সুইটহার্ট-পর্ব:১৯

0
1483

#সুইটহার্ট
#Sohani_Simu
১৯.

দেখতে দেখতে আমার ফাইনাল পরীক্ষা সন্নিকটে চলে আসলো।আজ বাদে কাল পরীক্ষা আর আজই আমি জ্বর বাঁধিয়ে সারাদিন-রাত শুয়ে আছি।পরীক্ষার আগে অসুস্থ হওয়া আমার জিনগত সমস্যা বলে আমি মনে করি।আমার ডিএনএ তে এডিনিন,গুয়ানিন,সাইটোসিন আর থায়ামিন বেসের সাথে হয়তো ফিভার বেসও আছে।সেজন্যই এত ঘন ঘন জ্বর হয়।ক্লাসের অন্যান্য বন্ধুদের দেখেছি তাদের বছরেও দুএক বার জ্বর হয় কিনা সন্দেহ আছে।

সন্ধ্যায় ফুপ্পির বাসায় আমার রুমে কম্বলের মধ্যে শুয়ে আছি।একটু পর কম্বল থেকে মাথা বের করে বালিশে হেলান দিয়ে বসলাম।শ্রাবণ এখনও সোফায় বসে ল্যাপটপ টিপছে দেখে দূর্বল কন্ঠে বললাম,
“শ্রাবণ ভাইয়া!কি করছেন?ওই শ্রাবণ ভাইয়া?এই অংক?আজব তো,আজ আমার গলায় জোড় নেই জন্য কেউ আমার কথা শুনতে পাচ্ছেনা নাকি?একবার সুস্থ হই তারপর সবাইকে কানের ডক্টরের কাছে নিয়ে যাবো।অংক ভাইয়া!!!!”

শ্রাবণ আমার দিকে তাকিয়ে ল্যাপটপ সোফায় রেখেদিলেন।আমি উনার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললাম,
“এতক্ষণ শ্রাবণ ভাইয়া বলছিলাম শুনতে পেলেননা যখনই অংক ভাইয়া বললাম তখনই শুনতে পেলেন।আপনার নাম যে অংক এবার প্রমাণ পেলেন তো?

উনি সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আমার পাশে এসে বসলেন।উনার ঠান্ডা হাত আমার কপালে রেখে জ্বর চেক করে নরম কন্ঠে বললেন,
“জ্বর চলে গেছে।”

আমি রাগী কন্ঠে বললাম,”এবার আপনিও চলে যান,গেট আউট।
উনি ভ্রু কুচকে বললেন,”কি হয়েছে বলবি তো,কথায় কথায় এত রাগ দেখাচ্ছিস কেন?”

আমি ঝট পট কম্বল মুড়িদিয়ে শুয়ে পরলাম।কথায় বলবো না উনার সাথে আর।কাল তৌসি আর নিতু আপুর সামনে ওকারনে আমাকে রুম থেকে বের করে দিয়েছিলেন,আমার কত ইনসাল্ট হয়েছিল!!আর কখনও আপনার রুমে যাব না হু।

মনে মনে কথা গুলো বলছিলাম তখনই শ্রাবণ বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
“খেয়ে আবার ঘুমা।আজ আর পড়া করতে হবে না।সকালে দুঘন্টা পড়বি তাহলেই হবে,উঠ।”

আমি একলাফে উঠে বিছানা থেকে টেবিলের কাছে যেয়ে বাংলা যত বই,খাতা,নোট যা আছে সব ব্যাগে ঢুকিয়ে ব্যাগ নিয়ে চলে আসবো তখনই শ্রাবণ বললেন,

“তুই কি তোর বাপের বাসায় যাচ্ছিস?”

আমি উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,”না রকির বাসায় যাচ্ছি,উড বি হাজব্যান্ডের বাসায়।”

উনি খপ করে আমার ব্যাগ নিয়ে বিছানায় ফেলে দিলেন।এক হাতে আমার হাত পেছনে ধরে অন্য হাতে আমার গাল টিপে ধরে চোখমুখ শক্ত করে আমার দিকে ঝুকে বললেন,
“এবার বল,কি যেন বললি?উড বি হাজব্যান্ড?রকিকে বিয়ে করবি?”

আমি এক হাতে উনাকে সরানোর চেষ্টা করতে করতে বললাম,”হুম করবো।বললামই তো,কতবার বলবো?শুনুন ওসব বয়ফ্রেন্ড টয়ফ্রেন্ড ক্যান্সেল,আমি আপনাকে বয়ফ্রেন্ড করবোনা আর বিয়েও করবোনা।আপনি আর সিজান দুজনই খারাপ ছেলে, আপনাদের অনেকগুলো গার্লফ্রেন্ড আছে।রকির একটাও গার্লফ্রেন্ড নেই,রকি ভাল তাই আমি রকিকেই বিয়ে করবো।ছাড়ুন নাহলে ফুপ্পিকে বলে দিবো।”

উনি আমার হাত ছেড়ে দিয়ে তাচ্ছিল্য হেসে বললেন,”তোর মতো ডাফারের বয়ফ্রেন্ড হবো আমি?নেভার।আম্মু অনেক জোড় করছিল তাই একবার তোকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম তারমানে তো এটা নয় এখনও তোকে বিয়ে করতে চাই।এখন যা ভাগ,গেট লস্ট।”

বলেই উনি আমার ব্যাগ আমার দিকে ছুড়ে দিলেন।আমি ব্যাগ ক্যাচ করে ভ্রু কুচকে বললাম,”ওই এটা আমার ফুপ্পির বাসা কোথাও যাবো না আমি আর আপনি কি ভেবেছেন?আপনার মতো আইফেল টাওয়ার আর ধবল রোগীকে আমি বিয়ে করবো?কোথায় আমি কত সুন্দর আর কোথায় আপনি ধলা বান্দর!!ইউ গেট লস্ট।”

শ্রাবণ ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করতে করতে বললেন,”তুই সুন্দর?নিশ্চয় রকি বলেছে।রকি ছাড়া তো তোর মতো কালো পেত্নী কে কেউ পাত্তা দেয়না।রকিও দুদিন পর কেঁটে পরবে জাস্ট ওয়েট এ্যান্ড ওয়াচ।”

আমি তেঁতে উঠে উনার কাছে গিয়ে কোমড়ে হাত রেখে বললাম,”আপনি আমাকে কালো পেত্নী বললেন?”

উনি আয়নাতেই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,”তো কি বলবো?ফর্সা?ফর্সা পেত্নী?”

আমি থমথমে মুখ করে বললাম,”ফর্সা বলতে হবে না আর পেত্নীও বলবেন না,কালো হলেই মানুষ পেত্নী হয়না।”

বলেই গট গট করে রুম থেকে বেড়িয়ে এলাম।ফুপ্পিকে খেতে দিতে বলে ডাইনিং টেবিলে মন খারাপ করে বসে থাকলাম।কাল উনি আমাকে রুম থেকে বের করে দিয়েছেন আর আজ কালো পেত্নী বলেছেন,ইনসাল্টের উপর ইনসাল্ট করে যাচ্ছেন আমাকে।ফুপ্পি আমাকে গরম স্যুপ খেতে দিয়ে জ্বর চেক করে বলল,
“এখন এটা খেয়ে আরেকটা নাপা খা, একটু পর নরম করে ভাত রান্না করে দিব ভাত খেয়ে ঘুমাবি।”

আমি কিছু না বলে খেতে লাগলাম।ফুপ্পি চেয়ার টেনে বসে বলল,”নিতু তোদের বাসায় থাকবে।শিরিন এখন একা ভয় পায় মা বুড়ো মানুষ শিরিনের সাথে বেশি কথা বলতে পারেনা নিতু থাকলে ভালই হবে।তোর রুমেই থাক।”

আমি খাওয়া থামিয়ে বললাম,”আচ্ছা আমি এখানে কেন থাকবো?আমি আমাদের বাসায় আমার রুমে থাকবো আর তোমার কি মনে হয় নিতু আপু ভাবসকে আমার চেয়ে বেশি দেখাশুনা করবে??আমার চেয়েও বেশি কথা বলবে ভাবসের সাথে?”

শ্রাবণ চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললেন,”তোর চেয়ে বেশি কথা বলবে এমন কেউ আছে নাকি?”

আমি রাগী কন্ঠে বললাম,”আমি বেশি কথা বলি?”

ফুপ্পি বলল,”তুই পরীক্ষার কয়দিন এখানেই থাকবি।”
আমি ফুপ্পির দিকে তাকিয়ে বললাম,”কিভাবে থাকবো এখানে বলো তো?শ্রাবণ ভাইয়া বার বার আমাকে গেট লস্ট বলছে। কাল তো আমাকে রুম থেকে বেরই করে দিল আর আজ আমাকে কালো পেত্নী বলেছে।তুমিই বলো আমি দেখতে কালো?”

ফুপ্পি চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল,”তোরা তোরা সব এক,আমার কথা তো দুজনার কেউ শুনিসনা।ছেলেকে কিছু বললে সে তো রাগ করে বসে থাকে আর তোকে কিছু বললে তুই চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলিস।আমার হয়েছে যত জ্বালা।”

ফুপ্পি চলে গেল।আমি শ্রাবণের দিকে তাকাতেই উনি আমাকে একটা চোখটিপ দিলেন।আমি একটা মুখ ভেঙচি দিয়ে রুমে চলে আসলাম।মেডিসিন খেয়ে বই নিয়ে বসলাম।কালকে সকালে আমার ফাইনাল এক্সাম ভাবতেই ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।আমি বিছানায় বসে পড়ছিলাম তখনই শ্রাবণ রুমে এসে বললেন,”আর পড়তে হবে না ডিনার করবি চল।”

আমি উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,”সব ভুলে গেছি।এখন কি হবে?”

উনি বিছানার পাশে এসে আমার থেকে বই কেড়ে নিয়ে বললেন,”ডোন্ট ওরি,লিখার সময় সব মনে পড়বে।”

ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি সাড়ে নয়টা বাজে।শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে দেখি একহাত জ্যাকেটের পকেটে ঢুকিয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে।আমি চিন্তিত হয়ে বললাম,
“এখন খাব না আর একটু পড়ি।”

তখনই তৌসি খাবারের ট্রে হাতে নিয়ে রুমে ঢুকে বলল,”ভাইয়া যাও আম্মু ডাকছে।আমি আর জুঁই এখানেই খাব।”

তৌসির কথা শুনে শ্রাবণ যাওয়া বাদ দিয়ে বিছানায় আমার পাশে বাবু হয়ে বসে বললেন,”আমার খাবারও নিয়ে আয়,আমিও এখানে খাব।”

তৌসি খাবারের ট্রে রেখে আবার চলে গেল।একটু পর তৌসি আর নিতু আপু প্লেট হাতে ফিরে এল।ওদের দেখে মনে হচ্ছে আজকে ঈদ লেগেছে।নিতু আপু এসেই হাসিখুশি মুখ করে বলল,
“আমিও তোমাদের সাথে খাব।”

আমি কিছু বলবো তার আগেই শ্রাবণ মুখ গম্ভীর করে বললেন,”পাঁচ মিনিটে সবাই খাওয়া শেষ কর,এখন কোনো আড্ডা হবেনা।”

উনার এক কথাতেই সবাই চুপচাপ খেল।আমি সবার আগে খাওয়া শেষ করে ফাইলপত্র সব গুছিয়ে নিয়ে শুয়ে পরলাম।তৌসি রাতে আমার কাছেই থাকলো।ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখলাম আমি এত স্লো লিখছি যে এক্সাম শেষ তাও প্রথম পাতায় লিখে শেষ করতে পারিনি।টেনশনে আমার ঘাম ছুটে গেল।

.
এক্সাম শেষ করে হল থেকে বেড়িয়ে দেখি শ্রাবণ ভাইয়া আর বাবা গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছে।বাবাকে দেখে তো আমি অনেক খুশি।এক দৌঁড়ে ওদের কাছে যেয়ে খুশি হয়ে বাবাকে বললাম,
“বাবা তুমি এসেছো?”

বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,”এক্সাম কেমন হলো আম্মু?”

“ভাল,তুমি আমাদের সাথে বাসায় যাবা?”

“হ্যা,চল।”

বাবা গাড়িতে উঠে বসলো।আমিও উঠবো তখনই শ্রাবণ আমার হাত ধরে আটকিয়ে মুচকি হেসে বললেন,”তোমার গালে কলমের কালি লেগে আছে।”

আমি হাসতে হাসতে আমার ডান হাত এগিয়ে দিয়ে বললাম,”হাতে দেখুন কত কালি লেগেছে।”

উনি হাত দেখে আমার গাল টেনে বললেন,”মাচ কিউট।”

আমি মুখ ফুলিয়ে বললাম,”কিউট নয় কালো পেত্নী।”

উনি শব্দ করে হাসলেন।তখনই কেউ আমাকে ডাকলো।সামনে তাকিয়ে দেখি ভাবির কাজিন শুভ ভাইয়া।শ্রাবণ তাড়াহুড়ো করে আমার একবাহু ধরে আমাকে বাবার পাশে বসিয়ে দিয়ে গাড়ির দরজা বন্ধ করে দিলেন।গাড়ির কাচ কালো হওয়ায় বাহিরে থেকে ভেতরে কিছু দেখা যাবেনা কিন্তু আমি ভেতর থেকে সব দেখতে পাচ্ছি।শুভ ভাইয়া বার বার গাড়ির দিকে তাকাচ্ছে।সাথে আরও কয়েকটা ছেলে আছে,সবার সাথেই শ্রাবণ ভাইয়া হাসি মুখ করে কথা বলছে।ছেলে গুলোকে আমার একটুও ভাল মনে হচ্ছেনা,সব গুলোর চেহারা গুন্ডা-মস্তানদের মতো।কানে দুল,হাতে চুড়ি,গলায় চেইন,মাথায় ব্যান্ড পরে আছে একেক জন।সবাইকে একসাথে দেখে মনে হচ্ছে শ্রাবণ ভাইয়া ওদের লিডার।দেখে মনে হচ্ছে শ্রাবণ ভাইয়া ওদের কোনো কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছে আর ওরা সব কিছু বুঝে নিচ্ছে।বাবা আমার সাথে টুকি টাকি কথা বলছে তাও আমি বার বার আড় চোখে শ্রাবণের দিকে তাকাচ্ছি।শুধু আমি একা নয় আরও অনেক মেয়ে উনার দিকে তাকাচ্ছে যেটা আমার একটুও ভাল লাগছেনা।সবার সাথে কথা শেষ করে একটু পর শ্রাবণ ভাইয়া ড্রাইভিং সিটে এসে বসলেন।লুকিং গ্লাসে তাকাতেই উনার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল।আমি মুখ ফুলিয়ে বাবার কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে রাখলাম।

চলবে…..!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here