কাজল নদীর জলে পর্ব-৩১

0
1154

কাজল নদীর জলে
—আফিয়া আপ্পিতা

৩১.
বিকেলের শেষ ভাগ, ছাদের রেলিঙ ঘেঁষে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে চয়ন-সুরলা। আজকের বিকেলটা বেশ সুন্দর, সচ্ছ আকাশে রংধনুর ভেলা। সুরলার মন খারাপ, বিষন্নতা কাটাতেই এসেছে এখানে। বিষন্নতার কারণ চয়নের আচরণ। আজ আবারও নিকোটিনের ধোঁয়া ছেড়ে তাকে ঘুম থেকে তুলেছে চয়ন। শ্বশুর শ্বাশুড়ি এসেছে আজ প্রায় চারদিন। প্রতিদিন তারা একসাথেই ঘুমায়। সুরলা যেদিকেই ঘুমাক ঘুরে ফিরে এসে পড়ে চয়নের বুকে। চয়নের আগে সুরলা ঘুম ভাঙেনা বিধায় বিষয়টা ঘুণাক্ষরেও টের পায় না সে।চোখ খুলে সুরলাকে বুকে দেখা চয়নের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। চাইতেও সরাতে পারেনা। অন্যান্য দিন সব ঠিকঠাক ছিল আজ সকালে ঘুম ভাঙতেই চয়নের মাথায় অতীতের ভূত চেপেছে, সেই ভূতকে সাড়া দিয়ে সে সুরলার মুখে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়েছে। ঘুম ভেঙে কাশতে কাশতে কান্না করে দিয়েছে সুরলা। কাশি থামিয়ে একটা কথাই বলেছে, “এখনো আমাকে কষ্ট দিতে আপনার মন সায় দেয়?”
তারপর থেকে সারাটা দিন চয়নের সাথে কথা বলেনি। লাঞ্চ টাইমে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে সুরলার জন্য শাড়ি থ্রি-পিস কিনে নিয়ে এসে গিফট দিয়ে কথা বলতে চেয়েছে। কিন্তু পারেনি। সুরলা এড়িয়ে গেছে তাকে। বিকেলে ছাদে এসে নিজের বিষন্নতা যেন আকাশের সাথে শেয়ার করছে। চয়ন কথা বলার চেষ্টা করে,
” করলা বেগম আজ অফিসে কী হয়েছে শুনবে?”

রংধনুতে চোখ রেখে সুরলা চয়নের প্রশ্নের জবাবে অন্য প্রসঙ্গে ফিরতি প্রশ্ন করে,
” আমি কি আপনার জীবনে এসে আপনার জীবনের সব রঙ চিনিয়ে নিয়েছি?”

চয়ন ও প্রশ্নের জবাবে প্রশ্ন করে,
“এমনটা মনে হওয়ার কারণ?”

“আপনি কেমন যেন বদলে গেছেন। ঠিক আগের মত নেই। ”
“আগে কেমন ছিলাম আর এখন কেমন আছি?”

“প্রথম যেদিন আপনাকে বাসস্টপে দেখছি সেদিন আপনি প্রাণপনে বাসের পেছনে ছুটছিলেন, তাও আপনার মুখটা গম্ভীর হয় নি, ঠোঁটের কোণে হাসি ছিল। আপনাকে দেখে আমার মনে হয়েছে, আপনি জীবনের সব বিপদ হাসিমুখেই মোকাবিলা করতে পারবেন। তারপর ও আমার সাথে পরিচয়ের আগে আপনি বেশ প্রাণবন্ত ছিলেন। মন খুলে হাসতেন, পেইন্টিং করতেন, গান গাইতেন। আপনাকে দেখে আমার মনে হতো আপনি ভীষণ সুখী একজন মানুষ। কিন্তু আজকাল তেমন মনে হয়না। আপনি কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেছেন। আমার সাথে করা আপনার সব আচরণ দায়সারা মনে হয়। আন্টি আংকেল চিবার সাথে আপনি যতটা মন খুলে কথা বলেন আমার সাথে বলেন না। আপনার হাসিতে আমি কৃত্রিমতা খুঁজে পাই। আপনি গান গান না, পেইন্টিং করেন না। চিবার থেকে জানতে পারলাম, আপনি মন ভালো থাকলে অবসরে পেইন্টিং করেন। অথচ আমি একবারও দেখিনি। ”

গম্ভীর কণ্ঠ সুরলার। চয়ন মনোযোগ দিয়ে শুনে সুরলার কথা, তারপর হেসে বলে,
“করলা বেগম, তুমি সবসময় দুই লাইন বেশি বুঝো। আমার মাঝে কোন পরিবর্তন আসে নি, আগের আমিটাই আছি আমি।”

আকাশ থেকে চোখ সরিয়ে চয়নের দিকে তাকায় সুরলা। তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,
“আপনার এই হাসিটার কৃত্রিমতা ও আমাকে স্পর্শ করছে। আমার মনে হয়, আপনার অতীত আপনাকে তাড়া করে প্রতিনিয়ত। সেই অতীত থেকে বেরুতে পারছেন না আপনি। আমাকে দেখলেই আপনার অতীত মনে পড়ে। চেহারা গম্ভীর হয়ে আসে। সেই গম্ভীরতা ঢাকতেই আপনি হাসিমজার আশ্রয় নেন। কেন জানি না, আপনার সেই অতীতটা আমার সহ্য হয় না। আমি আপনার সাথে কাউকে জোড়াতে পারিনা, কারো কথা শুনতে পারি না। আপনাকে নিয়ে আমি ইন্সিকিউর ফিল করি। আপনাকে হারাবার ভয়টা বাড়ছে দিনকে দিন। কোন কাজ করতে গেলে আমার ভয় হয়, যদি আমার কাজে কোন ভুল হয় আর আপনি রেগে যান। যার ফলসরূপ আপনি আমাকে আপনার জীবন থেকে বের করে দেন। তবে আমি বাঁঁচব কিভাবে! আজ সকালের পর থেকে আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে আপনি কি নির্ভয়ে কখনো আমাকে মেনে নিবেন না? একদিন আমাকে তাড়িয়ে দিবেন?”

মনের গহীন থেকে বের হওয়া সুরলার অনুভূতিগুলো ধাক্কা দেয় চয়নকে। সুরলার সব কথা সত্য। আসোলেই সে অতীত থেকে বেরুতে পারছেনা। সুরলাকে দেখলে অনন্যার কথা মনে পড়ে তার। তখন নিজেকে দমিয়ে রাখা দায় হয়। তাও বহুকষ্টে সে অভিনয় করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। সুরলার করা শেষ দুটো প্রশ্নের উত্তর অজানা চয়নের। দ্বিধা কাটিয়ে সে সুরলাকে আগলে নিতে পারবে কি-না সে নিজেই জানে না। দ্বিধাময় সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে কাউকে আশা দেয়া উচিত নয়। এই মর্মে প্রসঙ্গ পালটায়,
“তুমি বললে তুমি আমাকে প্রথম দেখেছিলে বাসস্ট্যান্ড। কিন্তু আমার জানামতে আমাদের প্রথম দেখা বাসার ছাদে হয়েছে। এর আগে তো আমি তোমাকে দেখিনি। তবে তুমি আমাকে দেখলে কোথায়?”

চয়নের প্রসঙ্গে ঘুরানোর ভঙি দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুরলা। চোখের কোণে জমাট বাধা জল গুলো মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে।
তারপর বলা শুরু করে,

“ছাদে দেখা হওয়া প্রায় দুই বছর আগের কথা। বাসা থেকে খালামণির বাসায় আসছিলাম। জানালার ধারে বসেছিলাম আমি। হঠাৎ আমার চোখ পড়ে বাস স্টপের দিকে দৌড়ে আসা এক মানবের দিকে। সাদা কালো ফর্মাল গেট আপে থাকা সাদা চামড়ার একটা ছেলে প্রাণপণে ছুটে আসছে বাসের দিকে।
ছুটাছুটি শেষে বাসের কাছে এসে থামে ছেলেটা। কালো মণির গভীর চোখে ক্লান্তির আভা, প্রশস্ত কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম চিকচিক করছে, কান আর নাকের ডগা লাল হয়ে আছে। ছাপ দাঁড়িতে ঢাকা মৃদু পরু ঠোঁটগুলো চেপে হাপাচ্ছে। তবুও চেহারায় গম্ভীরতার আভা নেই।।দৌড়ানোর কারণে মাথা ভর্তি রেসমি কালো চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। কয়েকটা আঁচড়ে পড়েছে কপালে। লম্বা চওড়া বেশ।
ছেলেটা বাসে উঠে। সিট না পেয়ে আমার পাশেই বসে পড়ে। আমি আড়চোখে তাকিয়ে দেখছিলাম ছেলেটাকে। সেই প্রথম দেখায় তার প্রতি ভালোলাগা জন্মে গিয়েছিল। সেদিন ছেলেটাকে প্রথম দেখার এর পর আরো দশ পনেরো দিন দেখেছিল। কখনো পথশিশুদের সাথে, কখনো আবার রক্তকণিকায়, কখনো বাসে, কখনো কাউকে রাস্তা পার হতে সাহায্য করছে। তবে সেদিনের মত নিকটে আর কখনোই পাই নি। মাস দুয়েকের ব্যবধানে হারিয়ে যায় ছেলেটা। আর দেখেনি ছেলেটাকে । কত খুঁজেছি! বাসা থেকে বের হলেই চারদিকে চোখ বুলিয়েছি। কিন্তু ছেলেটাকে চোখে আর পড়ে নি। বছর দুয়েক পর হঠাৎ ছেলেটাকে চোখে পড়ে আমার খালামণিদের পাশের বাসার ছাদে। কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে দেখে আমি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম যেন। এই যে এতক্ষণ যেই ছেলেটার কথা বললাম, সেই ছেলেটা কে জানেন? আপনি।”

সুরলা থামে। চোখের কোণে অশ্রুরা ভীড় করেছে। চয়নের দিকে তাকাতেই দেখে চয়ন বিস্মিত চোখে চেয়ে আছে তার দিকে। সুরলার কথায় চয়নের মাথা ভো ভো করে ওঠে। সে ভাবতে পারে না, এই পিচ্ছিটা তাকে এত ভালোবাসে! সুরলার অশ্রুসিক্ত চোখে নিজের জন্য গভীর ভালোবাসা দেখতে পায় সে। এত ভালোবাসা অগ্রাহ্য করবে কিভাবে ভেবে পায় না সে। তবে এটা নিয়ে ভাবার সিদ্ধান্ত নেয়। সুরলার চোখে চোখ রেখে বলে,
” সত্যটা বলি, অতীতের ঘটনা থেকে ভালোবাসার উপর থেকে বিশ্বাস ওঠে গেছে। আজকাল কাউকে ভালোবাসার কথা ভাবতেই ভয় লাগে। আবার যদি হারিয়ে ফেলি? তুমি আমাকে কিছুটা সময় দাও, আমি চেষ্টা করছি অতীত থেকে বেরিয়ে এসে বর্তমান নিয়ে ভাবার, ভালোবাসা নিয়ে ভাবার, ভালোবাসায় বিশ্বাস করার চেষ্টা করার। শুধু কিছুদিন সময় দাও? ”
” সময়ের সমাপ্তিতে আপনার বর্তমানে আমি থাকব?”
“দেখা যাক, অনুভূতি কী বলে। তবে হ্যাঁ, আমার ভাবনায় অবশ্যই তুমি থাকবে।”
“সত্যিই!” খুশিতে লাফিয়ে ওঠে সুরলা। চয়ন হেসে মাথা নাড়ায়।
“আমি আপনার ভাবনায় থাকব কথাটা ভাবতেই খুশি লাগছে আমার। এতটা খুশি লাগছে যে ইচ্ছে করছে আপনার কিউট কিউট গালে কিস টিস করে দিই। কিন্তু আপনার মতো লম্বুর গালের কাছে যেতে হলে আমার মই লাগবে, মই না থাকায় যেতে পারছিনা। ” খুশিতে মনের কথা সব বলে দেয় সুরলা। চয়ন ভ্রু কুঁচকে তাকায়। সুরলা জিহ্বা কামড় দিয়ে অন্যদিকে ফিরে যায়। ইশ! কী বলে ফেলেছে সে!
চয়ন বাঁকা হেসে বলে,
“আজকাল এইসব ঘুরে মাথায়? তাই তো বলি, এই মেয়ে আমার দিকে বখাটে দৃষ্টিতে তাকায় কেন!”

“আমি আপনার দিকে ভালোবাসার দৃষ্টিতে তাকাই, আপনার মাইন্ড খারাপ তাই খারাপ দিকে নেন।” অন্যদিকে তাকিয়ে থেকেই বলে সুরলা।
“করলা বেগম তোমার তাওবা করা উচিত, কিসব ভাবছো আজকাল।”

চয়ন এই টপিক নিয়ে দীর্ঘসময় মজা নিবে এটা জানে সুরলা। তাই প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলে,
“আমাকে একটা পেইন্টিং করে দিবেন?”
“প্রসঙ্গ পাল্টালে লাভ হবে না, আমি নোট করে নিয়েছি। নেটে ছেড়ে ভাইরাল করে দিব তোমার। ”

চয়নের দিকে ঘুরে চোখ রাঙায় সুরলা। চয়ন হেসে বলে,
” তোমার সাহস দেখে আমার অবাক লাগে। দুই ফুটের লিলিফুটের মত দেখতে তুমি আমাকে চোখ রাঙাও! ওই চোখ জোড়াসহ পুরো তুমিটাকে আমি এক হাতে কোলে নিতে পারি।”

সুযোগের সৎব্যবহার করে সুরলা। হাত বাড়িয়ে বলে,
“কোলে নিন, আমি ও দেখি আপনি কেমন কোলে নিতে পারেন।”

পিঞ্চ মারতে গিয়ে উলটো পিঞ্চে ফেঁসে গেছে চয়ন। এই মেয়ে ডেঞ্জারাস। চয়ন প্রসঙ্গ পালটে আগের প্রশ্নের উত্তর দেয়,
“কেমন পেইন্টিং লাগবে? থিম কী?”

সুরলা আর আগের টপিক ঘাটায় না। উত্তর দেয়,
“আকাশে রংধনু থাকবে। ছাদের রেলিঙের ঘেঁষে একজোড়া কপোত-কপোতী বসে দেখবে সেই রংধনু। ছেলেটার কাধে মেয়েটার মাথা থাকবে। ছেলেটার চেহারায় নিজের চেহারা বসাবেন আর মেয়েটার চেহারায় আমার চেহারা। বাস্তবে যেমন আমাদের সম্পর্কে ভালোবাসার ঘাটতি আছে, পেইন্টিং-এ যেন তা না থাকে। বাস্তবিক ভাবে ভালোবাসা পূর্ণতা না ফেলে আমি এই পেইন্টিং দেখে নিজেকে সান্ত্বনা দিব। পেইন্টিং করে দিবেন? ”

চয়ন উত্তর দেয়ার আগে চিবা দৌড়ে আসে। ছাদে এসে চয়ন আর সুরলাকে একা ছেড়ে সে অন্যদিকে চলে গেছে। দুজনকে একসাথে দেখে ফোনে ছবি তুলেছে অনেকগুলো। সেগুলো দেখিয়ে বলে,
“দেখো ভাবি, লাভ বার্ডের ছবি।”

সব ছবি দেখে সুরলা। একটা ছবি তার নজর কাড়ে। তাতে চয়ন সুরলা একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে। দুজনের ঠোঁটের কোণে হাসি। এটা তখনকার, যখন চয়ন সুরলাকে নিয়ে ভাববে বলেছে। সুরলার আনন্দ অনুভূতি হয়। তার আর চয়নের প্রথম কাপল ক্যান্ডিড পিক। খুশিতে গদগদ হয়ে সুরলা বলে,
“এই ছবিটা আমি ফ্রেমে বাধাই করে আমাদের রুমে টাঙাব। এই ছবিটা সুন্দর আসছে। থ্যাঙ্কিউ। ”

“থ্যাঙ্কিউ লাগবে না, ট্রিট হিসেবে তোমার বরকে বলো আমাদের ঘুরতে নিয়ে যেতে। তাহলেই হবে। ” সুরলা তাকায় চয়নের দিকে। চয়ন বোনের মাথায় ঠুয়া মেরে বলে,
” লুকিয়ে লুকিয়ে মিয়া বিবির প্রেম দেখিস, আবার সেসব ক্যাপচার করে ট্রিট চাস। কোন ট্রিট পাবি না। যা ভাগ। ”

চিবা মাথা ঢলে অভিযোগের সুরে বলে,
“ভাবি তোমার বরকে কিছু বলো, নয়তো আমি ছবি দিব না।”
“দিস না, আমি সেম ওয়েদারে টাইমার দিয়ে ক্যান্ডিড তুলে নিব।” চয়ন ফিরতি ঠুয়া মারে চিবার মাথায়। এবার সুরলা মুখ খুলে,
“আপনি আমাকে প্রমিস করেছেন ঘুরতে নিয়ে যাবেন। সেই প্রমিজ পূরণ করেননি। এখন আমাদের সবাইকে ঘুরতে নিয়ে যাবেন।”
“এই যে রংধনু দেখাতে নিয়ে এলাম এটাকে ঘুরতে আসা বলে না? প্রমিজ পূরণ হয়ে গেছে।” বাঁকা হেসে বলে চয়ন। সুরলা চয়নের গায়ে চিমটি কেটে বলে,
“আপনি এত কিপটে জানা ছিল না। ছাদে আসাকে কেউ ঘুরতে আসা বলে না। আমাদের বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাবেন।”

চয়ন হাত ঢলতে ঢলতে বলে,
“যত যাই করো বা বলো আমি ঘুরতে নিয়ে যাব না।”

সুরলা চয়নের কাছ ঘেঁষে ফিসফিস করে বলে,
“আজ চিবাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, আপনি নাকি কোনদিন সিগারেট মুখেও নেন না। মা ও সায় দিয়েছে। এর মানে মায়েরা কেউ জানে না আপনি যে সিগারেট খান। আমি কিন্তু মা বাবাকে বলে দিব। রাজি হয়ে যান।”

চয়ন ছোটো ছোটো চোখ করে তাকায় সুরলার দিকে। সুরলা বাঁকা হাসে। বলে,
“আপনি কি ঘুরতে নিয়ে যাবেন?”
চয়ন চুপ থাকে, সুরলাকে চিবাকে বলে, ” চিবা তোমাকে একটা সিক্রেট কথা বলি, শুনবে?” চিবা সায় জানায়। চয়ন এবার চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে থাকে। এই মেয়ে সত্যি বলে দিবে না তো! তার সিগারেট খাওয়ার কথা চরণ ও জানে না। বাবা মা তাকে কত ভালো জানে। এই সিগারেট খাওয়ার কথা শুনলে তাকে ভুল বুঝবে। মা মনে করে, সিগারেট ভালো মানুষেরা খায় না। সে ও মায়ের কাছে খারাপ বলে বিবেচ্য হবে। এটা না হতে দেয়ার জন্যই তড়িৎ বলে,
“কাল লাঞ্চ ব্রেকে যদি ছুটি পাই তবে নিয়ে যাব। এখন বাসায় চলো।” বলে সুরলার হাত ধরে সামনে আগায়।
সুরলা মুচকি হাসে। চিবা পেছু পেছু আসতে আসতে বলে,
” আমি বললাম রাজি হলে না, বউ বলতেই রাজি হয়ে গেলে। বাহ, ভাইয়া বাহ! ভাবি তুমি ভাইয়ার কানে কানে কী এমন শুনিয়েছে যে ভাইয়া রাজি হয়ে গেল। আর কিসের সিক্রেট বলবে?”

সুরলার হাস্যরসী জবাব,
“বউয়ের কাছে স্বামীদের মানানোর হরেক ট্রিকস থাকে, সেসবের একটা ফলো করলাম। তাতেই কাজ হয়েছে। বিয়ে করলে তুমিও বুঝতে পারবে।”

নিচে নামতে গিয়ে সিড়িতে দেখা হয় বিল্ডিংয়ের মালিকের আসাদুজ্জামানের সাথে। ভদ্রলোক কোন এক কাজে ছাদে যাচ্ছেন। ভদ্রলোককে দেখে চয়ন সালাম দেয়। আসাদুজ্জামান সালামের উত্তর নিয়ে বলেন,
“তোমার বাসা তো তিনতলায়। উপরে কোথায় গিয়েছিলে?”
“ওদের নিয়ে ছাদে গিয়েছিলাম একটু।” সুরলা আর চিবাকে ইশারা করে বলে চয়ন। ভদ্রলোক সুরলা আর চিবার দিকে তাকান এক পলক। তারপর প্রশ্ন করেন,
“তোমার বোন এরা?”

চয়ন সুরলার দিকে তাকায় একপলক। কুর্তির সাথে প্যান্ট পড়েছে আজ। জোবায়েদার মতে, সুরলা যেটাতে কমফোর্ট ফিল করে সেটাই পরতে পারবে। খুশিতে নিজের বেশে ফিরে এসেছে সুরলা। বেশভূষায় পিচ্ছিই লাগছে। চয়ন ফুস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বিড়বিড় করে বলে, “আরো জেদের বসে পিচ্ছি মেয়েকে বিয়ে কর।তারপর বউকে বোন বলুক মানুষ। ” সুরলা গোমড়ামুখে করে আছে। বউকে বোনকে শুনতে ভালো লাগে না তার। না হয় সে একটু পিচ্ছি দেখতে তাই বলে কি কারো বউ হতে পারে না! বোন কেন ভাববে। চিবা মিটিমিটি হাসছে। সে বেশ মজা পাচ্ছে এতে। চয়ন সুরলার গোমড়ামুখের দিকে তাকায় এক পলক তারপর বোনের দিকে তাকায়। চিবা চয়নের উত্তর শোনার জন্য উৎসুক হয়ে আছে। চয়ন গলা ঝেড়ে চিবাকে দেখিয়ে বলে,
“ও আমার বোন।”
“আর ও?” সুরলাকে দেখিয়ে সম্পর্ক জানতে চায় আসাদুজ্জামান। চয়ন মৃদু হেসে বলে,
“আমার মিসেস।”
চয়নের স্বীকৃতিতে সুরলার মুখে হাসি ফুটে।

“তুমি বিয়ে করেছো কবে!” বিস্মিত নয়নে প্রশ্ন করে আসাদুজ্জামান।
“এইবার ইদে ঢাকায় গিয়ে বিয়ে করেছি, অনেকটা তাড়াহুড়ায় থাকায় কাউকে জানানো হয়নি।”
“কেমন আছো মামুনি? কোন ক্লাসে পড় তুমি?” সুরলার উদ্দেশ্যে বলেন ভদ্রলোক। সুরলা হেসে বলে,
“ভালো আছি। আমি আইইউবিতে বিবিএতে পড়ি। চতুর্থ সেমিস্টারে। ”

ভদ্রলোকের অবিশ্বাস্য চাহনি। যেন তার বিশ্বাস হচ্ছেনা। তিনি প্রথমে ভেবেছেন চয়ন বাল্যবিবাহ করেছে। টুকটাক কথা বলে ভদ্রলোক চলে যান উপরে। যাবার আগে সুরলা তাকে চায়ের দাওয়াত দিয়েছে। ভদ্রলোক যেতেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে চিবা। ভাইয়ের দিকে দুঃখী চাহনি দিয়ে বলে,
” বেচারা ভাই আমার, বউকে বোন শুনতে হচ্ছে। আরো জুনিয়রের সাথে প্রেম করে বিয়ে করো।”
চয়ন রেগে তাকায় বোনের দিকে। তারপর সুরলার দিকে তাকায়। সুরলার ঠোঁটের কোনে ও হাসি। তা দেখে ধমকে বলে,
“মাথায় ঘোমটা দাও। বের হলে ঘোমটা দিয়ে রাখবে সবসময়।” অপ্রত্যাশিতভাবে ভাবে রেগে যায় চয়ন। সুরলা চমকে যায়।


পরদিন লাঞ্চ ব্রেকে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বাসায় ফিরে চয়ন। লাঞ্চ শেষে পুরো পরিবার নিয়ে বিচের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। গত কয়েকদিন টানা বৃষ্টির পর আজ কাঠফাটা রোদের ভেল্কি দেখা যাচ্ছে। তারউপর বন্দরটিলা থেকে বিচের দূরত্ব নেহাৎই কম নয়। এই অদূর ভ্রমণ শেষে বিচে পৌঁছে হাফিয়ে যান জোবায়েদা। একটা বিশ্রামের জায়গা খুঁজে। বিচের উপরে হকার মার্কেটে সামনে রাখা একটা ছাউনিতে বসে তারা। হালকা ভাজাপোড়া খেয়ে চয়ন সুরলা আর চিবা যায় সমুদ্র ভ্রমণে। জোবায়েদা আর বখতিয়ার সাহেব ছাউনির নিচে বসে থাকেন। চয়নরা বড় বড় পাথর বেয়ে নিচে নামে তারা। তারপর জুতা খুলে হাতে নিয়ে সমুদ্রের কোল ঘেঁষে হাটতে থাকে। সাথে চিবার ঐতিহাসিকমানের সেল্ফি কুলফি তো আছেই। সুরলাও চয়নের সাথে বেশ কিছু ছবি নিয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি শেষে পাথরে এসে বসে তিনজন। হাতে ধরা বাদাম। বাদাম চিবোতে চিবোতে আশেপাশে তাকায় সুরলা। চোখে পড়ে তাদের থেকে খানিক দূরত্বে বসা দুটো মেয়ের দিকে। যারা মুগ্ধ দৃষ্টিতে চয়নের দিকে চেয়ে আছে। ক্রাশ খেয়ে ফেলেছে বোধহয়। সুরলার মেয়েদের থেকে চোখ সরিয়ে চয়নের দিকে তাকায়। ম্যান্ডারিন কলারের কফি কালার হাফ হাতা শার্ট, ব্রাউন প্যান্ট পরনে তার। চোখে কালো সানগ্লাস, মুখ ভর্তি মৃদু ছাপ দাঁড়ি, ঠোঁটের কোণে ঝুলে আছে হাসি। ফর্সা চোয়ালটা সেই হাসিতে মেতে আছে যেন। মাথাভর্তি কালো চুলগুলো বাতাসে দুলছে। হাতে কফি কালার বেল্ডের ডায়াল ঘড়ি। সব মিলিয়ে বেশ সুদর্শন লাগছে চয়নকে। ক্রাশ খাওয়ার যোগ্য। কিন্তু চয়নের উপর ক্রাশ খাওয়ার অধিকার সে ছাড়া আর কারো নেই। অন্য কেউ চয়নের উপর নজর দিতে পারবে না। সুরলার নজর তীক্ষ্ণ হয়। মেয়েগুলো তখনো হা করে তাকিয়ে বসে আছে। সুরলা ব্যাগ খুলে মাস্ক বের করে। তারপর চয়নের হাতে ধরিয়ে গমগমে গলায় বলে,
“মাস্ক পরুন।”
হুটহাট মাস্ক পরতে বলায় চমকায় চিবা চয়ন দুজনেই। চয়ন ভ্রু কুঁচকে বলে,
“মাস্ক পরব কেন!”
“আমি বলছি তাই পরবেন।” গম্ভীর কণ্ঠে বলে সুরলা।
“বাদাম খাচ্ছি তো, খাওয়া শেষে পরব।” সুরলার আচার আচরণ বুঝতে পারেনা চয়ন। সুরলা খপ করে চয়নের হাত থেকে বাদামভর্তি কাগজের টোঙা চিনিয়ে নেয়। তারপর রেগে বলে,
“বাদাম খাওয়া লাগবে না আপনার, মাস্ক পরুন।”

সুরলার এই আচরণ অদ্ভুত ঠেকে চয়নের কাছে। হুট করে হলো কী মেয়েটার! বাদাম নিয়ে নেয়ায় বিরক্তি ও লাগছে, বোন সামনে থাকায় কিছু বলতেও পারছে না। বাঁকা চোখে চেয়ে থাকে সুরলার দিকে। বলে,
“তোমার হয়েছেটা কী বলো তো?”
“কিছু হয়নি। আপনাকে মাস্ক পরতে বলছি মাস্ক পরুন। ”
চয়ন যখন মাস্ক পরছে না তখন সুরলা না পারতে নিজেই চয়নের মুখে মাস্ক পরিয়ে দেয়। বলে,
“কাল থেকে অফিসে যাওয়ার সময় ও মাস্ক পরবেন। এখন চলুন এখান থেকে। মা বাবার কাছে যাব।”

চয়ন তখনো ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে সুরলার দিকে। সুরলার অদ্ভুত আচরণের কারণটা ধরতে পারেনা সে। সুরলা চয়নকে টেনে দাঁড় করিয়ে চয়নের হাত হাত গুজে দেয়। তারপর তাকিয়ে থাকা মেয়েদের দিকে চেয়ে ইশারায় বলে, “সে শুধু আমার। ” মেয়ে গুলো অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকে। তারপর চোখ ফিরিয়ে নেয়। ব্যাপারটা চোখে পড়ে চিবার। সে মুচকি হেসে বলে, “ওহ! এই ব্যাপার তবে! এরা সত্যিই লাভ বার্ড।”
সুরলা চয়নের হাত ধরে নিয়ে যায় উপর। বখতিয়ার আর জোবায়েদা যেখানে বসে ছিল সেখানে গিয়ে চেয়ারে বসে পড়ে। চিবা ভাই ভাবির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে যাচ্ছে। চিবার হাসিটা চয়নের চোখে পড়ে। চিবা চয়নের পাশে বসা ছিল। চয়ন বোনকে ধীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“তুই হাসছিস কেন? আর ওর অদ্ভুত বিহেভের কারণ জানিস?”
চিবাকে আর পায় কে। হেসে জবাব দেয়,
“জানি বলেই হাসছি।”
“কারণ বল? ” কৌতূহল গলায় বলে চয়ন। চিবা ভাইয়ের কাছ ঘেঁষে অনেকটা ফিসফিস করে বলে,
“দুটো মেয়ে তোমার দিকে হা করে তাকিয়ে ছিল অনেকক্ষণ। ক্রাশ ট্রাশ খেয়ে ফেলেছে সম্ভবত। ভাবির চোখে তা পড়তেই ভাবির চেহারার রঙ ওড়ে গেছে। জেলাসি থেকেই ভাবি তোমাকে মাস্ক পরিয়ে নিয়ে এসেছে। ভাবি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসা বলতেই হয়। তোমাকে হারানোর ভয় দেখলাম ভাবির চোখে। ভাগ্য করে প্রটেক্টিভ বউ পাইছো ভাই।”

চয়নের একপাশে বসে চিবা অন্য পাশে বসেছে সুরলা। চিবার কথা শুনে বিস্মিত চোখে সুরলার দিকে তাকায় চয়ন। সুরলা তখনো রাগে ফোঁসফোঁস করছে। ঘটনা যাচাই করতে চয়ন সুরলাকে উদ্দেশ্য করে বলে, “মাস্ক খুলে ফেলি?”
“কেন ওই মেয়েগুলো তাকিচ্ছিল যে ভালো লাগছিলো? আবার নিজের মুখ তাদের দেখাতে চান? তেমন হলে যান না? গিয়ে তাদের মুখ দেখিয়ে আসুন। আমার পাশে বসে আছেন কেন? আর ওই মেয়েগুলোও কেমন বেহায়া। বিবাহিত ছেলের উপর নজর দেয়। আমার বুক করা মানুষটার উপরই তাদের নজর দিতে হয়। ইচ্ছে করে মেরে কুচিকুচি করি।” দাঁত চিবিয়ে বলে সুরলা। চয়ন হেসে বলে,
“কেউ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলে আমার ভালোই লাগে। যাই বরং গিয়ে দেখা করে আসি ওদের সাথে। পছন্দ হলে নাম্বার ও দিয়ে আসব।” রগড় করে বলে উঠে দাঁড়াতে চায় চয়ন।
সুরলা হাত চেপে ধরে বসিয়ে দেয়। চোখ রাঙিয়ে শাসানোর ভঙ্গিতে বলে,
” অন্যকারো কাছে যাওয়ার কথা ভাবলে জানে মেরে দিব একদম। নজর দেয়ার হলে আমার উপর দিন, কারণ আপনি আমার বুক করা। কাল থেকে মাস্ক পরে অফিসে যাবেন, না জানি আসা যাওয়ার পথে কতজন এভাবে তাকিয়ে থাকে। আমার ক্ষমতা থাকলে সবার চোখ গেলে দিব। সুরলার বরের উপর নজর দেয় সাহস কত?”

চয়নের যেন অবাক হওয়ার পালা এসেছে। এই মেয়ের সব আচরণ তাকে অবাক করছে বারবার। সামান্য একটু তাকানো নিয়ে সে-কি সিরিয়াস যেন ওরা সত্যি তাকিয়ে থেকেই চয়নকে নিজের করে নিচ্ছে। চয়নের মনে হয়, এই মেয়েটা তাকে মাত্রার চেয়ে একটু বেশিই ভালোবাসে। এত ভালোবাসার যোগ্য সে?

“ভাইয়া ভাবিকে শান্ত করো, যেভাবে তোমার উপর রাগ ঝাড়ছে মা বাবার সামনে সিংক্রিয়েট হয়ে যাবে।” চিবার বলা কথায় চয়ন ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে। মা বাবার দিকে তাকিয়ে দেখে তারা নিজেরা কিছু একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে। এদিকে মন নেই তাদের। এই ফাঁকে সুরলার টেবিলের উপর রাখা হাতটার উপর হাত রাখে চয়ন। মৃদুস্বরে বলে ওঠে,
“আমি মজা করছিলাম। আমি কোথাও যাচ্ছি না, মাস্ক ও খুলছি না। তোমার সাথেই মাস্ক পরে আছি, তাই শান্ত হও প্লিজ! ”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here