৫ম তলার মেয়েটা পর্ব-৮

0
962

#৫ম_তলার_মেয়েটা

#পর্ব_৮

বাসায় এমন একটা থমথমে পরিবেশ যেন পিন পতনের শব্দে কেঁপে উঠবে।তাই যখন ডোর বেল বেজে উঠলো , যেন পুরো বাসায় কম্পন অনুভূত হলো।

দুলি দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে অবাক।দাদুবু বলে জড়িয়ে ধরলো তাদের দাদুকে। চিৎকার করে ডাকতে লাগল-
—মা মা দাদুবু এসেছে।
রোকেয়া দ্রুতপায়ে এসে পা ছুঁয়ে সালাম করলেন।
—আম্মা রাস্তায় কোন কষ্ট হয়নি তো?
—তোমাগো ঢাকায় যা জ্যাম , এইটাই তো অসহ্য।
এ ছাড়া আর কোন সমস্যা হয় নাই।আর সবাই কই?
—আম্মা ওরা সব বাইরে।আপনি ফ্রেশ হয়ে,খেয়ে বিশ্রাম করেন।
দুলি মুখ গোমড়া করে বলল-
—মা তোমরা জানতে দাদুবু আসবে?আমাকে এক বার ও জানাওনি।
—আরে দাদু রাগ করে না। হঠাৎ কইরাই আসতে হইলো।
এবার দাদু পেছনে তাকিয়ে বললেন-
—কিরে আকাশ ভিতরে আসস না ক্যান?

লম্বা ছিপছিপে আকাশ লাজুক মুখে ভেতরে ঢুকে সালাম দিলো।

—নাঈম বলল,সে নিজেই যাবে আমারে আনতে।বল তো নাঈমের এত কাজ ফেলাইয়া যাওনের কি দরকার?নাঈমরে বললাম গাড়ি তো পাঠাইবাই ড্রাইভার তো থাকবোই একলাই আসি।ও কিছুতেই রাজি হইলো না। তখন নাঈমরে বললাম তোর আসার দরকার নাই আমি আকাশরে নিয়া আসতাসি।

—আকাশরে তো তোমরা চিনই , বাবলুর ছেলে। খুব ভালো ছাত্র।ওর আবার কলেজ খোলা,কালকেই চইলা যাইবো।
—আম্মা কোন সমস্যা নেই।ওর কোন সমস্যা না থাকলে, ঢাকায় থেকে বেরিয়ে যাক কয়েকদিন। আকাশ চল ফ্রেশ হয়ে নাও।এই নিয়ে পরে কথা হবে।

হালকা গরম পানিতে লেবুর রস মিশিয়ে নিয়ে এলেন রোকেয়া।
—তুমি কক্খোনো ভুইলা যাও না, আমার কিসের পরে কি দরকার। দুপুরে খাওনের পরে আমি লেবু পানি খাই ,খাওয়া শেষ কইরা রুমে ঢুকতে টুকতেই মগ নিয়া হাজির। তোমার কাছে যে সেবা যত্ন পাই তুমিও তোমার ছেলের বৌয়ের কাছ থাইকা এমুন সেবা যত্ন পাইবা।

দুলি মুখ ভেংচি দিয়ে বলল-
—দাদুবু তোমার এই দোয়া কবুল হবে না।এক গ্লাস পানি ঢেলেও খায় না, তোমার নাতি বৌ সিমি। এখনই আলাদা বাসায় যেতে চায় আর সে করবে মায়ের সেবা।

রোকেয়া রাগি চোখে তাকালেন দুলির দিকে। বোঝাতে চাইলেন কেন এ সব কথা দাদুকে বলছে?

দুলির দাদু রোকেয়ার দিকে তাকালেন। তিনি তাকিয়ে কিছু বোঝার চেষ্টা করলেন।আরো দুই ছেলে ঢাকায় থাকলেও তিনি ঢাকায় আসলে সবসময় এই বাসাতেই থাকেন। রোকেয়ার কাছে থাকলে তাঁর শান্তি লাগে আর কোথাও গেলে সেই শান্তি তিনি পান না।অন্য বৌয়েরা তার সেবা যত্ন করলেও তাঁর মনে হয় ওরা করে দায়িত্ব মনে করে, আর রোকেয়া করে আত্নার টানে।তাইতো তিনিও মেজ ছেলের বৌ রোকেয়ার জন্য আত্নার টান অনুভব করেন। তাঁর মায়ের মতো বৌটার কপালে কি ছেলের বৌয়ের আদর জুটবে না?এটা কেমন কথা?

—আম্মা আপনি একটু ঘুমান। সন্ধ্যার পরে যেতে হবে ডাক্তারের কাছে। আপনার ছেলে সিরিয়াল দিয়ে রেখেছে।

—তোমরা সবাই খামোখা অস্থির হইতাছ।নাঈমরে বললাম,বুকে একটু ব্যথা করছিলো,এখন ঠিক আছে। তবুও ছেলে শুনলো না,ঢাকায় আইনাই ছাড়লো।

—একবার চেকাপ করে নিলে সমস্যা কি আম্মা?

—শোন আল্লাহর রহমতে এই বয়সেও তোমাগোর চাইতে ভালো আছি।দেখবা কোন সমস্যাই নাই।

—এত দুরে একা একা থাকেন চিন্তা তো হওয়ারই কথা।এত বার বলার পরেও ঢাকায় এসে থাকবেন না। কয়েকদিন থেকেই অস্থির হয়ে যান। এইবার আর যেতে দিবো না।

—গ্রামের যে তাজা বাতাস তোমাগো ঢাকায় তা কই ?সব তো দূষিত।খাওন থাইকা ধইরা বাতাস সব কিছুই দূষিত। আমার দম আটকা আটকা লাগে ঢাকায়।
রোকেয়া একটু হাসলেন।দুলিকে বললেন-

—চল দাদুকে রেস্ট নিতে দাও।

—মা থাকি না দাদুবুর সঙ্গে।

—তুমি থাকলে বকবক করবে আম্মা একটুও ঘুমাতে পারবেন না।

—আমি একটুও কথা বলবো না।

এবার দাদু বললেন-

—থাকুক না টিয়া পাখিটা।ও কথা বললেও আমার ঘুম চইলা আসবো,এত সুন্দর টিয়া পাখির মতো কথা কয়!

—আম্মা সে এখন খুব দুষ্টু হয়েছে ,একদম কথা শুনতে চায় না।

পরশ আর সিমি এক সাথেই বাসায় এলো।দাদু এসেছে শুনে পরশ এক দৌড়ে দেখা করতে চলে গেল। রোকেয়া সিমিকে ভালোভাবে বুঝিয়ে বললেন,দাদুর সামনে এমন কোন আচরণ যেন প্রকাশ না পায় যাতে উনি রেগে যান বা কষ্ট পান।

—আমি কিছু না বললেও দোষ হবে,বললেও হবে।

—সিমি আমাকে রাগিও না, তোমাকে সাবধান করে দিলাম।তুমি যখন মনে করছ দোষ হবেই তাহলে বরং কথাই বলো না।এবার চল আম্মার সাথে দেখা করবে আর উনার পা ছুঁয়ে সালাম করবে।

—এইটা ঠিক না,পা ছুঁয়ে সালাম করার কথা ইসলামে বলা নাই।

—ইসলামে যা যা বলা আছে তুমি সেগুলোর কয়টা মেনে চল?যে কোন একটার কথাই বল।বলতে পারবে?আমরা তো সবাই নামাজ পড়ি তুমি কয় ওয়াক্ত নামাজ পড় ?
আর পা ছুঁয়ে সালাম করলে সমস্যা কি?অনেক আগে থেকে যে রীতি চলে এসেছে, আর এতে করে যদি বয়ষ্ক একজন মানুষ মনে তৃপ্তি পান সেটা করা কি খুব বেশি অনুচিত হবে?

সিমির মুখ কালো হয়ে গেলো।সে আর কোন যুক্তি খুঁজে পেলো না।

সিমি দাদুকে সালাম করল।দাদু তাকে হাত ধরে পাশে বসালেন।
—দেখি দেখি নাতবৌরে দেখি, বলে সিমির থুতনিতে ধরলেন।বৌ তো দেখতে শুনতে ভালই।খালি হাতে তো বৌ দেখা যায় না,এই দুলি আমার হাত ব্যাগটা দে তো।
হাত ব্যাগ থেকে একজোড়া ঝুমকা বের করে সিমির হাতে দিয়ে বললেন-
একটু কানে পড়তো ঝুমকাটা ,কেমন মানায় দেখি।
হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলো সিমি।
দাদু আর রোকেয়া মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। দাদু হেসে বললেন-

—পছন্দ হয় নাই?

—হয়েছে।এটা কি স্বর্ণের?
এই বার সামনে একটা দাঁত পড়ে যাওয়া দাদু হো হো করে হেসে উঠলেন।

—তোমার কি ধারণা, সেইটা বল।
—আমার মাকে , আমার দাদু ঝুমকা দিয়েছিলেন স্বর্ণ বলে,পরে দেখা গেলো সেটা ইমিটিশনের।

—তোমার মায়ের সাথে যা হইছে সেইটা যে তোমার সাথেও হইবো সেইটা ভাবো কেমনে? তোমার দাদির সাথে পরশের দাদির তুলনা কর কেমনে?প্রত্যেকটা মানুষই তো আলাদা।
আচ্ছা ঠিক আছে আমি একটু ঘুমাই ,এই বার তুমি যাও।

পরশ খুব রাগ হলো সিমির ব্যবহারে।

—দাদুবু কখনো স্বর্ণ ছাড়া জিনিস দিবেন এটা ভাবলে কি করে?

—আমি এটা আগামীকাল দোকানে দেখিয়ে কনফার্ম হবো আসলেই স্বর্ণ কিনা।

—তুমি তো দেখি শুধু পাগল না অনেক লোভীও।
আমার মনে হয় তোমার সাথে আমাদের সাথে মিলবে না।সম্পর্ক তো শুধু দুইজন মানুষের মধ্যেই হয় না তাদের পরিবার পরিজন সবাইকে নিয়েই থাকতে হয়। আর এখনই এই অবস্থা তাহলে শুধু শুধু এই সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোন মানেই হয় না।

—এর মানে কি?তুমি ডিভোর্সের কথা বলছ?সেটা পারবে না। পাঁচ লাখ টাকা কাবিন হয়েছে।

—কাবিনের টাকা তোমাকে দিয়ে দিবো।

—তাহলেও ছাড়বো না,জেলের ভাত খাওয়াবো।

—সব কিছু এত সহজ ভাবো? আমার আত্মীয় স্বজন কে কোথায়,কি প্রফেসনে আছে জান? সমস্যা তোমার,আমাকে ফাঁসাতে সারাক্ষণ মনে মনে জপ করছ। আমার ফ্যমেলিকে ছোট করে। আর জেলের ভয় দেখাচ্ছ?এই সব করলে তোমার কি অবস্থা আমি করবো চিন্তা ও করতে পারবেনা।এত দিন আমার ভাল রুপ দেখেছ,এখন দেখবে আমার অন্য রুপ। কখনো চাইনি তোমার সাথে আমার এমন বিশ্রি সম্পর্ক তৈরি হোক আমার খারাপ রুপ তুমি দেখ কিন্তু তুমিই এই পরিস্থিতি তৈরি করলে।

এবার যেন একটু ভয় পেলো সিমি।সে চুপ করে রইলো।
মনে মনে ভাবতে লাগলো এদেরকে কিভাবে ঘায়েল করা যায়? নিজের জীবন কখনোই নিজের মায়ের মতো হতে দিবে না ।সেই জন্য যা কিছু করা দরকার সব কিছু করবে। ওদের ভালোমানুষী উপরে দেখানো, কিছু দিন গেলেই খারাপ ব্যবহার শুরু করবে।ওদেরকে একদম বিশ্বাস করে না সিমি।

টমবয় টাইপ মেয়ে পম্পিকে নিয়ে স্বর্ণা হাজির হলো নওমির বাসায়।ছোট,বড়,মাঝারি সব মিলিয়ে পম্পির ব্যাগ চোদ্দটা।একটা ছোট জারে একটা ফাইটার ফিস।এটা অবশ্য পম্পির হাতেই ধরা,অন্য কারো হাতে ফাইটার ফিসের জারটা দিতে পম্পি ভরসা পায় না। দারোয়ান মফিজ ও সাহায্য করলো এগুলো উঠাতে।পম্পি একশ টাকা দিল মফিজকে।মফিজ আশা করেছিল আরেকটু বেশি।
সে উল্টেপাল্টে নোটটা দেখতে লাগলো।
পম্পি বলল-
—কি মামা পোষায়নি? ঠিক আছে এর পরে পুষিয়ে দেব।
—আপনি কি ইখানে পারমেল(পারমানেন্ট) .
‌‌থাকপেন।
—মনে হচ্ছে থাকবো।
—সারকে(স্যার)কি কয়েচ্ছেন(বলেছেন)?
—সেটা আপনাকে ভাবতে হবে না মামা,আমি বলে নিব।ঠিক আছে?
—আইচ্ছা তাইলে পরে আমি আসি।
—আচ্ছা আসেন।

নওমি ভেবে পাচ্ছে না পম্পির এত জিনিস কোথায় রাখবে?
পম্পি বলল-
—কি রে তোর চোখ এত বড় বড় হয়ে গেল কেন?
আমি যেখানে যাই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সাথে নিয়ে যেতে হয়।তা না হলে আমি এসে বলবো, আমাকে একটা প্লেট দে,মগ দে ,এটা দে,সেটা দে?
এখন বল কোন রুমে থাকবো,যেখানে বলবি সেখানেই থাকবো।আর শোন বার বার বলতে পারবি না গুছিয়ে রাখ গুছিয়ে রাখ।আমাকে যেখানে থাকতে দিবি নিজের মত বিন্দাস হয়ে থাকবো।অনেক ক্ষুধা লেগেছে এই যে বিরিয়ানি এনেছি তিন জনে খেয়ে নেই।পরে লম্বা একটা ঘুম দিবো। ঘুম থেকে উঠে গোছগাছ শুরু করবো। এখন খেতে খেতে বল তো তোর সমস্যাটা কি? সমস্যাটা নিশ্চয় অনেক বড়।না হলে তোর তো ক্লাস মিস্ দেয়ার কথা না।

প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সবকিছুই বলল ওদেরকে নওমি।
পম্পি হাসতে হাসতে বলল-
—এটা কোন সমস্যা? এখন তো আমি আছি।নক করলেই ব্যাটাকে ঢুকিয়ে এমন ধোলাই দিব যে, বাপের নাম ভুলে যাবে।

এবার স্বর্ণা বলল-
—আমি বলি কি তুই বিয়ে করে ফেল নওমি।
এবার পম্পি রেগে ভেঙ্গানোর মতো করে স্বর্ণাকে বলল-
— নওমি তুই বিয়ে করে ফেল।এই গাধা বিয়ে কি কোন সমস্যার সমাধান হলো?বিয়ে হলো জীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যা।

চলবে…

#ফাহমিদা_লাইজু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here