#৫ম_তলার_মেয়েটা
#পর্ব_৩০
একটার পর একটা ছবি দেখছে নওমি কিন্তু বুঝতে পারছে খুব অল্পই।একটা ছবিতে চোখ আটকে গেলো।একটা মেয়ের অবয়ব।অনেকটা রজনীর মতো দেখতে।
পম্পি খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করতে লাগলো ছবি সম্পর্কে। উদ্দেশ্য রজনীকে রাগানো।
—ওরে আল্লাহ,এই লোক তো দেখ খালামনির ফিদা। যাকে বলে প্রকৃত প্রেমিক।
ছবির মেয়েটা অবশ্যই তুমি।নাক,চোখ ,মুখ সব কিছু তোমার মতো।একটা জিনিস ছাড়া, ঠোঁটের নিচের তিলটা শুধু। কিন্তু শিল্পীরা পোর্ট্রেট তৈরি করে, যার পোর্ট্রেট তাকে সামনে বসিয়ে।এই শিল্পী খালামণির এত নিখুঁত পোর্ট্রেট তৈরি করলো কিভাবে?
নওমি বলল-
—শিল্পীর মনে রজনীমণি এমনভাবে বসে আছে যে, সরাসরি তাকে দেখার আর দরকার হয়নি, চোখ বন্ধ করে মন থেকে দেখে নিয়েছে।
রজনী কে একটু চিন্তিত মনে হলো।
তাদের কথায় বাঁধা পড়ল যখন একজন হ্যান্ডসাম লোক কাছে এসে রজনীকে বলল-
—সত্যিই এসেছ?ভেবেছিলাম আসবে না।
—আসবো না ভাবার কি কারণ?
লোকটা একটা ফ্যাকাসে হাসি দিয়ে বলল-
—একদম আগের মতো আছ, তোমার কোন পরিবর্তন হয়নি।
—তোমার কিন্তু বেশ পরিবর্তন হয়েছে।
—কি রকম?
—আগে যেমন ভালো করে কথাই বলতে পারতে না। বেশিরভাগ সময় চুপচাপ থাকতে।এখন তো বেশ কথা বলছ।
—আফসোস, কেন যে তখন কথা বলতে পারতাম না!
রজনী এবার পম্পি আর নওমিকে পরিচয় করিয়ে দিলো-
—সিরাত,এই হলো আমার মেয়ে,আর ও হলো ওর বন্ধু।আর মেয়েরা ও হলো আমার ক্লাসমেট সিরাত।
সিরাতের মুখ হা হয়ে গেলো,পম্পিকে মেয়ে বলে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য। সে শুনেছিল রজনীর বিয়ে হয়েছে একজন বিবাহিত লোকের সাথে। কিন্তু রজনীর স্বামী যে এত বয়স্ক, তার যে এত বড় মেয়ে আছে এটা চিন্তারও বাইরে ছিল।
রজনী খলখলিয়ে হেসে বলল-
—মাছি ঢুকবে তো।মুখটা বন্ধ কর।
পম্পি আর নওমি একে অপরের দিকে তাকিয়ে দুজন দুজনকে বোঝাতে চাইলো ,চল এখান থেকে সরে যাই।
ওরা একটু দূরে গিয়ে ছবি দেখতে লাগলো।
হঠাৎ এখানে পম্পির আব্বুর কণ্ঠ শুনে পম্পি অবাক হয়ে গেল। তাকিয়ে দেখলো রজনীর সামনেই বড় বড় চোখ করে তার আব্বু দাঁড়িয়ে আছে। তাঁদের পাশেই সিরাত দাঁড়িয়ে।নওমি প্রশ্ন করলো ,
—এই সময় আঙ্কেল হঠাৎ এখানে?
পম্পি সেই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এগিয়ে গেলো, যেন নওমির কথা শুনতেই পায়নি। একেবারে আব্বুর সামনে সে-
—আব্বু তুমি এখানে? হোয়াট এ সারপ্রাইজ!
আমি, খালামনি আর নওমি এলাম এই আর্ট এক্সিবিশন দেখতে। তুমি আসবে জানলে তো সবাই একসঙ্গে চলে আসতাম।নওমি, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চাইলেও কিছুটা ঘোলাটে হয়েই গেলো।
সিরাত আর দাঁড়ালো না সেখানে।
পম্পির আব্বু তখনো খুব একটা স্বাভাবিক হলেন না। তার চেহারায় রুষ্টতা এখনও দেখা যাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে রজনী কে সিরাতের সাথে কথা বলতে দেখেই তার বাবা এমন করছে।পম্পির ধারণা হলো তার আব্বুর স্পাই নিশ্চয়ই খবরটা দিয়েছে।
পম্পি ছোটবেলায় খুব একটা বুঝতো না, তার আম্মু লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতো। বড় হলে বুঝতে পারতো তার আম্মুর সাথে তার আব্বু কি পরিমাণ খারাপ ব্যবহার করে। কখনো কখনো বাচ্চাদের সামনেও তার মাকে অনেক কিছু বলতো তার আব্বু। তখন নিজের অপমান এর চাইতে বাচ্চাদের সামনে এসব বলার জন্য আম্মু লজ্জায় মরে যেতো। পম্পির ভাই সব সময় বলতো,’আম্মু আমি বড় হয়ে গেলে তোমাকে আর পম্পিকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবো।’ আম্মু বলতো,’পরেরটা পরে দেখা যাবে, আগে পড়াশোনা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াও, তোমার বোনটাকে সব সময় দেখেশুনে রাখবে, এই দুইটা জিনিসই তোমার কাছে চাওয়া আমার।’
ভাইয়ার পড়াশোনা শেষ হতে হতেই আম্মু শেষ হয়ে গেল। সেই দুঃখ ভাইয়ার মনে এখনো আঘাত করে।আব্বু সব সময় সন্দেহ করতো আম্মুকে। একদিন ছোট খালার সঙ্গে ফোনে আলাপ করার সময়, কথা প্রসঙ্গে আম্মু বলে ফেলেছিল,’এই জীবন অসম্ভব যন্ত্রণার, দুরারোগ্য ব্যাধির চেয়েও যন্ত্রণার। কিছু না করেও সব সময় নিজের চরিত্র সম্পর্কে এমন বাজে আর অশ্লীল কথা শোনতে হয়। মানুষ একসময় সবকিছুতে নাকি অভ্যস্ত হয়ে যায় কিন্তু আমি আজও এই কথা শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হতে পারিনি কেন বলতে পারিস?এখনো মেনে নিতে পারিনি যে, আমি খারাপ আমার চরিত্র খারাপ। আমি যা না কেন তা স্বীকার করবো?’
আম্মু এই সংসার ছেড়ে চলে যেতে না পারলেও কখনো আব্বুর কাছে মাথা নত করে থাকেনি। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকেনি। আম্মুর প্রতিবাদ ছিল অন্যরকম।
একসময় আম্মু আলাদা রুমে থাকতে শুরু করলো। আব্বু কিছু বলতে থাকলে নিজের মত নিজে কাজ করতে থাকতো সেই কথাগুলো কানে গেলেও এমন একটা ভাব দেখাতো, তোমার যা ইচ্ছা বলতে পারো আমার কিছু যায় আসে না। একটা অবজ্ঞাভাব দেখাতো। নিজের মত থাকতে নিজেকে কিছুটা ভালোবাসতে শুরু করেছিল আম্মু তখনই একটা স্ট্রোক আম্মুকে কেড়ে নিলো।
সেদিন পম্পি বাসায় ছিলো না। কিভাবে তার আম্মু উত্তেজিত হয়ে গেল, ব্লাড প্রেসার বেড়ে গেল এবং স্ট্রোক হলো, জানে না , কিছুই জানেনা। বাসার কাজের লোক গুলোও কিছু বলতে পারলো না।
পম্পির ধারণা মোবাইলে তার আব্বু , আম্মুকে এমন কিছু বলেছিল যে, সে সহ্য করতে পারেনি। হয়তো বুকের ভেতর কষ্টের ভার এত বেশি হয়ে গিয়েছিল যে বহন করতে পারেনি।
পম্পির আব্বু বলল,
—তোমাদের দেখা শেষ হলে, এবার যাওয়া যাক।
পম্পি বলল-
—আব্বু আমরা বাইরে কোন ভালো রেস্টুরেন্ট এখন খাবো। এর পরে বাসায় যাবো।আজ আমাদের ভার্সিটি বন্ধ তাই সারাদিনের জন্য আমরা প্ল্যান করে বের হয়েছি। তুমিও কি আমাদের সঙ্গে খাবে?
পম্পির কথাগুলো অনেক জোরালো ছিল। পম্পির আব্বু ভাবলেন এখন মেয়েকে রাগানো ঠিক হবে না।
—ঠিক আছে আমি বাসায় যাচ্ছি , তোমরা খাওয়া শেষ করে আসো।
রজনী এতক্ষণ একটা কথা বলেনি। তার ভয়ের চেয়েও লজ্জা লাগছিল অসম্ভব। সিরাত যা বোঝার বুঝে গেছেছিল।ও আল্লাহ কি লজ্জার ব্যাপার! লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। তার চোখের পানি আর বাঁধা মানতে চাইছে না। পম্পি আরেকটু কাছে এসে রজনীর হাতটা চেপে ধরলো।
—চল খালামনি যাওয়া যাক।
নওমির বাসায় চলে যেতে ইচ্ছে করছিলো কিন্তু পম্পিকে বলার সাহস হলো না। পম্পি এখন খুব রেগে আছে।ওর বাবার উপরে রাগ যেন আর কমছেই না।
রজনীর গলায় যেন খাবার আটকে যাচ্ছে। কিছুতেই খেতে পারছে না।এই ব্যপারটা ওরা দুজনেই খেয়াল করলো।
নওমি কথা বলা শুরু করলো-
—রজনীমণি তুমি আমাকে কত কথা বল,মন ভালো রাখার কথা বল।এখন তুমি এভাবে মন খারাপ করে বসে থাকবে?
পম্পি বলল-
—কোন কিছু ভাবার দরকার নেই,তুমি আমার আব্বুকে ডিভোর্স দিয়ে দাও।এভাবে আর কয় দিন সহ্য করবে? আমার আব্বু তো, খুব ভালো করেই চিনি,কোন দিন ও শোধরাবে না।তুমি মরার আগ পর্যন্ত এ সব করতেই থাকবে। আমার আম্মুকে দেখেছি না।এখন মনে হয় আম্মু মরে গিয়ে বেঁচে গেছে।
—ডিভোর্স দিয়ে কোথায় যাবো,কার কাছে যাবো?
—কেন?সিরাতের কাছে।
রজনী এই কথা শুনে চমকে গেলো।
—কি বলছো এসব?এটা হতেই পারে না। সিরাত আর আমি – এটা কিছুতেই হতে পারে না। আরেকজনের জন্য আমি সিরাতকে নিজে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম একসময়। সেদিন আমি দেখেছিলাম ওর চোখে কি গভীর বিষন্নতা। কিন্তু তখন শুধু দেখেছিলাম, হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে চাইনি কারণ তখন আমি আরেকজনের জন্য এতটাই পাগল, তার জন্য দুনিয়ার সব কিছুই তুচ্ছ।
কিছুদিন আগে আমার বান্ধবীর কাছ থেকে আমার নাম্বার নিয়ে আমার সাথে যোগাযোগ করে সিরাতে।
এখন আমরা নিজেদের ফ্রেন্ড ও ভাবি না জাস্ট পরিচিত হিসেবেই যোগাযোগ।
—আসার আগে কিন্তু বলেছিলেন তোমার ফ্রেন্ডের আর্ট এক্সিবিশন।
—ওটাতো শুধু বলার জন্য বলা। ওরকম বয়সে অনেকেরই একজনের আরেকজনের জন্য ফিলিংস থাকে। সময়ের সাথে সাথে সেগুলো মন থেকে দূর হয়ে যায়।
—তোমার প্রতি সিরাতের কোন সাধারণ ফিলিংস ছিল না। সেটা ছিল সত্যিকারের ভালোবাসা। যেটা এখনো তার মনে বিদ্যমান।
—কি যে বল না যত্তসব ফালতু কথা।
—তুমি নিজের চোখেই তো দেখলে কতটা সুন্দর করে তোমার পোর্ট্রেট করেছে। দেখে মনে হচ্ছিল সত্তিকারের তুমি, শুধু ওই তিলটা ছাড়া।
—এখন আমার মনে পড়লো,ঐ তিলের কাহিনীটা। আমাদের কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সময় ছোট্ট একটা নাটকের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে আমার ছোট্ট একটা চরিত্র ছিল। তখন শাড়ি পড়েছিলাম সাজগোজ করার সময় একটা ফলস তিল দিয়েছিলাম।ওটাই হয়তো ওর মনে আছে।
—তো আর কিছু বলার প্রয়োজন আছে তোমাকে। নিজেই তো প্রমান পেয়ে গেলে।
—কিন্তু আমার পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব না, তোমার বাবাকে ধোঁকা দেয়া।
—ধোঁকা দেয়ার প্রশ্ন আসছে কেন?
—এসব প্রশ্ন এখন একদম বাদ। খেতে এসেছি ভালো করে সবাই খাও।একদম চুপ।
এ সব কথা শুনে নওমি শুধু তাশফির কথাই ভাবছিলো।তাশফিও কি তাকে এতোটা ভালোবাসে? ওর মা-বাবা কখনোই মেনে নেবেন না তাদের এই সম্পর্ক। তখন কি হবে? তাশফি কি করবে?সে কি করবে?তাশফিকে ছাড়া তার জীবন কিভাবে এগিয়ে যাবে?কিছুই জানে না।এখনই এ সব ভাবার দরকার ও নেই।অহেতুক মাথায় চাপ নেয়ার কোন দরকার নেই।
এখন এই সময়টা ওদের সাথে আনন্দে কাটুক, যদিও একটু আগেই একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে গেছে।
তবুও যার যার সমস্যাগুলো কে দূরে রেখে একটু সুখের খোঁজ তো চলতেই থাকবে।
চলবে…
#ফাহমিদা_লাইজু