— “আমি তো তোমাকে ভালবাসতে চাইনি আবির ভাইয়া, তুমিই তো আমাকে বাধ্য করেছিলে।”
— “আমার কাছে যে আর কোন উপায় নেই বৃষ্টি।”
— “তার উপর আবার আমার ফ্রেন্ডকেই বিয়ে করছ। হাসালে আমায়। প্রথমে আমাকে জোর করলে, এখন আমাকে মায়ায় ফেলে নিজের পথ দেখছ তুমি? আমার সামনেই মৌটুসিকে বিয়ে করবে আর আমি তোমাদের বিয়ের সব আয়োজন করব। অনেক সুন্দর তাই না? আবির ভা… ভাইয়া।”
— “তুমি আমাকে ভাইয়া বলছ কেন?”
— “আসল সম্পর্কটা এখন থেকে মানার চেষ্টা করছি। আবার কেন এসেছ আমার কাছে? আমি তো তোমাদের গায়ে হলুদের সব ব্যবস্থা করেই দিয়ে এসেছি। এতক্ষণে তোমাকে খোঁজা শুরু হয়েও গিয়েছে। যাও, হলুদ বাটা মেখে সেই বাটিটা দেও, সেটাও তো মৌটুসির কাছে নিয়ে যেতে হবে। যাই হোক, আমি তোমার মামাতো বোন বলে কথা। আদরের ছোট বোন, তোমার বিয়ের সব দায়িত্বই তো পালন করছি। যাও, যাও, বিয়ের সময় ঘনিয়ে আসছে তোমার। নতুন জীবনের জন্য শুভ কামনা।”
বলেই ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিল আবিরকে। দরজা আটকে সেখানে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল বৃষ্টি। সে নিজেকে বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছে। সে কি ভাবছে এই মুহূর্তে- সেটাই ধরতে পারছে না। নিজেকে নিজের কাছেই বড্ড অচেনা লাগছে। কান্না পাচ্ছে প্রচুর। অবশ্য কম সময় তো হয়নি আবিরের সাথে রিলেশনের। ৪ টা বছর। এর মাঝে নানান ঘটনার সম্মুখীন হলেও গত ৪ বছরের মধ্যে যতগুলো সাদৃশ্যপূর্ণ ঘটনা ছিল তার মধ্যে আবিরের সাথে সম্পর্কে থাকাও একটি। হুট করে চেনা মানুষটা অচেনা হয়ে গেলে কার-ই বা ভালো লাগবে! আজও ভাবে বৃষ্টি- সে কি আদৌ আবিরকে চিনেছিলেন নাকি চিনতেই পারেনি?
আবিরের সাথে বৃষ্টির চেনাজানা ছোট কাল থেকেই। আবির বৃষ্টির ফুফাতো ভাই। বৃষ্টির বাবারা দুই ভাই বোন। সেই সূত্রে আসা যাওয়াও ছিল দুই পরিবারে অবাধ। বাড়ি কাছাকাছি হওয়ায় যাত্রায় সমস্যা হত না প্রথম দিকে। তারপর হঠাৎ এক্সিডেন্টে আবিরের বাবা মারা গেলে আবিরের দাদির চরিত্রে পরিবর্তন আসে। যার ফলাফল হিসেবে বৃষ্টির বাবা একসময় নিজের বোনকে তাদের পাশের ফ্ল্যাটে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন। সেই থেকে একসাথে সাথে। শুরুর দিকে আবিরের প্রতি বৃষ্টির “ভাই” ব্যতীত অন্য কোন মনোভাব ছিল না। হঠাৎ করেই ৪ বছর আগে আবির বৃষ্টিকে প্রপোজ করে। তখনকার দৃষ্টিকোণ থেকে ভেবে বৃষ্টি রিজেক্ট করেছিল আবিরকে। তারপর থেকে আবিরের চরিত্রে আসে পরিবর্তন। সে বৃষ্টির সাথে অন্য ধরণের আচরণ করত। তার প্রতিটা কথায় বৃষ্টি আলাদা অর্থ খুঁজে পেত। যেটা বুঝতে সমস্যা হত না বৃষ্টির। তবে মানতে চাইত না সে। আবিরের কাজকর্ম আর পাগলামির কাছে একসময় বৃষ্টি হার মেনে নেয়। তারপর থেকে শুরু হয় তাদের সম্পর্ক। অবশ্য এটা শুরু হওয়ার পরও তারা যে সম্পর্কে আছে, এমন কোন কাজ করেনি কখনো। ঘুরতে গেলে পরিবারের সাথে গিয়েছে, খাওয়া দাওয়ার জন্যও সেই পরিবার-ই থাকত। আলাদা করে কখনো দেখা করেনি ওরা। তবে কথা বলেছে। মাঝে মাঝে বৃষ্টির এই মনেও হয়েছে যে আবিরের সাথে তার যোগসূত্র শুধু “মুখে ভালোবাসি বলা” পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। তার মধ্যে আবির বলত শুধু কথাটা, বৃষ্টি তো শুধু একবার বলেছিল আবিরের জোর করায়। তারপর একটা সময় বন্ধ হয়ে যায় সেসবও। সত্যিই কি তাদের মধ্যে আদৌ কোন সম্পর্ক ছিল? বৃষ্টি নিজেকে চিনতে পারে না। গত চার বছরে নিজের মধ্যে আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে বৃষ্টি। এতদিন মনে হয়নি এমন। কিন্তু গত কয়েক দিন ধরে তার মনে হচ্ছে, সে সেই আগের বৃষ্টি নেই, সে বদলে গিয়েছে। কিন্তু কোন দিক থেকে বদলেছে- সেটাও ঠাওর করতে পারছে না। মূলত কোন ভাবনাই ভাবতে পারছে না সে।
কয়েকদিন আগেই হুট করে বৃষ্টির ফুফু এলেন বৃষ্টির বাড়িতে। সাধারণত ভাইয়ের বাড়ি পাশে হলেও তিনি তেমন আসতেন না এদিকে। নিজের ফুফুকে দেখে বেশ খুশি হলো বৃষ্টি। তার আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে। কিন্তু ফুফু তাকে টেনে নিয়ে এসে বসিয়ে দিলেন। তারপর তিনিই কথা বলা শুরু করলেন।
— “হ্যাঁ রে বৃষ্টি, তোর এক বান্ধবী আছে না, মৌটুসি?”
— “হ্যাঁ, আছে। কেন?”
— “ওকে না আমার আবিরের জন্য খুব পছন্দ হয়েছে রে।”
— “কিন্তু…”
— “আমি চাই তুই ওদের বাড়িতে কথাটা তোল। আমি তো আর হুট করেই চলে যেতে পারি না। একটা ব্যাপার আছে না?”
নিজের ফুফুর এমন কথায় বিশাল অবাক হলেও শান্ত হয়ে বসেছিল বৃষ্টি। তার বিরুদ্ধে গিয়ে কোন কথা মুখ থেকে বের করতে পারেনি সে। অপেক্ষা করে আবিরের। ফুফুর বার বার এক প্রশ্ন করায় শুধু কোনোমতে মাথা নাড়িয়ে নিজের ঘরে চলে যায়। সেটাকে তার ফুফু “হ্যাঁ” হিসেবেই ধরে নিয়েছিলেন সেদিন।
এরপরও আবিরের কাছ থেকে কোন কথা শোনেনি সে এই নিয়ে। ভেবেছিল আবির হয়তো জানে না, তাই প্রতিবারের মতো স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলছে। কিন্তু আবিরকে বলবে বলবে করে বলা হয়নি প্রতিবার। আবিরের সাথে স্বাভাবিক কথা-বার্তায় এতটাই ডুবে যেত যে কল কাঁটার পর মনে পড়ত বিয়ের নিয়ে কথা বলার বিষয়টা। কিন্তু এরপর আবিরকে ফোন করলে আর পাওয়া যেত না। রাতে বাবা-মাকে না জানিয়ে ঘর থেকে বের হওয়াও হয়ে উঠত না। বাবা-মায়ের থেকে শুধু আবিরের বিষয়টায় গোপন রেখেছিল সে। বাকি সবটা পানির মতো পরিষ্কার ছিল বৃষ্টির বাবা আর মায়ের কাছে। এমনকি ছোট ভাই বিভোর পর্যন্ত এ নিয়ে কিছুই জানত না। অবশ্য তার জানার কথাও নয় এসব বিষয়ে।
ফুফুর জোরাজুরিতে মৌটুসির বাড়িতেও আবিরের কথা তুলেছিল একবার। ফুফু নিজে সামনে দাঁড়িয়ে থেকে বৃষ্টিকে দিয়ে কল করিয়েছিলেন মৌটুসির বাবা-মাকে। সেখান থেকেই শুরু হয় সবটা। আবিরকে জানানোর পরও আবির খাপছাড়া ভাবেই ছিল। এই নিয়ে কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি তার মাঝে। মৌটুসির সাথে আবিরের বিয়ে ঠিক হলো, বিয়ের জামাকাপড় সহ অন্যান্য সব কিছুর কেনাকাটা হলো, সবতাই স্বাভাবিক যেন দুজনের মতেই বিয়েটা হচ্ছে। বৃষ্টির ভূমিকা ছিল এক্ষেত্রে আবিরের “বোন” এর। নিজের বিয়ের সব কাজে ছিল, নিজের মন মতো পুরো বাড়ি সাজানোর দায়িত্ব নিয়েছিল যেন। সব কাজে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিল সে। আবিরের খাপছাড়া মনোভাবও বৃষ্টির বোঝার বাইরে ছিল।
এতকিছুর পর আজ আবিরের গায়ে হলুদ। আজ হলুদ বাটার সময় পাশে বসে থাকা ফুফুই তাকে হঠাৎ বলে উঠল,
— “যাক, আমার ছেলে যাকে ভালোবাসে, তাকেই বিয়ে করছে শেষমেশ।”
— “ভালোবাসে মানে?”
কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে বৃষ্টি। ফুফু সাথে সাথেই উত্তর দেন,
— “মৌটুসিকে তো আবির অনেক আগে থেকেই ভালোবাসে। যদিও আমি জানতে পেরেছি কয়েকদিন আগে। এতদিন তো মৌটুসি মৌটুসি করে পাগল করে দিয়েছিল। বিয়ে করলে না কি তাকেই করবে আর কাউক…”
পুরো কথা শেষ হতে না হতেই আবির বৃষ্টির হাত ধরে টেনে নিয়ে যাওয়া শুরু করে। পিছনে আবিরের মা প্রশ্ন করলেন কয়েকবার।
— “কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস ওকে?”
কিন্তু কোন উত্তর এলো না। আবির বৃষ্টি ঘরে নিয়ে এসে পড়লে বৃষ্টি বলেছিল কথাটি। কিন্তু আবির পুরো কথাটাই ঘুরিয়ে দেয় নিজের দিক থেকে। হঠাৎ করেই এতগুলো ঘটনা ঘটে যাওয়ায় বৃষ্টি স্থির করে নিজেকে কিছু সময় দেওয়ার। তারপর নাহয় বাকিটা ভাবা যাবে। এই মুহূর্তে তার কি প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত সেটাই বুঝে উঠতে পারেনি কে বৃষ্টি।
_____
গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হলো কিছুক্ষণ আগে। বৃষ্টি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সবটা সামলিয়েছে। যতই হোক, নিজের ফুফাতো ভাই আর বান্ধবীর বিয়ে বলে কথা। সামনে না থাকলে তো হাজার কথা উঠবে বিয়ে বাড়িতে। গায়ে হলুদ শেষ হলে সেটা নিজে মৌটুসির বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয় সে। তার গায়ে হলুদ শেষ হতে হতে অনেকটা সময় লেগে যায়। শেষে বিয়ে যেই কমিউনিটি সেন্টারে হবে সেখান থেকে ঘুরে এসে নিজের ঘরে চলে যায় বৃষ্টি। বিছানায় নিজেকে এলিয়ে দিতেই ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিতে বেশি সময় লাগে না বৃষ্টির।
।
চোখ মেলে তাকাতেই বৃষ্টি নিজেকে একটা ফুলে সজ্জিত ঘরে আবিষ্কার করে। একটু ভালো করে সব দিক দেখতেই বুঝতে পারে সে নিজে একটা বাসর ঘরে আছে যেটা সে নিজেই আবিরের জন্য সাজিয়েছিল। ঠিক একই রকম ঘর। আরেক্তু ভালো করে মনে করার চেষ্টা করতেই বুঝতে পারে, নাহ, ঘরটা তো এখনো সাজানো হয়নি। শুধু যারা সাজাবে তাদেরকে সাজানোর ধরনটা বলে দেওয়া হয়েছিল। যেইটা নিখুঁতভাবে বৃষ্টির সামনে বর্তমানে সজ্জিত।
দরজা খট করে খোলার শব্দে সামনের দিকে তাকায় বৃষ্টি। সে অবাক হয়, সে নিজে কি করে বিয়ের সাজে এই বাসর ঘরে বসে আছে? নিজের শরীরের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারে তার শরীরে যেই শাড়িটা সেটা সেই একই বিয়ের শাড়ি যেটা আবির মৌটুসির জন্য পছন্দ করেছিল।
মুহূর্তেই তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। তাহলে কি সত্যিই আবির কোন ব্যবস্থা করেছে, যার জন্য আবিরকে আর মৌটুসিকে বিয়ে করতে হয়নি। তার সাথেই আবিরের বিয়ে হয়েছে? জানা নেই। আবার দরজা খোলার কথা মনে পড়তেই সেদিকে তাকায় বৃষ্টি। আবির বিয়ের শেরওয়ানি পরে দাঁড়িয়ে আছে। আবিরকে দেখতে খারাপ লাগছে না। কিন্তু এই শেরওয়ানিটা মৌটুসি পছন্দ করেছিল আবিরের জন্য। ভাবতেই সেই হাসিটা মুখ থেকে সরে গেল। আবির যখন এসে তার হাত ধরে টান দিল, তখন তার নজরে এলো আবিরের মুখটা। চোখ লাল হয়ে এসেছে। মুখে হিংস্রতা প্রকাশ পাচ্ছে। বৃষ্টি চিনতে পারল না আবিরের এই রূপ।
আবির টেনে টেনে তাকে ঘর থেকে নিয়ে গেল। এবার বৃষ্টি খেয়াল করল আবির যেন তার আত্মাকে ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আর সে নিজ অবস্থানেই বসে আছে। এন আবির তার ভেতর থেকে একটা অস্তিত্বকে টেনে নিয়ে গেল। আরেকটা অস্তিত্ব সেখানেই রেখে গেল। বৃষ্টি নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে দেখল তার পরনে সেই গায়ে হলুদের হলুদ শাড়িটা। এটা পরে বৃষ্টি ঘুমাতে গিয়েছিল বাড়ি ফিরে। বৃষ্টি অপেক্ষা না করেই তাদের পিছু পিছু গেল। বৃষ্টির মনে হচ্ছে তার সামনে একটা সিনেমা চলছে আর সে সেই সিনেমার মধ্যে দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণটা দেখতে পারছে। তাদের সাথে হেঁটে যেতে পারছে। তার সামনেই আরেকটা বৃষ্টি বিয়ের সাজে আবিরের পিছু পিছু হেঁটে চলেছে।
আবির সেই বিয়ের সাজের বৃষ্টিকে নিজে ফ্লোরে ছুঁড়ে মারল। কথা থেকে একটা চাবুক এনে বৃষ্টিকে মারতে শুরু করল। বিয়ের সাজে থাকা বৃষ্টি বার বার কাকুতি মিনতি করছে তাকে যেন না মারা হয়। আর দাঁড়িয়ে থাকা বৃষ্টি চিৎকার করে বলছে – “পাল্টা মার দেও বৃষ্টি, ওর সামনে মাথা নত করো না।” কিন্তু হায় ভাগ্য! সামনে থাকা কেউ তার আওয়াজ শুনতে পারছে না। বৃষ্টির নিজের সামনেই তার আরেকটা প্রতিচ্ছবিকে মেরে রক্তাক্ত করা হলো। আবির নিজের করল। কিন্তু হলুদ শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে থাকা বৃষ্টি কিছুই করতে পারল না। নিজের এমন রূপ দেখে সে চমকে উঠল। শিউরে উঠে পাশে থাকা কারো হাত খামচে ধরল। সামনে রক্ত গঙ্গা বইছে যেন। বৃষ্টির হাতের বন্ধন আরও শক্ত হচ্ছে। হঠাৎ পুরুষালি আওয়াজে সে লাফিয়ে উঠে।
— “এই যে মিস, শুনছ? আমার হাত ছাড়। রক্ত বের করে ফেলবে না কি?”
— “কি হয়েছে?”
বলেই সামনে তাকাল বৃষ্টি। সামনে এক সুদর্শন লোক তাকে অনবরত হাত ছাড়তে বলছে। সে বুঝতে পেরে ছেড়ে দিল। আগের ঘটনাগুলো ভাবতেই বুঝতে পারল স্বপ্ন দেখছে। সেইখানে থম মেরে বসে রইল। তার হালকা ঝাঁকুনিতে ধ্যান ভাঙল।
— “কি হয়েছে? কথা বলছ না কেন? আমার হাত তো আজ শেষ করে দিলে তুমি।”
চলবে।
[ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিবেন। শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করব।]
স্বপ্ন
সাদিয়া_সৃষ্টি
পর্বঃ- ০১