#অজানা
#লেখনীতে_তাশরিফা_খান
পর্ব–৫১
💝
আরশের লোকেরা ওকে খবর দিতেই ওর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। আস্তে করে চেয়ারে বসে পড়লো ও। কি হচ্ছে না হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। পুরো দুনিয়া নিয়ে ঘুরাচ্ছে আরশের। বুকের কোথাও একটা ফাঁকাফাঁকা লাগছে। বুকে ব্যাথা করছে আরশের। বুকে হাত দিয়ে হাসফাস করতে লাগলো। আরশের অবস্থা দেখে লেনা, সজল রুমের ভিতরে দৌড়ে এলো। সজল এসেই আরশকে ধরে বললো।
“কি হয়েছে স্যার! এমন করছেন কেনো?” লেনা ডক্টরকে ডাক দেও।”
লেনা ডক্টরের কাছে চললো। আরশ কোনো রকম নিজেকে একটু ঠিক করে কান্না ভেজা চোখে থেমে থেমে বললো।
“সজল আমার রিবা! মায়াপরী…”
সজল তাড়াহুড়ো করে বললো।
“ম্যাডামের কি হয়েছে স্যার? বলুন?”
আরশ খুব ভেঙে পড়লো। পরক্ষনেই নিজে নিজেই বললো।
“নাহ! আমার মায়াপরীর কিছু হতে পারেনা। ও আমাকে রেখে কোথাও যেতে পারেনা। সবাই মিথ্যা কথা বলছে। সবাই মিথ্যা বলছে। আমার মায়াপরী আমায় রেখে কোথাও যেতে পারেনা।” কথাগুলো বলে পাগলের মতো দৌড়ে বের হতে লাগলো। সজল ও ওর পিছনে দৌড়াচ্ছে। আরশ বিড়বিড় করছে আর পাগলের মতো দৌড়ে চলেছে। সজল বুঝতে পেরেছে আরিবার কিছু হয়েছে তাই তাড়াতাড়ি গিয়ে গাড়ি বের করলো। আরশ তাড়াহুড়ো করে গাড়িতে উঠেই কান্না ভেজা চোখে বললো।
“তাড়াতাড়ি আরিবার কলেজের রাস্তায় চলো।?”
সজল তাড়াতাড়ি গাড়ি চালাচ্ছে তবুও আরশ আরও জোরে চালাতে বলছে। আরশ একবার বাইরে তাকাচ্ছে তো একবার ভিতরে তাকাচ্ছে। এসি চালু হওয়া সত্তেও ঘেমে এলাকার। শুধু এদিক ওদিক তাকিয়ে হাসফাস করছে আারশ।
গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে যেতে লাগলো আরশ। আরিবার পোড়া গাড়ি দেখেই থমকে গেলো। গতি থেমে এলো ওর পা আর সামনে আগাচ্ছে না। ভাবলেশহীন ভাবে দু পা সামনে আগালো। গাড়ির কাছে বসে ওর মা বাবা সবাই পাগলের মতো কাঁদছে। আরশ ওখানেই হাটু গেড়ে বসে পড়লো। মাটির দিকে তাকিয়ে অঝোরে কাঁদতে দেখলো। সজল এই প্রথম আরশকে কাঁদতে দেখলো। সজল এসে আরশকে ধরে বললো।
“স্যার সামলান নিজেকে!”
আরশের কোনো হেলদোল হলোনা। হাত মুঠ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলো। ওর চিৎকারের আওয়াজ আকাশে বাতাসে প্রতিধ্বনিত হতে লাগেলো। আরশের মা ছেলের অবস্তা দেখে দৌড়ে ছেলের কাছে আসলেন। আরশ নিজের মাকে দেখে ঠিক থাকতে পারলো না। ওর মাকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে থেমে থেমে বললো।
“আম্মু তুমি বলো রিবা মরেনি। সবাই মিথ্যে বলছে। ও আমাকে রেখে যেতেই পারেনা তুমি তো জানো? ও কোথায় যেনো লুকিয়ে আছে ওকে বের হতে বলে। ওকে পেলে কিন্তু আমি সত্যি সত্যি মারবো। ওকে আসতে বলো!”
আরশ এমন ভাবে কথাগুলো বলছে। এখন ওকে যে কেউ দেখলে পাগল মনে করবে। সব বডিগার্ডরা অবাক হয়ে তাদের স্যার কে দেখছে। তারা জানে তাদের স্যার তাদের ম্যাডামকে অনেক ভালোবাসে। তার জন্য এত কাঁদবে সেটা বুঝতে পারেনি। মিসেস তারিন নিজেও কাঁদছেন। আরশের কান্না শুনে নিজেকে আরও অসহায় লাগছে। আরিবার মা বাবা পাগলের মতো মাটিতে বসে বসে কাঁদছেন। সবাই কাঁদছে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কেউ নেই। এত বড়লোক, যারা চেয়ার ছাড়া কখনও বসে না। তাড়া আজ মেয়ের জন্য মাটিতে বসে কাঁদছেন। পাশের লোকেরা আরশের কান্না দেখে অবাক হয়ে গেলো। মানুষ কাউকে কতটা ভালো বাসতে পারে এটা না দেখলে তারা বুঝতে পারতো না। হঠাৎ একটা কিছু মনে পড়তেই রাগে আরশের শরীর টগবগ করে উঠলো। কিন্তু কি করবেও? চুপ থাকা ছাড়া ওর উপায় নেই।
ফায়ার সার্ভিস আর পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে। তারা এসে আগুন নিভিয়েছে। পুলিশ এসে তদন্ত করছে। আরশ আস্তে আস্তে সামনে এগিয়ে গেলো। গাড়ির সামনে গিয়ে ভাবলেশহীন ভাবে দাড়িয়ে আছে। ঠিক মতো দাড়াতেও পারছেনা। সজল ওকে ধরে রেখেছে। হঠাৎ করেই একটি পুলিশ বলে উঠলো।
“গাড়িতে কতজন লোক ছিলো?”
মি. আফজাল কান্না ভেজা চোখে নাক টেনে বললো।
“দুজন ছিলো। একজন আমাদের ড্রাইভার আর আমাদের রিবা মামনি!”
“এখানে তো মেয়েটির পোড়া দেহ নেই!”
কথাটা শুনে সবাই চমকে গেলো। কালো ঘন মেঘের মাঝে একটু রোদ্রের আলো দেখতে পেলো। কান্নার মাঝেও আরশ হেসে দিলো। কান্না ভেজে চোখে হেসে হেসে সবার দিকে তাকিয়ে বললো।
“আমি বলছি না রিবা কিছুতেই আমায় ছেড়ে যেতে পারেনা। ও আমাকে রেখে কোথাও যেতে পারেনা। ও আসবে একটু পরেই আসবে। তোমরা দেখে নিও। আমি জানি রিবা শুধু শুধু আমায় ভয় দেখাচ্ছে।”
আরশ কথাগুলো বলেই আসে পাশে খুঁজতে লাগলো। সবাই মিলে খুঁজছে। পাশে অনেক লতা পাতা ঝোপ ঝার আছে। আরশ সামনে যেতেই দেখলো আরিবার ওড়না। আরশ তাড়াতাড়ি নামতে গিয়ে নিজেও পড়ে গেলো। পরে গিয়ে হাতপা ছিলে গেছে। তাতে ওর কিছুই না। আরিবার ওড়নাটা পেয়েই তাড়াতাড়ি হাতে নিয়ে চুমু দিয়ে শক্ত করে বুকে সাথে মিশিয়ে ধরে রাখলো।
আরিবার খবর পেয়ে শান্তা, শাওন, তূর্য এসেছে। ওরাও অনেক কান্না কাটি করছে। আরিবা ওদের প্রানের বন্ধু। ও ছাড়া ওদের একটুও ভালো লাগেনা। আরিবা গাড়িতে নেই যেনেই ওরাও আরিবার খোঁজ করছে। নিজেদের এক বান্ধবীকে হারিয়েছে ওরা আরেক জনকে হারাতে চায়না। আরিবা ওদের মধ্যে সব চেয়ে হাসি খুশি মেয়ে। ও না থাকলে ওদের ক্লাসটাই মরা মরা লাগে। শান্তা কান্না জড়ানো গলায় বললো।
“আরিবাকে পেলে আমি ১হজার টাকা মসজিদে দিবো। আল্লাহ তুমি আমাদের সহায় হও ওকে বাঁচিয়ে দেও!”
“আমি ওই ট্রাক ওয়ালাকে পেলে পিছ পছ করে রান্না করতাম। ওই শালায় নাকি ইচ্ছা করে ধাক্কা মারছে।”
তূর্য সামনে তাকিয়ে রেগে কথাগুলো বললো। শাওন খুঁজছে আর বলছে।
“আমি বুঝলাম না কে রিবার শত্রু। ওকে তিনদিন মারার চেষ্টা করা হইছে। ও নিজের পরিবারের কাছে না বলে ভুল করছে। তারা টেনশন করবে বলে বলেনি। বললো তারা পুলিশে জানাতো আজ এসব হতোই না।”
কেউ আর কিছুই বললো না। খুঁজতে লাগলো। আরশ খুঁজতে খুঁজতে একটা ঝোপের মধ্যে আরিবাকে দেখতে পেলো। পেয়েই সবাইকে ডাকলো। ও নিজে আগেই ছুটে গেলো। কাছে গিয়ে ওর মাথাটা কোলে নিয়ে বলতে লাগলো।
“এই রিবা? কথা বল? চুপ করে আছোছ কেনো?”
পাগলের মতো করে কথাগুলো বলতে বলতে মাথার নিচে হাত গেলো আরশের। হাত সামনে আনতেই দেখলো রক্তে আরশের হাত মেখে গেছে। এতক্ষনে সবাই এসে গেছে। রক্ত দেখে সবাই ভয় পেয়ে গেলো। মি. জাকির তাড়াহুড়ো করে আরশকে বললেন।
“পালস্ রেট চেক করো আরশ। মামনির পালস্ চেক করো।”
আরশ কাপাকাপা হাতে আরিবার হাত ধরলো। পালস্ চেক করেই বললো।
“বেঁচে আছে আমার রিবা। বলচিনা ও আমায় টেখে কোথাও যাবেনা। তাড়াতাড়ি হসপিটালে চলো।”
আরশ আরিবার ওড়না দিয়ে ওর মথাটা বেধে আরশ ওকে কোলে করে গাড়িতে বসালো। সজল গাড়ি যালাচ্ছে। আরশ তারা দিলো আরও। হাসতাপালে পৌছানোর আগেই বরশ সব কিছু রেডি করে রাখতে বলছে। আরিবাকে নিয়েই আই সি ইউ তে ভর্তি করলো। আরশ আই সি ইউ এর সামনে পাগলের মতো এদিক ওদিক পাইচারি করছে। ওর চুলগুলো এলোমেলো, শার্টে ময়লা লেগে আছে। পুরো শরীর ঘামে ভিজা। চোখগুলো ফোলা ফোলা লাল লাল, পাঁপড়িগুলো এখনও ভিজে আছে। নার্সরা ওকে দেখে সবাই হতবাগ। কেউ কাউকে কতটা ভালোবাসতে পারে তা দেখছে সবাই। আরিবার পরিবার আর ওর বান্ধুরা কান্না ভেজা চোখে চেয়ারে বসে আছে। মিসেস তারিন ছেলের কছে এসে দাঁড়ালেন। ছেলের কাঁধে হাত রেখে বললেন।
“বাবা শান্ত হ। আমাদের সাথে ওখানে চুপ করে বস! আমরাও কষ্ট পাচ্ছি। আমি জানি তুই কতটা কষ্ট পাচ্ছিস্। তবুও তোকেতো সুস্হ থাকতে হবে। এমন করলে তুই নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়বি!”
“আম্মু! ওকে ছাড়া আমি অসহায়, নিঃস্ব। মা তুমি ওকে সুস্থ করে দেও আমি ঠিক হয়ে যাবো। ও আমার ভালো থাকার ঔষধ। ওকে এনে দেও! ওকে সুস্থ করে আনো!”
কথাগুলো বলে কাঁদতে কাঁদতে আই সি ইউর দরজা ঘেষে বসে পড়লো। হাটু ভেঙে চুপ হয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বসে রইলো।
——————————–
রাত নয়টা। বেলকনিতে দাড়িয়ে আছে তৃনা। জিসান ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। তৃনা না ঘুরেই বুঝতে পাড়লো এটা জিসান। তাই মুচকি হাসি দিয়ে বললো।
“কি হয়েছে? শান্তিতে আকাশও দেখতে দিবেনা?”
“তুমি শুধু আমায় দেখবে। আকাশ দেখবে কেনো?
জিসানে কথাটা শুনে তৃনা মুচকি হেসে বললো।
” বাব বা, এত জেলাস?”
“হুম! একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো সত্যি বলবে তো?
” আরে বলেই দেখো না!”
জিসান মন খারাপ করে বললো।
“তুমি কি আমায় মন থেকে মেনে নিয়েছো? নাকি আরশ এখনও তোমার মনে আছে?”
তৃনা মুচকি হেসে বললো।
“আমি তোমাকে মন থেকে মেনে নিয়েছি। আরশ ভাইয়া শুধুই আমার ভালোলাগা ছিলো। তোমার সাথে চলে বুঝতে পেরেছি ভালোবাসা কি? ভালোআাসি বলেই তো তোমায় বিয়ে করেছি। ”
তৃনার কথায় জিসান খুব খুশি হলো। তৃনাকে জড়িয়ে ধরে বললো।
“তোমায় অনেক ভালোবাসি। সেই প্রথম দিন থেকেই। তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে।
“কি সারপ্রাইজ?”
“শোনো তাহলে, পরশু হানিমুনে যাবো। সিলেট যাবো বুঝলে?”
কথাটা শুনে তৃনাও মুচকি হাসলো। হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো। ধরে দেখে শাহীনের কল। দাঁতে দাঁত চেঁপে বললো।
“শালা বন্ধু নামে শত্রু! আমার রোমাঞ্চে বারোটা বাজিয়ে দিলো। এদের জন্য একটুও শান্তি নাই।”
তৃনা মুচকি হাসলো। জিসান ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে শাহীন বললো।
“দোস্ত আরিবা এক্সিডেন্ট করছে। আমি হসপিটালে যাচ্ছি। তুই গেলে আয়!”
কথাটা বলেই তাড়াহুড়া করে ফোনটা রেখে দিলো। জিসান নিজেও তৃনাকে নিয়ে তাড়াহুড়ো করে হসপিটালে গেলো।
—————————
জিসান শাহীন গিয়ে দেখলো আরশ আই সি ইউর সামনে হাটু ভেঙে বসে আছে। আরশের কাছে যেতেই আরশ ওদের জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। জিসান ওর পিঠে হাত রেখে বললো।
“ধুর শালা এভাবে কেউ কাঁদে? মাইয়া মানুষেটর মতো শুরু করছোছ। ভাবির কিছুই হবে না!”
“কাঁদিস না দোস্ত! সব ঠিক হয়ে যাবে।”
শাহীন স্বল্প স্বরে কথাটা বললো। ওদের কথার মাঝেই আই সি ইউর দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে আরশ পিছনে ফিরে দেখলো ডক্টর বের হইছে। আরশ উঠেই জিজ্ঞাসা করলো।
“রিবা সুস্থ হয়ে গেছে তো? আমি ওর সাথে দেখা করতে পারবো তো?”
ডক্টর কিচুই বলছেনা চুপ করে রইলো। মি. জাকির এসে কান্না জড়িত কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলো।
“চুপ করে থাকবেন না ডক্টর! বলুন আমার মেয়ের কি অবস্হা?”
ডক্টর আস্তে করে বললো।
“দেখুন আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি কিন্তু..”
কথাটা বলে ডক্টর চুপ করে রইলো। আরশ অসহায় চোখে ডক্টরের দিকে তাকালো। আরশ আস্তে করে ফ্লোরে হাটু গেড়ে বসে পড়লো।
💖
ইনশাআল্লাহ চলবে….
(আজ দুই পর্ব দিয়েছে। সবাই ধন্যবাদ দাও এবার!)