সূর্য ডোবার আগে পর্ব-২৩

0
1955

#সূর্য_ডোবার_আগে
পর্ব-২৩
লেখিকা ~ #সুমন্দ্রামিত্র
কঠোরভাবে প্রাপ্তমনষ্কদের জন্য।
.
.
.

হলদে সাদা ফ্লুরোসেন্ট লাইট, তিনটি দেওয়াল ঢাকা মানুষপ্রমাণ আয়না- সল্টলেক সেক্টরফাইভের ফোরটীন ফ্লোরের ঝাঁ চকচকে অত্যাধুনিক ওয়াশরুমে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে দেখতে রাগে, অপমানে থরথর করে শরীর কাঁপছে তিন্নির। মুখ চোখ টকটকে লাল। মিথিলেশ আজ বিকেলের মিটিংয়ে সবার সামনে যেভাবে ইনসাল্ট করেছে ওকে, এমনকি ওর প্রফেশন্যালিজম নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে সেইটা মনে করেই আরো উত্তেজিত হয়ে গেছে তিন্নি। কোনরকমে মিটিংয়ের শেষমিনিট অবধি পাথরের মতো মুখ নিয়ে ইমোশনগুলো লুকিয়েছিলো, এখন ওয়াশরুমে ছুটে এসে দরজা বন্ধ করে ভেঙে পড়লো প্রায়। খুঁজেপেতে কমপ্লেক্স প্রোগ্রাম ডিবাগিং আর নির্ভুল, নিখুঁত কোডিং করা সীমন্তিনী আচারিয়ার প্যাশন। আজ, সায়কের জন্য ওর সেই দক্ষতা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। তিন্নির পাঠানো ক্লায়েন্ট সাবমিটেড কপিতে পেজের পর পেজ কোড ডিলিট, ফাংশনাল রিকেয়্যারমেন্টে স্পেলিং মিসটেক আর রং স্ট্যাটিস্টিক্সের ছড়াছড়ি। ব্যাকআপ ফাইল অবশ্যই আছে তিন্নির কাছে, ভুল ফাইল সেন্ড হয়ে গেছে বলে আ্যপলোজি মেলও পাঠানো যায়, কিন্তু সেগুলো এস্কালেশন আসার পরের স্টেপ বাই স্টেপ প্রসেস, ক্লায়েটের কাছে ক্রুটিবিচ্যুতিপূর্ণ ডেটা পাঠানোর এক্সকিউজ নয়। সায়ক আর তিন্নির মিলিত প্রজেক্ট, আর টিমমিটিংয়ে সবার সামনে শুধু তিন্নিকেই যাচ্ছেতাইভাবে ঝেড়েছে মিথিলেশ। এতদিনের সহকর্মীদের মুখে ফুটে উঠেছিল তখন বিদ্রুপের বাঁকা হাসি! সবাই জানে কেন হয়েছে, কি হয়েছে কিন্তু কেউ মুখ খুলবে না, তিন্নির কাছেও কোনো কংক্রিটপ্রুফ নেই। হাতেনাতে ধরা বা লিখিত প্রমান ছাড়া কমপ্লেন করতে পারবে না তিন্নি, সেটা “Hearsay’s” কেস।

বেসিন থেকে অঝোরধারায় পড়ে যাওয়া হাতজমানো ঠান্ডা জলের ঝাপটা দিল তিন্নি মুখেচোখে, হৃৎপিন্ডের গতিবেগ একটু শান্ত হলো যেন। খুব ইচ্ছে করছিল এতো অপমানের মুখোমুখি জবাব দেয়, এক্ষুনি গিয়ে রেজিগনেশন দিয়ে দেয় কিন্তু পরক্ষনেই মনে হয় এত তুচ্ছ কারণে, এত সহজে অন্যায়ের কাছে হেরে যাবে ও? তিন্নি রেজিগনেশন দিলে তো সায়কেরই জিত! সেদিনের সিসিডির সেই ঘটনাটা ঘটার পর যথারীতি সায়ক আবারও ক্ষমা চেয়েছিল তিন্নির কাছে কিন্তু এবারে আর ভুল করে নি তিন্নি। নিলিপ্ততা আর উদাসীনতার কঠোর মোড়কে নিজেকে আবৃত করে নিয়েছে যে বর্ম ভাঙার সাধ্য সায়কের নেই। ব্যর্থ হয়ে এবার অন্য পথ ধরেছে সায়ক, বিভিন্ন ছলচাতুরিতে তিন্নিকে অপদস্ত করার। যেহেতু নিজে নোটিস পিরিয়ডে আছে তাই গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, অন্যদিকে সায়কের থেকে প্রজেক্টের কোনো ম্যাসিভ এক্সপেক্টেশনও নেই। নতুন লোক হায়ার না হওয়া অবধি তিন্নিকেই সায়কের কাজগুলোও সামলাতে হচ্ছে, তার সাথে জুটেছে এইসব অনর্থক বদমায়েসি আর ফিচেল পিছনেলাগা।

ভাবতে ভাবতেই আবারো উত্তেজিত হয়ে পড়লো তিন্নি। কারো একজনের সাথে কথা বলতে পারলে, মনের উষ্মা শেয়ার করতে পারলে হয়তো খুব ভালো হতো, কিন্তু কার সাথে কথা বলবে তিন্নি? অবধারিতভাবে অভিমন্যুর নামই প্রথমে মনে আসে কিন্তু তাকে তো এখন পাওয়া যাবে না! ওদের সম্পর্কের প্রথম শর্তই হলো, তিন্নি কোনোদিন নিজে থেকে ফোন করবে না লাইফ আ্যন্ড ডেথ সিচ্যুয়েশন না হলে। সেখানে ছুটকো অফিস পলিটিক্স নিয়ে কি বলবে, কি বোঝাবে তিন্নি অভিমন্যুকে? সে তো বুঝবেও না, উল্টে নিস্ফল রাগে অগ্নিমূর্তি হয়ে উঠবে।

না।
সায়কের প্রোপোজাল নিয়ে আজও অভিমন্যুকে কিছু জানায় নি তিন্নি। কিছু কিছু এমন কথা থাকে যা ফোনে বলা যায় না, বোঝানো যায় না। উল্টে সম্পর্কে নিয়ে আসে আরো জটিলতা, আননেসেসারি কমপ্লিকেশন। কিছু কিছু কথা গোপন রাখাই ভালো। ওরা নিজেরাই তো সবে চিনছে একে অপরকে। যত দিন যাচ্ছে তত গভীর আর পরিণত হচ্ছে তিন্নি আর অভিমন্যুর সম্পর্ক, পরিণত হচ্ছে তিন্নিও। কিশোরী চপলতা ভুলে যেন “নারী”তে রূপান্তরিত হচ্ছে ধীরে ধীরে। আগের মতো ঠুনকো অভিমান, ইগোর বদলে বুঝতে শিখছে, পড়তে শিখছে মানুষটাকে। চোরাগোপ্তা ভালেবাসার টানাপোড়েন এখন প্রকাশিত, উন্মুক্ত….. আগের থেকে আরো সাবলীল, সহজবোধ্য এবং সুস্পষ্ট। ক্রমশ মর্মার্থ করেছে অভিমন্যুর সাথে তিন্নির সম্পর্কের যে পরিসর তাতে ওয়ার্কলাইফ পলিটিক্স নিয়ে জলঘোলা করা আসলে অর্থহীন, ঠিক যেমন অভিমন্যুর জব প্রোফাইল তিন্নির পক্ষে বোঝার অসাধ্য।

বাবার শেখানো শান্তিমন্ত্রটা আজ অনেকদিন পর চোখ বুজিয়ে মনে মনে উচ্চারণ করতে লাগলো তিন্নি, ধীরে ধীরে উত্তেজনা প্রশমিত হয়ে এলো, হৃৎপিণ্ডের গতিবেগ একটু কমলো বোধহয়, তারপর সটান সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ভেঙে পড়ার সময় নয় এটা। এ অফিসে বন্ধু বলে কেউ নেই ওর! শেষ অবধি যদি এ চাকরি ছাড়তেই হয়, তবে সবার মুখোশগুলো টেনে ছিঁড়ে দেয়েই যাবে তিন্নি। ওয়াশরুমের মানুষপ্রমাণ আয়নায় একদৃষ্টিতে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়েছিল তিন্নি, আচমকা একটা উচ্ছসিত গলার আওয়াজে চটকা ভাঙলো ওর।
—- ওহ্ মাই গড। সীমন্তিনী? লং টাইম নো সি! কেমন আছো?

লেডিস ওয়াসরুমে তিন্নিকে জড়িয়ে ধরলো পিয়াসা। তারপরই ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললো — “হেই। তুমি ঠিক আছো? ওয়্যার ইউ ক্রায়িং?”

**************************__****************************

ক্যাফেটেরিয়ায় দুইকাপ চা নিয়ে মুখোমুখি বসে পিয়াসা আর তিন্নি। স্বচ্ছ জানলার কাঁচে ওদের ছায়া পড়েছে, বাইরের আকাশ ততক্ষনে হালকা গোলাপি রং মাখা, একটু পরেই রাতের অন্ধকারে ডুবে যাবে, জেগে উঠবে কল্লোলিনী তিলোত্তমা। বলতে গেলে একরকম জোর করেই পিয়াসা টেনে এনেছে তিন্নিকে, এই ক্যাফেটেরিয়ায়, চায়ের অর্ডার দিয়েছে। রিজন দিয়েছে – “If a tea cannot fix it, then it’s a serious problem! তাছাড়া আমাদের সেই স্টুপিড ট্রিপটার পর তো তোমার সাথে কোন কথাই হয় নি! লেটস ক্যাচআপ গার্ল।”

তারপর পিয়াসা নিজেই বকবক করে গেছে, মাঝে মাঝে ওর সতর্কদৃষ্টি বুলিয়ে গেছে তিন্নির মুখের ওপর কিন্তু আরএকবারের জন্যও জিজ্ঞেস করেনি “হোয়াটস্ রং, তুমি কাঁদছিলে কেন।”

পিয়াসা কিছু জিজ্ঞেস না করায় স্বস্তি পেয়েছে তিন্নিও। পিয়াসার অর্থশূন্য, অকাজের কথা শুনতে শুনতে একটুর জন্য হলেও মন কখন ডাইভার্ট হয়ে গিয়েছে, আজকের কার্বনমনোক্সাইডে ভরা টক্সিক দিনটায় পিয়াসা যেন একমুঠো তাজা অক্সিজেন। কখনো কখনো বোধহয় আলবাল স্টুপিড গল্পও মনকে এমন হালকা করে দেয় যে ক্ষনিকের পাহাড়প্রমান ঝামেলা যন্ত্রণাগুলোও নুড়ির সমান হয়ে যায়। ঘন্টাখানেক এভাবেই হ্যাজানোর পর পিয়াসার বাক্যস্রোত থামলো যখন তিন্নির মুখে জেন্যুইন আন্তরিকতার হাসি। একগাল হেসে অদৃশ্য কলার তোলার ভঙ্গি করলো পিয়াসা — “ইটস গুড টু সী ইউ স্মাইলিং! কেমন জাদু করলাম দেখলে।”

তিন্নি নিজেও বুঝেছে পিয়াসার ওকে ক্যাফেটেরিয়ায় টেনে আনার মুল উদ্দেশ্য ছিল, ওর মুড ঠিক করা। এক প্রজেক্টে ওরা কখনো কাজ করেনি, গ্যাংটকের ট্যুরেই ওদের প্রথম আর শেষ দেখা, তাও কোনো স্বার্থ ছাড়াই পিয়াসা যেভাবে আজ বিকেলে তিন্নির মুড ঠিক করার ঠেকা নিয়েছিল এটা ভেবেই অস্বচ্ছন্দতার হাসি হাসলো তিন্নি। খারাপ লাগছিল এই ভেবে ট্রিপের শেষদিনে কেমন রুড ব্যবহার করেছিল ওদের সবার সাথে। মুখ তুলে বললো — “থ্যাঙ্ক য়ু ফর টুডে…. আই রীয়েলী নিডেড ইট। আর তারসাথেই বলি, সরি ফর মাই রুড বিভেভিয়ার….”

—- কি বলছো? তুমি আর রুড?
হেসে উঠলো পিয়াসা!

তিন্নি হাসলো না, আগের কথার রেশ টেনেই বললো —- “গ্যাংটক থেকে ফেরার দিন, ট্রেনে…”

—- হেই, ইটস ও.কে। তোমার জায়গায় আমি থাকলে আরো হল্লা মাচাতাম! তুমি বলে তাও ওই সায়ক বলে ছেলেটাকে সহ্য করছিলে, আমার সাথে কেউ ওই ল্যাঙ্গুয়েজে কথা বললে সিধা থাপ্পড় মেরে দিতাম। আই ডোন্ট ইভেন নো হাউ ইউ টলারেটেড হিম।

চুপ করে রইলো তিন্নি। স্বল্পপরিচিত পিয়াসাকে তো আর এটা বলা যায় না এরপরও সায়ক কিভাবে ওর পেছনে লেগেছে। পিয়াসা কিছুক্ষন চুপ করে রইলো তারপর বললো — “সীমন্তিনী, জানি না এটা তোমাকে বলা আমার উচিত হচ্ছে কিনা বাট একটা আ্যডভাইস দিচ্ছি। এই কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডে হলো সাপলুডো খেলা, এখানে কেউ কারো বন্ধু নয়। গ্রো ইওয়োর নেটওয়ার্ক কিন্তু কাউকে ব্লাইন্ডল্যি বিশ্বাস করো না ….. তাতে ঠকতেও হবে না। গুড লিসেনার্স হওয়া অবশ্যই ভালো তারই সাথে মাঝে মাঝে নিজের কথাটা শোনানোরও দরকার কিন্তু।”

ম্লান হাসলো তিন্নি। পিয়াসার কথাটা কতোবড়ো সত্যি, আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে ও। চুপ করে থাকে বলেই এতবড়ো টিমের একজনও আজ তিন্নির সাথে দাঁড়িয়ে নেই। হাতঘড়িতে সময় দেখে চটকা ভাঙলো ওর — “আজ উঠি পিয়াসা, বাড়ি ফিরতে হবে। এগেইন, থ্যাঙ্ক য়ু ফর টুডে। তুমি জানো না, হাউ ব্যাডলি আই নিডেড টু টক টু সামওয়ান!”

ঝকঝকে হাসি হাসলো পিয়াসা — “লাইফ ইজ ফুল অফ অপশনস ডিয়ার… নেক্সট টাইম এমনি লো ফীল করলে অফিস কমিউনিকেটরে আমায় পিং করো, উই মাইট হ্যাংআউট এগেইন।”

ভিতরে ভিতরে একটু মজা পেলো তিন্নি, ভুরু উঁচিয়ে তাকালো — “মাইট? মানে ডাকলেই আসবে না, তাই তো?”

গলা ফাটিয়ে হেসে উঠলো পিয়াসা, তারপর বললো — “ডিপেন্ড করছে, আমরা আদৌ ফ্রেন্ড হতে পারি কিনা তার ওপর!”

হেসে ফেললো তিন্নি। এমন স্পষ্ট করে সত্যি বলতে আর কাউকে দেখে নি ও….. অভিমন্যু ছাড়া। তারপরেই রিয়েলাইজ করলো, পিয়াসার সাথে কথা বলতে বলতে সাড়ে তিনমাসে এই প্রথমবার অফিসে থেকেও গত আধা-একঘন্টায় একবারের জন্যও অভিমন্যুকে মিস করে নি তিন্নি। সেটাতে কি মনখারাপ হওয়া উচিত নাকি মন ভালো, ঠিক বুঝতে পারলো না তিন্নি।

**************************__****************************

~ ঢ্যাং কুড়াকুর, ঢ্যাং কুড়াকুর বাদ্যি বেজেছে।

রোববারের সকাল। ঋতু পরিবর্তনের সূচিপত্র মেনে শরৎ এসে গেছে। কাশফুলের সাদা চাদরে ঢেকে শ্রীরামপুরের মাঠঘাট -রেললাইন, নীলকান্তমণি আকাশ আর পেঁজাধুনো তুলো তুলো মেঘ, পুকুরে পুকুরে শালুক, পদ্ম জানান দিচ্ছে মা চলে গেছেন বাপের বাড়ি ছেড়ে। মিষ্টি রোদে ঝকঝকে করছে চারিদিক। দূর্গাপুজো শেষ হয়েছে সবে, পরশু কোজাগরী পূর্ণিমা! দূরে কোথাও মাইকে এখনো পুজোর গান বাজছে। শ্রান্ত শরীরে বিছানা ছেড়ে উঠলো তিন্নি, জানলাদুটো খুলে দিতেই একরাশ শিউলি ফুলের আবছা গন্ধ হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরলো তিন্নিকে, বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠলো ওর। কত অমিল না বাইরের প্রকৃতি আর তিন্নির মনের ভেতরে চলে যাওয়া কুজ্ঝটিকার মধ্যে? কাল সারারাত দুচোখের পাতা এক হয় নি, শরীর অবসন্ন, মন ভার হয়ে আছে জগদ্দল পাথরের মতো, সারারাত জেগে কান্নার ক্লান্তি চোখে মুখে স্পষ্ট। ভারী একটা নিশ্বাস ফেললো তিন্নি। কেমন আছে সে? কতদিন কথা হয় নি….. আজ কি তার কল আসবে?

সেই জুন মাস থেকে প্রতিরাতে নিয়মকরে কথা বলে যাচ্ছে তিন্নি আর অভিমন্যু আর আজ অক্টোবরের মাঝামাঝি, একরাতও ব্যতিক্রম হয় নি। অভিমন্যু এখন তিন্নির দৈনন্দিন অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। অভিমন্যুকে ছাড়া একটা দিনের কথাও ভাবতে পারতো না তিন্নি কিন্তু…… গত তিনদিন ধরে অভিমন্যুর ফোন আসছে না। “আগামী কয়েকদিন বাঙ্কারে থাকতে হবে” নবমীর রাতে শেষবারের ফোনে এটুকুই বলেছে অভিমন্যু, এর থেকে বেশি জিজ্ঞেস করাও যেত না ফোনে। “বাঙ্কার” ওদের কোড ওয়ার্ড – যার মানে অভিমন্যুকে আন্ডারকভার যেতে হবে আগামী কয়েকদিনের জন্য। কোনো ফোন নেই, যোগাযোগ করার কোনো উপায় নেই, এমনকি কোনো ইলেকট্রনিক নিউজেও প্রকাশ হবে না – এমন গোপন এসব অপারেশন। কতদিন লাগবে, কবে ফিরবে কেউ জানে না। আর কতরাত অভিমন্যুর ফোনের অপেক্ষা করতে হবে – তাও জানে না তিন্নি। অভিমন্যু ওর থেকে অতদূরে, একাকী, কোনো এক নির্জন সীমান্তে ডিউটি করছে – পুজোর আনন্দ এমনিতেও মাটি হয়েছিল তিন্নির, আর নবমীর রাত থেকে গত তিনরাত ঘুমোতেও পারে নি ও।
সেই প্রানোচ্ছল তিন্নি আর নেই। বিগত কয়েকমাস ধরে যে মেয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়েদের টপ টেন লিস্টে ছিল, মাত্র তিনরাতের মধ্যে সে পাথর হয়ে গেছে। কথায় কথায় মিষ্টি মুচকি হাসি হেসে ফেলা নরম মেয়েটি আজ টইটম্বুর করছে সাগরভর্তি জলে, জোর করে হাসতে গেলেও ছলকে পড়ছে নোনতা জল। প্রয়োজন ছাড়া একটা কথাও কারুর সাথে বলছে না, খাওয়া দাওয়া একরকম প্রায় ছেড়েই দিয়েছে, অনেক বকাঝকা করলে কোনোরকমে একটু কিছু খুঁটে খেয়ে উঠে যায়, জিজ্ঞেস করলে বলে “খিদে নেই”। সর্বদা অন্য জগতে বিরাজমান, শুধু অব্যক্ত এক প্রার্থনায় বিড়বিড় করে চলেছে ঠোঁট। চারিদিকে ঢাকের বোলে মুখরিত, পাড়ার পুজো প্যান্ডেল ঘিরে আলোর রোশনাই কিন্তু তিন্নি এসব থেকে কয়েক যোজন আলোকবর্ষ দুরে! নতুন জামা আর পূজাবার্ষিকী ছেড়ে সারা দিনরাত সকল অনলাইন নিউজচ্যানেলের খবর আর টুইটার খুঁজে গেছে তিন্নি, ভুলক্রমেও যদি মিডিয়ায় চলে আসে – সিকিমের পার্বত্য অঞ্চলে কোথাও কোনো অশান্তি হয়েছে কিনা, ভালো মন্দ যাহোক কিছু একটা খবরের আশায়! থেকে থেকে দুশ্চিন্তারা মাথার ভেতর কিলবিল করে উঠছে ছিনেজোঁকের মতো। সারা দিনরাত শতকোটি বার ঈশ্বরের নাম জপ করে গেছে তিন্নি, দশমীর দিন দূর্গা মা’কে বরণ করতে গিয়েও চোখে জল চলে এসেছে বারবার, তাও একটা অশ্রুও মাটিতে পড়তে দেয় নি। বারবার প্রার্থনা করে গেছে –” ওকে দেখো ভগবান, ওকে অক্ষত রেখো। আর কিচ্ছু চাই না তোমার থেকে, ওর কিছু ক্ষতি হওয়ার আগে আমাকে উঠিয়ে নিও!”

সবাই ভেবেছে পুজো শেষ হয়ে গেছে বলে তিন্নির মনখারাপ, বাবা বুঝিয়েছে ওকে – “মা’ রে! পুজো তো প্রতিবছরই আসে, আবার আসবে পরের বছর! এতো মনখারাপ করে পাগল মেয়ে?”
কাকে বলবে তিন্নি কেন ওর কান্না পাচ্ছে??

অভিমন্যু বলেছিলো বটে এ জীবন সহজ হবে না – সত্যিই যে এতো নির্মম, নির্দয় হতে পারে, তিন্নির ধারণা ছিল না। একটা মানুষ যাকে ও দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে, সে ওর থেকে বহুদূরে, মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে, মুখোমুখি। হয় বেঁচে ফিরে আসবে নয়তো ফিরে আসবে তেরঙায় মুড়ে – কিন্তু ফিরে ঠিকই আসবে! এ মানসিক চাপ যে কি ভয়ানক, যে অভিজ্ঞতা করে নি, সে জানবে না! কথায় কথায় কেঁদে ফেলা নরম মনের তিন্নি একফোঁটাও চোখের জল ফেলে নি, বুকে পাথর রেখে আছে তাও কাঁদে নি।
অভিমন্যুকে প্রমিস করেছে তিন্নি – কাঁদবে না একবারও। অভিমন্যু প্রমিস করেছে তিন্নিকে – ফিরে ও আসবেই।

**************************__****************************

উচ্চগ্রামে হাসির রোল আর অচেনা অনেকগুলো গলার আওয়াজে চিন্তার জাল কেটে গেলো তিন্নির। কেউ এসছে নাকি বাড়িতে? এত সকালে? বাথরুম যাওয়ার পথে কৌতূহলী হয়ে পর্দার আড়াল থেকে বসার ঘরে মুখ বাড়ালো। পরনে ওর রাতে শুয়ে ঘুমোনোর রংচটা থ্রী কোয়ার্টারপ্যান্ট আর ফুটো ফুটো হাফহাতা টপ, চুল না আঁচড়ানো উস্কো খুস্কো, চোখের কোনে পিচুটি, মুখে চোখে জল দেওয়া হয় নি দাঁত ব্রাশ করা তো দূরের কথা! একটু দেখেই তো চলে যাবে, এই ভেবে ভারীপর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে রইলো তিন্নি, পা’দুটি যে দেখা যাচ্ছে সে খেয়াল রইলো না! ঘরের ভেতরের দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে চেয়ে রইলো তিন্নি! সোফা আর চেয়ারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দুজন মাঝবয়সী ভদ্রমহিলা বসে, একটা বাচ্চা হুটোপাটি করে বেরাচ্ছে, আর একজন ওর বয়সী মেয়ে – চা খাচ্ছে। প্লেটে প্লেটে একগাদা মিষ্টি আর লুচি,তরকারি সাজানো। রন্জনবাবু ধোপদুরস্ত জামাকাপড়ে টিপটপ, টুকটাক গল্প করছেন ওঁনাদের সাথে। ভাস্বতীদেবী তদারকিতে ব্যস্ত, এটাওটা খাওয়ার জন্য জোরাজোরি করছে, এমনকি শুভও এত সকালে উঠে পড়ে ঘরবার করছে। অবাক হয়ে গেল তিন্নি! কারা এঁরা? ওদের কোনো দুর সম্পর্কের আত্মীয় বিজয়া করতে এসেছে? আগে তো কখনো দেখেনি এদের! এই সাতসকালেই মহিলাদের সাজের বহর দেখে চোখ কপালে উঠলো ওর। তারওপর তিন্নির অমন দুর্দন্ডপ্রতাপ মাতৃদেবী মানে, ভাস্বতীদেবী যেভাবে বিনীতবদনে এঁনাদের আপ্যায়ন করছেন, দেখে তো ওর মাথাখারাপ হওয়ার জোগাড়। সুর্য কি আজ দক্ষিনদিকে উঠেছে?
বাসীমুখে অবাক হয়ে ঘরের ভেতরের আজব দৃশ্য দেখছিল তিন্নি, হঠাৎ মহিলাবর্গের সাথে আসা ডেঁপো বাচ্চাটা পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকা তিন্নিকে দেখতে পেয়ে হাত দিয়ে “ওই!ওই!” করতে ঘরের সবার চোখ পড়লো ওর দিকেই! সোফায় বসে থাকা মধ্যবয়স্ক মহিলা বললেন – “আরে!! তুমি ওখানে লুকিয়ে কেন, এদিকে এসো?”

বাহ্!দারুন ব্যাপার!
আচ্ছা জ্বালা হলো তো! কি করবে এবার তিন্নি? এতক্ষনে নিজের দিকে নজর পড়লো ওর। বহু ব্যবহৃত বহু পুরোনো ছাইরঙা গায়ের পাতলা টপটা দু-এক জায়গায় ফুটোও আছে বোধহয়, নিচের কাপ্রিটাতেও ফুটো থাকা অসম্ভব কিছু নয়। আসলে এই জামাটা ওর সেই ক্লাস ইলেভেনের জামা! পুরোনো হয়ে গেছে কিন্তু এত্তো খুব আরাম, মায়ের হাজার বকাবকিতেও ফেলতে মন চায় না তিন্নির খুব নরম বলে এটা পরেই গরমের রাতগুলোতে শুতে যায়। এদিকে ওর মুখচোখের অবস্থা আর বলার নয়! রাত জেগে কান্নার ছাপ স্পষ্ট, মুখে জল দেয় নি এখনো, চোখে পিচুটি লেগে আছে বোধহয়!
তিন্নি ইতস্তত করছে দেখে অল্পবয়সী মেয়েটা সোফা থেকে উঠে এসে পর্দার আড়ালে তিন্নির হাত ধরে টানলো – “আরে, তুমি লজ্জা পাচ্ছো কেন? এটা তো তোমারই বাড়ি !”

বাধ্য হয়ে পর্দার আড়াল থেকে বাইরে এলো তিন্নি। সাড়ে তিনজন অচেনা মানুষের সামনে এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লজ্জায় কানের ডগা থেকে গাল লাল-গোলাপি উঠলো যেন। রঞ্জনবাবু মিটিমিটি হাসছিলেন তিন্নিকে দেখে, ভাস্বতীদেবী উঠে এসে বিরক্তির সুরে কানে কানে বললেন – “বাইরের লোকের সামনে এইভাবেই চলে এলি? জামাটা অন্তত ছেড়ে আসতে পারতিস তো।“

হাত ধরে তিন্নিকে টেনে আনলেন সামনে — “এই যে! এই আমার মেয়ে সীমন্তিনী, ডাক নাম তিন্নি। কলকাতায় আই.টি অফিসে চাকরি করে…….। প্রণাম কর যা।“
শেষ কথাটা তিন্নির উদ্দেশ্যে।

অপরিচিত লোকজনদের প্রণাম করতে ভারী আপত্তি তিন্নির, কিন্তু সবার সামনে এভাবে ঠ্যালা দিলে আর কি’ই বা করার আছে! হাতজোড় করে বেজার মুখে শুকনো নমস্কার সারার পর মায়ের আর এক ঠ্যালা খেয়ে বয়স্ক দুই মহিলাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বাবার কাছে গিয়ে বসতে চাইছিলো তিন্নি, অল্পবয়সী মেয়েটি সোফা থেকে উঠে ওকে জায়গা করে দিয়ে বললো — “তুমি ভাই এইখানেই বসো, আমি বরং চেয়ারে গিয়ে বসি।“

— “না!না! তা কেন? আপনি বসুন না?”
নিজের পোশাকআষাকের অস্বস্তিতে মৃদু আপত্তি জানালো তিন্নি, মেয়েটি ফিক করে হেসে বললো – “এসব আপনি টাপনি চলবে না কিন্তু, তুমি করে বলো।“

কেউ নিজের পরিচয় দেয় নি, তিন্নিও সৌজন্যবোধে জিজ্ঞেসও করে উঠতে পারলো না “আপনারা কে”, “কোথা থেকে আসছেন”! মুখ গোঁজ করে বসে পায়ের নখ খুঁটতে লাগলো মাটিতে। কিছুক্ষন অস্বস্তিকর নীরবতার পর সোফায় বসে থাকা সবচেয়ে বয়স্ক ভদ্রমহিলা গলা খাঁকড়ি দিয়ে রাশভারী গলায় বললেন — “তা, তুমি কি রোজই এত বেলা করে ঘুম থেকে ওঠো?”

“বেলা?”
তড়াক করে পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গেলো, মনে মনে সওয়াল করলো রোববার সকাল সাড়ে আটটার সময় লোকের বাড়ি কে আসে! এক,দুই সেকেন্ড সময় নিলো তিন্নি, প্রশ্ন-বুলেটটা ডজ্ করবে নাকি সরাসরি কঠিন জবাব দেবে? ভেতরের অনেক সংযমের প্রয়াসে শান্ত গলায় ছোট্ট করে উত্তর দিলো একটু পর — “সারা সপ্তাহ অফিস থাকে তো, রোববার তাই দেরি হয়। “

তিন্নির কাঠ কাঠ গলা বোধহয় সবারই কানে লাগলো, ঘরের ভেতর আর একটু গুমোট হয়ে উঠলো বোধহয়, কয়েক সেকেন্ড ফ্যানের আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। আড়চোখে তিন্নি দেখলো মাঝবয়সী মহিলা মুখ বাঁকালেন, অল্পবয়সী মেয়েটি খুকখুক করে কেশে জলের গ্লাস তুলে নিল, কিন্তু ও গায়ে মাখলো না। তিন্নির তখন মন অন্যকোথাও…. হাতের কাছে ফোন নেই, যদি অভিমন্যুর কল এসে থাকে? নিজের অজান্তেই ছটপটিয়ে উঠলো, তা দেখে ভাস্বতীদেবী চোখ পাকালেন তিন্নিকে, বুঝেও না বোঝার ভাণ করে রইলো তিন্নি।

রঞ্জনবাবু মেয়ের গলার তেঁতোভাব ধরে ফেলে সামাল দিতে তড়িঘড়ি বলে উঠলেন –“ আসলে প্রতিদিন তিনঘন্টার ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করে তো, শরীরে আর কিছু থাকে না……. কালও অফিস গিয়েছিলো। সপ্তাহে একটা দিন তাই দেরি করে ওঠে।“

রঞ্জনবাবুকে বিশেষ পাত্তা না দিয়ে বয়স্ক ভদ্রমহিলা আবার বলে উঠলেন – “কলকাতার কোথায় যেন অফিস তোমার?“

— সেক্টর ফাইভ। কলেজ মোড়ের কাছে।

— ভিড় ট্রেনে প্রতিদিন যাও, অসুবিধে হয় না?

— নাহ, অভ্যেস হয়ে গেছে।

— সে-ই! তোমরা সব আজকালকার মেয়ে, আমরা আবার ঘরের বাইরে পা দিতেই ভয় পাই। তা কতদিন চাকরি করছো?

— এই তো দুইবছর হলো জাস্ট! আপনি……মানে আপনারা ঠিক কে বলুন তো? মাফ করবেন, আমি চিনতে পারছি না !

পরপর এতগুলো প্রশ্নের জবাব দিয়ে নিজেকে আর ধরে রাখতে না পারলো তিন্নি, মুখ ফস্কে জিজ্ঞেস করেই ফেললো। ভাস্বতীদেবী তিন্নির খুব কাছেই দাঁড়িয়েছিলেন, একটা চিমটি কাটলেন মেয়েকে, ঠোঁট টিপে চুপ করে গেলো তিন্নি। অপরিচিতা বয়স্ক ভদ্রমহিলা হাসলেন, তৃপ্তির হাসি নাকি সন্তুষ্টির? কথাটার জবাব না দিয়ে পরের প্রশ্নে লাফ দিলেন —“ চাকরির বাইরে আর কি কি শখ আছে? গানটান গাইতে পারো? রান্নাও নিশ্চয়ই পারো?“

অদ্ভুত তো!
মাথার মধ্যে একটা চড়চড়ে বিরক্তি মেশানো রাগ ফিরে আসছিলো তিন্নির, তখন থেকে একতরফা প্রশ্ন করে যাচ্ছে, এ কি ইন্টারভিউ নিতে এসেছে নাকি? কে রে বাবা এরা! এতো আত্মীয়তার কি সম্পর্ক আছে? তিন্নি মুখ খোলার আগেই ভাস্বতীদেবী তড়িঘড়ি বলে উঠলেন — “টুকটাক সব পারে, মেয়ে আমার খুব করিৎকর্মা।“

কথাটা সর্বৈব মিথ্যা।
তিন্নি রান্নাঘরে পা দেয় না কোনোদিন। আলু আর শাঁখালুর পার্থক্যও বোঝে না! অতিকথনের দোষ এড়াতে রঞ্জনবাবু বাধা দিলেন স্ত্রী’কে, প্রশ্নকর্ত্রীকে সত্যিকথাটাই বললেন -– “আসলে ছোট থেকে পড়াশোনা তারপর আই.টির চাকরিতে মেয়ে এতো ব্যস্ত, রান্নাঘরে ঢোকার সময় পায় না।“

মা বাবার কথা শুনে মুখচোখ শক্ত হয়ে উঠেছিল তিন্নির, দেখে দ্রুত সামাল দিলেন রঞ্জনবাবু – “তবে, তিন্নি খুব ভালো কবিতা আবৃত্তি করতে পারে! মা……একটা কবিতা বল তো?”

দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠা বারুদের মতো গনগনে রাগটা এবার আর ধরে রাখতে পারলো না তিন্নি, ও কি ক্লাস থ্রীতে পড়া বাচ্চা নাকি, বাড়িতে লোক এলে কবিতা পড়ে শোনাবে? কড়াচোখে একবার বাবার দিকে তাকালো, তারপর সোফা থেকে সটান উঠে পড়ে বললো — “আপনারা বরং কথা বলুন, আমি মুখ ধুয়ে আসছি।”

কারো দিকে না তাকিয়ে আলগোছে শুকনো একটা নমস্কার সেরে গটগট করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল তিন্নি। বসারঘর থেকে বেরিয়েই দেখলো শুভ সকাল সকাল রেডি, বাইরে যাচ্ছে কোথাও। ইশারায় ভাইকে ডাকলো -– “কে রে এরা? চিনিস? এতো সকালে আমাদের বাড়ি এসেছে?”

তিন্নিকে লিভিংরুম থেকে বেরোতে দেখে শুভর চোখ কপালে! অবাক গলায় বললো — “তুই এই জামাকাপড়ে ওদের সামনে গিয়ে বসলি?”

— আমি তো এই ঘুম থেকে উঠলাম! মুখ ধোয়াও হয় নি, ওরাই দেখতে পেয়ে ডাকলো! কেন রে?

— তুই কি রে দিদি? দিনদিন ছাগল হয়ে যাচ্ছিস?

চোখ পাকালো তিন্নি। ওর মুখ দেখে শুভর মনে কেমন একটা সন্দেহ জাগলো, চাপা গলায় বললো — তুই জানিস না কিছু? মা বলে নি তোকে?

— না তো? কে এঁনারা? আমাদের কোনো রিলেটিভ নাকি! আগে তো দেখি নি।

— এখনো হয় নি, তবে …. হতে কতক্ষন?

মাথার ছয় ইঞ্চি ওপর দিয়ে সব কথা উড়ে যাচ্ছিলো তিন্নির, মনটা আরেকবার আনচান করে উঠলো, অভিমন্যুর ফোন এলো কি? বেজার মুখে বললো — “শুভ? সকাল সকাল শুরু করেছিস?”

মিচকি হাসি হাসলো শুভ, সঙ্গে সঙ্গে সুযোগের সদব্যবহার করতেওভুললো না – “আগে ১০০ টাকা দে। তারপর বলবো।“

উফফ!
সাতসকালে এতোজনের এতো খেজুরে কথা পছন্দ নয় তিন্নির। নে বাবা নে, যা পারিস নে! মনে মনে ভাইকে দু তিনটে গালি দিয়ে বিনা বাক্যব্যায়ে নিজের ঘরে ঢুকে পার্স থেকে একশো টাকার একটা নোট ভাইয়ের হাতে ধরিয়ে দিতে কান এঁটো করা হাসি হাসলো শুভ – “একবার বলতেই দিয়ে দিবি জানলে আরো বেশি চাইতাম!”

চোখ পাকিয়ে ধমকে উঠলো তিন্নি — “এবার ওই একশো টাকাটাও কেড়ে নেবো। বলবি কি?”

একগাল হাসলো শুভ – “ঠিক জানি না। তবে যা বুঝলাম এরা মা’র কোনো বান্ধবীর বান্ধবী, তোকে দেখতে এসছে।“

ভুরু কুঁচকে কপালে উঠলো তিন্নির — “আমাকে দেখতে এসেছে? কেন??”

দিদিটা দিনদিন কেমন গাম্বাট হয়ে যাচ্ছে, সবসময় কোন খেয়ালে ডুবে থাকে কে জানে! সকাল সকাল দিদির সাথে একটু মজা করার ইচ্ছে হলো শুভর। তাছাড়া, মা যখন আগে থেকে দিদিকে এব্যাপারে কিছু জানায় নি, তখন নিজে যেচে কিছু বলাও উচিত হবে না। হালকা চোখ টিপে যা মাথায় এলো তাই বলে দিলো – “আমি কি জানি! ওই বয়স্ক মহিলার মেয়ের চাকরির জন্য বোধহয়। নয়তো তোকে দিয়ে লাইফ ইনস্যুরেন্স করাবে!!”

— চাকরি! আমি কোথা থেকে চাকরি দেব?

— তবে লাইফ ইনস্যুরেন্সের স্কিম করাতে এসেছে হবে হয়তো। মা’কে জিজ্ঞেস করিস, আমি কাটলাম!

একশো টাকার নোটটা তিন্নির নাকের ডগায় নাচাতে নাচাতে শুভ বেরিয়ে গেলো। তিন্নির ভুরু কুঁচকেই রইলো, লাইফ ইনস্যুরেন্স করাতে এতো সকালে কে আসে? তাদেরকে এতো আপ্যায়নের বা কি আছে?? মা’ও না! …….. সত্যি!
আর বাবাও কিছু বললো না তো?

বিশাল বড়ো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাথরুমে ঢুকে গেলো তিন্নি, জল ছিটিয়ে ছিটিয়ে অনেকক্ষন সময় নিয়ে ব্রাশ করলো, মুখে চোখে জল দিলো, তারপর কি ভেবে টুক করে স্নানটাও সেরে নিলো – যতটা সময় বাথরুমে কাটানো যায় আর কি। না হলেই তো মা টেনে বসিয়ে দেবে অপরিচিত মহিলামহলের সামনে! আবার মুখোমুখি হওয়া এড়াতে অনেকটা সময় নিয়ে জল ঘেঁটে বাথরুম থেকে বেরিয়ে তিন্নি দেখলো ওনারা উঠছেন ততক্ষনে।স্বস্তির নিশ্বাসটা গোপন করে নিয়ে ভদ্রতার হাসি হেসে তিন্নি বললো –“আবার আসবেন।“

বয়স্ক মহিলা তিন্নির থুতনিতে আঙুল ছুঁইয়ে একটি চুমো দিয়ে বললেন – “এই তো, স্নান টান সেরে একদম লক্ষী ঠাকুরের মতো লাগছে!” তারপর মৃদু অনুযোগের সুরে বললেন — “তুমি তো আর আমাদের সামনে এলে না, গল্পও হলো না!”

ওনার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা ভাস্বতীদেবীর মুখ হাসিতে ভরে উঠেছে ততক্ষনে। তিন্নির বয়সী অল্পবয়সী মেয়েটাও ফচকে হাসি হেসে তিন্নিকে চোখ মারলো – “আবার আসবো আমরা, এখন তো যাতায়াত লেগেই থাকবে।“

ভারী অদ্ভুত তো!
তিন্নি ভুরু কুঁচকে দাঁড়িয়েই রইলো। আজ সকাল থেকে ঠিক কি কি হচ্ছে তিন্নির খাপছাড়া মনে কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। সত্যি বলতে অভিমন্যুর খবর না পাওয়ায় হয়রান হয়ে গিয়ে আধা কথা কানেও নিচ্ছে না তিন্নি! তাও কেমন যেন একটা সন্দেহ হচ্ছিলো মনে! বাড়ি ফাঁকা হয়ে গেলে ভাস্বতীদেবীকে তিন্নি ডেকে বললো — “ওমন যাকে তাকে লাইফ ইনসুরেন্স করানোর জন্য সাতসকালে বাড়িতে ডেকে এনে খাতিরদারি করে জলখাবার খাওয়াচ্ছো? আমাকে একবার জিজ্ঞেস করবে তো! ওসব উটকো লোকের কাছ থেকে কোনো স্কিম নেবো না এখন।”

ভাস্বতীদেবী বসার ঘর থেকেই খেয়াল করেছিলেন শুভ কথা বলছে তিন্নির সাথে, কিন্তু ঠিক কি বলেছে তো আর জানেন না! মনটা ওনার আজ আনন্দে ভরে আছে, হাজার হোক, মেয়ের বিয়ের কথা মোটামুটি ফাইনালে হয়েই গেলো, এরপর শুধু সামনে এগোনোর পালা। দুই তিন সপ্তাহ আগেই আসার ছিল এঁনাদের, নানা কার্যকারণে পিছোতে পিছোতে অবশেষে দুর্গাপুজোর পর এলেন। তবে প্রথম দেখাতেই যে তিন্নিকে এঁনাদের পছন্দ হয়ে যাবে, স্বপ্নেও ভাবেননি ভাস্বতীদেবী। খুশিতে ডগমগ হয়ে মেয়ের সব কথা কানে তোলেন নি, তিন্নির কথা শুনে প্রথমে আকাশ থেকে পড়লেও তারপর মনে মনে ভাবলেন- সেই!! বিয়ে তো একরকম লাইফ ইনসুরেন্সই বটে। মেয়ে হয়তো মায়ের সামনে নিজমুখে বিয়ের কথা তুলতে লজ্জা পাচ্ছে! এমনিতেও আজকালকার চাকরি করা মেয়েদের আধুনিক কথা বোঝা দায়!
মুখে বললেন – “সে তো সবাইকেই করতে হয় একদিন না একদিন! আগে থেকে দেখাশোনা করে কথা বলে রাখতে হবে না? সারা জীবনের ব্যাপার!”

দেওয়াল ঘড়ির দিকে চোখ পড়লো তিন্নির, দশটা বেজে গেছে এখনো তো অভিমন্যুর ফোন এলো না! আর কতোদেরি? কখন থেকে মনটা যেন চড়ুইপাখির মতো ছটফট করছে! অন্যমনস্ক হয়ে মা’র কথাগুলো ঠিক শুনছিলো না তিন্নি, মুখে বললো – “পেপারস রেখে গেছে? আমাকে দিও। চেক করে বলবো।“

আরেকপ্রস্থ অবাক হলেন ভাস্বতীদেবী! পেপারস আবার কি! তিন্নি কি হবু বরের স্কুল কলেজের সার্টিফিকেট চাইছে? ভারী অবাক হয়ে বললেন — “কাগজপত্র কেন লাগবে রে? ওরা তো আমাদের পরিচিত। আমার বান্ধবীর বান্ধবী।”

ততক্ষনে বেডরুমে রাখা মোবাইলে পরিচিত রিংটোনটা বেজে উঠেছে। তিন্নির আর কিছু শোনার অবকাশ নেই, মা’কে সামনে থেকে সরিয়ে দিয়ে দৌড়ে নিজের ঘরে ঢুকে সজোরে দরজা বন্ধ করে দিলো! মেয়ের গমনপথের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন ভাস্বতীদেবী -এ জন্মে আর মেয়েকে বুঝতে পারবেন না উনি। এই ফোনই মেয়েটার মাথা খেলো, কোনোরকমে এখন বিয়ের চৌকাঠ পার করতে হবে ব্যাপারটা হাতের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই। আচ্ছা! সম্বন্ধটা ঠিকঠাক হবে তো? আশা নিরাশার দোলাচলে দুলতে থাকা মন নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন ভাস্বতীদেবী।

**************************__****************************

ঘরে ঢুকেই বাঁধভাঙা বন্যার জলের মতো ফোনটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো তিন্নি — তুমি ঠিক আছো?

হাঁফাতে হাঁফাতে ওপাশ থেকে অভিমন্যুর ক্লান্ত গলা ভেসে এলো –“ হ্যাঁ। আরএকবার বেঁচে ফিরে এলাম।”

কেঁদে ফেললো তিন্নি, উদ্বেগে-চিন্তায়-মানসিক কষ্টে, আর আনন্দে….এতদিন পর অভিমন্যুর গলা শুনে! ফোঁপাতে ফোঁপাতেই বললো — “কিছু হয়নি তো তোমার ? হাতে-পায়ে-গায়ে কোথাও লাগে নি তো? প্লিজ অভিমন্যু, আমাকে লুকিও না কিছু!”

নরম গলাটা ভেসে এলো অনেকদুর থেকে – “পাগল মেয়ে! আই প্রমিসড ইউ, না?”

আর একটা কথাও না বলে ফোনটা বুকের কাছে চেপে ধরে কেঁদেই চললো তিন্নি। খুব খুব শ্রান্ত গলায় অভিমন্যু বললো —- “এবার রাখি, সোনা? আমি খুব টায়ার্ড, টানা ৬৫ ঘন্টা ঘুমোই নি! রাতে ফোন করবো, ও.কে?”

বুকের ভেতর আমূল কেঁপে উঠলো তিন্নি। কেন এতো নরম করে অভিমন্যু কথা বলছে? কেন মন মানছে না সব ঠিক আছে? তিন্নির মনের ভেতরে বসে থাকা একটা টাইমবোম্ব যেন টিকটিক করছে আরো বড়ো কিছু হয়েছে তা শোনার অপেক্ষায়, কিন্তু প্রশ্ন করার হিম্মত হলো না ওর। নিস্তেজ, বিবশ গলায় শুধু এটুকুই বলতে পারলো — “আমি অপেক্ষা করে থাকবো।”

অভিমন্যু ফোন কেটে দেওয়ার পর কাটা কলাগাছের মতো বিছানায় পড়ে রইলো তিন্নি,উঠে বসার আর শক্তি নেই ওর। তিনদিন ধরে চলে আসা পাহাড়প্রমাণ মানসিক পরিশ্রান্তি আর অপেক্ষার অবসানে স্থবিরের মতো এলিয়ে পড়ে রইলো। তিনরাতের জমাট কান্নাগুলো নোনতা গরমজল হয়ে ধীরে ধীরে চোখের কোল বেয়ে নেমে আসার সাথে সাথে তিন্নিও ঘুমোলো, দীর্ঘ ৬৫ ঘন্টা পর দুচোখের পাতা এক করে। সারাটাদিন ভাস্বতীদেবী, রঞ্জনবাবুর বারংবার ডাকাডাকিতেও সে কালঘুম ভাঙলো না ……… গত তিনরাত যে ও’ও ঘুমোয়নি।

.
.
.
.

দেশমাতৃকাকে রক্ষা করার শপথ নিয়ে হাসতে হাসতে এদেশের বীর জওয়ানরা প্রতিকুল পরিবেশে, দুরদুর্গম সীমান্তে, যুদ্ধক্ষেত্রে শুধু প্রান দেন না, নিজেদের প্রানের বিনিময়ে বাকি ১৩৩ কোটি ভারতবাসীর সুরক্ষাও সুনিশ্চিত করেন, কেবলমাত্র নিজেদের পেশিশক্তি এবং বুদ্ধিবলে। সোনার মেডেল, বীর চক্র, পরম বীর চক্র – আরো নানা উপাধি হয়তো ফৌজির পেশাদার জীবন অলঙ্কারসমৃদ্ধ করে তোলে। তেরেঙ্গায় মোড়া কফিন যখন ফৌজির বাড়িতে এসে পৌঁছোয়, দেওয়া হয় গান স্যালুট, সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে সেন্টিমেন্টাল ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের সাথে মনের কোণে সুড়সুড়ি তোলা সুপার এডিটেট প্যাট্রিওটিক ভিডিও। সেগুলো পড়ে, দেখে দুইতিনদিন সাধারণ মানুষের রক্ত ফুটতে থাকে টগবগিয়ে… মোড়ে মোড়ে চায়ের কাপে তুফান ওঠে আর্মির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে, তাদের “সো কলড্” অপদার্থতা নিয়ে, ভাগ্য ভালো হলে …… তাদের বীরগাথা নিয়ে। তারপর যে কে সেই! অন্তরালে চলে যায় সেই সেনাদের মৃত্যু ~ তেলেভাজার ঠোঙা হয়ে ঠাঁই পায় রাস্তার জন্জালে, সবাই ভুলে যায় তাদের নাম, তাদের অবদান। পঁচিশ বছর আগের কোন এক ক্রিকেট ম্যাচের স্কোরবোর্ড মুখস্ত রাখা দেশবাসী অথবা পর্দার ম্যাচো অভিনেতার সব সংলাপ ঠোঁটস্থ রাখা জনগন ভুলে যায় মাত্র তিনদিন আগে শহীদ হওয়া সেনার নাম – যদি না সেই আত্মত্যাগ নিয়ে কোনো “বায়োপিক” বানানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। কোনো এক অসম যুদ্ধজয়ের গাঁথা স্মরন করতে শহীদদের স্মরনে শ্বেতশুভ্র মর্মর মেমোরিয়াল গড়ে তুললে তা হয়ে দাঁড়ায় পপুলার টুরিস্ট স্পটে… সেলফির ভিড়ে হারিয়ে যায় ফৌজির নাম, তার কর্ম, তার অবদান। ২৪X৭ – অহরহ, অহির্নিশ সেই শহীদদের নিঃস্বার্থ প্রাণত্যাগের বিনিময়েই দেশের অখণ্ড মানচিত্রে আজও অটুট। কিন্তু, শুধু কি সেনারাই একা সীমান্তে যুদ্ধ লড়ে? সীমান্ত থেকে বহুদূরে; ফোঁটায় ফোঁটায় চোখের জলের তর্পণ চড়িয়ে তাদের প্রিয়জনরাও কি সেই মানুষগুলোর অপেক্ষায় …… একটা খবরের অপেক্ষায়, নিঃসঙ্গমনে সহিষ্ণুতা আর সহনশক্তির নিঃশব্দ যুদ্ধ লড়ে না? ভালোবেসে যাওয়া সেই একলা মানুষগুলোর বীরগাথা হয়তো সাদা কাগজে অলিখিতই থেকে যায়।
.
.
.

চোখের জলের যে কোনো দাম হয় না ……. ভালোবাসার কোনো দাম হয় না …….. নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ যে খবরের কাগজের হেডলাইন হওয়ার যোগ্য নয়!

ক্রমশঃ
© সুমন্দ্রা মিত্র। ভালো লাগলে নামসহ শেয়ার করবেন।

***********************__******************************

সকল পর্বের লিঙ্ক~
Video Teaser
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145475543838322/?vh=e&d=n
Part 1
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145129087206301/?d=n
Part 2
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145859077133302/?d=n
Part 3
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/146221053763771/?d=n
Part 4
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/146595433726333/?d=n
Part 5
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/147293876989822/?d=n
Part 6
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148075966911613/?d=n
Part 7
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148530310199512/?d=n
Part 8
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148951006824109/?d=n
Part 9
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/149405760111967/?d=n
Part 10
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/150313546687855/?d=n
Part 11
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/151106323275244/?d=n
Part 12
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/151923336526876/?d=n
Part 13
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/152353663150510/?d=n
Part 14
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/154065792979297/?d=n
Part 15
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/156163186102891/?d=n
Part 16
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/157132182672658/?extid=QdVQFGSjLzQUsE31&d=n
Part 17
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/157444422641434/?extid=fI3jIc0PCiYXDa0N&d=n
Part 18
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/158095955909614/?extid=1E2JOZfMCmqscBoi&d=n
Part 19
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/158831902502686/?extid=R8zo6L2l274CIQ7r&d=n
Part 20
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/159626782423198/?extid=0e8jrLLhsuLqgsQX&d=n
Part 21
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/160047349047808/?extid=e9DIdFXAkqxTg77U&d=n
Part 22
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/160963752289501/?extid=EgYDh0z3hVr5TCBY&d=n
Part 23
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/161833698869173/?extid=gRK0HHMoLW0bu0gK&d=n
Part 24
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/162740122111864/?extid=KIR9o3zetBHgH9mt&d=n
Part 25
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/163061178746425/?extid=fhzBxEjnlA7n6Ulu&d=n
Part 26
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/163695728682970/?extid=tm0Y81ykORQhpsq9&d=n
Part 27
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/164305438621999/?extid=WsYE2BjXkYvPmqyF&d=n

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here