#ভালোবাসি_আমি_যে_তোমায়
#Sohani_Simu
পর্ব:৫৯
জন্মদিন উপলক্ষে বাসায় আজ উৎসব মুখর পরিবেশ।টোয়া আপু একাই সব মাতিয়ে রেখেছে।কিচেনে কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না। রান্না বান্না পারে তো না কিছু শুধু শুধু খালাকে বিরক্ত করছে।আমি রান্না পারিনা তাই কিচেনে ভীর না করে তরীকে নিয়ে রুমে আসলাম।সকাল থেকে তরীর হাত আমি ছাড়িনি। সিদ্ধান্ত নিয়েছি তরীকে এখন থেকে আমার কাছেই রাখবো,তরী আমার সাথে থাকলে নির্ভীক ভাইয়া কিছু করতে পারছেনা নাহলে উনি আমাকে জ্বালিয়ে মারছেন।অসভ্য লোক একটা!
রুমে এসে দেখি নির্ভীক ভাইয়া একদম ফর্মমাল হয়ে সোফায় বসে ল্যাপটপে কার সাথে যেন ইংলিশে কথা বলছেন।আমি সেদিকে না দেখে তরীকে নিয়ে পেইন্টিং সরালাম। ড্রয়ার থেকে চাবি নিয়ে সিক্রেট রুমের দরজা খুলে বুক ভরা সাহস নিয়ে ভেতরে ঢুকলাম।
এতদিন যেটাকে ভূতের ঘর ভেবে এসেছি সেটা দেখে আমি অবাক।এটা মোটেও ভুতের ঘর নয় তবে একটু অগোছালো, দেয়ালের সাদা রংটাও বেশ পুরোনো।আসলে এই রুমের সব কিছুই পুরোনো।দেয়ালে খরি মাটি দিয়ে অনেক আঁকিবুঁকি করা আছে আর একপাশের দেয়ালে শুধু ছবি আর ছবি। এগুলো সব আমার ছোট বেলার ছবি।নির্ভীক ভাইয়ার ছবিও আছে, উনিতো ভালই বড় ছিলেন তখন,এগারো বারো হবেন হয়তো।তরী আমাদের ছবি দেখে বলল,
তরী:ছোট ভাবি তুমি তো সব গুলো ছবি চাঁদ ভাইয়ার কোলে চড়ে তুলেছো।এটা বেস্ট।(একটা ছবিতে আঙুল ঠেকিয়ে)
আমি ওই ছবিটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম।ছবিটা আসলেই বেস্ট।এটা সম্ভবত কোন পার্কে তোলা কারন আমাদের পেছনে অনেক ফুলগাছ আছে।আমি নির্ভীক ভাইয়ার কোলে চড়ে উনার গালে হাত দিয়ে আছি উনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসছেন।এবার উনার সাথে দেখা হওয়ার পর এই কয়েকমাসের ছবি দেখতে লাগলাম।এই লোকটা লুকিয়ে লুকিয়ে আমার অনেক ছবি তুলেছেন।আমাদের বাসায় যেয়েও দেখছি লুকিয়ে আমার অনেক ছবি তুলেছেন।প্রায় আধ ঘন্টা ছবি দেখতেই কেটেঁ গেল।এখানে একটা কালো গিটারও আছে।এইরকমই একটা গিটার প্রান্ত ভাইয়ার বাসায় আছে।পুরাতন আলমারি খুলে দেখি সব পুরাতন জিনিসপত্রে ঠাসা।এখানে খেলনা আছে, ড্রেস আছে।পুরো রুম দেখে আমার চোখ জুড়িয়ে গেল।নির্ভীক ভাইয়া আমার আর উনার ছোটবেলার সব স্মৃতি এখানে লক করে রেখেছেন।আমার প্রতি উনার ভালোবাসার গভীরতা হারে হারে বুঝতে পারছি।এসব দেখে উনার প্রতি আমার ভালোবাসাও কয়েকগুন বেড়ে গেল।
পুরো রুম দেখে প্রায় এক ঘন্টা পর আমরা বেড়িয়ে আসলাম।আমাদের রুমে আসতেই দেখি উনি হাসি মুখে ল্যাপটপ অফ করছেন।আমাকে দেখেই উনি মুখ গম্ভীর করে বললেন,
নির্ভীক:এই পিচ্চি কাম হেয়ার।(হাত দিয়ে ইশারা করে)
আমি:এই তরী নির্ভীক ভাইয়া তোমাকে ডাকছে যাও।(মুচকি হেসে তরীর দিকে তাকিয়ে)
তরী:আমাকে নয় চাঁদ ভাইয়া তোমাকে ডাকছে।আমি নিচে গেলাম তুমি শুনে তাড়াতাড়ি আসো।
বলেই তরী ছুটে চলে গেল। আমিও আতংকে ওর পেছন
পেছন ছুটেছি কারন আমাকে একা পেলেই উনি প্রমিজ ভাঙ্গা কিস দিচ্ছেন।কি ভয়ানক সেই কিস!আমি পালাতে যাচ্ছিলাম কিন্তু উনি আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন।আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে নিজের কোট টাই খুলে ফেললেন।শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে বললেন,
নির্ভীক:তরীকে কি যেন বললা নির্ভীক ভাইয়া ডাকছে না কি যেন?(দুষ্টু হেসে)
পেছাতে পেছাতে আমি দেয়ালে ঠেকে গিয়েছি।এখন আমার কি হবে!উনি মনে হয় এইবার আর আমাকে ছেড়ে দিবেন না।উনি আমার দুহাত দেয়ালে চেপে ধরে আমার গলার কাছে মুখ আনতেই আমি চোখ খিচে বন্ধ করে বললাম,
আমি:সরি সরি সরি আমি বলতে চাইনি ভুল করে বলে ফেলেছি আর কোনদিনও বলবোনা কখনও বলবো না।(একদমে)
নির্ভীক:নির্ভীক বলো।(গলা থেকে মুখ তুলে)
আমি:এএএখন?(ভীত চোখে উনার দিকে তাকিয়ে)
নির্ভীক:তুমি মনে মনেও আমার নামের পেছনে ভাইয়া লাগাও তাইনা?আমার কথা যতবার মনে আসে ততবার ভাইয়াও মনে আসে?এই আমি তোমার কি হই বলো?আমাকে তোমার ভাই লাগে?(ধমক দিয়ে)
আমি মাথা নাড়িয়ে না বললাম।উনি আমার দুই গাল ধরে রাগী কন্ঠে বললেন,
নির্ভীক:প্রতিদিন আমাকে নির্ভীক বলে ডাকবা কারনে অকারনে নির্ভীক বলবা।এখনই বলো।
আমি:নিনিনির্ভীক।(চোখ নিচু করে কাঁপাকাঁপা গলায়)
নির্ভীক:গুড,এখন থেকে প্রাকটিস করো।রাতে যেন কোন কাঁপাকাঁপি আটকা আটকি না থাকে থাকলে তো বুঝতেই পারছো কি হবে।(দুষ্টু হেসে)
আমি মাথা নিচু করে থাকলাম।উনি আমাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বললেন,
নির্ভীক:ওই রুমে কি দেখলা.?(মুচকি হেসে)
আমি উনাকে সব বললাম।উনি মুচকি হেসে আমাকে বেডে বসিয়ে দিয়ে আমার পাশে বসে বললেন,
নির্ভীক:ওটাই আমার রুম আর এটা এমনি একটা রুম।এখান থেকে চলে গেলে ভাইয়ার কাছে সব আমানত রেখে যেতে হবে। এত কিছু তো নিয়ে যেতে পারবোনা।একমাত্র জারিফ ভাইয়ায় এসব ঠিক ঠাক করে রাখতে পারবে।
আমি:কোথায় যাবেন?(ভ্রু কুচকে)
নির্ভীক:এখান থেকে অনেক দূরে।(আমার কাঁধে মাথা রেখে)
আমি:না আপনি কোথাও যাবেন না।(উঠে দাঁড়িয়ে তেজি গলায়)
উনি মুচকি হেসে আমাকে টেনে উনার কোলে বসিয়ে দিয়ে বললেন,
নির্ভীক:তোমাকেও নিয়ে যাবো।তোমাকে ছাড়া আমি কোথাও যেয়ে থাকতেই পারিনা।তুমি যা পিচ্চি তোমাকে পকেটে ঢুকিয়েই নিয়ে যেতে পারবো।(ঘাড়ে কিস করে)
আমি:কিন্তু কোথায় যাবেন আপনি?(ভ্রু কুচকে উনার দিকে তাকিয়ে)
নির্ভীক:যেখানে আমি ছাড়া তোমাকে আর কেউ ভালোবাসবেনা।সব সময় কেউ তোমার ক্ষতি করতে চাইবেনা সেখানে।(কপালে কপাল ঠেকিয়ে)
আমি:কিন্তু সেটা কোথায়?(বিরক্ত হয়ে কপাল সরিয়ে)
নির্ভীক:তুমিই বলো কোথায় যাবা।ফ্রান্স নাকি সুইজারল্যান্ড নাকি দুটোতেই যাবা?(মুচকি হেসে)
আমি চিন্তিত হয়ে উনার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।উনি শুধু মুচকি হাসছেন।কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললাম,
আমি: আমি কোথাও যাবো না।আপনার যেখানে ইচ্ছে যেতে পারেন। (উনার দিকে তাকিয়ে)
নির্ভীক:তারমানে তুমি আরাফ ভাইয়ার সাথে থাকবা।ওকে যাও।(আমাকে কোল থেকে তুলে দিয়ে)
আমি:কি বলছেন?আজব তো!আরাফ ভাইয়ার কথা উঠছে কেন?(ভ্রু কুচকে)
নির্ভীক:আরাফ ভাইয়া তো তোমাকে আমার থেকে বেশি ভালোবাসে।সকালে কতগুলো গিফট দিয়ে গেল।তোমার পছন্দও হয়েছে আর সুন্দর করে চোখের সামনে সাজিয়ে রেখেছো।আমি তো এত কিছু দিই নি।আর আমার কোন গিফটই তো চোখের সামনে রাখোনা সবগুলো বাক্স বন্দি করে রাখো।যাও যাও চলেই যাও তুমি আরাফ ভাইয়ার কাছে। (মন খারাপ করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে)
আমি রেগে ধপ ধপ করে হেঁটে গিয়ে ওয়্যারড্রপের উপর থেকে আরাফ ভাইয়ার দেওয়া বড় গিফট বক্স নিয়ে এসে উনার পিঠে ছুরে মারলাম।উনার লেগেছে নিশ্চিত, লাগুক আমারো অনেক লেগেছে। উনি পেছনে ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
নির্ভীক:আরে মারছো কেন?আমি তো তোমাকে আটকায়নি যেতেই বলছি।আচ্ছা আরাফ ভাইয়াকে নিয়ে যেতে বলি দাঁড়াও।আমার ফোন টা কোথায় গেল।(খোঁজা খুঁজি করে)
আমি বেডের পাশে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে কাঁদতে লাগলাম।হঠাৎ উনি আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার কাঁধে মুখ রেখে বললেন,
নির্ভীক:আরে আমি মজা করছিলাম।আমার কাছ থেকে তোমাকে কোথাও যেতে দিবো না।তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবোনা তো।
আমি:আপনি সকালেও আরাফ ভাইয়াকে বলছিলেন আমাকে নিয়ে যেতে।(হেঁচকি তুলতে তুলতে)
নির্ভীক:আমি তো এমনি বলেছি।রাগ করে বলেছি। আমার বউকে অন্য কেউ কেন এত ভালোবাসবে?আর তুমি আরাফ ভাইয়ার সাথে ওত সুন্দর করে হেসে কথা বললা কেন?আমার ভাল লাগেনি রাগ হয়েছে খুব।তোমার পানিশমেন্ট আছে আজ।(জড়িয়ে ধরে)
ইশ!বর আমার আরাফ ভাইয়াকে নিয়ে জেলাস।(মনে মনে)
আমি:এতক্ষণ বাজে কথা বললেন এখন আবার পানিশমেন্ট দিতে চাইছেন?আপনি খুব খারাপ।(নাক টেনে)
উনি আমার দুই গাল ধরে ঠোঁটে কামড় দিয়ে ধরে থাকলেন।উনি এখনই পানিশমেন্ট দিয়ে দিবেন আমি ভাবতেও পারিনি।আমার মতো বাচ্চা মেয়েকে কি শাস্তিই না দেন উনি উনার করাতের মতো ধারালো দাঁত দিয়ে।উনার সামনের দাঁত গুলো সব উপড়ে নেওয়া উচিত।ভাইয়াকে বলবো এবারের বার্থ ডেতে ভাইয়া যেন আমাকে উনার মুখের সামনের দশ টা দাঁত গিফট করে আমি ওগুলো উনার সিক্রেট রুমে সাজিয়ে রাখবো।
আজকে আমি ব্যাথা পেলেও চুপ করে থাকলাম কারন আমি এখন রেগে আছি।আমাকে চুপ থাকতে দেখে উনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে আমার দু কাঁধে হাত রেখে বললেন,
নির্ভীক:আর অত সুন্দর করে হেসে কথা বলবা?(ভ্রু কুচকে)
আমি:চলে যাবো এখান থেকে।(রেগে)
নির্ভীক:আরাফ ভাইয়ার কাছে যাবা?(গা জ্বলানো হাসি দিয়ে)
আমি:কারও কাছে যাবোনা।একা একা চলে যাবো অনেকদূরে।আপনি ভাল থাকুন শান্তিতে থাকুন।ডাইনোসর কোথাকার!!
ফটাফট কথা গুলো বলে রেগে গজ গজ করতে করতে রুম থেকে বেড়িয়ে আসতে লাগলাম।ভেবেছি উনি আমাকে আটকাবেন কিন্তু না উনি একটা সাদা টিশার্ট আর কালো জিন্স কাঁধে নিয়ে ওয়াশরুমে গেলেন।আমি বেডের কাছে এসে বেড সাইড টেবিল থেকে গ্লাস নিয়ে ঢক ঢক করে পানি খেলাম।পানি খাওয়ার সময় ঠোঁট জ্বালা করলো তাই কেটে গেছে কিনা দেখার জন্য আয়নার সামনে দাঁড়ালাম।না কাটলেও মাংস একটু ফুটো হয়েছে।দুঃখী ফেস করে চলে আসছিলাম হঠাৎই ভাবলাম উনি শাওয়ার নিয়ে একটু পর হিরো সেজে নিচে যাবেন আর আমি এত সাধারণ হয়ে ঘুরবো?নেভার। আমি এখন সাজবো যাতে সবাই ওই হিরোটাকে না দেখে আমাকে দেখে।
আলমারি খুলে একটা সাদা গাউন বের করলাম।ওয়াশরুমের দরজা লাগিয়ে দিয়ে রুমেই চেন্জ করে নিলাম তারপর চুল গুলো খোলায় রেখে দিলাম আর কিছু করতে ইচ্ছে করছিল না তাও ঠোঁটে পিংক কালার লিপস্টিক লাগালাম।উঠে দাঁড়িয়ে ওড়না ঠিক করবো তখনই ওয়াশরুমের দরজায় ধাক্কা ধাক্কি শুরু হলো।আমি বিরক্ত হয়ে যেয়ে দরজা খুলে দিলাম।উনি আমার দিকে তাকিয়েই হা হয়ে গেলেন আর আমিও উনাকে দেখে হা।উনার সামনের ভেজা চুল গুলো নাকে এসে ঠেকেছে প্রায়।চুলের ডগায় পানি টপ টপ করছে।চুল মুছা বাদ দিয়ে উনি আবুলের মতো হা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।একটু পর চুল ঠিক করে টাওয়েল ঘাড়ের উপর রেখে মুচকি হেসে বললেন,
নির্ভীক:এত সেজেছো?কাহিনী কি বলো তো?আমাকে পাবনায় পাঠানোর প্ল্যান করছো নাকি?(মুচকি হেসে আমার দিকে আসতে আসতে)
আমি উল্টো দিকে ঘুরে মুচকি হাসলাম।তারপর নাক মুখ ফুলিয়ে বললাম,
আমি:পঁচা লোকের সাথে কথা বলবোনা।বাই দ্যা ওয়ে আমি কিন্তু চলে যাচ্ছি আর আসবোনা।(রুম থেকে যেতে যেতে)
নির্ভীক:ওয়েট আমিও আসছি।(আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে)
আমি ওড়না ভাল করে গায়ে জড়াতে জড়াতে নিচে আসতে লাগলাম কিন্তু তখনই কে যেন পেছন থেকে জোড়ে ধাক্কা দিল আর আমি তাল সামলাতে না পেরে স্টিলের রেলিং টপকে চিৎ হয়ে উপর থেকে একদম নিচে পরে গেলাম।পরার সময় সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করে বললাম,
“নির্ভীককককক!!!!!”
ভাইয়াটাও মাথায় এসেছিল কিন্তু বলার সময় পেলামনা।দেহটা সোফার উপর পরলেও মাথটা যেয়ে পরলো সোফার কাচের টেবিলের উপর।টেবিল ভেঙ্গে গেছে বুঝতে পারলাম।আমার সাদা ওড়নাটা ধীরে ধীরে উড়ে এসে আমার মুখের উপর পড়লো।আর সঙ্গে সঙ্গে আমি হারিয়ে গেলাম সাদার মায়ায়।
চলবে……..