হোসেনকে। হোসেন কি বলবে বুঝতে পারছে না।
নিরা আবার বলল,
‘কোন দিন বিশেষ দরকার না পড়লে স্যারের কাছে এই কথা জানাইবা না।উনি তো জানেনই না নওমির কথা।’
এই কথা হজম করার মতো শক্তি হোসেনের ছিল না।সে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো কেমন যেন টলতে টলতে। বারান্দায় বসে পড়লো মাথা নিচু করে।
হোসেনের বৌ এসে সামনে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করল,
‘এতক্ষণ বইনের কাছে আমার বদনাম শুনলা?তো এখন কি শাস্তি দিবা আমারে?
এমনিতেই মাথাটা ভোঁতা হয়ে আছে নিরার কথা শুনে এখন বৌয়ের কথা শুনে মেজাজ সপ্তমে পৌঁছে গেল। বারান্দায় রাখা মাটির কলসটা তুলে একটা আছাড় মারলো হোসেন।সেই শব্দে ভেতর থেকে নিরাও কেঁপে উঠলো আর বৌ একেবারে থ হয়ে গেল।এমন রাগ তো হোসেন কখনো দেখায় না।
হোসেন কোন কথা বলল না,বাড়ী থেকে বেরিয়ে গেলো।ফিরলো অনেক রাতে।বৌ এসে কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলল,
‘আমার তো কোন দোষ ছিল না ,নিরাই তো আমারে মারতে নিছে আগে।’
‘তোমার কথা শুনলে মরা মানুষ ও উইঠা পরবো আর আমার বইন তো একটা জ্যান্ত মানুষ! আমার কপালপোড়া বইন ,ও তোমার চোখের কাঁটা?
ঠিক আছে আইজ থাইকা আলাদা সংসার নিয়া থাক তুমি। আমি আর আমার বইন আলাদা। অন্য কেউ হইলে ঘাড় ধাক্কা দিয়া বাইর কইরা দিত কিন্তু তুমি আমার সন্তানের মা তাই তোমারে সম্মান দেই।’
কয়েকদিন এভাবে চলার পর বৌ হোসেনের কাছে ক্ষমা চাইলো। আবার সবাই একসাথে হলো।নিরা, হোসেনের চোখের দিকে তাকিয়ে আর কথা বলতে পারে না।কি এক অপরাধবোধে ভুগে সে।তবে নিরা খেয়াল করছে হোসেন কি আগের মতো নওমিকে ভালোবাসে নাকি ঘৃণার চোখে দেখছে। কিন্তু সে জানে না, ‘পালার বড় জ্বালা’ । হোসেন, নওমিকে নিজ সন্তানের ভালোবাসা দিয়ে লালনপালন করেছে। জন্মপরিচয় সেই ভালোবাসার উপর চেপে বসতে পারবে না। হোসেনের পিতৃস্নেহ মন নওমির জন্য কানায় কানায় পূর্ণ।কোন কিছুই সেখানে ফাটল সৃষ্টি করতে পারবে না কখনো।
এখন ভাবী নিরাকে আরো গোপনে অত্যাচার করতে লাগল।নিরার শরীর আরো দুর্বল হচ্ছে।সে তেমন কিছুই খেতে পারে না।আসলে খেতেই ইচ্ছে করে না। সারাক্ষণ বমি বমি লাগে,চোখে অন্ধকার দেখে।
নিরার নিজের মৃত্যুর ভয় না করলেও নওমির জন্য ভয় হতে লাগলো।তার অবর্তমানে নওমির কি হবে এই ভয়ে মন আৎকে উঠে।ডাক্তার দেখাবে সেই কথা বলতেও লজ্জা লাগে ভাইকে। এমনিতেই ভাইয়ের ঘাড়ে বসে খাচ্ছে।সে নিজেই বুঝতে পারছে তার শরীরের শক্তি যেন শেষ হয়ে আসছে। একদিন রাতে হোসেন যখন বাইরে বসে ছিল তখন তার আশপাশে কেউ নেই দেখে নিরা এগিয়ে যায় ভাইয়ের কাছে।
‘ভাইজান ঘুমাও নাই যে এখনো?’
‘তুই ও তো ঘুমাস নাই।’
‘ভাইজান আমার নওমিরে তুমি দেইখো। কোনদিন পর কইরো না।আমারে যদি কথা দেও তাইলে মইরা শান্তি পামু।’
‘এত খালি মরণ মরণ করস ক্যান?কিছুই হইবো না তর।’
‘আমারে কথা দেও।’
‘আচ্ছা কথা দিলাম।তুই কি ভাবস?ওরে কোন সময় আলাদা চোখে দেখি?নওমি তো আমারই মেয়ে।’
একদিন নিরাকে তার শ্বশুর বাড়ি থেকে খবর পাঠানো হলো একবার গিয়ে যেন দেখা করে । নিরার স্বামী খুব অসুস্থ।নিজের শরীর এত খারাপ নিয়েও নিরা তার মেয়েকে নিয়ে গেলো।নিরাকে দেখলে খুব একটা বোঝা যায় না তার শারীরিক অবস্থা।গিয়ে দেখলো আসলেই তার স্বামী অসুস্থ , বিছানা থেকে উঠতে পারে না। কিন্তু কি হয়েছে এটা কেউ বলল না।
সবাইকে বাইরে যেতে বলে নিরার স্বামী শুধু নিরার সাথে কথা বলতে চাইলো।
‘তোমারে এক মুহুর্ত ও শান্তি দেই নাই যত দিন আমার কাছে ছিলা।আসলে কাউরেই শান্তি দেই নাই।আরো দুইবার বিয়া করছিলাম কেউ আমার লগে নাই। আমার কোন সন্তান ও নাই। আমারে ক্ষমা কইরো।’
‘ক্ষমা করলাম।’
‘নিরা আর একটা কথা,তুমি সত্যি কইরা কউ তো তোমার মেয়ের বাপ কি আমি?তাইলে আমার ঐ দুই বৌয়ের সন্তান কেন হইলো না?’
নিরা একটা কথাও বলল না।লোকটা আসলেই খুব অসুস্থ যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে,কথা বলছে খুব কষ্টে। এত টুকু বলেই হাঁপিয়ে গেছে।
‘বল আমারে সত্যিটা বল।’
‘কি হইবো জাইনা?’
‘আমার আত্নার শান্তি পাইবো ও যদি আমার সন্তান হয়।’
‘তাইলে জাইনা রাখ তোমার আত্নার শান্তি পাওনের মত খবর আমার কাছে নাই। আমি কিছু শুনাইতে পারবো না।আমি আসি।’
এই বলে নিরা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো নিরা।মেয়ের হাত ধরে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো।কি কারণে তার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পরতে লাগলো বুঝতে পারলো না। তোফাজ্জলকে সে আজও ভুলতে পারেনি।সে দিন নিরা পালিয়ে এসেছিল আসলে নিজের কাছ থেকে নিজেই। তোফাজ্জলের স্ত্রী, সন্তান আছে।তাদের সাথে অন্যায় হোক এটা কখনো চায়নি সে।সে যদি ওখানেই থেকে যেতো তাহলে অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়ে যেতো।সব কিছু ভেবে সেদিন নিজেই দুঃখের সাগরে ভেসে গিয়েছিল তোফাজ্জলের এক চিমটি ভালোবাসা নিয়ে।নওমি যদি কখনো জানতে পারে ওর জন্ম পরিচয় তখন কি তাকে খুব ঘৃণা করবে? তার আদরের নারীছেড়া ধন যদি তাকে ঘৃণা করে তখন কিভাবে বাঁচবে সে এই চিন্তা তাকে গ্রাস করে রেখেছে সবসময়।
চলবে…
#ফাহমিদা_লাইজু