#সূর্য_ডোবার_আগে
পর্ব-২২
লেখিকা ~ #সুমন্দ্রামিত্র
কঠোরভাবে প্রাপ্তমনষ্কদের জন্য।
.
.
.
সপ্তাহের মাঝামাঝি, কাজের দিন। শুভ আর তিন্নি দুজনেই নিজের মতো যে যার কাজে বেরিয়ে গেছে সকাল সকাল। শুভ আজকাল বারীনদার জিমে রিসেপশনে বসছে, তাতে ওর মাসমাইনে তেমন বিশেষকিছু না পেলেও, ফ্রি’তে জিমের যন্ত্রপাতিগুলো নাড়াচাড়া করে, টুকটাক ভিডিও বানিয়ে ইন্সটা,ফেসবুকে দেয়। বারীনদার কথায়, মার্কেট ধরতে এখন জিম করা হট বডি, খোলামেলা চেহারা প্রদর্শন, চুলের কেত, একটু বিতর্কিত টপিক আর হালকা খিস্তিই যথেষ্ট। শুভও তাই করছে….. যদিও এখনো কিছু ভাইরাল হয় নি, কিন্তু হতে কতক্ষন? দুপুরদিকে শুভ বাড়ি ফিরে খাওয়াদাওয়া সেরে একটা ভাতঘুম দেয়, তারপর আবার বিকেল পাঁচটা বাজলো তো বেরিয়ে পড়ে। ফাঁকা বাড়িতে ভাস্বতীদেবী আর রঞ্জনবাবু সেই রাত্রি আটটা নয়টা অবধি। আজ বৃহস্পতিবার – বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ রঞ্জনবাবুও ব্যস্ত, বারান্দায় টেবিলের ওপর আধখাওযা চায়ের কাপ আর দুই তিনটে খবরের কাগজ ছড়ানোছেটানো। বিগত কয়েক সপ্তাহের রোববারের “পাত্রী চাই” কলামে লাল গোল ঢ্যাঁড়া দেওয়া, এগুলো ভাস্বতীদেবীর পছন্দ করে দেওয়া লিস্ট। রঞ্জনবাবুর ওপর দায়িত্ব পড়েছে রাশি রাশি এই বিজ্ঞাপনের ভিড় থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ফাইনাল ক্যান্ডিডেটদের বেছে নেওয়া যাদের সাথে বিয়ের কথা অবধি এগোনো যায়, শ্রীরামপুরের ফিরিঙ্গিডাঙার আচার্য্যবাড়ির বড়োমেয়ে সীমন্তিনী আচারিয়ার জন্য। চশমা চোখে “কোনো দাবি নেই” ব্রাহ্মণ পাত্রদের লিস্ট দেখতে দেখতে রঞ্জনবাবু গলা তুললেন
—তিন্নি জানে? ওর যদি আবার কাউকে পছন্দটছন্দ হয়ে থাকে ?
— ওর আবার কিসের পছন্দ? নিজের মেয়েকে তো চেনো! সাত চড়ে রা করবে না, যা করার সব আমাদেরই দেখেশুনে দিতে হবে।
— তাও, একবার অন্তত জিজ্ঞেস করে দেখো! ট্রেনে-বাসে, অফিসে টফিস যাওয়া আসা করে, যদি কাউকে ওর ভালো লেগে থাকে?
— সে ভালো লেগে থাকলে লাগবে! তাই বলে যার তার সাথে তো আর বিয়ে দিতে পারি না।
তিন্নি অফিস বেরিয়ে যাওয়ার পর রঞ্জনবাবুকে জলখাবার দিতে দিতে ভাস্বতীদেবী আরএকবার তিন্নির বিয়ের কথা পেড়েছিলেন। দেখতে দেখতে বছরদুই হয়ে গেল মেয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে চাকরি করছে, সামনের জানুয়ারিতে পঁচিশে পা! এখনই গা না করলে আর কবে বিয়ে দেবেন? ছোট থেকেই কড়া শাসনে রেখেছেন মেয়েকে, যারতার সাথে যাতে প্রেম না করে বসে! বড্ড ভয় করতো ভাস্বতীদেবীর , তিন্নি যা নরমসরম মেয়ে আর বাস্তবজ্ঞানহীন! যদি ভুল কারো সাথে জড়িয়ে পড়ে আর না বুঝেই অনেকটা এগিয়ে যায়? একটু বয়স বাড়তেই তিন্নির আগেপিছে পাড়ার দু চারজন বা কলেজেও যে বেশ কিছু মৌমাছি ঘোরাঘুরি করেনি তা তো নয়, শুভর কাছ থেকে সব খবরই রাখতেন উনি! মায়ের চোখ, তাও স্বীকার করেন মেয়ে ওনার যথেষ্ট সুন্দরী, তার সাথে মেধাবী তো বটেই! পর পর দু-দুটো বোর্ডপরীক্ষায় রাজ্যের মধ্যে স্ট্যান্ড করা মুখের কথা নয়! নেহাত রঞ্জনবাবুর আ্যকসিডেন্টটা হয়েছিল, উনি সুস্থ থাকলে মেয়েকে কি আর ঘরের কাছের বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে স্কলারশিপে পড়তে পাঠাতেন? কিন্তু পাড়া/কলেজে মৌমাছিদের ঘোরাঘুরিই সার, মেয়ে যে মায়ের ভয়ে কারো দিকে চোখ তুলেও তাকাতো না, তাই বেশিদূর এগোয়নি একটাও। এইজন্য মনে মনে একটু প্রচ্ছন্ন গর্ববোধও করেন ভাস্বতীদেবী! আজকালকার দিনে যেখানে এক একটা মেয়ের এই বয়সে তিনটে চারটে করে বয়ফ্রেন্ড আর কথায় কথায় ছাড়াছাড়ি, তিন্নি সেখানে নির্ভেজাল ভালোমানুষ! পাত্রপক্ষের কাছে কি এর ডিমান্ড নেই? তবে ইদানিং মাস দুয়েক, তিনেক মেয়ে যে কারো সাথে অনেক রাত অবধি ফোন কথা বলে, তা টের পেয়েছেন ভাস্বতীদেবী। এইজন্যই এতো তাগিদ ওঁনার, তিন্নি হাতের বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার আগেই বিয়ের কথাবার্তা সেরে রাখতে চান উনি। নয়নয় করে অনেকদিন হয়ে গেছে, রঞ্জনবাবুর কোনো তাপউত্তাপ নেই দেখে নিজেই গত কয়েকসপ্তাহের কাগজে খুঁজে খুঁজে পছন্দের পাত্রের লিস্ট বানিয়েছেন। বেশি কিছু চাহিদা তো নেই ওঁনাদের – একটু অবস্থাসম্পন্ন বনেদী পরিবার, তিন্নির থেকে বেশি বেতনের কোনো ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার, বিদেশে সেটেল্ড হলে ভালো আর দাবিহীন পাত্রই খুঁজছেন উনি, সাথে ব্রাহ্মণ, পাল্টি ঘর হতেই হবে – সেটা তো অলিখিত শর্ত। আজ সকাল থেকে মেজাজে রঞ্জনবাবুকে বসিয়ে দিয়েছেন ওনার লিস্ট থেকে দেওয়া ফাইনাল সিলেকশন করে রাখতে, এরপর বিজ্ঞাপনে দেওয়া ফোন নাম্বার দেখে যোগাযোগ করার কথা, সে হবে না হয় আরএকদিন।
পাড়ার মহিলাদের কাছেও খোঁজখবর লাগিয়েছেন, এখন তো আর ঘটকের অত চল নেই। কারো এক জনের চেনা সূত্রে একটি পাল্টি ঘরের খোঁজও পেয়েছেন – ওঁনারাও একমাত্র ছেলের জন্য মেয়ে খুঁজছেন তবে একটু তাড়া আছে ওঁনাদের, সামনের মাঘেই ছেলের বিয়ে দিতে চান! সেটা আবার ভাস্বতীদেবীর না পসন্দ। তবে সম্বন্ধটা ভালোই, বলতে গেলে একেবারে ওঁনার মনের মতোই! ছেলে অর্থোপেডিক সার্জন, বিদেশে সেটেল্ড, আদিবাড়ি শ্রীরামপুরেই , লতায় পাতায় অনেক আত্মীয়স্বজন ছড়ানো ছেটানো আশেপাশে। তবে পাত্রের বয়স একটু বেশি, বছর তেত্রিশ-চৌত্রিশ হবে।সে হোক, পুরুষমানুষের আবার বয়স কি? মাসখানেক আগে ছুটিতে দেশে ফিরে ছেলে নাকি কোনো এক আত্মীয়ের বাড়ি এসেছিলো শ্রীরামপুর, তিন্নিকে দেখেছে দু একবার, যাতায়াতের পথে। তারপর দিনকয়েক আগে ছেলের মা নিজে থেকেই ফোন নাম্বার জোগাড় করে কথা বলেন ভাস্বতীদেবীর সাথে। এখন ওঁনারা বাড়ি এসে তিন্নিকে দেখে যেতে চান একবার – সেই কথাই রঞ্জনবাবুকে বলছিলেন ভাস্বতীদেবী।
নিমরাজি হয়ে সবটা শুনে যাচ্ছিলেন রঞ্জনবাবু। তারপর জিজ্ঞেস করলেন — “তুমি কি করে চিনলে এঁনাদের?”
— “স্টেশনমোড়ে যার কাছে ব্লাউজ বানাতে যাই, তার পাশের বাড়ির – আশালতা, ওর পিসতুতো ননদের ছেলে। “চ্যাটার্জী”, পাল্টি ঘর। ছেলে তো বাইরে থাকে! ছুটিতে পিসির বাড়িতে এসেই নাকি প্রথমবার তিন্নিকে দেখে তারপর অফিস যাতায়াতের পথেও দু একবার দেখেছে। মেয়ে তো আমাদের দেখতে খারাপ নয়! ছেলের নাকি খুব পছন্দ হয়েছে তিন্নিকে। আমাদের পরিবারের কথাও সব জানে ছেলেটি, মানে তোমার অবস্থা আর কি!”
আড়চোখে একবার স্বামীর দিকে তাকিয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবান্তরটা বুঝতে চাইলেন। কোনো অভিব্যক্তি না দেখে আবার বলতে শুরু করলেন ভাস্বতীদেবী – “ছেলের মা তাই ছেলের কথামতো একবার তিন্নিকে দেখতে চান। তুমি হ্যাঁ বললে সামনের রোববার সকালের দিকেএকাই আসবেন….. সব ঠিকঠাক এগোলে ছেলেটি এই জানুয়ারী নাগাদ আবার আসবে হয়তো তিন্নির সাথে কথা বলতে।“
— ছেলের মা একা আসবেন মানে?
রঞ্জনবাবু মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন দেখে উৎসাহ পেয়ে ভাস্বতীদেবী বলতে লাগলেন – “আসলে ওঁনারা তিন্নিকে ঘরের বউ করে নিয়ে যেতে চান তাই একদম ঘরোয়া ভাবে দেখতে ইচ্ছুক। এর আগে যতবার ওঁনারা ছেলের জন্য পাত্রী দেখতে গেছেন, সবাই নাকি পার্লার থেকে সেজেগুজে, মুখে রংচং মেখে পড়া মুখস্থের মতো করে …… ওই কি বলে গো? তোমরা চাকরিতে দিতে যাও?”
কথাটা পেটে আসছে মুখে আসছে না ভাস্বতীদেবীর।
— ইন্টারভিউ?
স্ত্রীর মুখের ভাবভঙ্গি দেখে আন্দাজেই বললেন রঞ্জনবাবু।
— হ্যাঁ “ইন্টারভিউ”!
স্বস্তির হাসি হাসলেন ভাস্বতীদেবী। — “এর আগে যতবার ওঁনারা ছেলের জন্য পাত্রী দেখতে গেছেন, সবাই নাকি মুখে রংচং মেখে পড়া মুখস্থের মতো করে ইন্টারভিউ দিয়েছে, বিদেশে যাওয়ার জন্য সবাই তো ছোঁক ছোঁক করছে! ওঁনারা তাই তিন্নিকে সাবলীলভাবে ঘরের মেয়ের মতো দেখতে চান, ওকে না জানিয়ে!”
স্বল্প উত্তেজিত হয়ে উঠলেন রঞ্জনবাবু — “এটা কি দোকানের শাড়ি কেনা হচ্ছে ভাস্বতী? আট-দশটা শাড়ি বেছে, দাম দেখে কিনবে? একটা শিক্ষিত, ভালো চাকরি করা মেয়ে – তাকে না জানিয়ে ওমন হঠাৎ করে দেখতে চলে আসবে আর তুমি তাতে রাজিও হয়ে গেলে?”
গলা চড়লো ভাস্বতীদেবীর — “আহ্! ব্যপারটা ওমন করে ভাবছো কেন? ধরে নাও না, উনি আমাদের পুর্বপরিচিত, অনেককাল আসেননি, এবারে বাড়িতে এসে হঠাৎ করে তিন্নিকে দেখে গেলেন। এমন ভান করছো যেন তিন্নি পৃথিবীর একমাত্র মেয়ে যাকে ছেলেরবাড়ি থেকে দেখতে আসছে। তোমার বাড়ির লোকে আমায় দেখতে যান নি?”
— সেটা সাতাশ বছর আগের কথা ভাস্বতী। তখনকার সময় আলাদা ছিল, লোকজন আলাদা ছিল। অনেককাল আগে একটা ভুল হয়েছে বলেই আজকেও সেই একই ভুল করতে হবে, তার তো কোনো মানে নেই! তিন্নি আজকালকার মেয়ে, চাকরি করছে…. ওর তো সম্মানে লাগতে পারে!
রেগে উঠলেন ভাস্বতীদেবী — “বলছো এমনভাবে যেন আমি তোমাদের জন্মশত্রু! মেয়েকে তো আমি পেটে ধরি নি, তুমি একাই মানুষ করেছো। নেহাত চাকরিটাই করি নি কোনোদিন, সেই জন্য এ বাড়িতে আমার কোনো সম্মানও জুটলো না!”
বলতে বলতে চট করে গলাটা নরম করে নিলেন ভাস্বতীদেবী। অফ টপিকের কথা তুলে এখন ঝগড়া অশান্তির সময় নয়, ঠান্ডা মাথায় ব্যাপারটা সামলাতে হবে। রঞ্জনবাবু মুখ খুলতে যেতেই নরম করে বললেন —- “ভেবে দেখো, যদি এখানে বিয়ের কথা ফাইনাল হয়েই যায় তবে তো তিন্নিকে আর গাধার খাটুনি এই চাকরি করতে হবে না! ছেলে বাইরে থাকে, তিন্নিকেও ওখানেই নিয়ে যাবে, সারাজীবন পায়ের ওপর পা তুলে বসে থাকবে। তাই তো বলছি, এমন হাতের লক্ষী ঠেলে দিও না। আর তাছাড়া……. “
একটু দম নিলেন ভাস্বতীদেবী, তারপর মনের শঙ্কাটা মুখে প্রকাশ করে ফেললেন। —- “দেখতে এলেই যে ব্যপারটা বিয়ে অবধি গড়াবে তা তো নয়!”
রন্জনবাবু তখনও নিমরাজি দেখে তুণ থেকে শেষ অস্ত্র বার করলেন ভাস্বতীদেবী, একটু জোরেই ঝাঁঝিয়ে উঠলেন —- “তোমার আর কি! সারাজীবন হুইলচেয়ারে বসেই কাটিয়ে দেবে। জ্বালা তো আমার, এরপরে বয়স বেড়ে গেলে একা হাতে মেয়ের বিয়ে দেব কি করে সে খেয়াল আছে?”
বিষন্ন হয়ে গেলেন রঞ্জনবাবু, হাতের কাগজগুলো মুড়ে রেখে বললেন –“তিন্নিকে না জানিয়ে বাড়িতে ডেকো না। ওকে একবার অন্তত জিজ্ঞেস করো।“
— তোমার সাথে সকাল বিকেল মেয়ের অত কথা, তুমিই জিজ্ঞেস করো। তবে এখন একদম না, আগে ওঁনারা দেখে যাক, তারপর! নয়তো তোমার জেদি মেয়ে সামনেও আসবে না।
হাল ছেড়ে দিলেন রঞ্জনবাবু — দেখো! যা ভালো বোঝো করো তবে!
আবার উৎসাহে টগবগ করে উঠলেন ভাস্বতীদেবী। — “সামনের রোববার এঁনাদের আসতে বলছি?।“
ভাস্বতীদেবী চলে গেলে বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগতে লাগলো রঞ্জনবাবুর। মেয়ের বিয়ে দিতে হবে সবাই জানে, তাও মনটা খারাপ লাগছে। মেয়ের বাবাদের বোধহয় আঁতুড়ঘরের দিন থেকেই শুনে আসতে হয় “মেয়ের বিয়ে দিতে হবে, এখন থেকে সামলে চল”। একদিন না একদিন তিন্নি এবাড়ি ছেড়ে “নিজের বাড়ি”, শ্বশুরবাড়ি চলে যেতই সে তো সেই মেয়ের জন্মেরদিন থেকেই মনকে প্রস্তুত করে এসেছেন রঞ্জনবাবু। কিন্তু আর কটা’দিন অপেক্ষা করে গেলে হতো না? মেয়েটা বড্ডো অবুঝ, বড্ডো জেদি আর বড্ডো চাপা মন, কাউকে মুখ খুলে কিচ্ছু জানায় না! নতুন পরিবার, নতুন পরিবেশ কি করে মানিয়ে নেবে? তারা যদি তিন্নির গভীর মনটাকে না বুঝে সেটাকে উন্নাসিকতা বলে ভুল বোঝে? যে ছেলেকেই ওঁনারা তিন্নির জীবনসঙ্গী হিসেবে পছন্দ করুন না কেন, সে যদি তিন্নির নরম মন, ওর কবিতা, ওর হঠাৎ হটাৎ হারিয়ে যাওয়াগুলোকে অবহেলা করে? তিন্নি তো কষ্ট পেলেও জানাবে না ওঁনাদের! সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার, তিন্নি ছাড়া ওঁনার রোজের দিনগুলো কিভাবে কাটবে এবার? চোখের কোণ ভিজে এলো রঞ্জনবাবুর।
**************************__****************************
নির্মল নীল আকাশে পেঁজা পেঁজা তুলোর মতো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে, রেল লাইনের ধারে কাশফুলের সারি আর বাতাসে পুজো পুজো গন্ধ। সবে বিশ্বকর্মাপুজো শেষ হলো, আর সপ্তাহদুই পরই “মাঁ” আসছেন বাপের বাড়ি। তবে তাতে তিন্নির আর কি, ঝাঁচকচকে আই.টি কর্পোরেট অফিসের চাকরি দুর থেকে দেখতে যতই গ্ল্যামারাস লাগুক না কেন, ভেতর ভেতর তো ঠুনকো ফোঁপলা! মাত্র দুইদিন ছুটি! তার ওপর এবছরের ষষ্ঠী থেকে নবমী উইকডে। অন্যন্যবার পুজোর দিনক’টা ছুটি নিয়ে নেয় কিন্তু এবারের সব ছুটি তিন্নি বাঁচিয়ে রাখছে ডিসেম্বরের জন্য। শরতে অকালবোধনে পুরো বাংলা, সবাই মেতে উঠবে মাতুক না, তিন্নির কাছে অকালবোধন না হয় অভিমন্যু ফিরলে পৌষের ক্রিসমাসেই হলো?
তবে আজকাল তিন্নির কাজে খুব ভুলচুক হচ্ছে। এই তো গত পরশুই অনসাইট ক্লায়েন্টের সাথে মিটিং ছিল একটা, প্রেজেন্টেশনের দায়িত্ব ছিল তিন্নির ওপর। ভিডিও কনফারেন্সে কল চলছে, প্রজেক্ট ম্যানেজার, ক্লায়েন্ট ম্যানেজার বাঘা বাঘা লোকজনসব বসে, মাঝ প্রেজেন্টেশনে তিন্নি দেখে মাঝের তিনটে স্লাইড মিসিং! কি ভাগ্যিস, একটা ছোট্ট পেনড্রাইভে সব ব্যাকআপ ফোল্ডার রাখা থাকে তিন্নির কাছে! নিজের মনগড়া কিছু কথা বলতে বলতে চট করে পেনড্রাইভে থেকে কম্পিউটারে প্রেজেন্টেশনটা লোড করে নিয়েছিল তিন্নি! ভিডিওকলে মিটিং উৎরে গিয়েছিলো কিন্তু মিথিলেশ ঠিকই নজর করেছিল, পরে তিন্নিকে ডেকে একটু ঝাড়ও দিয়েছিলো যে আগে থেকে চেক না করে কেন মিটিংয়ে এসেছিলো তিন্নি। লজ্জায় মুখ খুলতে পারে নি তিন্নি, নিজের ওপর বড্ড রাগ হচ্ছিল ওর। এই প্রথম বোধহয় এমন কোনো ভুল হলো, সারাদিন কলকাতায় বসে সিকিমের কথা ভাবলে যা হয় আর কি! সায়কও পরে এসে বলেছিলো ওকে, সারাদিন ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকলে এমনি হয়। মজা করেই বলেছিলো হয়তো! তিন্নিও জবাব দিতে ছাড়ে নি অবশ্য, এই মিটিংটার দায়িত্ব ওদের দুজনের ওপরই ছিল, সায়ককে লাস্ট মোমেন্টে তিন্নি পাঠিয়েছিলো প্রেজেন্টেশনটা, ওরও তো দেখে নেওয়া উচিত! অবশ্য সায়কের এক্সকিউজও ফেলনা নয়। ও’ই বা কি করে জানবে তিন্নির ফাইলে ঠিক ক’টা স্লাইড থাকার কথা! তাই চুপ করে গিয়েছিলো তিন্নি, কথা বাড়ায় নি আর! মনে মনে নিজেকে চার পাঁচটা লাথি মেরে শাষিয়েছিলো তিন্নি – যে করেই হোক, মনকে লাগাম পড়িয়ে প্রফেশনাল আর পার্সোনাল জীবনের মধ্যে সীমারেখা টানতেই হবে এবার। সকাল নয়টা থেকে বিকেল সাড়ে ছয়টা অবধি আর একদম অভিমন্যুর কথা ভাববে না তিন্নি! কিন্তু মন কি শোনে মনের কথা? সে তো ফড়িং ডানা মেলে বারবার উড়ে যায় উত্তর সিকিমে, সেই মনের মানুষটির কাছে যার গাঢ় বাদামি চোখ তাড়িয়ে বেড়ায় তিন্নিকে – স্বপ্নে কি বাস্তবে।
অভিমন্যুর কথা মতো সায়ককে একটু এড়িয়েই চলছিল তিন্নি কিন্তু ঠিক এড়ানোও যাচ্ছিলো না। সত্যি বলতে এক অফিসে, এক প্রজেক্টে কাজ করে কতদিন কাউকে এড়ানো যায়? বিশেষ করে সায়ক ওর কাছে ক্ষমা চাওয়ার পর থেকে আবার আগের মতো স্বাভাবিকভাবেই কথা বলতে আসে তাইতেই তিন্নি আরো কেমন জানি একটা অপরাধবোধে ভুগছে। না শোনার থেকে “না” বলতে আরো বেশি মনের জোর লাগে। এটা তো অস্বীকার করা যায় না, পরিস্থিতির চাপে এক’একজন এক’একরকম রিআ্যক্ট করে! তিন্নি নিজে কি পারফেক্ট? মোটেও না! অভিমন্যু ওকে গ্যাংটকের হোটেলে পৌঁছে দেওয়ার পর তিন্নিও তো মেঘা, পিয়াসা, সবার ওপর রাগ করেছিল, রূঢ় ভাষায় কথা বলেছিলো। মাঝে মাঝে সন্দেহ জাগে অভিমন্যুও হয়তো একটু বেশিই পজেসিভ তিন্নিকে নিয়ে।
আর্মি অফিসার অভিমন্যু সেন আর পজেসিভনেস? তাও আবার তিন্নিকে নিয়ে?
কথাটা ভাবলেই পেট থেকে গুলগুলিয়ে হাসি বেরিয়ে আসে তিন্নির, আবার একটা শিশিরভেজা কুয়াশাচ্ছন্ন ভালোলাগাতেও মনটা ভরে যায়!মানুষটা কম কথা বলে, হয়তো মন খুলে সব ইমোশন প্রকাশ করে না কিন্তু ওর আপাত পাথরকঠিন বুকের ভেতর তিন্নির জন্য যে নরম ভালোবাসা আর প্রবল অধিকারবোধ লুকিয়ে আছে, সেটা খুব ভালো করেই টের পায় তিন্নি। অজানা ভালোবাসায় শিরশিরিয়ে ওঠে তখন বুকের ভেতরটা। তাই আর ব্যতিব্যস্ত করে তোলে না মানুষটাকে নিত্যনতুন চাহিদা নিয়ে। বহতাকালের সাথে তাল মিলিয়ে, সময়ের সাথে সাথে পরিণত এবং গভীর হয়ে উঠছে ওদের সম্পর্ক আর মানিয়ে নিচ্ছে তিন্নি – সম্পর্কে কম্প্রোমাইজ যদি করতেই হয়, তবে ও’ই করুক না হয়! সেই মানুষটার ওপর তো আরো গুরুদায়িত্ব রয়েছে, ১৩৩ কোটি দেশবাসীর মধ্যে একজন অতিসাধারণ আই.টি ইঞ্জিনিয়ার মিস সীমন্তিনী আচারিয়ার হঠাৎ হঠাৎ মনখারাপ সামলানোর থেকে মেজর অভিমন্যু সেনের চওড়া কাঁধে চাপানো দায়িত্ব যে আরো বেশি ইম্পরট্যান্ট।
একা একা ক্যাফেটেরিয়ায় লাঞ্চ করছিলো তিন্নি, কি করা উচিত, কি করা উচিত নয় এসব নিয়ে মনের মধ্যে কাটাছেঁড়া চলছিল ওর, সায়ক এসে বসলো ঠিক ওর পাশটিতে – “কি রে? তুই কি এখনো আমার ওপর রাগ করে আছিস?”
চমকে উঠে ধরা পরে যাওয়ার অস্বস্তির হাসি হাসলো তিন্নি — “খামোকা রাগ করবো কেন?”
—- এই যে, নিজে থেকে আমার সাথে কথাই বলিস না!
কি বলবে বুঝে উঠতে পারলো না তিন্নি। সায়ক ওর দিকে আরএকটু ঝুঁকে পড়ে গলা নামিয়ে বললো
— এক মাসের ওপর হয়ে গেছে তোর কাছে ক্ষমা চাইলাম! তারপরও আমার সাথে আর আগের মতো কথা বলছিস না, সবসময় ছাড়া ছাড়া ভাব !.. রাগ ছাড়া আর কি?
একদৃষ্টিতে সায়ক দেখে যাচ্ছিল তিন্নিকে – আজ ও পড়েছে একটা নেভিব্লু কুর্তি, চুলগুলো চুড়ো করে মাথার ওপর ক্লাচার গিয়ে আটকানো, এপাশ ওপাশ থেকে এক দুগাছা চুল আলগোছে মুখের আশেপাশে ছড়িয়ে। চাবুকসটান চেহারা, অলঙ্কার বলতে একহাতে ঘড়ি, ব্যস আর কিচ্ছু নেই। তাতেও যেন ঝলসে যাচ্ছিল সায়কের চোখ, স্থান-কাল-পাত্র ভুলে আঠার মতো এঁটে রইলো তিন্নির দিকে। সায়কের অদ্ভুত জ্বলজ্বলে দৃষ্টি কেমন যেন একটা অন্য সিগন্যাল পাঠাচ্ছিল তিন্নির মাথায়। কেন জানি মনে হচ্ছে সায়ক মুখে অন্য কথা বললেও ওর চোখ অন্য কথা বলছে। ভাবনাটা বেশি পাত্তা না দিয়ে তিন্নি চট করে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল — “নতুন ডেলিভারেবলগুলো দেখলি?”
— কাজ ছাড়া কি আমার সাথে আর অন্য কোনো ব্যাপারে কথা বলা যায় না?
—আর কি নিয়ে কথা বলবো অফিসে?
চুপ করে গেলো সায়ক, তারপর একটু ইতস্তত করে বললো — “সীমন্তিনী, আজ বিকেলে আমার সাথে কফি খেতে যাবি?”
মনের ভেতরে কে একজন সাবধান করে দিলো সাথে সাথে। অভিমন্যুকে বললে আবার রাগ করবে না তো? ভুরু কুঁচকে সটান দাঁড়িয়ে পড়লো তিন্নি — “হঠাৎ চা ছেড়ে কফি?”
— কিছু কথা বলার ছিল রে তোর সাথে, একটু সিক্রেটে, অফিসে বলতে চাই না। বেশি দূরে যেতে হবে না, আমাদের অফিসের দুটো বিল্ডিং পরেই সিসিডি, ওখানেই চল? বিকেল চারটে? মাই ট্রিট।
— কারণটা কি বল তো! কেমন একটা অন্যরকম… অডবিহেভ করছিস যেন??
ভাঙা ভাঙা গলায় সায়ক বললো — “এ অফিসটা আমি ছেড়ে দিচ্ছি রে, আজ পাতা ফেলে দিলাম। দুই মাসের নোটিশ পিরিয়ড।”
— সে কি? কেন???
এবার জেনুইনল্যি অবাক হলো তিন্নি।
— “এভাবে নয়! আজ বিকেলে কফি খেতে চল, সব বলবো। অফিসে সবার সামনে এসব ডিসকাস করা উচিত নয়।”
নিচু গলায় কথাক’টা বলে ক্যাফেটেরিয়া থেকে বেরিয়ে গেলো সায়ক, তিন্নিকে হ্যাঁ/না কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই।
দূরের দেওয়ালে ঝোলানো হলিডে ক্যালেন্ডারের দিকে চোখ পড়লো তিন্নির, সেপ্টেম্বরের প্রায় শেষ এখন। আর সপ্তাহদুই পরেই পুজো। হঠাৎ করে চাকরি ছাড়ছে কেন সায়ক? ও ই তো একসময় তিন্নিকে বারণ করেছিল এই অফিসের চাকরিটা ছাড়তে। মনের চোরাগোপনের অস্বস্তিটা সারা শরীরে ছড়িয়ে গেল তিন্নির, আজকাল সায়ক কেমন যেন একটু “অন্যরকম ভাবে” তাকিয়ে থাকে না ওর দিকে?
ধুর!
অভিমন্যুর কথা শুনে ওর’ও মাথা খারাপ হয়ে গেছে! বিকেলে কথা বললেই তো সবটা ক্লিয়ার হবে।
আনমনা হয়ে নেভিব্লু আনারকলি কুর্তির হিল্লোল তুলে ক্যাফেটেরিয়া থেকে ওডিসির দিকে পা বাড়ালো তিন্নি। ইতিউতি মুগ্ধচোখে চেয়ে থাকা আরো দুইতিনজন সহকর্মীর বুক থেকে ঠিকরে বেরিয়ে এলো চাপা দীর্ঘশ্বাস, সীমন্তিনী আচারিয়া ওই দুদিনের ফচকে ছোকরা সায়কের সাথেও কথা বলে কিন্তু ওদের সাথে বলে না? কি আছে সায়কের মধ্যে যা ওদের মধ্যে নেই?
**************************__****************************
বিকেল চারটে বেজেছে। দুপুরের ভাতঘুম জড়ানো কলকাতা শহর একটু একটু করে আড়মোড়া ভাঙছে, সেক্টরফাইভের সিসিডির ঠান্ডাঘরে ম ম করছে রোস্টেড কফি আর চকোলেট সসের অনুপম সুবাস, তিন্নির সবচেয়ে প্রিয় দুইটি জিনিসের কম্বিনেশন। ছড়ানো ছেটানো বেতের চেয়ারে দুই তিনজন কাপল বা বন্ধুর দল , অফিস কেটে পুজোর প্ল্যানিং করতে এসেছে বোধহয়। নিজের জন্য একটা ক্যাপুচিনো আর তিন্নির জন্য একটা এক্সট্রা ডার্ক চকলেট “ডেভিল’স অন” অর্ডার করে বেতের সোফায় শরীর এলিয়ে দিলো সায়ক। মিনিট কয়েকের মধ্যেই অর্ডার এসে গেলো টেবিলে, মুখোমুখি বসে তিন্নি ওর দিকে ভুরু উঁচিয়ে তাকিয়ে সায়ক কি বলবে শোনার জন্য।
বেশ কিছুক্ষন সময় কেটে যাওয়ার পর গলা খাঁকড়ি দিলো সায়ক — “আজ কিন্তু তোকে ফাটাফাটি লাগছে দেখতে! নীল রঙে দারুন মানায় যাই বলিস!”
সায়কের এই পুরোনো স্বভাব, মসকা চড়ানোগুলোতে তিন্নি খুব পরিচিত, পাত্তা না দিয়ে শুকনো গলায় বললো — “হঠাৎ করে পাতা ফেললি কেন? কোথায় জয়েন করছিস? কলকাতা না বাইরে?”
একটা প্রশ্নেরও উত্তর দিলো না সায়ক। একদৃষ্টিতে তিন্নিকে দেখতে দেখতে বললো — “তুই কিন্তু এ কয়েকমাসে অনেকটা বদলে গেছিস!”
অবাক চোখে তাকালো তিন্নি — “হুহ্? কি বদলে গেলাম?”
“দেখতে আগের চেয়ে সুন্দরী হয়েছিস, চেহারায় চটক এসেছে, কনফিডেন্স লেভেল হাজারগুণ বেড়ে গেছে, আরো আ্যট্রাকটিভ হয়েছিস”~ কথাগুলো জিভের আগায় চলে এলেও নিজেকে আটকালো সায়ক। মুখে বললো
— না…. মানে আগে তুই কেমন চুপচাপ থাকতিস, দুঃখী দুঃখী ভাব। এখন সবসময় বেশ হাসিখুশি, সেজেগুজে অফিস আসিস, শার্প উত্তর দিস! আগে তো ফোন ছুঁয়েও দেখতিস না, এখন বোধহয় তোর হাতের সাথে আঠা দিয়ে আটকানো!
হেসে ফেললো তিন্নি — “ভালো! তোর কি আর কোনো কাজ নেই যে সবসময় আমি কি করছি দেখে যাচ্ছিস?”
—- আমি একা নয়, সবাই নোটিস করছে, এই তো সেদিন প্রবালদা’ই বলছিল যে …..
হাত তুলে থামিয়ে দিলো তিন্নি, আর ভালো লাগে না ওর, সবসময় এ কি বলেছে সে কি বলেছে শুনতে! –“যেজন্য এখানে ডাকলি, সেটা বল এবার। কি এমন কথা যে অফিসের ক্যাফেটেরিয়ায় বলা যাবে না?”
দমে গেল সায়ক। প্রশংসা করলেও খুশি হয় না এমন মেয়েকে আর কি বলে নরম করা যায়! চুপ করে মনেমনে পরপর কথাগুলো সাজিয়ে নিচ্ছিলো আর তিন্নি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলো সিসিডির ইন্টেরিয়র, মনে মনে ভাবছিলো, অভিমন্যু কলকাতায় ফিরলে এইরকম একটা জায়গা খুঁজে কফিডেটে গেলে কেমন হয়? আচ্ছা, অভিমন্যু কি কফি পছন্দ করে? আজই জিজ্ঞেস করতে হবে তো!মনেমনে ডিসেম্বরে শীতের ওম মাখা মিষ্টি মিষ্টি কফিডেটের দিবাস্বপ্ন দেখতে দেখতে আনমনা তিন্নি ধীরেসুস্থে টলগ্লাসের হুইপক্রিমটা সরিয়ে শীতল ক্যাফিনে সবে একটা চুমুক দিতে যাচ্ছিলো, সায়কের প্রশ্নটায় বিষম খেলো আচমকা।
— তোর বয়ফ্রেন্ড আছে?
মন না আয়না? আজকাল কি সবাই ওর মনের কথা পড়ে ফেলছে নাকি? সায়ক ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে দেখে নিজেকে সামলে নিলো তিন্নি। হাতের গ্লাসটা সামনের কাঁচের নামিয়ে রেখে বললো – “হঠাৎ এ কথা?”
চোখের দৃষ্টিটা কেমন যেন বদলে গেল সায়কের। জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁটটা চেটে নিয়ে বললো – “তোকে একটা কথা বলার ছিল সীমন্তিনী।“
এক ঝটকায় মিষ্টি মিষ্টি প্রেমপ্রেমভাব উবে গিয়ে সতর্ক হয়ে উঠলো মন, চারমাসের পুরোনো ফ্লাশব্যাকগুলো ফিরে এলো হঠাৎ। সায়কের চোখের এই দৃষ্টি, গলার স্বর তিন্নির খুব পরিচিত। দমকলের লালঘন্টি তখন ঘন ঘন বেজে ওর মাথায় আবার যেন বিপদসঙ্কেত পাঠাচ্ছে, সিকিমের হোটেলের ঠিক সেই দিনটার মতো। মনেমনে অলরেডি নিজেকে গালি দিচ্ছিলো তিন্নি, ইডিয়টের মতো কি মরতে সায়কের কথায় এখানে আসতে রাজি হলো ও! তবে আর যাই হোক, এটা তো আর সিকিমের বন্ধ হোটেলরুম নয়, পাবলিক প্লেস! এখানে নিশ্চয়ই সায়ক সিন্ ক্রিয়েট করতে সাহস পাবে না! সেই ভরসাতেই মনের ভাব মুখে প্রকাশ না করে তিন্নি গলা শক্ত রেখে বললো – “বল! আই আ্যম অল ইয়ারস।“
— ঠিক বুঝতে পারছি না কি করে বলবো!
স্পষ্টতই বিরক্তি ফুটে উঠলো এবার তিন্নির মুখে — “মুখ দিয়ে বলবি, আবার কি?”
কিছুক্ষন সব চুপচাপ, সায়ক যেন মুখ তুলতেই পারছে না! তারপর ঠান্ডা হয়ে আসা ক্যাপুচিনোর কাপে চোখ আটকে রেখে তিনটে শব্দ তারপর ছিটকে এলো সায়কের মুখ দিয়ে
—- আমি তোকে লাইক করি, মানে ভালোবাসি।
হাঁ হয়ে তাকিয়ে রইলো তিন্নি, নিজের ওপর রাগে আর উত্তেজনায় কানের ডগা লাল হয়ে উঠলো ওর। সায়ককে কি রেসপন্স করবে তিন্নি, তারও আগে ওর মাথায় ঘুরছিলো একবারও সায়ককে না দেখে, শুধুমাত্র তিন্নির মুখের কথা শুনেই “অভিমন্যু” কি করে সায়কের দুর্বলতা জেনে গেলো, তাও আবার অতদিন আগেই? প্রথম চমকটা সামলে নিয়ে সায়কের চোখের দিকে সরাসরি তাকালো তিন্নি — “পাগলামো করিস না সায়ক। তোর মাথার ঠিক আছে? কি যা তা বলছিস তুই?”
— পাগলামো নয় সীমন্তিনী, আমি সত্যি তোকে ভালোবাসি! অনেক দিন ধরে…… বলবো বলবো করেও বলে উঠতে পারি নি, ভেবেছিলাম তুইও জানিস।
তিন্নির কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো এবার, তেতে উঠে বললো — “আমি? আমি কি করে জানবো সায়ক? তুই শুধুই আমার কলীগ……”
— শুধুই কলীগ?
চোয়াল শক্ত হয়ে গলা চড়ালো সায়ক – “সারা অফিসে একমাত্র আমার সাথেই তুই হেসে হেসে কথা বলিস না? একমাত্র “আমার” সাথেই নিচের ফুটে চা খেতে নামিস, আমার কথায় ঘুরতে এলি সিকিম, আমাকে লিফটে জীবনানন্দের কবিতা শুনিয়েছিলিস…. তোর মনে পরে না, সীমন্তিনী?”
শেষের দিকে সায়কের গলাটা কেমন যেন হাহাকারের মতো শোনালো। হততম্বের মতো চেয়ে রইলো তিন্নি, কি থেকে কোথায় চলে গেছে সায়ক!
ব্যাপারটা হাতের বাইরে বেরোনোর আগে, সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বললো
– “সায়ক, তুই কিন্তু ভুল ভাবছিস!”
— কিসের ভুল? কোনটা ভুল? এতদিন ধরে লিডঅন করিস নি তুই আমাকে? টানা দুইবছর তোকে লাইন মেরে গেলাম আর তুই “বুঝতে পারিস নি”? ওদিকে যেই আর্মির ওই হাঙ্কিপাঙ্কি লোকটাকে দেখলি অমনি একঘন্টার আলাপে ওর প্রেমে গলে গেলি? ওর সাথে যদি তোর ট্রেনে দেখা না হতো, তাহলে তো আজ আমার প্রেমেই হাবুডুবু খেতিস! ভুল বলছি কিছু?
—- সায়ক!!
ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো তিন্নির, চেঁচিয়ে উঠলো প্রায় — “এবার কিন্তু বড্ড বাড়াবাড়ি করছিস তুই!”
আশেপাশের লোকজন ওদের দিকে ঘুরে তাকাচ্ছে দেখে গলা নামিয়ে নিলো তিন্নি। নিচু অথচ স্পষ্ট গলায় বললো — “একটা কথা শুনে রাখ, আমি কোনোদিন তোর প্রেমে হাবুডুব খাই নি, ভবিষ্যতেও খেতাম না। হ্যাঁ, এই প্রজেক্টে তোর সাথে আমি হেসে কথা বলেছি কারণ বাকিরা কেউ “তোর মতো” দিনের পর দিন আমার সাথে কথা বলতে আসে নি, তোর মতো প্রতিদিন আমাকে “চা খেতে যাওয়ার” জন্য সাধাসাধি করে নি। নর্থবেঙ্গল ট্রিপটাও তুই টানা তিনমাস ধরে আমাকে সেধে গিয়েছিলি সায়ক! আমারও তো একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে হয় মাঝে মাঝে – সেটা ভুল? আর কবিতা? কবিতা আমার প্রাণ! আমার দুঃখ হলে কবিতা বলি, আনন্দ হলে কবিতা বলি, আবেগে কবিতা বলি! You happened to be in that place on that day! তোর বদলে অন্য কেউ সেদিন লিফটে থাকলে সেও কবিতা শুনতো সায়ক।“
অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলো সায়ক. অনেকপরে গলায় শব্দ খুঁজে পেলো — “তুই আমার সাথে আর সবার তুলনা করতে পারলি?”
তিন্নি চুপ করে রইলো। সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায় না,তা সে যতই সত্যি হোক না কেন। যে সত্যি অন্যকে নির্মম আঘাত করে, সেই সত্যিকে মৌনতায় বদলে নিলো তিন্নি। কিন্তু ওর ঠান্ডা চোখের দিকে তাকিয়ে সায়ক উত্তর পেয়ে গেল, কাতর গলায় বলে উঠলো — “একবার বল না সীমন্তিনী, তুই এসব মিথ্যা কথা বলছিস!”
তিন্নির মনটা ভরে যাচ্ছিলো অনেকটা খারাপলাগায়, কিন্তু কিভাবে সায়ককে বোঝাবে ও, তিন্নির দিক থেকে সায়ক ছিল শুধুই বন্ধু, তার একটুও বেশি না? নরম গলায় বললো — “কেন মিথ্যে বলবো সায়ক?”
দুজনের মাঝে বেতের মোড়া সরু কাঁচের টেবিল। লম্বা হাত বাড়িয়ে তিন্নির ডানহাতটা জোর করে সায়ক নিজের হাতে জড়িয়ে নিতে, এক মুহূর্তে শিউরে উঠলো তিন্নি! এ কি করছে সায়ক, এতো লোকজনের সামনে? সায়কের সেদিকে খেয়াল নেই, সব হারানোর গলায় বলে উঠলো —“তাহলে…… তাহলে আমার কি হবে? আমি যে তোকে ভালোবাসি?“
— কিন্তু আমি তো তোকে ভালোবাসি না!
সায়কের ঘামে ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে হাত আরো জোরে এবার চেপে ধরলো তিন্নিকে, শক্ত আঙুলে ওর নরম চামড়া কেটে বসে যাচ্ছে যেন, কটকট করে বাজছে হাড়গুলো। হিংস্রভাবে মুখচোখ কুঁচকে সায়ক বলে উঠলো — “তবে এতদিন ধরে আমায় নাচালি কেন?”
বারুদের স্তুপে জ্বলন্ত দেশলাই কাঠি পড়লো এবার। বিদ্যুত্স্পৃষ্টের মতো ছিটকে উঠে নিজের সবটুকু শক্তি দিয়ে সায়কের হাতটা ছাড়িয়ে নিলো তিন্নি। মাথার মধ্যে দপদপ্ করে জ্বলে ওঠে বারুদটা একটু শান্ত হলে স্থির চোখে তাকিয়ে বললো
— “ মাইন্ড ইওয়োর ল্যাঙ্গুয়েজ সায়ক, লিমিট ক্রস করিস না। আই আ্যম সরি…. কথাটা বলতে আমার খারাপ লাগছে, শুনতে তোর আরো খারাপ লাগবে! বাট ট্রুথ ইজ, আমার জীবনে তুই “স্পেশাল” কেউ নোস, তুই শুধুই আমার কলীগ! আগে বন্ধু ছিলিস, কিন্তু এখন…. শুধুই “কলীগ”। আই আ্যম সরি, যদি তোর মনে হয় এতদিন তোকে “নাচিয়েছি” বা, লিডঅন করেছি! বিশ্বাস কর, সেগুলো জেনেবুঝে করিনি। তোর বলা হাজারটা কথার মধ্যে আমি হয়তো দশটি কথায় “হ্যাঁ” বলেছি! সেটা যদি তোকে নাচানো হয়, আমি জানি না আর কি করা উচিত ছিল। আমার জীবনে একজনই আছে, অভিমন্যু।“
বাহ্! অসাধারণ!
মুখ ফস্কে অভিমন্যুর নাম বেরিয়ে যেতেই মনে মনে নিজেকে একটা চড় মেরে ঠোঁটে অদৃশ্য সেলোটেপ লাগিয়ে নিলো তিন্নি!
সায়কের চোখ ছোট হয়ে এলো — “মানে, ওই লোকটার সাথে তোর এখনো কন্টাক্ট আছে?”
নিজের জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিনয় করার ব্যর্থ প্রয়াস করলো তিন্নি — না!
— মিথ্যে বলিস না সীমন্তিনী, আমাকে লোকাতে পারবি না তুই।
কখনো কখনো নম্রতা, ভদ্রতার সীমারেখা টানাটা খুব জরুরি। কফির দামটা মনেমনে হিসেবে করে পার্স থেকে টাকা’কটা বার করে টেবিলের ওপর রেখে সটান উঠে দাঁড়ালো তিন্নি, যেন মেজর অভিমন্যু সেনের কঠিন হিমশীতল গলা প্রতিফলিত হলো ওর স্বরে – “শেষবারের মতো সাবধান করছি সায়ক, আমার পার্সোনাল ব্যাপারে নাক গলাস না। নিজের চরকায় তেল দে।“
বিকেলের কমলা আলোয় নেভিব্লু আনারকলি কুর্তির অতুলন হিল্লোল তুলে সেক্টর ফাইভের সিসিডির স্বয়ংচালিত দরজা দিয়ে দৃপ্ত পায়ে বেরিয়ে গেল তিন্নি। ভাঙাচোরা মুখ নিয়ে সায়ক বসে রইলো পিছনে। ঠান্ডা হয়ে আসা না ছোঁওয়া ক্যাপুচিনো কাপ আর একটু একটু করে ঘরের তাপমাত্রায় ফিরে আসা কোল্ডকফির গ্লাস পড়ে রইলো কফিটেবিলে, পাশাপাশি থেকেও যেন ওরা হাজার আলোকবর্ষ দুরে।
——————————————————-
***********************__******************************
সকল পর্বের লিঙ্ক~
Video Teaser
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145475543838322/?vh=e&d=n
Part 1
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145129087206301/?d=n
Part 2
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145859077133302/?d=n
Part 3
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/146221053763771/?d=n
Part 4
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/146595433726333/?d=n
Part 5
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/147293876989822/?d=n
Part 6
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148075966911613/?d=n
Part 7
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148530310199512/?d=n
Part 8
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148951006824109/?d=n
Part 9
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/149405760111967/?d=n
Part 10
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/150313546687855/?d=n
Part 11
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/151106323275244/?d=n
Part 12
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/151923336526876/?d=n
Part 13
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/152353663150510/?d=n
Part 14
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/154065792979297/?d=n
Part 15
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/156163186102891/?d=n
Part 16
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/157132182672658/?extid=QdVQFGSjLzQUsE31&d=n
Part 17
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/157444422641434/?extid=fI3jIc0PCiYXDa0N&d=n
Part 18
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/158095955909614/?extid=1E2JOZfMCmqscBoi&d=n
Part 19
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/158831902502686/?extid=R8zo6L2l274CIQ7r&d=n
Part 20
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/159626782423198/?extid=0e8jrLLhsuLqgsQX&d=n
Part 21
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/160047349047808/?extid=e9DIdFXAkqxTg77U&d=n
Part 22
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/160963752289501/?extid=EgYDh0z3hVr5TCBY&d=n
Part 23
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/161833698869173/?extid=gRK0HHMoLW0bu0gK&d=n
Part 24
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/162740122111864/?extid=KIR9o3zetBHgH9mt&d=n
Part 25
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/163061178746425/?extid=fhzBxEjnlA7n6Ulu&d=n
Part 26
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/163695728682970/?extid=tm0Y81ykORQhpsq9&d=n
Part 27
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/164305438621999/?extid=WsYE2BjXkYvPmqyF&d=n