মুহূর্তে পর্ব-৫৬

0
1140

#মুহূর্তে
পর্ব-৫৬
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

কবিতা চুপ করে কথাগুলো শুনলো। প্রথম কথাগুলো কবিতার স্বাভাবিক লাগলেও শেষ বাক্যেই খটকা লাগে তার,”কথনের মনের সাথে খেলা করেছি?”

শিউলি রাগান্বিত স্বরে বলে, “একদম নাটক করবে না আমার সাথে। তুমি আমার ভাইয়ের জীবন নষ্ট করে দিয়েছ।”
“আপু আপনি কি বলছেন আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”
“বুঝতে পারছো না? আমার ভাইকে এত কষ্ট দিয়েও তুমি বুঝতে পারছ না তুমি কি করছ?”

কবিতা মাথা নাড়ায়। শিউলি কবিতার হাত ধরে টেনে নিজের সাথে নিয়ে যায়। গাড়িতে করে কথনের বাসার সামনে এসে থামে। তারপর কিছু সময়ের জন্য উপরে যেয়ে ফিরে আসে। কবিতার হাতে একটি ডায়েরি দিয়ে বলল, “তাহলে এটা পড়ে বুঝো আমি কথাগুলো কেন বলছি। আর খবরদার আমার ভাইয়ের আশেপাশে আসার চেষ্টা করবে না। তোমার জামাই তোমাকে ছেড়ে দিয়েছে বলে আবার আমার ভাইকে নিজের পিছনে ঘুরানোর যে পরিকল্পনা করছো তুমি তা বাদ দিয়ে দেও।”
কবিতা খানিকটা লজ্জাবোধ করে শিউলির এমন কথায়, “আপু এমন কিছু না আমি শুধু কাব্যকে নিতে….”
“কাব্য? কাব্য তোমার ছেলে?” বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে শিউলি।
“জ্বি। আপনারা জানেন না?”
শিউলি নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রন করার যথেষ্ট চেষ্টা করল। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কবিতাকে বলে, “কথন আমাদের বলেছে কাব্য ওর বন্ধুর ছেলে। দেখ কবিতা আমার তোমার বিয়ের কথাটা বলা ঠিক হয় নি। কিন্তু তুমিও বুঝ তোমার কারণে কথনের জীবন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ওর বিয়ের বয়স পাড় হয়ে যাচ্ছে কিন্তু ও বিয়ে করছে না। আমাদের পুরো পরিবার ওকে নিয়ে অনেক চিন্তিত। দয়া করে ওর থেকে দূরে থাকো। আমি তোমাকে অনুরোধ করছি।”
কবিতা সংকোচ নিয়ে বলল, “আপু আপনি ভুল বুঝছেন। কথন এবং আমি কেবল ভালো বন্ধু। আপনি সম্ভবত ভুল বুঝছেন। কথন আমাকে না, অন্য এক মেয়েকে ভালোবাসে। সে আমাকে ওই মেয়ের কথা বলেছে।”
“আর তার নাম কি?”
কবিতা দ্বিধায় পড়ে গেল। কথন কখনো মেয়েটার নাম বলে নি তাকে। সে কি বলবে বুঝতে পারে না। শিউলি বলে, “তুমি এখন হাস্পাতালে না যেয়ে এই ডায়েরিটা পড়ো আমি যা বলতে চাচ্ছি তুমি নিজেই বুঝে যাবে।”
কবিতা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে। তার কথানুযায়ী শিউলি তাকে তার শপে দিয়ে আসে। জায়গাটার কাজ শেষ। দুইদিন পর শপের ওপেনিং হবে। তাই এখনো কেউ নেই। এখানে আসবাবপত্র ছাড়াও কিছু নেই। আজ সন্ধ্যা থেকে সব পণ্য আনা হবে। তাই নীরবে এসে ডায়েরি পড়া শুরু করে কবিতা।

“মেয়েটা আস্তো এক পাগল। পাগল বললেও ভুল হবে। পাগলের দাদী। প্রথম দিনই তার প্রমাণ পেয়ে গেছি।”
এতটুকু পড়েই কবিতা মুখের বিকৃতি ঘটে। সে গম্ভীর মনোভাব নিয়ে ডায়েরিটা পড়া শুরু করেছিলো আর শুরুতেই পড়ে তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “সাহস কত বড় আমাকে পাগল বলার। আমি এত শান্ত, শিষ্ট, ভদ্র একটা মেয়ে ছিলাম আমাকে পাগল বলতেছে, বেয়াদ্দব একটা। নিজে পাবনার পাগলখানার পাগলের… পাগলের কিছু একটা।”

কবিতা আবারও ডায়েরি পড়া শুরু করে,
“প্রথমদিনই মাথার বারোটা বাজায় দেয় আমায়। এরপর জানি এই পাগল মেয়েটাকে আমার সাথে বিয়ের করানোর চিন্তায় আছে সবাই। ওই পাগল মেয়েছে আমার জন্য যে বাছাই করলো সবার মাথার তার কী ছিঁড়ে গেছে না’কি? অবশ্য মেয়েটা এতও খারাপ না। মনের ভালো আছে। কথাবার্তাও মিষ্টি। গতকাল আমাদের বাসায় আসার পর যেন সবাই ওকে ছাড়া কিছু বুঝেই না। আমার নিজের ঘরেই অতিথির মতো ফিল হচ্ছিল। মেয়েটা আমাকে অনুরোধও করলো, আমি যেন তাকে নিয়ে কবিতা লিখি। লেখার চেষ্টা করছি, হচ্ছে না। তবে অদ্ভুত ব্যাপার ঘটলো আজ। ও নিজের নবীনবরণের জন্য শাড়ি পরে সেজেছিলো। ওকে একবার দেখার পর চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। দেখে মনে হচ্ছিল শুভ্রপরীকে দেখছি। মুহূর্তের জন্য আমার গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছিল না। দৃষ্টি আটকে পড়ে সামনে দাঁড়ানো শুভ্রপরীর উপর। হৃদয়ে অদ্ভুত এক কম্পন জাগলো।
কবিতা যখন আমায় জিজ্ঞেস করে, “দেখুন আজ আমি প্রথম শাড়ি পরলাম। আর জেবা আপু কত সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে আমাকে। কেমন লাগছে আমাকে?”
আমি তখন বলতে চাইছিলাম, ‘স্নিগ্ধ, পবিত্র এবং আসমান থেকে নেমে আসা হুরপরীর মতো লাগছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত তোমার হাসি দেখে পরীও লজ্জা পাবে।’ কিন্তু কথাটা বলতে পারছিলাম না। কেমন লজ্জা লাগছিলো। দ্বিধাবোধ হচ্ছিলো। আগে তো কখনো এমন হয় নি। আমি সবসময়ই সরাসরি কথা বলার মানুষ। তাহলে আজ হঠাৎ এমন কেন হলো?”

~কথন
২১.০৮.২০১৩

“ডায়েরির দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় আজ লিখছি। অথচ লেখাটা একই মানুষের জন্য। আমার ডায়েরি লেখাটা তেমন পছন্দের নয়। আর বিশেষ কোনো মানুষের জন্য তো একদমই নয়। তবুও লিখছি। আজ আমার সিনিয়র মারা যাবার পর তার বাসায় গেলাম সব কলিগরা মিলে। সেখানে পেলাম কবিতাকেও। ওকে আজ প্রথম কাঁদতে দেখেছিলাম। ওর কান্না কেন যেন বিষাক্ত লাগছিলো আমার কাছে। একদম সহ্য হচ্ছিলো না। অবশেষে এই না অসহ্য হবার কারণটা আমার জানা নেই। সম্ভবত কান্নাটা তার ব্যক্তিত্বের সাথে যায় না একারণে? কে জানি? তবে এতটুকু বলব তার হাসিটা আমার অত্যন্ত প্রিয়। ও হাসলে বাতাসে অন্যরকম অনুভূতি ছড়িয়ে যায়। খুব মিষ্টি দেখায় ওকে। মায়াবী দেখায়।
‘মিষ্টি তোমার হাসি মায়ায়
ভুলেছি আমি এই পৃথিবী,
এই জগৎ
এবং জগতের প্রমোদ ছায়া।’
ছিঃ! কি বাজে একটি ছন্দ লিখলাম। এই ছন্দ মেয়েটাকে শোনালে সম্মান রাখবে না সে। ভালো কিছু ভাবতে হবে।”

~কথন
২৫.০৮.২০১৩

“আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, আমি এই তিনবার একই মেয়ের জন্য ডায়েরিটা লিখছি। তবে না লিখে পারলাম না। এটা আসলে একটু আজব। অন্যরকম। সবার থেকে আলাদা। খানিকটা মিষ্টি, একটু বদমেজাজী। এক বন্ধুর বিয়েতে গিয়েছিলাম। মা’য়ের কথায় ওকেও নিয়ে যেতে হলো। সেখানে যেয়ে উর্মি আমাদের একসাথে দেখে শুরু করল অন্য নাটক। কবিতাকে উল্টাপাল্টা কিছু কথাও বলছিলো। আমার রাগ উঠলেও অন্যের অনুষ্ঠানে এসে কিছু বলতে পারছিলাম না। কিন্তু কবিতা চুপ রইলো না। উল্টো উর্মিকে জবাব দিয়ে তার মুখ বন্ধ করে দিলো। ওর এমন রূপ দেখে আমি ইম্প্রসই হয়েছি। তবে কথা শুনিয়েও তার রাগ কমে নি। সে অনুষ্ঠান ছেড়ে চলে গেল। আমার সব ছেড়ে যেতে হলো তার পিছনে। সে রাতে ঝুম বৃষ্টি নামল। সে লাল রঙের একটি পোশাক পরেছিলো। অন্ধকার জাগতে বিদ্যুৎ চকমকানোর মাঝে একটা ভয়ানক সৌন্দর্যের দর্শক হয়েছি আমি। তার কাজলমাখা চোখদুটো বৃষ্টির মাঝে লেপ্টে যাচ্ছিল। সে লেপ্টে যাওয়া কাজলভরা চোখদুটো দেখে আমার হৃদয় দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলো। আচ্ছা আমি কী তার প্রেমে পড়ে যাচ্ছি?”

~কথন
২২.১১.২০১৩

“জবা বিয়ের আগে ফটোশুট করতে যাবে বলে অস্থির হয়ে ছিলো। আমাকেও জোর করে নীল পাঞ্জাবী পরিয়ে নিলো। একপ্রকার বাধ্য করল আমাকে নীল পাঞ্জাবিটা পরতে। তখন কারণটা আমি জানতাম না। জানলাম কিছুক্ষণ পরে। জবা কবিতার বাসার সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে তার অপেক্ষা করছিলো। আমার সামনে দিয়ে দরজা থেকে বেরিয়ে এলো আসমানী। আমি চেয়েও চোখ সরাতে পারছিলাম না। কবিতা পড়েছিল আসমানী রঙের শাড়ি এবং রূপালী রঙের গয়না। হাল্কা সাজ। সে হাল্কা সাজেই তাকে এত রূপবতী দেখাচ্ছে। আমি তাকে দেখে চোখ সরাতে পারছিলাম না। বেহায়ার মতো হা করে তাকিয়ে ছিলাম। জবা আমাকে বড় একটা লজ্জা দিলো এরপর খুব কষ্টে চোখ সরালাম। তবুও সারারাস্তা গাড়ির আয়নায় কেবল তাকেই দেখছিলাম। ফটোশুটের সময় জবা আমাকে কবিতার সাথে ক’টা কাপল পিক তোলার জন্য জোর করল। মুখে বিরক্ত হলেও মনে মনে খুব খুশি ছিলাম। সেদিন প্রথম ওকে এতটা কাছে থেকে দেখলাম। ওর কাজলমাখা চোখ দেখে নিশ্বাস নিতে ভুলে যাচ্ছিলাম। আচ্ছা আমি কি না চাওয়া সত্ত্বেও ওকে ভালোবেসে ফেলেছি?
তুমি চুপি চুপি আরও কিছু গল্প বলে যাও
আমি শুনবো নীরবে
তুমি আমার স্বপ্নজগতে এসো
আমি ডুবে থাকব তোমার কাজলমাখা কৃষ্ণনগরীতে।

আচ্ছা এই ছন্দটা কী কবিতাকে শুনাবো? নাহ, থাক।
কিছু অনুভূতি নিজ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখা উচিত।

~কথন
১২.১২.২০১৩

কবিতার ফোন বেজে উঠলো। কথন ফোন করছে তাকে। সম্ভবত সে এসেছিলো জেনেছে কথন। সে কল ধরে। কিন্তু কথা বলতে পারছিলো না সে। কথন তাকে ভালোবাসে। এতবছর ধরে ভালোবেসে এসেছে। এতবছর ধরে তাকে না পেয়েও অন্যকাওকে বিয়ে করে নি। একথা সে বিশ্বাস করতে পারছিলো না। তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না।

“হ্যালো কবিতা, তোমার না আসার কথা ছিলো কাব্যকে নেওয়ার জন্য?” ফোনের ওপাশ থেকে কথন বলে। কবিতা কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে, “আপনি কি কাব্যকে বাসায় দিয়ে উওরার শপে আসতে পারবেন একটু?”
“তোমার কন্ঠ এমন শুনাচ্ছে কেন? তুমি ঠিক আছো তো?”
“আপনি আসুন।”
“ওকে ওকে, আমি আমার ডিউটি প্রণয়কে করতে বলে আসছি। রাস্তায় কাব্যকে বাসায় দিয়ে আসব।”
“হঁ”
কবিতা ফোন কেটে দিলো। আবছা দৃষ্টিতে তাকাল ডায়েরির দিকে। ডায়েরিতে শত পৃষ্ঠার মতো লেখা আছে। প্রতিটি পৃষ্ঠায় তার গল্পই লেখা। সে সবগুলো পড়েও না। পড়তে পারে না। কেমন অস্বস্তি লাগে তার। অপরাধবোধ হয়। গুণে গুণে পঁচিশটার মতো পৃষ্ঠা পড়ে। তারপর শেষ পৃষ্ঠা পড়ে,

“তুমি সে চাঁদ যাকে দূর থেকে ভালোবাসা যায় কিন্তু তাকে ছোঁয়ার সাধ্য আমার নাই। তুমি আমাকে ভালোবাসো নি কবিতা। কেন ভালোবাসো নি?”

শেষ পৃষ্ঠাটা সেদিনের লেখা যেদিন কবিতা তাকে তীর্থের কথা বলেছিলো। কবিতার ভীষণ কষ্টের অনুভূতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে তার বুকের ভেতর কামড়ে ধরে রেখেছে কেউ। কথন এতবছর যার জন্য অকারণে অপেক্ষা করে এসেছে সে মেয়েটা কবিতাই? এত বছর ধরে কি করে কোনো স্বার্থ ছাড়া কথন তাকে ভালোবাসতে পারে? বিনিময়ে কিছু না চেয়ে? তাকে পাবে না জেনেও।

কবিতা চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করতেই চোখের কোণা দিয়ে এক বিন্দু অশ্রজল বয়ে পড়ে। ভীষণ অবাক হয় কবিতা। তার অপরাধবোধ হওয়াটা মানা গেলেও কথন তাকে ভালোবাসে এই জেনে তার এত কষ্ট হচ্ছে কেন? সম্ভবত এই অপূর্ণ ভালোবাসার কষ্ট অনুভব করেছে এই কারণে। বুক পুড়ে, জ্বলে, শূন্য লাগে নিজেকে। তবুও কিছু করা যায় না। নিরুপায় থাকি আমরা। এই অসুখের ঔষধ নেই যে। আছে তো কেবল বেদনার নিবাস।

কবিতা বিড়বিড় করে বলে, “আমারও আর কাওকে ভালোবাসার সাধ্য নেই কথন। একবার ভালোবাসা পেয়ে হারিয়ে দেখেছি। সহ্য করেছি হৃদয়ক্ষরণ। আর এই কষ্ট সহ্য করার সাহস আমার নেই। তুমি আমাকে ভালোবাসতে পারো না। এভাবে অপেক্ষা করতে পারো না। তোমার অন্যকাওকে ভালোবাসা উচিত। না আমি আর কখনো অন্যকাওকে ভালোবাসতে পারবো, আর না ভালোবাসায় বিশ্বাস করতে পারবো। আমি এখন অনুভূতিহীন। প্রেম নিবাসে আর চরণ রাখার চেয়ে নির্বাসনে যাওয়াটায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করব আমি।”

কিছুক্ষণ পর রুম প্রবেশ করে কথন। দরজা খুলে অবাক হয়ে বলে, “তুমি একা কী করছো কবিতা? আর এত তাড়াহুড়ো করে ডাকলে যে?.”
কথন একগাল হেসে কক্ষে প্রবেশ করছিল, কিন্তু যে মুহূর্তে কবিতার হাতে তার ডায়েরিটি দেখলো তার ঠোঁটের হাসি মলিন হয়ে গেল। মুখে ছড়িয়ে পড়লো ভয় ও চিন্তার ছাপ। কবিতার কাছে এই ডায়েরিটা এলো কীভাবে?

*আগামী দুইদিনও একটানা গল্প দিব।*

চলবে…

[বিঃদ্রঃ ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। গল্পটা কেমন লাগছে জানাবেন। ধন্যবাদ।]

সকল পর্ব
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=381227816949915&id=100051880996086

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here