সূর্য ডোবার আগে পর্ব-৩২

0
2352

#সূর্য_ডোবার_আগে
পর্ব-৩২
লেখিকা ~ #সুমন্দ্রামিত্র
কঠোরভাবে প্রাপ্তমনষ্কদের জন্য।
.
.

ঘড়ির কাঁটা এগারোটা ছুঁইছুঁই, শ্রীরামপুরের ফিরিঙ্গিডাঙা মোড়ের আচার্য্যবাড়িতে খাওয়াদাওয়া মাথায় উঠেছে। নিশ্চল তিনটি প্রাণী বোবা হয়ে বসে, দেওয়াল ঘড়ির টিক টিক আওয়াজের সাথে কান্নার আওয়াজ মিশে। লিভিং রুমের সোফায় বসে ফুলে ফুলে কাঁদছে তিন্নি, নরম গালে পাঁচ আঙুলের ছাপ তখনও স্পষ্ট।
সেদিকে তাকিয়ে থেকে বুকের ভেতর মুচড়ে উঠলো রঞ্জনবাবুর, ঘরের অসহ্য নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে ধীর গলায় বললেন
— এ তুই কি করলি মা? তোর কাছ থেকে আমরা এটা আশা করি নি। এতদিন ভাবতাম, তুই আমাকে অন্তত সব বলিস, শেষে আমার কাছ থেকেও এতবড়ো কথাটা লুকিয়ে গেলি তুই?

একটু আগেই সায়কের জন্য অফিসে কি কি হয়েছে, সব খুলে বলেছে তিন্নি। আজ সায়কের ফেয়ারওয়েল স্পিচ, তারপর কম্পিউটার খারাপের বাহানায় তিন্নির থেকে ওর পাসওয়ার্ড নেওয়া, কোড ডিলিট করে দেওয়া- সব! রঞ্জনবাবু, ভাস্বতীদেবী দুজনেই স্তব্ধ হয়ে বসেছিলেন, সবটা শুনে বুঝে উঠতে পারছিলেন না এরূপ অদ্ভুত সমস্যার কার্যকারণ কি আর কি’ই বা তার সমাধান! আই.টি অফিসে কাজ করে এমনও যে হতে পারে, এ যেন ধারণার অতীত!

নিজের মতো করে ছাড়া ছাড়া একটা গল্প দাঁড় করিয়েছে তিন্নি। সিম্পলিফ্যায়েড সহজ কাহিনী, সায়কের বলা মিথ্যেগুলোর ভারসাম্য বজায় রেখেছে আরো কয়েকটি মিথ্যে দিয়ে।
তিন্নির ভার্সনে গল্পটি হলো, জুন মাসে নর্থবেঙ্গলের ট্রিপে তিন্নি শিয়ালদা স্টেশনে ট্রেন মিস করার ঠিক আগে অপরিচিত এক ব্যক্তির সাহায্যে ট্রেনে উঠতে পারে, যদিও পরের স্টেশনেই ও সায়কদের কামরায় চলে যায়। এরপর গ্যাংটকে ঘোরার সময় বাবামন্দিরের কাছে সায়করা ভুল করে ওকে পাহাড়ি চা দোকানে ফেলে চলে গেলে খবর পেয়ে ইন্ডিয়ান আর্মির ছোট একটা টীম আসে, ধসে রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ার জন্য সেই রাত তিন্নি আর্মিবেসক্যাম্পে থাকতে বাধ্য হয়, “আরো অনেক আটকে পড়া পর্যটকদের সাথে”। পরেরদিন আর্মির তরফ থেকে তিন্নিদের “সবাইকে” ফিরিয়ে দেওয়া হয় হোটেলে। ব্যস এটুকুই।

শুভকে বলা সায়কের মিথ্যে, নোংরা কথাগুলোর ভারসাম্য বজায় রেখে এপাশে ওপাশে নিজের মিথ্যে আ্যলিবাই ঢুকিয়ে গল্প বানিয়েছে তিন্নি আর সেই গল্পে অভিমন্যুর কোন অস্তিত্ব নেই। মনের ভেতর কুঁকড়ে উঠছিলো নিজের এই নির্লজ্জতায়, অবাক হয়ে যাচ্ছিল – কি করে এমন পাকা অপরাধীর মতো গল্প বানাতে শিখে গেল তিন্নি? তাও একচুল গলা কাঁপে নি ওর। সত্যি কথাগুলো বলার মতো আর যে মুখ নেই তিন্নির। সায়কের কুচক্রী শয়তানি বুদ্ধিতে চিরকালের জন্য সত্যের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে।

কাঁদতে কাঁদতে ডুকরে উঠলো তিন্নি
— আই আ্যম সরি বাবা, আমি বুঝতে পারি নি কি ভাবে এ কথাগুলো তোমায় বলা যায়। কি কি তোমায় বলতাম বাবা? প্রথমে ঘুরতে যাওয়ার ডেস্টিনেশন চেন্জ… তাতেই তোমরা কতো চিন্তা করছিলে! তারপরও কি করে বলতাম, সায়করা ফাঁকা রাস্তায় আমায় ফেলে চলে গিয়েছিলো আর আমি ব্ল্যাকআউট হয়ে গিয়েছিলাম? হাতের ফোনটাও ছিলো না কাউকে কনট্যাক্ট করার জন্য! কি করে জানাতাম ইন্ডিয়ান আর্মি এসে আমায় রেসকিউ করেছিল আর বাধ্য হয়ে ওদের ক্যাম্পে আমায় একরাত কাটাতে হয়েছিল? ধসে রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলে আমি কি করতে পারি বাবা?

তিন্নির কথাগুলো মনে মনে নাড়াচড়া করে অনেকক্ষন পর মুখ খুললেন রঞ্জনবাবু
— তাই বলতিস, তাহলে তো আজকের এই ঘটনা গুলো ঘটতো না!

— হয়তো বলেও দিতাম বাবা, ট্রিপটার পর বাড়িতে ফিরেই বিছানা না নিলে। আমিও যে আর পারছিলাম না, আমার শরীর যে আর দিচ্ছিলো না।
উগড়ে ওঠা অভিমানে ফুঁপিয়ে উঠলো তিন্নি।

এতক্ষনে মখ খুললেন ভাস্বতীদেবী, থম মেরে যাওয়া গলায় বললেন
—- আর শুভ কি বলছে, কে একটা আর্মির লোক তোকে নাকি শিয়ালদা স্টেশনে ট্রেন থেকে ফলো করছিল, তোকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল ওদের ক্যাম্পে?

রঞ্জনবাবুও জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইলেন তিন্নির দিকে। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে বয়ে যাওয়া অবিরাম নোনতা জলের স্রোত মুছে নিয়ে তিন্নি বললো
— সব গল্প ! মিথ্যে কথা। তোমার মাথা ছুঁয়ে বলছি বাবা, কেউ আমাকে তুলে নিয়ে যায় নি!
তোমাদের আমার কথা বিশ্বাস না হলে সায়ক ছাড়া আর যারা যারা ট্রিপে গিয়েছিলো তাদের সবাইকেও জিজ্ঞেস করে দেখো? ……. পিয়াসা, মেঘা, নির্মাল্য আরও যারা যারা আছে সবার সাথে কথা বলো!

ষাটোর্দ্ধ বলিরেখা জীর্ণ কপালে ফুটে উঠলো বেশ কয়েকটি গাঢ় চিন্তার রেখা। পুরো ঘটনাটা আরএকবার মনের মধ্যে তলিয়ে ভেবে রঞ্জনবাবু বললেন
—- কিন্তু ওই সায়ক ছেলেটাই বা তোর সাথে এমন করছে কেন? এসব করে কি পাবে ও?

সায়ক আজ অফিসে কি কি করেছে সেসব শোনার পর ভাস্বতীদেবীর বুকের ভেতরটাও শুকিয়ে আসছিলো, আবার এদিকে মেয়েকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না! কে জানে মেয়ে আবার এগুলো বানিয়ে মিথ্যে গল্প বলছে কিনা! বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলে দুলতে অবিশ্বাস মেশানো সন্দিগ্ধ গলায় বলে উঠলেন
—- তিন্নি, নিশ্চয়ই তুই কিছু করেছিস যার জন্য ছেলেটা এভাবে তোর পেছনে লেগেছে? দুইবছর এক অফিসে কাজ করলি, ওর কথায় নেচে আমাদের সাথে ঝগড়া করে একলা ট্রিপে ঘুরতে গেলি, এভাবে বাজে কথা রটিয়ে, তোর সর্বনাশ করে কি লাভ হলো ওর?

মা বাবার মিলিত জিজ্ঞাসার সামনে অসহায়ের মতো তাকিয়ে রইলো তিন্নি। কি উত্তর হয় এই প্রশ্নগুলোর?
কেন এমন করছে সায়ক?
পজেসিভনেস? জেলাসি? রিজেকশন সহ্য না করতে পারার প্রতিশোধস্পৃহা? সায়কের কৃতকর্মের পেছনে যে ইমোশনটাই দায়ী থাকুক না কেন অভিমন্যুর নামও যে তার সাথে জড়িয়ে।
দুহাতে মুখ ঢেকে নিয়ে আবছা গলায় তিন্নি বললো
—- আমি জানি না মা! আমি জানি না, কেন সায়ক এমন করলো, বারবার। আমি শুধু ওকে ভালো বন্ধু ভেবেছিলাম।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে গম্ভীর গলায় রঞ্জনবাবু বললেন
— কর্মক্ষেত্রে হেসে কথা বললেই কেউ কারো বন্ধু হয় না তিন্নি। মানুষ চিনতে শেখো।
তারপর একটু থেমে সরাসরি তাকালেন তিন্নির দিকে
—- তার মানে ট্রেনের ওই লোকটা তোকে আর যোগাযোগ করে নি তো?

শিঁড়দাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল তিন্নির, একমুহূর্তের জন্য নিশ্বাস নিতে ভুলে গেলো যেন। তারপর বাবার গা থেকে হাতটা সরিয়ে নিয়ে চোখ বন্ধ করে বললো
— না, করে নি!

ছলনাটুকু এবার হয়তো বাবা-মেয়ের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে গেলো। আড়চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো শিউরে উঠলো তিন্নি। রঞ্জনবাবুর মুখ পাথরের মতো কঠিন হয়ে উঠেছে ততক্ষনে। মিনিটকয়েক পর একটি সুদীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভাস্বতীদেবীকে বললেন
— ভাস্বতী, আমি তিন্নিকে বিশ্বাস করি। আশা করি ও আমাকে ছুঁয়ে কোনোদিন মিথ্যে বলবে না।

— তবে… তবে কি বিয়ের সম্বন্ধটা ভেঙে দেব?

—- নাহ্, তা কেন? তিন্নির পঁচিশ হতে চলেছে, বিয়ে হতে হতে আরো ছয়সাত মাস তো লাগবেই। ততদিন তিন্নি‘ও ছেলেটার সাথে কথা বলুক, ওকে চিনুক। ঠিক আছে রে মা?

এতোক্ষনের কান্নাকাটির পর তিন্নির মনে একটা সুপ্ত আশা জেগেছিল বিয়ে নামক বিপর্যয়টি এবারের মতো এড়ানো গেল। ভাস্বতীদেবীও মনে মনে তাই ভাবছিলেন, সত্যিই হয়তো ওঁনারা একটু তাড়াহুড়োই করছেন। কিন্তু রঞ্জনবাবুর থেকে অপ্রত্যাশিত উত্তরে তিন্নি আর ভাস্বতীদেবী দুজনেই চমকে উঠলেন। আকস্মিকতায় স্তব্ধ তিন্নির মুখ দিয়ে একটা প্রতিবাদও বেরোলো না, রঞ্জনবাবু মেয়ের দিকে না তাকিয়ে নিজেকেই জবাবদিহি করার মতো বলে যেতে লাগলেন
— ছেলে ডাক্তার, জার্মানিতে সেটেলড, আমাদের পাল্টি ঘর। শ্রীরামপুরেই আদিবাড়ি, কয়েকমাস আগে ছুটিতে বেড়াতে এসে তোকে দেখেছে অফিস যাতায়াতের পথে, ওর বাড়ির লোকেরও তোকে পছন্দ হয়েছে। ছেলের বাড়ি থেকে তাড়া আছে বলছে, জানুয়ারীতে ছেলে আবার এদেশে ফিরে, তোর ভিসা টিসা ঠিকঠাক হয়ে গেলে আগামী জুন-জুলাইতেই চারহাত এক করে দেওয়া যাবে, তারপর তোকে নিয়ে চলে যাবে ওদেশে। এ দেশে কি আছে বল? দেখছিস তো, অফিসেও কত ঝামেলা! তার চেয়ে এই ভালো…. বাইরে গেলে কত সুযোগ সুবিধা, ওখানকার লোকজন কত ভদ্র, তুই সুখী হবি আমি নিশ্চিত……..।

অনেকচেষ্টায় গলায় স্বর খুঁজে পেলো তিন্নি, চাপা কান্নায় বুজে আসা গলায় বললো
— আমি তো নিজের যোগ্যতাতেও বাইরে যেতে পারি বাবা, সেটা কেন ভাবছো না! অফিসে আমি যেভাবে কাজ করি আজ না হয় একবছর পর আমি তো নিজেও যেতে পারি অনসাইট। কিন্তু আমি যেতে চাই না!

— কেন? কি আছে এ দেশে? সবাই সুযোগ পায় না আর তুই সুযোগ পেয়েও ছেড়ে দিচ্ছিস?

অভিমন্যুর নাম ছাড়া আর কোনো উত্তর খুঁজে পেলো না তিন্নি। মিথ্যে কথা না বাড়িয়ে অস্পষ্ট গলায় বললো — আমি ঘরে যাবো বাবা? শরীরটা খুব খারাপ লাগছে।

রঞ্জনবাবু হঠাৎ সচকিত হয়ে উঠলেন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে, তারপর কোন অসীম শূন্যের দিকেই তাকিয়ে বললেন
— হ্যাঁ তুই ঘরে যা! অনেক রাত হলো, কাল সকালে ওঠা আছে আবার।

কোনোরকমে ছাড়া পেয়ে একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে নিজের ঘরে যাওয়ার জন্য তিন্নি পা বাড়াচ্ছিল, পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে পড়লো রঞ্জনবাবুর শেষ কথাটায়
—- তিন্নি, আর একটা কথা। কালকে তোর মা’র থেকে ফোন নাম্বার নিয়ে ছেলেটার সাথে কথা বলবি কিন্তু।

স্থির শান্তগলার মধ্যে লুকিয়ে থাকা অভ্রান্ত আদেশের সুর বুঝতে কষ্ট হলো না তিন্নির! ধীর পায়ে তিন্নি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা ভাস্বতীদেবী বললেন
— তোমার মনে হচ্ছে না আমরা একটু বেশিই তাড়াহুড়ো করে ফেলছি? তিন্নি তো বললো এগুলো সবই ওই অফিসের ছেলেটার শয়তানি….

রঞ্জনবাবু মাথা নাড়লেন। ভাঙাচোরা মুখে ফুটে উঠল বেদনার স্পষ্ট চিন্হ। ধীর গলায় বললেন
— মেয়েকে আমি মানুষ করতে পারলাম না ভাস্বতী। তিন্নি এখন আমাকে মিথ্যে বলতে শিখে গেছে…… এ জীবনে এটাই আমার সবচেয়ে বড়ো হার।

পরাজিত সৈনিকের মতো মাথা নামিয়ে হুইলচেয়ারে বসে রইলেন রঞ্জনবাবু। এতবছরের বিবাহিত জীবনে এই প্রথমবার বোধহয় নিজেকে সঠিক প্রমানিত করতে পেরে আর স্বামীকে তিন্নির ব্যাপারে হার স্বীকার করতে দেখেও একটুও আনন্দ হচ্ছিলো না ভাস্বতীদেবীর। এই জিত যে উনি চান নি কোনদিন। বুকের ভেতর বারবার মুচড়ে উঠছিল অব্যক্ত কান্নায়। চোখে আঁচল চাপা দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন পড়ে থাকা কাজের বাহানায়।

**************************__****************************

তেত্রিশকোটি ভগবানের কাছে একটাই প্রাথনা ছিল তিন্নির, আজ যেন অভিমন্যুর ফোন আসে! নিজেকে এতটা হেল্পলেস আর কখনো লাগে নি ওর। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে কাঁদছিল তিন্নি। সেই কান্নার হিসেবে রাখলে হয়তো হুগলীনদীর ঘোলাটে জল সাদা হয়ে যেত, পাথরও গলে যেত!
অন্যদিকে সাইলেন্ট ফোন বেজে যাচ্ছিল নিজের মতো। বেশ কিছুক্ষনপর ফোনের লাইট দেখে ধড়ফড় করে উঠে বসলো তিন্নি, হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছে গলা স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে ধরাগলায় অভিমন্যুর কল রিসিভ করলো — হ্যালো?

গত পাঁচমাসে ফোন আসার সঙ্গে সঙ্গে তিন্নি যেন ঝাঁপিয়ে পড়তো ফোনের ওপর সেখানে আজ এতো দেরি! অভিমন্যু একটু অবাক হয়েই বলে ফেললো
— যাহ! ঘুমিয়ে পড়েছিলে? বড্ড দেরি করে ফেললাম কি? আজ হাতে সময় নিয়ে ফোন করলাম।

— ন-না! কিছু না…. এমনিই।

সেকেন্ডও লাগলো না বুঝে উঠতে, ওপ্রান্তের উদ্বিগ্ন আওয়াজটা ভেসে এলো
— সীমন্তিনী? কি হয়েছে? তুমি কাঁদছো?

এতোক্ষনের জমিয়ে রাখা কান্নাটা আর ধরে রাখা গেল না, উপচে বেরিয়ে এলো সব জ্বালা- যন্ত্রনা-ক্ষোভ- লাঞ্ছনা -অপমান। বিন্দু বিন্দু চোখের জলে ভিজিয়ে দিলো বালিশ, বিছানার চাদর! বালিশে মুখ গুঁজে অবরুদ্ধ স্বরে তিন্নি ফুঁপিয়ে উঠলো
— কবে আসবে অভিমন্যু? আর তো পারছি না আমি।

পাথরকঠিন বুকের ভেতর কি ছলকে ওঠে রক্ত? হয়তো না! একটু চিন্তা করে অভিমন্যু নরম গলায় বললো
— এখন তো হবে না সোনা, আরো মাস দেড়েক। কেন? কি হয়েছে?

ঝটপট আবার মনের শামুকখোলে নিজেকে গুটিয়ে নিলো তিন্নি, চোখের জল মুছে বললো
— ওহ্…ও.কে …. তুমি চিন্তা করো না, আমি সামলে নেবো।

একবার কান্নাকাটির পর যে কথা অর্থহীন। অভিমন্যু ছাড়লো না, চিন্তিত হয়ে বললো
— অফিসে কিছু হয়েছে?
— নাহ্।
— তবে কি বাড়িতে কিছু হয়েছে?

ছটফটিয়ে উঠলো তিন্নি। এর আগে সায়ক নিয়ে অভিমন্যুর ওয়ার্নিংগুলো আর সেই রাতের দুঃসহ ফোনকলের স্মৃতি এখনো টাটকা, আবার সেই একই পথে কে হাঁটতে যায়? প্রসঙ্গ চাপা দিতে মরিয়া হয়ে বললো
— কিছু হয় নি অভিমন্যু, আমি শুধু…….আই মিস ইউ! কতদিন দেখি নি তোমায়!

—- আই মিস ইউ টু! এবার বলো কাঁদছিলে কেন? মা’র সাথে ঝগড়া হয়েছে?

গোয়েন্দা অফিসাররা এতো সহজে হার মানেন না। খুব ক্যাজুয়ালি নিজের প্রশ্নে অটল থাকলো অভিমন্যু আর আপাতসহজ প্রশ্নদুটি তিন্নির মনে ফিরিয়ে আনলো একটু আগে মা’র হাতের চড়ের আঘাত। পাঁচ আঙুলের দাগ বসে যাওয়া রক্তলাল গরম গালে হাত ছুঁইয়ে মন শক্ত করে নিলো তিন্নি, ছোট্ট উত্তর ওর – নাহ্!

— শুভ কিছু বলেছে? আরে না বললে কি করে বুঝবো কি হয়েছে?

ওপ্রান্তে অভিমন্যু অধৈর্য্য হয়ে উঠেছে ক্রমশ!
আরেকটা বড়ো ঝড় ওঠার অপেক্ষামাত্র আর আজ রাতে সেই ঝড়ের ঝাপ্টা সহ্য করার মতো ক্ষমতা নেই তিন্নির! ভয়ে বুক দুরদুর করছিলো ওর। চোখের সামনে ভাসছিলো একটাই দৃশ্য – একটু পরেই সায়কের নাম শুনে অভিমন্যুর চোয়াল আর মুখের পেশিগুলো কেমন শক্ত হয়ে ফুটে উঠবে! তারপর সাইক্লোন না টর্নেডো, না জানি কি আছড়ে পড়বে তিন্নির ওপর! সকালে কার মুখ দেখে উঠেছিল তিন্নি? নিজের মুখটাই কি?
একটা বড়ো ঢোঁক গিলে, উপায়ান্তর না দেখে তিন্নি কোনোরকমে বললো – সায়ক!….

প্রত্যাশিতভাবেই অভিমন্যুর গলা কঠিন হয়ে উঠলো, দাঁতে দাঁত চেপে বললো
— কি করেছে স্কাউন্ড্রেলটা?

অনেকটা অস্বস্তি আর ভয় নিয়ে ক্ষীণ গলায় আমতা আমতা করে তিন্নি বললো
— সায়ক আমাদের অফিস ছেড়ে দিয়েছে, আজ ওর লাস্ট ডে ছিল.. সন্ধ্যেয় আমি অফিস থেকে বেরোনোর জাস্ট আগে ওর কম্পিউটার কাজ করছিলো না, তারপর আমার লগইন পাসওয়ার্ড চায়……

নিজের কানেই কথাগুলো শুনতে কেমন বোকার মতো লাগছিলো! ওপ্রান্তের নিস্তব্ধতায় সবটা শেষ করার সাহস হলো না তিন্নির, ততক্ষনে চাপা রাগে অলমোস্ট গর্জে উঠেছে অভিমন্যু
— হোয়াই ডোন্ট ইউ এভার লিসেন টু মি? আই টোল্ড ইউ হি মাইট ট্রাই টু হার্ম ইউ… তারপরও তুমি পাসওয়ার্ড শেয়ার করলে?

সেই সন্ধ্যে থেকে কাঁহাতক নিজের বোকামোকে দোষ দেবে তিন্নি? গত তিনচার ঘন্টা ধরে একই কথা শুনতে শুনতে ক্লান্ত ও। কাঁদতে কাঁদতেই অভিমানে ঠোঁট ফুলে উঠলো তিন্নির
— আবার তুমি বকছো আমাকে?

অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, তিন্নির একটা কথায় মেজর অভিমন্যু সেন উদ্গত রাগটা দীর্ঘশ্বাসে পরিণত করে বললেন
— বকি নি, বলো।

বাচ্চার মতো ফুঁপিয়ে উঠলো তিন্নি
— এসব টেকনিকাল ব্যাপার তুমি বুঝবে না!

— ট্রাই মি সীমন্তিনী, আই আমি লুজিং মাই পেশেন্স হিয়ার।

অভিমন্যুর বরফঠান্ডা ধারালো গলায় মনে মনে কেঁপে উঠলো তিন্নি। তারপর গড়গড় করে উগরে দিলো সায়কের লাস্ট স্পিচ, ওর কাছ থেকে সিস্টেম পাসওয়র্ড চাওয়া, তিন্নি অফিসে থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর ওর আই.ডি থেকে কোড উড়িয়ে দেওয়া, ক্লায়েন্ট এস্কালেশন, তিন্নির আবার অফিস ছোটা, ব্যাকআপ ফাইল থেকে কারেকশন পাঠানো – সব! বলতে বলতে হাঁফিয়ে উঠলো তিন্নি, নিজের বোকামো রিয়াল্যায়িজ করে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছিলো ও!

অন্যদিকে অভিমন্যু চুপচাপ সবটা শুনে বললো
— আর কি? এতো সামান্য ব্যাপারে তো তুমি কাঁদছিলে না? আর কি হয়েছে?

কি করে এই মানুষটা না বলতেও বুঝে যায় সবকিছু? একটা ছোট্ট ঢোঁক গিললো তিন্নি, তারপর বললো — সায়ক বাড়িতেও.. মানে শুভকেও কন্টাক্ট করেছিল …!

— স্ট্রেঞ্জ! শুভকে কেন? ওহ্ ….. বুঝলাম!

ফুঁপিয়ে উঠলো তিন্নি
— আমাদের সেই জুনের ট্রিপটায় সিকিমে যা যা হয়েছিল সব জানিয়েছে শুভকে। শিয়ালদা স্টেশনে তোমার সাথে ট্রেনে দেখা হওয়া থেকে শুরু করে তুমি যে আমাকে রেস্কিউ করেছিলে, তোমার সাথে আর্মিক্যাম্পে একরাত ছিলাম সেগুলোকে রং চড়িয়ে টুইস্টেড গল্প বানিয়ে শুভকে জানিয়েছে…. শুভর থেকে মা বাবাও অবভিয়াসলি সবটা শুনেছে।

দমবন্ধ করে আজকের সায়ক এপিসোড শেষ করলো তিন্নি। শুনতে শুনতে নিঃশ্বাস চেপে দাঁতের ফাঁক দিয়ে চাপা গর্জে উঠলো অভিমন্যু
— দ্যাট স্কাউণ্ড্রেল!

ঠোঁটের কোণে কষ্ট মেশানো একটা হাসি মুচড়ে উঠলো তিন্নির! এ তো কিছুই না! ঠিকরে বেরোনো দীর্ঘশ্বাসটা গোপন করে নিয়ে ধীরগলায় তিন্নি বললো

— এখনো সবটা বলা হয় নি অভিমন্যু!

— আরও? আর কি?

ওপ্রান্তের অভিমন্যুর অবাক হওয়া স্বরেও হাসি পেলো না তিন্নির। সময় নিয়ে থেমে থেমে বললো
— গত দুই সপ্তাহ, তোমাকে একটা কথা লুকিয়ে গেছি অভিমন্যু, প্লিজ রাগ করো না। তুমি ব্যস্ত ছিলে… ওখানকার পরিস্থিতি ভালো না, তুমি না বলতেও আমি জানি, তোমার ডিউটি কতটা ইম্পোর্ট্যান্ট! আর আমি বুঝতে পারি নি তোমাকে কি করে জানাবো ব্যপারটা, বুঝতে পারি নি তলায় তলায় সবকিছু এত তাড়াতাড়ি এতদুর এগিয়ে যাবে।

— সীমন্তিনী? কি হয়েছে বলবে?

সেই মাতাল করা কেয়ারিং কণ্ঠস্বর, যে স্বর তিন্নির সকল ছেলেমানুষিকে প্রশ্রয় দেয়, আদর দিয়ে ওকে ভুলিয়ে নেয়! আজ সেই মানুষটার ভালোবাসা আর বিশ্বাসের পরীক্ষা! ধীর গলায় তিন্নি বললো
—- গ্যাংটক থেকে ফেরার পর থেকে আমার বিয়ের জন্য বাড়িতে উঠেপড়ে লেগেছে। মা-বাবা নিজেরাই সবকথা বলে নিয়েছে, কেউ আমার মতামতটুকুও নেয় নি। আজ জানতে পারলাম, ছেলের বাড়ি থেকে কোনো একদিন এসে আমাকে দেখেও গেছে তারা, আমাকে না জানিয়েই! এখন, বাবাও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়েটা করিয়ে দিতে চাইছে – ছেলে দেশের বাইরে থাকে, ওদের বাড়ি থেকে তাড়া আছে এসব যুক্তিতে, কেউ আমার কথা শুনতেও চাইছে না অভিমন্যু। প্লিজ আমাকে ভুল বুঝো না। বিশ্বাস করো, আমি এতসব কিছু জানতাম না।

একনিঃশ্বাসে সবটা বলে অভিমন্যুর প্রতিক্রিয়া শোনার জন্য থামলো তিন্নি, কিন্তু অপরপ্রান্তে কেবলই শ্মশানের স্তব্ধতা। বুকের ভেতর দূরদূর করে উঠলো তিন্নির, অভিমন্যুও কি ভুল বুঝলো ওকে? একটু সময় পর চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এলো আবার, চাপা গলায় ডুকরে উঠলো তিন্নি
— অভিমন্যু! কিছু তো একটা বলো!

অনেকক্ষন নিস্তব্ধতার পর অভিমন্যুর নির্লিপ্ত স্বর ভেসে এলো — হুম..ম।

ঝুপ করে বুকের ভেতরটা দমে গেলো তিন্নির। এতো সংক্ষিপ্ত আর শান্ত প্রতিক্রিয়া আশা করে নি ও। মনের মধ্যে চাগিয়ে উঠলো ভয়জড়িত সেই অমোঘ প্রশ্নটা, যেটা আজকের সারা সন্ধ্যে এবং বিগত দুইসপ্তাহ ধরে তিন্নির মনে ক্রমাগত বেজে চলেছে – তবে কি তিন্নির বিয়ে নিয়ে অভিমন্যুর কিছুই যায় আসে না? সত্যি বলতে ক’দিনেরই বা সম্পর্ক ওদের? নিজেদের এখনো ঠিকভাবে জানলো না তারমধ্যেই কি “বিয়ে” নামক একটা জগদ্দল দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া যায়? সর্বোপরি যে সম্পর্কের শুরু হয়েছিল কোনো এক্সপেকটেশন ছাড়া, সেই সম্পর্কে যে কিছু দাবি করা যায় না!

ডুকরে আসা কান্নার বেগটা সামলে নিয়ে উদাসীন গলায় তিন্নি বলে চললো
— গ্যাংটক থেকে ফিরে এসে বাবার পায়ে ধরে ডিসেম্বর অবধি সময় চেয়ে নিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম ততদিনে তুমি চলে আসবে বা আমি সামলে নেবো সব… সেই সময়টুকুও কেউ দিল না আমায়। আজ, বাবার গা ছুঁয়ে তোমার নাম বলি নি, চোখে চোখ রেখে মিথ্যে বলে গেছি, হয়তো কাল পরশু আরো মিথ্যে বলতে হবে! তাও আমি ম্যানেজ করে নেবো, অভিমন্যু। বিলিভ মি, তোমার ওপর কোনো বার্ডেন চাপাতে আমি চাই না।

অভিমন্যু নিরুত্তর, একটা সাড়াও নেই। কলটা কি কেটে গেছে? চট করে ফোন চেক করে গুমরে ওঠা কান্নার আভাসটুকু মুছে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টায় তিন্নি বললো
— আই নো তুমি আমার চেয়েও অনেক অ-নেক খারাপ সিচুয়েশনে রয়েছো আ্যন্ড আই আ্যম সরি…. আজ এগুলো জানাতে বাধ্য হলাম বলে! চিন্তা করো না… ভেবো না জোর করে তোমার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছি এসব! তেমন হলে কলকাতার বাইরে চাকরি নিয়ে চলে যাবো, বিয়ে থেকে বাঁচতে আরো অনেক অপশন আছে! তোমাকে আমার দায়িত্ব নিতে হবে না! আমি সামলে নেবো ঠিক।

চড়চড় করে আত্মসম্মানে লাগছিলো নূন্যতম জবাবদিহি করতে তাও বলে চলছিল তিন্নি, কে জানে যদি এরপর আর বলার সুযোগ না পায়? শেষের দিকে বার বার গলা কেঁপে উঠলো, না চাইতেও কান্নায় বুজে আসলো স্বর। তারপর বালিশে মুখ গুঁজে নিলো তিন্নি।

নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছিলো তিন্নি – একার জীবন ওর, একার কান্না। কারোর কাছে কোনো এক্সপেকটেশন নেই, চাওয়া পাওয়ার দাবি নেই। সবই তো জানা কথা, জানা ব্যাথা, তাও কেন এতো কষ্ট হচ্ছে? কেন বুকের ভেতরটা ছিঁড়েখুঁড়ে যাচ্ছে অসহ্য ব্যাথায়? একবার ভাবলো ফোন কেটে দেবে, কি দরকার আর কথা বলার! চোখের জল মুছে নিয়ে মন শক্ত করে জীবনে প্রথমবার অভিমন্যুকে “bye” বলতে প্রস্তুত হলো তিন্নি, তখনই ভারী, শান্ত গলায় প্রায় আদেশ করলো অভিমন্যু

— সীমন্তিনী, স্টপ ক্রাইং! উইল ইউ?
.
.
.
.
সেই গলা, যা শুনে তিন্নি মরেছে প্রথম দিন থেকে! যা তিন্নির শিরায় শিরায় মাতুনি ছড়িয়ে দেয় আজও, এত কান্নার মধ্যেও! ইচ্ছে করছিলো এখনই ছুটে যায় সিকিমের সেই শুকনো পাহাড়ি উপত্যকার সেই জংলা সবুজ মিলিটারি তাঁবুতে, জড়িয়ে ধরে মুখ লুকিয়ে নেয় তার পাথরকঠিন বুকে! মুখে চাদর গুঁজে ফোঁপানো বন্ধ করলো তিন্নি। বুজে আসা গলায় কোনোমতে সার ফিরলো
— ও.কে।
— এতকিছু হয়ে গেছে আমাকে আগে জানাও নি কেন?

অজানা অভিমানে ফুঁপিয়ে উঠলো তিন্নি
— আই আ্যম সরি অভিমন্যু। দুইদিনে একবার, মাত্র পাঁচমিনিটের ফোনকলে কি করে এতো কথা তোমায় বলতাম? নিজের ফ্যামিলি নিয়ে এসব কথা কি বলা যায়!

ভারী একটা নিশ্বাস ফেলে অনেকক্ষন চুপ করে রইলো অভিমন্যু, হয়তো মুচড়ে উঠলো হৃৎপিন্ডটা! তারপর কোমল স্বরে বললো
— তুমি জানো না আই উড নেভার জাজ ইউ?

দুইপ্রান্তে অপার নিস্তব্ধতা। আর একটি বড়ো একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে অভিমন্যু বললো
— এনিওয়ে হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট? তুমি কি চাও?

ছলনা করে লাভ নেই, চোখ বুজে মনের একান্ত চাওয়া, সত্যি কথাটাই স্বীকার করে নিলো তিন্নি।
— বিলিভ মি অভিমন্যু, কোনো ইনজ্যুরি ছাড়া তুমি আমার কাছে ফিরে এসো এটুকু ছাড়া আর কিচ্ছু চাই না আমি।

তবে তিন্নি হয়তো অভিমন্যুর প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারে নি। বোধহয় সেইজন্যই পরের প্রশ্নে ফিরে গিয়ে হালকা একটু হাসির আভাষ ফুটে উঠলো অভিমন্যুর গলায়
— হুমম, সে তো হলো। বিয়ে করতে চাও না?

— না।

— কেন? শুনে তো ভালোই লাগলো! তোমার বাড়ির পছন্দের ছেলে, দেশের বাইরে থাকে .. আই গেস হি হ্যাজ এ গুড সিভিলিয়ান লাইফ।

রাগ আর অসহয়তায় আরো দুটি নোনতাজল গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে, চড়ের আঘাতের জায়গাটা জ্বলে উঠলো আবার। বুজে আসা গলায় তিন্নি বললো
— বিদ্রুপ করছো অভিমন্যু?

— ইওয়োর উড বি…… হোয়াট ডাজ হি ডু?

তিন্নির মাথা তখন ব্ল্যাঙ্ক, অপ্রত্যাশিত প্রশ্নটায় খেই হারিয়ে ফেলে পাল্টা প্রশ্ন করলো
— মানে? দ্যাটস ইরিলিভেন্ট! হোয়াই ডাজ ইট ম্যাটার টু ইউ?

—- বাহ্! নিজের কম্পিটিশনটা দেখে নিতে হবে না? কি করে তোমার হবু বর?

হয়তো আর একটু স্পষ্ট করলো অভিমন্যু, কিন্তু তিন্নির মাথা আজ হিন্ট নেওয়া বন্ধ করে নিয়েছে। উল্টে বিরক্ত হয়ে চিড়বিড়িয়ে উঠলো
— স্টপ জোকিং অভিমন্যু, নো ওয়ান ইজ মাই “হবু বর”। যার কথা জিজ্ঞেস করছো সে ডাক্তার, জার্মানিতে সেটলড্! তাতে কি হয়েছে?

চাপা হাসির শব্দটা নিঃশ্বাসে লুকিয়ে নিলো অভিমন্যু, তারপর শান্ত গলায় বললো
— হুমম! তা আল্টিমেটল্যি ম্যাডামের কি ইচ্ছে? এন.আর.আই ডাক্তার হ্যাজব্যন্ড চাই? না আমার মতো একজন সাধারন রুখাসুখা আনরোম্যান্টিক ফৌজি?
.
.
.

চমকে উঠে খাড়া হয়ে বসলো তিন্নি, বুকের খাঁচায় আটকে থাকা হৃৎপিন্ডটা ছলাৎ করে লাফিয়ে উঠেই থেমে গিয়েছে কখন, কানে তালা ধরে গেছে যেন। আদৌ কি ঠিক শুনলো তিন্নি নাকি গোটাটাই ওর ইমাজিনেশন, কল্পনা মাত্র?
তিন সেকেন্ডস নীরব হয়ে থাকলো তিন্নি, ঠিক শুনুক বা ভুল! তারপর একটা ঢোঁক গিলে শুকনো গলায় বললো
— তুমি কি মজা করছো আমার সাথে?

মেজর অভিমন্যু সেনের অচঞ্চল, স্থিরদৃঢ় কণ্ঠস্বর ভেসে এলো
— নাহ্! শুধু তোমার উত্তরটা শুনতে চাইছি!

চোখ বন্ধ করে নিলো তিন্নি, লাবডুব করে বেজে চলা হৃৎপিন্ডের সাথে তাল মিলিয়ে কয়েকফোঁটা গরম জল টপটপ করে আবারো গড়িয়ে পড়লো ওর চোখের কৃষ্ণসাগর থেকে। তিনটি বড়ো বড়ো শ্বাস নিয়ে অনেকটা বাতাস বুকের ভেতর অবধি টেনে নিলো তিন্নি। তারপর ধরা গলায় তিনটি প্রশ্ন ফিরিয়ে দিলো
— কি মনে হয় তোমার? কার জন্য দিন গুনছি আমি? কার ফিরে আসার জন্য ডিসেম্বরের অপেক্ষা করে আছি?

দীর্ঘশ্বাসটা গোপন করে নিল অভিমন্যু। শান্ত অবিচল স্বরে চিরাচরিত গাম্ভীর্য্যতায় বললো — আর ইউ শিওর? আর একবার সুযোগ পাচ্ছো ভালোভাবে সুখী জীবন বাঁচার। এনআরআই বর, বিদেশের জীবন, যেখানে তুমি নিরুদ্বেগ জীবন কাটাবে! আমার মতো অনিশ্চিত কঠিন লাইফ নয়…..

অভিমন্যু আরো কিছু বলার আগেই থামিয়ে দিলো তিন্নি, স্থিরদৃঢ় স্বরে বললো
— আগেও বলেছিলাম, আবারো বলছি অভিমন্যু..নিরুদ্বেগ জীবন আমি চাই না, অন্য কাউকে আমার চাই না! আমি শুধু তোমাকে চাই। ইউ ইনটেন্ডেড টু বি দ্য লাস্ট পারসন আই লাভ… ভুলে গেলে?

দূরত্ব মেরেকেটে দুইহাজার মাইল, দুইটি ভিন্ন রাজ্য -ভিন্ন পরিবেশ, জুড়ে আছে মোবাইল নেটওয়ার্কের নন-আয়নাইডজিং ওয়েভে, নিঝুম ঘরে ঘড়ির সময় বয়ে চলেছে টিকটক্ টিকটক্।
অনন্তর সময় পর মেজর অভিমন্যু সেন একটি সিদ্ধান্ত নিলেন, হঠকারী সিদ্ধান্তই বলা যায়। ভারী গলায় বললেন
— অলরাইট দেন। আমি তোমার বাবার সাথে কথা বলতে চাই, এখনই।
অবাক হয়ে ফোন ধরে রইলো তিন্নি!
— এখন??? কেন?

— টু টেল ইওয়োর ফ্যামিলি দ্যাট আই আ্যম গোয়িং টু ম্যারি ইউ!

—- হো-আ-য়া-ট?????

সব ভুলে ফোনের মধ্যে তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো তিন্নি, তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে ফিসফিস করে আবারো একই প্রশ্ন করলো
— হোয়াট???

— ইউ হার্ড দ্যাট রাইট।

কয়েক মিলিসেকেন্ডে কয়েকহাজার প্রশ্ন ভিড় করে এলো মাথায়, অবাধ্য জিভ মস্তিষ্কের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করায় না চাইতেও সবচেয়ে অনভিপ্রেত অথচ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি অস্ফুটে বেরিয়ে এলো তিন্নির মুখ দিয়ে।
— কেন? চ্যারিটি করছো?

গলায় শব্দ করে হাসলো অভিমন্যু তারপর বললো — আর তো উপায় দেখছি না ম্যাডাম!

কি বলবে কিছু ভেবে পেলো না তিন্নি। একদিকে মনব্যাঙাচি তিড়িং করে লাফ দিয়েছে বুকের পদ্মপুকুরে অন্যদিকে কি যেন একটা অদ্ভুত আবেগে গলা বুজে আসছে ওর।
সার ফিরলো অভিমন্যুর স্বরে, হালকা হাসি মাখানো গলায় বললো

— রিয়েল্যী সীমন্তিনী? দিনদিন যা কম্পিটিশন বাড়িয়ে দিচ্ছো এবার তো আর পাল্লা দিতে পারবো না!

গড়িয়ে আসা চোখের জল মুছে নিলো তিন্নি, এখনো কেন কাঁদছে ও? তার জবাব হয় না! ধরা গলায় বললো
— কাল সকালে বাড়িতে কথা বলো অভি, এখন সাড়ে বারোটা বাজতে যায় প্রায়।

–কাল!?
হঠাৎ গলার স্বর পাল্টে গেল অভিমন্যুর। কি করে বলবে ও কথাটা?
কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললো
– সীমন্তিনী, কাল হবে না।
— কেন?
অভিমন্যু নিরুত্তর দেখে আচমকা বুক কেঁপে উঠলো তিন্নির, আবার প্রশ্ন করলো
— কাল কেন হবে না অভিমন্যু?
— আই ক্যান নট টেল ইউ দ্যাট।

ওহ!
থমকে গেলো তিন্নি, তারপর নিজেই নিজেকে সান্তনা দিয়ে মন বাঁধলো। হয়তো রুটিন ডিউটি, গত দুই সপ্তাহে এমন তো হচ্ছেই। মনে চেপে বসা কালো শঙ্কাটা জোর করে উড়িয়ে দিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টায় বললো
— তবে পরশু বলো, কোনো ব্যাপার নয়।

কিন্তু অভিমন্যু এবারও নিরুত্তর দেখে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো তিন্নির। তবে কি যা ভাবছে সেটাই হতে চলেছে? আবারও? মন শক্ত রেখে বললো
— অভিমন্যু, আই আ্যম আস্কিং ইউ সামথিং!

কোনো উত্তর নেই। যা বোঝার বুঝে নিলো তিন্নি, শেষ জোরটুকু দিয়ে জিজ্ঞেস করলো
— কবে ফিরবে?
— আই ক্যান নট টেল ইউ দ্যাট।
অবিচল বরফঠান্ডা স্বর অভিমন্যুর।
.
.
.
এ’কদিনের অভিজ্ঞতা তিন্নিকে অনেককিছু শিখিয়ে দিয়েছে, শিখিয়ে দিয়েছে রূঢ় বাস্তববাদী হতে, চরম ধৈর্যশীলা হতে, প্রত্যাশা না রাখতে, পদে পদে স্যাক্রিফাইস করতে! তাও প্রতিবারই মনে হয় যেন এই প্রথমবার এমন হলো। প্রতিবার সেই একই ভয়, একই কান্না, একই প্রার্থনা – যে প্রার্থনা আদতে নিষ্ফল।
আর তো পারা যায় না! ঘরে বাইরে আর কত চাপ সহ্য করবে তিন্নি? কাউকে ভালোবাসা কেন এতো কঠিন? অবুঝ কান্নায় ফুঁপিয়ে উঠলো আবারও, অভিমন্যুর গম্ভীর গলাটি একটু নরম হয়ে বললো
— ডোন্ট ক্রাই, প্লিজ?

নিজেকে সামলে নিতে নিতে তিন্নি জিজ্ঞেস করলো
— কতদিনের জন্য??

বড়ো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো অভিমন্যু ,তারপর বললো
— জানি না। দুইদিন হতে পারে, দুইসপ্তাহ হতে পারে।

মেরুদন্ড বরাবর বয়ে গেলো গা ছমছমে এক অজানা আশংকা, কেঁপে উঠলো তিন্নি। এভাবে তো অভিমন্যু বলে না কখনো! আগের বারের বুলেটের আঘাত এখনো মিলিয়ে যায় নি, আবারো সেই একই সংগ্রাম, সেই অসহ্য মানসিক টানাপোরেন? ফৌজির সাথে জীবন কাটানোর স্বপ্ন দেখা সহজ নয়, তা তিন্নি জানতো! কিন্তু “জানা” আর সেই জানায় বেঁচে থাকার মধ্যে পার্থক্য আছে। প্রতিদিনের সুখস্বপ্নে লুকিয়ে আছে মৃত্যুর আশঙ্কা। ভালোবাসার মানুষটি যার জন্য গায়ে কলঙ্ক মেখে নিয়েছে তিন্নি, যার জন্য নিজের পরিবার থেকে দূর হয়ে গেছে, সমাজ সংসার, সবকিছু তুচ্ছ যে মানুষটির কাছে – সেই মানুষটি আজ মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। আজকের দিনটি পেরিয়ে গেলে আবার কালকের অপেক্ষা, তারপর আবার পরশু। ডুকরে ওঠা কান্নার বেগটা সামলাতে বালিশে মুখ গুঁজলো তিন্নি, ওকে যে শক্ত হতে হবে, অভিমন্যুকে যে জানতে দেওয়া চলবে না ও কাঁদছে।
নরম গলা ভেসে এলো অভিমন্যুর।
— আবার কাঁদছো সীমন্তিনী?

গলা স্বাভাবিক রাখার বৃথা চেষ্টা করলো তিন্নি
— কই? কাঁদি নি তো?

— খুব অসুবিধা হলে বাড়িতে বলে দিও আমার কথা।

অনেক সাহস জুটিয়ে মনটা কঠিন পাথরে বেঁধে ফেললো তিন্নি, তারপর দৃঢ় গলায় বললো
— আমি সামলে নেবো অভিমন্যু, আমি ঠিক পারবো হ্যান্ডেল করতে। তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। তুমি শুধু সময়মতো ফিরে এসো আমার কাছে, আই আ্যম ওয়েটিং ফর ইউ।

— আমি ফিরে আসবো সোনা, তোমার জন্য আর পিহুর জন্য আমায় যে ফিরে আসতেই হবে।

কি ছিল সেই স্বরে? নিশ্চল প্রতিজ্ঞা? অবর্ণিত ভালোবাসা? স্থির আশ্বাস?

আর একটি নিদ্রাহীন রাত কেটে গেলো, পৃথিবীর দুইপ্রান্তে দুইটি ভালোবাসার মানুষের একে অপরের চিন্তায়, পাশে না থাকার অসহায়তায়। জীবন সত্যিই যে এতো নির্মম, নির্দয় হতে পারে, তিন্নির ধারণা ছিল না। ধরে রাখলে হয়তো হুগলির ঘোলাটে মিষ্টি জল সাদা লবনাক্ত হয়ে যেত তিন্নির চোখের জলে, তাও সেই চোখের জল বন্ধ হয় না, ফালা ফালা হয়ে যায় হৃদয়, শুধু প্রার্থনায় নড়ে যায় ঠোঁট।

“What” is a lifetime adventure for us, is a daily routine for our Braveheart soldiers. Our Flag does not Fly high because the wind moves it. It flies with the last breath of every fallen soldier fighting for it.
Jai Hind.

 

ক্রমশঃ
© সুমন্দ্রা মিত্র। ভালো লাগলে নামসহ শেয়ার করবেন

 

***********************__******************************

সকল পর্বের লিঙ্ক~
Video Teaser
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145475543838322/?vh=e&d=n
Part 1
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145129087206301/?d=n
Part 2
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145859077133302/?d=n
Part 3
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/146221053763771/?d=n
Part 4
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/146595433726333/?d=n
Part 5
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/147293876989822/?d=n
Part 6
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148075966911613/?d=n
Part 7
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148530310199512/?d=n
Part 8
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148951006824109/?d=n
Part 9
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/149405760111967/?d=n
Part 10
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/150313546687855/?d=n
Part 11
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/151106323275244/?d=n
Part 12
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/151923336526876/?d=n
Part 13
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/152353663150510/?d=n
Part 14
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/154065792979297/?d=n
Part 15
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/156163186102891/?d=n
Part 16
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/157132182672658/?extid=QdVQFGSjLzQUsE31&d=n
Part 17
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/157444422641434/?extid=fI3jIc0PCiYXDa0N&d=n
Part 18
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/158095955909614/?extid=1E2JOZfMCmqscBoi&d=n
Part 19
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/158831902502686/?extid=R8zo6L2l274CIQ7r&d=n
Part 20
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/159626782423198/?extid=0e8jrLLhsuLqgsQX&d=n
Part 21
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/160047349047808/?extid=e9DIdFXAkqxTg77U&d=n
Part 22
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/160963752289501/?extid=EgYDh0z3hVr5TCBY&d=n
Part 23
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/161833698869173/?extid=gRK0HHMoLW0bu0gK&d=n
Part 24
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/162740122111864/?extid=KIR9o3zetBHgH9mt&d=n
Part 25
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/163061178746425/?extid=fhzBxEjnlA7n6Ulu&d=n
Part 26
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/163695728682970/?extid=tm0Y81ykORQhpsq9&d=n
Part 27
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/164305438621999/?extid=WsYE2BjXkYvPmqyF&d=n
Part 28
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/164941361891740/?extid=Ck5D6rJFfhyP5vvH&d=n
Part 29
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/165252361860640/?extid=Nq4U03rtVoPWvXTe&d=n
Part 30
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/166475585071651/?extid=vZLf99OzhuVT4DA6&d=n
Part 31
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/167096588342884/?extid=bxlA1UFJH0sAGqge&d=n

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here