#সূর্য_ডোবার_আগে
পর্ব-৩১
লেখিকা ~ #সুমন্দ্রামিত্র
কঠোরভাবে প্রাপ্তমনষ্কদের জন্য।
.
.
নভেম্বরের শুরু, বাতাসে হালকা শীতের আমেজ ছড়িয়ে। কালীপুজো ভাইফোঁটার পালা সবে শেষ হয়ে এখন বাঙালীর উৎসবহীন ম্যাড়মেড়ে রোজনামচা জীবন। ভোরবেলায় ঘাসে ঘাসে জমে থাকে জমাট শিশির। মোয়া আর নতুন গুড়ের গন্ধ মেখে থাকা নরম লেপমুড়ি দিয়ে ধোঁয়া ধোঁয়া সকালের দিনগুলিতে হিমের আলসেমিটা গায়ে মাখতে মাখতে শহর জেগে ওঠে আর নির্ঘুম তিন্নির চোখে লেগে থাকে জমাট কান্না।
শ্রীরামপুরের ফিরিঙ্গিডাঙা মোড়ের আচার্য্যবাড়িতে আজকাল বিরাজ করে এক চরম নিস্তব্ধতা। মা-মেয়ের সরাসরি কথা বন্ধ যদিও ভাস্বতীদেবীর ছিটকে আসা তির্যক বাক্যবাণ, অপমানের হুল এবং বিদ্রুপ বন্ধ হয় নি।
তিন্নি জবাব দেয় না, যেটুকু সময় বাড়িতে থাকে- মুক ও বধির সেজে থাকে! এই কয়েকদিনে বোধকরি গন্ডারের থেকেও পুরু হয়ে গেছে ওর গায়ের চামড়া। মাঝে মাঝে এক একটি সুতীব্র অপমানের ছুরি ফালা ফালা করে দেয় হৃৎপিন্ড তাও তিন্নি মনে চাপিয়ে নিয়েছে নিস্পৃহ কর্ত্যব্যের অভেদ্য বর্ম, অদৃশ্য তুলো কানে গোঁজা সর্বক্ষন। রঞ্জনবাবুর সাথেও তিন্নির আগের মতো সেই সহজ সরল সম্পর্ক আর নেই। নিঃশব্দে কাঁদে তিন্নি, মাঝে মাঝে গুমরে ওঠে তীব্র অভিমানে। নিজের লোকেদের থেকে আত্মসম্মানে ঘা পাওয়া বুঝি সবচেয়ে বড়ো আঘাত।
ছোট থেকে অবহেলা পেতে পেতে মা’র থেকে কোনোদিনই বিশেষ কোনো প্রত্যাশা ছিল না তিন্নির, কিন্তু শেষে বাবাও বুঝলো না ওকে? বয়ঃসন্ধিকাল থেকে থেকে তিন্নির আত্মসম্মান গড়ে তোলার মুখ্য কারিগর, তিন্নির সকল বিপদে ঢাল হয়ে যিনি দাঁড়িয়েছিলেন সবসময়, উচিত-অনুচিত, সত্যি-মিথ্যের ফারাক বোঝানো, কবিতার পাঠ দেওয়া যে মানুষটিকে তিন্নি দেবতার আসনে বসিয়েছিলো, এতো ন্যায়শিক্ষার শেষে সেই মানুষটাও যে বিয়েটাই তিন্নির জীবনের মুখ্য পরিণতি বলে মনে করেন- সে আঘাতটাই বড়ো বেশি বুকে বেজেছে তিন্নির, আরো বেশি কষ্ট পেয়েছে যখন ওর মতামত নেওয়ার প্রয়োজন বোধটুকুও কেউ করে নি। যেন সংসারে ও একটা বোঝা, ঘাড় থেকে নামিয়ে দিলেই শান্তি।
যে বাড়িটাকে তিন্নি নিজের বাড়ি বলে ভাবতো, আজ ঠারে-ঠোরে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে এই বাড়ি তার নয়, এখানে সে ক্ষনিকের অতিথি মাত্র। যে পরিবারের সাথে সময় কাটানোর জন্য গত দুই বছরের ডেলি প্যাসেঞ্জারির কষ্ট মাথায় তুলে নিয়েছিল তিন্নি, আজ বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে এই পরিবার তার নয়, তিন্নির আসল পরিবার অপেক্ষা করছে অন্য কোথাও – মা’বাবার দেখে শুনে বুঝে নেওয়া কোনো এক অপরিচিত ফ্যামিলি যার সাথে তিন্নিকে কাটাতে হবে সারাজীবন। কারণ এটাই নরমাল – সমাজের নিয়ম। এ ব্যাপারে তিন্নির মতামতের দরকার নেই কারণ “মা বাবা কি সন্তানের খারাপ চায় কখনো”?
তাই নিজেকে বড্ডো গুটিয়ে নিয়েছে তিন্নি, একমনে শুধু দিন গুনে যায় কবে ডিসেম্বর আসবে। একটি আনপ্লানড্ ট্রিপ তিন্নির পৃথিবী ওলোটপালোট করে দিয়েছে, এক অনিশ্চিত ভালোবাসাকে কাছে এনে দিয়েছে – তারই সাথে চিরপরিচিত লোকগুলিকে দূরের করে দিয়েছে। নিজের পরিবারের সাথে নিঃশব্দ যুদ্ধ লড়তে লড়তেই তিন্নি ঠিক করেছিল যা’ই হয়ে যাক না কেন, অভিমন্যুকে একটা কথাও জানানো যাবে না।
এক তো সে পড়ে আছে দেশের কোন দুর্গম প্রান্তরে, প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ানো অতন্দ্র প্রহরী, সেই মানুষটিকে নিজের অশান্তিময় জীবনের দুঃখের পালাগান শুনিয়ে আরো ব্যতিব্যস্ত করতে চায় না তিন্নি। সাথেসাথে বুকের কোন গভীরে গিয়ে মানে লেগেছিলো ওর, নিজের অসহায়তার জন্য আরেকজনের কাছে সদ্য শুরু হওয়া সম্পর্কের বার্ডেন চাপিয়ে দিতে। মা-বাবার থেকে পাওয় এই অবহেলা-কষ্টগুলো, অপমান, যন্ত্রনাগুলো যে নিতান্ত ব্যক্তিগত, একমাত্র ওর নিজের!
তাই অভিমন্যুর ফোন এলে নিখুঁত অভিনয় করে যায় তিন্নি, ভালো থাকার অভিনয় – খুশি থাকার অভিনয়। শব্দহীন অশ্রুগুলো লুকিয়ে নেয় মেকিহাসির আওয়াজে, রুদ্ধ হয়ে আসা স্বর বদলে নেয় ঠান্ডা লাগার অজুহাতে। তিন্নির সারাদিনের ঊষর রুক্ষজীবনে মিনিটকয়েকের ফোনকলটুকুই যে একঝলক টাটকা দখিন বাতাস, পরেরদিনটি বেঁচে থাকার জীবনীশক্তি, অমৃতসুধা। ওই সময়টুকু জগৎসংসার সবকিছু ভুলে যায় তিন্নি, আবার ফিরে পায় নিজেকে, নিজের মতো করে। অভিমন্যুর সাথে কথা বলে তিন্নি ফিরে পায় তার হারিয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস, নতুন করে যুদ্ধ লড়ার সাহস।
Falling in love with you did not make sense
Yet, I fall head over heels every time I listen to your breaths.
To love you was the hardest thing I did
Tangled, intense and intricated that’s how I feel.
To be held in your arms, it felt so right
The thought of being together is keeping me up all night.
We cannot control the distance between us
We cannot constraint, our feelings are out of hand.
I scream at loudest, yet you can’t hear them
My silent tears were not to be condemned.
It wasn’t easy when I wished upon Every falling star
Believing in destiny that one day I’ll get what I want.
I will wait for you my Love! Does not matter if forever,
I will Always hold onto you that one day we’ll be together.
I will Always love you. Today tomorrow, forever and ever.
**************************__****************************
~ ফেয়ারওয়েল সায়ক। বেস্ট উইশেস ফর নেক্সট!
বাটারক্রিম ফ্রস্টিং সাদা কেকের ওপর আঁকা বাঁকা চকোলেট গানাশের ল্যাটিন হরফে লেখা লাইনদুটি। সবার তুমুল হাততালির মাঝে লজ্জা পাওয়া আরক্ত মুখে কেক কাটলো সায়ক।
আজ ওর লাস্ট ডে এই কোম্পানিতে, ক্যাফেটেরিয়ায় একটা ছোট্ট ফেয়ারওয়েল পার্টির আয়োজন করা হয়েছে প্রজেক্টটিম থেকে, তিন্নিও আছে। টিমের তরফ থেকে মিথিলেশ সায়কের হাতে তুলে দিল বিদায়ী স্মারক এবং তারপর ছোট্ট একটি গতানুগতিক স্পিচ্ – প্রজেক্টে সায়কের অবদান আর থ্যাঙ্কইউ নোট।
এরপর কেক কাটার পালা, তা সাঙ্গ হতেই টিমের বাকিরা হইহই করে উঠলো
– স্পিচ্! স্পিচ্! লাস্ট ডে রোস্টিং। স্পি-ই-চ্!
— এই না না ! আমি কিছু রেডি করে আসি নি।
লজ্জা লজ্জা মুখে হাতপা নেড়ে ছাড়া পাওয়ার ভান করছিলো সায়ক, পেছন থেকে কে একজন চেঁচিয়ে উঠলো – স্পিক্ ইওর হার্ট আউট ম্যান! যা মনে আছে বলে দে আজ।
কান এঁটো করা লজ্জা লজ্জা মুখ করে হাসলো সায়ক। তারপর গলা খাঁকরি দিয়ে শুরু করলো
— থ্যাংক ইউ সো মাচ গাইজ, আ্যকচ্যুয়ালি থ্যাংক ইউ ইজ নট এনাফ! কলেজ পাসআউট ফ্রেশার্স থেকে সফটওয়্যার আ্যনালিস্টের পথ তা সহজ ছিল না! এই প্রজেক্টে আছি দুইবছরেরও বেশি, সব সিনিয়ররা হাতে ধরে কাজ শিখিয়েছো, ভুল করলে বকেছো, কোডিং করা শিখিয়েছো। মিথিলেশদা, প্রবালদা তোমাদের সবাইকে মেন্যি মেন্যি থ্যাঙ্কস আমার যাবতীয় ভুলত্রুটিগুলো শুধরে দেওয়ার জন্য। এরপরও একজনের কথা না বললেই না, সে হলো সীমন্তিনী।
ক্যাফেটেরিয়ার দেড়মানুষ প্রমান স্বচ্ছ জানলার কাঁচে আঁকাবাঁকা ছায়া, বাইরের ছাইরঙা আকাশ ঢাকা ধুলো কুয়াশার জমাট মেঘে। দূরের নলবনের ধোঁয়াটে নীল জলরাশি আর এভারগ্রিন কলকাতার দিকে আনমনা হয়ে তাকিয়ে থাকা তিন্নি সায়কের কণ্ঠে হঠাৎ নিজের নাম শুনে চটকা ভেঙে চমকে উঠলো!
অবাকচোখে চড়ুইপাখির মতো ছোট্ট হাঁ করে তাকিয়ে রইলো সায়কের দিকে, আর টিমের সবার চোখ তখন তিন্নির দিকে।
সবকটা দাঁত বার করে হেসে সায়ক বললো
— ইয়েস, সীমন্তিনী! আমার খুব ভালো বন্ধু!
এই অফিসে ছেড়ে যেতে একমাত্র ওকেই আমি মিস করবো! ওর সাথে আমার ঘন্টার পর ঘন্টা কাটানো মুহূর্তগুলো, ক্যাফেটেরিয়ায় একসাথে লাঞ্চ করা, নিচের ফুটে চা খেতে খাওয়া,সিসিডিতে কফি, সিকিমে আমাদের ঘুরতে যাওয়া, ওর কোডিং, প্রেজেন্টেশন স্কিল মানে কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি! সব মিলিয়ে আমি ওর ডাই হার্ট ফ্যান!
কি তাই তো সীমন্তিনী? তুই আবার রাগ করছিস না তো এসব শুনে? ওহ্ কাম অন! আজ আমার লাস্ট ডে, আজ তো আমায় বলতে দে! কাল থেকে তোর একার রাজত্ব!
মুখটা হাঁ’ই হয়ে রইলো তিন্নির!
কি বলে যাচ্ছে এসব সায়ক? হাতে গোনা কযেকটা দিনের কথা এভাবে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে রোজানামচার মতো কেন বলছে টিমের সবার সামনে। টিমের দু তিনজনের চোখে অবিশ্বাসের দৃষ্টি আর বেশিরভাগের ঠোঁটেই মুচকি বিদ্রুপ!
মিথিলেশ এগিয়ে এসে সায়কের কাঁধে একটা হাত রাখলো
— আই থিঙ্ক ইউ গট টু’উ এক্সসাইটেড! লেটস হ্যাভ দ্য কেক, শ্যাল উই?
টিমমেটদের হাসিঠাট্টা আর লাস্ট সেলফির দৌলতে তখনকার মতো কথাটা ধামাচাপা পড়ে যেতেও তিন্নির মুখের অন্ধকার আর ঘুচলো না, এককোণে চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিল ও!
সবাই কেক নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তে সায়ক ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে ওর থেকে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে হাসি হাসি গলায় বললো
—– সীমন্তিনী, তুই কিছু মনে করিস নি তো? সত্যিই আমি হয়তো একটু বেশিই এক্সসাইটেড হয়ে পড়েছিলাম! আসলে এসব স্পিচ দেওয়ার অভ্যেস নেই তো, কিছু প্রিপারেশনও ছিল না! যা মুখে এসেছে তাই বলে গিয়েছি! বাদ দে না! আজ আমার লাস্ট ডে, প্লিজ রাগ করিস না? কাল থেকে আর দেখা হবে না, লেটস ডিপার্ট অন এ গুড নোট।
পাছে মনের তেঁতোভাব মুখে চলে আসে সেই ভয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না তিন্নির, সায়কের বাড়িয়ে রাখা হাতটা ধরতেও মন চাইছিলো না।
দেখেই সায়কের দাঁত বের করে রাখা আলো আলো মুখটা ঝুপ করে অন্ধকার হয়ে গেলো। চোখে মুখে একটা দুঃখ দুঃখ ভাব ফুটিয়ে বললো
— সীমন্তিনী, কাউকে লাইক করা ক্রাইম কিনা আমি জানি না! আমার তোকে জেন্যুইনলী ভালো লাগতো আর একটা ভুল ধারণা ছিল… মে বি তুইও আমায় লাইক করিস। কিন্তু সেগুলো সবই পাস্ট! তোর “না”শোনার পর থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি আমি। কিন্তু, তারপরও তুই এমন একটা বিহেভ করছিস যেন নিজের ফিলিংসটা তোর সাথে শেয়ার করে চূড়ান্ত অপরাধ করে ফেলেছি! জাস্ট পুট ইউরসেল্ফ অন মাই শু আ্যন্ড ইউ উইল আন্ডারস্ট্যান্ড হোয়াট আই আ্যম গোয়িং থ্রু।
সায়কের স্পষ্ট কথাগুলো শুনে একটু অপ্রস্তুতে পড়ে গেলো তিন্নি। মনে মনে ভাবছিলো, সত্যিই তো এভাবে ও কোনোদিন ভেবে দেখে নি! তাছাড়া যাওয়ার আগে অযথা তিক্ততা বয়ে বেরিয়েই বা কি লাভ! ক্যাজুয়ালি হেসে, সায়কের বাড়িয়ে রাখা হাতটা ধরে বললো
— থ্যাংক ইউ ফর বিয়িং এ ফ্রেন্ড টু মি ইন দিস প্রজেক্ট। অল দ্য ভেরি বেস্ট অন ইওর নেক্সট ভেঞ্চার। নতুন অফিস. নতুন পরিবেশ – খুব ভালো থাকিস আর খুব ভালো করে কাজ করিস। এই অফিস ছেড়ে দিতে হলে পরে তোর’ই কাছে রেফারাল চাইবো কিন্তু!
দুজনেই হেসে ফেললো, তারপর সায়ক বললো
— যাওয়ার আগে তোর এই হাসিটাই মিস করছিলাম রে! ভালো থাকিস! আর অবশ্যই, যদি কোনোদিন কোনো হেল্প লাগে …. মনে রাখিস আই আ্যম জাস্ট ওয়ান কল আ্যওয়ে।
.
.
.
কাজের মধ্যে ডুবে থাকলে হুস করে সময় কেটে যায়।
ক্যাফেটেরিয়ার কেকপর্ব সমাপ্ত হওয়ার পর ঘন্টাদুই পেরিয়ে কখন যে ঘড়ির কাঁটা ছয়টায় পৌঁছে গেছে, তিন্নি খেয়ালই করে নি। আচমকা কম্পিউটার স্ক্রিনের টাস্কবারে চোখ পড়তে চমকে উঠলো। নাহ্! আর দেরি করলে হয়তো ছয়টা পঞ্চান্নোর লোকাল মিস হয়ে যাবে!
সারাদিনের কাজের ধকলের পর আবার দেড় দুই ঘন্টা ভিড় ঠেলে অশান্তিময় বাড়ির পরিবেশে ফিরতে ইচ্ছে করে না, তাও ফিরতে তো হবেই। জলদি হাতে পেন্ডিং টাস্কগুলো ড্রাফট করে বেরোনোর জন্য নিজের সিট্ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো তিন্নি।
ফ্রাইডে ইভনিং, অফিসও প্রায় ফাঁকা হয়ে এসেছে, দুমদাম আওয়াজে চোখে পড়লো একটু দূরে সায়ক ওর কম্পিউটার নিয়ে ধস্তাধস্তি করছে। তিন্নি উঠে দাঁড়াতেই দুর থেকে অপ্রস্তুতের হাসি হাসলো সায়ক
— কি জ্বালা দেখেছিস? লাস্ট ডে আর এমনসময়ই কম্পিউটারটা বিগড়োতে হলো!
চোখ কপালে উঠলো তিন্নির! আজ না সায়কের এ অফিসে শেষ দিন? ওয়ার্কিং আওয়ার্স পেরিয়ে যাওয়ার পরও কি করছে অফিসে? মনের অবাকভাবটা মুখে ফুটে উঠলো ওর।
— তুই যাস নি এখনো? ফেয়ারওয়েল হয়ে যাওয়ার পরও এতো লেট অবধি অফিসে কি করছিস!?
— আরে! Bid adieu ইমেল লিখছিলাম, লাস্ট ইমেল ফ্রম মাই আই.ডি! ওটা না পাঠিয়ে কি করে যাই বল! সাড়ে ছয়টা বেজে গেছে, এখন তো হার্ডওয়্যার টীমও নেই যে কম্পিউটারটা ঠিক করে দেবে!
— এতক্ষন কি করছিলি তবে?
— এটা সেটা ব্যাকআপ নিতে নিতেই লেট্ হয়ে গেলো! তারপর কম্পিউটারটাও বারবার রিস্টার্ট হচ্ছিলো…….
সায়কের ওর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা দেখে কেমন গা শিড়শিড়িয়ে উঠলো তিন্নির। চট করে একবার হাতঘড়িতে চোখ বুলিয়ে নিতে বিরক্তিরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো মনে মনে। এখানে দাঁড়িয়ে খেজুরে গল্প করতে থাকলে বাইরে অটোর লাইনও পাল্লা দিয়ে বাড়বে। সেটা বুঝেই চোখ সরিয়ে নিয়ে গলায় একছটাক চিন্তা মিশিয়ে রিক্যোয়েস্ট করার ভঙ্গীতে সায়ক বললো
— সীমন্তিনী, তোর আই.ডি পাসওয়ার্ডটা দিয়ে যাবি? তোর সিস্টেমে লগইন করে মেলটা পাঠিয়ে দিয়েই বেরিয়ে যাবো আমিও।
ভুরু কুঁচকে উঠলো তিন্নির।
— আমি এখনই বেরোচ্ছিলাম রে সায়ক, আর দেরি করলে সেই লাস্ট ট্রেনে বাড়ি যেতে হবে!
হাঁ হাঁ করে উঠলো সায়ক
— না!না! আমার জন্য তোকে দেরি করতে হবে না! জাস্ট পাসওয়ার্ডটা দিয়ে বেরিয়ে যা, আমি মেল ড্রাফট করেই কম্পিউটার বন্ধ করে দেব।
বলতে বলতে চোখে মুখে একটা কাতর আবেদন ফুটিয়ে তুললো সায়ক!
মুখের ওপর “না” করতে গিয়েও থমকে গেলো তিন্নি।
একঝলক চিন্তা করলো সায়ককে কি ভরসা করে পাসওয়ার্ড দেওয়া উচিত হবে? ওদের প্রজেক্টে অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সিকিউরিটি খুব কড়া, এমনভাবে পাসওয়ার্ড শেয়ার করা যায় না ঠিকই, কিন্তু আনঅফিসিয়াললি অনেকেই করে। কয়েকমাস আগেও যখন ওদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল সায়ক ওর কম্পিউটারে কাজ করেছে বা তিন্নি সায়কের কম্পিউটারে! তাছাড়া আজ তো বেচারার লাস্ট ডে! কি আর হবে?
একটু ভেবে কম্পিউটারটা আনলক করে দিয়ে তিন্নি বললো
— যাওয়ার আগে মনে করে কম্পিউটার শাটডাউন করে দিস আর এগ্যেইন অল দ্য বেস্ট ফর ইওর ফিউচার!
প্রায় লাফিয়ে উঠে কান এঁটো করা হাসি হাসলো সায়ক
—– থ্যাংক ইউ! থ্যাংক ইউ সো মাচ সীমন্তিনী! আই উইল রিয়েলি মিস ইউ, অফকোর্স … আ্যজ এ ফ্রেন্ড !
আলতো হেসে অফিসে থেকে বেরিয়ে গেলো তিন্নি, পেছন ফিরে তাকালে দেখতে পেতো সায়কের একটু আগের নরম হাসি হাসি মুখ বদলে গেছে হঠাৎই, হিংস্র শ্বাপদের ন্যায় জ্বলজ্বল করছে চোখদুটো।
**************************__****************************
সেক্টর ফাইভের অটোর লাইন আর কলকাতার শুক্রবারের হালকা ট্রাফিক পেরিয়ে বিধাননগর স্টেশনে পৌঁছে সবে ট্রেনে উঠতে যাবে তিন্নি, ব্যাগের মধ্যে রাখা মুঠোফোন বেজে উঠলো তারস্বরে আর অন্যমনস্কতার ফলে একটুর জন্য চোখের সামনে দিয়ে ট্রেনটা বেরিয়ে গেলো!
বিরক্ত হয়ে বেজে যাওয়া ফোনটা বার করে ভুরু কুঁচকে উঠলো ওর, তারপর ব্যস্ত গলায় কলটা রিসিভ করলো তিন্নি
— হ্যালো??
ওপ্রান্তে গাঁক গাঁক করে বেজে উঠলো মিথিলেশের গলা
— এটা তুমি কি করেছো সীমন্তিনী?
আকাশ থেকে পড়লো তিন্নি
— কি হয়েছে? হ্যোয়াই আর ইউ শাউটিং মিথিলেশ?
— কোথায় আছো তুমি? কাম ব্যাক টু অফিস রাইট নাউ!
— হোয়াট? হ্যোয়াই? আমি তো জাস্ট অফিস থেকে বেরোলাম, এখন বিধাননগর স্টেশনে!
— প্রোডাকশন সার্ভার থেকে ৫ পেজের একটা কোড ডিলিট হয়েছে ঘন্টাখানেক আগেই, তোমার আই.ডি থেকে করা। পুরো সিস্টেম বসে গেছে, ক্রিটিকাল কল চলছে! হ্যোয়াই উড ইউ ডিলিট সামথিং ডাইরেক্টলি ইন সার্ভার!
— কি বলছো কি মিথিলেশ! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!
— সীমন্তিনী, আমি কম্পিউটারের সামনে বসে আছি! তুমি ডেভেলপার-এই কোডিংয়ের অ্যাডমিন অ্যাক্সেস একমাত্র তোমার আর অনসাইট ডেভলপারের কাছেই ছিল! অ্যান্ড ইট ইজ শোয়িং ইওর আই.ডি, ডট ৬:৩৫ PM।
মিথিলেশের কথার মাঝে চেঁচিয়ে উঠলো তিন্নি
— হোয়াট ননসেন্স! আমি ৬:২০তে বেরিয়ে গেছি অফিস থেকে!
— তাহলে কি তুমি বলতে চাইছো সিস্টেম ভুল দেখাচ্ছে?
পায়ের তলা থেকে আচমকা মাটি সরে গেলো তিন্নির! আজকের সায়কের ওভারফ্রেন্ডলি হাবভাব, গায়ে পড়ে কথা বলার চেষ্টা সবকিছু দিনের আলের মতো স্পষ্ট হয়ে গেল। নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো
— সায়ক!
সায়কের নাম শুনে থমকে গেলো মিথিলেশ, তারপর একটু পজ নিয়ে বললো
— হোয়াট ডু ইউ মিন! সায়কের কাছে অ্যাডমিন অ্যাক্সেস ছিল না !
ঠোঁট কামড়ে ধরলো তিন্নি! এতবড়ো ট্রাপটা দেখতে পেলো না?
তিন্নির ডেস্কটপে “পাসওয়ার্ড” বলে একটা ফোল্ডারে শেয়ারড্রাইভ-প্রোডাকশন সিস্টেম-অ্যাডমিন যাবতীয় লগইন ডিটেল সেভ করা থাকে! যে কেউ কম্পিউটার খুলেই দেখতে পাবে! “বন্ধু” নামক মুখোশের আড়ালে সায়কের জিঘাংসা মাখানো কালো কদর্য রূপটা চিন্তা করে শিউড়ে উঠলো তিন্নি, ভিড় প্যাচপ্যাচে স্টেশনে দাঁড়িয়ে নিজের বোকামো স্বীকার করে নিলো
— অফিস থেকে বেরোনোর মিনিটকয়েক আগে সায়ক আমার কম্পিউটার পাসওয়ার্ড নিয়েছিল…. ওর সিস্টেম ক্র্যাশ করে গিয়েছিলো আ্যন্ড হি হ্যাড টু সেন্ড দ্য bid adieu মেল্!
— মাই গুডনেস! হাউ নেগলিজেন্ট ক্যান ইউ বি? ডোন্ট ইউ নো দ্য কোম্পানি পলিসি এগেইনস্ট শেয়ারিং পাসওয়ার্ডস?
ছটফট করে উঠলো তিন্নি
— সায়ক কোথায়? লেট্ মি কল হিম!
— ইট ওয়াজ হিস্ লাস্ট ডে সীমন্তিনী, আমরা ওর এগেইনস্ট কিছু করতে পারবো না! প্লাস তুমি যে এই আ্যলিগেশন আনছো, কোনো প্রমাণ আছে তোমার কাছে?
কিছুক্ষন থম হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ধীরে ধীরে তিন্নি বললো — না! আই আ্যম এক্সট্রেমল্যি সরি মিথিলেশ!
মিথিলেশ বোধহয় বুঝতে পারলো তিন্নির অবস্থা! উত্তেজিত গলাটা অপেক্ষাকৃত স্বাভাবিক হয়ে এসে বললো
— সীমন্তিনী, আমরা সবাই জানি তুমি আমাদের প্রজেক্টের অ্যাসেট কিন্তু ইউ হ্যাভ টু বি স্মার্ট টু! এনিওয়ে কাম ব্যাক টু অফিস রাইট নাউ! এখন আমাদের টিমের রেপুটেশন জড়িয়ে গেছে এর সাথে, আজ রাতের মধ্যেই ইস্যুটা সলভ করতে হবে আদারওয়াইজ দেয়ার উইল বি হিউজ এস্কালেশনস্।
তিন্নির উত্তরের অপেক্ষা না করেই খট্ করে কল কেটে গেল ওপ্রান্তে। বাজপড়া ল্যাম্পপোস্টের মতো কিছুক্ষন থম হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ওভারব্রীজের সিঁড়ি দিয়ে দৌড় লাগালো তিন্নি!
**************************__****************************
ক্যাববুক করার মতো সময় নেই হাতে!
স্টেশন থেকে দৌড়ে বেরিয়ে রুটের একটা রানিংঅটোকেই রিসার্ভ করে আধা ঘন্টায় আবার সেক্টরফাইভের অফিস পৌঁছলো তিন্নি।
সায়ক অনেকটাই ড্যামেজ করেছে কিন্তু তিন্নির কাছে ব্যাকআপ ফাইল ছিল। ওর নিজের হাতে বানানো কোড, চোখ বুজে টাইপ করে দিতে পারবে। ইমার্জেন্সি ট্রান্সপোর্ট রিকোয়েস্ট করে সিকিউরিটি টিমের সাথে ধস্তাধস্তি করে অনেক চেষ্টায় রাত সাড়ে আটটা নাগাদ প্রোডাকশন সিস্টেম যখন আবার চালু হলো, হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো তিন্নি! সারাদিনের মানসিক চাপে বিধস্ত প্রায়! মাথার শিরাগুলো দপদপ করছে, এতরাতে বাড়ি যাবে কি করে ভেবে পাচ্ছিলো না!
মিথিলেশই ব্যবস্থা করে দিলো, তিন্নিদের কোম্পানির পলিসি অনুযায়ী রাত আটটার পর অফিস থাকতে হলে মেয়েরা ম্যানেজমেন্টের আ্যপ্রুভালে অফিসের ক্যাব পায়। ট্রেন-অটোর দুই ঘন্টার রাস্তা রাতের ফাঁকা রাস্তায় টানা গাড়িতে লাগলো একঘন্টারও কম।
রাত যখন সাড়ে নয়টার কাঁটা পেরিয়েছে, ধীরপায়ে বাড়ি ঢুকলো তিন্নি! সায়কের বিশ্বাসঘাতকতা যেন নিংড়ে নিয়েছে ওর সকল জীবনীশক্তি! ক্লান্ত শরীর তখন একটু বিছানা পেলে বাঁচে!
উঠোন পেরোতেই দেখলো শুভ দাঁড়িয়ে কোমরে হাত দিয়ে। তিন্নিকে দেখেই চেঁচালো
— “মা আ! দিদি এসে গেছে”
তারপর চোখ টিপে তিন্নিকে বললো
— “আজ তোর কপালে দুঃখ নাচছে”!
হে ভগবান!
আজ না প্লিজ? আবার কি হলো? আজ আর কোনো যুদ্ধ লড়ার শক্তি নেই তিন্নির।
উঠোন পেরিয়ে ঘরের বারান্দায় পা দিতেই ভাস্বতীদেবী এসে দাঁড়ালেন রাস্তা আটকে
— লজ্জা করে না তোর এ বাড়িতে পা দিতে? মানসম্মান আর কিছু বাকি রাখলি না? এইসব করতেই বারবার আমাদের মিথ্যে কথা বলে বাইরে ঘুরতে যাচ্ছিস, লেট্ করে বাড়ি ফিরছিস তাই তো? শেষে কে না কে বাইরের উটকো লোকের কাছ থেকে এসব শুনতে হলো।
কে কি বললো আবার!
ধৈর্যের শেষ সীমায় এসে কাতর গলায় তিন্নি বলে উঠলো — প্লিজ মা, আজ না! আজ আমি বড্ডো টায়ার্ড!
— খবরদার, এক পা ভেতরে দেবে না! এ বাড়িতে থাকতে হলে চুপ করে আমার কথা শুনে তোমায় চলতে হবে, উঠতে হবে, বসতে হবে। না পোষালে রাস্তা খোলা আছে এই মুহূর্তে বেরিয়ে যাও।
ভাস্বতীদেবীর রুদ্র মূর্তি দেখে পা ওখানেই থমকে গেলো তিন্নির। শুভ পাশ থেকে বললো
— মা! তোমার আদরের মেয়ের পাড়াতে সম্মান না থাকতে পারে কিন্তু আমার আছে! দয়া করে ঘরের ভেতরে এসব নাটক শুরু করো! আর দিদি, তোকেও বলিহারি! প্রেম কে না করে তাই বলে এইভাবে?
ধক্ করে উঠলোবুকের ভেতর। কি বলছে এসব শুভ?
গলা শুকিয়ে আসছিলো তিন্নির, ফ্যাকাশে হয়ে আসা মুখে ভাইকে জিজ্ঞেস করলো
— হেঁয়ালি ছেড়ে বলবি কি হয়েছে?
— তোমার অফিসের কলিগকে জিজ্ঞেস করো!
অন্ধকার থেকে রঞ্জনবাবুর গম্ভীর গলা শোনা গেলো!
পর্যায়ক্রমে শুভ, মা তারপর বাবার দিকে ফ্যালফ্যালিয়ে চেয়ে থেকেও তিন্নি কিছু বুঝে উঠতে পারলো না! তারপর বিদ্যুৎচমকের মতো বোধগম্য হলো বোধহয়!
সায়ক? আবারো ?
বাজপড়া তালগাছের মতো ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো তিন্নি বারান্দার কোলাপ্সিবলে গেট ধরে।
— তিন্নি, ঘরে এসো। তোমার সাথে কথা আছে!
রঞ্জনবাবুর রাগ রাগ গলা শুনে বুকের ভেতর থেকে দুরুদুর একটা ভয়ে শরীর অবশ হয়ে এলো তিন্নির। কি বলবে, কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলো না। জীবনে এই প্রথমবার বাবাকে এতোটা রাগতে দেখে অদৃশ ফেভিকলে পা’গুলো সেঁটে রইলো মাটিতে, নিজেকে কেমন যেন স্ট্যাচুর মতন মনে হচ্ছিলো।
ভাস্বতীদেবী নিজের মতো বলে যাচ্ছিলেন
— কিসের কথা? এতদিন ধরে যখন বলছিলাম মেয়েকে সামলাও, বিয়ে দিয়ে এবাড়ি থেকে বিদায় করো তখন আমাকে চোপা করছিলে! কিন্তু আজ? আজ তো ওরই বন্ধু শুভকে জানালো সব নিজে থেকে! আদর দিয়ে দিয়ে মেয়ের মাথা খেয়েছো, বন্ধুদের সাথে বেড়াতে যাওয়ার বাহানায় রাতের পর রাত বাড়ি ফিরছে না আর কতো চুনকালি মাখালে তোমার জল হয়ে যাওয়া রক্তটা জ্বলে উঠবে? ছিঃ ছিঃ! শুভ ছেলে হয়ে যা সাহস পায় না, তিন্নি সেখানে …….
শুভ ততক্ষনে ওর মোবাইলটা তিন্নির হাতে ধরিয়ে দিয়েছে, সামনে খোলা মেসেঞ্জারে সায়কের চ্যাট
“হাই শুভ! তুমি হয়তো আমাকে চিনবে না, আমি তোমার দিদির সাথে এক অফিসে কাজ করি, তোমার দিদির শুভানুধ্যায়ী! কিছু কথা তোমার বাড়িতে জানানো মনে হলো তাই এভাবে কন্টাক্ট করছি ……..” .
এরপর সায়ক লিখে গেছে গত জুনমাসে সিকিম বেড়াতে গিয়ে অভিমন্যুর সাথে তিন্নির দেখা হওয়া, তিন্নির একরাত হোটেলে না ফেরা, আর্মি ক্যাম্পে রাত কাটিয়ে পরের দিন ফেরা সব! তফাৎ এটাই, প্রকৃতপক্ষে যা যা হয়েছিল, সেই সত্যি ঘটনাগুলো টুইস্ট করে, বাড়িয়ে চড়িয়ে বিভিন্ন আঙ্গিকে নোংরা ইঙ্গিত মেশানো লেখা…. বাস্তব থেকে বহুক্রোশ দূরের গল্প।
পড়তে পড়তে গা গুলিয়ে উঠলো তিন্নির, পেটের ভেতর দিয়ে পাক খাওয়ানো একটা ব্যাথা ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীরে! দমবন্ধ হয়ে আসছে যেন । কোলাপ্সিবলে গেটটা ধরে থেকে মরিয়া হয়ে বলে উঠলো
— আমি কি ঘরে ঢুকতে পারি? শরীরটা খুব খারাপ লাগছে।
গলার স্বরটা কি একটু জোরে হয়ে গিয়েছিলো? এক সেকেন্ড সব চুপচাপ তারপর……
.
.
.
ঠাসস্!
সজোরে একটা চড় এসে পড়লো তিন্নির গালে, তারপর আরো একটা। হাতে ধরা মোবাইল ছিটকে পড়ে গেলো বাগানে, পেছন থেকে শুভ ধরে না ফেললে তিন্নিও হয়তো ওখানেই পড়ে যেত!
মাথা ঘুরছে বনবন, চোখে অন্ধকার হয়ে আসছে সবকিছু। হাত পা কাঁপতে কাঁপতে ভাইয়ের হাত ছেড়ে মাটিতে বসে পড়লো তিন্নি, যত না আঘাতের তীব্রতায় তারচেয়েও বেশি বিস্ময়ে আর আকস্মিকতায়!
— কি করছো কি মা??
চেঁচিয়ে কথাটা বলেই মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে শুভ চুপ করে গেলো! ভাস্বতীদেবীর এমন রূপ ও আগে কখনো দেখেনি! ভাঙাচোরা পুঁটলির মতো তিন্নি মুখ গুঁজে মাটিতে বসে আছে যেন কোনো কথাই ওর কানে ঢুকছে না।
সেদিকে তাকিয়ে ভাস্বতীদেবী সজোরে ঘোষণা করলেন
— শয়তান মেয়ে! মা’র মুখে মুখে কথা বেড়েছে তোমার? এই তোমার শিক্ষা?এ বাড়িতে থাকতে হলে চোখ নিচু করে চলবি, মাথা নিচু করে চলবি,যখন যা বলবো – মুখ বুজে শুনবি। নাহলে এই দন্ডে বেরিয়ে যা বাড়ি থেকে, জানবো আজ থেকে আমার মেয়ে মরে গেছে।
কথাক’টা বলে ভাস্বতীদেবী দুমদুম্ পায়ে বারান্দা ছেড়ে ঘরে ঢোকার উপক্রম করলে স্তব্ধ গলায় রঞ্জনবাবু বললেন
— এতো বড়ো মেয়েকে তুমি মারলে ভাস্বতী??
— হ্যাঁ মারলাম! আরো আগেই মারা উচিত ছিল। আর শোনো, ছেলের বাড়িতে আমি হ্যাঁ বলে দিয়েছি, জগদ্ধাত্রীপুজোর পর ওরা পাকা কথা বলে যাবে।
ছাঁৎ করে উঠলো বুকের ভেতর, জড়দেহে সার ফিরে এলো তিন্নির! উঠে দাঁড়ানোর শক্তি নেই, হাঁটুমুড়ে মাটিতে বসে থেকেই লালআগুন হয়ে জ্বলতে থাকা গালটা চেপে অস্ফুটে বললো
— কিসের পাকা কথা?
জবাবে ঘেন্না মেশানো একটা দৃষ্টি উপহার পেলো মায়ের কাছ থেকে, ভাস্বতীদেবীর হয়ে রঞ্জনবাবু উত্তর দিলেন
— মাসখানেক আগে যারা তোমাকে দেখতে এসেছিলো, তারা তোমায় পছন্দ করে গেছে!
সহজ বাংলা কথাও যেন বোধগম্য হচ্ছিলো না তিন্নির ! আগের মতোই থম মেরে যাওয়া অস্ফুট স্বরে বললো
— কে দেখতে এসেছিলো আমায়? কবে দেখলো?
এইবার ভাস্বতীদেবী কর্কশ স্বরে বলে উঠলেন — বিজয়ার পর যারা বাড়ি এসেছিলো , ফুটো পাজামা পড়ে তুমি যাদের সামনে গিয়ে বসেছিলে।
পাগল পাগল লাগছে এবার তিন্নির। পুজোর পরপর কোনো এক রোববারের সকালে যারা বাড়ি বয়ে এসেছিলো, যাদের তিন্নি ভেবেছিল লাইফ ইনস্যুরেন্সের এজেন্ট, তাদের কথা বলছে কি মা? ওইজন্য ওঁনাদের অত খাতিরদারি, তিন্নিকে অত প্রশ্ন?!
মাথার ঘোলাটেভাব কেটে গিয়ে রাগে অপমানে থরথর করে হাত-পা কাঁপছে, মাথার শিরাগুলো দপদপিয়ে উঠেছে! চোখ বেয়ে টপ টপ করে নোনতা জলগুলো বেয়ে পড়তে একটু আগের সজোরে থাপ্পড় ভুলে চেঁচিয়ে উঠলো তিন্নি
— আমাকে না জানিয়ে যার তার সামনে আমাকে দেখাচ্ছো তুমি? আমি কি বাজারের আলু পটল?
— চুপ কর। চুপ কর তুই। একটা কথা বেরোবে না মুখ দিয়ে! বাইরে রাত কাটিয়ে ঘরে ফিরে আবার মা’র মুখে মুখে তর্ক? আর একটা থাপ্পড়ে মুখ ভেঙে দেব এবার।
রঞ্জনবাবুও এবার স্বাভাবিক স্থিতধা হারিয়ে ফেলেছেন, বিরক্ত হয়ে বললেন
–ভাস্বতী, অনেক হয়েছে! এবার শান্ত হও! আর তিন্নি? মার্ সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় ভুলে গেছো তুমি? এতদিন ধরে এই শিক্ষা পেয়েছো? আর একটাও কথা নয়! শুভ, দিদিকে ঘরে নিয়ে যা।
— মাইরি বলছি, মাঝরাতে সাতপাড়ার লোক জানিয়ে এসব নাটক দেখতে আমার ভালো লাগে না! বাড়ি না বাংলা সিরিয়াল!
গজগজ করে কথাগুলো বলতে বলতে তিন্নিকে হ্যাঁচকা মেরে দাঁড় করিয়ে দিয়ে ঘরে ঢুকে গেলো শুভ।
নাকের কাছে হাত নিয়ে দেখল তিন্নি, গড়িয়ে আসা চ্যাটচ্যাটে গরম রক্তে চোখের জল মিশে রয়েছে। ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে মাথা নীচু করে ঘরে ঢুকলো নতুন আর একটা যুদ্ধ লড়তে, যে যুদ্ধে আগে থেকেই হেরে গিয়েছে তিন্নি।
ক্রমশঃ
© সুমন্দ্রা মিত্র। ভালো লাগলে নামসহ শেয়ার করবেন
***********************__******************************
সকল পর্বের লিঙ্ক~
Video Teaser
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145475543838322/?vh=e&d=n
Part 1
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145129087206301/?d=n
Part 2
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145859077133302/?d=n
Part 3
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/146221053763771/?d=n
Part 4
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/146595433726333/?d=n
Part 5
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/147293876989822/?d=n
Part 6
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148075966911613/?d=n
Part 7
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148530310199512/?d=n
Part 8
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148951006824109/?d=n
Part 9
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/149405760111967/?d=n
Part 10
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/150313546687855/?d=n
Part 11
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/151106323275244/?d=n
Part 12
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/151923336526876/?d=n
Part 13
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/152353663150510/?d=n
Part 14
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/154065792979297/?d=n
Part 15
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/156163186102891/?d=n
Part 16
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/157132182672658/?extid=QdVQFGSjLzQUsE31&d=n
Part 17
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/157444422641434/?extid=fI3jIc0PCiYXDa0N&d=n
Part 18
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/158095955909614/?extid=1E2JOZfMCmqscBoi&d=n
Part 19
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/158831902502686/?extid=R8zo6L2l274CIQ7r&d=n
Part 20
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/159626782423198/?extid=0e8jrLLhsuLqgsQX&d=n
Part 21
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/160047349047808/?extid=e9DIdFXAkqxTg77U&d=n
Part 22
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/160963752289501/?extid=EgYDh0z3hVr5TCBY&d=n
Part 23
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/161833698869173/?extid=gRK0HHMoLW0bu0gK&d=n
Part 24
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/162740122111864/?extid=KIR9o3zetBHgH9mt&d=n
Part 25
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/163061178746425/?extid=fhzBxEjnlA7n6Ulu&d=n
Part 26
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/163695728682970/?extid=tm0Y81ykORQhpsq9&d=n
Part 27
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/164305438621999/?extid=WsYE2BjXkYvPmqyF&d=n
Part 28
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/164941361891740/?extid=Ck5D6rJFfhyP5vvH&d=n
Part 29
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/165252361860640/?extid=Nq4U03rtVoPWvXTe&d=n
Part 30
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/166475585071651/?extid=vZLf99OzhuVT4DA6&d=n