#শুভ্র_বর্ষণ
#প্রভা_আফরিন
#বোনাস_পার্ট
দরজা জানালার ফাক ফোকর দিয়ে হুহু করে প্রবেশ করা উত্তরের ঠান্ডা বাতাস জানান দিচ্ছে শীত জেঁকে বসেছে। পৌষের সমাপ্তি আসন্ন। কুয়াশা ঠেলে রক্তিম সূর্য কোমল আভা নিয়ে পূর্ব দিগন্তে উঁকি দেওয়ার সাথে সাথেই শোভা শীতের অলসতা ঠেলে ব্যস্ত পায়ে পুরো বাড়ি ছুটে বেড়াচ্ছে। গায়ে জড়ানো কালো জমিনে লাল সুতোর ডিজাইন করা কাশ্মীরি শাল। তবে সেই শাল ওর শরীর থেকে মাটিতেই শোভা পাচ্ছে বেশি। ছোটাছুটির ফলে বারবার গা থেকে খুলে পড়ছে। শোভা রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখলো হালিমা খুটুরমুটুর করছে। শোভা একটু আগে যা যা নোংরা করেছে সেগুলো পরিষ্কার করছে। শোভা মুচকি হেসে ফিরে আসতে গিয়ে ধাক্কা খেলো। পায়ের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বললো,
“কি ব্যাপার! এই শীতের মাঝে এভাবে পায়ে পায়ে ঘুরছিস কেনো তুই? কিছুদিন আগেই না ঠান্ডায় কাশতে কাশতে নিজের সাথে আমাদেরও ঘুম হারাম করে দিয়েছিলি, ভুলে গেছিস?”
শোভার কথা শেষ হতেই উপর থেকে ডাক এলো,
“শোভা! শোভা!”
শোভা ব্যস্ত পায়ে উপরে ছুটলো। গায়ের শাল নিচেই রইলো। বেডরুমের কাছে গিয়ে বললো,
“সকাল সকাল ষাঁড়ের মতো চেচাচ্ছেন কেনো? আমি কি কানে কালা?”
“বারান্দার দরজা ফাক করে রেখেছো কোন আক্কেলে? বাচ্চাগুলো যে এই রুমেই আছে খেয়াল করেছো? এমনিতেই বড়টার ঠান্ডা সেরেছে মাত্র। ছোটগুলোর লাগলে সামলাতে পারবে তো?”
শোভা জিভ কেটে আশেপাশে নজর বুলিয়ে বিছানায় দিকে দৃষ্টি স্থির করলো। কম্বলের নিচে কিছু নড়াচড়া করছে। শোভা মিষ্টি হেসে বললো,
“খেয়াল করিনি। সরি!”
রিয়াদ চোখ ছোট ছোট করে তাকালো। এই মেয়ে নিষ্পাপ হাসি দিয়ে মানুষকে পটানোর ঐশ্বরিক ক্ষমতা নিয়ে এসেছে বোধহয়। নাকি সে একাই পটে! ভাবনাটা এগোলো না বেশিক্ষণ। রিয়াদ আবার সরু চোখে শোভাকে মাথা থেকে পা অবধি খেয়াল করলো। খ্যাক করে উঠলো সাথে সাথে।
“তোমার শীতের পোষাক কোথায়? এভাবে পাতলা জামা পড়ে ঘুরছো কেনো? সবার শরীরের খেয়াল রাখার দায়িত্ব কি আমার একার?”
শোভা দৌড়ে আসার ফলে গরম লাগছিলো, তাই শালের খেয়াল করেনি। কোথায় পড়েছে খোজার জন্য পেছনে তাকাতেই দেখলো মুখ দিয়ে শাল টেনে আনছে টফি। নিচে ওর সাথে ধাক্কা লেগেই শালের দিকে খেয়াল করেনি শোভা। এগিয়ে গিয়ে টফির মুখ থেকে শাল নিয়ে গায়ে জড়ালো সে। টফি লাফিয়ে বিছানায় উঠে গেলো। শোভা বারান্দার বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়ানো রিয়াদের কাছে গিয়ে নিজের ঠান্ডা হাত জোড়া ওর গালে চেপে ধরলো। রিয়াদ ছিটকে সরে গিয়ে চোখ গরম করে তাকালো। শোভা পাত্তা না দিয়ে আবারো এগোলো ওর দিকে। এতোক্ষণ কম্বলের বাহিরে থাকায় রিয়াদের হাতও ঠান্ডা হয়ে গেছে। তাই সে এবার সরে না গিয়ে নিজের ঠান্ডা হাতজোড়া শোভার চাদরের নিচে জামা ভেদ করে পেটে স্পর্শ করলো। শোভা ঠান্ডায় কেপে উঠে দুমদাম রিয়াদের বুকে কিল বসিয়ে দিলো। রিয়াদ হেসে ওর হাত চেপে ধরে বললো,
“অন্যকে জ্বালাতে তো বেশ লাগে। এবার নিজেও একটু বোঝো। বাই দ্যা ওয়ে, সকাল সকাল ছোটাছুটি করছো কেনো?”
শোভা হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গিতে মাথা দুলিয়ে বললো,
“আজকে না আমরা হাসপাতালে যাবো আপুকে আনতে! তাই একটা ওয়েলকাম কেক বানাচ্ছি। এখন ওভেনে বেক হচ্ছে।”
রিয়াদ ওর গাল টিপে দিয়ে বললো,
“বাহ! সবার বেলা দেখছি সবই মনে থাকে। যত ভুলো মনা শুধু এই অধমের জন্য।”
“কারণ আমার একটা জ্যান্ত রিমাইন্ডার আছে। যে আমার এবং তার সব প্রয়োজন সময়মতো মনে করিয়ে দেয়।”
কম্বলের নিচে ইতোমধ্যে হুটোপুটি শুরু হয়ে গেছে। শোভা এগিয়ে গিয়ে কম্বল সরিয়ে দিতেই তিনখানা শান্তশিষ্ট লেজবিশিষ্ট মুখ ভেসে উঠলো। শোভা ভালো করে খেয়াল করতেই দেখলো ওর বালিসে নখের একাধিক আচড়ে বালিসের কভার ফুটো হয়ে গিয়েছে। তা দেখে দাতে দাত চেপে বললো,
“শিয়ালের দল, আমার বালিসের কি হাল করেছিস?”
টফি প্রতিবাদ স্বরূপ ডেকে উঠলো। সে নিজে শিয়াল ডাক পছন্দ করলেও তার বাচ্চাদের কেউ শিয়াল ডাকবে তা পছন্দ করে না। টফি যেন শোভার বিরুদ্ধে রিয়াদের কাছে নালিশ করলো এমন ভাব করে রিয়াদের সামনে গিয়ে ডাকলো। রিয়াদ শোভার কাছে গিয়ে বললো,
“এটা কিন্তু ভারী অন্যায় শুভি। ওদের বাবা কিন্তু শিয়াল ডাক টা পছন্দ করছে না। এরপর যদি আবার এই ছানাগুলো বাবা আমার কাছে নালিশ ঠুকে তাহলে কিন্তু তুমি শাস্তি পাবে। তাইনা টফি!”
টফি সম্মতিসূচক লেজ নাড়লো। ততক্ষনে বাকি দুইজন শোভার গায়ের সাথে লেগে মোচড়া মুচড়ি শুরু করে দিয়েছে। হলুদ লেজবিশিষ্টের নাম ক্যান্ডি এবং অপরজন লজেন্স, যার দেহে বেশিরভাগই সাদা পশমে আবৃত। সাদা ও হলুদ মিশেল গায়ের রঙটা হলুদ বাবা এবং সাদা পশমি মায়ের থেকে পেয়েছে ওরা। এখন ওদের বয়স তিনমাস। এক বছর আগে যখন দীর্ঘ তিন বছরের প্রেমের অবসান ঘটিয়ে রিয়াদ ও শোভা পরিণয়ে আবদ্ধ হয় তখনই টফির প্রেমিকার সন্ধান মেলে। একই এলাকার একটা পালিত সাদা পশমি কুকুর, নাম ডোরা। রিয়াদের বউভাতে তার দেখা পায় টফি। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে বেচারা প্রেম করেছে। দুইজোড়া বাচ্চার জন্মও দিয়েছে। যার একজোড়া টফির কপালে জুটেছে। ডোরা এখন আর এই এলাকায় নেই। তার মালিক তাকে নিয়ে অন্য শহরে পাড়ি জমিয়েছে। টফি নিজের ছেলেমেয়ের সাথে বেশ আছে এখন। তিন মাস্তানকে নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটে আরিফ সাহেবের পরিবারের।
বেলা বাড়ার সাথে সাথে কুয়াশার প্রকোপ কমে এসেছে। বোনকে ওয়েলকাম করার জন্য শোভার রেড ভেলভেট কেক রেডি। হালিমা সকালের কাজ সেরে এখন আনোয়ার সাহেবের বাড়িতে গেছেন। শোভার বিয়ের পর হালিমার হয়েছে যত জ্বালা। মেয়েরা কেউ বাড়ি থাকবে না বিধায় কাজও তেমন নেই। সেই জন্য হালিমাকে এক বছর আগে শোভার শ্বশুর বাড়িতে কাজ করতে পাঠিয়ে দিয়েছেন শিরীন বেগম। টুকটাক কাজ দুই ননদ-ভাবী মিলেই করে ফেলতে পারবেন।
কিন্তু এতদিনের মায়া কি আর ভুলতে পারে হালিমা! তাই দুই বাড়িতেই টুকটাক কাজ সেরে দেয় সে। যখন শিরীন বেগম বলেন,
“হালিমারে একটু তেল মালিশ করে দে না কোমড়ে। ইদানীং ব্যথা ব্যথা লাগে।” কিংবা সুমা বেগম যদি বলেন, “দেওয়ালে ঝুল জমছে, একটু ঝেরে দিস।”
সেই সময় হালিমার মুখ ছোটে। একা একাই গালাগাল করতে থাকে শিরীন এবং সুমা বেগমকে।বলে,
“বুইড়া দুই বেডি, কয়দিন পর কবরে যাইবো আবার কাম করার কত্তো শখ। ক্যান! আমারে না কইছেন আমার কাম আর লাগবো না! তাইলে অহন লাগে ক্যান? উচা হইয়া ঝুল ঝাড়তে পারেন না? কোমড়ে ব্যথা করার সময় এই হালিমার কথা মনে পড়ে?”
হালিমার মুখে যা আসে তাই বলে। সুমা বেগম এবং শিরীন বেগম থামান না, তর্ক করেন না। বরং তাদের ভালোই লাগে। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে বাড়িটা কেমন খা খা করে। যদিও শোভা দিনের মাঝেই তিন-চারবার দুই বাড়িতে দৌড়াদৌড়ি করে। তবুও মায়েদের মন এতো অল্পতে কি তৃপ্তি পায়!
মিহাটাও সাত মাস হতে চললো আসে না। আজ আসবে অনেকদিনের জন্য। সেই নিয়ে সকাল থেকে আনোয়ার সাহেবের বাড়ি মেতে আছে।
রিয়াদ আজ অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে। ছুটি নেওয়া রিয়াদের কাছে কমন একটা ঘটনা হয়ে দাড়িয়েছে প্রণয় এবং পরিণয়ের চার বছরে। প্রেম শুরু হবার পর শোভার হুটহাট বায়নায় কারণে-অকারণে কতবার যে ছুটি নিতে হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। প্রথম চাকরিটা শোভার পাগলামির পেছনে সময় দিতে গিয়ে খোয়াতে হয়েছে। দ্বিতীয়টায়, ভাগ্যিস বসের বিশ্বস্ত এবং প্রিয় ব্যক্তি বলে চাকরিটা এখনো টিকে আছে। বিয়ের আগে তিন বছরে দুজনের মেলামেশা কেয়ারিং দেখে এলাকার সকলেই জেনে গেছিলো শোভা এবং রিয়াদের প্রণয়ের সংবাদ। সকলেই প্রায় আশ্চর্য হয়েছিলো রিয়াদের মতো ডিসেন্ট একজনকে শোভার মতো খেয়ালি পনা মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়াতে দেখে। আনোয়ার সাহেব নিজেও মেয়ের কান্ড জেনে অবাক হয়েছিলো। প্রথম প্রথম একটু নিমরাজি ভাব থাকলেও পরে সকলের নীরব সম্মতি দেখে সম্পূর্ণ মেনে নেন তিনি। দুজনের আংটিবদল করে একটা সামাজিক স্বীকৃতি দিয়ে রাখেন।
রিয়াদ যখন সকালের খাবার শেষে রুমে ঢুকলো মুহূর্তেই মেজাজ তাওয়ার গরম হয়ে গেলো। ওর গোছানো রুম, যেটা টফি, ক্যান্ডি এবং লজেন্সও অগোছালো করে না সেটায় শোভা একাই ছোটখাটো ঘুর্ণিঝড় চালিয়ে দিয়েছে। শোভা আয়নার সামনে ব্যস্ত ভঙ্গিতে চুল আচরাচ্ছে। এখানে জামা, ওখানে জুতা। মেকাপ এবং অর্নামেন্টস তো বাদই। নিশ্চয়ই আলমারিটা আবার ঘেটেছে। রিয়াদ এগিয়ে গিয়ে বললো,
“তুমি কি শোধরাবে না? মানুষ এতোটা অগোছালো হয় কি করে? যেখানে বাড়ির বউ ঘর সংসার সামলায়, সেখানে আমার বউ আউলায়। দিস ইজ হরিবল, উফফ!”
“এতোদিকে তাকাচ্ছেন কেনো? আমিতো কিছু মনে করছি না। আপনিও করবেন না তাহলেই হয়। মনে করেন আমরা দুইজন ব্যাচেলর। আর ব্যাচেলরদের বাড়ি একটু এলোমেলো হয়।”
“আমি ব্যাচেলর হলেও পরিপাটি ব্যাচেলর হবো। এমনি এমনি কি আর আমার ওপর ক্রাশ খেয়ে হা করে থাকতে নাকি! আমার এই সুন্দর স্বভাবের জন্যই কিনা মেয়েরা পাগল।”
শোভা চুপ হয়ে গেলো। এই একটা যায়গায় সে কথার উত্তর দিতে ব্যর্থ। সে যে রিয়াদকে আগে পছন্দ করতো এটা নিয়ে রিয়াদ প্রায়ই সুযোগ বুঝে খোচা দেয়। শোভাকে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রিয়াদ আবার বললো,
“এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে দেখবে হাসপাতালে যাওয়ার আগেই মিহা বাড়িতে চলে এসেছে। এতো অলস কেনো যে তুমি! বিরক্তিকর।”
“ওওওও! এখন বিরক্তিকর হ্যা! আমি তো পুরোনো হয়ে গেছি। তাই আমার কিছুই আর ভালো লাগে না। থাকবোনা এখানে। বাপের বাড়ি চলে যাবো।”
রিয়াদ মুখ বেকিয়ে তাচ্ছিল্য করে বললো,
“অ্যাহ! একই পাড়ার বউ আবার বাপের বাড়ির ভয় দেখায়! তোমার বাড়িতে তোমার থেকে আমারই কদর বেশি। তাই ওসব ইমোশনাল কথা ছেড়ে দাও।”
বাকি পুরোটা সময় শোভা গাল ফুলিয়ে রইলো। রিয়াদের সাথে একটা কথাও বললো না। রিয়াদও আর ঘাটলো না। আজ বোধহয় পাগলীটাকে একটু বেশিই রাগিয়ে ফেলেছে।
হাসপাতালে পৌঁছে শোভা মিহার গায়ে ঝাপিয়ে পড়লো। দুইদিন যাবত মিহা হাসপাতালে রয়েছে। একটা নতুন প্রাণ পৃথিবীতে এনে মেয়েটা একদম দুর্বল হয়ে পড়েছে। কন্যা সন্তানের জননী হয়েছে সে। মিহার মতোই মিষ্টি একটা মেয়ে। শোভা প্রতিদিনই হাসপাতালে আসছে। কিন্তু বাচ্চাটাকে কোলে নিতে ভয় হয়। আজ সাহস করে কোলে নিতেই মুখ কুচকে কান্না জুড়ে দিলো নবজাতক। শোভা ভয় পেয়ে সাথে সাথেই আবার নিশান্তের কোলে দিয়ে দিলো। নিশান্ত হেসে বললো,
“একি শোভা! তুমি না ওকে পেলে পুষে নিজের মতো বানাবে? এভাবে ভয় পেলে তো হবে না।”
রিয়াদ মাঝখান থেকে বলে উঠলো,
“সাবধান ভাইয়া। বাচ্চাটা ওর সান্নিধ্যে বড় হলে আরেকটা শোভা তৈরি হবে। একটা শোভাই আমার জীবন তেজপাতা করে তুলছে। দুই বাড়ির মানুষকে জ্বালিয়ে মারছে। আরেকটা হলে এবার আপনার শান্তশিষ্ট বাড়িটাও যাবে।”
রিয়াদের কথায় সকলে বিস্তর হাসলো। শোভার রাগের উনুনে আরো একটু জ্বালানি পড়লো যেন। চোখ দিয়েই রিয়াদকে শাসালো। রিয়াদ অবশ্য পাত্তা দিলো না।
বাচ্চা কোলে মিহা যখন আনোয়ার সাহেবের বাড়িতে ঢুকলো, সাথে সাথেই উৎসব মুখর পরিবেশে ছেয়ে গেলো বাড়িটা। সুমা বেগম মিহার কপালে চুমু খেয়ে বাচ্চাটা কোলে নেয়। মিহার পুরো প্রেগ্ন্যাসির সময় তিনি একফোটা যত্নও করতে পারেননি মেয়েকে। নিশান্তের পরিবার এক মুহূর্তের জন্য মিহাকে ছাড়েনি। বরং সুমা বেগমের থেকে ঢের ভালো যত্ন নিয়েছেন। মিহার প্রতি বেশি যত্নের একটা কারন ফাইজাও। প্রথমবার ছেলের জন্মের পর দ্বিতীয়বার যখন কনসিভ করে তখন ফাইজার মিসক্যারেজ হয়ে যায়। যার ফলে মিহার ক্ষেত্রে নিশান্ত যত্নের সামান্যতম ত্রুটি রাখেনি, আর না তার পরিবার রেখেছে। মেয়ে জামাইয়ের কথা ভাবলে সুমা বেগমের গর্বে বুকটা ভরে ওঠে।
নিশান্ত নিজেই মেয়ের নাম রাখলো ‘মিঠি’। মিষ্টি মিহার মিষ্টি মেয়ে মিঠি। নিশান্ত যতবারই মেয়েকে কোলে নেয়, ততবারই অপলক তাকিয়ে থাকে। এখনো অবাক লাগে ভাবতে যে ও বাবা হয়েছে। ওরও একটা রাজকন্যা আছে। আর প্রায় প্রতিবারই মিহাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহারটি দিয়ে আমায় তুমি আবারো তোমার কাছে দুর্বল করে দিলে।”
মিহা মুচকি হাসে। লোকটা চিন্তায় কয়েকদিন ভালোমতো ঘুমাতেও পারেনি। নিশান্তের কপালে চুমু খেয়ে বলে,
“দুর্বলতা নয়, আপনার শক্তি হয়ে থাকতে চাই বাকিটা জীবন।”
নিশান্ত মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে। প্রেগ্ন্যাসির শুরু থেকেই এক অন্যরকম সৌন্দর্য ভর করেছে মেয়েটার মাঝে। এতো ধকলের পরও যেন ভাটা পড়েনি তাতে।ও মেয়ে-বউকে বুকে জড়িয়ে রাখে। সুখী হতে আরকি লাগে। শুধু একে অপরের ছোটখাটো বিষয়গুলো সম্মান দিয়ে, ভালোবেসে তার সবটা গ্রহনের মাঝেই মিষ্টি একটা সম্পর্ক পূর্ণতায় রূপান্তর হয়।
_________
কুয়াশাচ্ছন্ন রাতের আকাশে ধোয়াটে চাঁদ বিরাজ করছে। শীতল পরিবেশে কফি হাতে ক্রোধবিলাশে ব্যস্ত শোভা। হাতের রুবি পাথরের হিরের আংটি টা দেখছে আর কফিতে চুমুক দিচ্ছে সে। আংটিটা রিয়াদ পড়িয়েছিলো বিয়ের দিন। এরপর একদিনের জন্যও খোলা হয়নি। রিয়াদের ওপর রাগ হলে আংটিকেই ঝারে সে। সকাল থেকে রিয়াদ ওকে অনেকভাবে ক্ষ্যাপিয়েছে। যার ফলে আজ বাবার বাড়িতে নিজের বরাদ্দকৃত রুমের বারান্দায় বসে চাঁদ দেখছে এবং রিয়াদকে মনে মনে ঝারছে সে। এত রাত হয়ে গেলো তবুও সরি বলতে এলো না! যাবেই না ওই বাড়িতে আর।
ইংলিশ মম অবশ্য একবার এসেছিলো। শোভাকে চোখে হারান তিনি। শোভার জন্য স্পেশালি আজকে কমলার চপ বানিয়েছিলেন তিনি। শোভা তা দেখে খুব কষ্টে রাগ চেপেছে। বিয়ের পর কোষ্ঠকাঠিন্য আক্রান্ত না হলেও ইংলিশ মমের পাল্লায় পড়ে ডায়রিয়া হয়েছে অনেকবার।
রাত বাড়তেই বারান্দা ছেড়ে বিছানায় গেলো শোভা। ফোন চেক করে দেখলো একটা ফোন বা ম্যাসেজও আসেনি। অভিমান পাহাড়ের চূড়া স্পর্শ করলো এবার। জেদ ধরে শুয়ে পড়লো সে।
চোখ যখন লেগে এসেছে গালে ঠান্ডা হাতের স্পর্শে লাফিয়ে উঠলো শোভা। পিটপিট করে চোখ মেলতেই পর্দায় গুনধর স্বামীর সুদর্শন মুখখানা ভেসে উঠলো। দাত কেলিয়ে শোভাকে জড়িয়ে ধরলো রিয়াদ। ঠান্ডা শরীরের স্পর্শে কেপে উঠলো শোভা। হাতে পর পর কিল বসিয়ে বললো,
“ছাড়ুন বলছি। চৌম্বকের মতো লেগে আছেন কেনো?”
“ছাড়বো বলে ধরেছি নাকি?”
“আমায় কেনো ধরবেন! আপনার টিপটপ জীবনকে অগোছালো করে দিয়েছি আমি। আপনার ঘর সামলানোর বদলে বিগড়ে দেই। তাহলে আমাকে কেনো ধরবেন আপনি? যান না যান, মনের মতো কাউকে খুজে নিন।”
“বলছো? খুজবো? পরে কাদবে না তো?”
শোভা রিয়াদের টিশার্ট খামছে ধরলো। বললো,
“ওহ! আমি বললেই খুজবেন? আমায় মানাবেন না? থাকবোই না আপনার সাথে।”
“আমায় ছাড়া থাকতে পারবে বুঝি?”
“খুব পারবো।”
“ঠিক তো!”
শোভা নিরুত্তর। রিয়াদ হাসলো। শোভার গালে নাক চেপে ধরে বললো,
“পারবে না। এই যেমন আমিও পারলাম না। তোমাকে ক্ষ্যাপাতে ভালো লাগে আমার। তা কি বোঝো না, হুম! পাগলীটার এই অভিমানী মুখ যে আমার প্রিয় তা কি জানো না!”
রিয়াদের আহ্লাদী কন্ঠে শোভার রাগ গলে গেলো। দুজনে একে অপরকে জড়িয়ে ধরতেই তিন মূর্তি খাটের নিচ থেকে বেড়িয়ে খাটে উঠে পড়লো। শোভা খেয়াল করলো ক্যান্ডিকে সাজানোর চেষ্টা করা হয়েছে। রিয়াদ চেষ্টা করেছে বোঝাই যাচ্ছে। ক্যান্ডি মেয়ে, লজেন্স ছেলে। যার ফলে শোভা ক্যান্ডিকে সাজিয়ে রাখে সবসময়। বাকি দুজন পিটপিট করে তাকিয়ে থাকে শুধু। তিনজন ছুটে এসে শোভাকে ঘিরে ধরলো। শোভা বললো,
“তাইতো বলি! কি যেন মিসিং লাগছে। এদের হুটোপুটি মিসিং ছিলো। এখন মনে হচ্ছে এটা সত্যিই শোভার ঘর।”
রিয়াদ ক্যান্ডিকে কোলে নিয়ে বললো,
“হ্যা, আমার অগোছালো মিষ্টি ঘর এবার পরিপূর্ণ।”
_________সমাপ্ত_______