#৫ম_তলার_মেয়েটা
#পর্ব_৫
বাড়িওয়ালার বোন জামাই , নওমির পথ রোধ করে দাঁড়ালো।
রাস্তার পাশে লাইটপোস্টে লাইট নেই তাই এই জায়গাটা কিছুটা অন্ধকার। খুব বেশি রাত হয়নি,বলা যায় সন্ধ্যা কিছুক্ষণ আগে বিদায় নিয়েছে।নওমি দোকানে যাচ্ছে পাউরুটি আনার জন্য।সকালে পাউরুটি আর কলা খেয়েই বেশিরভাগ সময় বাসা থেকে বের হয় সে।
হঠাৎ একটা লোককে এভাবে সামনে এসে দাঁড়াতে দেখে খুব ভয় পেলো নওমি।ভাবলো ছিনতাইকারী।
যখন, সেই একই রকমভাবে বিশ্রি হাসি হেসে প্রায় ফিস ফিস করে লোকটা নওমিকে বলল-
—দরজা খোল না কেন?বার বার নক করি,বুঝতে
পার না কিছু?
এটা ছিনতাইকারী না বুঝতে পেরে যতটা না স্বস্তি এলো তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি ভয় তাকে ঘিরে ধরলো লোকটাকে চিনতে পারার পর।গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো নওমির।কারণ এই লোক ছিনতাইকারীর থেকেও ভয়ঙ্কর।
ভয় এবং আতঙ্কে নওমি কোন কথাই বলতে পারছিলো না।
—কি ব্যপার নওমি কোন কথা বলছো না যে।সব রকম সুবিধা পাবে,আমি যেভাবে বলি সেইভাবে চললে।
নিজেকে কিছুটা সামলে নওমি বলল-
—আপনি আমাকে যেমন মেয়ে ভাবছেন আমি তেমন মেয়ে না।
কথা বলতে গিয়ে নওমির গলা কাঁপছে।
—আরে রাখ তো তোমার, যেমন আর তেমন।ঐ সব বুলি প্রথমে সবাই বলে ,এর পরে টাকার গন্ধ পেলে তখন খোলস থেকে বেরিয়ে আসল রুপে আসে। টাকা-পয়সা নিয়ে কোন ঝামেলা হবে না।
—আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন।যা মুখে আসছে বলে যাচ্ছেন!
—এখনো তো কিছুই করিনি,কথা না শুনলে এই বাসা থেকে খুব তাড়াতাড়ি তাড়ানোর ব্যবস্থা করবো,আর এমন অবস্থা করবো এই মুখ আর সমাজে দেখাতে পারবে না।
সত্যি বলছি তোমাকে প্রথম দেখেই আমার মনে ঝড় উঠে গেছে।তোমাকে রানী করে রাখবো।
নওমির কান দিয়ে যেন কথা ঢুকছিল না, তার মনে হচ্ছিল গরম কোন পদার্থ তার কান দিয়ে ঢুকছে। বাসার দিকে দৌড় দিল নওমি।উদভ্রান্তের মত সিঁড়ি দিয়ে উঠলো। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সে কিছুতেই দরজার চাবি লকের ভেতরে লাগাতে পারছে না।ওর কাছে মনে হচ্ছে হিংস্র হায়েনা তাকে তাড়া করেছে,ধরতে পারলেই কামড় বসিয়ে দিবে।
অনেকক্ষণ চেষ্টার পর লক খুলতে পারলো। দরজা লাগিয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়। সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে গেছে। আবার উঠে দরজা টেনে দেখলো ঠিক মত দরজা লেগেছে কিনা। বিছানায় শুয়ে নওমি কাঁপতে লাগলো।
এভাবে কতক্ষণ সময় কেটে গেলো নওমি ধারণা করতে পারলো না।মোবাইলে রিং হতেই বিছানা থেকে ছো মেরে মোবাইলটা হাতে নিল,মনে হচ্ছে কেউ যেন মোবাইলটা ছিনিয়ে নিয়ে যাবে। মোবাইল স্ক্রিনে মামা দেখে তার আত্মায় যেন পানি এলো।
—মামা ..বলেই নওমি হু হু করে অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগলো।
হোসেন একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলেন।কি হয়েছে আদরের ভাগ্নীর ,এই দুঃচিন্তায় তাঁর আত্মা বের হয়ে যেতে চাইলো।
বার বার জিজ্ঞেস করতে লাগলেন-
—মা, আমার কি হইছে বল আমারে। আমি কি এখনই রওনা দিব,বল আমারে,চইলা আসবো? মারে বল আমারে কি হইছে?
নওমির ভেতরে ঝড় কিছুটা কমে আসলে,প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সব কিছু বলল রশিদের সম্পর্কে।
হোসেন রাগে ফেটে পড়লেন রশিদের উপর, পারলে এখনই গলা চেপে ধরেন ।
—তুই আমারে আগেই বলস নাই কেন? কত বড় সাহস ..। গালিগালাজ শুরু করলেন রশিদকে।
নওমি মা আমার, তুই কোন চিন্তা করিস না। আমি সব ব্যবস্থা করতেছি।
—মামা আমার আর পড়তে হবে না।আমি চলে আসি ময়মনসিংহ।মামা তোমার কাছে খুব আসতে ইচ্ছে করছে।আমার খুব একা লাগছে , অসম্ভব ভয় লাগছে।ছোট বেলার মত তুমি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিও।মামা অনেক রাত আমি ঘুমাতে পারি না।
—এমন করিস না মা,একটু শান্ত হইয়া আমার কথা শোন।সব ঠিক করমু আমি।ঐ রশিদ এই বাড়ির আশপাশে আর আসতে পারবো না।তুই একদম চিন্তা করিস না।তোরে অনেক শক্ত হওন লাগবো।মনে রাখিস, সবাই শক্তের ভক্ত নরমের যম।এমন করলে কেমনে চলবে।দুনিয়া খুব কঠিন জায়গা।তোরে শক্ত হইয়া চলতে হইবো।
ভাত খাইছস?
—না
—এখনি খাওয়া শেষ কইরা ঘুম দে।আমার কথা শোন,না শুনলে আমি কইলাম খুব কষ্ট পাবো।
—ঠিক আছে মামা।
—এইবার রাখি তাইলে মা।কাইল সকালে আবার ফোন দিবোনে।
—আচ্ছা।
হোসেন ওখানে বসে কি করবেন নওমি ভেবে পেলো না।তবে কিছুটা আস্বস্ত হলেও পুরোপুরি ভারমুক্ত হতে পারলো না সে।
রোকেয়া, নাঈমকে বললেন-
—সিমির বাবা বড় ভাইয়ার কোম্পানিতে চাকরি করে এই কথা জান?
নাঈম ল্যাপটপ থেকে মুখ না উঠিয়েই উত্তর দিলেন-
—না তো।
রোকেয়া রাগ হয়ে বললেন-
—আমি না বলেছি আমার সাথে কথা বলার সময় অন্যদিকে মনোযোগ দিবে না।
—আমি তো কথা বলছি না,কথা তো বলছো তুমি।
—সব সময় সব কিছু নিয়ে ফাজলামো করবে না তো।কথা শুনলে রাগে গা জ্বলে যায়।
—আচ্ছা ঠিক আছে।এই যে ল্যাবটপ রেখে দিলাম। তোমার ডাগর কালো চোখের দিকে তাকালাম। এবার বল রুক্কু।
—আগে তোমার ঢং করা বন্ধ কর।
এই বলে রোকেয়া উঠে চলে যেতে চাইলে নাঈম রোকেয়ার হাত ধরে ফেললেন।
—আচ্ছা এইবার বল,আমি সিরিয়াস।
রোকেয়া নাঈমের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন।
—তোমার হাসি দেখে আমার হৃদয় জুড়ায় রুক্কু।
—তোমার চেহারার ভাব দেখে হাসি পেলো।যা কর না!
আচ্ছা শোন আত্নীয় স্বজন কেউ জানে না পরশের বিয়ের কথা।জানতে পারলে কেউ কথা শোনাতে ছাড়বে না। একটা রিসেপশন প্রোগ্রাম করলে কেমন হয়?
—সিমির বাবা তো মনে হয় মানবে না।
—এই জন্যই বলছি ভাইয়ার কথা,যদি জানতে পারে কোম্পানির চেয়ারম্যান এর ভাগ্নের সাথে তার মেয়ের বিয়ে হয়েছে, তখন নিশ্চয়ই তাদের আপত্তি থাকবে না।
—আমি চাচ্ছি না।কোন পরিচয় ব্যবহার করে এই সম্পর্ক নরমাল করতে। ছেলে এবং আমার পরিচয় জেনেই যেন ওরা সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
—তোমার পরিচয় জানলেও কি আপত্তি কযতে পারবে? সমস্যা হলো পরশ এখনো পড়াশোনা করছে।সময় হলে সেও ভালো কিছু করবে।
—আরো কিছু দিন যাক।দেখা যাক কি হয়।পরে প্রোগ্রাম করা যাবে।
—কেউ বাসায় এসে সিমিকে দেখলে কি বলবো?
—যেটা সত্যি সেটাই বলবে। আমাদের তো কিছু করার নেই। সন্তান যদি মা-বাবাকে কথা শোনানোর ব্যবস্থা করে,শুনতেই হবে।এই দায়ভার আমাদেরই নিতে হবে।
রোকেয়ার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। তিনি আর কথা বাড়ালেন না।বুঝতে পারলেন উপরে উপরে যতোই দেখাক না কেন নাঈমের মনেও কষ্ট জমে আছে।
রোকেয়ার সাথে সিমির ভালো ব্যবহার করাটা দুলি কিছুতেই মানতে পারছে না। সেই দিন সাথে নিয়ে গিয়ে খাট কিনে দিল!আল্লাদ দেখলে রাগ উঠে যায়।সে এবার ক্লাস নাইনে উঠেছে।তাদের সব জিনিসে সিমির ভাগ বসানোটা মানতে পারলেও তার মায়ের আদরে ভাগ বসানো,কোন ভাবেই মেনে নিবে না দুলি।সে ভাবে তার আপুটাও কেমন। সারাক্ষণ আছে পড়া নিয়ে। সিমির কথা কিছু বললে বলে,’ও তাই,তাতে কি হয়েছে?’ এই সব কথাবার্তা।ভাইটাও একেবারে বেহায়া হয়ে গেছে।বৌকে নিয়ে বাইরে যায়, আর এসে রেডি করা খাবার খায়।কত আরাম।এই সব দেখে রুমিকে বলল-
—আপু তুমি বিয়ে করে ফেল?
—কেন?আমি বিয়ে করবো কেন?
—তাহলে ভাইয়ার মতো তুমিও আনন্দে দিন কাটাবে তোমার স্বামীকে নিয়ে।
—এই সব আনন্দের দরকার নেই।আমি জবে ঢুকে পরে বিয়ে করবো।বাবাকে তো বলেছি এই কথা।বাবাও বলেছেন আমার ইচ্ছে মতোই হবে।
এই যে ওরা বাবার টাকায় চলছে এটা খারাপ দেখায় না?
—আমিও তো তাই বলি আপু।
—হয়েছে বড়দের ব্যপারে তোর কথা বলতে হবে না।
—তাহলে স্বীকার করছ আমি এখনো ছোট আছি।সেই দিন আমাকে যে বললে,’এখন বড় হয়েছিস ঠিক করে ঘুমানোর অভ্যাস কর, আমার গায়ের উপর পা উঠিয়ে দিলে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়।’
—সেই কথা তখনের জন্য ঠিক ছিল।আর এখন যা বললাম, সেটাও ঠিক।তুই এত বড় হয়ে যাসনি যে বড়দের ব্যপারে নাক গলাবি।
—তোমাদের কথাই বুঝতে পারি না।এই বল বড় হয়ে গেছি আবার এই বল ছোট আছি।
এমন সময় সিমি ঢুকলো-
—আপু কি করছো তোমরা?
দুলি মুখ ভেংচি দিয়ে চলে গেলো।
সিমি বসতে বসতে বলল-
—তুমি এত পড়াশোনা কর কিভাবে বল তো? আমি কিছুক্ষণ পড়ার পরেই হাঁপিয়ে যাই।
—এই জন্যই কি বিয়ে করে ফেলেছ?
সিমির মুখটা হঠাৎ কালো হয়ে গেলো।কোন কথা না বলে বেরিয়ে গেলো।
নিজের রুমে যেতেই পরশের চোখে পড়লো সিমির মুখ ভার।
—কি ব্যপার ,কি হয়েছে?
—তোমার বোনদের সাথে গল্প করতে গেলাম।দুলি আমাকে দেখেই ভেংচি কেটে চলে গেল।আর রুমি বলল,’আমি বিয়ে করেছি কেন?’
—তুমি রুমি আপুকে নাম ধরে বলছ কেন?আর কখনো বলবে না।
—আমার সাথে কি করলো সেটা না দেখে,নাম ধরে বললাম কেন তাই নিয়ে পরেছ?
—রুমি আপু এমনিতেই কথা কম বলে। তোমাকে শুধু শুধু কেন এই কথা বলতে যাবে? তুমি কি বলেছিলে?
—আমি বললাম,তুমি এত পড়াশোনা কর কিভাবে?আমি তো একটু পড়লেই হাঁপিয়ে যাই।এই কথা শুনেই বলল,এই জন্যই কি বিয়ে করে ফেলেছ?’
—তাহলে এই কথার খারাপ কি দেখলে?আপু জিজ্ঞেস করতে পারে না, তোমার পড়তে ভালো লাগে না বলেই কি বিয়ে করেছ।
— বোনেরা যা বলবে সেটাই ঠিক, আমার সম্মানের কথা ভাববে না?
—আমাদের বাসায় তোমার সম্মান কেউ নষ্ট করবে না,এই সব বন্ধ না করলে তোমার নিজের সম্মান নিজেই জন্যই নষ্ট হবে। সবার সঙ্গে মিলেমিশে চলার চেষ্টা কর।না হলে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে তোমার সাথে সাথে আমার ও।সবাই আমাকে দুরে সরিয়ে দিবে।এটা আমি সহ্য করতে পারবো না।একটু বোঝার চেষ্টা কর ।
—দুলি আমার সাথে কেমন ব্যবহার করে জান?
—ও তো ছোট মানুষ।
—ঝিমি এমন করলে বাবা মেরে তক্তা বানিয়ে দিতো।
—তুমিও কি মার খেতে নাকি?
সিমি কোন কথা বলল না।
—আচ্ছা ঠিক আছে আমি দুলির কথা মাকে বলবো,মা যেন বুঝিয়ে বলে।
সিমির ভালোই অভিজ্ঞতা আছে মার খাওয়ার ব্যপারে। তার বাবার রাগ উঠলে এমন মারতো যে শরীর অবশ হয়ে যেতো।সেই কথা আর মনে করতে চায় না সিমি।
ঘুম ভাঙ্গতেই গত রাতের সব ঘটনা মনে পড়লো নওমির। তার চোখে শুকিয়ে আছে গত রাতের চোখের পানি। কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে গিয়েছিল মনে করতে পারছে না।রাতে খাওয়া হয়নি,পেট সেটাই জানান দিচ্ছে কিন্তু উঠতে ইচ্ছে করছে না কিছুতেই।রাতে মশারীও টানানো হয়নি।মশারা ইচ্ছে মত কামড়েছে, শরীরে অনেকগুলো মশার কামড়ের দাগ,এখন এইগুলো খুব চুলকাচ্ছে।
আজ আর ভার্সিটিতে যাবেনা।একদম ইচ্ছে করছে না বাইরে বের হতে।সব কিছু বন্ধ রাখলেও,পেটের ভেতরে খাবার দেয়ার কাজ তো আর বন্ধ রাখা যাবে না।
চলবে…
#ফাহমিদা_লাইজু
৪র্থ পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1275491626299195/