#৫ম_তলার_মেয়েটা
#পর্ব_৩৪
তাশফি যখন নওমিকে জিজ্ঞেস করলো ‘কি রং এর শাড়ি তোমার পছন্দ’ নওমি কোন উত্তর দিলো না।বিয়ের কথা বলতে থাকলে নওমি একেবারে লজ্জায় লাল হয়ে যায়। ভাগ্যিস তাশফি সামনে নেই, সামনে থাকলে দেখতে পেত নওমির গাল দুটো টমেটোর মত লাল হয়ে গেছে এখন। বিয়ের শাড়ি বলে কথা!
তাশফি বলল-
—কই বললে না তো কি রং এর শাড়ি তোমার পছন্দ?
—তোমার কি রং পছন্দ?
—কি আশ্চর্য! শাড়ি কি আমি পড়বো নাকি? তুমি পড়বে তাই তোমার পছন্দটাই আসল।
—কিন্তু আমার কাছে মনে হয় আমাকে যারা দেখবে তাদের পছন্দটাও তো অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমি তো আর আমাকে দেখবো না।
—তুমি তো দেখি উল্টো কথা বলছো। সব মেয়ে চায় নিজের পছন্দের পোশাক কিনতে ।
—আমি চাই বিয়ের শাড়ি তুমি পছন্দ কর।
তাশফি এই কথা শুনে হাসলো।
—তাহলে আমার পোশাকটা তুমি পছন্দ করবে।
—না,সবাই একসাথে শপিং করার সময়, সবার সামনে আমি নির্লজ্জের মত কিছু বলতে পারব না।
—এটা কেমন কথা?তোমাকে আমি দেখবো, আমাকে কি তুমি দেখবে না?
এই সব আলোচনাতেই এখন বেশির ভাগ সময় নওমি আর তাশফির কেটে যায়।তারা এখন হাওয়ায় ভাসছে।তাদের চোখে শুধুই রঙিন স্বপ্নের আনাগোনা।
আজ দাদু খবর পাঠালেন দোতলায় যেতে।
দাদু বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দুষ্টুমি করতে লাগলেন নওমির সাথে।আসল কথা হলো নওমিকে তিনি গয়না কিনে দিতে চান তাঁর নিজের টাকায়।আর নওমিকে সাথে নিয়ে গিয়ে নওমির পছন্দই কিনতে চান গহনা। নাওনি তার স্বভাব মতোই বললো তার কিছুই লাগবেনা। বেশি বেশি করে শুধু যেন তার জন্য দোয়া করেন।দাদু বললেন, এইটাই তাঁর দোয়া,নওমি মানা করলে তিনি কষ্ট পাবেন। ঠিক হলো বিকেলে বের হবে দাদুর সাথে।
দাদুর সাথে কথা বলতে বলতে তোফাজ্জল হোসেন বাসায় চলে এলেন।দাদু তাকে ডেকে নওমির কাছে বসালেন। তিনি নামাজ পড়তে উঠে গেলেন।
তোফাজ্জলকে দেখলে ইচ্ছে করে বাবা ডাকতে, তাঁকে জড়িয়ে ধরতে। ইচ্ছে করে ছোট বাচ্চাকে যেভাবে বাবারা আদর করে সে রকম আদর পেতে। কিন্তু সেই সব ইচ্ছা তার ভেতরেই গুমরে মরে।
তোফাজ্জল,নওমির সাথে কথা বলতে গেলে যেন কথা খুঁজে পান না।দুই একটা কথার পরে তাই বসেই রইলেন চুপ করে।
কিন্তু কথা না বললেও ভাবনারা তো বিচরণ করতেই থাকে।
নওমির মা নিরা একটা সাধারণ গ্রাম্য মেয়ে হয়েও কিভাবে তার মনে বসে গিয়েছিলো ভাবলে অবাক লাগে।এর আসল কারণ ছিল নিরার সারল্য আর নিঃস্বার্থ মনোভাব।তিনি ভেবেছিলেন সেই রাতের ঘটনায় নিরা ভেবেছে তার সাথে তোফাজ্জল অন্যায় করেছেন এই জন্যই ও চলে গেছে।এই জন্য তাঁর মনে একটা গ্লানি বয়ে বেরিয়েছেন সব সময়। কিন্তু ভুল ভেঙ্গে ছিল নওমির খবর জানার পরে। নিরা কে ভুলতে তাঁর অনেক সময় লেগেছিল,আসলে ভুলতে কি পেরেছিলেন?
মাঝে মাঝে মনে হতো হাজেরার সাথে তিনি অন্যায় করেছেন। কিন্তু নিয়তির কাছে সবাই বড় অসহায়।
তোফাজ্জল ভাবতে লাগলেন –
‘হাজেরা কি আমাকে ক্ষমা করবে?ও কিছুতেই আসবে না।ওর সামনে দাঁড়াবো কোন মুখে?তবে আমাকে তো যেতেই হবে ওর কাছে। ক্ষমা চাইতে হবে।অনেক দিনের অভ্যাসও হয়তো এক সময় ভালোবাসায় রুপ নেয়।
তোফাজ্জল তাকিয়ে রইলেন নওমির দিকে।নওমি তার নিজের মেয়ে,ভাবলে অবাক লাগে।এটাও এক আশ্চর্য বিষয় ও হয়েছে তাঁর নিজের দাদির মতো। তোফাজ্জলের দাদির চেহারা তাঁর সম্পূর্ণ মনে নেই, শুধু একটা আবছা স্মৃতি আছে।
তাঁর মা জালেরা বেগম বলেন এই কথা। তাঁর ভাই,বোন কারো সন্তান দাদির মতো হলো না,বেছে বেছে নওমিই বা কেন এমন হবে? সৃষ্টির রহস্য বোঝা ভার!
তবে নওমি তাঁকে কখনো বাবা বলে সম্বোধন করে না। মেয়েটার এত আত্মসম্মানবোধ তিনি খুব অবাক হয়েছিলেন এই বিষয়টাতেও। জালেরা বেগম বলেছেন ঠিক এমন স্বভাবেরই ছিলেন তোফাজ্জলের দাদি।
নওমি বাবা বলে না এই ব্যপারটা তোফাজ্জলকে কষ্ট দেয় না,এটা তিনি আশাও করেন না। শুধু মনে একটু খচখচ করে।
জালেরা বেগম ঢুকতে ঢুকতে বলতে লাগলেন-
—বাপ-মেয়ের কি কথা শেষ হইছে?কথা শেষ হইলে টেবিলে আস,খাইতে খাইতে কথা কই।
নওমির একটুও খেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু এখন খেতে মানা করা তার পক্ষে সম্ভব না।দাদু এত আদর মাখা কন্ঠে বলেন যে কোন ভাবেই এই ভালোবাসা অগ্রাহ্য করা সম্ভব না। নওমি যে ভালোবাসার বড় কাঙাল। বাবা,দাদু সবার ভালোবাসা সে পেতে চায়।
জালেরা বেগম তীক্ষ্ণ চোখে দেখলেন কাজের লোক কাছে আছে কিনা। তাদের আগেই বলা হয়েছে, কান পেতে কথা শুনতে যেন আশপাশে না থাকে কেউ।ওদের মাধ্যমেই এখান থেকে ওখানে কথা উড়াউড়ি করে।
জালেরা বেগম নওমির বিয়ের প্রসঙ্গ তুললেন আবার। যদি সম্ভব হয় গয়না কেনার সময় তাশফি যেন থাকে।
নওমি বলল,তাশফিকে সে বলে দেখবে।
নওমির মামার বাড়িতে গিয়েছিল তাশফির বাবা-মা। মোটামুটি একটা তারিখ ঠিক ঠাক হয়েছে। নওমির মামা তাশফির বাবাকে বলেছিলেন তোফাজ্জল একটু কথা বলতে চায়। কিন্তু তাশফির বাবা এখনো দেখা করার তারিখ বা সময় জানাননি।এতে অবশ্য নওমি মনে মনে একটু রাগ হয়েছে,কেন তোফাজ্জল নিজেই কথা বলতে চাইলেন তাশফির বাবার সাথে,কি দরকার ছিল?
সময়ের সাথে সাথে দুঃখ কষ্ট গুলো হালকা হয়ে যায়,এক সময় আর অতটা ভারী মনে হয় না কষ্টগুলোকে। মানুষ কখনো ইচ্ছে করে কখনো বা অজান্তেই ভুলে যায় কষ্ট আর তখন হাতড়ে হাতড়ে সুখের স্মৃতিগুলো মনে করে সুখানুভূতি অনুভব করে, পুলকিত হয় ,সেগুলোর কাছে ফিরে ফিরে যেতে চায়।
হাজেরার মনে সেই গভীর দুঃখ অনেকটা কমে গেছে।এখন দুঃখটা অভিমানে রুপ নিয়েছে। ছেলেরা বলেছিলো তাদের কাছে চলে যেতে, কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত যেতে পারেননি।মন সায় দেয়নি। তোফাজ্জল একবারই ফোন দিয়েছিলেন।তখন রাগের স্ফুলিঙ্গ উড়ছিল হাজেরার মনে, কি থেকে কি বলেছেন? ওই সময়ের জন্য সেই সব হয়তো ঠিকই ছিল কিন্তু এখন তার মনে হয় একবার তো আসতে পারতো কথা বলতে পারতো? তার এত বড় একটা অপারেশন হয়েছে মানুষ তো দেখতেও আসে।হাজেরা জানতেন না যে, তোফাজ্জল হসপিটালে গিয়েছিলেন তাকে দেখতে, হাজেরার ভাই হাফিজ দেখা করতে দেয়নি।হাফিজ এখনও হাজেরাকে প্রতিনিয়ত বলে যাচ্ছে দেশের বাইরে চলে যাওয়ার জন্য। এতে অবশ্য তার একটা স্বার্থও আছে। দেশের বাইরে স্যাটেল হলে হাজেরা হয়তো বাবার সম্পত্তি আর চাইবে না। হাফিজ নিজেও প্রচুর সম্পত্তির মালিক তারপরও তার আরো চাই আর চাই। হাজেরা এতদিন ভাইয়ের বাসায় থেকে বুঝতে পারছেন মোটামুটি সবকিছুই। এখানে তিনি খুবই একা। সবাই যার যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তাঁকে সবাই এই পরিবারের মেহমান হিসেবে ভাবছে। নিজের নামে এত টাকা পয়সা থাকলেও এখানে তার কোন দাম নেই। একটা নিঃসঙ্গতা ঘিরে আছে সব সময় তাঁকে। কোন কিছুতে যেন মন বসেনা। এতদিন পরে হিসেব-নিকেশ করতে বসেছেন নিজের জীবনের। তোফাজ্জল কেন অন্য নারীতে আসক্ত হলো এটা কি তার দোষ? সন্তান জন্মের পর সংসার সন্তান নিয়ে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন আলাদা করে স্বামীকে কখনো বুঝতেই চাননি। প্রথম থেকে কোন ব্যাপারেই তাদের মতের মিল ছিল না। কোন কিছু পছন্দ না হলে কিংবা তার মন মতো না হলে তোফাজ্জলের উপরে খুবই রাগারাগি করতেন। একটা সময় সবকিছুর ভার তার ওপর দিয়ে তোফাজ্জল যেন পালিয়ে বাঁচলেন সংসারের দায় থেকে। প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া তাদের মধ্যে কথা হতো না। তবে যত যাই কিছু হোক দিন শেষে সমাজ-সংসারের কাছে তারাই তো তাদের সন্তানের বাবা-মা। ভালোবাসা কাকে বলে তিনি কখনো বোঝেননি । বাবা মা বিয়ে দিয়েছে সংসার করতে হয় তাই করেছেন আলাদা করে কোন কিছু ভাবার অবকাশই ছিল না কিংবা জানতেনই না। এই অবস্থার জন্য হাজেরা কাউকে দোষ দিচ্ছেন না সবকিছুই নিয়তি বলে মেনে নিয়েছেন।
হঠাৎ নিজের রুমে তোফাজ্জলকে ঢুকতে দেখে হাজেরা অবাক হয়ে গেলেন। ড্রইংরুমে না বসে সরাসরি তাঁর রুমে চলে এসেছেন এতে অবাক হওয়ারই কথা।এত বছরের মধ্যে কখনো এমন হয়নি । কেউ তাকে কেন জানালো না?
তোফাজ্জল যেন হাজেরার মনের কথা বুঝে ফেললেন-
—আসলে আমি মানা করেছি তোমাকে খবর দিতে। এখানে বস। আমি তোমার সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই।
—আমার সঙ্গে আবার কি কথা?
হাজেরার অভিমান যেন উপচে পড়ছিল। কিছুতেই তিনি ধরা দেবেন না। আগে মন থেকে তোফাজ্জলকে ক্ষমা চাইতে হবে, সব কিছুর জন্য।
—আমি তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি। তোমাকে ছাড়া তোমার বাসা শূন্য পড়ে আছে। আম্মাও চলে যেতে চাইছেন গ্রামের বাড়িতে। বাড়িতে ঢুকলে মনে হয় প্রাণহীন একটা বাড়ি।
—আমাকে কি দরকার ওই বাড়িতে? ওইটা তোমার বাড়ি। আমি তোমার কে?
আচমকাই তোফাজ্জল, গভীর মমতায় হাজেরার হাত ধরে আরো কাছে নিয়ে এলেন।
—তুমি আমার স্ত্রী, আমার সন্তানদের মা।
—সন্তানদের মা!নওমিও তো তোমার সন্তান।ওকে নিয়েই থাক।
—নওমি আমার সন্তান এই কথা তো আমি অস্বীকার করছি না।সব কিছু জানার পরই তোমাকে জানানোর দরকার ছিল।আমি তোমার কাছে লুকিয়েছি, আমাকে ক্ষমা কর হাজেরা।
আমি মন থেকে তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি।
—আমার হাত ছাড়।আমাকে তো তুমি ভালোবাসা না,তাহলে কেন আমাকে নিতে আসলে?
—তুমিও কি আমাকে ভালবেসেছ?
—সংসারের দরকার সংসার করেছি,আলাদা করে তোমাকে ভালোবাসা দরকার কিংবা বলা দরকার সেই সব তো বুঝিনি।তুমিও তো কখনো কিছু বলনি।
—কিছু বললেই তুমি রাগ হয়ে যেতে।আমাকে কখনো বুঝার চেষ্টাই করনি।আমাকে আলাদা সময় দেয়া দরকার। দুজনের একান্ত কিছু সময় কাটানো দরকার সেই সব বুঝনি কখনো। সন্তানদের দেখাশোনা করবে ঠিক আছে আমিও তো কিছুটা হলেও দেখাশোনা করেছি। কিন্তু জীবনের যৌবনকালকে হেলায় নষ্ট করে দিলে সেই সময় কি আর ফিরে আসে। স্বামী-স্ত্রী যদি দুজন দুজনকে একান্তভাবে কাছে না পায় আস্তে আস্তে দূরত্ব তৈরি হয়।আমি শুধু শারীরিক সম্পর্কের কথাই বলছি না। সারাদিন শেষে বাসায় ফিরে চাইতাম,সব কিছু তোমাকে বলতে।তুমি কাজের কথা বলে চলে যেতে।হয়তো কখনো বিকেলে একসাথে বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে গল্প করা, একটু ঘুরতে যাওয়া,একটু ছাদে হাঁটা , কোন কিছুর জন্যই তোমার সময় হয়নি।
এতদিন পর আর এই সব নিয়ে কথা বাড়াতে চাই না।
আমাকে ক্ষমা কর,চল তোমার বাড়িতে।আমরা আবার নতুন করে শুরু করবো আমাদের অধ্যায়।
চলবে…
#ফাহমিদা_লাইজু