অজানা পর্ব-৬২

0
1204

#অজানা
#লেখনীতে_তাশরিফা_খান
পর্ব–৬২

💝

আরিবা হসপিটালে বসে নিরবে চোখের জল ফেলছে। আরিবা আর সহ্য করতে পারছেনা। এত কষ্ট নিয়ে আর কতদিন থাকবে? আরিবার হৃদয় ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। হসপিটালের বেডে শুয়ে থাকা ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে কান্না করতে লাগলো। অগত্যা লোকটির হাতটা নিজের হাতের মাঝে নিলো। শক্ত করে হাতটা ধরে কান্না ভেজা চোখে থেমে থেমে বললো।

“এভাবে আর কতদিন বলো তো? আর কতো অপেক্ষা করবো আমি বলো? সবাই নিজেদের মতো ভালো আছে। নিজেদের গুছিয়ে নিয়েছে। আমি তো পারছিনা আমার হৃদয়ে শুধু হাহাকার করে বেড়ায়। শান্তাও মা হয়ে গেলো আর আমি? কেনো আমার সাথেই এমন হলো বলো তো? আমার জীবনের সব হাসি খুশি শেষ হয়ে গেলো। প্রতি রাতে কান্না আমার সাথি হয়। প্লিজ ফিরে এসো! এক ভুলের জন্য কতো শাস্তি দিবে আমায়? ফিরে এসো আমার কাছে। বলছি তো ভুল হয়ে গেছে আর কখনও তোমায় অবিশ্বাস করবোনা। প্লিজ একটিবার উঠো! মায়াপরী বলে ডাকো প্লিজ প্লিজ!”

কথাটা বলতে বলতে শব্দ করে কেঁদে উঠলো আরিবা। একটি নার্স এগিয়ে এসে বললো।

“দেখুন ম্যাম এভাবে কাদবেন না। পেশেন্টের সমস্যা হতে পারে। দয়া করে সাইলেন্ট থাকুন!”

আরিবা নিজের মুখ চেপে কান্না করতে লাগলো। ওর হৃদয় কোনো বাঁধ মানছে না। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে ওর। কিন্তু তা ও পারেনা সব জায়গাতেই মানুষে ভরপুর।

একটু পরেই একজন নার্স এসে বললো।

” আপনাকে ডক্টর এনামুল হক ডাকছে।”

আরিবা চোখের পানিটা মুছে বললো।

“আপনি যান আমি একটু পরেই আসছি।”

কথাটা বলতেই লোকটি চলে গেলো। আরিবা বেডে শুয়ে থাকা আরশের নিথর দেহের দিকে তাকিয়ে বললো।

“আজ আসি আমি আবার কাল আসবো। প্লিজ আমায় না জ্বালিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে পরো। ছোট থেকে জ্বালিয়েছো আর কত জ্বালাবে? এবার একটু শান্তি দেও প্লিজ! তাড়াতাড়ি উঠো নাহলে দেখবে একদিন আমিও হারিয়ে যাবো ওইদিন তুমি হাজার খুঁজেও আমায় পাবেনা। বাই!”

কথাটা বলেই আরিবা রুম থেকে বেরিয়ে আসলো। টিস্যু দিয়ে চেহরাটা মুছে তাকাতেই দরজার পাশে সজলকে দেখতে পেলো। সজল বেশির ভাগ সময় আরশের কাছেই থাকে। এই পাঁচ বছরে অনেক কিছু চেঞ্জ হয়েছে। সজল দু বছর আগে বিয়ে করেছে। আরিবাকে দেখে সজল বললো।

“ম্যাম! কেমন আছে?”

আরিবা মলিন হাসলো। সজল আরিবার হাসির মানে বোঝে। তাি আর কিছু জিজ্ঞাসা করলো না। জিব দিয়ে ঠোঁটটা ভিজিয়ে বললো।

“স্যারের অবস্থা বেশি ভালো না। কিছু একটা করুন ম্যাম!”

আরিবা নাকটা টেনে বললো।

“আমি ডক্টরের সাথে কথা বলতে যাচ্ছি।”

কথাটা বলেই আরিবা ডক্টরের কাছে গেলো। দরজার সামনে দাড়িয়ে বললো।

“মে আই কামিং স্যার!”

আরিবাকে দেখেই ডক্টর এনামুল বললো।

“আরে আসো আসো! বসো!”

আরিবা জোর পূর্বক হেসে বসে পড়লো। এনামুল ফাইলটা বন্ধ করতে করতে বললো।

“কেমন আছো আরিবা?”

ডক্টর এনামুল হক আরিবাকে খুব স্নেহ করেন। আরিবা মুচকি হেসে বললো।

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি স্যার! আপনি কেমন আছেন?”

“আমিও ভালো আছি!”

“তোমায় একটা জরুরি কথা বলতে ডেকেছি। কথাটা শুনে হয়তো কষ্ট হবে তোমার তবে একটু শক্ত থেকো!”

আরিবা চোখ বন্ধ করে জোরে একটা শ্বাস নিয়ে বললো।

“শক্ত হতে হতে নিজেকে পাথর বানিয়ে ফেলেছি স্যার! আর কত শক্ত হবো? যা বলার বলুন আপনি। আমি সব কথা শোনার জন্যই তৈরি আছি।”

ড. এনামুল হক বললেন।

“আরশের অবস্হা দিন দিন খারাপ হচ্ছে এমন খারাপ হতে থাকলে বেশি দিন বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। দেখো ওর মাতার আঘাত অনেক গুরুতর তাই ও কোমায় আছে। যদি এখন অপারেশন টা করানো হয় তবেই হয়তো ভালো হবেনা।”

আরিবা অবাক হয়ে ডক্টরের দিকে তাকিয়ে বললো।

“আপনি জানেন অপারেশনটা আরশের জন্য ক্ষতিকর। হয়তো মারাও যেতে পারে এর নিশ্চয়তা নেই। তাইতো পাঁচ বছর আগে আমি অপারেশন টা করাইনি৷ আমি যেনো তাকে সামনে দেখতে পারি তাই অপারেশনটা করাচ্ছি না। নাহলে তো আগেই করাতাম। এখন কোমায় হলেও দেখতে পাচ্ছি মরা গেলে তো দেখতেও পারবোনা।”

“আমি জানি অপারেশন করলে একেবারে সুস্থ হয়ে বাঁচতে পারে আবার মারাও যেতে পারে। মৃত্যুর আশঙ্কাই বেশি তবুও আরশের অবস্হা এখন খুব খারাপ। যখন তখন মারা যেতে পারে তার থেকে অপারেশন টা করানোই বেটার। দেকো আমি ভালো কথা বলছি। তুমি ভেবে দেখো! যদি পারো দুদিনের মধ্যেই অপারেশন টা করিয়ে নাও। হয়তো সময় খুব কম আছে।”

কথাটা শুনেই আরিবার চোখের জল গড়িয়ে পড়লো। বুক ফেটে কান্না আসতে চাইলো। আরিবা হাত দিয়ে মুখটা চেপে ধরে বেড়িয়ে গেলো। ডক্টর এনামুল হক আরিবার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

গাড়িতে বসে অঝোরে কাঁদছে আরিবা। ওর একটা ভুলের মাশুল ও পাঁচ বছর ধরে দিচ্ছে। পাঁচ বছর ধরেই আরশ এমন মৃতের মতো শুয়ে রয়েছে। ওইদিন আরশ মারা যায়নি। মাথায় গুরুতর আঘাতের কারনে কোমায় চলে যায়। আরশের বেঁচে থাকার কথা শুনে আরিবা একটু আস্বস্ত হলেও পুরোপুরি হতে পারেনি অনেকটাই ভেঙে পরেছিলো। পরে ডক্টরের পরামর্শ নিয়ে আরিবা আরশকে নিয়ে বাহিরেও গিয়েছে ওর চিকিৎসা করাতে কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। সবাই বলেছে অপারেশন করাতে তাতে মৃত্যুর আশঙ্কাই বেশি তাই আরিবা তা করায়নি হসপিটালে ডক্টরের অধীনে রেখেছে। এখন করাতেই হবে কি করবে ও বুঝে পাচ্ছেনা। সিটে হেলান দিয়ে ভাবতে লাগলো।

———————————–

আরিবা গাড়িতে বসে সারা রাস্তা কেদেছে। বাড়িতে ঢুকেই হনহন করে নিজের রুমে চলে গেলো। মিসেস তারিন ও মিসেস আয়শা এর কারন বুঝতে পারলেন না। তারাও আরিবার পিছু পিছু গেলো কিন্তু কোনো লাভ হলো না। আরিবা ভিতরে ঢুকেই দরজা অফ করে দিয়েছে। বাহির থেকে মিসেস তারিন ও মিসেস আয়শা ডেকে যাচ্ছেন কিন্তু আরিবা দরজা খুললো না। ব্যাগটা বিছানার উপরে ফেলে ওয়াশরুমে চলে গেলো। শাওয়ার অন করে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। ঝর্নার পানির সাথে আরিবার চোখের পানি মিলিয়ে যাচ্ছে। মিসেস তারিন ও মিসেস আয়শা কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করেই চলে যান। এই শীতের মাঝে আরিবা এক ঘন্টার মতো ভিজেছে। এক ঘন্টা পর বের হয়ে নিজেকে একটু পরিপাটি করে টেবিলে খেতে বসলো। টেবিলে আগে থেকেই মিসেস তারিন ও মিসেস আয়শা বসে ছিলো। মিসেস আয়শা আরিবাকে জিজ্ঞাসা করলেন।

“কি হয়েছে তোমার? তখন ওভাবে চলে গেলে কেনো?”

আরিবা মিসেস আয়শার কথার উওর দিলো না। মিসেস তারিনের দিকে তাকিয়ে বললো।

“কাকিমনি! কাল আরশ ভাইয়ার অপারেশন! ”

মিসেস তারিন আরিবার প্লেটে খাবার দিচ্ছিলেন। কথাটা শুনে হাত থেকে চামচ টা পরে গেলো। অবাক হয়ে আরিবার দিকে তাকিয়ে থাকলেন তিনি। মিসেস আয়শা আরিবার ওমন করার কারন বুঝতে পারলেন। মিসেস তারিন কান্না ভেজা কন্ঠে বললেন।

“কেনো আমার ছেলেটাকে মেরে ফেলতে চাইছিস? ওকে এখন দেখতে পারছি ছুঁতে পারছি এটাই অনেক। যদি অপারেশন করালে ওর কিছু হয়? না না তুই অপারেশন করাবি না।”

আরিবা করুন চোখে মিসেস তারিনের দিকে তাকিয়ে বললো।

“এ ছাড়া কোনো উপায় নেই কাকিমনি। ডক্টর বলেছে আরশ ভাইয়ার অবস্হা ভালো। যখন তখন দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। এ ছাড়া কি বা করার আছে বলো আমায়?”

মিসেস তারিন কিছুই বললেন না। কারও মুখে খাবার যাচ্ছেনা আজ। সবাই কোনো রকম খেয়ে চলে গেলো। আরিবা সারারাত জেগে কেঁদেছে। আল্লাহর কাছে মোনাজাত করে অনেক কেঁদেছে। ও জানেনা কাল কি হতে চলেছে। আল্লাহর কাছে শুধু এটুকুই চায়, আরশ যেনো আবার ওর কাছে ফিরে আসে।

————————————–

আরিবা সকাল থেকেই হসপিটালে। সাথে মিসেস তারিন ও মিসেস আয়শাও আছে। ডক্টর বলেছে বিকাল ৩টায় আরশের অপারেশন। তখন থেকেই আরিবা আরশের হাত ধরে নিরব হয়ে বসে আছে। একটুও কাঁদছে না। এই পাঁচ বছর কাঁদতে কাঁদতে ওর চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। মিসেস তারিন কেঁদে কেঁদে অস্থির। মিসেস আয়শা তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। আরশের অপারেশনের কথা শুনে সবাই ওকে দেখতে এসেছে। তূর্য শাওন শান্তা একসাথে এসেছে। শাহীন জিসান ও এসেছে। ওদের সবচেয়ে হাসি খুশি বন্ধুটা আজ নিরব হয়ে আছে। ওদের খুব কষ্ট লাগছে। আরশের কথা শুনে নিদ্র আর ওর বউও এসেছে। নিদ্র ওর খালাতো বোনকে বিয়ে করেছে। আরিবাকে ছাড়া ও বিয়ে করতে চায়নি শেষে মা বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বিয়ে করে নিয়েছে। নিদ্র এসেই আরিবার দিকে তাকালো। আরিবাকে দেখে ওর ভিতরে মোচর মেরে উঠলো। কত তরতাজা মেয়েটা কেমন নেতিয়ে পড়েছে। ওর ইচ্ছে করছে আরিবাকে বুকে আগলে নিতে। পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নিলো। আরিবার কথা এখনও ভুলতে পারেনি নিদ্র। এখনও মাঝে মাঝে আল্লাহ কে প্রশ্ন করে। আরিবা ওর হলে কি বেশি ক্ষতি হতো? কিন্তু এর উওর ওর অজানা। শান্তা তূর্য শাওন আরিবার দিকে এগিয়ে গেলো। শান্তা আস্তে করে আরিবার কাঁধে হাত রেখে বললো।

“চিন্তা করিছনা দোস্ত সব ঠিক হয়ে যাবে। একটু ধৌর্য ধর! আল্লাহ সাহায্য অতি নিকটে!”

শান্তার কথা শুনে আরিবা নিজেকে আর আটকাতে পারলো না ওদের তিনজনকে জরিয়ে ধরে কেদে ফেললো। ওর কান্না দেখে সবাই কাঁদছে। একটু পর ডক্টর এসে বললো।

“দেখুন সময় নেই আপনারা সরুন। রোগিকে কিছু বলার হলে বলে নিন! নাহয় দেখে নিন”

মিসেস তারিন কেঁদে কেঁদে কিচু কথা বলে চলে গেলেন। সবাই চলে গেলো। আরিবা আরশের মাথার কাছে বসে বললো।

“আমি জানিনা তুমি ফিরবে কিনা। যদি নাই ফিরো তবে আমিও তোমার সাতেই তোমার কাছে যাবো। তুমিহীনা আর ভালো লাগছেনা। এই যন্ত্রণা আর সহ্য করার মতো না। প্লিজ ফিরে এসো! আমি জানি তুমি তোমার মায়াপরীর কথা শুনবে। নাহয় আমিও তোমার কাছেই আসছি।”

কথাটা বলেই আরিবা বিষের বোতল শক্ত করে নিজের হাতের মুঠে নিলো। আরশকে অপারেশন করতে নেওয়া হবে তার একটু আগেই একজন নার্স এসে একটা কাগজ আরিবার হাতে দিয়ে বললো।

“ম্যাম এখানে সাইন করুন!”

আরিবার হাত কাঁপছে কি করে ও সাইন করবে? ও কি করে ওর আরশকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সাইন করতে পারে? নার্সটি আবারও তাড়া বললো।

“ম্যাম তাড়াতাড়ি সাইন করুন দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

আরিবা তবুও চুপ করে বসে রইলো। মিসেস তারিন কাঁদছেন। সবার চোখেই জল। ডক্টর এসে বললো।

“যত তাড়াতাড়ি সাইন করবেন ততই আপনার জন্য ভালো।”

কথাটা শুনে আরিবা চোখ বন্ধ করলো। দু ফোটা জল কাগজের উপর গড়িয়ে পড়লো। আরিবা চোখটা খুলেই সাইন করে দিলো। ডক্টর বললো।

“অপারেশন করার পর ৪৮ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে। ৪৮ ঘন্টার মধ্যে জ্ঞান ফিরলে সে বাঁচবে নাহয় নেই।”

কথাটা বলেই ডক্টর চলে গেলেন। আরিবা বিষের বোতল হাতে নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো।

💖

ইনশাআল্লাহ চলবে….

(আজ দুই পার্ট দিলাম। রি চেইক করিনি। সবার মতামত চাই গল্পটা কি বেশি বাড়াবো নাকি তাড়াতাড়ি শেষ করে দিবো? সবাই বলবেন। কমেন্টর উপর ভিত্তি করে কমাবো বাড়াবো।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here