সূর্য ডোবার আগে পর্ব-২৪

0
1829

#সূর্য_ডোবার_আগে
পর্ব-২৪
লেখিকা ~ #সুমন্দ্রামিত্র
কঠোরভাবে প্রাপ্তমনষ্কদের জন্য।
.
.
.

সে রাতে আর ফোন এলো না অভিমন্যুর।

একটি রিং হওয়ার অপেক্ষায় থেকে সারারাত ঘুম হলো না তিন্নিরও। আবোলতাবোল দুশ্চিন্তায় আর মনের সাথে মনের যুদ্ধে সমস্ত রাত বিছানায় এপাশ ওপাশ ছটপট করতে করতে ফোনটা হাতে নিয়েই ভোররাতে কখন চোখ লেগে গিয়েছিলো, নিয়মমাফিক আ্যলার্মের কর্কশ যান্ত্রিক স্বরে তন্দ্রা ভেঙে ধড়ফড় করে উঠে বসলো। আপনাআপনিই হাত চলে গেলো ফোনের দিকে, আরেকবার কললগ চেক করতে। অভিমন্যু ফোন করে নি তো? একচিলতে আশা, নিদেনপক্ষে যদি একটা মিসডকলও থাকে?

– নাহ! বৃথা সে আশা! কললিস্ট এম্পটি!

ঝুপ করে বুকের ভেতরটা খালি হয়ে গেলো তিন্নির। ছটফটিয়ে উঠলো মন, মাথার মধ্যে কে যেন চিৎকার করে উঠলো, কেন এমন হলো? অভিমন্যু যে বললো রাতে ফোন করবে, তাও করলো না? মনের ভেতরে বসে থাকা টাইমবোম্ব থেমে আসা হৃৎপিণ্ডের সাথে যেন তালে তাল মিলিয়ে টিকটিক করে জানান দিচ্ছে আসন্ন দুঃসংবাদ, শূন্য দৃষ্টিতে কিছুক্ষন ফোনটা আঁকড়ে বসে থাকার পর নিজেই নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করলো তিন্নি – “কেমন স্বার্থপরের মতো শুধু নিজের কথা ভাবছিস তুই! ওদিকে সেই মানুষটা যে টানা ৬৫ ঘন্টা না ঘুমিয়ে প্রাণ হাতে করে দেশের জন্য লড়াই করলো তার মানসিক ক্লান্তি নিরাময়, একটু বিশ্রামের কথা ভুলে গেলি?”

মন চলে নিজের মতোই, মাথার শাসন শোনে না।
ব্যাটারীচালিত পুতুলের মতো বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো তিন্নি, যেমনতেমন করে বাসি চাদর বালিশ গুছিয়ে রেখে পাঁচ মিনিটের মধ্যে গায়ে মাথায় কোনোরকমে জল ঢেলে বেরিয়ে এলো বাথরুম থেকে। অন্যদিনের মতো আজ আর অফিস যাওয়ার জামাকাপড় নিয়ে ভাবলো না, হাতের সামনে যা পেলো তাই গায়ে গলিয়ে, ভিজে চুলটা মাথার ওপর চুড়ো করে বেঁধে নিলো। অভিমন্যুর একটা ঠিকঠাক খবর না পাওয়া অবধি গলা দিয়ে খাবার নামবে না তিন্নির। খেতে ইচ্ছে করছে না একেবারেই, কিন্তু ভাস্বতীদেবী ঘুমচোখে খাবার আগলে বসে আছেন। এখন বারণ করলে আরো দু চারটে বিষমাখানো কথার হুল শুনতে হবে। এতো সকালে মেয়েকে আর ভাত দেন না ভাস্বতীদেবী, চা-বাটারটোস্ট বানিয়ে দেন। গরম চায়ের কাপ গলায় উপুড় করে ঢেলে নিয়ে টোস্টগুলো ছুঁয়েও দেখলো না তিন্নি, টেবিল ছেড়ে উঠে পড়লো। ভাস্বতীদেবী চেঁচিয়ে উঠলেন পেছন থেকে — “সেই যদি খাবিই না, তবে সকাল সকাল আমাকে রান্নাঘরে ঢোকাস কেন? খাবার নষ্ট করবি বলে?”

ভাস্বতীদেবীর কথা আজ কানে গেলো না তিন্নির। চিন্তায় জর্জর গিঁটপাকানো মন নিয়ে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে, অন্যান্যদিনের মতো রঞ্জনবাবুকে “বাই” বলেও গেলো না। সম্মোহিতের মতো কোনোদিকে না তাকিয়ে অফিস যাওয়ার সাথী হ্যান্ডব্যাগটা হাতে গলিয়ে রিকশায় উঠে বসলো চুপচাপ। ভাস্বতীদেবী এই সুযোগে স্বামীকে খোঁটা দিতে ছাড়লেন না, তিতকুটে গলায় বললেন — “এখনো সময় আছে… আদরের মেয়েকে সামলাও! হাতের বাইরে বেরিয়ে গেলে পরে আমাকে দোষ দেবে না! আমি কিন্তু ছেলের বাড়িতে হ্যাঁ বলে দিচ্ছি।”

কি বলবেন রঞ্জনবাবু, ভেবে পেলেন না। কাল সকাল থেকে তিন্নির আচার আচরণ ওঁনার চোখেও অসদৃশ্য লাগছে। তিন্নি তো কখনো এমন করে না। গতকাল সকাল সকাল স্নান সেরে সেই যে অবেলায় শুয়ে পড়লো, কি কাল ঘুমে পেয়েছিলো মেয়েটাকে -এতো ডাকাডাকিতেও সে ঘুম ভাঙলো না! আজ সকালেও মুখে কথা নেই, চোখে কালি ঢেলে গেছে, থমথমে চেহারা। অফিস যাওয়ার আগে একবার বাবার দিকে চেয়েওতাকালো না! মেয়ে কি অভিমান করেছে ওঁনার ওপর, তিন্নিকে না জানিয়ে ছেলের বাড়ি থেকে দেখতে আসায় রঞ্জনবাবুও সম্মতি দিয়েছেন বলে? বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে উঠলো রঞ্জনবাবুর, মনে মনে বললেন –“হায় রে মা! আজ যদি তোর বাবাটা পঙ্গু হয়ে হুইলচেয়ারে বন্দি না থাকতো, তবে তোকে এতো কষ্ট পেতে হতো না!”

ওদিকে রঞ্জনবাবুর মতামতের অপেক্ষা না করেই ঘরে ঢুকে গেলেন ভাস্বতীদেবী। লোকে বলে ~লাখ কথা ছাড়া বিয়ে হয় না। সত্যিই তো। একের পর এক ফোন, আত্মীয়স্বজন-পাড়াপ্রতিবেশীদের জানানো, ছেলের বাড়ির সাথে কথা এগোনো, লিস্ট মিলিয়ে সব যোগাড়যন্ত্র করা -অনেক কাজ সামনে, একা হাতে ওনাকে সবটা সামলাতে হবে! মেয়ের বিয়ে কি মুখের কথা?

.
.

আজ কাকভোরে স্টেশন যাওয়ার আগে বিশালাক্ষী মন্দিরে দুটো এক্সট্রা ধুপ জ্বললো তিন্নি, চিরাচরিত প্রার্থনাটা আজ দুইমিনিট বেশি ছিল। সকাল থেকে বাম চোখের পাতা কাঁপছে ওর, মনটা কেমন যেন কু ডাকছে! অত সকালে মন্দির খোলে নি তখনও, তা হোক! বন্ধ দরজাতেই মাথা ঠুকে, কৃষ্ণকালো চোখদুটি বুজিয়ে দুই হাতজোড় করে বিড়বিড় করতে লাগলো অভিমন্যুর সুরক্ষা কামনায়, একটা ফোনকলের আকুল প্রার্থনায়! কোনো মন্ত্র নয়, কোনো রীতিসম্মত পুজো নয়, শুধু “একজনকে” ভালো রাখার আকুল আবেদন। ভাগ্যের হাতে নিজের ভালোবাসাকে ছেড়ে দিয়েছে তিন্নি, ভগবানের ওপর অটুট বিশ্বাস রাখা ছাড়া আর যে কোনো উপায় নেই। দরকার পড়লে সারা পৃথিবীর সকল ধর্মস্থানের প্রতিটি পাথরে মাথা ঠুকবে তিন্নি, শুধুমাত্র অভিমন্যুর সুরক্ষার জন্য।

**************************__****************************

ট্রেনে, অটোর লাইনে এমনকি অফিস পৌঁছেও অবসন্ন হৃদয়ে ঈশ্বরের নাম স্মরণ করতে করতে মনে মনে নিজেই নিজেকে সান্তনা দিচ্ছিলো “নিশ্চয়ই ওর কিছু হয় নি, মিশন শেষ হওয়ার পর আমাকে তো জানালো সব ঠিক আছে!” কিন্তু তখনই অন্য মনটা প্রশ্ন করে “তবে এখনো কেন তার একটা বার্তাও এসে পোঁছলো না? ফোন না হোক একটা মিসড কল দিয়ে তো জানাতে পারতো সে ঠিক আছে? অভিমন্যু কি জানে না তিন্নির মনে কি চলছে?”
অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা, অব্যক্ত অভিমান আর আশঙ্কায় খুব খু-ব কান্না পাচ্ছে তিন্নির, থেকে থেকে বুকের ভেতরটা পায়রার ডানার মতো ছটফটিয়ে উঠছে শুধু আর একবার অভিমন্যুর গলার আওয়াজ শোনার জন্য।

সকাল সাড়ে এগারোটা নাগাদ ফোনটা এলো, আননোন নাম্বার। তিন্নি তখন অফিসে কনফারেন্স কলে ব্যস্ত, সচরাচর মিটিংয়ে থাকলে তিন্নি কখনো ফোন ধরে না কিন্তু আজকের ব্যাপার আলাদা। সাইলেন্টে রাখা ফোনটা টেবিলের ওপর রাখা ছিল, স্ক্রিনে সাদা আলো জ্বলে উঠতেই প্রেজেনটেশন থামিয়ে দিল তিন্নি — “এক্সকিউজ মি অল, আই হ্যাভ আ্যন ইম্পরট্যান্ট কল টু এটেন্ড।“

মাঝপথে প্রেজেনটেশন থামিয়ে দেওয়ায় মিথিলেশ একটু বিরক্ত হলো –“আর ইউ সিরিয়াস? মোর ইম্পরট্যান্ট দ্যান দিজ?”

— ইয়েস মিথিলেশ। সরি ফর দ্যাট।

ফোনটা কানে চেপে কাঁচের দেওয়ালে ঢাকা কনফারেন্স রুম থেকে বেরিয়ে এলো তিন্নি।

—হ্যালো?
কাঁপা কাঁপা গলায় ফোনটা রিসিভ করলো তিন্নি, মনে মনে ভেবেছিলো হয়তো অভিমন্যুর দরাজ গলা হেসে উঠবে আবার কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে অপরিচিত একটা ভারী গলা ভেসে এলো — “আ্যম আই স্পিকিং টু মিস সীমন্তিনী আচারিয়া?”

— ইয়েস?

— সীমন্তিনী, দিজ ইজ কর্নেল শ্রীবিষ্ণু রঙ্গনাথাম স্পিকিং! ফিউ মন্থস এগো, ইউ মেট মি ইন সিকিম…… রিমেম্বার?

— ইয়েস স্যার….. অভিমন্যু কোথায়? ইজ হি অল রাইট?

— একটা খারাপ খবর আছে মিস্ আচারিয়া। ইউ আর হিজ এমার্জেন্সি কন্ট্যাক্ট, আই থট আই শুড লেট্ ইউ নো।

— ইজ হি ……..আ্যলাইভ?
শুকনো বাঁশপাতার মতো কাঁপতে কাঁপতে শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে প্রশ্নটা করলো তিন্নি, উত্তর শোনার মতো আর কোনো শক্তি ছিল না তিন্নির কাছে।

— অভিমন্যু বেঁচে আছে, কিন্তু ওর দুটো গুলি লেগেছিলো কাল। হি ইজ ইন আই.সি.ইউ আ্যন্ড ……

কর্নেল স্যার আরো কিছু বলে যাচ্ছিলেন কিন্তু তিন্নির কানে আর কিছু ঢুকলো না। ফোন পড়ে গেলো হাত থেকে, চোখের সামনে পলকে সবকিছু অন্ধকার হয়ে যাওয়ার আগেই অভিমন্যুর মুখটা ভেসে উঠলো তিন্নির সামনে। পা-গুলো অসাড়, এসি অফিসের মধ্যে দরদর করে ঘামতে লাগল তিন্নি, ওর হৃৎপিন্ডের লাবডুব শব্দ বোধহয় কলকাতার ট্র্যাফিকের আওয়াজ ছাপিয়ে সিকিম পৌঁছে গিয়েছিল। কাঁচের দেওয়ালটা ধরে নিজেকে মাটিতে পড়ে যাওয়া থেকে আটকালো তিন্নি। তবে যে ও এতবার ভগবানকে ডাকলো, চোখের জলে এতবার প্রার্থনা করলো, মনের প্রাণের বিশ্বাসের আরতি চড়ালো দিনের পর দিন, মাসের পর মাস – সব মিথ্যা? ভগবান বলে তবে সত্যিই কি কিছু নেই? হৃৎপিণ্ড যেন ঠান্ডা বরফ,কোনো অনুভুতি আসছে না তিন্নির মনে। একফোঁটা চোখের জলও বেরোলো না, ভিতরে ভিতরে হয়ে উঠছে অস্থির ও ভঙ্গুর। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর, দম বন্ধ হয়ে আসছে………আবার কি ব্ল্যাকআউট হয়ে যাবে? প্রানপন চেষ্টায় আরএকবার অভিমন্যুর গাঢ় বাদামি চোখদুটো ভেসে উঠলো মনের আয়নায় ঠিক তখনি সম্বিৎ ফিরে পেলো তিন্নি। শুকনো হয়ে আসা ঠোঁটটা একবার ভিজিয়ে নিলো তিন্নি, তারপর মাটিতে পড়ে থাকা ফোনটা কানে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ভেঙে পড়ার সময় নয় এটা। অনেকদিন পর তিন্নির চরিত্রের সেই খোলা তরবারি আবার বোধহয় ঝলসে বেরিয়ে এলো ওর “বেচারা” খাপ থেকে। চোয়াল শক্ত করে কর্নেল শ্রীবিষ্ণু রঙ্গনাথামকে স্পষ্ট গলায় জিজ্ঞেস করলো — “অভিমন্যু কেমন আছে?”

একটু সময় নিলেন কর্নেল, তারপর একটু গুছিয়ে নিয়ে বললেন — “ওয়েল, এটা বলবো না যে হি ইজ কমপ্লিটলি আউট অফ ডেন্জার বাট ডক্টরস থিঙ্ক হি উইল বি অলরাইট।”

কথাটা মাথায় রেজিস্টার হতে একসেকেন্ড সময় লাগলো, পরের দুইসেকেন্ডে তিন্নি ভেবে নিলো কি করা উচিত। নিজে জানেও না ও কি বলতে চলেছে, আদৌ তা সম্ভবপর কিনা। এই মুহূর্তে মনের কথা, মাথার কথা আর মুখের কথার মধ্যে কোনো তালবন্ধন নেই। শুধু এটুকু বোধ আছে, আজ আর ইতস্তত করলে চলবে না, যেকরেই হোক নিজের সর্বশক্তি দিয়ে সবাইকে কনভিন্স করাতেই হবে। হয়তো কেউ মুখের ওপর সরাসরি “না” করবে, এই তো? কোনো চেষ্টা না করে গুমড়ে মরার থেকে মনের অনুচ্চারিত প্রশ্নগুলো মুখে এনে “না” শোনা ভালো! একটুও না ভেবে সাহস করে মনের কথাটা বলেই ফেললো তিন্নি।
—- মে আই কাম টু ভিসিট হিম স্যার? প্লিজ স্যার, আই রিয়েলি নিড টু সি হিম।

থমকে গেলেন কর্নেল, এটা হয়তো উনি আশা করেননি। কি ভেবে, হয়তো বা তিন্নির কাতর আবেদনেই মন ভিজে উঠলো ওনার –“ ইয়েস ইউ মে ..বাট …”

— আই আ্যম কামিং আ্যজ সুন্ আ্যজ পসিবল।
আর কিছু শোনার প্রয়োজনবোধ করলো না তিন্নি, ফোন কেটে দিলো।

পরের কাজগুলো খুব দ্রুতগতিতে হলো – নিজের ডেস্কে দৌড়ে ফিরে এসে মেকমাইট্রিপ, ইন্ডিগো, স্পাইসজেট যাবতীয় অনলাইন ওয়েবসাইট চেক করতে লাগলো তিন্নি, শিলিগুড়ির নেক্সট ফ্লাইট কখন। বেলা খুঁজতে খুঁজতে একটাই পেলো, দুপুর ৩টে নাগাদ কলকাতা থেকে ইন্ডিগোর ফ্লাইট, বিকেল ৪টের মধ্যে শিলিগুড়ি পৌঁছবে। সাধারন সময়ের থেকে দ্বিগুনের বেশি ভাড়া, তাতে কিছু যায় আসে না তিন্নির। ক্রেডিট কার্ড দিয়ে টিকিট বুক করে কনফার্মেশন মেইল চলে আসতেই আবার দৌড়ে এলো কনফারেন্স রুমে। ঝড়ের গতিতে ভেতরে ঢুকে মিথিলেশকে বললো — “মিথিলেশ, আই হ্যাভ এ ফ্যামিলি ইমার্জেন্সি, আমাকে এখনই বেরিয়ে যেতে হবে।”

তিন্নির গলার স্বর আর বিপর্যস্ত চেহারা দেখে মিথিলেশ আদতেই উদ্বিগ্ন হয়ে বললো — “কি হয়েছে সীমন্তিনী? তোমার ফাদারের কিছু হয়েছে? আমাদের কোনো হেল্প লাগবে?”

আঁতকে উঠলো তিন্নি। বাবা!?? এরা কি ভাবছে বাবার কিছু হয়েছে?
মুখ ফস্কে সত্যিটা বেরিয়ে আসতে আসতেও তারপর নিজেকে আটকালো তিন্নি, যদি এরা তাই ভাবে, ভাবুক না, ক্ষতি নেই! কিন্তু এই মুহুর্তে অভিমন্যুর কাছে যাওয়াটা আরো বেশি জরুরী, তাতে বাবার নামে মিথ্যে এক্সকিউজ হলে তাই-ই সই। অস্পষ্ট গলায় মিথিলেশের শেষ প্রশ্নটার উত্তর দিলো —“না, কিন্তু আমার যাওয়াটা খুব দরকার!”

— ইটস ওকে, প্লিজ গো। কোনো হেল্প লাগলে জানিও, আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।

মিথিলেশ আর আটকালো না তিন্নিকে। ঘাড় নেড়ে আবার নিজের ডেস্কে ফিরে এসে সঙ্গী হ্যান্ডব্যাগ, মোবাইল ফোন আর ওয়ালেট হাতে নিয়ে ওডিসি ছেড়ে বেরিয়ে গেলো তিন্নি। এলিভেটরের জন্য অপেক্ষা করছিলো তিন্নি, চোখে পড়লো দূর থেকে দৌড়ে আসছে সায়ক। এলিভেটর আসার অপেক্ষা না করে ততক্ষনে চোদ্দতলা থেকে হাওয়ার গতিতে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেছে তিন্নি। হাঁফাতে হাঁফাতে অফিসের নিচে নেমে এসে সামনে যে ট্যাক্সি পেল, তাতেই উঠে পড়ে বললো – “দমদম চলো, ডোমেস্টিক এয়ারপোর্ট।“

ট্যাক্সি যখন নিউটাউনের ট্র্যাফিকে আটকে, তিনটে বড় বড় শ্বাস নিয়ে এবার বাড়িতে ফোন করলো তিন্নি, কাঁপা কাঁপা গলায় ডাকলো —- “বাবা?”

জীবনের শ্রেষ্টতম অভিনয়টা আজই করতে হবে ওকে, একটুও ভুলচুক হলে চলবে না।

**************************__****************************

অফিসে থাকাকালীন তিন্নি তো কোনোদিন ফোন করে না? সকালের ঘটনার জন্য মেয়ের বুঝি মন খারাপ হয়েছে! তিনবার রিং হওয়ার পর অল্প হেসে ফোন ধরলেন রঞ্জনবাবু – “হ্যাঁ রে মা, কি হয়েছে? হঠাৎ এখন ফোন করলি?”

ফোন রিসিভ করতেই যদিও রঞ্জনবাবুর গলা চেন্জ হয়ে গেল! ডুকরে ওঠা কান্নাটা চেপে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করতে করতে একনিঃশ্বাসে সাজিয়ে রাখা মিথ্যেকথাগুলো ছিটকে বার করে দিলো তিন্নি – “বাবা!! আমাদের প্রজেক্টের একটা নতুন ডেডলাইন চলে এসেছে, অনেক রাত অবধি থাকতে হবে অফিসে! জানি না, কখন কাজ শেষ হবে, লাস্ট ট্রেন ধরার রিস্ক নিতে পারবো না। প্লিজ, মা’কে জানিয়ে দিও আজ আর বাড়ি ফিরতে পারবো না।

তিন্নির গলাটা কেমন ভাঙা ভাঙা শোনাচ্ছে না? থমকে গেলেন রঞ্জনবাবু। তিন্নি তো কখনো এমন করে না! কি হয়েছে মেয়েটার? কোনো উটকো ঝামেলায় জড়িয়ে গেল কি? উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন – “তোর গলা শুনে মনে হচ্ছে তুই খুব চিন্তা করছিস, ভয় পেয়েছিস। কি হয়েছে মা? তুই কি বাইরে? গাড়ির আওয়াজ পাচ্ছি….. কোথাও যাচ্ছিস?”

— বাবা প্লিজ!!! সবসময় এতো প্রশ্ন করো না, বলছি না অফিসে একটা ঝামেলা হয়ে গেছে? প্রজেক্টের সবাইকেই থাকতে হবে, আর অত রাতে আমার পক্ষে বাড়ি ফেরা সম্ভব নয়, ব্যাস।!

জীবনে এই প্রথমবার বোধহয় রঞ্জনবাবুর সাথে চেঁচিয়ে কথা বললো তিন্নি! মুখ থেকে কথা গুলো ছিটকে বেরোনোর পরই নিগূঢ় অনুশোচনায় ডুবে গেলো তিন্নি, কেঁদে ফেলে বললো – “প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা করো বাবা! বিশ্বাস করো, খুব জরুরি না হলে এভাবে জানতাম না। আমি এখন কথা বলার মতো অবস্থায় নেই।“

স্তব্ধ গলায় রঞ্জনবাবু বললেন – “বাবার কাছে কিছু কি লোকাতে পারবি মা? তোর ওপর সে বিশ্বাসটুকু আছে, যাই করবি …. আমার সম্মানের কথা মাথায় রেখেই ভেবেচিন্তে করবি। টেনশন করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে।“

চাপা কান্নাটা গিলে নিলো তিন্নি, ভাঙা গলায় বললো —-“ মাকে একটু বুঝিয়ে বলো প্লিজ।”

— তোর মাকে বোঝানোটা একটু চাপের ব্যাপার রে মা, তারপর কাল আবার লক্ষীপুজো! তাও দেখছি কি করা যায়। তুই চিন্তা করিস না, ঈশ্বরের ওপর বিশ্বাস রাখ, সব ঠিক হয়ে যাবে।

— রাখছি।
ফোন কেটে দিয়ে মনে মনে বললো— “তোমার আশীর্বাদ যেন সফল হয় বাবা, সব যেন ঠিক হয়ে যায়।”

এয়ারপোর্টে পৌঁছে চেক-ইন করে যখন একটু বসার সুযোগ পেলো তিন্নি,ঘড়ির কাঁটা একটা পেরিয়ে গেছে। ডোমেস্টিক লাউঞ্জে একটা ওয়াশরুমে ঢুকে এতোক্ষনের জমে থাকা কান্নাটা গুমড়ে বেরিয়ে এলো, হু হু করে কেঁদে ফেললো তিন্নি! বেসিনের বয়ে যাওয়া ঠান্ডা জলের সাথে চোখের গরম নোনতা জল মিশে একাকার। অনেকটা চোখের জল বেরিয়ে যাওয়ার পর মনের চাপটা একটু হালকা হতে কর্নেল শ্রীবিষ্ণু রঙ্গনাথামকে রিংব্যাক করলো তিন্নি, দু-তিনবার রিং হতে ফোন রিসিভ হলো

— স্যার আমি সীমন্তিনী বলছিলাম …..।

ভারী গলা ভেসে এলো ওপ্রান্ত থেকে — “হ্যাঁ, বলুন। আপনি আসছেন তবে?”

— ইয়েস স্যার, আমি এখন কলকাতা এয়ারপোর্টে, গ্যাংটক পৌঁছে কিভাবে যাবো যদি বলতেন……

তিন্নির কথার মাঝেই কর্নেল রঙ্গনাথাম ওকে থামিয়ে দিলেন — “আপনি কি ৪:১০এর ফ্লাইটে শিলিগুড়ি নামছেন? “

তিন্নি এমন অবাক হলো যে জবাব দিতেই ভুলে গেলো! ফোনের ওপারে কর্নেল একটু হেসে বললেন —- “আমাদের লোক থাকবে শিলিগুড়ি এয়ারপোর্টে, আপনাকে এস্কর্ট করে নিয়ে আসবে।”

— অভিমন্যু কেমন আছে স্যার?

— ওর অপারেশন সাকসেসফুল, বাট হি হাজ্‘নট রিট্রিভ হিস্ সেন্সেস ইয়েট।

অনেককটা দ্বিধা ভরে জিজ্ঞেস করে ফেললো তিন্নি। — ওর ইনজুরি নিয়ে …. মানে …… ঠিক কি হয়েছিল? ক্যান ইউ গিভ মি এনি ডিটেলস?

— ইট ওয়াজ লো ভেলোসিটি উন্ড। একটা গুলি ছুঁয়ে বেরিয়ে গেছে, আদার ওয়ান বিট সিরিয়াস। বাট ডোন্ট ওরি, হি উইল বি অলরাইট। সী ইউ সীমন্তিনী।

কল কেটে দিলেন কর্নেল, ফোনটা হাতে নিয়ে শূন্য চোখে তাকিয়ে রইলো তিন্নি। কি হচ্ছে কেন হচ্ছে আর কিছু বোঝার মতো অবস্থায় নেই ও! এটাই দেখার ভাগ্য ওকে আর কোথায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে!

**************************__****************************

কলকাতা থেকে খাতায় কলমে মাত্র একঘন্টার ফ্লাইট, আসলে সময় লাগে আরো কম! মিনিট চল্লিশেই শিলিগুড়ির মাটি ছুঁলো ইন্ডিগোর ফ্লাইট। শিলিগুড়িতে পৌঁছে আর কোনো অসুবিধা হলো না, এয়ারপোর্টের বাইরেই জীপ্ নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল দুজন আর্মির লোক, ওরই প্রতীক্ষায়। নির্বাক এগিয়ে গেলো তিন্নি। প্রায় সাড়ে চারমাস পর আবার নর্থবেঙ্গলের মাটিতে পা রেখে মাথাটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে, দূরের জমাট সবুজ পাহাড়গুলোর দিকে একপলক চোখ গেলো, অভিমন্যুর ছায়া যেন এই সবুজ পাহাড় আর নর্থবেঙ্গলের জংলী হাওয়াতেই মিশে আছে। আজ এতগুলো মাস পর প্রাণের শহরে ফিরে আলাদা কোনো অনুভূতিই হচ্ছেনা তিন্নির। গ্যাংটক যাওয়ার প্রিয় রাস্তার বড্ড চেনা দৃশ্যপটগুলোও আজ আর টানছেনা ওকে। কেবল মনে হচ্ছে কতক্ষনে নার্সিংহোমে পৌঁছবে! আস্তে আস্তে শেষ বিকেলের ময়লা আকাশ তখন ফিকে আলোতে সাজছে– পাহাড়ের গা বেয়ে দ্রুতবেগে ছুটে চলছে ওদের জীপ্। দিনের আলো নিভতে চুলের কাঁটার মতো পাহাড়ি বাঁকগুলো ক্রমশ অস্পষ্টতর হচ্ছে। ওর সাথে কোনো লাগেজে নেই, সাথের হ্যান্ডব্যাগটা ছাড়া! আবছা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ওটাকেই আঁকড়ে ধরে বসে রইলো তিন্নি, সারাটা রাস্তা একটাও কথা না বলে। কতক্ষন পেরিয়ে গেছে কোনো হুঁশ নেই, মনের মধ্যে চলে যাওয়া উথলপাতাল কালবৈশাখীর ঢেউ থমকে গেলো ড্রাইভারের গলা- “এসে গেছি ম্যাডাম। “

I am a soldier.
Army is my life.
Nation is my pride.

গ্যাংটকের আর্মি হসপিটালে ঢোকার ঠিক আগের মুহূর্তে গেটের আগে একটা বিলবোর্ডে নজর পড়লো তিন্নির। নিকষ কালো রাতে হলদে আলোয় জ্বলজ্বল করছে ইংলিশ হরফের লেখাগুলো। স্থিরদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইলো তিন্নি। জেনেশুনে যে বিষ মুখে দিয়েছে ও, এখন তো তার কনসেকোয়েন্স মেনে চলতেই হবে। কবেই নিজের ভালোবাসাকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়েছে ও। একমাত্র ভরসা ছিল পরম শক্তিমান ঈশ্বরের ওপর, কর্নেল স্যারের আজকের ফোনকলের পর আর একবারও ঈশ্বরের নাম মুখেও আনে নি তিন্নি।
যখন তিন্নি পৌঁছলো তখন রাত প্রায় সাড়ে সাতটা। সকাল থেকে বোধহয় একগ্লাস জলও খায় নি, মুখ চোখ বসে গেছে, শরীর আর দিচ্ছে না ওর। শুধু মনের জোরে এগিয়ে গেল সার সার কেবিনের দিকে। দূর থেকে ওকে দেখতে পেয়ে কর্নেল শ্রীবিষ্ণু রঙ্গনাথাম এগিয়ে এলেন, তিন্নির মুখের দিকে চেয়েই বোধহয় কথা না বাড়িয়ে অভিমন্যুর কেবিন দেখিয়ে দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।

এরপর??
এতোক্ষনের ধরে রাখা মনের জোরের আর ছিঁটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই। ভারীপর্দা সরিয়ে সামনে এগোনোর জন্য একটা পা’ও এগোলো না, একচুল না নড়ে স্থানুর মতো দাঁড়িয়েই রইলো তিন্নি । কতক্ষন ওভাবেই দাঁড়িয়েছিল কে জানে, হঠাৎ চমক ভাঙলো একজন সাদা আ্যপ্রোন, গলায় স্টেথো ঝোলান সৌম্যদর্শন ডাক্তারের ডাকে
— “এতরাতে এখানে আপনাকে কে আ্যলাও করলো? এখন পেশেন্টের সাথে দেখা করা যাবে না।”

— সরি স্যার। আমি কলকাতা থেকে এখনই ছুটে আসছি, ওর…. মানে অভিমন্যু সেনের খবর পেয়ে ……..
চটকা ভেঙে আবছা গলায় আমতা আমতা করে জবাব দিলো তিন্নি।

— ওহ আপনিই তিনি? অভিমন্যুর এমারজেন্সি কন্ট্যাক্ট?

ক্রস কোশ্চেনটা গায়ে মাখলো না তিন্নি, পাল্টা প্রশ্ন করলো — “অভিমন্যু কেমন আছে স্যার? কি করে এমন হলো…..”

—- হি ওয়াজ কট বিট্যুইন ক্রসফায়ার। একটা গুলি হাতের মাসলে টাচ্ করে বেরিয়ে যায়, দ্য আদার ফ্যাটাল ওয়ান ওয়াজ স্নাইপার শট, বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট থাকার জন্য ইট বিকেম লো ভেলোসিটি উন্ড।

উফফ্! কি কষ্ট।
দমবন্ধ হয়ে এলো তিন্নির, থরথর করে কেঁপে উঠলো ঠোঁট। অনেক কষ্টে হারিয়ে যাওয়া ভাষা খুঁজে পেল —- বুলেট প্রুফ জ্যাকেটে ছিল….. তারপরও?

—- যুদ্ধের ময়দানে ম্যাথেমেটিক্স আর স্ট্যাটিস্টিক্স কাজে আসে না মিস আচারিয়া। ইয়েস, দিস ইজ ওয়ান অফ দ্য রেয়ারেস্ট কেস বাট ডোন্ট ও্যরি, অভিমন্যু ইজ ইয়াং আ্যন্ড স্ট্রং, হি উইল বী ফিট আ্যন্ড ফাইন বাই টুমরো…. কাল বা পরশুই ফ্লিডওয়ার্ক না হলেও আদার ডিউটিতে জয়েন করতে পারবে!

সব ভুলে কিছুক্ষন হাঁ করে তাকিয়ে রইলো তিন্নি! কি অবলীলাক্রমে এই পরিস্থিতিতেও ডিউটি নিয়ে চিন্তা করছে! এরা মানুষ??

পোড়খাওয়া আর্মি ডাক্তার তিন্নির মুখের অবস্থা দেখেই ব্যাপারটা বুঝে নিলেন, প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন
—- “আপনার নিশ্চয়ই থাকার জায়গা নেই। কর্নেলস্যরকে বলে দেখি, তেমন হলে আজ রাতের জন্য হসপিটালের স্টাফ কোর্য়াটারে আপনার থাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে ।“

না! না!
মাথার সবক’টি নিউরোন একযোগে বিদ্রোহ ঘোষনা করে দিল, এতদুর থেকে তিন্নি ছুটে এলো সে কি স্টাফ কোর্য়াটারে থাকার জন্য?আজ আর ইতস্তত করলে চলবে না, বড়োজোর না বলবে, এই তো? একটু দোনামোনার পর সাহস করে মনের কথাটা বলেই ফেললো — “স্যার আমি কি এখানে থাকতে পারি ওর সেন্স না আসা অবধি?”

— সরি মিস আচারিয়া। আমরা আল্যাউ করতে পারবো না!

— প্লিজ স্যার ……. আমি কাউকে বিরক্ত করবো না, এককোনায় চুপ করে পড়ে থাকবো! আই রিক্যোয়েস্ট ইউ স্যার।

বলতে বলতে বারবার গলাটা কেঁপে উঠলো, আত্মসম্মান বজায় রেখে যতটা কাতর আবেদন করা যায় তাই করলো তিন্নি, হয়তো তার থেকেও বেশী। বয়ষ্ক ডাক্তারের বোধহয় একটু মায়া হলো, মনে মনে ভাবলেন কতটুকুই বা বয়স মেয়েটির, হয়তে বা ওঁনার আপন সন্তানেরই বয়সী। চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন —- “লেট মি সী হোয়াট আই ক্যান ডু! “

আবারও অপেক্ষা। টিকটিক করে এগিয়ে যাচ্ছে ঘড়ির কাঁটা আর একটু একটু করে শরীর ছেড়ে দিচ্ছে তিন্নির। যেকোন মুহুর্তে ব্রেকডাউন হয়ে যাবে ওর। ঘন্টাখানের পর ফিরে এলেন কর্নেল আর সেই সৌম্যদর্শন ডাক্তার
—- ও.কে। ইউ ক্যান স্টে হিয়ার। বাট রিমেম্বার দিস ইজ আ্যন এক্সেপশন, এ ভেরি রেয়ার এক্সেপশন।

চোখের জলগুলো আর আটকানোর চেষ্টা করলো না তিন্নি, কান্নার দমকে বুজে আসা গলায় কোনরকমে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বললো — “থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।”

কর্নেল আর ডাক্তার দুজনেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, কিছুক্ষন পর ভারী গলায় অনুমতি দিলেন —- ইউ মে ভিসিট হিম ইফ ইউ ওয়ান্ট। টেক কেয়ার মিস আচারিয়া।

দুইজোড়া জুতোর ভারী শব্দগুলো মিলিয়ে গেল গ্যাংটকের আর্মি হাসপাতালের শুনশান বারান্দায়, কোথাও জনমানুষের অস্তিত্ব নেই যেন। খোলা অলিন্দ দিয়ে বয়ে আসছে হাড়কাঁপানি হু হু ঠান্ডা হাওয়া, কলকাতার থেকে প্রায় দশ পনেরো ডিগ্রী কম টেম্পারেচার, সেখানে তিন্নির পরনে একটা পাতলা সাদা চিকনকারী চুড়িদার কামিজ। শিঁড়দাঁড়া বরাবর এক শীতল কম্পন বয়ে গেল যেন, অনেকটা ঠান্ডাবাতাস বুকভরে টেনে নিয়ে অভিমন্যুর কেবিনে পা দিল তিন্নি।

***********************__******************************

সবুজ আর সাদা পর্দা ঝোলানো, ওষুধ আর কেমিক্যালের গন্ধে মাথা ধরে যায়। লোহার সরু বেড, সবুজ চাদরে ঢাকা, তারওপর শুয়ে আছে অভিমন্যু। চোখ বোজা, কোমর থেকে পা অবধি পাতলা কম্বলে ঢাকা,হাতে আর বুকে পুরু ব্যান্ডেজ। পাশে স্যালাইন ঝোলানো। কতদিন পর মানুষটার মুখ দেখলো তিন্নি, বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠলো অব্যক্ত যন্ত্রনায়। দীর্ঘ সাড়ে চার মাসের বিচ্ছেদের পর অভিমন্যু আর ওর আবার দেখা হওয়া নিয়ে কি কি স্বপ্নই না দেখেছিলো তিন্নি, কিন্তু এমন বাস্তব বোধহয় অতিবড় দুঃস্বপ্নেও আসে না কারোর। হসপিটালের সরু বেডে অসহায়ের মতো পড়ে থাকা সিডেটিভে আচ্ছন্ন মানুষটাকে খুব ইচ্ছে করছিলো সপাটে জড়িয়ে ধরে, ওর সাদা ব্যান্ডেজে জড়ানো বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলে ” এই দ্যাখো আমি এসেছি! একবার তো চোখ মেলে তাকাও।”
কিন্তু এতো সিনেমা নয় যে তিন্নি অভিমন্যুর বুকে মাথা রাখলেই ম্যাজিক টাচে অভিমন্যুর জ্ঞান ফিরে আসবে! চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এলো তিন্নির, থরথর করে কেঁপে উঠলো ঠোঁট তাও প্রানপনে নিজেকে আটকালো একফোঁটা চোখের জলও যেন গড়িয়ে না পড়ে। ডেটল আর লাইজলের গন্ধ মেশানো ঠান্ডা বাতাস নিঃশ্বাসের সাথে টেনে নিলো অনেকটা তারপর যন্ত্রমানবীর মতো অভিমন্যুর বেডের পাশে একটা টুল টেনে নিয়ে ওর কড়া পড়া শক্ত হাতটা নিজের বরফের মত ঠান্ডা হাতে নিয়ে পাথরের মূর্তির মতো অধীর অপেক্ষায় বসে রইলো — কখন অভিমন্যু চোখ মেলে তাকাবে।

রাত বোধহয় দুটো কি তিনটে হবে, অভিমন্যু ভারী হয়ে থাকা চোখদুটো খুললো! আবছা হলদে আলোয় কিছু বোঝা যায় না ভালো, ওর বিছানার পাশে সাদা চুড়িদার কামিজ পরে কে বসে আছে?
কোনো নার্স কি? নরম, ঠান্ডা হাতের স্পর্শটা খুব চেনা, মনের বড্ড কাছের! ভালো করে চোখ খুলে তাকাতে প্রথমে বিশ্বাস হলো না ওর! এখনো কি স্বপ্ন দেখছে? অস্পষ্ট মুখটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠতে অভিমন্যু দেখলো তিন্নি ওর দিকে চেয়ে। স্লো মোশনে টপটপ করে দুফোঁটা ফুটন্ত গরম চোখের জল তিন্নির গাল বেয়ে গড়িয়ে এসে পড়লো অভিমন্যুর হাতে, তারপর সেই নারী তার চিরপরিচিত, চিরপ্রতীক্ষীত কান্নাভেজা হাসি হাসতে অভিমন্যু অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। অনেকগুলি নিঃস্তব্ধ মিনিট পার হয়ে যাওয়ার পর বহুকষ্টে শুকনো ঠোঁটদুটি নড়ে উঠলো ওর — “তুমি এখানে?”

কোনো কথা না বলে ম্লান হেসে তিন্নি তাকিয়ে রইলো অভিমন্যুর দিকে যতক্ষন তাকিয়ে থাকা যায়। তারপর প্রবল বাতাসে উড়ে চলা শুকনো ম্যাপেলপাতার মতো কাঁপতে কাঁপতে লোহার টুল থেকে পড়ে গেল ঠান্ডা সিমেন্টের মাটিতে, অজ্ঞান হয়ে।

ক্রমশঃ
© সুমন্দ্রা মিত্র। ভালো লাগলে নামসহ শেয়ার করবেন।

***********************__******************************

সকল পর্বের লিঙ্ক~
Video Teaser
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145475543838322/?vh=e&d=n
Part 1
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145129087206301/?d=n
Part 2
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145859077133302/?d=n
Part 3
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/146221053763771/?d=n
Part 4
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/146595433726333/?d=n
Part 5
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/147293876989822/?d=n
Part 6
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148075966911613/?d=n
Part 7
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148530310199512/?d=n
Part 8
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148951006824109/?d=n
Part 9
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/149405760111967/?d=n
Part 10
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/150313546687855/?d=n
Part 11
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/151106323275244/?d=n
Part 12
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/151923336526876/?d=n
Part 13
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/152353663150510/?d=n
Part 14
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/154065792979297/?d=n
Part 15
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/156163186102891/?d=n
Part 16
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/157132182672658/?extid=QdVQFGSjLzQUsE31&d=n
Part 17
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/157444422641434/?extid=fI3jIc0PCiYXDa0N&d=n
Part 18
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/158095955909614/?extid=1E2JOZfMCmqscBoi&d=n
Part 19
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/158831902502686/?extid=R8zo6L2l274CIQ7r&d=n
Part 20
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/159626782423198/?extid=0e8jrLLhsuLqgsQX&d=n
Part 21
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/160047349047808/?extid=e9DIdFXAkqxTg77U&d=n
Part 22
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/160963752289501/?extid=EgYDh0z3hVr5TCBY&d=n
Part 23
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/161833698869173/?extid=gRK0HHMoLW0bu0gK&d=n
Part 24
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/162740122111864/?extid=KIR9o3zetBHgH9mt&d=n
Part 25
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/163061178746425/?extid=fhzBxEjnlA7n6Ulu&d=n
Part 26
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/163695728682970/?extid=tm0Y81ykORQhpsq9&d=n
Part 27
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/164305438621999/?extid=WsYE2BjXkYvPmqyF&d=n

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here