#গল্প
বৃষ্টি_ভেজা_অরণ্য
পর্ব_২
-শাতিল রাফিয়া
আমি প্রেমে পড়েছি তাও আবার একটা কন্ঠস্বরের! মানুষটাকে দেখিনি, তার সম্পর্কে একেবারে কিচ্ছুই জানি না! আবার এরমধ্যে তাকে খুঁজে বের করতে চাচ্ছি! এইকথা আমি শুধুমাত্র দুইজনকে বলতে পারব। একজন হল নিশা, আরেকজন হলেন দুলাভাই। আর অন্য কাউকে জানানোর প্রশ্নই আসে না! আপাকে বললে সে অতি নাটকীয়তা করে যে কি করবে আল্লাহ জানেন! আর আমার বড়ভাই বোনদের ব্যাপারে ওভার প্রটেক্টিভ! ভাইয়াকে এই কথা বললে দেখা যাবে আমার ফোন নিয়ে তার নম্বরটাই ব্লক করে দিয়েছে!
দুলাভাই আর নিশাকে জানানোর জন্য তাদের একটা কফিশপে আসতে বললাম।
মা জিজ্ঞেস করলেন – কোথাও যাচ্ছিস?
– হ্যাঁ আগামীকাল..
– আগামীকালের সব প্রোগাম ক্যান্সেল কর।
– কেন মা?
– ওমা! কালকে মেঘ আপুর আকিকা করব। বাসায় সবাইকে দাওয়াত করেছি। তুই তো মানুষ দেখলে পারলে পালিয়ে যাস! এখন কিন্তু পরীক্ষা শেষ! এখন আমার হাতে হাতে কাজ দিবি!
মেঘের আকিকা মানে দুলাভাই আর নিশা আসবেই। ভালই হল। ও আচ্ছা! বলাই হয়নি! ভাইয়ার মেয়ের নাম রাখা হয়েছে মেঘমালা।
সেই ঘটনার পরদিন ভাবী বাবাকে বলল- আচ্ছা আব্বা আপনি ছেলেমেয়েদের এত সুন্দর সুন্দর কাব্যিক নাম রেখেছেন- অভ্রনীল, রূপরেখা আর বৃষ্টিলেখা! তিতুনের মামার সাথে মিলিয়ে তার ভাল নাম রেখেছেন শঙ্খনীল! আপনার নাতনির জন্য কোন নাম ঠিক করেননি?
বাবা হেসে বললেন – করেছি। মেঘমালা। মেঘমালা হক।
হক আমাদের পদবী।
ভাবী মুগ্ধ হয়ে বললেন – সেটা আগে বললেন না যে?
আপাকে ভাবী ফোন করে আজ সকালে আবার ডেকে এনেছে। এখন তার রাগ আবার পড়ে গেছে। আপা নাটকীয় হলেও তার মনটা বিশাল বড়। হুটহাট মন খারাপ করে, আবার তা তাড়াতাড়ি ঠিকও হয়ে যায়।
বাবা আড়চোখে আপাকে দেখে গলা নামিয়ে বললেন – বলার কি উপায় ছিল?
ভাবী হাসতে হাসতে বলল- ঠিক আছে! তাহলে মেঘমালা হক ফাইনাল। আর ডাকনাম টুনটুন! আপা যেটা রেখেছে!
বড়আপাকে বেশ খুশি হতে দেখলাম!
আকিকা করা হল। দুপুরে সবার দাওয়াত ছিল। খাওয়া দাওয়ার পর সবাই মিলে একসাথে গল্প করতে বসে গেল। আরেকটু পর আমি, দুলাভাই আর নিশাকে নিয়ে সাথে তিনকাপ কফি বানিয়ে ছাদে চলে গেলাম। ছাদে ছোট গোল টেবিলের মত করা আছে। তার চারপাশে বসার জায়গাও আছে।
বসার পর দুলাভাই জিজ্ঞেস করল- তারপর শালিকা বলুন! এত জরুরি তলব কেন?
নিশা কফিতে একটা চুমুক দিয়ে মুচকি হেসে বলে- আপনার কথাই ঠিক হয়েছে ভাইয়া! আপনার শালিকা তো সত্যিই ভ্যালেন্টাইন্স ডে তে প্রেমে পড়েছে!
আসলেই তো! আমি নিজেও খেয়াল করিনি! তার সেই কণ্ঠ তো আমি ভ্যালেন্টাইন্স ডে তেই শুনেছি!
দুলাভাই অবাক হয়ে বলে- সত্যি বৃষ্টি? তুই প্রেমে পড়েছিস?
আমি লজ্জা পেয়ে ধীরে ধীরে মাথা নাড়লাম!
– কে সে? কি করে?
– জানি না!
দুলাভাই ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলে- জানিস না মানে?
আমি সব খুলে বলার পর দুলাভাই হো হো করে হেসে উঠল! আর নিশা দেখলাম একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে!
আমি বললাম – কি হল তোমাদের?
নিশা বলে- আমি জানতাম তুই পাগল! কিন্তু এরকম বদ্ধ পাগল সেটা আজ জানলাম! আমি আরও কত খুশি হয়েছিলাম যে তুই প্রেমে পড়েছিস! কি মজা! কিন্তু তুই একটা কণ্ঠের প্রেমে পড়েছিস! তার নাম তো দূরে থাক, তাকে দেখিসনি পর্যন্ত!
আমি রেগে গিয়ে বললাম – কেন? না দেখে প্রেমে পড়া যায় না? মানুষজন আর.জে- দের কণ্ঠের প্রেমে পড়ে না?
দুলাভাই আমাকে থামিয়ে বললেন- আস্তে বৃষ্টি। রাগ করিস না। আর.জে- দের প্রেমে পড়া আর এই প্রেম এক নয়! আর.জে-দের সবাই চেনে, চাইলে দেখতেও পারে। আর সেলিব্রিটি ক্রাশ সবার সাথে! প্রেমে পড়া ঠিক আছে কিন্তু তুই তাকে খুঁজে বের করতে চাইছিস! এটা কি সম্ভব? বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের ভিড়ে কে সে সেটা কিভাবে জানবি বল?
আমি মুখ শক্ত করে বললাম – আমি জানি না! তোমার কোন পরিচিত নেই? এই নম্বর দিয়ে কোনভাবেই কি তাকে বের করা যায় না?
নিশা বলল- তোর কি মনে হয় তুই সিম কোম্পানির কাছে গিয়ে তাদের কাছে জানতে চাইলে তারা তোকে ডিটেইলস বলে দিবে? কখনোই না!
– আমার পরিচিত বন্ধু আছে। কিন্তু সে এই কোম্পানির না! আর আমরা কেউ নিশ্চয়ই সরাসরি ফোন করে তার নাম পরিচয় জিজ্ঞেস করতে পারি না!
আমি হঠাৎই দুইহাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে শুরু করলাম!
কাঁদতে কাঁদতেই বললাম – তোমরা জানো না সেদিনের পর থেকে আমি কী অশান্তিতে ভুগছি! সবসময় তার কণ্ঠ আমার কানে বাজছে! সে কে আমি জানি না! সে কেমন বা কি, বয়স কত, কোথায় থাকে আমি কিচ্ছু জানি না। কিন্তু প্লিজ আমাকে একটা উপায় বল যেন আমি তাকে খুঁজে পাই!
দুলাভাই আর নিশা খুবই অবাক হল!
নিশা আমাকে ধরে রাখে।
দুলাভাই হঠাৎই বলে- তুই তোর সেই ফ্রেন্ডকে জিজ্ঞেস কর! কি যেন নাম বললি? সুমি! ওকে জিজ্ঞেস করে দেখ! সে হয়তো ওর নাম্বার দিতে গিয়ে ভুলে ওর পরিচিত কারও নাম্বার দিয়েছে! যদিও সম্ভাবনা নেই, তবুও! লাস্ট হোপ!
নিশা বলে- আচ্ছা এমনও তো হতে পারে নাম্বারটা তোকে অন্য কেউ দিয়েছে। তুই ভুল করে সুমির নামে সেভ করেছিস!
আমি বললাম- হ্যাঁ তাই তো! সেটাও হতে পারে! আমি আগামীকাল-ই সুমির বাসায় যাব। ওকে জিজ্ঞেস করব।
নিশা মাথা নেড়ে বলল – আজ থেকে আমাদের প্রজেক্ট ‘সার্চ কণ্ঠস্বর!’
আমার ভাগ্যটা খুবই সুপ্রসন্ন বলতে হবে। সুমিকে ফোন করে ওর ঠিকানা নেওয়ার আগেই সে আমাকে ফোন করে। আগামীকাল ফ্রেন্ডদের হ্যাংআউট! সবাই মিলে মুভি দেখতে যাব, খাওয়া-দাওয়া করব! আমি একলাফে রাজি হয়ে গেলাম।
আর ফাঁকে একরাশ আশা নিয়ে জিজ্ঞেসও করলাম- আচ্ছা তুই আমাকে তোর নতুন নাম্বারটা দিয়েছিলি? নাকি অন্য কেউ দিয়েছে?
সুমি বলে- কি জানি! মনে নেই তো! কেন? কোন সমস্যা?
– না! সেরকম কিছু না। আচ্ছা কাল সামনাসামনি বলব।
ফোনে এত কথা খুলে বলে বোঝাতে পারব না। তাই বললাম না!
সারারাত আমার ঘুম হল না! কতবার যে নম্বরটা ডায়াল করতে গিয়েও করিনি!
মুভিতে আমি কোন রকম মনোযোগ দিতে পারলাম না! সেটা শেষ হওয়ার পর ফুড কোর্টে খাবার অর্ডার করে বসে আছি। সবাই সেলফি তুলছে, কথা বলছে।
আমি মোবাইল বের করে সুমিকে জিজ্ঞেস করলাম- এই নম্বরটা চিনিস?
সে দেখে বলে- না দোস্ত! নাম্বার তো আর মুখস্থ রাখি না। কার নাম্বার এটা।
আমি কি আর জানি!
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম – জানি না। তোর নামে আমার ফোনে এটা সেভ করা ছিল!
– ওমা! কি জানি!
তখন খাবার চলে আসলে সে বলে- তুই একটা কাজ করিস। নাম্বারটা আমার ফোনে টেক্সট করে দিস। আমি চেক করে দেখব।
বলতে চেয়েছিলাম- এখনই দেখ।
কিন্তু সুমি খাওয়া শুরু করে।
বিল মিটিয়ে যখন সবাই বের হয়ে যাব হঠাৎই লক্ষ করি, টেবিলের ওপর আমি যেখানে বসে ছিলাম সেখানে একটা ভিজিটিং কার্ড।
লেখা-
অরণ্য আহমেদ।
ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ম্যানেজার, সাপোর্ট গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ।
মোবাইলঃ ০১…
মোবাইল নাম্বারটা দেখে আমি ভূত দেখার মত চমকে উঠি! এটা তো সেই নাম্বার!
আমি কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে থাকলাম! এরপরই আনন্দের আতিশয্যে ‘ইয়াহু’ বলে চিৎকার করে হুট করে কেঁদেই দিলাম!
বন্ধুবান্ধবেরা দৌড়ে আসে! কি হল আমার!
আমি হেসে বললাম- না রে কিছু না! আমার একটা মূল্যবান সম্পদ খুঁজে পাচ্ছিলাম না! এখন পেয়েছি!
– কি এমন সম্পদ?
আমি ডান হাতের অনামিকায় পরে থাকা আংটি দেখিয়ে বললাম – এটা অনেক শখ করে কিনেছিলাম। একটু আগে খুলে গিয়েছিল, খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এখন পেয়েছি। টেবিলের ওপর ছিল!
এরপর কথা ঘুরিয়ে অন্য কথায় নিয়ে গেলাম! কিন্তু মনের মধ্যে খচখচ করতে লাগল! ব্যাপারটা অতি কাকতালীয়! প্রথমত আমার মোবাইলে একটা নাম্বার সেভ করা সুমি নামে যেটা আদৌ সুমির নয়! আর তার ওপর সেই নাম্বারের মালিকের কার্ড আমি সরাসরি পেয়ে গেলাম! ব্যাপারটার সাথে কি সুমির সম্পর্ক আছে?
হাঁটতে হাঁটতে ফিসফিস করে সুমিকে জিজ্ঞেস করলাম- তোর ব্যাগ থেকে কি কোন কার্ড হারিয়েছে দেখ তো!
সুমি ব্যাগ খুলে উল্টেপাল্টে দেখে বলে- না তো দোস্ত! কেন?
আমি কার্ডটা দেখালাম।
সুমি কিছুক্ষণ দেখে বলে- কার কার্ড এটা?
– আমাদের টেবিলে পেয়েছি।
– আসলে মনে নেই আগে দেখেছি কি না! কত কার্ডই তো রেখে দেই মাঝেমধ্যে! কি জানি আমার ব্যাগে ছিল কি না! অন্যদের জিজ্ঞেস কর।
আমি আর জিজ্ঞেস করা করির ঝামেলায় গেলাম না! মানুষটাকে যে খুঁজে পেয়েছি তাতেই আমি খুশি! খুব খুশি! অতি জোশে আজ আমি এক্সট্রা একটা সিম কিনে ফেললাম। সেই সিম থেকে ফোন করে দুলাভাই আর নিশাকে বিকালে একটা রেস্টুরেন্টে আসতে বললাম।
নিশা পইপই করে বারণ করে দিল আমি যেন আগেই অরণ্যকে নেটে না খুঁজি। সেও আমার সাথে খুঁজবে। যদিও তার কথাটা আমি রাখতাম না।
বাসায় যাওয়া মাত্রই ল্যাপটপ নিয়ে বসে যাচ্ছিলাম কিন্তু তার আগেই ভাবী এসে মেঘমালাকে আমার কোলে দিয়ে বলে- বৃষ্টি রাখো না একটু আমি গোসল করে আসি। আম্মা পাশের ফ্ল্যাটে গিয়েছেন কি কাজে যেন আর আব্বা বাজারে। আমি খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি।
আমি বিরস মুখে মেঘমালাকে কোলে নিয়ে বসে আছি। তাকে ভাল করে দেখছি। না তার নাক মোটেও আপার মত হয়নি। নাকটা বরং ভাবীর মত লাগছে। মাথার চুলগুলো ভাইয়ার মত কোঁকড়া হয়েছে!
যাইহোক এই অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই মেঘমালা কাউ করে কেঁদে ওঠে! আমি আগেই বলেছি বাচ্চারা আমাকে পছন্দ করে না। আমি তো কোলে নিয়ে চুপচাপ বসেই আছি তাহলে তোর ঘুম থেকে ওঠার দরকারটা কি?
ভাবী বাথরুম থেকে বলে- বৃষ্টি কোলে নিয়ে একটু হাঁটো। আমি আসছি।
আমি কোলে নিয়ে চুপ করানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু সে আরও জোরে চ্যাওম্যাও করে ওঠে! হঠাৎই মা এসে প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই চুপ করিয়ে ফেললেন!
এরপর আমাকে বললেন – একটা বাচ্চাকেও চুপ করাতে পারিস না!
– আচ্ছা আমার কি দোষ? আমি তো কোলে নিয়ে চুপচাপ বসেই ছিলাম!
– বসে থাকলেই হয়?
আমি বিরক্ত হয়ে বলি- তুমি সামলাও তোমার নাতনিকে। আমিও গোসল করে আসি। আবার বিকালে বের হব।
– সারাদিন টো-টো করে ঘুরে বেড়াস! পরীক্ষা শেষ হয়েছে একটু রান্নাবান্না করা শেখ! বিয়েশাদিও তো দেব নাকি?
আমি হেসে জিজ্ঞেস করলাম- আমাকে রান্না করার জন্য বিয়ে দেবে মা?
মা কঠিন মুখে বললেন – শোন বৃষ্টিলেখা! আমি তোকে আগেই বলে রাখলাম আমি কিন্তু এবার আর কোন ‘না’ শুনব না। আমি তোর জন্য পাত্র দেখছি!
মা চলে গেলে মেজাজটা খুব খারাপ হল! এই দুইবছর আগেই মা তার বান্ধবীর কেমন কেমন এক আত্মীয়ের অতি স্ট্যাবলিশড আর নামকরা ছেলের সাথে আমার বিয়ের আলোচনা চালাতে চেয়েছিলেন। আমি আর বাবা কঠিনভাবে নিষেধ করে দেয়ায় সেটা আর আগাতে পারেননি। কিন্তু মনে হচ্ছে এখন বাবাও রাজি হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু আমি এখন বিয়ের কথা ভাবছি-ই না। মাত্র অনার্স হল। মাস্টার্স করব, চাকরি করে প্রতিষ্ঠিত হয়ে নেই, তারপর ভাবা যাবে। আর এখন তো আমি আমার প্রেম নিয়ে ব্যস্ত। কেমন হবে আমার সেই কল্পনার মানুষ, যার কণ্ঠ এত্ত সুন্দর! নিশার কথাটা রাখব ভাবলাম। ওর সাথেই মানুষটাকে খুঁজব। গোসল করে, খেয়ে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিলাম।
সব শুনে দুলাভাই বললেন – আমি বুঝতে পারছি না। কাকতালীয় ব্যাপার হয় ঠিক। কিন্তু তাই বলে এতটাই?
নিশা বিজ্ঞের মতো করে বলে- আমি বুঝেছি।
– কি বুঝলে?
– ভাইয়া এটা তো খুবই সাধারণ একটা হিসাব! আসলে কার্ডটা সুমি আগেই পেয়েছে কোথাও থেকে। তার ব্যাগে ছিল। আর কার্ডের নাম্বারটাও কোন কারণে সেভ করে রেখেছে। ওর নিজের নাম্বার দেয়ার সময় ভুলক্রমে বৃষ্টিকে অরণ্যের নাম্বার দিয়েছে। আর আজ সুমির ব্যাগ থেকেই কোনভাবে কার্ডটা বেরিয়ে আসে! কথায় আছে- বিশ্বাসে মেলায় বস্তু! আর বৃষ্টি তো স্ট্রংলি চাইছিল অরণ্যকে খুঁজে বের করতে!
দুলাভাই চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে থাকল। নিশার ব্যাখ্যা তার তেমন একটা বিশ্বাসযোগ্য লাগছে না মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। যাই হোক, যেভাবেই হয়ে থাকুক না কেন আমি তার খোঁজ পেয়েছি এটাই আমার জন্য অনেক। এবার তার চেহারা দেখার জন্য আর তর সইছে না। নিশাকে নিয়ে বাসায় এলাম।
নিশা বলে- আজ আমাদের প্রজেক্ট “সার্চ কণ্ঠস্বর” কে সেকেন্ড স্টেজে নিয়ে যাচ্ছি – প্রজেক্ট “সার্চ অরণ্য”- তে!
আমি হেসে ফেললাম!
আমরা আগে সাপোর্ট গ্রুপ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলাম! দেশের নামকরা গ্রুপ। অনেক ইনফরমেশন আছে।
কিন্তু আমাদের যাকে দরকার তার সম্পর্কে কিছু নেই। থাকবে না জানতাম। এমপ্লয়িদের ইনফরমেশন নিশ্চয়ই তারা পাবলিক করে বেড়াবে না! এরপর আর কি! চিরচেনা ফেসবুকের সাহায্য নিতে হল! কিন্তু ফেসবুকে ‘অরণ্য আহমেদ’ নামে অনেক আইডি আছে। আর তার ফেসবুক আইডির নাম আসলে কি, বাংলা না ইংরেজিতে লেখা এসব কিছুই জানি না! খুঁজে খুঁজে কিছু বের করতে না পেরে আমি হাউহাউ করে কান্না শুরু করলাম!
– নাম-পরিচয় জেনেও কিছু করতে পারছি না নিশা!
– আরে পেয়ে যাব! কান্না বন্ধ কর!
আমি এবার উঠে দাঁড়িয়ে বললাম – ঠিক! পেতে তো হবেই। একবার যখন ঠিক করেছি খুঁজে বের করব আমি বের করবই! আমি সরাসরি তার অফিসে গিয়ে দেখা করব!
নিশা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে – কিভাবে দেখা করবি? তুই চাইলেই কি দেখা করতে দিবে নাকি? আর অপরিচিত মানুষের সাথে সে কেন দেখা করবে? এতবড় পজিশনে আছে দেখা করার আগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে না?
আমি মুচকি হেসে বললাম – হ্যাঁ নিব! নতুন নাম্বার কিনেছি কি জন্য?
– বোকার মত কথা বলিস না বৃষ্টি! ফোনে কথা বলে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফিক্সড করবি? কি বলবি কেন দেখা করতে চাস? কোন ভ্যালিড রিজন ছাড়া সে রাজি হবে না। আর এসব করতে গিয়ে বিরক্ত হয়ে তোর নাম্বারটাই না ব্লক করে দেয়!
নিশার কথায় যুক্তি আছে! কি করব তাহলে? হঠাৎই আমার মাথায় আইডিয়া এসে যায়!
আমি এবার হেসে বললাম – পেয়েছি। ওদের অফিসে ইন্টারভিউর জন্য সার্কুলার দিয়েছে না? এই একটু আগেই তো দেখলাম। আমি ওদের অফিসে ইন্টারভিউ দিতে যাব। চাকরি হবে না জানি। না হলে নেই। আমার আর তার ডিপার্টমেন্ট যেহেতু একই, আর বড় পজিশনে আছে, আশা করছি সে থাকবে ইন্টারভিউ বোর্ডে। আর যদি নাও থাকে আমি যেভাবেই হোক ওদিন খুঁজে বের করে দেখা করে আসব।
– ইন্টারভিউতে তোকে ডাকবে তুই জানিস কি করে? নাও ডাকতে পারে!
ম্লান হেসে বললাম- জানি। যদি না ডাকে তবে আমি কোন না কোনভাবে ব্যবস্থা করব দেখা করার।
– সেই ব্যবস্থা এখনই কর!
মাথা নেড়ে বললাম- তুই বুঝতে পারছিস না। ইন্টারভিউতে যদি না ডাকে আর এটার সম্ভাবনাই বেশি আমি জানি, তাহলে আমি তাকে ফোন করে দেখা করতে চাইব। আর সেজন্য আমাকে তার সাথে ফোনে কথা বলে সখ্যতা বাড়াতে হবে। সেজন্য সময় লাগবে। তাই দুইদিকেই চেষ্টা করব। ইন্টারভিউতে ডাকলে তো হলই। আর তা নাহলে এই কয়দিনে আমি ঠিক কথা বলে সখ্যতা বাড়াব। দেখিস!
নিশা মাথা নেড়ে বলে – তুই-ই জানিস কি করছিস!
– দেখা আমাকে করতেই হবে, কথা আমাকে বলতেই হবে। তার কণ্ঠ আমার একটা নেশা হয়ে গেছে!
রাতেরবেলা বারোটার দিজে নিজেকে সংবরণ করতে না পেরে তার নাম্বারে ফোন দিলাম।
কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর ভেসে এল সেই কণ্ঠ! যার জন্য আমি তৃষিত হয়ে ছিলাম! যেটা শোনার জন্য আমার কান ছটফট করছিল!
– হ্যালো আসসালামু আলাইকুম।
আমি হুট করে জিজ্ঞেস করে ফেললাম – কেমন আছেন?
নিশা আমাকে ইশারা করে জিজ্ঞেস করে – কি বলছিস এসব?
ওপাশ থেকে বলে- স্যরি। আপনাকে ঠিক চিনতে পারছি না। তবে আমি ভাল আছি।
বাহ! কি সুন্দর করে কথা বলছে! সে আমাকে চিনেনা। তবুও!
আমি বললাম – আমাকে আপনি চিনবেন না। কিন্তু আমি আপনাকে চিনি।
সে হেসে বলে- তাই? তাহলে পরিচয়টা কি দিতে চান নাকি না?
– পরিচয় দিলে তো চিনবেন না। আমার নাম..
বলে থেমে গেলাম। কি নাম বলব? আসল নাম বলব না।
– আমার নাম..ন..নিশা!
চোখের সামনে নিশাকে দেখে ওর নামটাই বলে দিলাম! এদিকে নিশা আমার দিকে কটমট করে তাকাল! আমি চোখের ইশারায় স্যরি বলে দিলাম!
অরণ্য বলে- ঠিক আছে নিশা। আমাকে কি দরকারে ফোন করেছেন একটু বলবেন?
আমি আবার চুপ করে গেলাম। কি বলব? আমি তোমার কণ্ঠস্বর শোনার জন্য ফোন করেছি?
– ইয়ে.. আসলে..মানে.. না কোন স্পেসিফিক কারণ নেই!
– ঠিক আছে। তাহলে যখন কোন স্পেসিফিক কারণ থাকবে তখন কথা হবে। এবার তাহলে রাখছি! ভালো থাকবেন। বাই।
ফোনটা কেটে দিল! দিবেই তো! আমি কি একটা! ঠিক মত কথাই বলতে পারলাম না!
নিশা জিজ্ঞেস করে – কি করলি কাজটা? এরকম করলে সখ্যতা না শত্রুতা গড়ে উঠবে!
আমি মুখ গোমড়া করে বলি- জানি না! ধুর! ওর সাথে কথা বলতে গেলে কি যে বলে ফেলি! আমার তো ইচ্ছা করে শুধু তার কথাটাই শুনে যাই! শুনেই যাই!
আজ স্পিকার অন করে রেখেছিলাম নিশাকে কণ্ঠটা শোনাব বলে। রেকর্ডার অন করে রেখেছিলাম যাতে আমি যখন ইচ্ছা তার কণ্ঠ শুনতে পারি!
নিশাকে জিজ্ঞেস করলাম- কণ্ঠস্বরটা সুন্দর না?
নিশা মাথা নেড়ে বলে – হ্যাঁ! আসলেই সুন্দর!
এরপর হেসে বলে- দেখা হলে দেখবি সে দেখতে একদমই পচা। টাক মাথা, দাঁত নেই, বুড়ো একেবারে..
আমি ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বললাম- একদম চুপ! সে হবে একদম রুপকথার রাজকুমার, প্রিন্স চার্মিং!
নিশা খিকখিক করে হেসে বলে- হ্যাঁ প্রিন্স চার্মিং উইথ হিজ উড বি কুইন!
– তুই একটা আস্তা শয়তান! কোথায় ভাল কিছু বলবি, ভাল দোয়া করবি উল্টো ভয় দেখাচ্ছিস!
নিশা আবার হেসে বলে- তবে একটা বিষয় জানিস? তোর এই বিরল প্রজাতির ভালবাসা দেখতে খুব মজা পাচ্ছি!
[চলবে]