মুহূর্তে পর্ব-৩২

0
626

#মুহূর্তে
পর্ব-৩২
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

ফোন কাটার পর মৃণা জলদি করে তীর্থের নাম্বার ফোন থেকে ডিলিট করতে যাবে তখনই আইদের কন্ঠ শুনে সে, “মৃণা, আমার ফোনে কার সাথে কথা বলছ তুমি?”
আইদের কন্ঠ শুনতেই ঘাবড়ে যায় মৃণা। তার হাতের থেকে ফোন পড়ে যায়। আইদ তার কথা শুনে নেয় নি তো?
মৃণা জলদি করে ফোনটা উঠিয়ে বলল, “আমার ফোনে টাকা শেষ হয়ে গেছিলো তাই রূপাকে কল করার জন্য তোমার ফোন নিলাম।”
আইদ হাসে, “ঠিকাছে। এখানে এত ঘাবড়ে যাবার কী আছে?”
তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছচ্ছিলো আইদ। মৃণা নিজে যেয়ে আইদের হাতের থেকে তোয়ালে নিয়ে তার মাথা মুছতে শুরু করে।
আইদ হতবাক।
সে কী ঠিক দেখছে? যে মৃণা আজ পর্যন্ত নিজ থেকে তার সাথে কথা বলতে আসে নি সে এসে তার চুল মুছে দিচ্ছে?

“তোমার আজ হঠাৎ কী হলো মৃণা?”
“কেন আমি আমার স্বামীর মাথা মুছে দিতে পারি না?”
মৃণা জোরপূর্বক হাসি তার ঠোঁটের কোণে রেখে বলল। যেমন করেই হোক কয়দিন তার সবার সাথে ভালোভাবে ব্যবহার করতে হবে। বিশেষ করে আইদের সাথে। যেন কেউ তাকে নিয়ে কোনো ধরনের সন্দেহ না করে। আইদকে কোনোভাবেই বুঝতে দেওয়া যাবে না যে তাদের সম্পর্কে কোনো সমস্যা আছে।
পায়ের পাতায় ভর করে উঁচু হয়ে আইদের মাথা মুছে দেবার শেষে সে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। সে দেখে আইদের ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি। সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “ভালো কিছু হয়েছে? এভাবে হাসছ যে?”
“হয়েছে তো। তুমি মাত্র এত আদর করে আমার মাথা মুছে দিলে, আমার কাছে এলে। এটা অনেক বড় ব্যাপার নয়?”
মৃণা কি বলবে বুঝতে পারে না। কিন্তু তার আবারও কেন যেন রাগ উঠে আইদের উপর। আইদের এইসব কথা শুনে তার মনে হয় সে নিজে অনেক খারাপ। তার চিন্তাভাবনা খারাপ। সে নিজে মানুষটা খারাপ। সে যা করছে সব ভুল। আইদের কারণে তার মনে অপরাধ ভাবটা বিরাজ করে। কিন্তু সে জানে সে যা করছে তা ভুল না। নিজের জন্য ভাবাটা কখনোই ভুল হতে পারে না। উচ্চাকাঙ্খী হওয়া খারাপ তো কিছু না। তাই না? উল্টো যেসব মানুষরা ভাবে অহরহ ধন-সম্পদ ছাড়াও সুখে থাকা যায় তারা বোকা। আর আইদ সে বোকাদলের মাঝে একজন। বোকা না হলে এতদিনে সে তার কোম্পানি থেকে অনেক টাকা সরাতে পারতো। কিন্তু নীতিই তার কাছে সর্বোপরি। কিন্তু নীতি কখনো বিলাসিতা দেয় না।

আইদ যদি আজ তার সকল ইচ্ছা পূরণ করতো তাহলে হয়তো তীর্থের প্রতি তার ভালোবাসাটাও ভুলে যেত সে, ভুলে যাবার চেষ্টা করতো আইদের কুদর্শন বাহ্যিক গঠন। কিন্তু না, সে তো তা করবে না। সবশেষে দেখা গেলে তার তীর্থের কাছে যাবার আরেকটা কারণ আইদ নিজে।

আইদ মৃণার গালে হাত রেখে বলল, “আমার ভালো লাগছে যে তুমি আমাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছো। অনেক খুশি লাগছে আমার। আমি জানি তুমি মুখে কিছু না বললেও আমাদের বিয়েতে তুমি সন্তুষ্ট না। আমি আমার সব দিয়ে চেষ্টা করব সারাজীবন তোমাকে সুখে রাখার।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মৃণা, “তোমার পক্ষে এই জনমে তা সম্ভব না।” মনে মনে বলল সে।
.
.
পরেরদিন সন্ধ্যায়,
মৃণার বুক কাঁপছে। গতকালই সে প্রেগন্যান্সি কিট দিয়ে টেস্ট করেছে। রেসাল্ট পজিটিভ। সে নিজে বুঝতে পারছে না সে কী চায়? প্রেগন্যান্ট হলে কী সে খুশি হবে, না দুঃখী? যদি প্রেগন্যান্ট হবার সত্ত্বেও তীর্থ তাকে আপন না করে? আর আইদকেই কী বলবে সে? আইদ এসব জানলে যে সর্বনাশ হয়ে যাবে। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। আজব দ্বিধায় পড়ে গেল সে।

অন্যদিকে আজ সকালে সে একা এসে টেস্ট করিয়েছিলো। তীর্থ আসেও নি। শুধু একজনকে দিয়ে সব ব্যবস্থা করে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন তার আসার কথা। ডাক্তারের সাথে দেখা করার কথা কিন্তু এখনো তার আসাতে দেরি। দুইবার তার নাম ডাকা হয়েছে, সে যায় নি। তৃতীয়বার ডাকার পরপরই তীর্থ এলো। তীর্থকে দেখেই খুশিতে তার মন নেচে উঠে। সে উঠে যেয়ে তীর্থকে বলে, “তোমাকে আমি কতদিন পর দেখছি। তুমি জানো আমি কতটা মিস করেছি তোমাকে?”
কথাগুলো যেন তীর্থের কানেও গেল না। সে রুক্ষভাবে বলল, “ডাক্তারের কাছে চলো।”
মনটা খারাপ হয়ে গেল মৃণার। এতদিন পর দেখা হবার পরেও কেউ এভাবে কথা বলে? কিন্তু আপাতত সে কিছুই বলল না। চুপচাপ গেল ডাক্তারের কাছে। প্রেগন্যান্সি পজিটিভ আসলো। তিনমাসের প্রেগন্যান্ট সে। ডাক্তার কতগুলো পরামর্শ দিলো মৃণাকে। সাথে কিছু ঔষধও লিখে দিলো।

তীর্থ কেবিনেও তার সাথে কোনো কথা বলল না। বের হবার পরও না। মৃণা তার সাথে কথা বলতে চাইলে তীর্থ বলে, “গাড়িতে উঠে কথা হবে।”
মৃণা চুপ করে যায়। পিছু নেয় তীর্থের। গাড়িতে উঠার পরই তীর্থের রাগ বর্ষে পড়ে তার উপর, “তোমাকে আমি বলেছিলাম বার্থ কন্ট্রোল পিল নিতে তুমি নেও নি কেন?”
কেঁপে উঠে মৃণা। সে সংকোচিত হয়ে যায়। আমতা-আমতা করে বলে, “নিয়েছিলাম তো। কিন্তু হয়ে গেছে, আমার কী দোষ?”
তীর্থ কিছুক্ষণ চুপ থাকে। তারপর হঠাৎ করে গাড়ির স্টারিং-এ ঘুষি মেরে বলে, “আমি যখনই ভাবি সব ঠিক করে দিব তখনই ঝামেলায় পড়তে হয়। ভাল্লাগে না এসব আর।”
মৃণা এখনো চুপ।
তীর্থ তাকায় মৃণার দিকে। শান্ত গলায় বলে, “যা হওয়ার হয়ে গেছে। অবরশন করিয়ে নেও।”
আঁতকে উঠে মৃণা, “কী বলছো এসব? এটা আমাদের ভালোবাসার অংশ।”
ভ্রু কুঁচকে যায় তীর্থের, “ভালোবাসার? আমাদের অবৈধ সম্পর্কের চিহ্ন। মৃণা এটা তোমার আমার দুইজনের জন্যই শ্রেয়। তোমার কী মনে হয় বাচ্চাটার কথা যদি তোমার পরিবার জানে তাহলে তারা তোমাকে আপন করে নিবে? আর আমি এক কথা বলে দিচ্ছি, যতদিন আমার সাথে কবিতার সংসার ঠিক আছে ততদিন আমি তোমার সব ইচ্ছা পূরণ করবো কিন্তু যদি তোমার কারণে আমার এবং কবিতার সম্পর্কে কোনো সমস্যা হয়, তাহলে তোমার দিকে। ফিরেও তাকাব না আমি।”
“আমি তোমার জন্য সবাইকে ছেড়ে আসতে রাজি। আর তুমি আমাকে আপন করতে রাজি না? প্রয়োজনে আমরা অন্যকোথাও যেয়ে থাকবো। কবিতা কিছুতেই আমাদের সম্পর্কে জানবে না আমি বলছি তো। তারপরও তুমি…. ”
মৃণার কথা শেষ হওয়ার আগেই তীর্থ বলল, “এই বাচ্চাটা অবরশন করিয়ে নেও, আমি তোমার স্বামীর জন্য ভালো একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিব। তোমার সংসারে আর কোনো অভাব থাকবে না। সাথে তোমার ইচ্ছা পূরণ করার জন্য তো আমি আছিই।”
“তীর্থ একটা প্রশ্ন করি?”
“হুঁ”
“তুমি কি আমাকে ভালোবাসো?”
কিছুক্ষণ চুপ থাকে তীর্থ। কিন্তু আজ প্রশ্নটা এড়িয়ে যায় না।
“ভালোবাসি। কিন্তু যতটা কবিতাকে ভালোবাসি তার আনাচে-কানাচেতেও তোমার জায়গা নেই।”
কথাটা শুনে শরীর জ্বলে উঠে মৃণার। কিন্তু সে জানে এই মুহূর্তে সে তীর্থকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে না। তাই সে বলে, “ঠিকাছে তুমি যা বলবে তেমনই হবে। কিন্তু তুমি আগের মতো আমাকে অবহেলা করতে পারবে না। আমার খুব কষ্ট হয় তুমি এমন অবহেলা করলে।”

তীর্থ হাসে। তার ধ্রুবর কথা মনে পড়ে, ” মৃণা কেবল তোর সাথে কেবল টাকার জন্য আছে। ও সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে তোর টাকাকে।”
আজ ধ্রুবর কথার প্রমাণ পেল তীর্থ। এতক্ষণ ধরে বাচ্চাটা অবরশন করার বিরোধ করছিলো, অথচ এখন তার স্বামীর জন্য ভালো চাকরি ও তার সকল ইচ্ছা পূরণের অফার দেবার পরই সে তার কথা মেনে গেল?
সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ধ্রুব ভুল বলে নি তাহলে।”
“কী বললে?”
“কিছু না।”
তীর্থ গাড়ি স্টার্ট দিলো।
.
.
মৃণা বাসায় এসে দেখে আইদ আগেই অফিস থেকে এসে পড়েছে। সে আসতেই তাকে জিজ্ঞেস করে, “কোথায় গিয়েছিলে?”
মৃণা একটু অবাকই হয়। আইদ কখনো তাকে এমন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে না। কখনো জানতে চায় না সে কোথায় গেছে। কিন্তু সে স্বাভাবিকভাবেই উওর দেয়, “রূপার সাথে দেখা করতে গিয়েছি।”
“ওহ।”
আইদকে গভীর চিন্তায় দেখা গেল। আইদ কী কোনোভাবে তাকে সন্দেহ করছে? না, এমনটা করতে দেওয়া যাবে না। তার বুকের ভেতর ভয় কাজ করলেও তা সে মুখে বুঝতে দেয় না।
মৃণা মিষ্টি করে হেসে আইদকে বলে, “আচ্ছা আগামীকাল তো তোমার ছুটি। চলো না আমরা কোথাও ঘুরতে যাই। বিয়ের পর কোথাও যাওয়া হয় নি।”
“তুমি যেহেতু চাইছ যাব।”
“তুমি যে আমাকে একটা শাড়ি উপহার দিয়েছিলে ওই শাড়িটা পরবো। তুমি বলো তো তোমার কেমন সাজ পছন্দ, তোমার মন মতো সাজবো আগামীকাল।”
মৃণার এমন কথা শুনে আইদের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি এঁকে এলো। সে দ্রুত মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো।
মৃণা বলে, “আমি একটু ক্লান্ত। আমি গোসল করে আসি।”
মৃণা চলে গেল।

কিছুক্ষণ আগে আইদকে তার এক কলিগ ফোন করেছিলো। সে গর্ভবতী বলে ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলো। গাইনি ডাক্তার। সেখানে না’কি সে মৃণাকে দেখেছে অন্য এক পুরুষের সাথে। আইদ বলেছিলো সম্ভবত সে ভুল দেখেছে। বলার পরও তার মনে খুঁতখুঁত লেগেই ছিলো। সম্ভবত মৃণার ব্যবহারে। এখন তা ভাবলেও নিজের উপর রাগ উঠে। কীভাবে এমনটা ভাবতে পারে সে? লজ্জা লাগা উচিত তার। মৃণা এদিকে তাদের সম্পর্ক ঠিক করার চেষ্টা চালাচ্ছে আর সে মৃণাকেই সন্দেহ করছে। আইদ নিজের চিন্তার উপর ধিক্কার জানালো।
.
.
পরেরদিন সারা বিকেল ঘুরাঘুরি করে আইদ ও মৃণা। প্রথমে হাতিরঝিলে যেয়ে ঘুরে আসে। তারপর সেখান থেকে যায় রেস্টুরেন্টে। রেস্টুরেন্টে খেয়ে দেয়ে দুইজনের মা বাবার জন্য খাবার নিয়ে বাসায় ফিরে তারা। বাসায় ফেরার পর আজব কান্ড ঘটলো। তারা দুইজন ঘরে প্রবেশ করতেই মৃণা এবং আইদের মা বাবা তাদের জড়িয়ে ধরে। যেন তাদেরই অপেক্ষা ছিলো। আইদের মা তো মৃণাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেয়ে বলে, “তুই এতবড় খুশির খবর আমার থেকে লুকালি কেন হ্যাঁ? এসব খবর কেউ মা বাবার থেকে লুকায়? আমি কত খুশি বুঝাতে পারব না। আমি…আমি কি বলব তাও বুঝছি না। আল্লাহ তোমাকে বাঁচিয়ে রাখুক।”
মৃণা হতবাক। কি হচ্ছে সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না।

আইদের মা এবার মৃণাকে ড্রইংরুমে নিয়ে আরামে বসিয়ে যেয়ে একটা মিষ্টির প্লেট নিয়ে আসে। মৃণাকে মিষ্টি খাইয়ে আইদকে মিষ্টি দেয়। আইদ তো মিষ্টি পেয়ে একটা হাতে তুলে নেয়। তারপর জিজ্ঞেস করে, “তোমরা কীসের জন্য এত খুশি তা তো বলো।”
আইদ মিষ্টিটা মুখে দিতে নিবে তখনই তার মা বলে, “তোর বাবা হবার মিষ্টি আর আমার দাদী হবার।”
আইদ থেমে যায়। তার মনে হলো সে ভুল শুনছে। আইদের মা তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আমাদের ঘরে আবার একটি রাজকন্যা বা রাজপুত্র আসবে। আমাকে ‘দাদি’ বলে ডাকবে। আমার তো ভেবেই সুখ সইছে না।”
আইদের যেন মাথায় কাজ করছিল না। তার এবং মৃণার মাঝে এমন কোনো সম্পর্ক এখনো তৈরি হয় নি। তাহলে মৃণা প্রেগন্যান্ট হয় কীভাবে? সে কিছু বলল না। শুধু বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মৃণার দিকে।

মৃণা যেন পাথর হয়ে গেছে। তারা কীভাবে জানলো মৃণা প্রেগন্যান্ট। ভয়ে তার জান বেরিয়ে যাওয়ার অবস্থা। সে আমতা-আমতা করে বলে, “আপনাদের কোথাও ভুল হয়েছে। আমি তো প্রেগন্যান্ট না।”
কথাটি শুনার সাথে সাথে হৈ-হুল্লোড়ের পরিবেশটি থমথমে হয়ে গেল।
তখনই মৃণার মা বলে, “আমি আজ তোর আলমারিতে তোদের বিয়ের এলবাম খুঁজতে যেয়ে প্রেগ্ন্যাসি কিটের প্যাকেট পেলাম।”
“টেস্ট করেছিলাম, নেগেটিভ এসেছে মা। তোমার সবাইকে বলার আগে আমার সাথে কথা বলা উচিত ছিলো।”
আইদ দ্রুত তার রুমে চলে গেল। তার পিছু গেল মৃণাও।।
মৃণার মা অসহায় গলায় বলে, “আসলেই দোষ আমারই। অযথা আমি সবার মনে খুশি জাগিয়ে দিলাম।”
আইদের মা তার বান্ধবীর মন খারাপ দেখে বললেন, “আরে এখানে মন খারপের কিছু নেই। ওদের বিয়ে হয়েছে কয়মাস। বাচ্চা তো পরে নেওয়া যাবে। এখন সবাই বসে মিষ্টি খাও। বাচ্চার খুশি না হলে কি হবে, আমাদের ছেলে বউ আজ প্রথম ঘুরতে গেল এই খুশিতে মিষ্টি নেও।”

মৃণা রুমের ভেতর যেতেই আইদ আর্তনাদ করে উঠে, “আমাদের মাঝে কিছু হয় নি তাহলে তোমার টেস্ট করবারই কী দরকার ছিলো?”
কেঁপে উঠে মৃণা। শঙ্কিত হয়ে যায়। সে বুঝতে পারে না কি উওর দিবে। সে জলদি করে একটি বাহানা বানাল, “ও…ওটা রূপার জন্য এনেছিলাম। ও ভাবছে যে…ও সম্ভবত প্রেগন্যান্ট। অনেক ভয়ে ছিলো তাই আমাকে বলে।”
বাহানাটার পরেও মৃণার বুকের ভেতর ভয় কমছিলো না। আইদ তার এই মিথ্যাটা বিশ্বাস করবে কি’না সে বুঝতে পারছে না।
“ওহ, সরি আমি অকারণে তোমার উপর সাথে উঁচু স্বরে কথা বললাম। না বুঝে এমনভাবে কথা বলাটা উচিত হয় নি।”
মৃণার জানে জান আসে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে হেসে বলল, “না, সমস্যা নেই। যাস্ট ভুল বুঝাবুঝি ছিলো।”
“আচ্ছা শুনো, আমার একটা কল করতে হবে অফিসের কাজে আসছি আমি।”
আইদ যাবার পর মৃণা একটু আগের ঘটনা মনে পড়ে। সবাই কত খুশি ছিল তাদের নিয়ে। একটি প্রাণ যে জন্ম নেয় নি সেও মানুষকে এতটা খুশি দিতে পারে? মৃণা তার পেটের উপর হাত রাখল। অদ্ভুত অনুভুতি হলো তার। এই পেটের ভেতর তার অংশ আছে। বুকটা কেঁপে উঠে তার। আর কেবল কয়দিন আছে এই অংশটা তার মাঝে। আগামীকাল অবরশনের জন্য ডাক্তারের সাথে কথা বলতে যাবে সে এবং তীর্থ আর ক’দিনে অবরশন করানো হবে। তার এই অংশটা এই পৃথিবীতে আসার আগেই চলে যাবে।
.
.
কবিতা গুণগুণ করে গান গেয়ে বেড়াচ্ছিলো। তার মনটা আজ ফুরফুরে। কেননা তীর্থ তার ওয়াদা রাখছে। সে আসলেই তার সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করছে তাদেরকে খুশি রাখার। সব ঠিক করার। এর থেকে বেশি কী চাই তার? গতকালও তারা ফ্যান্টাসি কিনডমে যেয়ে ঘুরে আসে বাচ্চাদের সাথে। বাচ্চাদের খুশি দেখে তার মনটাও খুশিতে ভরে গেল।

আজ রাতেও তাদের বাহিরে যাবার কথা। রাতের খাবার বাহিরে খাবে সবাই মিলে। কুহু হবার পর এমনভাবে তারা ডিনারে হয়তো কখনো যায় নি। এই ছোট ছোট প্রচেষ্টাই তার মনে হাজারো সুখ বেঁধে দেয়। তীর্থের প্রতি সকল রাগ একপাশে রেখে কবিতা আজ তীর্থের মন মতো তৈরি হয়ে নিলো। তার পছন্দের সাদা শাড়ি পরেছে কবিতা। তার গোল নয়ন দুটোয় ভরেছে কৃষ্ণ কাজল। ঠোঁটে এঁকেছে গাঢ় লাল রঙের লিপ্সটিক। দুইহাত ভর্তি শুভ্র রঙের কাঁচের চুড়ি। আর কানে রূপালী কানেরদুল। একটউ বেলির মালা আনিয়ে খোঁপাতেও বেঁধেছে সে।

কলিংবেল বেজে উঠে। তীর্থ এসেছে ভেবে সে ছুটে গেল দরজার দিকে। যাবার পূর্বে একটিবার আয়নাতে নিজের দর্শন করে নিলো। ভালোই দেখাচ্ছে তাকে। একদম তীর্থের মন মতো সেজেছে সে।

দরজা খুলে তীর্থকে পেল না সে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আইদ। তাহিরার কলিগ। তার সাথে এর আগে পাঁচ ছয়বার দেখা হয়েছে কবিতার। কিন্তু সে হঠাৎ তার বাসায় কেন এলো সে বুঝতে পারলো না। সে নম্রভাবে বলল, “আরে আইদ তুমি? ভেতরে আসো।”
“সরি আপনাকে এই সময়ে ডিস্টার্ব করলাম। কোথাও বাহিরে যাচ্ছিলেন?”
“একটু পর তীর্থ আসলে যাব। ফ্যামিলি ডিনারে যাবার কথা।”
আইদ এইবার কিছু বললো না। কবিতার পিছনে ড্রয়িংরুমে গেল সে। কবিতা তাকে বসিয়ে একগ্লাস পানি নিয়ে এলো।
“চা খাবে?”
“না আপু। একটু বসবেন, কথা আছে।”
আইদ বসলো। বিনয়ীভাবে জিজ্ঞেস করল, “তাহিরা আপুকে নিয়ে কিছু?”
আইদ মাথা নাড়ায়। তার অস্বস্তি স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে তার মুখে। সে গ্লাসটা উঠিয়ে একবারেই পানি শেষ করলো। তারপর আমতা-আমতা করে বলল, “আপু জানেন, তাহিরা আপু আমার সিনিয়র হলেও উনি আমাকে ছোটভাইয়ের মতো আদর করে। সে সুবাদে পরিবারের অনেক কথা আমাকে বলেছে। আপনার কথাও বলেছে।”
কবিতা হাসে, “তোমার কথাও বলেছে। আমি তো ভেবেছিলাম তুমি আমার ছোট যেভাবে আপু করে ডাকতে। তারপর জানলাম আমরা সেইম এইজ। তাও আপু বলে ডাকছ।”
“এমনিতেই ডাকতে ইচ্ছা করলো। আশা করি রাগ করবেন না।”
“রাগ করবো কেন? তুমি বলো।”
“তাহিরা আপুর কাছ থেকে আপনার আর তীর্থের কথাও শুনেছি। আপনি না’কি তাকে অনেক ভালোবাসেন। অনেক বেশি।”
“হঠাৎ করে এসে এই কথা জিজ্ঞেস করছো যে?”
ব্যাপারটা খুবই আজব লাগলো কবিতার কাছে তাই না জিজ্ঞেস করে থাকতে পারলো না।

“আপনি কী আজ উনার জন্যই সেজেছেন?”
“হ্যাঁ, একটু বেশি সাজ হয়ে গেছে কিন্তু প্রথমবার আমাকে শাড়িতে এভাবে দেখেই প্রশংসা করেছিলো ও। জানো ও নিজের মনের কথা খুব কম বলে। আমি প্রথমদিন ওর মুখ থেকে প্রশংসা শুনে বেশ অবাক হয়েছিলাম। আমার থেকে ওর বন্ধুরা বেশি হয়েছে। যেন এটা অসম্ভব কিছু।”
আইদ ইতস্ততভাবে জিজ্ঞেস করে, “উনি আপনাকে ভালোবাসে।”
“অনেক বেশি।”
বুক চিরে আফসোসের নিশ্বাস বেরিয়ে আসে আইদের।
“আপু আমার মৃণার সাথে বিয়ে হয়েছে। ওকে চিনেন?”
“মৃণা? ও হ্যাঁ, তীর্থের অফিসে কাজ করে ও?”
“ও প্রেগন্যান্ট।”
কবিতা উৎসুক হয়ে বলে, “বলো কী? কনগ্রেটস। ওকেও আমার পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানিও।”
আইদ কবিতার সামনে একটি কাগজ বের করে বলল, “আমি আপনার খুশিতে আগুন লাগাতে চাই না কিন্তু আপনার একথা জানা উচিত।”
“তোমার ওয়াইফ প্রেগন্যান্ট তা আমার জানা উচিত? খুশিতে আগুন? আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”
“আমার আপনার কষ্টের কথা আন্দাজও করার মতো সামর্থ্য নেই। কিন্তু আপনার এটা দেখা উচিত। এই বিষয়ে আপনি না জানলে আপনার নিজের প্রতি অন্যায় হবে। আর আমি এই অন্যায় করতে চাই না।”

কবিতা আইদের কথা কিছুই বুঝতে পারে না। সে কাগজটা হাতে নিয়ে দেখে মৃণার প্রেগন্যান্সির রিপোর্ট।
“তুমি আমাকে এই রিপোর্ট কেন দিচ্ছো?”
“স্বামীর স্থানে নামটা দেখুন।”
কবিতা চোখ বুলায় কাগজটিতে। তীর্থের নাম দেখে সে চমকে উঠে। তখনই আইদ বলে,
“মৃণার গর্ভের সন্তানই আমার না। আমাদের এখনো এমন কোনো সম্পর্ক হয় নি যে মৃণা আমার সন্তান তার গর্ভে ধারণ করতে পারবে।”
কবিতার শরীর কাঁপতে শুরু হয় রিপোর্টটা দেখে কিন্তু সে বিশ্বাস করতে নারাজ যে তীর্থ এমন কিছু করতে পারে। সে উঠে আর্তনাদ করে উঠে, “এটা ভুল, মিথ্যা। আমি…আমি জানি তীর্থ এমন কিছু করতে পারে না। বাংলাদেশে আর তীর্থ হাসান থাকতে পারে না?”
আইদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়। তার ফোন বের করে বলে, “আমার এক কলিগ ক’দিন আগে আপনার স্বামীর সাথে মৃণাকে গাইনি বিশেষজ্ঞ এর কেবিন থেকে বের হতে দেখেছে। ও আমাকে ভুলভাল বুঝিয়ে দিলো আমি বুঝে গেলাম। নিজেকে ধিক্কার দিলাম ওর জন্য এতটা খারাপ ভাবতেও। গতকাল মৃণার মা আলমারি থেকে প্রেগ্ন্যাসির কিট পেয়ে, তাও ভুল বুঝিয়ে দিলো। কিন্তু এবার আমি খোঁজ নিলাম। রাতে আমার কলিগকে কল দিয়ে ডাক্তারের খোঁজ নিয়ে আজ তার সাথে দেখা করতে যাই। তারাও না’কি আজ দেখা করতে গিয়েছে তার সাথে। বাচ্চা অবরশন করার জন্য। ডাক্তারকে আমি সব বুঝানোর পর তিনি আমাকে এই কপিটা দিলো। আর আমি আপনাকে দেখাতে চাই আমি কি দেখেছি আসার সময়।”
আইদ একটি ছবি দেখলো। গ্যারাজে নেওয়া ছবিটি। ছবিটিতে একটি মেয়ে তীর্থকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে।

ছবিটি দেখে নিশ্বাস আটকে গেল কবিতার। সে এক পা পিছাতেই সোফার সাথে পা লেগে বসে পড়ে সে। পাথর হয়ে গেছে সে। বহুকষ্টে কাঁপা-কাঁপা নিশ্বাস ফালায় সে।
বুকের ভেতর অঝোরে তুফান বয়ে গেল। সে নিশ্চিত এটা কোনো স্বপ্ন। দুঃস্বপ্ন। তীর্থ কখনো তার সাথে এমন করতে পারে না। তার মনে হলো। এই স্বপ্ন ভেঙে যাবে।
কিন্তু আফসোস!
এই দুঃস্বপ্ন থেকে সে আর জাগলো না।

চলবে…

[বিঃদ্রঃ ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। গল্পটা কেমন লাগছে জানাবেন। ধন্যবাদ।]

সকল পর্ব
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=381227816949915&id=100051880996086

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here