মুহূর্তে শেষ পর্ব-

0
1951

#মুহূর্তে
পর্ব-৫৮
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

সে মুহূর্তেই কেউ একজন তার চোখের উপর হাত রাখে। কানের কাছে মুখ এনে মুগ্ধতা ভরা গলায় বলে, “তোমার কাজলমাখা নয়নে আমার প্রাণ আসে যায় কিন্তু সে নয়নে আমার জল সহ্য হয় না।”

কবিতা তার চোখের সামনে থেকে হাত সরিয়ে পিছনে ফিরে তাকায়। কথনকে দেখে অবাক হয় সে, “আপনি এখানে কি করছেন?”
“অনু পাঠাল। বলল আমি এসে যেন তোমার খেয়াল রাখি। এখন মনে হচ্ছে ওর কথাটা মেনে ভুল করি নি প্রয়োজন ছিলো।” কথন তীর্থের দিকে তাকিয়ে বলল। তার দৃষ্টি কঠিন। কবিতার মনে পড়ে এর আগেও দুজনে মারামারি করে একে অপরকে আহত করেছিল তাই সে কথনের হাত ধরে সেখান থেকে নিয়ে যায়।

তীর্থ কথনকে কবিতার সাথে দেখে ক্রোধিত হয়। সে হাত শক্ত করে মুঠো করে নেয়। তার চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। মাথায় রক্ত উঠে যায় তার। তার পাশে থেকে নদী বলে, “আপনি ওদিকে কেন যাচ্ছেন? আপনাদের মাঝে তো সব শেষ। কবিতা ভাবি…মানে কবিতা অন্যকারো সাথে হাত ধরে ঘুরছে। উনি মুভ অন করেছে। আপনারও এখন করা উচিত। আন্টি আমার সাথে আপনার বিয়ে ঠিক করেছে রাজি হয়ে যান। একবারে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
নদী হাসিমুখে কথাগুলো বলে। তীর্থ কঠিন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতেই তার মুখের হাসি উড়ে যায়। ভয়ে বুক কেঁপে উঠে তার। সাথে সাথে সে হাত ছেড়ে দেয়। তীর্থ কবিতার দিকে যায়।

কবিতার কাছে যেতে নেবার সময় মাঝ রাস্তায় তীর্থ তার পুরনো এক বিজনেস পার্টনারের সাথে দেখা হয়। ঠিক বিজনেস পার্টনার বললে ভুল হবে। ব্যবসায়ের শুরুর দিকে থেকে কাঁচামাল নিতো সে। খুব ভালো সম্পর্ক ছিলো কিন্তু কিছু কারণে তা আর থাকে না।
“আরে মিস্টার তীর্থ, কেমন আছেন?”
“জামাল সাহেব আপনি? আপনাকে যখন কল দিয়েছিলাম আপনার এসিস্ট্যান্ট বলল আপনি না’কি ঢাকার বাহিরে।”
জামাল সাহেব হেসে বলে, “আপনি হয়তো বার বার ফোন দিয়েছিলেন। এতবার ফোন দিলে সে এমনই বলে।”
তীর্থ লজ্জা বোধ করে। কিছুটা সংযত হয়ে বলে, “আমি একটু কাজের কথা বলার জন্য কল দিয়েছিলাম।”
“আমার সাথে কাজের কথা? আমার মতো ছোট ব্যবসায়ীর সাথে আপনার কি কাজের কথা থাকতে পারে? আপনি না বলেছিলেন, আপনি আমার মতো ছোট ব্যবসায়ীদের হাতের মুঠোয় রাখেন। আমরা তো আপনার সামনে বসারও যোগ্য না। আপনার কারখানায় তো সব দামী দামী কাঁচামাল আসে। ওহ আপনার তো ব্যবসা একদম ডুবে গেছে। খবরটা শুনেছিলাম। তো বলেন কি কথা বলবেন।”

তীর্থ লজ্জায় কিছুক্ষণ চুপ থাকে। সে আগে কারও সামনে এভাবে এত লজ্জা পাবার পরও অনুরোধ করে নি। কিন্তু তার কিছু করার নেই। কম দামে ভালো কাঁচামাল তার কাছেই পাওয়া যায়। তাই প্রয়োজনে তার এমনটা করতেই হবে। তারপর বলে, “আমি আপনার কাছ থেকে ক্ষমা চাচ্ছি। আমার আপনার সাথে এমন ব্যবহার করা উচিত হয় নি। আমরা কি অতীত ভুলে আবার একসাথে কাজ শুরু করতে পারি না।”
“বুঝলে তীর্থ আমার বয়স তো কম হয় নি। তোমার মতো এমন অনেককে এই জীবনে দেখেছি। কাজের সময় সবাই খুব নমনীয়তার সাথে কথা বলে। কিন্তু যখন একটু উন্নতি করে তখন তার মাঝে একপ্রকার অহংকার এসে পড়ে। সে নিজেকে খুব বড় মনে করতে থাকে। অহংকারে অন্ধ হয়ে যায়। আমি তোমার বাবার বয়সের ছিলাম তারপরও তুমি আমাকে যেভাবে অপমান করলে তা আমি কীভাবে ভুলে যাই বলো? মানুষের এক বাজে স্বভাব আছে জানো? খানিকটা উন্নতি করলে নিজেকে মহান ভাবতে শুরু করে। আকাশে উড়তে শুরু করে। কিন্তু তারা এটা ভুলে যায় যে আকাশে উড়াল দেবার পর যখন জমিনে এসে পড়ে তখন তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। এমন মানুষ নিজের ভিত্তি ভুলে যায়। তুমিও ভুলে গিয়েছিলে। তুমি বয়সে ছোট বলে ক্ষমা করে দিতে পারি কিন্তু তোমার সাথে আর কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব না।”
জামাল সাহেব যেতে নিলেই তার কাছে অনুরোধ করে বলল, “আংকেল আমি ক্ষমা চাচ্ছি তো। দয়া করে আরেকটা সুযোগ দিন।”
“দেখ আমি আগের থেকেই কয়েকজনের সাথে কাজ করছি। এর মধ্যে একজনের কাছে আমার অধিকাংশ কাঁচামাল যায়। তাই অন্যকাওকে দেবার মতো পণ্য হবে না। মেয়েটা আমাকে অনেক সম্মান করে। গত কয়বছরে অল্প থেকে শুরু করে অনেক বড় হয়েছে অথচ আজও আমার সাথে সে প্রথমদিনের মতো আময়িকভাবে কথা বলে। এখন তাকে কমিয়ে দিয়ে তো আমি তোমাকে দিতে পারি না। ওই’যে মেয়েটা।”
জামাল সাহেব তীর্থকে হাতের ইশারায় কবিতাকে দেখাল। তীর্থ কবিতাকে দেখে আর কিছু বলে না। চুপ করে যায়। জামাল সাহেব বলে, “আমি আসি। পরে কথা হবে।”

জামাল সাহেব সেখান থেকে কবিতার কাছে যায়, “আরে কবিতা মামনী কেমন আছো? তোমাকে এমন উদাসীন দেখাচ্ছে কেন?”
কবিতা জামাল সাহেবকে দেখে জোরপূর্বক হেসে বলে, “না আংকেল এমন কিছু না। আপনি বলেন কেমন আছেন? আর আন্টি কেমন আছে?”
“আমি তো ভালো। তোমার আন্টিও বেশ ভালো আছে। তোমার কথা ওদিন জিজ্ঞেস করছিলো।” জামাল সাহেব কথনের দিকে তাকিয়ে আবার জিজ্ঞেস করে, “উনি তোমার হাসবেন্ড?”
কথাটা শুনে কথনের মন উড়ু উড়ু করলেও কবিতা ছটফট করে বলে দেয়, “না না আংকেল।”
“তাহলে বয়ফ্রেন্ড? মাশাল্লাহ একসাথে অনেক মানায় তোমাদের। বিয়ে করছ কবে?”
কথন ঝটপট উওর দেয়, “ও যেদিন রাজি হয়।”
কবিতা আড়চোখে কথনের দিকে তাকিয়ে কনুই দিয়ে তার পেটে মারল। আর জামালকে বলল, “আংকেল এমন কিছু না। ভুল ভাবছেন আপনি। উনি আয়ার বন্ধু হয়।”
জামালসাহেব হাসে, “যা ভাবছি তা তো ঠিকই মনে হচ্ছে। আর ভুল হলে ঠিক করে নিও। দুইজনকে একসাথে অনেক মানায়।”
“আহ আংকেল মনের কথা বলে দিলেন।” কথন একগাল হেসে বলে। কবিতা অগ্নিদৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতেই কথন চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। আরো কিছুক্ষণ কথা বললেন জামান সাহেব। তারপর চলে গেলেন। তার যাবার পর কথন কবিতাকে বলে, “দেখলে মানুষ তোমার আমার জুটিকে কত পছন্দ করেছেন। কেবল তোমারই পছন্দ হয় না।”
কবিতা বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে। সাথে সাথে কথন ঠোঁটে আঙুল রেখে বলে, “ঠিক আছে চুপ করলাম, নাহয় রাগে জংলী বিড়ালের মতো কখন খামচে দেও কে জানে।”
“আপনাকে তেমনই করা উচিত। গত সাপ্তাহ থেকে অনেক জালাচ্ছেন। আপনাকে বললাম বিয়ের জন্য অন্য মেয়ে দেখতে। আপনি বসে বসে আমাকে দেখেন।”
“ছিঃ ছিঃ আমি আমার বউ ছাড়া অন্যকারো উপর নজর দেই না।”
“উফফ বিরক্তিকর।” কবিতা কাঁদোকাঁদো গলায় বলে। কথনও তাকে ভেঙিয়ে একইভাবে বলে, “উফফ বিরক্তিকর।”
কবিতা বিরক্ত হয়ে মুখ ফুলিয়ে সেখান থেকে চলে যায়।

কথন হেসে তার পিছনে যেতে নিয়েছিলো। কিন্তু সে দেখে তীর্থ তার দিকে এগিয়ে আসছে। কথন তার সামনে যেয়ে দাঁড়ায়, “তুমি কবিতার কাছে কেন যাচ্ছ?”
কথনকে দেখে তীর্থের গা জ্বলে উঠে, “তোমার কী?”
“তুমি না কবিতার কাছে যেতে পারবে, আর না না ওর সাথে কথা বলতে পারবে।”
এবার মাথায় রক্ত উঠে যায় তীর্থের, “আর একথা বলার তুমি কে? কোন অধিকারে তুমি এই কথা বলছো?”
“হয়তো আমার কোনো অধিকার নেই। কিন্তু ওকে এত কষ্ট দেবার পর ওর সাথে কথা বলারও অধিকার হারিয়ে ফেলেছ তুমি। কীজন্য কথা বলতে চাও? ওর যন্ত্রণা আবারও মনে করাতে? তোমার বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনী মনে করাতে?”
কথাটা শুনে একটু দেবে গেল তীর্থ। সে আর কিছু বলতে পারলো না। কথন আবারও বলল, “আমি কয়েক বছর আগে ওকে তোমার কাছে ছেড়ে গিয়েছিলাম। তুমি ওকে সামলে রাখতে পারো নি। আমি এতবছর পর যখন ওকে হাস্পাতালে দেখেছিল ওকে আমি চিনতেও পারি নি। আগের কবিতাকে কোথাও পাই নি। ও কোথায় যেন হারিয়ে গেছিল। ওর হাসি, ওর চঞ্চলতা, ওর স্বপ্ন সব ছিনিয়ে নিয়েছ তুমি। বহু কষ্টে ও আবার ফিরে আসছে। প্লিজ ওর কাছে যেয়ে আর ওর কষ্ট বাড়িও না। যদি এক মুহূর্তের জন্য হলেও কবিতাকে আসলে ভালোবাসো তাহলে ওর থেকে দূরে থাকো।”
কথাগুলো বলেই কথন কবিতার কাছে চলে গেল। তার যতটুকু বলার ছিলো, সে বলেছে। বাকিটুকু তীর্থের উপর।
.
.
তীর্থ আর অনুষ্ঠানে থাকলো না। সেখান থেকে চলে এলো। বাসায় এসে নদী তাকে নানান প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে,
“সেখানে থেকে এভাবে এসে পড়লেন কেন? আপনার এক্স-ওয়াইফকে দেখে? আপনি এখনও ওর কথা ভাবেন?”
তীর্থ উত্তর দেয় না। সে যেয়ে সোফার উপর বসে থাকে। নিস্তব্ধ। তার মা-ও জিজ্ঞেস করতে থাকে, “কি’রে তোরা এত জলদি চলে আইলি কেন? সেখানে না কোন ব্যবসায়ীদের লগে কথা কইতি কাজের লাইগা।”

নদী রাগে ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলল, “তার এক্স-ওয়াইফকে দেখে চলে এসেছে।”
“মানে কবিতা? কবিতাও সেখানে গেছে?”
“জ্বি, আরও অন্য ছেলের হাত ধরে ঘুরছিল। আর এদিকে আপনার ছেলে আমাকে ইগনোর করছে, রাগ দেখাচ্ছে। আমাকে তার কি মনে হয় হ্যাঁ?”
তীর্থের মা নদীর কাঁধে হাত রেখে বলল, “থাক মা রাগ কইরো না। ওই একটু এমনই। তুমি শান্ত হইয়া বসো, আই তোমার লাইগা পছন্দের কিছু রান্না করে আনি।”
নদী তীর্থের মা’কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলে, “দূরে সরেন। আপনি যে এসব নাটক এখন করছেন তা আমি ভালো করেই বুঝতে পারছি। আপনাকে আমার মা ঠিক বলে দুই মুখা মানুষ। কাজ থাকলে মুখে অমৃত, কাজ শেষে বিষ। আপনার ছেলেকে আমি পছন্দ করতাম বলে বাবা বিয়ে জন্য রাজি হয়েছেন। নাহলে এমন কী আছে তার কাছে? আমার বাবা তার ব্যাবসায়ের জন্য টাকা দিতে রাজি তাও কি ঢং করছে! আমি তাকে বিয়ে করতে চাচ্ছি এটা তার ভাগ্য।”

তীর্থ দাঁড়িয়ে আর্তনাদ করে উঠে, “কে বলেছে তোমাকে করতে? তোমাকে কে বলেছে বিয়ে করে ধন্য করতে আমাকে?”
তীর্থের চিৎকার শুনে ভয়ে চুপ হয়ে গেল নদী। তীর্থের মা তার পাশে যেয়ে বলে, “এভাবে বলিস না বাবা। তোর ব্যবসা শেষ হয়ে গেছে রে। এখন খাওয়ার কিছু না থাকলে এই বাড়ি বেঁচতে হইবো। চুপ কর। চুপ কর।”
কথাটা শুনে সাহস পায় নদী। সেও বলে, “সেটাই। নিজের মা’য়ের কথা শুনুন, নাহয় দুইদিন পর পথের ফকির হয়ে যাবেন। আপনার বাজে স্বভাবের কারণেই তো কবিতা আপনাকে ছেড়ে এত খুশিতে আছে।”
তীর্থের চোখের সামনে ভেসে উঠে কবিতা এবং কথনের হাতধরা দৃশ্য। মাথায় রক্ত উঠে যায় তার। সে সামনে থাকা কাঁচের টেবিলটা এক লাথি দিয়ে ভেঙে ফেলে। রাগে তার চোখ লালচে হয়ে গেছে। সে আঙুল তুলে বলে, “খবরদার কবিতাকে এর মাঝে আনলে একদম খুন করে ফেলব। আমি আর একবারও যেন তোমাকে আমার চোখের সামনে না দেখি।”

তীর্থ নিজের রুমে চলে এলো। রাগে পায়চারি করতে লাগলো সারাটা রুমে। কিন্তু রাগ কমলো না। তার চোখের সামনে শুধু কবিতা চেহারা ভাসছে। সে প্রথমদিন তাকে দেখা থেকে তার ছেড়ে যাওয়া পর্যন্ত। কেমন শূন্য লাগছে বুকের ভেতর। তার বাচ্চাদের কথাও আজ খুব মনে পড়ছে। কুহু এবং কাব্যকে প্রথম কোলে নেবার অনুভূতিটা মনে পড়ছে। কেন সে এভাবে নিজের সুখের সংসারটা ধ্বংস করে দিলো? মুহূর্তেই শেষ করে দিলো সবটা। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখলে হয়তো আজ তার কাছে তার কবিতা থাকতো। তার বাচ্চারা থাকতো। কেন করল সে এমন পাপ? কেন? কেন? কেন?

তীর্থ রাগে দিশেহারা হয়ে গেল। এক এক করে রুমের সব ভাঙতে শুরু করলো। তার মা দরজায় ধাক্কা দিচ্ছিল। সে দরজা খুলে না। মেঝেতে বসে পড়ে সে। তার হাত দিয়ে কাঁচ আটকে আছ। রক্ত ঝরছে। চোখ দিয়ে অশ্রুজল বইসে তার। তার চোখের সামনে ভেসে উঠে সে তুফানের রাতে মৃণার মাঝে বিলীন হওয়াটা। সে ধ্বংসের মুহূর্তটা কী তার জীবন থেকে মুছে যেতে পারতো না?
.
.
“অনু তোর ভাইয়ের সাথে ডেটে গেছে।” কবিতা বাসাতে এসে তাহিরার কাছে অনুর কথা জিজ্ঞেস করতেই এই উওর পায়। সে হাসে, “সারাক্ষণ একসাথে ঘুরেফিরে জিজ্ঞেস করলেই বলছে, আমাদের মাঝে এমন কিছুই নেই।”
তাহিরা এবং কথন হাসে কথাটা শুনে। বিশেষ করে কবিতার বলার ভঙ্গি দেখে। কবিতা বলে, “তোমরা বসো, আমি চা নিয়ে আসছি।”
কবিতা সবার জন্য চা বানিয়ে আনে। অন্যদিকে কথন তাহিরার সাথে তার চিকিৎসা নিয়ে কিছু কথা বলে। কবিতা ফিরে আসার পর কুহু মুখ ফিরিয়ে বলে, “মা আংকেল আমাকে গল্প শুনতে দেয় না। খা’মণি আমাকে গল্প শুনায়। আংকেল খা’মণির সাথে কথা বলে।”
কাব্য পড়ছিলো। সে কুহুর কথা বলে, “আংকেল তো জরুরী কথা বলে। গল্প তো পড়ে শুনতে পারবে তুমি।”
কুহু মুখ ফুলিয়ে নেয়, “ভাই পঁচা। আংকেল পঁচা। সবাই পঁচা। আমি গল্প শুনবো। খা’মণি গল্প শুনাবে।”
কথন কুহুর গাল টেনে বলে, “আংকেলও কুহুর সাথে গল্প শুনবে। কুহু তো আংকেলকে কত ভালোবাসে।”
“না। কুহু একা শুনবে। যা যা।”
কথনকে ধাক্কা দিতে দিতে উঠায় কুহু। কথন কবিতার দিকে তাকিয়ে বলে, “তোমার মেয়ে আমাকে দুই পয়সারও ইজ্জত দিলো না। চলো ছাদে যাই।”

আকাশে আজ চন্দ্রিমার রশ্মি তীব্র। কথন ও কবিতা ছাদে উঠে দাঁড়ায়। কবিতা বলে, “আজ জ্যোৎস্না চারপাশে ছড়িয়ে আছে।”
“জ্যোৎস্নার কথা বাদ দেও। মেয়েটা তো একদম তোমার মতো হয়ে গেল এখন?”
“আমার মেয়ে আমার মতো হবে না?”
কথন মুখ লটকিয়ে নেয়, “এটাই তো সমস্যা। এখন তোমার সাথে সাথে ওকেও পটাতে হবে। কাব্য তো এক’পায়ে তৈরি থাকবে আমাকে বাবা করার জন্য। তোমার থেকে এখন আমাকে পছন্দ করে ও।”
কবিতা হেসে চায়ের চুমুক দিয়ে বলে, “আপনাকে হাজার বলেও লাভ নেই। এক কথা বারবার বলতে হয়রান হন না?”
“তোমাকে এত বছর ধরে ভালোবেসে হয়রান হই নি, বলে হয়রান হবো?”
কবিতা চা’য়ে চুমুক দিতে যেয়েও থেমে যায়। তার চায়ের কাপ ছাদের বর্ডারের উপর রেখে তাকায় কথনের দিকে। তার হাসিটা মলিন হয়ে যায়। সে করুণ চোখে তাকায় কথনের দিকে, “আপনি দয়া করে আমাকে ভালোবাসা ছেড়ে দিন।”
কথন কিছু মুহূর্ত কবিতার দিকে তাকিয়ে থেকে হেসে উঠে। যেন বিষয়টা ভীষণ মজার। কবিতার রাগ উঠে এই দৃশ্য দেখে, “আমি ফাজলামো করছি না।”
কবিতার এমন রাগ দেখে কথন হাসি থামায়। সে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি এঁকে কবিতার সামনে এসে ঝুঁকে তার মুখোমুখি হয়। চোখে চোখ রাগে। নরমসুরে বলে,
“তোমাকে ভালোবেসে এই জীবন নির্বাসন করে দিতে পারব, তোমাকে ভালোবেসে নিজেকে দিশেহারা করে দিতে পারব, তবুও তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না।”
কবিতা কথনের চোখ থেকে চোখ সরাতে পারে না। কথনের এমন গভীর দৃষ্টিতে যেন হারিয়ে গেল সে। হঠাৎ তার বুক কেঁপে উঠে। চোখ সরিয়ে নেয় সে, “আমাদের মনে হয়, আমরা এক বিশেষ ব্যক্তিকে ছাড়া কখনো বাঁচতে পারবো না। কথাটা ভুল। সবাই বাঁচে। হয়তো ভালোও থাকে। কেবল মনের দিক থেকে অসুস্থ হয়ে পড়ে।”
কথন কবিতাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে তার দুই হাত নিজের হাত নিয়ে আলতো করে ধরে। তার ছলছলে চোখে আবারও চোখ রাখে, “আমি আমার মনকে সুস্থ রাখতে চাই, তোমারও।”
“আমার পক্ষে আর সম্ভব না কথন। আমার মনের পক্ষে ভালোবাসাটা অসম্ভব। আর আমি তো একা নই, আমার জীবনে আরও দুইজন আছে।”
“আমি তোমার আগে তাদেরকে আমার জীবনে রাখবো। তাদের কখনো বাবার কমতি অনুভব হতে দিব না। ওয়াদা করছি।”
“এমন সবাই বলে।”
“সবাই চোখে চোখ রেখে মিথ্যা বলতে পারে না।”
কবিতা চমকে উঠে, “আমি তাদের জীবনের এত বড় সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারি না।”
“আমি অপেক্ষা করবো।”
“আর কত?”
“তোমার জন্য হলে আমার সারাজীবনের অপেক্ষাও কম পড়বে।”
কবিতার ঠিক এই মুহূর্তেই নিজের অতীতের সিদ্ধান্ত নিয়ে আফসোস হলো। ঠিক এই মুহূর্তেই তার মনে হলো কেন সে কথনকে বাছাই করে নি? কথন কেন তাকে নিজের মনের কথা বলে নি?
তার নয়ন দিয়ে অশ্রুজল বয়ে সে। সে রাগে কথনের কলার ধরে তাকে জিজ্ঞেস করে, “এত ভালোবাসলে কেন আমার কাছে ভালোবাসার কথা স্বীকার করেন নি? আপনাকে আমি একটি কবিতার আবদার করেছিলাম, আপনি সম্পূর্ণ ডায়েরি আমার নামে লিখেছেন, তা দেখান নি কেন? যখন আমি আপনাকে বললাম যে আমি অন্যকাওকে ভালোবাসি তখন কেন আপনি এভাবে আমাকে আপন করার জেদ করেন নি? কেন?”
কবিতা রাগে কথনের বুকে মারতে থাকে। কথন কিছুই বলে না। সে নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কবিতার দিকে। সে আচমকায় কবিতার দুই গালে হাত রেখে বলে, “কারণ আমি প্রতি মুহূর্তে কেবল তোমার সুখ চেয়েছিলো। আমার ভালোবাসা এতটা স্বার্থপর নয় যে তোমার খুশি ছিনিয়ে তা পাবার চেষ্টা করবো।”
আকস্মিক ভাবে কবিতা শান্ত হয়ে যায়। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কথনের দিকে। তবুও তার বুকের যন্ত্রণা কমে না। মুহূর্তের জন্যও না। আজ আসমানের বুকে ভেসে থাকা কেন্দ্রবিন্দু চন্দ্রিমা তাদের উপর জ্যোৎস্নার বর্ষণ করছে।
.
.
“খা’মণি গল্প শেষ কেন? রাজকুমার কী তাহলে রাজকন্যাকে বিয়ে করে নি?” কুহু আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে তাহিরাকে। কাব্য পাশেই বসে পড়ছিল। সে বিরক্ত হয়ে বলল, “এই রাজকন্যা, রাজকুমারী বাদ দিয়ে স্কুলের পড়া পড় তো। এসব গল্প দিয়ে কিছু হয় না।”
কুহু মুখ ফুলিয়ে তাকায় কাব্যের দিকে, “ভাইয়া তুই চুপ। তুই ভালো না। পঁচা। কুহুও রাজকন্যা হবে।” কুহু আবার তাহিরাকে জিজ্ঞেস করে, “খা’মণি গপ্পের কী রাজকন্যা রাজকুমারকে বিয়ে করেছে?”
তাহিরা কুহুকে কোলে নেয়, “তুমি রাজকন্যা হবে?”
কুহু দ্রুত মাথা নাড়ায়।
তাহিরা হেসে তার গালে চুমু খেয়ে বলে, “রাজকন্যা হতে হলে রাজকুমারকে বিয়ে করতে হয় না। আর তুমি রাজকন্যা হবে না। তুমি হবে রাণী। যেন কোনো রাজকুমার তোমাকে কষ্ট না দিতে পারে। তোমার মা’য়ের মতো শক্ত হবে। নিজের পা’য়ে দাঁড়াবে। নিজের সাথে অন্যদের কথা ভাববে। নিজের সাথে অন্যেরও সাহস হবে।”
“উঁহু খা’মণি গপ্পের কথা বলো না। গপ্পে কী তারা বিয়ে করেছে? তারা কী জীবন একসাথে কাটিয়েছে? তাদের কী ভালো এন্ডিং হয়েছে?””
তাহিরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে মলিন হাসি ঠোঁটে এঁকে চোখ বন্ধ করে বলে, “জীবনে হ্যাপি এন্ডিং অথবা স্যাড এন্ডিং বলতে কিছু নেই। জীবন চলমান। এর গল্প কখনো শেষ হয় না। প্রতিটি মানুষের জীবনের এক গল্প আছে। প্রতিটি গল্পের চরিত্র আছে। জীবন যেমন প্রতিটি মুহূর্তে বদলায় তেমন জীবনে থাকা চরিত্র বদলায়, সম্পর্ক বদলায়, জীবনের কাহিনীও বদলায়। তোমার জীবনের গল্পের সমাপ্তি কখন হয় জানো? যে মুহূর্তে তুমি তোমার শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করো ঠিক সে মুহূর্তেই তোমার জীবনের গল্পের সমাপ্তি ঘটে।”

সমাপ্ত।

[বিঃদ্রঃ ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। গল্পটা কেমন লাগছে জানাবেন। ধন্যবাদ।]

সকল পর্ব

https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=381227816949915&id=100051880996086

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here