#ভালোবাসি তাই
part:27
Writer:Afifa Jannat Maysha
🍁
এই হাসপাতালে আছি আজ প্রায় বাইশ দিন হতে চললো। এখানের প্রতিটি দিন ছিলো দমবন্ধকর। বন্দী পাখির মতো ছটফট করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলো না আমার। এতোকিছুর মাঝেও সায়ন ভাইয়ার কেয়ারনেস দেখে অবাক হয়েছি শুধু। যেই উনি আমায় সহ্য করতে পারতেন না সেই উনি এখন আমায় চোখের আড়াল হতে দেন না যেনো। আমার কি লাগবে না লাগবে সবকিছুর খেয়াল রেখেছেন উনি। এমন কোনো দিন যায়নি যেদিন উনি হাসপাতালে আসেননি ।
রাহুল ভাইয়ার খোঁজ পাওয়া যায়নি এখনো। পুলিশ হন্ন হয়ে খোঁজে চলেছে উনাকে। আমিও অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছি কোনদিন উনি ধরা পরবেন সে আশায়। শাস্তি দেওয়ার কথা পরে আগে তো আমায় জানতে হবে ঠিক কি দোষে এতো বড় ক্ষতি করলেন উনি আমার।
মুখের ব্যান্ডেজ খোলা হবে আজ। সে নিয়েই ডাক্তারদের মাঝে প্রচুর ব্যাস্ততা। আমি চুপচাপ বসে বসে মনে শক্তি যোগার করছি। কারণ আজ যে খুব বড় একটা ধাক্কা খেতে হবে আমায়। সেটা আমি ঠিকই বুঝতে পারছি। এতোদিন তো কত কত এসিড ভিকটিমদের দেখতাম আর দুঃখ প্রকাশ করতাম। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে আজ আমি নিজেই একজন এসিড ভিকটিম। একয়দিনে একচোখে দেখে দেখে অভ্যেস হয়ে গেছে আমার। বা চোখের উপর ব্যান্ডেজ থাকায় ডান চোখ দিয়েই দেখতে হয় সব।
আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে সারা আর সায়ন ভাইয়া।বাকি সবাই কেবিনের বাইরে। সারার মাঝেও যে ভয় কাজ করছে সেটা তাকে দেখেই বুঝতে পারছি আমি। কিন্তু আজ তার ভয় কাটানোর মতো অবস্থা আমার নেই। তাই আমিও চুপ করে বসে আছি।
– মা, তুমি রেডি তো?
ডাক্তার চাচার এই কথায় বুকটা ধক করে উঠলো। সারা গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেছে। সাহস যোগাতে শক্ত করে চেপে ধরলাম সারার হাত। সেও চোখের ইশারায় ভরসা দিলো আমায়। হঠাৎ কোমড়ে কারো স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠলাম আমি। পাশে তাকিয়ে দেখি আমার কোমড় চেপে দাঁড়িয়ে আছেন সায়ন ভাইয়া। উনার চোখে চোখ পড়তেই আমার আরেকটু কাছে এসে দাঁড়ালেন উনি। ধীর কন্ঠে বলে উঠলেন
– ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সব ঠিকই হবে ইনশাআল্লাহ।
– কিন্তু আমার তো ভয় হচ্ছেই। চাইলেও স্বাভাবিক থাকতে পারছি না আমি।
আমার কথায় বড় একটা শ্বাস নিলেন সায়ন ভাইয়া। আমায় সম্পুর্ন উনার দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন
– আমার চোখের দিকে তাঁকা। একটানা তাঁকিয়ে থাকবি। অন্য কোনো দিকে যেনো নজর না যায়।
সায়ন ভাইয়ার আদেশ অনুযায়ী উনার চোখের দিকে স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম আমি। কেমন যেনো নেশা ধরে যাচ্ছে আমার। উনিও তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। আমি আগেও সায়ন ভাইয়ার চোখের দিকে তাঁকিয়ে থেকেছি কিন্তু তখন এমন অনুভূতি হয় নি। কারণ তখন উনি আমার দিকে তাঁকাতেন না। আর তাকালেও সে দৃষ্টি আজকের মতো শান্ত হতো না।
– এখনো ভয় করছে?
সায়ন ভাইয়ার প্রশ্ন কানে আসতেই ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলাম আমি। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য এখন আর আগের মতো ভয় করছে না আমার। তাই আমি মাথা নেড়ে জানান দিলাম যে ভয় করছে না আর।
– গুড। এবার বল তুই রেডি তো?
– হ্যাঁ। যা হওয়ার হবে।
সারা আর সায়ন ভাইয়াকে আমার কাছ থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো। একটা চেয়ারে গুটিশুটি মেরে বসে আছি আমি। ডাক্তার চাচা মুচকি হেঁসে আমায় ভয় না পেতে আশ্বস্ত করলেন। একয়দিনে অনেক ভালো সম্পর্ক তৈরী হয়েছে উনার সাথে। নিজের মেয়ের মতো খেয়াল রেখেছেন উনি আমার।
আলতো হাতে ব্যান্ডেজ খুলতে শুরু করলেন ডাক্তার চাচা। আমি চোখ বন্ধ করে বসে আছি। ধীরে ধীরে মুখের বা পাশটায় কেমন অনুভূত হতে লাগলো। বুঝতে পারছি ব্যান্ডেজ খুলে ফেলায় এমন হচ্ছে।
– এবার তো চোখ খুলো মা? সব ঠিক আছে দেখো।
“সব ঠিক আছে ” ডাক্তার চাচার একথা যেনো ম্যাজিকের মতো কাজ করলো। ফট করে চোখ মেলে তাকালাম আমি। কিন্তু বুঝতে পারিনি এটা ডাক্তার চাচার স্বান্তনা ছিলো মাত্র। দুচোখ মেলে তাকালেও ডান চোখেই দেখতে পারছি আমি। যেমনটা ব্যান্ডেজ করা অবস্থায় ছিলো। আমি টলমলে চোখে সারা আর সায়ন ভাইয়ার দিকে তাকালাম একবার। চোখ বন্ধ করে নিজের ওড়না খামচে দাঁড়িয়ে আছে সারা। চোখের কোণা দিয়ে গড়িয়ে চলেছে নোনাজল। সায়ন ভাইয়ার চোখেও পানি টলমল করছে তবে উনি কাঁদছেন না। ওদের এমন রিয়েক্ট করার কারণটা বোধগম্য হচ্ছে না আমার। আমি তো এখনও বলিনি যে আমি বা চোখে দেখতে পারছি না। তাহলে ওরা কেনো এমন করছে?
ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ডাক্তার চাচার দিকে তাকালাম আমি। তিনি মুখে মিষ্টি হাঁসি বজায় রেখেই দাঁড়িয়ে আছেন। আমি ধরা গলায় বললাম
– চাচা, বা চোখে কিছুই দেখতে পারছি না আমি।
এবার মাথা নিচু করে ফেললেন চাচা। নিচের দিকে তাঁকিয়েই ছাড়লেন একটা দীর্ঘশ্বাস। আবার নিরাস ভঙ্গিতে বললেন
– এমন কিছুই ডাউট হচ্ছিলো। এখানে আমাদের কিছু করার নেই মা। তোমার বা চোখে আর দেখতে পাওয়ার কোনো চান্স নেই। আই এম এক্সট্রিমলি সরি।
একথায় আমার ভীষণ কষ্ট পাওয়ার কথা থাকলেও খুব বেশি কষ্ট পাচ্ছি না আমি। বারবার ভাবছি বা চোখে দেখতে পাবো না তো কি হয়েছে? ডান চোখে তো দেখতে পাবো। আমার এতেই চলবে। এমনও তো হতে পারতো যে দুটো চোখেই দেখতে পারতাম না। তখন? একটা চোখ ভালো আছে এটা নিয়েই হাজার শুকরিয়া।
– ডক্টর কোনোকিছুই কি করার নেই আপনাদের? প্লিজ ডক্টর। ওর বয়স মাত্র ঊনিশ বছর। সামনে ওর পুরো জীবন পরে আছে।
– আই আম সরি মিস্টার সায়ন। বাট সত্যি সত্যিই কিছু করার নেই আমাদের।
চাচার কথা যেনো মেনে নিতে পারছেন না সায়ন ভাইয়া। ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছেন উনি। সারা এখনো মাটির পুতুলের মতো স্তব্ধ হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
হঠাৎই আমি বললাম
– আমায় একটা আয়না দেওয়া যাবে চাচা। প্লিজ
ডাক্তার চাচা কতক্ষণ নিরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন আমার মুখপানে। তারপরেই বললেন
– শিউর। বাট বী স্ট্রং। ওকে?
– ওকে।
এক নার্সের সাহায্যে আয়না আনানো হলো কেবিনে। চাচা কাঁপা হাতে আয়নাটা বারিয়ে দিলেন আমার দিকে। আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে চমকে উঠলাম আমি। স্তব্ধ হয়ে বসে আছি। সারা শরীর থরথর করে কেঁপে চলেছে। সারা আর সায়ন ভাইয়ার ওরকম রিয়েক্ট করার কারণ এখন পুরো স্পষ্ট আমার কাছে৷
বা পাশে চোখের পাশ থেকে থুতনি পর্যন্ত ঝলসে যাওয়া চামড়ায় ভীষণ অচেনা লাগছে নিজেকে। না চাইতেও ঝরঝর করে চোখের পানি ফেলে চলেছি আমি। আলতো হাতে পাশের টেবিলটায় আয়নাটা রেখে দিলাম। সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। হয়তো আমার মনের অবস্থাটা বুঝার চেষ্টা করছে। আমি স্বাভাবিকভাবে ডাক্তার চাচাকে জিজ্ঞেস করলাম
– আমি কি আজই বাসায় যেতে পারি চাচা?
– হ্যাঁ আজকেই তোমায় ছেড়ে দেওয়া হবে।
– ওহ। কিন্তু কখন?
– এখনই যেতে পারবে তুমি।
আমি সারাকে উদ্দেশ্য করে বললাম
– তুই এভাবে দাঁড়িয়ে না থেকে আমার সাথে বাইরে চল। বাহিরে সবাই আছে নিশ্চই? সবাইকে তো দেখাতে হবে আমার নিউ লুক। তাই চল।
সারা কিছু না বলে অবাক হয়ে তাকালো সায়ন ভাইয়ার দিকে। সায়ন ভাইয়া তারাতাড়ি আমার কাছে এসে আমার হাত ধরে বললেন
– আমার সাথে চল। আমি নিয়ে যাচ্ছি তোকে।
জানি না কি হলো আমার। আমি চিৎকার করে বললাম
-হাত ছাড়ুন আমার। আপনাকে বলেছি আমি? সব বিষয় নিয়ে আপনার নাক না গলালেও চলবে। নিজের পথ দেখুন।
আমার এমন ব্যবহার হয়তো সায়ন ভাইয়া আশা করেন নি। তাই অবাক হয়ে বললেন
-তুই এভাবে কথা বলছিস কেনো?
– তো কিভাবে কথা বলবো? আমি ভালো করেই কথা বলছি। আপনি এখনো আমার হাত ধরে আছেন কেনো? ছাড়তে বলছি না?
সায়ন ভাইয়া চুপচাপ আমার হাত ছেড়ে দিয়ে দুরে গিয়ে দাঁড়ালেন৷ উনাকে দেখে খারাপ লাগছে আমার। বুঝতে পারছি না কেনো এমন ব্যাবহার করলাম আমি। তবে কেনো জানিনা সায়ন ভাইয়ার হাত ধরাটা সহ্য হয়নি আমার। মনে হচ্ছিলো দয়া করছেন উনি আমায়। আমিও মাথা নিচু করে বেরিয়ে যেতে নিলাম কেবিন থেকে। তখনই পেছন থেকে ডেকে উঠলেন ডাক্তার চাচা।
– মাইশা, মাই প্রিন্সেস।
– জ্বি চাচা।
-তোমায় মিস করবো খুব।
– আমিও চাচা। আমার কিন্তু যখনই ইচ্ছে হবে তখনই চলে আসবো এ হসপিটালে।
– অবশ্যই। আমি অপেক্ষা করবো।
– হুম
– আরেকটা কথা মা। তুমি যথেষ্ট স্ট্রং একটা মেয়ে। তাই বলছি সবসময়ই এমন স্ট্রং থাকবে। আবেগের বশে ভুল কোনো পদক্ষেপ তোমার থেকে কাম্য নয়। মনে রাখবে, এ দেশে এমন অনেক মেয়ে আছে যারা এসিড নিক্ষেপের পরও বেঁচে আছে। তারা সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে। তারা হেরে যায় নি।
ডাক্তার চাচা কি ইঙ্গিত করছেন সেটা বুঝতে পারছি আমি। আমিও মুচকি হেঁসে উত্তর দিলাম
– ডোন্ট ওয়ারি চাচা। এর থেকে বেশি কষ্টের মধ্য দিয়ে গেছি আমি। সেসময় যখন ভুল কিছু করিনি এখনো করবো না। তাই চিন্তা করবেন না। আজ আসি চাচা। আল্লাহ হাফেজ।
– ওকে মাই প্রিন্সেস। আল্লাহ হাফেজ।
🍁
কেবিন থেকে বেরোতেই এক অন্যরকম প্রশান্তি পেলাম। আজ কতদিন পর কেবিনের বাইরে বেরিয়েছি আমি। খাঁচার পাখিকে মুক্ত করলে তাদেরও বুঝি এমন আনন্দ হয়?
অন্য কোনো হাসপাতাল হলে হয়তো সব মানুষ অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকতো আমার দিকে। কিন্তু এখানে কেউ তেমনভাবে তাকাচ্ছে না। কারণ এটা তাদের জন্য স্বাভাবিক। এ হাসপাতালের প্রতিটা মেয়েই এসিড ভিকটিম।
রিসিপশনের চেয়ারগুলোতে বসে আছে বাড়ির সবাই। আবারও বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো আমার। মায়ের অবস্থা কি হবে সেটাই ভাবতে পারছি না আমি। আস্তে আস্তে হেঁটে গিয়ে দাঁড়ালাম তাদের সামনে। আমায় দেখেই দাঁড়িয়ে গেলো সবাই। আপু আর মায়ের কান্না শুরু হয়ে গেছে তৎক্ষনাৎ। ভাইয়া আর বাবা বোবার মতো তাকিয়ে আছে। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললাম
– বাড়িতে যাবে না? কবে থেকে বাড়ি যাই না আমি? তারাতাড়ি চলো প্লিজ। এই ভাইয়া, শুধু দাঁড়িয়ে থাকবি? আমায় বাড়ি নিয়ে যাবি না?
ভাইয়া তারাতাড়ি মাথা নেড়ে বললো
– হুম চল চল। সত্যিই তো কবে থেকে বাড়ি যাসনা তুই। এই মালিশা কান্নাকাটি থামাতো। কাঁদার মতো কিছু হয়নি। বাইরে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তোরা চলে আয়। আমি মাইশাকে নিয়ে যাচ্ছি।
আমার হাত ধরে হাঁটতে লাগলো ভাইয়া। তার চোখে জল মুখে হাঁসি। হাঁসিটা যে আমায় স্বান্তনা দেওয়ার জন্য সেটা বুঝতে আর বাকি নেই আমার। আমিও হাঁসি দিলাম। যে হাঁসিতে মিশে আছে ভাগ্যের প্রতি শুধু তুচ্ছতাচ্ছিল্যতা।
চলবে……….
[ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ ]