অজানা পর্ব-১৯

0
984

#অজানা
#লেখনীতে_তাশরিফা_খান
পর্ব–১৯

💝

“আমি পারবোনা ভাইয়া!”

“৫০কেজির বস্তা তোর মাথায় দিছি? ওয়েট বেশি? পারবি না?”

আরিবার অসহায় ভাব করে বললো।

“ভাইয়া! আপনিতো ৭০ কেজি।”

“আমাকে কোলে নিয়ে বসে থাকতে বলছি?”

“একেই তো। আমি পারবো নানানা..”

“চুপ! বলছি না, না, শব্দ আমার পছন্দ না? যা বলছি তা কর?”

আরিবা ঠোঁট উল্টে চুপ করে বসলো। আরশ ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরলো। আরিবা চুপ করে ভাবছে একটু আগের কথা। আরশ ওর মাথা টিপে দিতে বললো। আরিবা বললো।

“আমি তোমার মাথা টিপে দিব কেনো? আমি কি তোমার চাকর? পারবোনা আমি।”

আরশ রাগি গলায় বললো।

“দিবি কিনা বল? নাহলে সবাই কে বলে দিবো তুই কি করছোছ।”

“কি বলবা হুম? কি বলবা?”

আমতা আমতা করে কথাটা বললো আরিবা। আরশ আরিবার দিকে একটু ঝুকে এগিয়ে মাথা দুলিয়ে বললো।

“সবাই কে বলবো! তোমাদের আদরের মেয়ে রিবা এই আরশের ওয়াশরুমে সাবান মেখে রেখেছিলো।”

“কি, কি প্রমান আছে?”

“প্রমান?”

“হুম”

আরশ মুচকি হেসে বললো।

“সিসি ক্যামেরা আমার রুমে লাগানো আছে। কেউ আমার অগোচরে আমার রুমে আসলে আমি যেন জানতে পারি তাই। আমি জানি শুধু তুইয়েই আসোছ তাই লাগাইছি।”

আরিবা এদিক ওদিক তাকিয়ে সিসি ক্যামেরা খুঁজতে লাগলো। আর ধরা খাওয়া চোরের মতো করতে লাগলো।এবার আরশ আরও সুযোগ পেলে গেলো। তাই এবার আরিবার কোলে মাথা রেখে শোয়ার কথা বলছে। বসে বসে এসব ভাবছে আরিবা। হঠাৎ আরশের কথায় ওর ধ্যান ভাঙলো।

“কিরে? চুপ করে বসে থাকার কথা ছিলো? মাথা টিপে দে?”

আরিবা একটা ভেংচি মেরে আস্তে করে মাথা টিপে দিতে লাগলো। আরশ চুপটি করে শুয়ে আছে ওর কোলে। ওর নরম হাতের স্পর্শে খুব ভালো লাগছে আরশের। চোখ বন্ধ করে অনুভব করছে ওর মায়াপরীর ছোঁয়া। সারাদিনের ক্লান্তি যেন এক নিমিষেই চলে গেলো। যদি প্রতিটা সময় অনুভব করতে পারতো। কবে পারবে ও? যদি মায়াপরী ওসব যেনে যায়? ওকে ভুল বুঝে দূরে ঠেলে দেয়? মায়াপরী ওসব জানলে কি করে ওর সামনে দাড়াবে ও? এসব ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

আরশের মাথা টিপে আরিবার হাত ব্যাথা করছে। হাতটা নামিয়ে আরশের দিকে তাকালো। আরশ গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে। গ্রে কালারের টি-শার্ট পড়ে আছে। অতিরিক্ত ফর্সা হওয়ায় ঘামাক্ত মুখটা লাল লাল হয়ে আছে। খুব সুন্দর লাগছে। আরশ সত্যি খুবেই সুন্দর। ওর হাসি যেকোনো মেয়েকে পাগল করার জন্য যথেষ্ট। “বেটা খবিশ না হলে ওর উপর ক্রাশ খাওয়া যেতো। দেখতে সুন্দর হলে কি? ব্যবহার ফালতু। আমার সাথে বাজে ব্যবহার করে।” এসব ভেবেই আরিবা রাগি চোখে আরশের দিকে তাকালো। দেখলো লাল ঠোঁটটা ঘুমের কারনে মলিন হয়ে আছে। নিজের অজান্তেই আরিবা আরশের ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো। অপর হাত দিয়ে নিজের ঠোঁট ছুলো। আর ভাবলো আরশ ছেলে হয়েও ওর থেকে ফর্সা আর ঠোঁট ওর থেকে কত সুন্দর। দেখলেই তো কিস করতে ইচ্ছা করে। এসব ভেবেই লজ্জা পেলো আরিবা। কি ভাবছে এসব? এগুলো খারাপ জিনিস। পরক্ষনেই ভাবলো ও তো খারাপ দিকে ভাবেনি জাস্ট এমনি। তবুও তাড়াতাড়ি ঠোঁট থেকে হাত সরিয়ে ফেললো। সিল্কি চুলগুলো হাত দিয়ে কপাল থেকে সরিয়ে দিলো। হাত দিয়ে চুলগুলো নাড়াচাড়া করতে লাগলো। সিল্কি চুল ওর খুব ভালো লাগে। সারাদিন নাড়াচাড়া করতে ইচ্ছা করে।

চুলে হাত বুলাতে বুলাতে আরিবা ঘুমিয়ে পরলো। আরিবার মুখমণ্ডল এসে আরশের মুখের উপর ঠেকেছে। ওর শ্বাস আরশের গালে আছড়ে পড়ছে। আরশ খুব ভালো করেই বুঝেছে আরিবা ঘুমিয়ে গেছে। ওর শ্বাস আরশের গালে লাগতেই আরশের শরীর ঝাকি মেরে উঠলো। ও যেনো অন্য ঘোরে চলে যাচ্ছে। ঘোরের মাঝেই নিজের হাত আস্তে করে আরিবার গালে রাখলো। মসৃণ গালে হাত দিয়ে একটু স্লাইড করতেই আরিবা নড়ে উঠলো। ও নড়তেই আরশের ঘোর কাটলো। আস্তে করে হাত সরিয়ে ফেললো। মনে মনে বলতে লাগলো। “ইয়া আল্লাহ! এটা কি করতে ছিলাম? জানি না কি হয়েছিলো। সত্যি মাবুদ ওকে দেখলে নিজেকে ঠিক রাখাটা বড়ই কষ্টকর। শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে বাচানোর জন্য অনেক শুকরিয়া।” এসব ভেবেই আস্তে করে উঠে পরলো আরশ। আরিবার মাথার নিচে একটা বালিশ দিয়ে ওকে শুইয়ে দিলো। নাড়াচাড়া করতেই আরিবা ঘুমের মাঝে কপাল কুচকালো। বাচ্চাদের মতো বিরক্তি নিয়ে ঠোঁট উল্টে ঘুমিয়ে পড়লো। আরশ ওর কাহিনী দেখছে আর হাসছে। ছোট ছোট চুল গুলো আরিবার মুখের উপর পরে আছে। আরশ চুলগুলো হাত দিয়ে সরিয়ে দিলো। তাকিয়ে থাকলো ওর মায়াপরীর দিকে। এই মায়া ভরা মুখটা দেখলেই শান্তি ওর। সকল কষ্টের অবসাদ হলো এই মায়াভরা মুখ। তৃপ্তি নিয়ে দেখতে লাগলো ওর ভালোবাসা। সারারাত জেগে দেখবে। আজ ওর ঘুম আসবে না। আরশের মনে প্রশ্ন জাগে, হাজার বছর দেখলে কি তার তৃপ্তি হবে? পরক্ষনেই হেসে ফেললো। হাজার বছর তো কেউ বাঁচেই না। এসব ভাবনা চিন্তা ফেলে তাকালো ওর মায়াপরীর দিকে। আরশের কাছে এ যেন এক স্বর্গীয় সুখ।

—————————–

এই বিচিত্র পৃথিবীতে বিচিত্র ধরনের মানুষের বসবাস। একই পৃথিবীতে কেউ সুখের ভেলায় ভাসে আবার কেউ দুঃখের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। এত মানুষের মাঝেও সুখি মানুষ খুঁজে পাওয়া যায়না। সবারেই কিছুনা কিছু অপূর্ণতা থাকেই। কিছু মানুষের চাওয়া অনেক থাকে। তারা সব কিছু পেয়েও সুখি না। তাদের আরও চাই। এই অতিরিক্ত চাওয়াটাই মানুষের সুখি না হওয়ার কারন। আবার কিছু মানুষের চাওয়াটা সামান্য কিন্তু তাদের এই সামান্য চাওয়াটাই পূর্ণ হয়না। চাওয়ার সাথে পাওয়ার মিল না হলেই সে অসুখি। শত কিছু থাকলেও তার মাঝে অপূর্ণতা বিরাজ করবে। মনের মাঝে অপূর্ণতা থাকলে বাইরের পরিপূর্ণতা কখনোই আমাদের সুখ দেয় না।

আকাশটা মেঘাচ্ছন্ন। চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকারে পরিপূর্ণ। তেমনি নিদ্রর মনেও রয়েছে অন্ধকার। বেলকনিতে দেয়াল ঘেঁষে বসে আছে নিদ্র। পাশে তার গিটার রাখা। গিটারের উপর হাত বুলিয়ে তুচ্ছ একটা হাসি দিলো। এই হাসিতে লুকিয়ে আছে হাজার অভিমান। আরিবাকে প্রথম দিন গান গাইতে দেখেই এটা কিনে রেখেছে ওকে গিফট দিবে বলে। কিন্তু তা আর হলো কই। ভেবেছিলাে প্রতিরাতে এই বেলকনিতে বসে তার বিউটি ডলের গান শুনবে। মিষ্টি গানে হারিয়ে যাবে দূর অজানায় কিন্তু…এসব ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিদ্র। গিটারটা বুকে জড়িয়ে চোখ বন্ধ করলো। অনুভব করলো ওর বিউটি ডল কে। আস্তে করে গিটারে হাত বুলিয়ে আরিবাকে অনুভব করতে লাগলো। চোখ বন্ধ করে ওকে ভেবেই গাইতে লাগলো।

এই বুকেতে কেউ থাকে না, থাকো শুধু তুমি।
খুব যতনে সংগোপনে, লুকিয়ে রাখি আমি।
তুমি আমার সোনা পাখি আদর সোহাগ রাখি।
একলা করে চলে গেলে কেমনে বলো বাঁচি।

তোমার জন্য হৃদয় ভরে ভালোবাসা রাখি।
ভালোবেসে কাছে আসো আপন ভাবো যদি।
তুমি আমার সোনা পাখি আদর সোহাগ রাখি।
একলা করে চলে গেলে কেমনে বলো বাঁচি।

আমার বুকের মধ্য খানে তোমায় শুধু রাখি।
তুমি ছাড়া এ জীবনে কে আছে আমার সাথি?
তুমি আমার সোনা পাখি আদর সোহাগ রাখি।
একলা করে চলে গেলে কেমনে বলো বাঁচি।

এই বুকেতে কেউ থাকে না, থাকো শুধু তুমি।
খুব যতনে সংগোপনে, লুকিয়ে রাখি আমি।
তুমি আমার সোনা পাখি আদর সোহাগ রাখি।
একলা করে চলে গেলে কেমনে বলো বাঁচি।

গান গাইতে গাইতে কখন যে চোখের জল গড়িয়ে চিবুকে পড়ছে খেয়াল নেই নিদ্রর। গিটারটা পাশে রেখে চোখের জলটা মুছে নিলো। উঠে বেলকনির কিনারায় রেলিং ধরে আকাশের দিকে তাকালো। আল্লাহর কাছে তার হাজার অভিযোগ। সে তো তার মনের কথাটাও বলতে পারলো না। সব কিছু শুরু করার আগেই কেনো শেষ হয়ে গেলো? বিউটি ডল তার হলে কি খুব বেশি ক্ষতি হতো? এসব ভেবেই ঠুকরে কেঁদে উঠলো নিদ্র। কিন্তু সাথে সাথেই মুখে হাত দিয়ে কান্না চাপিয়ে রাখলো। ও কাঁদতে চায়না। সব কিছু ভুলতে চায় কিন্তু দিন শেষে যখন একা হয় ঠিক মনে পরে যায়। যে জিনিস নিজের না তাকে মনে করে কষ্ট পাওয়াটা শুধুই বোকামী তা নিদ্র জানে। একথা ওর বিবেক বুঝতে পারলেও মন কিছুতেই বুঝতে চায়না। ভাবনা সব সময় মানুষকে শুধু কষ্টই দেয়। আর ভাবা যাবেনা। এসব ভেবেই নিদ্র ঘুমাতে চলে গেলো। জানে ঘুম আসবেনা তবুও চেষ্টা তো করা যেতেই পারে।

———————-

সকাল বেলা চৌধুরী বাড়ির বড়রা সবাই টেবিলে বসে আছে। আরশ কাল রাতে সজাগ থাকার জন্য এখনও উঠতে পারেনি। আরিবা তাড়াতাড়ি দৌড়ে এসে বসে পড়লো। ওকে বসতে দেখেই মিসেস আঞ্জুমান ধমক মেরে বলে উঠলো।

“আবার দৌড়া দৌড়ি করতাছোছ? কাল কত করে বললাম কথা কানে গেলো না? আমি যে কাকে বলি না বলি, সেটা ওর কানেও লাগে না।”

এটুক বলে থেমে নিজের স্বামীর দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে আবার বললেন।

“এই যে তুমি! কিছু বলো না কেনো হুম? কাল পরে গেছিলো যদি কিছু হতো? তখন কি করবা?”

মি. জাকির খাওয়া রেখে মেয়ের দিকে তাকালেন। অস্থির হয়ে বললেন।

“মামনি! কি বলে তোমার আম্মু? সত্যি পড়ে গিয়েছিলে? কোথায় ব্যথা পেয়েছো? ডক্টরকে আসতে বলবো?”

আরিবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওর বাবার দিকে তাকিয়ে বললো।

“আব্বু আমি ঠিক আছি। কোনো ব্যথা পাইনি। অস্থির হইয়ো না তো। তোমার প্রেশার বেড়ে যাবে।”

“তবুও মামনি! তোমার সাবধানে চলা উচিত। বিপদ বলে আসে না বুঝছো? তাই সাবধান!”

মি. জাকিরের কথায় মি. আফজাল ও মাথা নাড়িয়ে তাল মেলালেন। মিসেস তারিন এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছে সবাই কে। আরিবা হতাশ ভাবে খাচ্ছে। দৌড়া দৌড়ি ছাড়া ওর ভালো লাগে না। তাতে ওর কি দোষ? একটু খেয়েই আরিবা উঠতে গেলেই ওর মা ধমকে উঠলেন।

“কই যাছ তুই? একটা পরোটাও শেষ করলিনা। তারাতারি খা। আমি দুধ ডিম আনতাছি।”

“আমি খাবোনা তুমি খাও।”

আরশ নাই এই সুযোগ পেয়েছে আরিবা। আরশ ছাড়া কাউকেই ভয় পায়না ও। আরিবার মা রেগে বললেন।

“ওকে যা তোর খাওয়া ও লাগবেনা আমাকেও আম্মু বলে ডাকা লাগবেনা।”

“আচ্ছা যাও! আম্মু বলে ডাকবো না। হুহ”

কথাটা বলেই আরিবা একটা ভেংচি কাটলো। ওর মা রেগে রান্না ঘরে চলে গেলো। একটু পর আরিবা ওর মাকে উদ্দেশ্য করে জোরে জোরে বলতে লাগলো।

“রিবার আম্মু! এই রিবার আম্মু!”

ওর কথা শুনে সবাই অবাক হয়ে তাকালো। মিসেস আঞ্জুমান রান্নাঘর থেকে রাগি চোখে এসে বললেন।

‘এই! কি বললি এগুলো?”

“তুমিয়েই তো আম্মু বলতে নিষেধ করছো।”

“আমি রিবার আম্মু না বুঝলি? আমার মেয়ে আমার কথা শুনতো”

আরিবা মুখ বাকিয়ে বললো।

” আমার আব্বুর বউ! এই আব্বুর বউ! আমার খাবার নিয়ে আসো!”

আরিবার কথা শুনে সবাই হেসে দিলো। মিসেস আঞ্জুমান ও মেয়ের পাগলামিতে হেসে ফেললেন।

💖

ইনশাআল্লাহ চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here