#ভালোবাসি_আমি_যে_তোমায়_২
#Sohani_Simu
২৪.
দুপুর দুটো বাজে।জারিফের ঘর থেকে ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে নির্ভীককে বেড়িয়ে যেতে দেখেই ভ্রু কুচকালো আরাফ।জারিফ তো এখন অফিসে আর কুহেলীকে ড্রইং রুমে টিভি দেখতে দেখে আসলো।তাহলে নির্ভীক এখানে কি করছিল?নির্ভীক চলে গেলে আরাফ জারিফের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়েই ভ্রু কুচকে বলল,
‘তুই?কখন ফিরলি?’
জারিফ দুটো বিয়ের কার্ড হাতে নিয়ে সোফায় বসে ছিল আরাফকে দেখেই একটা কার্ড লুকিয়ে ফেললো।আনন্দিত হয়ে বলল,
‘এইতো কিছুক্ষণ আগেই আসলাম।ভেতরে আয়।’
আরাফ দরজা থেকেই বলল,
‘তোর হাতে ওটা কি?’
‘রাযীন আর আফ্রার বিয়ের কার্ড।আয় দেখে যা।’
আরাফ শুধু অহ বলে নিজের ঘরে চলে গেল।জারিফ সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে কার্ডটা চোখের সামনে ধরতেই চোখ কপালে উঠে গেল।নির্ভীকের বিয়ের কার্ড লুকোতে গিয়ে ভুল করে রাযীনেরটা লুকিয়ে ফেলেছে।আরাফকে নির্ভীকের কার্ডটায় দেখাতে ডাকছিল।আরাফ এসে যদি কার্ডটা দেখতো কি কান্ডটায় না হতো।জারিফ দ্রুত নির্ভীকের কার্ডটা আলমিরাতে তুলে রাখলো।তারপর ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে গেল।
অন্ত নিজের ঘরে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে।সেন্সলেস হয়ে যাওয়ার পর ডক্টর ওকে ঘুমের ঔষধ দিয়েছে তারপর থেকে ঘুমোচ্ছে।কখন উঠবে কে জানে।ইচ্ছেমতি অন্তকে জাগানোর জন্য আল্লাহ্র কাছে দুইহাত তুলে অসহায় মুখ করে বিছানায় বসে আছে।হঠাৎ অন্ত একটু নড়েচড়ে উঠতেই ইচ্ছেমতি খুশি হয়ে নিচু আওয়াজে বলল,
‘উঠেছিস?তুই কি এখন সুস্থ?এই জানু?উঠনা,দেখ তোর নির্ভীক ভাইয়া অন্য কাউকে বিয়ে করে নিচ্ছে।’
অন্ত বিরক্ত হয়ে অন্যপাশ ফিরে শুলো।ইচ্ছেমতির কোনো কথায় শুনলোনা।ইচ্ছেমতি ঠিক করলো অন্তকে ডেকে তুলবে ঠিক তখনই তার ফোনে মেসেজ আসলো।নির্ভীকের মেসেজ।
‘নিচে আসো।’
ইচ্ছেমতি হাওয়ার বেগে নিচে যেতে লাগলো।নির্ভীকের সাথে কথা বলা খুব জরুরী।নির্ভীক আর কুহেলী ড্রইং রুমের সোফায় বসে আছে।ইচ্ছেমতি নির্ভীকের সামনে দাঁড়িয়ে রেগে বলল,
‘এসব কি নির্ভীক ভাইয়া?আপনি কি করে অন্য কাউকে বিয়ে করছেন?’
নির্ভীক মুচকি হেসে বলল,
‘অন্তকে বিয়ে করছি এটুকু জেনে রাখো।বিয়ে আর কার্ডের ব্যাপারে ওকে কিছু জানানোর দরকার নেই।যেদিন বিয়ে হবে সেদিন জানবে।’
বলতে বলতে নির্ভীক উঠে দাঁড়ালো।ইচ্ছেমতি চিন্তিত হয়ে বলল,
‘কিন্তু..’
‘কোন কিন্তু নয়।আর কোন কথা হবেনা এ ব্যাপারে।ভাবি? ভাইয়াকে নিয়ে তোমরা বিকেলে একবার আমাদের বাসায় এসো আম্মু কথা বলবে।’
কুহেলী মুচকি হেসে বলল,
‘ঠিক আছে।
নির্ভীক চলে গেল।ইচ্ছেমতি সস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সোফায় বসলো।
অন্ত ঘুম থেকে উঠলো রাত একটা সময়।ততক্ষণে সবাই ঘুমিয়ে গিয়েছে।আশেপাশে তাকিয়ে দেখে পাশে ইচ্ছে ঘুমোচ্ছে।ঘরে ডিম লাইটের আলো জ্বলছে।কিছুক্ষণ এটা ওটা ভাবতেই নির্ভীকের কথা মনে হল।উঠে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ফোন নিয়ে সোফায় বসলো।নির্ভীকের নাম্বার বের করে কল করলো।দুবার কল দেওয়ার পর নির্ভীক কল রিসিভ করতেই অন্ত খুশি হয়ে বলল,
‘সরি।এত রাতে ডিস্টার্ব করলাম।আপনি ঘুমোচ্ছেন?’
‘হুম।’
অন্ত সোফায় হেলান দিয়ে বলল,
‘অহ সরি ঘুম নষ্ট করলাম।’
নির্ভীক কিছু বলল না।অন্ত ফোন চোখের সামনে নিয়ে দেখলো কেটে দিয়েছে কিনা।কাটেনি।অন্ত ফোন কানে ধরে মন খারাপ করে বলল,
‘কথা বলছেন না কেন?’
কয়েকসেকেন্ড পর নির্ভীকের জবাব আসলো।
‘কি বলবো?’
অন্ত ভাবলো ঠিকই তো কি বলবে?অন্ত ফোন দিয়েছে তাই অন্তরই বলা উচিত কিন্তু অন্ত কথা খুঁজে পাচ্ছে না।অন্ত বুঝতে পারলো এত রাতে নির্ভীককে ফোন দেওয়া ঠিক হয়নি তাই মলিন কন্ঠে বলল,
‘ঠিক আছে বাই।’
নির্ভীক কিছু বলে কিনা শোনার জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষাও করলো কিন্তু কিছু বলল না।অন্ত কল কেটে গুটিসুটি হয়ে সোফায় শুয়ে পরলো।মনে মনে ভাবছে নির্ভীক হঠাৎ এমন করছে কেন?কাল পর্যন্ত তো ঠিকই ছিল,কত কথা বলল আর আজ ভাল করে কথা বলছেনা।এসব ভাবতে ভাবতে আবার ঘুমিয়ে পরলো।
—
হৈ-চৈ আর গাল টানাটানির অত্যাচারে অন্তর ঘুম ভেঙ্গে গেল।চোখ খুলে দেখে সোফায় শুয়ে আছে আর কাজিনরা তাকে ঘিরে ধরে আছে।অন্ত ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠে বসলো।ভীত কন্ঠে বলল,
‘তোমরা এখানে কিভাবে আসলে?এত সকালে?’
অন্তর খালাতো ভাই রিসাব ধব করে অন্তর পাশে বসে বলল,
‘সকাল নয় অন্তমনি,এখন দুপুর বারোটা বাজে।’
অন্ত এতে অবাক হল না কারন মাঝেমাঝে তাকে রাতদিন এক করে ঘুমোতে হয়।অন্ত সবার দিকে তাকালো।সবগুলো তার খালাতো আর মামাতো ভাইবোন কারন অন্তর বাবার কোন ভাই নেই,ইচ্ছেমতির মা তার একমাত্র ফুফু।সারা,রুহি,মিতু,লিরা,মিরা এরা অন্তর মামাতো-খালাতো বোন আর রিসাব,আরব,নাছিম,লিমন,তাজ,জিসান এরা অন্তর মামাতো-খালাতো ভাই।সবাই আফ্রার বিয়ে উপলক্ষে এসেছে।অন্ত সবাইকে পেয়ে খুব খুশি।
শেষ বিকেলে অন্তদের বাসার পেছনে কয়েকবাসা পর একটা ফাঁকা মাঠে শুকনো ঘাসের উপর বসে আছে অন্ত আর তার কাজিনরা।সবাই বসে বসে বিয়ের প্ল্যানিং করছে আর বাদাম খাচ্ছে।হঠাৎ অন্ত দেখতে পেল তাদের থেকে অনেক দূরে মাঠের শেষ কিনারায় নির্ভীক আর প্রান্ত উল্টোদিকে ঘুরে ঘাসের উপর বসে আছে।অন্ত সবাইকে বলে ছুটে সেখানে গেল।
নির্ভীক আর প্রান্ত তাদের কিছু বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়ার জন্য বসে আছে।সবাইকে এখানে আসতে বলেছে।এখনো কেউ আসেনি কিন্তু খুব শীঘ্রই চলে আসবে।নির্ভীক কানে ইয়ারফোন গুজে গান শুনছে আর প্রান্ত ফোন গুতোচ্ছে।হঠাৎ অন্ত তাদের সামন এসে দাঁড়ালো।ক্লান্ত হয়ে ঘাসের উপর বসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
‘আপনারাও এখানে এসেছেন?আমরাও এখানে ঘুরতে এসেছি।’
নির্ভীক অন্তর কথা শেষ হবার পর কান থেকে ইয়ারফোন খুলে পকেট থেকে ফোন নিয়ে টিপতে লাগলো।অন্ত কি বলেছে কিছুই শুনতে পায়নি।দুজনেই চুপ আছে দেখে অন্ত একবার নির্ভীকের দিকে তাকাচ্ছে তো একবার প্রান্তর দিকে তাকাচ্ছে।নির্ভীক কিছু বলছেনা দেখে প্রান্ত ফোন থেকে মাথা তুলে ভ্রু কুচকে নির্ভীকের দিকে তাকালো।নির্ভীক কথা বলছেনা জন্য প্রান্তই বলল,
‘হোয়াটস্ আপ বোনু?তোমরাও এখানে এসেছো?’
অন্ত মুচকি হেসে বলল,
‘হ্যাঁ।ভাইয়া আর আপুদের সাথে এসেছি।ওরা সবাই ওখানে আছে।’
প্রান্ত ঘাড় ঘুড়িয়ে পেছনে তাকালো।অনেক দূরে গোল হয়ে কিছু ছেলে মেয়ে বসে আছে।ইচ্ছেমতি দাঁড়িয়ে থেকে হাত নাড়িয়ে কিছু বলছে।ইচ্ছেমতিকে ছাড়া প্রান্ত কাউকে চিনতে পারলো না।মুচকি হেসে অন্তর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘অতদূর থেকে আমাদের দেখতে পেলে কিভাবে?’
অন্ত জুতো খুলতে খুলতে বলল,
‘হঠাৎ এদিকে তাকালাম আর আপনার দেখে মনে হল এটা আপনারাই হবেন তাই চলে আসলাম।’
প্রান্ত বার বার নির্ভীকের দিকে তাকাচ্ছে।বেশ বুঝতে পারছে নির্ভীকের কিছু একটা হয়েছে নাহলে অন্তর সাথে কথা বলছেনা কেন?প্রান্ত ভ্রু কুচকে নির্ভীকের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘কিরে কি হয়েছে?কথা বল।’
নির্ভীক ফোনের দিকে তাকিয়েই বলল,
‘কি বলবো?’
অন্তর মুখ কালো হয়ে গেল।নির্ভীক বার বার বলছে কি বলবো।সত্যি কি নির্ভীকের কিছু বলার নেই?অন্ত নির্ভীকের দিকে তাকিয়ে মন খারাপ করে বলল,
‘নির্ভীক ভাইয়া আমার সাথে কথা বলছেন না কেন?’
নির্ভীক অন্তর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘বলছি তো।’
নির্ভীকের এমন দায় সাড়া কথা শুনে অন্তর খারাপ লাগলো।মনে মনে ভাবলো এখানে আসা উচিত হয়নি। নির্ভীকের পছন্দ হয়নি তাই চলে যাওয়ায় ভাল।মলিন হেসে বলল,
‘আচ্ছা থাকুন আপনারা।আমি আসি।’
প্রান্ত ভ্রু কুচকে বলল,
‘চলে যাবা মানে?কিছুক্ষণ বসো এখানে।’
অন্ত জুতো হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
‘না ভাইয়া যেতে হবে থাকুন।’
বলেই অন্ত হাঁটা দিল।অন্ত যেতেই নির্ভীক ফোন পকেটে ঢুকিয়ে অন্তর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘এসেই প্রথম কথা কি বলেছিল?শুনতে পাইনি।’
প্রান্ত ভ্রু কুচকে বলল,
‘কথা বললিনা কেন ওর সাথে।’
নির্ভীক মরা ঘাসের উপর শুয়ে বলল,
‘রেগে আছি।’
প্রান্ত অবাক হয়ে বলল,
‘তুই ওর উপর রেগে আছিস!আই ক্যান্ট বিলিভ।কি করেছে ও?’
নির্ভীক প্রান্তর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘কষ্ট দিয়েছে আমাকে।’
তারপর বুকের বামপাশে হাত দিয়ে বলল,
‘এখানে।’
প্রান্ত ভ্রু কুচকে বলল,
‘তাই বলে ওর সাথে এমন ব্যবহার করবি?কত মন খারাপ করেছে মেয়েটা।অতদূর থেকে এখানে তোর সাথে কথা বলতেই তো এসেছিল আর তুই এমন করে কথা বললি।’
নির্ভীক মুচকি হেসে বলল,
‘ওকে আরও অনেক দূর থেকে আসতে হবে।’
প্রান্ত কিছু বলতে চেয়েও বলল না কারন তাদের বন্ধুরা চলে এসেছে।নির্ভীক উঠে বসে অন্তর দিকে তাকালো।অন্ত খালি পায়ে ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে।ফর্সা পায়ে কালো সুতোর মতো পায়েল পরে আছে।নির্ভীকের ইচ্ছে করছে অন্তর সামনে এককহাঁটু মুড়ে বসে অন্য হাঁটুতে অন্তর পা নিয়ে সুতো বাঁধা জায়গায় আলতো করে ঠোঁট ছোয়াতে।নির্ভীক কপাল ডলতে ডলতে মনে মনে বলল কি হচ্ছে টাকি?রেগে আছি আমি ওর উপর।এত ভালোবাসা আসছে কেন?ভালোবাসা তোমাদের ছুটি তোমরা এখন আসতে পারো।ভেবেই নির্ভীক আনমনে হেসে উঠলো।এদিকে বন্ধুরা আগ্রহ নিয়ে নির্ভীকের দিকে তাকিয়ে আছে।নির্ভীক কল্পনা থেকে বের হতেই বন্ধুদের তার দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে কেশে উঠলো।সাথে সাথে সবাই হো হো করে উঠলো।
—-
বেলকুনির গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে অন্ত।ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত।ঘন কালো মেঘে আকাশ থমথমে হয়ে আছে।সেজন্য আকাশে চাঁদ তারা কিছুই চোখে পরছেনা।দূরে কোথাও বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।চারপাশে গুমোট গরম।ঝড় আসবে হয়তো।আসুক।এই গরম আর সহ্য করা যাচ্ছেনা।শুধু গরম নয় আজকাল সবকিছুই অন্তর কাছে অসহ্য লাগছে।আর এর জন্য দায়ী নির্ভীক।দুদিন ধরে নির্ভীক অন্তর সাথে অদ্ভুত আচরণ করছে।দুদিনে নির্ভীক নিজের থেকে একবারও অন্তর সাথে কথা বলেনি।অন্ত কিছু বললে এককথায় উত্তর দিয়েছে।অন্যদের সাথে ঠিকই অনেক কথা বলছে শুধু অন্তর সাথেই এমন করছে যা অন্তর একদমই সহ্য হচ্ছে না।আজকে অন্তর মন একটুও ভাল নেই তাই সবার সাথে নিজের বোনের বিয়ের শপিং করতে যায়নি।অন্ত যায়নি দেখে আরাফও যায়নি।আরাফ আর অন্তকে বাসায় একা রেখে জারিফও যায়নি।
আরাফ নিজের ঘরে যাচ্ছিল কিন্তু অন্তর ঘর অন্ধকার দেখে ঘরে এসে আলো জ্বালিয়ে দিল।আরাফ ভেবেছিল অন্ত ঘুমোচ্ছে কিন্তু বিছানায় অন্তকে না দেখে চিন্তিত হয়ে বেলকুনিতে আসলো।এখানে এসে দেখলো অন্ত অন্ধকারে মন খারাপ করে বসে আছে।আরাফ মুচকি হেসে অন্তর পাশে বসলো।অন্তর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘মন খারাপ?’
অন্ত এবার ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে মৃদু স্বরে বলল,
‘হ্যাঁ।’
‘কেন?’
অন্ত নির্ভীকের বেলকুনির দিকে তাকালো।অন্ধকার বেলকুনি কিন্তু ঘরে আলো জ্বলছে আর বেলকুনির কাঁচের দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ঘরের ভেতর প্রান্ত হাঁটাহাঁটি করছে।নির্ভীক সম্ভবত বিছানায় বসে আছে তাই তাকে দেখা যাচ্ছে না।আরাফ অন্তর দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকালো।ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘চলো ছাদে যাই।’
অন্ত শান্ত চোখে আরাফের দিকে তাকালো।আবছা অন্ধকারেও আরাফ অন্তর চোখে চকচকে অশ্রু দেখতে পেল।কিছু সময়ের জন্য আরাফের মনে হল সে যা করছে তা ভুল।তার সরে যাওয়া উচিত কিন্তু পরক্ষণেই চোখমুখ শক্ত হয়ে এল।অন্তকে সে কোনদিন ছাড়বেনা।ভালোবাসলে তাকে ছাড়া যায় না।অন্তর এখন যা বয়স যখন তখন প্রেমে পরা স্বাভাবিক আর নির্ভীক ওকে প্রেমে পরতে বাধ্য করেছে।অন্ত এখন বুঝতে পারছেনা একটু বড় হলে ঠিকই ভাল লাগা আর ভালোবাসার মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারবে।অন্তর বয়সের দোষ দিয়ে আরাফ নিজেকে সান্ত্বনা দিল।অন্তর একহাত নিজের মধ্যে নিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
‘এত মন খারাপ করছো কেন?তুমি জানোনা তোমার মন খারাপ হলে আমার কতটা কষ্ট হয়?তুমি অন্যের জন্য আমাকে কষ্ট দিচ্ছ?আমাকে?’
অন্ত কান্নামুখ করে সামনের দিকে তাকালো।মিন মিন করে বলল,
‘নির্ভীক ভাইয়া সবার সাথে কত ভাল করে কথা বলছে শুধু আমার সাথে বলছেনা।আগে আমি কথা না বললে জোর করে আমার সাথে কথা বলতেন,একটু মন খারাপ করলেই কতকি করতেন এখন এমন কেন করছে?আমি নির্ভীক ভাইয়াকে ভালোবাসি আর…..।’
আরাফ অন্তকে পুরোটা বলতে না দিয়ে রাগী কন্ঠে বলল,
‘তুমি শুধু আমাকে ভালোবাসো আর কাউকে নয়।’
অন্তও রাগী কন্ঠে বলল,
‘উফ্ ভাইয়া প্লিজ এসব বল না।নোংরা লাগে আমার কাছে।ভাইয়াকে আর তোমাকে কোনদিন আলাদা করে দেখিনি।ছোট থেকে জেনে এসেছি আমার দুুটো ভাই এখন তুমি এসব বলছো,আমার কত খারাপ লাগছে যানো?আর নিপা আপুর সাথে বিয়েটা মানছোনা কেন?’
আরাফ অবাক হল।অন্ত নিপা আর তার বিয়ের কথাটা জানলো কি করে।এসব তো অন্তর জানার কথা নয়।নিশ্চয় নির্ভীক বলেছে।নির্ভীকের উপর রাগটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো।নিজেকে যতটা সম্ভব শান্ত করে অন্তর গালে হাত রেখে বলল,
‘তুমি আমাকে একটু বুঝার চেষ্টা কর।’
এতটুকু বলতে আরাফ দুবার শুকনো ঢোক গিলেছে।অন্তকে কিভাবে বুঝাবে ভেবে পাচ্ছেনা।বুঝতে না চাইলে তাকে বুঝানোর সাধ্য কার আছে?না বুঝলে না বুঝুক।দরকার হলে জোর করব।ভেবেই আরাফ অন্তর গাল থেকে হাত সরিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বলল,
‘তুমি ছোট তাই কোনদিন বলিনি।ভেবেছিলাম বড় হলে বলব কিন্তু দেরি করে ফেলেছি।জারিফের ভালোবাসা আর আমার ভালোবাসা কোনদিন এক ছিল না।আমি কোনদিন তোমাকে বোনের চোখে দেখিনি।খুব ভালোবাসি তোমাকে।নিপার সাথে বাবা-মা জোর করে বিয়ে দিয়েছিল, ডিভোর্স হয়ে গেছে আমাদের।কখনও ওকে স্ত্রীর অধিকার দেইনি।বিয়ের পর এক রুমে তো দূরের কথা এক ছাদের নিচেও থাকিনি ওর সাথে কথাও বলিনি।আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসি।আমি নিজেও জানিনা কবে আর কখন থেকে তোমাকে এত ভালোবাসলাম।’
অন্ত আরাফের থেকে একটু সরে বসলো।খুব সহজভাবে বলল,
‘আমি নির্ভীক ভাইয়াকে ভালোবাসি।’
আরাফ রাগী কন্ঠে বলল,
‘এটা ভালোবাসা নয়।আমি মানছি ওকে তোমার ভাল লাগে।এটা স্বাভাবিক।ও দেখতে সুন্দর তাই সব মেয়েরা ওকে পছন্দ করে,তুমিও ওকে পছন্দ কর কিন্তু এটা শুধু ভাল লাগা।লুক এ্যাট মি।আমি সুন্দর নই?কোন দিকে কম আছি ওর থেকে?আমার চেয়ে বেশি কেউ তোমাকে ভালোবাসেনা।তোমাকে আরও অনেক বেশি ভালোবাসতে চাই।সবসময় তোমাতে বিভোর থাকতে চাই।তুমি কি আমাকে একটু ভালোবাসবে?না বাসলেও প্রবলেম নেই শুধু পাশে থেকো সারাজীবন।’
আরাফকে অন্তর ঘৃণা হচ্ছে আবার কোথাও কষ্টও হচ্ছে।সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার কষ্ট।অন্তও আরাফকে ভালোবাসে।সেটা ভালোবাসার অন্য রঙ,আরাফের রঙের সাথে মিলে না।ভালোবাসা একটি মানবিক অনুভূতি।আবেগকেন্দ্রিক অভিজ্ঞতা।বিশেষ কোন মানুষের জন্য স্নেহের শক্তিশালী বহিঃপ্রকাশ হল ভালোবাসা।আবেগধর্মী ভালোবাসা গভীর হয়।আরাফের প্রতি অন্তর ভালোবাসা আবেগধর্মী নয়।আরাফের প্রতি তার কোন অনুভূতি নেই।অন্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো।আরাফ অন্তর হাত ধরে বলল,
‘বসো এখানে,কথা আছে।’
অন্ত মলিন মুখ করে বলল,
‘আসছি ওয়েট কর।’
আরাফ হাত ছাড়তেই অন্ত ঘরে আসলো।টেবিলে তার নীল রঙা ডায়েরী খুঁজতে লাগলো।ডায়েরীটার কথা একদমই মনে ছিলনা।নির্ভীকের প্রতি সব অনুভূতি ওই ডায়েরীতে লিখতো।এখন সেটা আরাফকে দেখাবে।ওটা দেখার পর আরাফ নিশ্চয় বলবেনা নির্ভীকের প্রতি অন্তর কোনো ভালোবাসা নেই।ভালোবাসা না থাকলেও যেই ভাল লাগাটা আছে সেটা একদিনের নয়।
পুরো ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজেও অন্ত তার ডায়েরীটা পেল না।নির্ভীকদের বাসায় যেই ঘরে থাকতো সেখানে আছে ভেবেই ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল।আরাফ বেলকুনির দরজায় দাঁড়িয়ে দেখছিল অন্ত কিছু খুঁজছে।অন্তকে চলে যেতে দেখে আরাফও গেল।
অন্ত বাসা থেকে বের হয়ে এক দৌঁড়ে নির্ভীকদের বাসায় আসলো।আরাফ তার পেছনে এসে জন্যই এতরাতে এখানে আসতে পেরেছে নাহলে অন্ত যা ভীতু রাতে একা ছাদেও যেতে পারেনা।ড্রইং রুমে নির্ভীকের বাবা-মা বসে ছিল অন্ত উনাদের সাথে কথা না বলেই উপরে চলে এসেছে কিন্তু আরাফ পারলোনা।আরাফ উনাদের সাথে কথা বলতে লাগলো আর অন্তর নিচে আসার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলো।অন্ত ওই ঘরের সামনে যেয়ে দরজা খুললো।ভেতরে অন্ধকার।দেয়ালে হাতরে সুইচ টিপে আলো জ্বালিয়ে দিল।ঘরের সবকিছু আগের মতোই আছে কিন্তু প্রচুর ধুলোবালি জমে আছে।টেবিলের উপর কিছু নেই।আলমিরা খুঁজেও কিছু পেলনা।ওয়্যারড্রপ খুলে নিজের আর ইচ্ছেমতির কিছু জামা-কাপড় পেল।ওসব রেখে বেডসাইট টেবিলের ড্রয়্যার খুললো।ড্রয়্যারে একটা টিকটিকি আর দুটো টিকটিকির ডিম দেখেই হকচকিয়ে লাফিয়ে উঠে কয়েকধাপ পিছিয়ে গেল।হঠাৎ কোথায় থেকে একটা আরশোলা উড়ে এসে গায়ে পরতেই অন্ত চিৎকার দিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে আসলো।নির্ভীকের ঘরের দরজা দিয়ে প্রান্তকে বেড়িয়ে আসতে দেখেই দৌঁড়ে গিয়ে প্রান্তকে জড়িয়ে ধরে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
‘প্রান্ত ভাইয়া,প্রান্ত ভাইয়া আরশোলা।’
আরশোলাটা তখনও অন্তর ওড়নায় বসে ছিল।অন্তর কথা বুঝে উঠতে প্রান্তর কিছুক্ষণ সময় লাগলো।অন্তর কন্ঠ পেয়ে নির্ভীকও ঘর থেকে বেড়িয়ে এসেছে।প্রান্ত অন্তকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আরশোলাটা ফেলে দিয়ে বলল,
‘আরশোলা আসলো কোথায় থেকে?তুমি এখানে কি করছো?কার সাথে এসেছে?’
অন্ত নিজের দিকে তাকিয়ে আরশোলা খুঁজতে খুঁজতে বলল,
‘আরাফ ভাইয়ার সাথে এসেছি।এখানে আমার ডায়েরী নিতে এসেছিলাম।ওই রুমে এত টিকটিকি আর আরশোলা,ইয়াক!!আর আছে?নেই তো না?’
বলেই সামনের দিকে তাকালো।নির্ভীক ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে অন্তর দিকে তাকিয়ে আছে।অন্ত মুখ মলিন করে নির্ভীকের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘খুঁজে পাচ্ছিনা।নীল কালার আর আমার নাম লিখা আছে দেখেছেন কোথাও ওটা?’
‘না।’
‘আমাদের বাসায়ও নেই।এখানেও পেলাম না।’
নির্ভীক আর কিছু বলল না।প্রান্ত বলল,
‘তোমার রুমেই কোথাও আছে হয়তো খুঁজে দেখ ভাল করে।’
অন্ত মলিন হেসে বলল,
‘আচ্ছা।’
অন্ত চলে যেতে লাগলো।প্রান্তও বাসায় যাওয়ার জন্য এগুতেই নির্ভীক আটকে দিল।প্রান্তকে ঘরে টেনে নিয়ে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দিয়ে উড়াধূরা কিল ঘুশি দিতে দিতে বলল,
‘শালা বলেছিলাম তোকে এখন যাসনা বাসায়।শুনলিনা আমার কথা।এখন মাইর খা।’
প্রান্ত নিজেকে রক্ষা করতে করতে বলল,
‘এই থাম মারছিস কেন?কি হয়েছে?’
নির্ভীক প্রান্তর পেটের উপর বসে গলা টিপে ধরে বলল,
‘কি হয়েছে?আমার বউকে জড়িয়ে ধরে বলছিস কি হয়েছে?চামড়া খুলে নিব তোর শালা।’
প্রান্তও পাল্টা আঘাত করে বলল,
‘আরে দুলাভাই তোর বউ আমার বোন হয়।আর কি বা* তোর শুধু আমাকেই চোখে পরে?ওই ছাগলটা যে সবসময় জোঁকের মতো তোর বউয়ের শরীরে লেগে থাকে সেটা চোখে পরেনা?’
নির্ভীক বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘কি করব বল?ও তো ওই ছাগলকে ভালোবাসে।’
‘বা* ভালোবাসে।’
বলে প্রান্ত বিরক্ত হয়ে উঠে বসলো।নির্ভীকের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘এভাবে আর কতদিন চলবে?’
নির্ভীক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘আজই শেষ নাহলে আমি মরেই যাব।ওর নরম তুলতুলে গাল,মিষ্টি ঠোঁট…
এসব ভেবে নির্ভীক কিছুক্ষণ চুপ করে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে থেকে ধুড়মুড় করে উঠে বসে বলল,
‘আস্তাগফিরুল্লাহ্!!’
চলবে…!………..