দেয়াল ঘড়িতে ২টা বাজে,ঘড়ির সামান্য আওয়াজটুকু ভারী হয়ে জানান দিচ্ছে রাতের নিস্তব্দতা, বিয়ে বাড়ির সবাই এখন ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে হয়তো,শুধু ঘুম নেই আমার চোখে।আমি চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করছি, পার্থক্য একটাই চাতক অপেক্ষা করে বৃষ্টির জলের আর আমি অপেক্ষা করছি আমার স্বামীর।মেয়েদেরই সবসময় অপেক্ষা করতে হয় কেনো?এর উত্তর বোধহয় আমার মতো নব্যবিবাহিত কারো কাছে নেই।জীবনে কারো জন্য এতো অপেক্ষা করিনি।উল্টো আমার জন্য স্কুল-কলেজের বাইরে হাজারো ছেলে অপেক্ষা করতো।আমার বাবার ভয়ে কারো সাহস হয়নি কিছু বলার।আমাকেও তারা কম ভয় পেতো না।
কতক্ষণ পরপর ক্লান্ত হয়ে আমার মনটা বলছে সৃজা তুই ঘুমা।আর আমি জোর করে চোখগুলো খুলে রাখার চেষ্টা করছি।কারণ যার সাথে বিয়ে হয়েছে তাকে আমার অনেক কিছু বলার আছে।যদিও নামটা ছাড়া তার সম্পর্কে আমি কিছুই জানিনা। উফ্ বিয়ের শাড়ী,গয়না আর পরে থাকা সম্ভব না।এগুলো পরার জন্য নাকী মেয়েরা বেশি করে বিয়ে করে,কী অদ্ভূত!
আমার আঠারো বছরের এই জীবনটায় শুধু পড়াশোনা আর ব্যক্তি স্বাধীনতা নিয়ে ভেবেছি,কখনো কোনো ছেলের জন্য মনে মায়া জমতে দেইনি।পড়াশোনায় ভালো করে কিছু একটা করতে হবে,নিজের পায়ে দাড়াতে হবে,মাকে ওই যন্ত্রনা থেকে মুক্ত করতে হবে কত ভাবনা।অথচ আজ কত ভাবনার ইতি ঘটলো।হায়রে জীবন!!
ক্লাস টেনে থাকতে সালমা ম্যাম একবার বলেছিলো আল্লাহ নাকি সবার জোড়া সৃষ্টি করে রেখেছে।ঠিক সময়ে তার সাথেই মিল হবে।কলেজে পরীক্ষা দেয়ার পরপরই হঠাৎ করে বাবা আমার বিয়ে দেয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলো।প্রথমে কোনো সন্দেহ না হলেও।যেদিন এ বাড়ির মানুষজন আমাকে দেখতে গেলো, সেদিনই তাদের আভিজাত্য দেখে বুঝে গেছিলাম বিয়ে দেয়ার কারণ।ওনারা প্রচুর ধনী।আমাদের গ্রামের সবচেয়ে বনেদী পরিবার হলেও তাদের কাছে আমার বাবা কিছুই না।প্রথমদিন দেখতে গিয়েই স্বর্ণের মোটা মোটা দুটো বালা পরিয়ে দিয়েছিলো।আমার কাছে এগুলো শিকল ছাড়া কিছুই মনে হয়নি।সেদিন বাবাকে কিছু বলতে পারিনি কিন্তু সব রাগ প্রতিদিনকার মতো ঘরের জিনিসপত্র ভেঙে মিটিয়েছিলাম।ভেবেছিলাম বিয়ে কিছুদিন পরে হবে।কিন্তু না হুট করে বরপক্ষ গেলো আর কাজী,উকিল ডেকে বিয়ে পরিয়ে নিয়ে আসা হলো।এ বাড়িতে এসে যদিও মনে হয়েছে আগে থেকেই সময় ঠিক করা ছিল, সবাই জানলেও শুধু আমি জানতাম না।হয়তো বাবার ধারণা ছিলো আমি খারাপ কিছু করে ফেলবো।আমাকে যখন সাজাচ্ছিলো তখন শক্ত হয়ে বসেছিলাম।আমার সব নিয়ম উলোট-পালোট হয়ে গেলো।আর হয়তো নদীর পাড়ে যেয়ে উদাসীন হয়ে বসে থাকতে পারবোনা,হয়তো কলেজের লাইব্রেরীতে যেয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা পার করতে পারবোনা।মায়ের গায়ে হাত তুললে থামাতে পারবোনা।আমার প্রতিদিনের রুটিনের একটা অন্যতম বিষয় ছিল প্রতিদিন একটা বই শেষ করা।আজও অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসের দ্য রেপ অব বাংলাদেশ বইটা পড়ার কথা ছিল,আচ্ছা বইটা কী রিমু লাগেজে দিয়ে দিয়েছে তাহলে এতক্ষণ বসে না থেকে বইটা পড়তে পারতাম।
ফুলের বিছানা থেকে নেমে যখনই আমি লাগেজটায় হাত দিলাম তখনই টি-শার্ট আর ট্রাউজার পরা এক ভদ্রলোকের আগমন ঘটলো।অবয়বটা পরিষ্কার হতেই বুঝতে পারলাম তিনি সাফওয়ান চৌধুরী যার সাথে আমার আজ বিয়ে হয়েছে।আমার সামনে এসেই বললেন “জামা-কাপড় পাল্টে দ্রুত বের হবে আমার তাড়া আছে।”
আমি কোনো সংকোচ না রেখে বললাম ” যা বলার এখন বলুন।”
কথাটা শোনামাত্র তিনি আমার কোমর আকড়ে হিসহিসিয়ে বললেন “যেটা বলছি সেটা করো,বেশি কথা বলা আমি পছন্দ করি না।”
আমার মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো এভাবে আমার শরীরে হাত দেয়ায়।জোর করে তার হাত দুটো ছাড়িয়ে আমি শুধু বললাম “একদম কাপুরুষের মতো আচরণ করবেন না।একটা মেয়েকে বিয়ে করে সারারাত তাকে একা একটা অচেনা জায়গায় বসিয়ে রেখেছেন,না সে এ বাড়ির কাউকে চেনে না যার সাথে তার বিয়ে হয়েছে সে তার পাশে আছে।”
আমার কথাগুলো শেষ হতেই তার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম তিনি আমার কথায় মোটেও খুশি হয়নি বরং ভয়ংকরভাবে রেগে গেছেন।এতে আমার কিছুই আসে যায় না কারণ আমি বরাবরই একরোখা,আমাকে নিয়ে কে কী ভাবলো তাতে আমি কিছুই মনে করিনা।আমার ভাবনার মাঝেই দরজাটায় জোরে একটা শব্দ হলো কারণ উনি রেগে বেরিয়ে গেছেন।উনি চলে যাওয়ায় আমি এক প্রকার শান্তি পেলাম।কোনোমতো শাড়ীটা পাল্টে একটা গভীর ঘুম দিলাম।
সকাল ৭টায় ঘুম ভাঙলো আমার।যদিও দেরীতে ঘুমিয়েছি কিন্তু ঘুম ৭টার মধ্যেই ভাঙবে এটা আমার নিত্যদিনের অভ্যেস।ঘুম থেকে উঠে এক কাপ কফি নাহলে আমার চলে না।কফির কথা চিন্তা করে মনে পড়ে গেলো এ বাসার কিছুইতো আমি চিনি না।রুম থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই আমার শাশুড়ীর সাথে দেখা হলো।
আমাকে দেখে মুখটা গম্ভীর করে কাছে আসলেন আর বললেন “সাফীর সাথে কী নিয়ে কথা কাটাকাটী হয়েছে তোমার??শোনো মেয়ে ছেলেকে ঘরে ফেরানোর জন্য বিয়ে দিয়েছি।বিয়ের পরেও যদি ছেলের বাহিরে রাত কাটাতে হয় তাহলে বিয়ে দিয়ে লাভ কী হলো।একটা কথা মনে রাখবে সাফীর সাথে তোমার সম্পর্ক ভালো মানে তুমি এখানে রাজরাণী আর যদি এমন চলতে থাকে তাহলে বাপের বাড়ি চলে যাবে।”বলেই গটগট করে হেটে চলে গেলেন।
কী মহিলারে বাবা!! বিয়ের পরদিনই বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়ার কথা বলে।এ-তো কিছুই না, আমার এক বান্ধুবির বিয়ে হওয়ার পর স্বামীর সাথে শারীরিক মিলনে রাজী হচ্ছিলো না বলে, দুই সপ্তাহর মধ্যেই স্বামী অধৈর্য হয়ে ডিবোর্সের কথা বললো।যদিও এখন তাদের মধ্যে সবকিছু ঠিকঠাক চলছে।বাসায় একটা ফোন দিতে হবে,নিশ্চয় মা আমাকে নিয়ে অনেক চিন্তায় রয়েছে।বিয়ের আগে আমাকে অনেক কিছু বোঝানোর চেষ্টা করেছে।বিয়েটায় একপ্রকার ব্ল্যাকমেইল করা হয়েছে আমায়।শুধু মা ছাড়া আমি কারো কথা শুনিনা তাই আসার সময় শুধু মায়ের জন্য কষ্ট হয়েছে।বাবার জন্য কষ্ট লাগা অনেক আগেই কমে গেছে কারণ তিনি উদ্দেশ্য ছাড়া কোনো কাজ করেন না,আমার বিয়েটাও তিনি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দিয়েছেন।একদলা খারাপ লাগা নিয়ে রুমে এসে মাকে ফোন দিলাম।মায়ের আওয়াজ শুনে আর কান্না আটকে রাখতে পারলাম না।একমাত্র মায়ের কাছেই কান্না করি আমি।মায়ের থেকে দূরে থাকা হয়ে ওঠেনি কখনো।এই প্রথম এতো দূরে।একটা অজপাড়াগাঁ থেকে একেবারে শহরে চলে এসেছি।এ যেনো পুকুরের মাছ সমুদ্রে পরা।
“কী হয়েছে মা??মাগো কাদিস না।যা হয়েছে তা মেনে নিতে শিখ মা।তাহলেই সুখী হতে পারবি। আমার জীবনটা যেভাবে নষ্ট হলো তোরটাও সেভাবে নষ্ট হোক আমি চাইনা।আমার পাপের শাস্তি তোকে যেনো না দেয় সৃষ্টিকর্তা।”
“তুমি কোনো পাপ করোনি মা,পরিবারের মায়া ছেড়ে যার হাত আকড়ে ধরেছিলে সে পাপী।যে তার মেয়েদেরকে নিজের উদ্দেশ্য হাসিলে ব্যবহার করে সে পাপী।আর ওই পাপীর একদিন শাস্তী হবে।”
“এভাবে বলিস না মা, লোকটা তোর বাবা।বাবা-মায়ের জন্য দোয়া করতে হয় মা অভিশাপ না।”
“তোমার সাথে আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না মা,রাখি।এরপরে আর ওই লোকটার হয়ে কথা বলবেনা।আর নিজের যত্ন নিও।এখনতো আর ওই লোকটা তোমায় মারবেনা।”
ফোন কেটে দেয়ার শব্দ হলো।নিশ্চয় মা এখন নিরবে চোখের জল ফেলবে।এমন সময় দরজায় নক করলো কেউ।চেয়ে দেখলাম একটা বাচ্চা মেয়ের হাত ধরে অফিসিয়াল গেটআপে একজন অতি সুন্দরী মহিলা রুমে প্রবেশ করলো।আমায় দেখে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো-
“আমি সানিয়া চৌধুরী।Your Sister-in-law।অফিসের চাপে বিয়েতে থাকতে পারিনি।সাফীর মতো তুমিও আমাকে বুবু বলে ডাকতে পারো।”
আমি তাকে সালাম দিলাম।সালামের উত্তর দিয়ে তিনি একবার ঘড়ি দেখলেন।তারপর বললেন ” অফিসের টাইম চলে যাচ্ছে,You know আমি লেট করা একদম পছন্দ করিনা।তোমার সাথে পরে কথা হবে।”
তারপর বাচ্চাটার সামনে হাটুগেড়ে আমার দিকে ইশারা করে বললো” মাম্মা উনি তোমার আন্টি।তোমার সাফী মামার ওয়াইফ।তাই ওঁর সাথে ভালো ব্যবহার করবে।ওকে??”
বাচ্চাটা হ্যা বোধক মাথা দোলালো।তারপর বাচ্চাটার কপোলে অধর ছুইয়ে, হিল পরা পায়ে দ্রুত চলে গেলেন।আর বাচ্চাটি দৌড়ে আমার কাছে এলো।একদম পুতুলের মতো মেয়েটি।ঠিক ওর মায়ের মতো দেখতে।
আমাকে দেখে বললো তুমি তো মাম্মার থেকেও বিউটিফুল।তারপর তার গল্পের ঝুরি খুলে বসলো।ওর বিড়ালটা কতদিন হলো হারিয়ে গেছে,সাফী মামা আইস্ক্রীম এনে দেয়,চকলেট এনে দেয়,মাম্মা দেয় না।ফুলি তাকে দুধ খেতে বলে, দুধ খেতে মোটেও তার ভালো লাগেনা।স্কুলে যেতে ভালো লাগে কারণ সেখানে অনেক বন্ধু আছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম তোমার নাম কী??
আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আফসোসের সুরে বললো উফ নামটাই তো বলা হলো না।My name is Tulip.What is your name??
“বাহ!সুন্দর নাম তো। আমার নাম সৃজা।”
এমন সময় দরজা খোলে কেউ রুমে প্রবেশ করলো।টিউলিপ দৌড়ে গিয়ে তার কোলে উঠে বললো মামা Where is my new doll.সাফিয়ান আমার দিকে একবার তাকিয়ে টিউলিপকে বললো ডল তোমার রুমে রেখে এসেছি।
“ওকে তাহলে আমি দেখে আসি।” বলেই কোল থেকে নেমে দৌড় দিলো।সাফওয়ান….
চলবে……
গল্পের নামঃ #সৃজা
লেখিকাঃআরুনীয়া চৌধুরী