#৫ম_তলার_মেয়েটা
#পর্ব_৪
মোবাইল ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখে নওমি ভাবনায় ডুবে গেল,’আমার মধ্যে এমন কি আছে যে একটা ছেলে এত দিন থেকে পেছনে ঘুরছে?সে কি আসলেই আমাকে ভালোবাসে নাকি সবই অভিনয়?’
নওমি যাকে নিয়ে এত গভীর ভাবনায় মগ্ন হয়ে গেল সেই ছেলেটার নাম তাশফি।নওমির ফ্রেন্ড স্বর্ণার সঙ্গে ভার্সিটিতে এসেছিল তার বড়ভাই তাসফি।স্বর্ণা পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল নওমির সাথে । টুকটাক অল্প কথা হয়েছিল তখন।এর পর ফেসবুকে এড হয় নওমির সাথে।মাঝে মাঝে কিছুক্ষণ চ্যাটিং হতো পড়ালেখা,স্বর্ণা এইসব সম্পর্কে। একদিন হঠাৎ প্রপোজ করে বসে তাশফি। তখন নওমি পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেয় তাশফির সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানো কোনভাবেই সম্ভব না নওমির।
তার পর তাশফির সঙ্গে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় নওমি।
একদিন স্বর্ণা জিজ্ঞেস করে নওমিকে-
—ভাইয়া কি তোর অযোগ্য?কেন তাকে এভোয়েট করছিস?
—না, বরং আমিই তোর ভাইয়ার যোগ্য না।এই ভার্সিটিতে পড়ছি,এত টাকা খরচ হয় ,এটা দেখে ভাবিস না,আমি অনেক টাকা ওয়ালা।জানিসই তো আমার বাবা-মা নেই।
এর পর নিজের সম্পর্কে সব কিছু জানায় সে স্বর্ণাকে।
—ভাইয়া এ সব নিয়ে ভাববে না।সে সত্যিই তোকে ভালোবাসে।
—বাস্তবতা খুব কঠিন। সমাজে নিজের অবস্থা এবং অবস্থান একটা সম্পর্কের জন্য খুব জরুরি।সমানে সমান হলেই আত্নীয়তা সুন্দর হয়।
একটা কথা বলে দেই তোকে, তুই আর কখনো তোর ভাইয়ার কথা আমাকে বলবি না।যদি বলিস তোর সাথে কথা বলবো না।
এর পর স্বর্ণা আর কথা বাড়ায়নি।
এর পর থেকে কয়েকদিন পর পর তাশফি কল দেয় নওমিকে। নওমি কল রিসিভ করে না।মনে মনে তার ভয়ও হয় , তার দূর্বলতা যদি প্রকাশ পেয়ে যায় তাশফির কাছে!
রিকশা থামানোর পরেও নওমি নামছে না দেখে রিকশাওয়ালা বলে-
—মামা আপনের ভার্সিটিতে আইয়া পরছি,এই বার নামেন।আপনে কি খুব বেশি টেনশনে আছেন?মামা টেনশন কইরেন না তো।যা মন চায় করেন।আইজ আছি তো কাইল নাই।
—যার বাবা-মা নেইঞ্জ সে কি ইচ্ছে করলেই সব কাজ করতে পারে মামা?
কখনো কখনো অপরিচিত মানুষের সাথে নিজের মনের কথা বললে মন হালকা হয়ে যায়। পরিচিতদের চাইতে অপরিচিতদের সাথেই বরং নিজের অবস্থা সম্পর্কে বলা যায়।
রিকশাওয়ালা নওমির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে।
নওমি ভাড়া দিতে গেলে বলে-
— মামা ভাড়া দেওন লাগবো না।
—এটা কি বলেন মামা?ভাড়া আপনাকে নিতেই হবে।এত কষ্ট করে এসেছেন।ভাড়া না পেলে চলবে কি করে?
—মা গো বেশী চাহিদা নাই,টেনশন নাই।আমি কামাই আর বৌ ছুটা কাম করে ভালোই চলে আমাগো।পোলাপান দুইটারে ইসকুলে পড়াইতেছি।নিজেরা পড়তে পারি নাই ওরা পইড়া মানুষ হোক।
—মামা তবুও আপনি রাখেন।আপনি টাকা না নিলে আপনার রিকশায় আর কখনো উঠবো না।
ভাড়া থেকে বিশ টাকা নওমিকে ফেরত দিয়ে রিকশাওয়ালা বলল-
—মামা তাইলে এইটা রাখেন।আপনের কাছে বিশ টেকা বেশি ভাড়া চাইছিলাম।এখন আমার নেয্য ভাড়া হইছে।আপনেরে আমিই প্রত্যেক দিন নিয়া আসমু।আমার নাম কুদ্দুস।আপনে যেইহান থাইকা রিকশায় উঠলেন ওইখানেই থাকুম টাইম মত।
—আচ্ছা ঠিক আছে মামা।
নওমি বিশ টাকা নিয়ে হাত দিয়ে বিদায় জানিয়ে গেইট দিয়ে ঢুকলো।মুখে আর কিছু বলতে পারলো না তার চোখ ভিজে যাচ্ছিল,গলা ধরে আসছিলো।মনে মনে ভাবতে ভাবতে ঢুকতে লাগলো ক্যাম্পাসে।’কিছু মানুষের কাছ থেকে মানুষ মনের গহীন থেকে ভালোবাসা পায় যেটা কখনো সে কল্পনাও করতে করে না।হতে পারে সে পেশায় ছোট একজন মানুষ তবুও তার হৃদয়ে এক সমুদ্র স্নেহ ভালোবাসা রয়েছে ।এই দিক থেকে সে বিশাল ধনী হৃদয়ের মালিক।’
নওমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ে তখন তার মা মারা যায়। তখন থেকে একমাত্র মামারই আদর-ভালোবাসা পেয়েছে।কেউ একটু আদর মাখানো কথা বললে তার চোখ ভিজে যায়।মামির কথা সে মনে করতে চায় না।তার মনে হয় মামির জায়গায় তিনি হয়তো ঠিক। নিজের সন্তানদের ভালোভাবে পেট না ভরিয়ে তাকে তো কিছু দিতে পারেন না। নিজের, নিজের স্বামী, সন্তানদের পরিপূর্ণ করে যদি না থাকে তাতে তার দোষ কোথায়?নওমির ভাগ্য খারাপ তাতে মামির দোষ কোথায়?
রোকেয়া বেশিরভাগ সময় নিজের রুমেই কাটাচ্ছেন।সিমি মেয়েটাকে যতটুকু দেখছেন আর অবাক হচ্ছেন, একফোঁটা লজ্জার বালাই নেই। এমনিভাবে ঘুরে বেড়ায় যেন এটা তার অনেক দিনের চেনা জায়গা। খাচ্ছে,দাচ্ছে,ঘুরে বেড়াচ্ছে।রুমি রান্নার কাজে সাহায্য করছে মাকে।দুলি ঘর-দোর গুছায় কিন্তু সিমি পরশের রুমটা পর্যন্ত গোছায় না। পরশের রুম তো এখন তাও রুম।এক অদ্ভুত চরিত্রের মেয়ে সে।
এই সব নিয়ে রোকেয়া, নাঈমের সাথে কথা বলতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত বলতে পারলেন না। কিভাবে যেন তাঁর মনের কথা টের পেয়ে যায় নাঈম।ঠিক এই ব্যপারটা নিয়েই নাঈম কথা তুললেন-
নাঈম বললেন-
—কি ব্যপার রুক্কু তুমি এভাবে চুপচাপ শুয়ে আছ কেন? এখনও মন খারাপ? তুমি স্বভাবিক হও,দেখবে সব কিছুই স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
—আমি ঠিক আছি।
—তোমার সিমিকে পছন্দ হয়নি।কেন পছন্দ হয়নি সেটা বের করতে পেরেছ?
—ওকে পছন্দ না করার অনেক কারণ আছে।আমরা সবাই কোন না কোন কাজ করি।আর ও খাবার শেষে নিজের প্লেটটা পর্যন্ত ধোয় না,নিজের রুমটা পর্যন্ত গোছায় না।কি রকম ফ্যামেলি থেকে এসেছে আল্লাহই জানেন।
—দেখ গিয়ে ওদের বাসায় এই সব কাজ ওরা নিজেরা কখনো করেনি ,হয়তো কাজের জন্য লোক ছিল।ওরা নিজেদের কাজ , দায়িত্ব,কার সাথে কেমন আচরণ করতে হবে এই সব শিখেনি।
তুমি নিজেও তো বলে দেখতে পার,শিখিয়ে নিতে পার।
—এত বড় মেয়েকে বারবার বলে কিভাবে শিখাবো?
—শুরু কর ,হয়ে যাবে।মনে আছে মা প্রথমে সহ্যই করতে পারতেন না তোমাকে। একদিন এত বড় মাছ কাটতে দিলেন তোমাকে।তুমি ধরতেই পারনা দেখে মা কি বলেছিলেন মনে আছে?
—‘আরে এই মাইয়্যা তো দেখি মাছই ধরতে পারে না।কোন দিন কি বাপে বড় মাছ কিই্ন্যা খাওয়ায় নাই?রান্দন বাড়ন কিছুই দেহি পারে না। ও আল্লাহ আমার ছেলেরে না খাওয়াইয়া মাইরা ফেলবো!’
এখনো স্পস্ট মনে আছে।
এই বলে হেসে ফেললেন রোকেয়া।
নাঈম বললেন-
—আমি মাকে কি বলেছিলাম মনে আছে?
—‘ মা, রোকেয়াদের বাড়িতে তিন জন ঘরের কাজের লোক, আর দারোয়ান,ড্রাইভার ও আছে। সব কাজের জন্য লোক আছে ওকে তো কিছুই করতে হয় নি।পারবে কি করে?’এই শুনে মা লাফিয়ে উঠে বলেছিলেন,’ও আল্লাহ তুই তো জমিদারের মেয়েরে বিয়া করছস।তোর মতো ফকিরের লগে থাকবো? দুইদিন পরেই দৌড় দিবো।’
ঘর ভর্তি লোকের সামনে আমার কি যে লজ্জা লাগছিলো তখন!
সেই সব দিন চোখের সামনে ভাসে,মনে হয় এই তো সেই দিনের কথা।
—আর তোমাদের দুজনের চেষ্টাতেই বৌ-শাশুরির সম্পর্কটা সুন্দর হয়ে উঠলো আস্তে আস্তে তাই না?
—ঠিক তাই।
আর কিছু বলার প্রয়োজন হলো না।রোকেয়া
উঠে গেলেন পরশের রুমে।
দুলি দেখলো তার মা পরশের রুমে যাচ্ছে।পরশ রুমে নেই ,বাইরে। কেন তাহলে রোকেয়া যাচ্ছে এই চিন্তায় সে অস্থির হয়ে গেল।রুমিও বাসায় নেই,সে থাকলে তবু পরামর্শ করা যেতো।মনে পড়লো বাবা নিশ্চয় জানবে ব্যপার কি?দুলি বাবার রুমে ঢুকলো।
রোকেয়া পরশের রুমে ঢুকে দেখেন, ফ্লোরে মাথা রেখে খাটের উপরে পাদুটো তুলে নাচাচ্ছে আর মোবাইল স্ক্রলিং করছে সিমি।রোকেয়া এসেছেন এটাও টের পেলো না,এতটাই মগ্ন মোবাইলে। দেখেই মাথাটা গরম হয়ে গেল রোকেয়ার। দাঁতে দাঁত চেপে রাগ দমন করে বললেন-
—তোমার সাথে কিছু কথা আছে।
সিমি হঠাৎ শাশুড়িকে দেখে ভয় পেয়ে গেল যেমনটা ভয় পেতো তার বাবাকে দেখে।
রোকেয়া খাটের উপর বসলেন। কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলেন না,কি বলবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না।পরশের সিঙ্গেল খাটে তো দুজন শোয়া যায় না।এই প্রসঙ্গ দিয়েই কথা শুরু করা যায়-
—এই খাটটা চেঞ্জ করতে হবে। আগামীকাল তোমাকে নিয়ে একটু বের হবো।
—ঠিক আছে আন্টি।
—আন্টি!আন্টি মানে কি?আমাকে তুমি আন্টি বলছো কেন?
—তাহলে কি বলবো?
রাগে রোকেয়ার গা জ্বলে যাচ্ছে। তবুও নিজেকে অনেকটা সামলে নিলেন?
—আমি তোমার কি হই?
—শাশুড়ি।
—এখনো আমারা এতটা মর্ডান হয়নি যে ,ছেলের বৌয়ের মুখে আন্টি শুনবো।মা ডাকবে।কি ডাকবে আমাকে?
—মা বলবো।
সিমির পরিবারের সবার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন রোকেয়া।কথা বলতে বলতে সিমি অনেকটা সহজ হলো।
এর পরে এই পরিবারের সম্পর্কে বললেন। রহিমা এসে ভারি কাজ গুলো করে দিয়ে যায়। আর বাকি কাজ যা আছে , যার যার কাজ নিজেকেই করতে হয়।
এটাও বললেন, ওরা যা করেছে ঠিক করেনি।এভাবে পরিবারকে না জানিয়ে তাদের বিয়ে করা ঠিক হয়নি। পরিবারকে জানালে সবাই মিলে বিয়ের ব্যবস্থা করতেন সময়মত।
সিমি বলল-
—আমার বাবা কখনো আমার পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে দিতেন না।
রোকেয়া যতটুকু বুঝতে পারলেন,সিমির বাবার উপর খুব রাগ।তিনি আর কথা বাড়ালেন না। অথচ রোকেয়ার বাবার সাথে তাঁর সম্পর্কটা ছিলো পৃথিবীর সবচেয়ে মধুরতম সম্পর্ক। রোকেয়ার নিজের বাবার মুখটা ভেসে উঠলো চোখের সামনে।
চলবে…
# ফাহমিদা_লাইজু