আঁধারের_গায়ে_গায়ে
তমসা_চক্রবর্তী
পর্ব-৪
।।১১।।
-“আমরা আপনার মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছি স্যার, কিন্তু কিছু প্রশ্নের উত্তর না পেলে যে আমরা তদন্তটা শুরু করতে পারব না”!!
উজান মুখের কথাটা শেষ করতেই রুমালের খুঁট দিয়ে চোখের জল মুছে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলেন প্রিয়নাথ সাহা।
-“বলুন কি জানতে চান আপনারা!! আপনাদের সব রকমের সহযোগিতা করার চেষ্টা করব”!!
-“দেখুন স্যার গত দুমাসের মধ্যে আপনাদের বাড়িতে তিন তিনটে দুর্ঘটনা ঘটে গেল।আর আমাদের..”!!
-“আদৌ ওগুলো দুর্ঘটনা কিনা সে বিষয়ে আমার কিন্তু যথেষ্ট সংশয় আছে অফিসার”!!
উজানের কথার মাঝেই সংশয় প্রকাশ করলেন প্রিয়নাথ সাহা। ওনাকে খানিকটা আশ্বস্ত করে উজান আবার বলে,
-“আপনার সন্দেহটা আমাদের যথেষ্টই যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে স্যার। তাই একটাই রিকোয়েস্ট, আমাদের ওপর একটু বিশ্বাস রাখুন, আমরা সব ঘটনাগুলোই তদন্ত করব। কিন্তু তার আগে যে তদন্তের স্বার্থে ঘটনাগুলো একটু বিস্তারিত ভাবে জানা দরকার স্যার”!!
-“দেখুন, আমার দিদির মৃত্যুর দিন..”,
শুরুতেই প্রিয়নাথ সাহাকে কথার থামিয়ে দিল মিলি।
-“কিছু মনে করবেন না মিস্টার সাহা, মিসেস সেনের মৃত্যুর ঘটনা থেকে শুরু না করে যদি আপনি সৃঞ্জয় বাবু আর সৌমিলি দেবীর মৃত্যু থেকে শুরু করেন তাহলে ঘটনাপ্রবাহগুলো বুঝতে আমাদের আর একটু সুবিধা হয় আর কি”!!
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মিলিকে আপাদমস্তক দেখলেন প্রিয়নাথ বাবু।
-“আপনি!!আপনাকে তো ঠিক..”!!
-“আমি অহনা, অহনা গঙ্গোপাধ্যায়।প্রাই..”,
-“মাই গড, তুমিই অহনা”! জোর চমকালেন প্রিয়নাথ সাহা।
-“প্রধান বলেছিল বটে এর কথা। কিন্তু এতো একেবারেই বাচ্চা মেয়ে!তা সত্যি ও এত এত জটিল কেস সলভ করেছ”!!
ভ্রূ জোড়া কুঁচকে বেশ সন্দিগ্ধ চোখে উজানের দিকে তাকালেন প্রিয়নাথ বাবু।মিলির মুখটা চট করে একবার দেখে নিল উজান।মেয়ে যে এহেন কথাবার্তায় বিশেষ অস্বত্বি বোধ করছে তা ওর চোখে মুখে স্পষ্ট।তাই দেখে উজান পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টায় বলে,
-“বয়সে যাবেন না স্যার। ওর পঞ্চইন্দ্রিয়ের সাথে সাথে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়টাও কিন্তু প্রখর”!
-“হ্যাঁ স্যার,আমরা সকাল থেকে যা পারিনি উনি কিন্তু ঘন্টাখানেকের মধ্যেই সেটা উদ্ধার করে ফেলেছেন”!!
ভুবন তালুকদার এখন মিলি বলতে অজ্ঞান।দুই পুলিশ কর্তার আশ্বাসে প্রিয়নাথ সাহাও একটু ভরসা পেলেন। নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে মিলিকে বললেন,
-“আমি শুভেন্দুদার যৌবনকাল থেকেই শুরু করছি।পুরো ব্যাপারটা জানা থাকলে তোমাদের কাজেও সুবিধা হবে”!!
-“নিশ্চই স্যার”!!
।।১২।।
-“ঘটনার শুরু আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে। শুভেন্দুদা যখন মিউনিসাপ্যালটির স্থায়ী চাকরি ছেড়ে ব্যবসা করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন, তখন যে শুধু ওঁর বাবা অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন তা নয়, আমার দিদি, মানে শুভেন্দুদার স্ত্রী অনুসূয়া সেনও স্বামীর মূর্খতায় রেগে বাপের বাড়িতে পাড়ি দিয়েছিলেন।
কিন্তু বাবার অসন্তোষ, বৌয়ের রাগ কোনকিছুই শুভেন্দুদাকে তার সিদ্ধান্ত থেকে নড়াতে পারেনি।বড্ড একরোখা মানুষ ছিলেন কি না!!সে যাই হোক ঝোঁকের মাথায় চাকরি তো ছেড়ে দিলেন, কিন্তু ব্যবসার মূলধন বলতে তো ছিল শুধু নিজের জমানো কিছু টাকা আর মায়ের দেওয়া কিছু গয়না।তাই নিয়েই শুভেন্দুদা একটি প্রিন্টিং প্রেস খুলে বসলেন। মিউনিসিপ্যালিটির চাকরির সুবাদে সেখানে বেশ কিছু পরিচিতি ছিলই ওনার।তাদের সাহায্যেই আস্তে আস্তে ওঁর প্রিন্টিং প্রেসের ব্যবসা বেশ ফুলে ফেঁপে উঠলে একটা সময়ে আমার বাবার সুপারিশে কিছু লেখক বন্ধু এগিয়ে আসেন। শুভেন্দুদাকে তারা নিজেদের বই প্রকাশের প্রস্তাব দেন। বুদ্ধিমান এবং বিচক্ষন শুভেন্দুদা এই প্রস্তাব একেবারে লুফে নিলেন।ভগবানের অশেষ কৃপায় ওঁকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি কোনদিনও।সময়ের সাথে সাথে কলেজ স্ট্রীটে নিজের দোকান,প্রকাশনী সংস্থা সবই শুরু হয়ে গেল।
শুভেন্দুদার ব্যবসার এই রমরমা ওনার বাবাকে চুপ করিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্টই ছিল।উল্টে অবস্থা এরকম হয়ে উঠেছিল যে ব্যবসার শুরুতে শুভেন্দুদার পাশে না থাকার কারনে, ওঁর বাবা সর্বত্র আমার দিদিকে বোকা মেয়েমানুষ বলে অভিহিত করতেন।উনি ভুলেই গিয়েছিলেন, সেইসময় বৌমাকে সমর্থনকারীদের মধ্যে উনি ছিলেন অন্যতম।
উনি ভুলে গেলেও শুভেন্দুদা কিন্তু কিছুই ভোলেননি। ওদিকে ততদিনে শুভেন্দুদার জেদ আর অধ্যাবসায় সেন প্রকাশনীকে এক নতুন মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে।চাইলে যে বাঙালি অনেক কিছুই করতে পারে,সেটা তখন শুভেন্দুদা বারংবার প্রমান করছিলেন। কিন্তু কথায় আছে না, ‘কিছু পেতে গেলে, কিছু হারাতে হয়’। শুভেন্দুদাও কিন্তু এর ব্যাতিক্রম ছিল না।ধীরে ধীরে সফলতার শীর্ষ ছুঁতে থাকা শুভেন্দু সেনের সাথে বাড়ির মানুষগুলোর আত্মিকটান কমে গিয়েছিল ভয়ঙ্করভাবে। আর এই ব্যাপারটাই ভীষনভাবে নড়া দিয়েছিল শুভেন্দুদার মাকে।আসলে পরিবার পরিজন ভুলে ছেলে শুধু ব্যবসায় মনোনিবেশ করবে এটা মনে হয় উনি কোনোদিনই চাননি।
আবার এদিকে তখন আমার দিদি ন’মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় বাপের বাড়িতে।এর কিছুদিন পরেই নাতি হওয়ার খবর পেয়ে মাসিমা,মানে শুভেন্দুদার মা বিন্দুমাত্র কালবিলম্ব না করে দিদিকে হাসপাতাল থেকে সোজা এবাড়িতেই ফিরিয়ে নিয়ে আসেন।আর দিদির জীবনে সেটাই মনে হয় কাল হল, জানেন”!!
অনেকক্ষন একটানা কথা বলে একটু থামলেন প্রিয়নাথ সাহা।টি টেবিলে রাখা জলের গ্লাস থেকে গলাটা ভিজিয়ে নিয়ে আবার শুরু করলেন।
-“দিদিকে ওই বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে শুভেন্দুদার মনোভাব ঠিক কি ছিল সেটা বলা কঠিন।তবে প্রতিক্রিয়া যাই হয়ে থাকুক না কেন, এবাড়িতে ফিরে আসার পর দীর্ঘদিন দিদিকে আর কেউ হাসতে দেখেনি জানেন।আমরা বেশ কয়েকবার ওকে প্রশ্নও করেছিলাম, কিন্তু কখনোই মুখ ফুটে কোনো উত্তর দেয়নি।তবে হ্যাঁ, মাসিমা কিন্তু নাতি আর বৌমাকে অত্যন্ত যত্নে রাখতেন। কিন্তু ওই যে বলে না,’কপালে না থাকলে ঘি, ঠকঠকালে হবে কি’!! সৃঞ্জয়ের অন্নপ্রাশনের মাস তিনেক পরেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মাসিমা চলে গেলেন।আর মাসিমার পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই শুভেন্দুদা বৌ বাচ্চা সমেত উঠে আসলেন এই বাড়িতে”!!
প্রিয়নাথ সাহা একটু থামাতেই মিলি প্রশ্ন করল,
-“আর ওনার বাবা”!!
।।১২।।
-“শুভেন্দুদা একটা কথা বরাবর বলত জানেন!!সেনেরা নাকি কিচ্ছু ভোলে না,কিচ্ছু না’।ব্যবসা নিয়ে বাবার সাথে মনোমালিন্য বা বাবার বিরূপ প্রতিক্রিয়া কোনো কিছুই ভোলেননি শুভেন্দুদা।তাই মায়ের মৃত্যুর পর বাবাকে সোজা বৃদ্ধাশ্রমে রেখে নিজের পরিবারকে নিয়ে এই বাড়িতে উঠে আসতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেননি।যদিও বেশিদিন শুভেন্দু সেনকে বাবা নামক বোঝাটি টানতে হয়নি। মাসিমার মৃত্যুর বছরখানেকের মধ্যেই শুভেন্দু দার বাবাও একদিন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।রয়ে গেল শুধু আমার দিদি অনুসূয়া।তাকে যে শুভেন্দুদা কেন নিজের কাছে রেখে দিয়েছিল আজও এই প্রশ্নের উত্তর আমি পাইনি।
তবে পুত্র স্নেহে দিনে দিনে ভীষন রকরমের আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিলেন শুভেন্দুদা।স্কুল আর টিউশনির সময়টুকু বাদ দিয়ে দিনের বেশিরভাগ সময়ই সৃঞ্জয়কে তিনি নিজের কাছে রাখার চেষ্টা করতেন। আর ফলস্বরূপ যা হওয়ার ঠিক তাই হল।মা নামক একজন মানুষ যে বাড়িতে আছে, তারও যে কোনো সুবিধা অসুবিধা, মতামত থাকতে পারে এসব সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো জ্ঞানই তৈরি হলনা সৃঞ্জয়ের। সময়ের সাথে সাথে বাবাই হয়ে উঠেছিল সৃঞ্জয়ের একমাত্র ধ্যান জ্ঞান। বাবার সাথে ওঠা বসা,বাবার ব্যবসা এসবই পাখির চোখ হয়ে উঠেছিল সৃঞ্জয়ের জন্য।
এরও প্রায় বছর দুয়েক পরে হঠাৎই একদিন শুভেন্দুদা ঠিক করেন, তিনি ছেলের বিয়ে দেবেন। সৃঞ্জয় যদিও ব্যবসার কাজের বাহানায় প্রথম দিকে একটু গাইগুই করেছিল, কিন্তু শুভেন্দুদা নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। সৃঞ্জয়কে বুঝিয়েছিলেন,
-‘আমার এই সম্পত্তি, এত কষ্ট করে দাঁড় করানো ব্যবসা কার জন্য! যদি কোনো উত্তরাধিকারী নাই থাকে, তবে তুমি কার জন্য পরিশ্রম করবে, ব্যবসার এত উন্নতি কার জন্য !ব্যবসার উন্নতির জন্য বিয়েটাও কিন্তু ভীষন জরুরী সঞ্জু’!!
হ্যাঁ, সৃঞ্জয়কে এই নামেই ডাকতেন শুভেন্দুদা।তবে কি জানেন, সৃঞ্জয়ের বিয়ের ব্যাপারে শুভেন্দুদা কিন্তু সাংঘাতিক বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন।সব ঘটকদের প্রথমেই জানিয়ে দিয়েছিলেন,পাত্রী হতে হবে গরীব ঘরের।বাবা মা না থাকলেই ভালো হয়, কিন্তু তাই বলে অনাথ হওয়া চলবে না।আর মোটামুটি চালিয়ে নেওয়ার মত শিক্ষিত হতে হবে।
বড়লোক বাড়ির এমন অদ্ভুত ডিমান্ডে অবাক হলেও বেশ অনেক কটাই সমন্ধ এনেছিলেন নন্দ ঘটক।তার মধ্যে থেকেই ঝাড়াইবাছাই করার পর সৌমিলির ভাগ্যের শিকে ছেড়ে। ছোটবেলায় বাবা মা মারা গিয়েছিল বেচারির। তারপর থেকে মামার বাড়িতেই মানুষ – বিনা পয়সার ঝি আর কি!!সৌমিলির মামার বাড়িটা আসলে ছিল নন্দ ঘটকের শ্বশুরবাড়ির পাড়ায়।তাই হয়ত মামারা না চাইলেও নন্দ ঘটক সৌমিলির কথাটা শুভেন্দুদার কানে তুলেছিলেন।যাইহোক, ফাল্গুনের এক সন্ধ্যায় সৃঞ্জয় আর সৌমিলির চার হাত এক করে দেন শুভেন্দুদা এবং বলাইবাহুল্য বিনা পয়সার ঝির এমন তাক লাগানো গতি দেখে রাগে হিংসায় সৌমিলির মামার বাড়ির লোকেরা তার সাথে সব যোগাযোগ ছিন্ন করল।তবে সৌমিলি এবাড়িতে নতুন বৌ হিসেবে পা রাখার পরই সেন ভিলায় শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়”!!
-“নতুন অধ্যায়”!!
মিলির চোখেমুখে ভিড় করেছে একরাশ প্রশ্ন। সেদিকে একঝলক তাকিয়ে মুচকি হাসলেন প্রিয়নাথ সাহা ।