#ভালোবাসি_আমি_যে_তোমায়
#Sohani_Simu
পর্ব:৫৭
হাইড্রোজেন সালফাইডের তীব্র ঝাঝালো গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসছে।দুমিনিট ধরে আমি এখানে আটকে আছি।কে যেন দরজা বাহিরে থেকে বন্ধ করে দিয়েছে।নাকে মুখে ওড়না চেপে পুরো ল্যাব জুড়ে আমার ফোন আর বই খুঁজছি।অনেক খুজে বই আর ফোন পেলাম তাও যেখানে হাইড্রোজেন সালফাইড রাখা আছে সেখানে।বই ব্যাগে ঢুকিয়ে ফোন হাতে নিয়ে এক দৌঁড়ে দরজার কাছে আসলাম। জোরে জোরে দরজা ধাক্কাতে লাগলাম।কাউকে ফোন করবো ফোন অফ হয়ে আছে।একটু ধাক্কা ধাক্কি করার পর ওপাশ থেকে ছেলেদের কন্ঠ পেলাম,
“ভেতরে কে আছেন?”(উঁচু কন্ঠে)
আমি বুঝলাম ভার্সিটিরই কোন স্টুডেন্ট।আমি মুখ থেকে ওড়না সড়িয়ে উঁচু কন্ঠে বললাম,
আমি:প্লিজ হেল্প মি,দরজা খুলতে পারছিনা। এখানে খুব গন্ধ।
“ভেতরে কেউ আছে কিন্তু দরজায় তো তালা দেয়া।এই কেউ চাবি নিয়ে আয় ফাস্ট।”
ওদিকের কথা শুনে বুঝলাম দরজায় তালা দেওয়া আর কেউ চাবি নিতে গেল।একটু পর আমার বন্ধুদের কথাও শুনতে পেলাম,আমি এতক্ষণ যাচ্ছি না দেখে ওরা আমাকে নিতে এসেছে।আমি ওদের সিঁড়িতে দাঁড়াতে বলে এক দৌঁড়ে এখানে চলে এসেছিলাম।ফোন অন করে দেখি মাত্র ১৩% চার্জ আছে কিন্তু ফোনে তো ফুল চার্জ ছিল।আমি ব্যাটারি সার্ভার অন করে নির্ভীক ভাইয়াকে ফোন দিলাম কিন্তু ফোন ঢুকলোনা।তখনই মনে হলো উনার তো এক্সাম আছে তাই ফোন অফ রেখেছেন।এবার রাযীন ভাইয়াকে ফোন দিলাম।সঙ্গে সঙ্গে উনি রিসিভ করে বললেন,
রাযীন:ক্লাস শেষ?আমি নিচে ওয়েট করছি তুই চলে আয়।
আমি:ভাইয়া আমি ল্যাবে আটকে গেছি।দরজা বাহিরে থেকে তালা দেওয়া।সবাই তালা খোলার চেষ্টা করছে।(এক নিঃশ্বাসে)
রাযীন:হোয়াট?আমি আসছি।
রাযীন ভাইয়া কল কাটতেই দরজায় তালা খোলার শব্দ হতে লাগলো কিন্তু অনেকক্ষণ হয়ে যাচ্ছে তালা খুলছেনা।আমি ভেতর থেকে সবার উদ্দেশ্যে বললাম,
আমি:তাড়াতাড়ি খুলুন।নিঃশ্বাস নিতে পারছিনা, দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।(উঁচু কন্ঠে)
ওপাশ থেকে আদনান আর রিপন সহ আরও কিছু ছেলের কন্ঠ পেলাম,
“এখানে তো এই তালার চাবিই নেই।দরজা ভাঙতে হবে।এই অন্ত দরজা থেকে সরে দাঁড়া।”
আমি সরে গিয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসলাম।দরজায় সবাই ধাক্কা দিচ্ছে।একসময় দরজা খুলে গেল।সবাই আমাকে ধরে বাহিরে নিয়ে আসলো।ইচ্ছে আমাকে পানি দিল।রাযীন ভাইয়াও ততক্ষণে চলে এসেছে।আমাকে ঘিরে এখানে একটা ছোট জটলা পেকে গেছে।কোথায় থেকে টোয়া আপু দৌড়ে এসে আমার পাশ থেকে আইরিনকে উঠিয়ে দিয়ে আমার প্রতি যত্ন দেখাতে লাগলো।
আমি:আমি ঠিক আছি। কিছু হয়নি।(টোয়া আপুর দিকে তাকিয়ে)
রাযীন:ওকে বাসায় চল।
ভাইয়া,ইচ্ছে আর টোয়া আপুর সাথে গাড়ির কাছে আসলাম।টোয়া আপু আমাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে চলে গেল।ইচ্ছে বলল আরাফ ভাইয়া ওকে নিতে আসবে তাই ও আমাদের সাথে গেল না।রাযীন ভাইয়া আমাকে নিয়ে বাসায় চলে আসলো।
বাসায় এসে শাওয়ার নিয়ে শুয়ে পরলাম।মাথা ঝিম ঝিম করছে,তাকিয়ে থাকতে পারছিনা,বমি বমি ভাব হচ্ছে আর নাকে সেই গন্ধ লেগেই আছে।মনে হচ্ছে ফুসফুসে গন্ধটা স্থায়ী ভাবে বশত ভিটা করে নিয়েছে।আমি জোড়ে জোড়ে শ্বাস ত্যাগ করছি যাতে গন্ধটা বের হয়ে যায় কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছেনা।
তিনটার পর নির্ভীক ভাইয়া বাসায় আসলেন।রাযীন ভাইয়াকে আমি বারণ করেছিলাম উনাকে এসব ব্যাপারে জানাতে কিন্তু ভাইয়া উনাকে সব জানিয়ে দিয়েছেন।উনি রুমে এসে আমাকে শুয়ে থাকতে দেখেই আমার কাছে এসে বসে বললেন,
নির্ভীক:এসব কি করে হলো অন্ত?কি হচ্ছে?শরীর খারাপ লাগছে?(চিন্তিত হয়ে)
আমি: কিছু হয়নি আমি ঠিক আছি।আসলে আমি ল্যাব শেষ করে বাহিরে এসে দেখি একটা বই আর ফোন ব্যাগে নেই।প্রথমে ভেবেছিললাম হারিয়ে গিয়েছে কিন্তু একটা মেয়ে বলছিল সে ওগুলো ল্যাবে দেখেছে তাই আমি ল্যাবে গেলাম আর তখনই কেউ দরজা বাহিরে থেকে লক করে দিয়েছিল।(উনার দিকে তাকিয়ে)
আমি উনাকে সব বললাম।আমার শরীর খারাপ লাগছে ব্যাপারটা উনার কাছে চেপে গেলাম কারন কয়েকদিন ধরে উনি নাওয়া খাওয়া ঘুম বাদ দিয়ে দিনরাত পড়াশুনা করছেন এরমধ্যে এসব বললে উনার টেনশন বাড়বে।তাই আমি উনাকে বললাম আমার কিছু হয়নি।উনার মনে হয় আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না তাই বললেন,
নির্ভীক:তোমাকে অসুস্থ দেখাচ্ছে।সত্যি করে বলো কোথায় কষ্ট হচ্ছে।(আমার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত চোখে তাকিয়ে)
আমি:ঘুম পাচ্ছে আমার কিন্তু আপনি তো ঘুমোতে দিচ্ছেন না তাই বিরক্ত লাগছে।(অন্যপাশ ফিরে শুয়ে)
নির্ভীক:আমার তো মনে হচ্ছে তোমার মাথা ব্যাথা করছে,মেডিসিন দিচ্ছি দাঁড়াও।(বসা থেকে দাঁড়িয়ে)
আমি:মেডিসিন খেয়েছি।(চোখ বন্ধ করে)
উনি হন্ত দন্ত হয়ে আবার আমার পাশে বসে আমার দিকে ঝুকে আমার গাল টেনে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললেন,
নির্ভীক:খুব বেশি ব্যাথা করছে?আর কি হচ্ছে?বলো আমাকে।(চিন্তিত হয়ে)
আমি বুঝলাম আমার শরীরের অবস্থা ভাল নয় তাই উনার কাছে কিছু লুকিয়ে লাভ নেই।উনাকে সব বলে দিলাম।উনি পড়াশুনা বাদ দিয়ে আমাকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে গেলেন।এই কান্ডটা ঘটে এক দিক দিয়ে ভালই হয়েছে উনি সব সময় আমার কাছে থাকছেন,আমার পাশে বসেই পড়াশুনা করছেন।কয়েকদিন উনি কেমন দূরে দূরে থাকতেন।দিনের বেশির ভাগ সময় বাহিরে আর সারারাত টেবিলে বসে থাকতেন।আমার একদম ভাল লাগতোনা।উনি রুমে আমার চোখের সামনে থাকলেও উনাকে খুব মিস করতাম। সাত দিন সময় লেগেছে আমার স্নায়বিক সমস্যা দূর করতে।মাথা ব্যাথা,বমি বমি ভাব,জ্বর,ডাবল ভিশন এর জন্য এই কয়দিন আর ভার্সিটি যাই নি।
.
আজকে শরীরটা পুরো ঠিক লাগছে।সকাল থেকে প্রজাপতির মতো এখানে ওখানে উড়ছি।আজকে নির্ভীক ভাইয়ার লাস্ট এক্সাম তাই উনি সকাল সকাল বাসা থেকে বেড়িয়ে গিয়েছেন।চারটা বেজে গেল তাও উনার আসার কোন কথা নেই।এই দিকে টোয়া আপু এসেছে।এই টোয়া আপু বার বার এখানে আসার বাহানা খোঁজে।আমাকে খুব হিংসা করে, আমার উপর রাগ করে আমি সব বুঝতে পারি কিন্তু অনেক সময় আবার ভালোও বাসে।এইতো দুদিন আগে আমাদের বাসায় এসে আমার জন্মদিনের জন্য কেক বানানোর ট্রায়াল করছিল।আমার জন্মদিনের কেক নাকি টোয়া আপু বানাবে তারপর হঠাৎ কি হল আমাকে কয়েকটা কটু কথা শুনিয়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে গেল।দুদিন পরই আমার জন্মদিন।টোয়া আপু আজ এমনি এসেছে। এসেই আমার আর আপুর সাথে বাহানা ধরেছে শাড়ি পরবে তারপর পাশের মাঠে একটা ফুচকার দোকান আছে ওখানে গিয়ে ফুসকা খাবে।টোয়া আপু নিজের শাড়ি বাসা থেকে নিয়ে এসেছে আপু একটা কলাপাতা কালার শাড়ি পরার জন্য নেড়ে চেড়ে দেখছে আর আমি আপুর একটা নীল কালারের শাড়ি হাতে নিয়ে বসে আছি।
আমি:আমি এটা পড়বো।(আপুর দিকে তাকিয়ে)
আফ্রা:ওটার থেকে তোর নীল কালার শাড়িটা বেশি সুন্দর যেটা নির্ভীক ভাইয়া তোকে কিনেদিয়েছিল।ওটা নিয়ে আয় যা।(শাড়ির ভাজ খুলতে খুলতে)
আমি: না না এখন ওটা পরবোনা,এটায় পড়ি?(আপুর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে)
আফ্রা:আচ্ছা পড়।আমিও নীল শাড়ি পরবো।
বলেই আপু আলমারি খুলে আরেকটা নীল শাড়ি বের করলো আর টোয়া আপু বলল,
টোয়া:তাহলে আমিও নীল শাড়ি পরবো কিন্তু এখানে তো আমার নীল শাড়ি নেই।অন্ত তোর শাড়ি আমাকে পরতে দিবি?(আমার দিকে তাকিয়ে অনুরোধ করার মতো করে)
আপু আমার থেকে আপুর নীল শাড়ি নিয়ে টোয়া আপুকে পড়ার জন্য দিল আর আমাকে বলল আমার শাড়ি পরতে। আমি রুমে এসে আমার শাড়ি নিয়ে আপুদের কাছে যেতেই টোয়া আপু আমার হাত থেকে শাড়ি নিয়ে বলল,
টোয়া:ওয়াও এটা অনেক বেশি সুন্দর। আমি এটা পরবো প্লিজ প্লিজ প্লিজ।(আমার দিকে তাকিয়ে)
আফ্রা:কিন্তু টোয়া ওই শাড়িটা ও একবারও পরেনি।আজকে ও পড়ুক তুমি অন্য একদিন পরো।(টোয়া আপুর দিকে তাকিয়ে)
টোয়া:শাড়িটা তো ওরই। ও যখন ইচ্ছা পরতে পারবে, আজকে আমি পরি প্লিজ।(হ্যাংলার মতো করে)
আমি আর কি বলবো।মন খারাপ করে টোয়া আপুকে শাড়িটা পরতে বললাম।তিন জন নীল শাড়ি, নীল কাচের চুড়ি,কালো টিপ,কাঠের অর্নামেন্ট পরে নিচে আসলাম।নিচে আসতেই মনে হল ফোন রুমে ফেলে এসেছি। তাই আমি দ্রুত পায়ে রুমে আসলাম।ফোন নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছিলাম তখনই নির্ভীক ভাইয়া রুমে এসে চেঁচিয়ে বললেন,
নির্ভীক:ওই শাড়িটা তুমি টোয়াকে পরতে দিলা?তুমি জানো আমি……..
আমি উনার দিকে ঘুরতেই উনার রাগী ভয়েসে বলা কথা গুলো ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল।উনি আমাকে দেখতে দেখতে আমার একদম কাছে এসে দাঁড়ালেন।উনার তাকানো দেখে আমি লজ্জায় মাথা নামিয়ে পেছন দিকে সরে গেলাম।উনি আবার আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলেন আর আমি পিছিয়ে যেতে লাগলাম।পেছাতে পেছাতে আমি আলমারির সাথে লেগে গেলাম।উনি আমার একদম কাছে এসে দাঁড়ালেন।আমার দিকে ঝুকে একহাত আমার কমোড়ে অন্যহাত আমার ডান কানের নিচে রাখলেন।আমি একবার উনার দিকে তাকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে নিলাম।এমন চোখের দিকে তাকানোর সাহস আমার নেই।এমন পরিস্থিতিতে আমার হাত মৃদু কাপছে,গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে,নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসছে আর সব থেকে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো আমার মনে হচ্ছে আমি এখনই সেন্সলেস হয়ে যাবো।উনি আমার বাম ঠোঁটের কোণায় নিজের ঠোঁঠ রেখে বললেন,
নির্ভীক:খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে তোমাকে।একটু ভালোবাসলে কি আমার মায়াপরী রাগ করবে?(লো ভয়েসে)
আমি কাঁপা কাঁপা হাতে আমার কোমড়ে রাখা উনার হাত সরানোর চেষ্টা করতেই উনি আমাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে আমার ঠোঁট দখল করে নিলেন।আমার দুই হাত মুক্ত আছে তাও উনাকে বাঁধা দেওয়ার শক্তি পাচ্ছিনা।কিছু পরার আওয়াজ পেতেই উনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে দাঁড়ালেন।ঘন ঘন শ্বাস নিতে নিতে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখি টোয়া আপু আমাদের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে আছে।টোয়া আপুর পায়ের কাছে ফোন পরে আছে।আমি সোজা হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়ালাম।নির্ভীক ভাইয়া রাগী কন্ঠে বললেন,
নির্ভীক:অন্ত এখন কোথাও যাবেনা।তোদের যেখানে ইচ্ছে তোরা যেতে পারিস।(শার্টের বাটন খুলতে খুলতে)
টোয়া আপু ফোন তুলে নিয়ে আমাকে চোখের ইশারায় শাসিয়ে চলে গেল।এই মেয়ের হাব ভাব কিছু বুঝিনা,কি চায় কি ও?আমি রুম থেকে চলে আসবো তখনই উনি শার্ট খুলতে খুলতে বললেন,
নির্ভীক:উফ্ মাথা নষ্ট করে দিয়েছো একদম!পিচ্চি মানুষের এত তেজ?কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আমার মতো একটা ছেলের জগৎ ভুলিয়ে ছেড়ে দিলা।তোমার পাওয়ার দেখে আমি শিহরিত!(মুচকি হেসে আমার দিকে তাকিয়ে)
উনার এমন কথা শুনে লজ্জা পেয়ে আমি আর কোন দিকে না তাকিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলাম।নিচে এসে শুনলাম টোয়া আপু চলে গেছে।আমি আর আপু খালাকে নিয়ে ছাদে আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় নিচে এসে চেন্জ করে আপুর শাড়ি আপুকে দিয়ে আমাদের রুমে চলে আসলাম।রুমে এসে দেখি নির্ভীক ভাইয়া ঘর অন্ধকার করে ঘুমোচ্ছেন।আহারে বেচারা এক্সামের জন্য কত দিন ঠিক করে ঘুমোতে পারেননি।আজ একটু ঘুমোক শান্তি মতো।আমি দরজা ভিরিয়ে দিয়ে নিচে চলে আসলাম কিন্তু নির্ভীক ভাইয়া যদি এক্সাম শেষে ক্লান্ত হয়ে ঘুম দেন তাহলে প্রান্ত ভাইয়া এখন আমাদের বাসায় কি করছে?উনারও তো আজ এক্সাম ছিল তাহলে উনি না ঘুমিয়ে এখানে কি করছেন??
চলবে……….