কাজল নদীর জলে
আফিয়া আপ্পিতা
২৯.
“আপনি সত্যিই আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবেন? এর জন্যই বাসায় পাঠাতে চাচ্ছেন?” ব্যাথাতুর গলায় বলে সুরলা। চয়ন ভ্রু কুঁচকে তাকায়। ব্যাগ গোছানোর সাথে ডিভোর্সের কী সম্পর্ক! সুরলার কথাটা নিয়ে গভীর চিন্তা করে। চিন্তাভাবনা শেষে বিড়বিড় করে বলে, “দুই লাইন বেশি বুঝলে যা হয় আর কি।” তারপর গম্ভীরমুখে বলে,
“এত কথা বলার সময় নেই এখন, দ্রুত ব্যাগ প্যাক গুছিয়ে নাও। এখুনি যেতে হবে। আমি ও তোমার সাথে যাব।”
” না গেলে হয় না? এখান থেকে একবার যাওয়া মানে সারাজীবনের জন্য চলে যাওয়া। আর পুরো জীবনের জন্য একে অপরের থেকে মুক্তি। আপনি ভেবে বলছেন তো!” ছলছল চোখে বলে সুরলা। চয়ন অন্যদিকে তাকিয়ে সুরলার অগোচরে মুখ টিপে হাসে। তারপর সুরলার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
“একবার যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তখন ফিরানো যাবে না। যেতে হবেই।”
“একবার গেলে আমি কিন্তু আর ফিরব না।” কাঁদোকাঁদো গলায় বলে সুরলা। চয়ন তার গম্ভীরতা বজায় রাখে।
“আমি ফিরতে অনুরোধ করব না।”
সুরলা অশ্রুসিক্ত চোখে চেয়ে থাকে চয়নের পানে। কাল রাত থেকে পুরোনো অনুভূতিগুলো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেছে। আজ তা চিরতরে নিধন করতে হবে ভাবতেই পারছে না। চয়নের অতীত জানার পর থেকে চয়নকে ছাড়ার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছিল সুরলা। এখন সেই ভাবনা স্বয়ং চয়নই আনছে। সুরলা অসাড় হয়ে বসে থাকে, নড়ে না। চয়ন সুরলার ট্রলি খুঁজে নিয়ে ওয়ারড্রব থেকে কাপড় বের করে এলোমেলো করে রাখতে শুরু করেছে। সে তার কাজে মগ্ন থেকেই বলে,
“সব জিনিস গুছাও, একটা জিনিস ও যাতে না থাকে। কেউ যাতে বুঝতে না পারে তুমি এখানে ছিলে। ”
চয়ন তার সাথে সাথে তার সব স্মৃতি ও মুছে ফেলতে চাইছে! এতটা ঘৃণা করে তাকে! ভাবতেই টুপ করে এক ফোটা জ্বল গড়িয়ে পড়ে সুরলার চোখ থেকে। কাপড় এলোমেলো করে ট্রলিতে রাখার মাঝে সুরলার দিকে তাকায় চয়ন। সুরলাকে কাঁদতে দেখে থেমে যায়। ঘটনা এখানেই শেষ করা উচিত। চয়ন শব্দযোগে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে বলে,
” করলা বেগম, তোমাকে বোকা বানানো এত সহজ জানতাম না। যাক গে, তোমার রিয়েকশন ভালো ছিল। আমি মুগ্ধ।”
কান্না থামিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকায় সুরলা। বলে,
” মানে!”
“মানে হলো, মা বাবা আসছে। তাই তোমাকে আমার রুমে নিতে যেতে এলাম। বাবা মা তোমাকে এই রুমে দেখলে উল্টোপাল্টা ভাবতে পারে তাই তোমাকে আমি রুমে যাবার কথা বলতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তুমি পুরো কথা না শুনে নিজের মত ব্যাপারটা সাজিয়ে নিলে। দুই লাইন বেশি বুঝে, ঢাকা গিয়ে ডিভোর্স অবধি নিয়ে গেলে। আমি ও সত্য গোপন রেখে দায়সারা কথা বললাম, যাতে তোমার রিয়েকশন দেখতে পারি। আমি ভাবি নি, তুমি এতটা সিরিয়াস হয়ে কাঁদতে বসে যাবে। তোমার রিয়েকশন দেখে আমি মুগ্ধ। যাক, কেউ একজন আমাকে হারাবার ভয়ে কাঁদছে!”
স্মিত হেসে বলে চয়ন। এতক্ষণে সুরলার পুরো ব্যাপারটা বুঝে এসেছে । বুঝে আসতেই ক্ষেপে গেল চয়নের উপর। এই লোক আবার তার অনুভূতি নিয়ে মজা করছে! আবার বলে কি-না তোমার রিয়েকশন দেখতে চাচ্ছিলাম। সুরলা উঠে চয়নের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। আকস্মিক খাট থেকে কুশন নিয়ে মারতে থাকে চয়নকে। বলতে থাকে,
“আপনি মজা করছিলেন? জানেন, আমার কেমন লাগছিল? মনে হচ্ছিল, কেউ কলিজা ফুটো করে দিয়েছে। ভালোবাসার মানুষকে হারানোর ভয়ানক কষ্টটা তো আপনি ও বুঝেন তাও মজা করেন কেন! সবসময় আমার অনুভূতি নিয়ে খেলতে হয় আপনার? এত কষ্ট দেন কেন? এত কষ্ট দেয়া থেকে একবারেই মুক্তি দেন। আমি চলে যাই। থাকব না আর। আপনার মজা, আপনার অতীত নিয়ে আপনি থাকুন। আমি ঢাকা ফিরে যাচ্ছি।”
কুশন রেখে ব্যাগ ট্রলিতে এলোমেলো করা কাপড় সহ চেইন লাগিয়ে হাটা ধরে। চয়ন আটকাতে চায়, সুরলা থামে না। হনহন করে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। চয়ন আসে পিছু পিছু। সুরলাকে থামাতে কোমরে হাত দিয়ে বসে পড়ে ফ্লোরে। আর্তনাদ করে বলে,
” দেখতে তো দুই ফুটের লিলিফুট, তাও তোমার শক্তি আসে কোথা থেকে? আমাকে পুরো শেষ করে দিলে। মরে গেলাম রে!”
সুরলা সদর দরজায় এসেছে সবে। চয়নের আর্তনাদ শুনে থেমে যায়। পেছু ফিরে চয়নকে ফ্লোরে বসে থাকতে দেখে দৌড়ে যায়। ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে,
“কী হয়েছে? কোথায় ব্যাথা পেয়েছেন? বেশি লেগেছে? ” প্রশ্নের ঝুলি খুলে বসে সুরলা। চোখে মুখ ভরা অস্থিরতা। চোখে পানি এসে গেছে ফিরতি। চয়ন সুরলার চেহারার দিকে তাকায় এক পলক। তারপর মৃদু হাসে। সুরলার ভালোবাসা তাকে স্পর্শ করে যাচ্ছে প্রতিক্ষণে। চয়ন উঠে দাঁড়ায়। হেসে বলে,
“রুমে চলুন মিসেস।”
সুরলা বুঝতে পারে, চয়ন আবারও মজা করেছে। সুরলা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,
“আবারও মজা করছেন আপনি! আপনি মানুষটা ভীষণ খারাপ। ”
“আমি মানুষটা আগে থেকেই খারাপ, তোমার ভালোবাসার আগ থেকেই। তাই পুরনো অধ্যায় নিয়ে কথা বলা বাদ দাও। রুমে চলো তাড়াতাড়ি। তোমার সব জিনিস গুছিয়ে নাও। বাবা মা এসে পড়বেন যে কোন সময়। বাবা মা এসে পৌঁছে গেলে কিন্তু বিপদ। ” সুরলার হাত ধরে বলে চয়ন। সুরলা হাতের দিকে এক পলক তাকিয়ে বলে,
“আমি যাব তবে তিনটা শর্তে। ”
“শর্ত! কিসের শর্ত! এই রুম থেকে ওই রুমে যাবে তার জন্যও শর্ত দেয়া লাগে?” বিরক্তি গলায় বলে চয়ন। সুরলা ভেংচি কেটে বলে,
“আমার দেয়া লাগে। পূরণ করলে বলুন, নয়তো আমি ঢাকা চললাম।” হাত ছুটাতে চায় সুরলা। চয়ন হাত শক্ত করে ধরে অনুনয়ের সাথে বলে,
“যেও না প্লিজ! বাবা মা তোমার ফিরে যাওয়ার কথা শুনলে আমাকে আবার খারাপ ভাববেন। তাদের চোখে ঘৃণা আর অবিশ্বাস দেখে সহ্য করতে পারি না আমি। ”
“তাহলে শর্ত পূরণ করুন।” দায়সারা উত্তর সুরলার। চয়ন হতাশ গলায় বলে,
“হাতি গর্তে পড়লে পিঁপড়ে ও লাথি দেয়। বলো কী কী শর্ত?”
সুরলা যেন এরি অপেক্ষায় ছিল। তড়িৎ হেসে বলে,
” প্রথম শর্ত , আমাকে ঘুরতে নিয়ে যেতে হবে। ”
সায় জানিয়ে চয়ন বলে,
” ঠিক আছে নিয়ে যাব । দ্বিতীয় শর্ত?”
” দ্বিতীয় শর্ত, আমার নামকে ব্যঙ্গ করা যাবে না। সুরলা বা ভালোবেসে সরু ডাকবেন। আর এখন বলতে হবে, সুরলা আমার সাথে আমাদের রুমে চলো। ”
“এ আর এমন কী? তোমার নাম ধরেই সম্বোধন করছি, গরিলা আক্তার ওরফে করলা বেগম আমার সাথে আমাদের রুমে চলো।” রগড় করে বলে। সুরলা ক্ষেপে যায়। অন্যদিকে ফিরে বলে,
“আমি সত্যিই ঢাকায় ফিরে যাব বলে দিচ্ছি।”
” ওকে ফাইন, বলছি। ” সিরিয়াস ভঙি চয়নের।
সুরলা আড়চোখে তাকিয়ে বলে,
“বলুন।”
” বলছি, তার আগে বলো, কী যেন নাম তোমার? আমার তো মনে আছে, গরিলা আর করলা।” হাসি চেপে বলে চয়ন। সুরলা চয়নের হাতের বাধন থেকে হাত ছাড়িয়ে কদম বাড়ায়। রাগে শরীর কাঁপছে তার। এই লোকটা এত খারাপ কেন! এক কদম বাড়িয়ে আরেক কদম দিতে পারে না। তার আগেই চয়ন সুরলার হাত ধরে বলে,
“কিট্টি আমার সাথে আমাদের রুমে চলো।” মৃদু স্বরে বলা চয়নের এই কথাটাই সুরলার সব রাগ নিঃশেষ করার জন্য যথেষ্ট ছিল। কতদিন পর এই ডাকটা শুনেছে সে! এই ডাকটা শুনে সুরলার মনে হচ্ছে তারা আগের সেই সুন্দর স্মৃতি ফিরে গেছে। সেই পরিচয়, সেই বন্ধুত্ব, খুনসুটি! এখন সব স্মৃতি। আজ যেন সব তাজা হল। সুরলার ইচ্ছে হয় বলতে, “অন্য কোন নাম নয় এই নামেই ডাকবেন আমায়। আপনার মুখে ‘কিট্টি’ ডাকটা বড্ড আদুরে শোনায়। লজ্জায় বলতে পারে না। চয়ন বলে,
” দ্বিতীয় শর্ত সম্পূর্ণ হয়েছে?”
সুরলা মাথা নাড়ায়। চয়ন তৃতীয় শর্ত জানাতে বলে। সুরলা চয়ন আর তার হাতের বাধনের দিকে তাকিয়ে বলে,
“বছরের বারোটা ঋতুতে ঘটে যাওয়া সব সুখ দুঃখ এইভাবে হাতে হাতে রেখে পার করবেন। কখনো ছেড়ে দিবেন না তো? কথা দিন।”
সুরলার কথায় চয়ন হাতের বাধন শিথিল করে দেয়। পরক্ষণেই দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখে বাধন শক্ত করে বলে,
“তাড়াতাড়ি চলো, দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
★
বৈশাখ তার আগমনী বার্তা হিসেবে ঝড় বৃষ্টি নিয়ে হাজির হয়েছে আকস্মিক। মাঝে মাঝে বজ্রপাতের ভয়ংকর শব্দ কানে আসছে। রুম গুছাতে গিয়ে বারবার ভয়ে কেঁপে ওঠছে সুরলা। চয়ন রুমে নেই, পুরো ফ্ল্যাটের দরজা জানালা বন্ধ করতে রুমের বাইরে গেছে। চয়নের রুমের জানালা বন্ধ, বারান্দার দরজাটা তাড়াহুড়ায় লাগাতে গিয়ে লাগানো হয়নি, লক লাগেনি। চয়ন বেরিয়ে যেতেই ধমকা হাওয়ায় খুলে গেছে। বজ্রপাতের শব্দ আর ধমকা হাওয়া আসছে সেদিক থেকে। হুট করে ভয়ানক শব্দে একটা বজ্রপাত পড়ে। যেন সুরলার কানের কাছে। সুরলা ভয়ে সিটিয়ে যায়। সুরলা তখন কাভার্ডে নিজের কাপড় গুছিয়ে রাখছে। হাত থেকে কাপড় ও পড়ে গেছে। ভয়ে কাভার্ড আর দেয়ালের চিপায় লুকিয়ে পড়ে। সিদ্ধান্ত নেয়,এই ঝড় থামানোর আগে সে আর বেরুবেই না। বাসা থাকলে এই সময়টা মা তাকে আগলে রাখে, খালার বাসায় থাকলে খালা বা নিতিকা আগলে রাখে। এইখানে তো তাকে আগলে রাখার মা খালা কেউ নেই, তাই লুকিয়েই থাকবে। বজ্রপাতকে বেশ ভয় পায় সুরলা।
দরজা জানালা লক করে চয়ন রুমে আসে। চারদিকে চোখ বুলিয়ে সুরলাকে না দেখে ভ্রু কুঁচকায়। বারান্দা কাছে গিয়ে ও খুঁজে, বারান্দায় ও নেই। বারান্দার দরজা বন্ধ করে ওয়াশরুমে দেখে। ওয়াশরুমের দরজা বাইরে থেকেই লক। গেল কোথায় মেয়েটা! কপালে চিন্তার ভাজ পেলে ডাকে,
” করলা বেগম কোথায় তুমি? ‘
সুরলা চুপটি করে বসে থাকে। জবাব দেয় না। চয়ন আবারও ডাকে, ” বিবি গরিলা, হুট করে কোথায় গেলে?”
সুরলা তখনো নিরব। ভয়ের মাঝেই তার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি এসেছে, সে কোন আওয়াজ করবেনা। চয়ন তাকে না পেয়ে কী করে দেখা যাক। চয়নের কপালের ভাজ গাঢ় হয়। সেটা দেখতে ভালো লাগছে সুরলার। যাক, চয়ন তার জন্য চিন্তা ও করে তবে! চারদিকে চোখ বুলাতে বুলাতে কাভার্ডের হালকা ফাঁক করা দরজায় চোখ যায় চয়নের। দুটো চোখকে তারার মত জ্বলতে দেখা যাচ্ছে। এই মেয়েটা কাভার্ডে লুকিয়েছে কেন! কোথাও আমাকে ভয় দেখানোর জন্য নয় তো? হতে পারে। সুরলার ভাবনা আন্দাজ করে অন্যদিকে ফিরে হাসে চয়ন। মেয়েটা তো জানে না, সে ভয়কে জয় করতে জানে। চয়ন দুষ্টু হেসে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে বলে,
“এই ঝড় বৃষ্টিতে এত তেলাপোকা আসছে কোথা থেকে! দেয়ালটাকে রীতিমতো প্লে গ্রাউন্ড বানিয়ে নিয়েছে। কতগুলো আবার কাভার্ডে ডুকে যাচ্ছে। কাভার্ডের কাপড় সব খেয়ে ফেলবে আজ। বাসায় মেডিসিন ও….
আর বলতে পারেনি। কাভার্ডের দিকে তেলাপোকা যাচ্ছে কথাটা শুনে সব ভুলে এক চিৎকার দিয়ে কাভার্ড থেকে বেরিয়ে পড়ে সুরলা। সামনে চয়নকে দেখে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। বলতে থাকে,
” প্লিজ তেলাপোকাগুলোকে তাড়িয়ে দিন! আমার ভীষণ ভয় লাগে। ”
চয়ন খালি দেয়ালটায় চোখ বুলিয়ে বাঁকা হেসে বিড়বিড় করে বলে,
“মিশন সাকসেসফুল।”
তারপর সুরলাকে ছাড়িয়ে বলে,
“আমার রিয়েকশন দেখবে না?”
সুরলা যেন শুনে নি। আবার ঝাপটে ধরে বলে,
“তেলাপোকা তাড়িয়ে দিন প্লিজ! আমার ভয় করছে।”
চয়ন শব্দযোগে হাসে। পরক্ষনেই থামিয়ে দেয়। সুরলাকে সে অপছন্দ করে, সুরলা তার জেদ মাত্র। সুরলার স্পর্শে তার রাগত অনুভূতি হওয়ার কথা, কিন্তু এখন রাগত অনুভূতি হচ্ছে না। তার চেহারায় হাসি খেলে যাচ্ছে। এটা তো হবার ছিল না। গম্ভীর হয়ে কারণ জানার চেষ্টা করে। সুরলাকে এক ঝটকায় ছাড়িয়ে দেয়। বলে,
“তেলাপোকা নেই আমি তোমাকে কাভার্ড থেকে বের করতে মজা করছিলাম। ” বলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। মাথায় একটা কথাই আসছে, এই মেয়ের উপর তার মায়া জন্মে যাচ্ছে না তো! আবার কী ধোঁকা খাবে সে! চয়নের ভাবনায় গুলো গোলকধাঁধায় ঘুরছে যেন।
চয়নের হুটহাট আচরণে থ বনে যায় সুরলা। চারদিক চোখ বুলিয়ে তেলাপোকা পায় না। আসলেই মজা করছিল বদটা। কিন্তু হুট করে চলে গেল কেন মাথায় আসে না সুরলার। রুমের বাইরে উঁকি দেয়। দেখে চয়ন গম্ভীর চেহারা নিয়ে সোফায় বসে আছে। সুরলা মাথা চুলকে বলে, ” এতক্ষণ তো ভালোই ছিল। হঠাৎ কী হলো এর!”
কারণ উদঘাটন করতে সুরলা ও যায় ড্রয়িংরুমে। তাছাড়া, বজ্রপাতে একা রুমে থাকতে ভয় লাগছে। ড্রয়িংরুমে গিয়ে সোফায় চয়নের পাশে বসতেই চয়ন সুরলাকে দেখে উঠে দাঁড়ায়। যেতে নিলে সুরলা হাত ধরে ফেলে। ভ্রু কুঁচকে বলে,
“এতক্ষণ তো বেশ ভালোই ছিলেন। হঠাৎ করে কী হলো আপনার? ”
জবাবে চয়ন গম্ভীর গলায় বলে,
“লিভ মি এলোন।” সুরলার হাত ছাড়িয়ে গেস্ট রুমে চলে যায়। সুরলা বিস্মিত নয়নে চেয়ে থাকে চয়নের পানে। এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
“এই ছেলেকে আমি আদৌ বুঝতে পারব? এই ছেলে আদৌ আমার অনুভূতিকে বুঝতে পারবে?”
.
চরণ ফোন দিয়ে জানিয়েছে, প্লেনে ওঠার আগ মুহুর্তে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেয়ার কারণে বখতিয়ার আরেফিন সাহেবদের ফ্লাইট ডিলে হয়ে হয়েছে। আজ তারা আসবেন না পরিবেশ ঠিক হলে কাল আসবেন। চরণ দু’জনকেই জানিয়েছে আলাদা ভাবে। শুনে চয়ন সুরলা উভয়েই স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। এখন নিজেরা এবং ঘর দুটোই অগোছালো হয়ে আছে। দুটোর একটু সময় দরকার।
ঘড়ির কাটায় রাত এগারোটা। চয়ন সেই যে গেস্ট রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়েছে আর বের হয়নি। সুরলা ড্রয়িংরুমে সোফায় গুটিসুটি মেরে বসে আছে। খানিক আগেই ঝড় থেমেছে। মৃদুভাবে বৃষ্টি প্রকোপ আছে এখনো। বজ্রপাতের মাত্রাও কমেছে অনেকাংশে। ক্ষিধের তাড়ানায় ভয়কে দমিয়ে ওঠে পড়ে। কিচেনে গিয়ে ফ্রিজ খুলে দেখে কয়েকটা বিরিয়ানীর প্যাকেট। সম্ভবত রাতে সবার জন্য খাবার এনেছে চয়ন। কোন ফাঁকে এনেছে সে টের ও পায় নি। আজকাল নিজের খাবারের সাথে সাথে সুরলার খাবারের ও চিন্তা করে চয়ন। অফিসে যাবার আগে আর পরে খাবার আনে। এই বিষয়টা ভালো লাগে সুরলার। সব ঠিকঠাক শুধু মাঝে মাঝে বেঁকে যায় কেন বুঝা দায়। এখনো রুমেই দরজা আটকে বসে আছে। কেন কে জানে!
এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দুটো বিরিয়ানির প্যাকেট নিয়ে ওভেনে খাবার গরম করে। দুটো প্লেটে বিরিয়ানি ঢেলে টেবিলে রাখে। গেস্ট রুমের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। খানিক ভাবে। সোজাসাপটা ডাকলে বের হবে না নিশ্চিত তাই ট্রিকস করে ডাকে।
“শুনছেন? আংকেল কল দিয়েছে, আপনার সাথে কথা বলতে চাচ্ছে। তাড়াতাড়ি আসুন।”
সুরলার কথা কানে যেতেই ভাবনার সময় নেয় না চয়ন। তার কাছে সব একদিকে আর তার বাবা একদিকে। বাবা কথা বলতে চাচ্ছে, বাবার সাথে কথা বলতে হবে এটাই মস্তিষ্কে ঘুরে। তড়িৎ দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। সুরলার সামনে হাত বাড়িয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
” ফোন দাও।”
চয়নের মুখ পানে তাকিয়ে আছে সুরলা। ছাপ দাঁড়ির ফাঁকে ঠোঁট জোড়ায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। হাসির লেশ মাত্র নেই। ফর্সা চেহারায় গম্ভীরতা আর চিন্তার আভা। এত চিন্তাভাবনা কিসের! আবার কী তার ভাবনায় অনন্যা বিচরন করছে? নিশ্চিত হতে জিজ্ঞেস করে,
“হুটহাট কী হয় আপনার বলুন তো?নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে মেয়েদের মতো দরজা লাগিয়ে বসে থাকেন। আপনার দুঃখটা কোথায় একটু খুলে বলবেন?”
সুরলার বাড়তি কথায় বিরক্ত চয়ন। তাড়া দিয়ে বলে,
“বাড়তি কথা না বলে ফোন দাও, বাবা না-কি কথা বলবেন।”
সুরলা বোকা হাসি দেয়। সুরলার হাতে ফোন না দেখে চয়ন বুঝে সুরলা মজা করছে তার সাথে। রেগে বলে,
“তুমি ফান করছিলে আমার সাথে?”
” আপনি মেয়েদের মতো দরজা আটকে দিয়ে রুম থেকে বেরুচ্ছিলেন না বলেই তো আমাকে এই মজাটা করতে হলো। সর্যি।” চয়নের রাগ দেখে চোখ মুখ খিচে বলে সুরলা। সে দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার রুমে যেতে নেয় চয়ন। সুরলা হাত ধরে আটকে বলে,
“ক্ষুধার মাত্রা এত বেশি যে, পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে যেন। ডিনার করতে আসুন।”
“আমি খাব না, তুমি খেয়ে নাও।”
“আপনি খাবেন না, আমি একা একা খাবো? হবে না আসুন একসাথে খাবো।” জেদ ধরে বলে সুরলা। চয়নের উত্তর নেতিবাচক।
সুরলা রেগে বলে,
” আপনি আবার তৃতীয় ব্যক্তির খেয়ালে আমাকে কষ্ট দিচ্ছেন? আমি কিন্তু সত্যি সত্যি বাসায় চলে যাব। আর তা কাল আংকেল আন্টি আসার আগে।”
চয়নের হাত ছেড়ে দিয়ে ড্রয়িংরুমের দিকে চলে যায়। এই বদলোককে মানাতে মানাতে সে হাফিয়ে গেছে। ধৈর্যের একটা সীমা থাকে। ড্রয়িংরুমে গিয়ে খাবারের প্লেট নিয়ে কিচেনে চলে যায়। একটা রেখে আরেকটা নিতে এসে দেখে চয়ন চেয়ারে বসা। সুরলাকে দেখে বলে,
“খাবার নিয়ে আসো।” সুরলা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। এই না খাবে না বলল। এখন আবার বসে গেল! চয়ন গম্ভীর কন্ঠে বলে,
“খাবার আনবে নাকি আমি না খেয়ে চলে যাব?”
বলতে দেরি সুরলার খাবার আনতে দেরি নেই। কিচেন থেকে খাবারের প্লেট এনে চয়নের পাশে বসে। চয়ন এক লোকমা মুখে দেয়ার পরে সুরলা মুচকি হেসে খেতে শুরু করে। চোখে মুখে খুশির আভা। যেন চয়নকে খাওয়াতে নয়, কোন ট্রফি জয় করেছে সে। চয়ন চেয়ে থাকে সুরলার পানে।
চলবে…