#মুহূর্তে
পর্ব-২১
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
প্রণয় হেসে একবারের জন্য আকাশে তাকায়। তারপর বলে, “ভালোবাসা, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর শব্দ অথচ অসুন্দর অনুভূতি দিয়ে যায়। তুমি ভালোবাসার মতো সুন্দর অনুভূতি অনুভব করবে অথচ সাথে কষ্ট অনুভব করতে চাইবে না। তা তো হয় না।”
কথন তার কফির মগে একটি চুমুক দিয়ে বলে, “ভালোবাসায় কষ্ট মানানসই, কিন্তু যে অপেক্ষার কোনো অন্ত নেই তা তো মানানসই নয়। যদি আমি ওকে পেতাম তাহলে কষ্টের কোনো আফসোস থাকতো না। কিন্তু আমি জানি, আমি ওকে কখনো পাব না। এইটাই তো আফসোসের ব্যাপার। না ওকে ভুলতে পারি, আর না ওকে পেতে পারি।”
প্রণয়ের মন খারাপ হয় কথনের এমন কথায়। সে ভালোমতোই জানে কথনের মনের ব্যাথা। সে-ও তার ভালোবাসার মানুষ থেকে দূরে এসেছে। কিন্তু সে জানে, ফিরে গেলেই তার ভালোবাসার মানুষটিকে পাবে সে। কিন্তু কথনের পক্ষে তা সম্ভব নয়। প্রণয়ের মাথায় হঠাৎ বুদ্ধি এলো। সে ডাইরির এক পাতা খুলে কিছু বাক্য পড়ে শুনালো কথনকে, “আমার হৃদয়ের স্পন্দন বন্ধ হয়ে আসে। কবিতা আমার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো গাঢ় লাল রঙের শাড়ি পড়ে। আমার দমটা বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। এতটা সুন্দর লাগছিলো তাকে। এমন না যে কবিতা আমার সামনে আগে লাল রঙ পড়ে নি অথবা আগে শাড়ি পরেনি। পরেছে। আমি মুগ্ধ হয়েছি কিন্তু কখনও এমন মনে হয়নি যে আমার সকল স্বপ্ন জুড়ে একটি মেয়ে রাজত্ব করতে পারে।”
কথন হাসে। প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “ভাই তুই কি আমার মন ভালো করার জন্য এই মুহূর্ত মনে করালি, না আঘাত পূণরায় অনুভব করার জন্য।”
” কথন শুন, ভালোবাসায় অনেক বাঁধা আসে। এর মানে এই নয় যে আমরা আমাদের ভালোবাসার মানুষকে ভুলে যাব। আমি যাকে ভালোবাসি তার জন্যও আমার অনেক সাধনা করতে হয়েছে। দুইদিন পর তাকে আমি দেখতে পারব, তোকে আমি বুঝাতে পারবোনা আমার কতটা ভালো লাগছে। আল্লাহর কাছে দোয়া কর, ইনশাল্লাহ তুইও একদিন ভালবাসার মানুষকে পেয়ে যাবি।”
“আমারটা সম্ভব না’রে। সম্ভব না। সে এখন অন্যকারও। আর আমি চাই না তার জীবনে কোন কষ্ট হোক। আমি তাকে পাওয়ার জন্য না, তার খুশির জন্য দোয়া করব। ও যেন খুশি থাকুক, ওর ভালবাসার মানুষটার সাথে।”
“অন্যকাওকে পাবি যাকে তুই ‘আরও ভালোবাসতে পারিস।”
“তুই থাক, আমি আরেক কাপ কফি বানিয়ে আনি।”
কথন উঠে যায় কফি বানানোর উদ্দেশ্যে। কিচেনে যেয়ে কফি মেকার অন করে তার মানিব্যাগ থেকে একটি ছবি বের করে। ছবিটি তার ও কবিতার। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বাহারে সে এবং কবিতা শুভ্র রঙে লেপ্টে ছিলো। দুইজন তাকিয়ে ছিলো একে অপরের দিকে। সে প্রথম তাদের চোখে চোখ রেখে কিছু শুভ দৃষ্টি বন্ধন করা। সে দিনটি ভোলার মতো নয়। সে দৃষ্টি ভোলার মতো নয়। এমন মায়াভরা চোখে কোনো হৃদয়হীন ব্যক্তির ভোলার সাধ্য থাকে। কথনের মাঝেমধ্যে আফসোস হয় সে হৃদয়হীনা কেন নয়?
ছবিটা দেখতে দেখতেই কথা ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠল। সে একটি দেয়ালে হেলান দিয়ে ছবিটির পিছনে লেখাটি পড়ে,
“মেয়েটির সাজ ভীষণ পছন্দের। তবে সে জানে না, তার মায়াভরা দৃষ্টির সামনে এই পৃথিবীর সকল সৌন্দর্য তুচ্ছ।”
.
.
কলিংবেল বাজে। কবিতা একদিকে রান্না করছিলো অন্যদিকে পড়াচ্ছিলো কাব্যকে। এই শেষ সন্ধ্যায় কে এলো তা বুঝতে পারে না সে। বিশেষ কারও আসার কথা ছিলো না। তীর্থের মা’ও কিছুক্ষণ বাহিরে গিয়েছো তার বান্ধবীদের সাথে গল্প করতে। তার এত তাড়াতাড়ি আসার কথা নয়।
কবিতা দরজা খুলে তীর্থকে দেখতেই চমকে উঠে। বিস্ময় নিয়ে বলে, “তুমি না একদিন পর আসতে?”
তীর্থ কোনো উওর দেয় না। কবিতার হাত ধরে একটানে তাকে বুকে জড়িয়ে। জড়িয়ে ধরে এক গভীর নিশ্বাস ফেলে। এতক্ষণ তার জান যায় যায় অবস্থা। সারারাস্তা অশান্তি এবং ভয়ে কেটেছে তার। কবিতা যদি ভুলেও গতরাতের ঘটনা জানে তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। সে তো কবিতাকে ছাড়া থাকতে পারবে না।
কবিতা হতভম্ব হয়ে যায় তীর্থের হঠাৎ তাকে জড়িয়ে ধরায় সে ভয়ার্ত গলা জিজ্ঞেস করে, “সব ঠিক আছে তো?”
“হুম, কেবল তোমার কথা মনে পড়ছিল খুব। তাই চলে এলাম তোমার কাছে।”
কথাটা শোনার পর কবিতার মন ফুরফুরে হয়ে গেল। সে একগাল হেসে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে তীর্থের বুকে নিজের মুখে লুকিয়ে আলতো সুরে বলে, “তুমি কেবল আমার জন্য এসেছ?”
তীর্থের মাথায় এলো যে তারা এখনো দরজায় দাঁড়ানো। তীর্থ কবিতাকে ছেড়ে বলল, “ভিতরে যেয়ে কথা বলি আসো। সিঁড়ি থেকে উঠানামা করার সময় কেউ দেখে নিলে আবার লজ্জা পেতে হবে।”
কথাটা অপ্রভাবিত হয় কবিতা। সে তীর্থের হাতদুটো আবার তার কোমরে আবদ্ধ করে বলে, “উফফ তারা দেখলে তারাই লজ্জায় ফুরফুর করে নিচে নেমে যাবে। তুমি আমাকে ছেড়ো না তো।”
তীর্থ হাসে কবিতার এমন পাগলামি দেখে। সে কবিতাকে আবারও জড়িয়ে ধরে।
“আম্মি আম্মি এতা মেদাম কি লিখে দিয়েছে?” কাব্যের কণ্ঠ শুনে তাড়াহুড়ো করে কবিতা সরে যায় তীর্থের বুক থেকে। কাব্য রুম থেকে দৌড়ে এসে তার বাবাকে দেখে উৎসুক গলায় বলে, “আব্বু তুমি ককন এসেছ?”
“এইমাত্র।”
“আব্বু আব্বু আমার সাতে তেলবে?”
কবিতা বলে, “খেলা পরে। আগে হোমওয়ার্ক। হোমওয়ার্ক শেষ হলে বাবা তোমার সাথে খেলবে। এইবার জলদি করে রুমে যাও, আম্মি আসছে।”
কাব্য বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়িয়ে তার মা’য়ের আদেশ পালন করল। কবিতা তীর্থের দিকে তাকিয়ে বিরক্তির সুরে বলল, “তোমার লজ্জা শরম বলতে কিছু আছে? এভাবে খোলামেলা জায়গায় কেউ জড়িয়ে ধরে? কেউ দেখলে কি ভাবতো?” কবিতা মুখ ফুলিয়ে তীর্থের পিঠ করে রুমের দিকে যেতে নিলেই আবার ফিরে এসে তীর্থের গালে একটা চুমু খেয়ে বলল, “আচ্ছা এখন জলদি যেয়ে হাতমুখ ধুঁয়ে নেও। এতবড় জার্নি করে এসেছ, নিশ্চয়ই খুদা লেগেছে। আমি ছটফট করে নাস্তা বানিয়ে দিচ্ছি।”
তারপর কবিতা আবারও হাওয়ার বেগে চলে গেল। তীর্থ কবিতার এমন কান্ড দেখে হেসে মাথা নাড়িয়ে বলে, “পাগল একটা।”
শাওয়ার নিচ্ছিল তীর্থ। এর মাঝে তার মনে পড়ে গতরাতের কথা। এরমাঝে সে আবার ভাবে মৃণার সাথে সব কথা ক্লিয়ার না করে তার আসাটা উচিত হয় নি। একদিকে তো মৃণা বলেছিলো যে তীর্থ গতরাতে কোনো জোর করে নি তাকে, তাহলে এমন ব্যবহার কেন করছিল সে? মাথায় ডুকছে না, কিছুই মাথায় ঢুকছে না তার। মৃণার সাথে কথা বলতে হবে কিন্তু সে একটা জিনিস ভালো করে জানে কিছুতেই গতরাতের কথা কবিতাকে জানতে দেওয়া যাবে না। কবিতাকে এমন কিছু সন্দেহও করতে দেওয়া যাবে না। যদি কবিতা ভুলেও জেনে যায় এবং তাকে ছেড়ে যেতে চায় তাহলে? ভাবতে বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠে তীর্থের। সে কবিতাকে ছাড়া বাঁচতে পারার কথা ভাবতেও পারে না।
তীর্থ দেখল সে তোয়ালে নিয়ে আসে নি তাই ডাক দেয় সে কবিতাকে। কবিতা বাথরুমের দরজার বাহির থেকে জিজ্ঞেস করে, “ডাকছ কেন?”
“একটা তোয়ালে দিয়ে যাও।”
কিছুক্ষণ পর তোয়ালে নিয়ে হাজির হয় কবিতা। দরজায় টোকা দিয়ে বলে, “এই নেও।”
তীর্থ দরজা খুলতেই দরজার ফাঁক দিয়ে কবিতা তোয়ালেটা দেয়।
হঠাৎ তীর্থের মাথায় দুষ্টুমি বুদ্ধি আসে। সে কবিতার হাত ধরে টান দিয়ে ভেতরে নিয়ে আসে তাকে। দরজা বন্ধ করে দেয়। কবিতাকে ঝর্ণার নিচে এনে দাঁড় করায়।
আচমকায় এমনটা হওয়ায় কবিতা কিছু বুঝে উঠতে পারে না। সে একবার মুখ তুলে ঝর্ণার দিকে তাকিয়ে আবার তাকায় তীর্থের দিকে। বিরক্তির ভাব নিয়ে বলে, “আমি পুরো ভিজে গেলাম তো।”
তীর্থ কবিতাকে কাছে যেয়ে তার কোমরে হাত রেখে তাকে কাছে টেনে আছে। তারপর কবিতার দিকে ঝুঁকে বলে, “আজ সকালে কি বলছিলে আমি রোমেন্টিক না, তাই না?”
কবিতা লজ্জায় মুখ নামিয়ে নেয়, “ভুল বলেছি না’কি?”
“তাহলে এখন রোমেন্টিক হচ্ছি তো। একবার তাকাও।আমার দিকে।”
কবিতা লজ্জায় মিইয়ে গেল। সে চোখ উঠালোই না। তীর্থ তার থুতনিতে আঙুল রেখে মুখ তুলে বলে, “মরে যাব এমনভাবে লজ্জা পেতে দেখলে। লজ্জা পেলে এত সুন্দর লাগে কেন তোমায়?”
তীর্থ ঝুঁকে কবিতার কানের পাতায় একটা চুমু খেল। সাথে সাথে কেঁপে উঠে সে। চোখ দুটো চেপে বন্ধ করে নেয়। তীর্থ কবিতার কপাল ছোঁয়া ভেজা চুলগুলো আলতো আঙুলে সরায়। কবিতার কোমরে থাকা হাতটা বুলিয়ে তার পিঠের কাছে নিয়ে আসে। একটানে মিশিয়ে নেয় তাকে নিজের সাথে। আবারও তার কাছে যেতে নেয়।
কবিতার তো হৃদয়ের স্পন্দন বাঁধনহারা।
তীর্থের এই মাতাল স্পর্শে ধ্ক করে উঠে তার হৃদয়। দিশেহারা হয়ে যায় নিশ্বাস।
ডাক পড়ে জাহানারা বেগমের, “বউ….এই বউ আমার পানের ডিব্বা কই রাখসো তুমি?”
ভয়ে কবিতা লাফিয়ে উঠে। সে হতদম্ব হয়ে আশেপাশে তাকাতে থাকে। ঝর্ণাটা বন্ধ করে তীর্থকে জিজ্ঞেস করে, “মা ডাকছে তো। এখন আমি কীভাবে যাব? কী করলে তুমি বলো তো।”
তীর্থ কবিতার হাত থেকে তোয়ালে নিয়ে মাথায় রাখতেই কবিতা বলে, “তুমি ভেজা তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছবে?”
“উঁহু, আদর করব।”
তীর্থ তোয়ালে দিয়ে কবিতার মাথা ঢেকে দুইহাত দিয়ে তার গাল ধরে বলে,”একমুহূর্তে অন্যকোনো কথা শুনবে না, কেবল আমার স্পর্শ অনুভব করো।”
তীর্থ মুহূর্ত না ব্যয় করে কবিতার ঠোঁটে ঠোঁট মিশিয়ে দিলো। কবিতার ঠোঁট দুটো নিজের দখলে নিয়ে খেলতে থাকে তার সাথে।
ওদিকে তীর্থের মা ডেকেই যাচ্ছিল কবিতাকে। কবিতা জানে এখন না গেলে অনেক কথা শুনতে হবে তাকে। কিন্তু তীর্থের স্পর্শকে অনুভব না করার সাধ্য তার নেই।
[একটু শান্তির পর্ব দেওয়ার জন্য পর্বটা এতটুকু হলো। আরও লিখেছিলাম কিন্তু গল্পে এতদিন বেশিই ঝামেলা দেখিয়ে ফেলেছিলাম তাই আজ দিলাম না। ইনশাআল্লাহ আগামীকাল রাতে আরেক পর্ব দিব।]
চলবে….
[বিঃদ্রঃ ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। গল্পটা কেমন লাগছে জানাবেন। ধন্যবাদ।]
সকল পর্ব-
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=381227816949915&id=100051880996086